আমি সেই চারুলতা পর্ব-০৮

0
211

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৮
_______________________

এইটুকু বলে চারুলতা চুপ করে গেলো। তিন জোড়া দৃষ্টি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে এরপর কি হয়েছে সেটা শোনার জন্য। চারুলতা চুপ করে যাওয়ায় সাজিদ একটু বিরক্ত হলো। সীমার চেহারায় কিছুটা শোকের ছায়া পড়েছে আর হিমেলের চোখের কোনে একফোটা জল। সবেমাত্র পুলিশে জয়েন করেছে সে। এইসব ছোট খাটো বিষয়েও তার কষ্ট হয়। কয়েকবছরের মাঝেই নিশ্চয়ই সেটা সহ্য হয়ে যাবে তারপর হিমেলও পরিনত হবে একজন কঠোর দায়িত্ববান পুলিশ অফিসারে। যেমনটা এখন সাজিদ আর সীমা। চারুলতা কে উদ্দেশ্য করে সাজিদ বললো,
– কি হলো আপনি চুপ করে গেলেন কেনো?
চারু কিছু বললো না শুধু একবার অসহায় দৃষ্টিতে সাজিদের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিলো। যেকোনো মেয়েই হয়তো মায়ের এমন মৃত্যুর কথা বলতে বলতে এতক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়তো কিন্তু চারুলতা নিশ্চুপ। তার ভিতরে সুক্ষ এক আবেগ কাজ করছে যা কারোর কাছে প্রকাশ করতে চায় না। এমনকি হিমেলের চোখেও একফোঁটা জল কিন্তু চারুর চোখে নেই। কতটা আঘাতে চারু নামের এই নিরিহ মেয়ে এমন কঠিন পাথরে পরিনত হয়েছে। হিমেলেরও এখন তাকে কোনো ভয়ংকর ডায়নীর মতো লাগছে না। মনে হচ্ছে সদ্য ফুটে উঠা ১৫ বছরের সেই কিশোরীটি। প্রায় অনেকক্ষণ চুপ থেকে চারু নিজেই বললো,
– আমার মা কে মেরে ফেললো আমার বাবা নামক নরপিশাচ টি। আমার চোখের সামনে কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না। আর একইসাথে করলো নিজের আপন ভাতিজিকে বিয়ে করার মতো জঘন্য এক পাপ। কি মনে হয় এখানেই তার পাপের শেষ? তার জঘন্য পাপ সম্পর্কে জানলে মরে যেতে ইচ্ছে করবে আপনাদেরও।
চারুর বাকি কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সাজিদ। একইসাথে সীমা এবং হিমেল।
– মাত্র এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত আমি ভাবতাম আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। আমি যদি শিহাবকে বিয়ে করে নিতাম তাহলে আমার মা বেচে থাকতো। এই অপরাধবোধ থেকে রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি আমি। কিন্তু পরে আমি কি জানতে পারলাম জানেন? শিহাবের সাথে আমার বিয়ে দেবার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না নরপিশাচ টার। আমরা ছিলাম শুধু তার গুটি। আমাদের তিনজনের আবেগ নিয়ে দিনের পর দিন নিজের অজান্তেই খেলে গেছে সে। হ্যাঁ আমি মানি সে নিজের অজান্তে খেলেছে কিন্তু আমাদের তিনজনকে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। তার আরো বেশি শাস্তি হওয়ার কথা ছিলো। তার জঘন্য পাপের জন্য তার আরো জঘন্য শাস্তি পাওয়ার ছিলো।
চারু চুপ করে গেলো। হাজার চেষ্টা করেও সাজিদ তাকে দিয়ে আর কিছু বলাতে পারলো না। সেখান থেকে উঠে গেলো তিনজন। চারু যখন একবার থেমে গেছে তাকে দিয়ে আজ আর কিছু বলানো যাবে না। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসে পড়লো সাজিদ। তার মুখোমুখি সীমা এবং কিছুটা দূরে হিমেল। থানাটা হঠাৎ খালি খালি মনে হচ্ছে। কে জানে সবাই কোথায় গেলো। এর মাঝেই সীমা বললো,
