আমার বোনু পর্ব-০৭

0
321

#আমার_বোনু
#Part_07
#Writer_NOVA

অথৈ আজকাল ঊষাকে সহ্য করতে পারে না। সবসময় মনে হয় তার থেকে তার স্বামী দূরে থাকার একমাত্র কারণ এই ঊষা। আদিল কিন্তু অথৈকে যথেষ্ট সময় দেয়। তবুও ওর মনে হয় ঊষা না থাকলে এর থেকে বেশি সময় দিতো। কেনো জানি ভীষণ হিংসে হয়। যদিও এমনটা প্রেগন্যান্সির সময় হয়ে থাকে। তবে এটা নিয়ে একটু চিন্তিত জিনিয়া। কারণ জিনিয়াও সেইম কাজটা নিজের প্রেগ্ন্যাসির সময় করেছে। এর কারণে অর্ণব ওকে পরবর্তীতে খুব সুন্দর করে একটা শিক্ষাও দিয়েছিলো। যাতে সে তার ভুল বুঝতে পেরেছিলো। তবে অথৈ এর জন্য সে আশংকায় আছে। ঊষাকে নিজের কিংবা আদিলের আশেপাশে দেখলে অথৈ হিংস্র হয়ে যায়। এই তো গতকাল বিকালের ঘটনা…….।

অথৈকে কোন কাজ করতে দেয় না জিনিয়া। তবুও জোর করে একটু কাজ করতে এসেছে। জিনিয়া মানা করেছে কিন্তু শুনেনি। তাই জিনিয়া বারবার সাবধান করছিলো।

— দেখো অথৈ তোমার কোন কাজ করার দরকার নেই। আমি বারবার মানা করছি। কোন বিপদ হলে পাঁচ ভাই আমাকে বাঘের মতো ধরবে। তখন কি জবাব দিবো বলো তো?

অথৈ মুচকি হেসে জবাব দিলো,
— কিচ্ছু হবে না। কেউ তোমাকে কিছুই বলবে না। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকতে কত ভালো লাগে বলো তো ভাবী? আমি বিরক্ত হয়ে গেছি।

— বিরক্ত হলেও বাপু তোমাকে এভাবেই থাকতে হবে। তোমাকে নিয়ে আমি কোন রিস্ক নিতে চাইনা। তোমার কোন অঘটন ঘটলে আমার আর এই বাড়ি থাকা হবে না। সংসার হারাতে হবে আমায়।

অথৈ কোন জবাব দিলো না। ছুড়ি দিয়ে বরবটি কাটতে লাগলো। কিছু সময় পর ঊষা অনলকে কোলে নিয়ে কিচেনের দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে হাসিমুখল জিজ্ঞেস করলো,

— কি করো তোমারা?

জিনিয়া একগাল হেসে উত্তর দিলো,
— রান্না করি।

ঊষার কন্ঠ শুনে অথৈর রাগ উঠে গেলো।কাঠ কাঠ গলায় বললো,

— কিচেনে কেউ নিশ্চয়ই নাচতে আসে না ঊষা। এটা তোমার বোঝার কথা।

ঊষা ইতস্ততায় পরে গেলো। অথৈর থেকে এরকম উত্তর আশা করেনি। বিব্রত ভঙ্গিতে বললো,

— আসলে আমি সেভাবে বলতে চাইনি মেজো ভাবী, তুমি যেভাবে বুঝেছো।

অথৈ আবারো বিরক্ত গলায় বললো,
— আমি ঠিকই বুঝেছি ঊষা।

অনল কোল থেকে নেমে চোখ দুটো বড় মানুষদের মতো করে কুচকে অথৈর হাত ধরে বললো,
— তুমি আমার রাণীর সাথে এভাবে কথা বলছো কেনো চাচিআম্মু?

অথৈ একবার স্থির দৃষ্টিতে অনলের দিকে তাকালো। অনল গাল ফুলিয়ে রেখেছে। তার রাণীর মন খারাপ দেখলে তারও খারাপ লাগে। ঊষা আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,

— মেজো ভাবী তুমি কি কোন কারণে আমার ওপর অনেক বিরক্ত? আমি কি কোন অপরাধ করেছি?বলো না, তুমি আমার ওপর এতো বিরক্ত কেন?