– মেয়েটা কিন্তু বেশ রহস্যময়ী। মনোরমাকে যখন মারলো তখন আমারও মনে হয়েছিলো শিহাবকে বিয়ে করলে ওর মা বেচে যেতো। কিন্তু মেয়েটা আমার এই ভুল ভেঙে আরো গভীর রহস্যে ফেলে দিলো।
– কিন্তু ম্যাম আমার মনে হয় বিয়েটা শাওনের সাথে হলেই ভালো হয়।
– আমার সেটা মনে হয় না। যেকোনো বাস্তববাদী মানুষই চাইবে বিয়েটা শিহাবের সাথে হোক কারণ সে বিয়ের জন্য উপযুক্ত। তুমি এখনো তরুন। এই কাহিনী টাকে ভালোবাসার গল্প হিসেবে দেখছো তাই তুমি চাইছো মিল টা যেনো শাওনের সাথে হয়।
– সেটা তো আপনি চাইছেন। যাই হোক, আপনাদের হয়তো মনে নেই মেয়েটার স্বামীর নাম জামাল হোসেন। শাওন কিংবা শিহাব, কারোর সাথেই চারু নামের মেয়েটির বিয়ে হয়নি।
হিমেল বেশ অবাক হলো। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বললো,
– ওহহহ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম চারুলতার বিয়ে জামাল হোসেন নামক এক মাতালের সাথে হয়েছিলো। খুবই দুঃখজনক।
– হিমেল চারুলতার কেসটা কি কোর্টে পাঠানো হয়েছে?
– না স্যার। কালকে পাঠানো হবে। স্যার একটা কথা বলি?
– কি কথা?
– আমার না চারুলতার কেসটা কোর্টে পাঠাতে ইচ্ছে করছে না। মেয়েটার জন্য খুব মায়া লাগছে। মনে হচ্ছে যেনো এটি পনেরো বছরের সেই নিষ্পাপ কিশোরী।
– মনে না চাইলেই সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া যায় না হিমেল। তুমি যে পোশাক টা পড়ে আছো সেটার দিকে দেখো। এইটা শুধু একটা পোশাক নয়। এর দায়িত্ব অনেক। এটাকে গ্রহণ করতে হলে সব আবেগ বিসর্জন দিতে হয়।
– কেনো স্যার? পুলিশদের কি মায়া হয় না?
– হবে না কেনো? আমরা পুলিশেরাও মানুষ। আমাদের অনুভূতি আছে। তবে আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। আবেগ দিয়ে এইসব নির্ণয় করা আমাদের সাজে না। তুমি নতুন জয়েন করেছো তাই হয়তো প্রথম প্রথম ব্যাপারটা খুব অমানবিক লাগবে কিন্তু ধীরে ধীরে সহ্য হয়ে যাবে। আরো অনেক ধরনের কেস দেখবে নিজের ক্যারিয়ারে।
সাজিদের কথা শুনে সীমা বলে উঠলো,
– এইটা আমার ক্যারিয়ারের সাত বছর চলছে। আমার জীবনে চারুলতার মতো কেইস প্রথম। একে তো মেয়েটার বয়স সবেমাত্র উনিশ। তার মধ্যে মেয়েটা পাচটা খুন করেছে। আবার নিজে এসে আত্মসমর্পণ করেছে। আবার আমাদের কাছে আরেকটা খুনের জন্য সাহায্যও চাইছে। আবার মেয়েটা আগে ছিলো একটা নিরীহ ধরনের মেয়ে।
– মেয়েটা একা ছিলো না। তাকে কেউ না কেউ সাহায্য করেছে।
– কি মনে হয়? কে হতে পারে?
– হয়তো হামিদ। যতটুকু শুনলাম ১৮ বছর বয়সেও ছেলেটার দারুণ তেজ ছিলো। আর এখন নিশ্চয়ই তার বয়স ২২। যুবক মানুষ গরম রক্ত। তার উপর মনোরমা মৃত্যুর আগে চারুলতার দায়িত্ব তার কাছে দিয়ে গিয়েছিলো।
– যদি হামিদ খুন করতেই সাহায্য করে তাহলে বিয়েটা আটকালো না কেনো? যেই ছেলে খুন করতে পারে সে কি বিয়েটা আটকাতে পারতো না?
– কে জানে? এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বাকি। এইসব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র চারুলতাই আমাদের দিতে পারবে।
হিমেল হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো। তার চিৎকারে সীমা আর সাজিদ দুজনেই তার দিকে তাকালো,
– স্যার রাত দুটো বাজে।
হিমেলের কথা দুজনেই চমকে গেলো। রাত দুটো বেজে গেছে। এত সময় কিভাবে পার হয়ে গেলো। নিশ্চয়ই চারুলতার কথা শুনতে শুনতে তাদের সময় কেটে গেছে আর তারা সেটা বুঝতেই পারেনি। সীমা তাড়াতাড়ি নিজের ফোন চেইক করলো। তার স্বামীর তিনটা মিসড কল উঠে আছে। সাজিদও চেইক করে দেখলো পুতুলের ১৩ টা মিসড কল।
– ইশ আমার ছেলেটা বোধহয় না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে। ও আবার আমার হাতে না খেলে খেতে চায় না।
সীমার কথায় হিমেল আর সাজিদ দুজনেই তার দিকে তাকালো। কাজের সময় সীমা যতটা কঠিন নিজের ছেলের ক্ষেত্রে সে ঠিক ততটাই নরম। একেই বোধহয় মা বলে। তিনজনই দ্রুত থানা পরিত্যাগ করে নিজের বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো। সাজিদ বাড়ি পৌঁছাতেই দেখলো ওর মা আর পুতুল বসে আছে। অর্থাৎ তারা এখনো ঘুমায়নি।
– তোমরা এখনো জেগে আছো যে? ঘুমাও নি?
– তুমি এত দেরি করে এলে কেনো বাবা? আমি কতক্ষণ ধরে তোমার অপেক্ষা করছিলাম।
– অপেক্ষা কেনো করছিলে মাম্মাম? বাবা তো কাজে বিজি ছিলো। মা তুমি ওকে ঘুম পারাওনি কেনো বলোতো?
– জিজ্ঞেস কর করবার বলেছি। তার এক কথা, বাবা না আসা পর্যন্ত ঘুমাবো না।
– ঠিক আছে। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো আমি পুতুলকে নিয়ে যাচ্ছি।
সাজিদ কোলে করে পুতুলকে নিয়ে গেলো। মা নেই মেয়েটার। তাকে কোনো কষ্ট সে দিতে চায় না। নাহ, মা মারা যায়নি পুতুলের। সাজিদের সাথে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিলো সাজিদ আর সায়মার। বিয়ের পর মতে একদম মিলতো না তাদের। দুজনেই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো। তাদের মধ্যে কখনো ভালোবাসা জন্মায়নি। সাজিদ সারাদিন নিজের কাজে আর সায়মা সারাদিন নিজের কাজে। একে অপরের চেহারা শুধু দেখতো রাতে তাও বেশিরভাগ সময়ই তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। একে অপরকে জানা হয়নি, বোঝাপড়া হয়নি, ভালোবাসা হয়নি। এক পর্যায়ে সায়মার সাথে মানিয়ে নেওয়া সাজিদের কাছে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অতঃপর ডিভোর্স। কোর্ট পুতুলকে সায়মার সাথে থাকার নির্দেশ দিলেও সায়মা সরাসরি বলে দিলো, সাজিদের মেয়েকে সে চায় না। তার মেয়ে যেনো তার কাছেই থাকে। দ্বিমত করেনি সাজিদও। পুতুলকে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। ওর মেয়ে কেনো অন্যের করুনায় বড় হবে? তার কাছেই রাজকুমারীর মতো থাকে। এরপর থেকেই মা আর মেয়েকে নিয়ে সংসার সাজিদের। বাবা তো মারা গেছে কুড়ি বছর হতে চললো।
পুতুল কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সাজিদের ইচ্ছে হলো চারুর কেসটার ব্যাপারে আরো কিছু তথ্য জানার। সে কাউকে কিছু একটা মেইল করে দিলো তারপর অনলাইনে করিমপুরের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য জানতে শুরু করলো। একসময় তার চোখ আটকে গেলো একটি নামে। শিহাব। চারুর ভাষ্যমতে শরীরের প্রতিটি লোমকূপেও যার আভিজাত্যর ছোয়া, এমনই একটি ছেলের ছবি রয়েছে। এই ছেলেটিই কি শিহাব? তাহলে শাওন?

সকালে নির্দিষ্ঠ সময়ে থানায় এসেছে সাজিদ। হিমেল ফাইলপত্র নিয়ে কিছু ঘাটাঘাটি করছে কিছুক্ষণের মাঝেই আগমন ঘটলো তার।
– স্যার আসবো?