অথৈ মিনমিনে গলায় চরম বিরক্তি নিয়ে বললো,
— যত্তসব আদিখ্যেতা! আমার আর সহ্য হয় না।

কথাটা বলে অথৈ হনহনিয়ে ঊষাকে সাইড কাটিয়ে কিচেন থেকে চলে গেলো। ঊষা অবাক চোখে একবার অথৈর দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ অথৈর কি হলো তা সে বুঝতে পারছে না। এতদিন অব্দিতো ভালোই ছিলো।ঊষার চোখর কর্ণিশ বেয়ে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। অথৈর কথা সে শুনতে পেয়েছে। জিনিয়া পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ঊষাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো,

— ঊষা তুমি কিছু মনে করো না ওর কথায়। আসলে এই সময় মেজাজ একটু বিগড়ানোই থাকে। মুড সুইং তো অহরহ থাকেই।

ঊষার ভীষণ খারাপ লেগেছে। তার সাথে কখনও কেউ এরকমভাবে কথা বলেনি। ঊষা একটা চাপা দীর্ঘ শ্বাস টেনে বললো,

— কোন সমস্যা নেই বড় ভাবী। আমি বুঝতে পারছি।

কথাটা বলে অনলকে কোলে তুলে ড্রয়িংরুমের দিকে চলে গেলো। জিনিয়া কিছু সময় ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো এই বিষয়ে অথৈর সাথে কথা বলতে হবে। এরকম চলতে থাকলে ঊষার ভাইদের কানে বিষয়টা চলে যাবে। তখন জিনিয়াকে বকা শুনতে হবে। সে কেনো এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেইনি তার জন্য।

গতকালের কথা ভেবে জিনিয়া এখনো চিন্তিত। সে জানতো এমন হবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তা ভাবেনি।ভাইয়ের চিন্তায় তার জীবন অর্ধেক শেষ হতে বসলো সেখানে আকস্মিক আবার এই ঝামেলা হাজির।

আজ পাঁচ ভাই সন্ধ্যার সময় বাসায় ফিরেছে। অনেক দিন ধরে বোনকে ঠিকমতো সময় দিতে পারে না তারা৷ তাই ভাবলো আজ একটু সময় বের করতে পেরেছে যখন বোনকে নিয়ে কাটানো যাক। অর্ণব ও আদিলের মাঝে চুপ করে বসে আছে ঊষা। অনল তার ছোট চাচা অরূপের কোলে। অরূপের সাথে তার বেশ ভাব। ঈশান বিপরীত সোফায় বসে মোবাইল ঘাটছে আর আড়চোখে সবাইকে লক্ষ্য করছে। ইশাত একটা ম্যাগাজিন নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে। হঠাৎ আদিল অনলকে প্রশ্ন করলো।

— তোমার কি চাই অনল? ভাইয়ু নাকি বোনু?

অনল দাঁত দিয়ে আঙুলের নখ কামড়াচ্ছিলো। বড় চাচার প্রশ্ন শুনে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। অর্ণব ছেলেকে মৃদুস্বরে ধমকে উঠলো,

— অনল বাবা, বড় চাচ্চু প্রশ্ন করেছে। তার কথার উত্তর দাও।

বাবার ধমক খেয়ে অনল লক্ষ্মী ছেলের মতো বললো,
— আমার একটা বোনু চাই।

ইশাত ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কেনো বোনু চাই?

অনল মোচড়ামুচড়ি করে অরূপের কোল থেকে নেমে ঊষার দিকে ছুট দিলো। ঊষার কোলে চুপটি করে বসে উত্তর দিলো,

— আমার একটা বোনু হলে আমিও তোমাদের মতো করে বোনুকে আগলে রাখবো। তোমরা যেমন রাণীকে অনেক আদর করো। আমিও তেমন আমার বোনুকে অনেক আদর করবো। কেউ বোনুকে কিছু বললে শান চাচ্চুর মতো ইচ্ছেমতো মাইর দিবো।

অনলের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। জিনিয়া চায়ের ট্রে নিয়ে টি-টেবিলে রেখে মুচকি হেসে শাসনের সুরে অনলকে বললো,

— পাঁজিপানা হচ্ছে?

অনল মুখ টিপে হেসে বললো,
— একটুও না।

অরূপ একবার উপরের দিকে তাকিয়ে জিনিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
— মেজো ভাবীকে যে দেখছি না। সে কোথায়?

জিনিয়া একবার উপরের রুমে দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে ফেললো। তারপর অরূপের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

— আছে হয়তো ওর রুমে।

আদিল ঊষার দিকে তাকিয়ে বললো,
— বোনু যা তো গিয়ে তোর মেজো ভাবীকে ডেকে নিয়ে আয়।

ভাইয়ের কথা শুনে ঊষা চোখ বড় করে আদিলের দিকে তাকালো। সে কিছুতেই অথৈ-এর সামনে পরতে চাইছে না। আজও অথৈ ওকে বাগে পেয়ে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে। যার দরুন সে অথৈর সামনে যেতে চাইছে না।ঊষা ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো,

— মেজো ভাইয়ু আমি?

আদিল কপাল কুঁচকে উত্তর দিলো,
— হ্যাঁ, তুই। কেনো কোন সমস্যা?

ঊষা একবার জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে তারপর বললো,
— না, কোন সমস্যা নেই।

ঈশান কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে সব লক্ষ্য করেছে। বোনের মুখের এক্সপ্রেশন সে দেখেছে। এক ভ্রু উঁচু করে বললো,

— কি হয়েছে কালুর মা?

ঊষা কথা লুকাতে সামনের পাটি দাঁত দেখিয়ে বললো,
— কিছু না।

জিনিয়া ঊষাকে বাঁচাতে তাড়াহুড়ো করে বললো,
— ঊষা, তোমার যাওয়ার দরকার নেই। তুমি বসে গল্প করো। আমি গিয়ে দেখে আসি অথৈ কি করছে। এমনি আমি এখন উপরে যেতাম। দুই জা মিলে একসাথে গল্প করবো আর চা পান করবো।

ইশাত বললো,
— তাহলে তোমার এখানে থাকার দরকার নেই। আমরা ভাই-বোন মিলে গল্প করি। তুমি বরং তোমার কাজে যাও।

জিনিয়া দুই কাপ চা নিয়ে উপরে চলে গেলো। যাওয়ার আগে ঊষার দিকে এক পলক তাকালো। ঊষা কৃতজ্ঞতার হাসি দিলো। জিনিয়া হাসতে হাসতে উপরে চলে গেলো। এইসব ঘটনা সবার চোখ থেকে আড়াল হলেও সিক্রেট এজেন্সির কর্মী আদিলের চোখ থেকে কিন্তু আড়াল করা এতো সহজ নয়। সে মনোযোগ দিয়ে সবকিছু খেয়াল করেছে। ঈশানেরও একটু একটু খোটকা লেগেছে।

কেটে গেছে আরো একটি দিন। আজ কলেজ থেকে আসার পর থেকে ঊষা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। জিনিয়া কয়েকবার ডাকতে এসেছিলো। কিন্তু ঊষা উঠেনি। তার এখন একা থাকতে ভীষণ ভালো লাগে। সন্ধ্যার সময় উঠে থুম মেরে কিছু সময় বসে রইলো। ঘন্টাখানিক ঘুমানোয় তার মাথা এখন ঝিমঝিম করছে। আলসেমি নিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই মুহুর্তে এক কাপ কফি কিংবা চা না খেলে তার মাথা ঠিক হবে না। তাই কোনমতে নিজেকে টেনেটুনে কিচেনের দিকে রওনা দিলো। যাওয়ার আগে বড় ভাবীর রুমে উঁকি দিলো। জিনিয়া তার ছেলে অনলকে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ পড়াচ্ছে। ভাবীকে ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছে হলো না। ধীর পায়ে এগুতে লাগলো। মেজো ভাবীর রুমে সামনে দিয়ে যাওয়ার আগে তার রুমে একটু উঁকি দিলো। অথৈ বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কারো সাথে মোবাইলে কথা বলছে। ঊষা দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে কিচেনে চলে গেলো।

দশ মিনিট সময় ব্যয় করে এক কাপ কড়া কফি করে আনলো ঊষা। ড্রয়িংরুমে বসে টিভি অন করলো। টিভি দেখতে মন চাইলো না।কিছু সময় চ্যানেল পাল্টে টিভি বন্ধ করে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমটা পুরো অন্ধকার করে রাখানো। দরজা আটকে ড্রিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিতেই একটা গম্ভীর কন্ঠ ঊষার কানে ভেসে এলো।

— লাইট জ্বালিয়ো না প্লিজ।

ঊষা ভয় পেয়ে গেলো। কন্ঠটা পুরুষের। তার রুমে তো কারো আসার কথা নয়। আর কোন পুরুষ মানুষ তো নয়। ভূত-প্রেত, জ্বীনদের কথা তার মনে পরছে এখন। গলা শুকিয়ে আসছে। হাত-পা প্রচন্ড কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

— কে, কে?

আবছা আলোতে ঊষা দেখলো তার বিছানায় কেউ একজন সটান হয়ে শুয়ে আছে। অবয়বটা পুরুষের। সে আবারো প্রশ্ন করলো,

— কে আপনি?

অপরপাশ থেকে এবার আকুতি মিশ্রিত কন্ঠ এসে ঊষার কানে বারি খেলো। যার মধ্যে ছিলো হাজারো আকুলতা। যা শুনে ঊষার দমবন্ধ অনুভূতি হতে লাগলো। কন্ঠটা যে তার বড্ড চেনা। সেই চিরচেনা মানুষের কন্ঠ। যাকে সে পেয়েও নিজের দোষে হারাতে বসেছিলো। থমকে দাঁড়ালো সে।আবারো আকুতি মাখা কন্ঠ এসে ঊষার কানে লাগলো,

— মাথাটা একটু টিপে দিবে ঊষারাণী? বড্ড বেশি যন্ত্রণা করছে।

~~~নিজের বলে ভাবছো যাকে সে কি আসলে নিজের হয়!সময় থাকতে বুঝে নিও এ দুনিয়ায় কেও কারো নয়।

#চলবে