– এসো। বসো।
– স্যার চারুলতার কেইস কোর্টে পাঠানো হয়েছে।
হিমেলের মাঝেই আগমন ঘটেছে সীমার। সে এখনোই গিয়ে জানতে চায় পরবর্তীতে কি হয়েছিলো। তার যেনো অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না। পুলিশেরা সবসময় সাধারণ ভাবে থাকলেও তাদের মাঝেও কৌতূহল কাজ করে যা তার প্রকাশ করতে পারে না। করতে চায় না। এই মূহুর্তে সীমার অবস্থাও তাই।
– আপনারা কি বাকিটা জানতে যাবেন না?
– এত সকালে?
– হ্যাঁ যাই। হাতে এখন আর তেমন বিশেষ কাজ নেই।
– ম্যাম কাল রাতে কিন্তু আমি একটা জিনিস খুব ভেবেছি।
– কি?
– চারুলতার স্বামী জামাল হোসেনের বয়স তার থেকে দ্বিগুণ। শিহাবের বয়সও দ্বিগুণ। এমনকি হতে পারে না যে শিহাবেরই ছদ্মনাম জামাল হোসেন?
– খুব সুন্দর ধারণা করেছো হিমেল তবে জানিয়ে দেই তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
হিমেলকে হতাশ হতে দেখা গেলো। সে ভেবেছিলো এই কথাটা মাথায় আসায় সাজিদ আর সীমা দুজনেই তাকে সাবাসী দেবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না।
– কেনো স্যার? ভুল কেনো?
– প্রথম কারণ, চারুলতার হিসেবে যদি বলি শিহাবের বয়স এখন ৩৪ হবে আর তার স্বামী জামাল হোসেনের বয়স ছিলো প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। দ্বিতীয় কারণ, জামাল হোসেনের বাড়ি চারুলতার পাশের গ্রামে আর শিহাব চারুলতার গ্রামের জমিদারের ছেলে। তৃতীয় কারণ, চারুলতার ভাষ্যমতে শিহাব খুবই সুদর্শন, ভদ্র ও মার্জিত স্বভাবের ছিলো আর জামাল হোসেন কে আমার মোটেও সুদর্শন লাগেনি। ভদ্রতা দুরের কথা সে ছিলো একজন মাতাল। শিহাবের ব্যাপারে আরো অনেক তথ্যই আমি ইতিমধ্যে জানি।
– কি সেই তথ্য? আর আপনি কিভাবে জানলেন স্যার?
– কাল রাতে খোজ নিয়েছিলাম। শিহাবের সাথে কোনো কারণবশত তার পরিবারের সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই। বর্তমানে সে একজন সফল ব্যাবসায়ী এবং ব্যাবসা পুরোটাই সে একা দাড় করিয়েছে। যদিও শিওর না তবে অনেকেই বলছে ওর ব্যাবসা নাকি খুব শীঘ্রই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আরেকটা কথা কি জানো? শিহাব কিন্তু এখনো অবিবাহিত। কেউ ওর বিয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে কখনো কোনো পরিষ্কার উত্তর দেয় না। এক্সের ব্যাপারে কেউ জিজ্ঞেস করলে কি বলে জানো? বলে, “ছিলো কেউ একজন। সে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি।” সেই অপ্রাপ্তির মানুটির নামও সে জানিয়েছে।
– কে সে? চারুলতা?
– স্বর্ণলতা!
– স্বর্ণলতা নামে তো শিহাবই চারুলতা কে ডেকেছিলো তাই না স্যার?
– হুম। ওর সাথে বিয়ে হলেই মেয়েটি হয়তো সুখী হতো।
– আপনি এত কিছু কিভাবে জানলেন?
সীমার কথার প্রতিউত্তরে সাজিদ বললো,
– আগেই তো বলেছিলাম তাদের ব্যাপারে খোজ নিয়েছি আমি।
– স্যার শাওনের কোনো খোজ পান নি?
– হ্যাঁ পেয়েছি।
– তার কি অবস্থা?
– জামাল হোসেনের সাথে যেদিন চারুর বিয়ে হয় সেদিন শাওন আত্মহত্যা পথ বেছে নেয়। তবে সে বেচে আছে কি না মারা গেছে সেই তথ্য আমার কাছে নেই। এরপর থেকে কেউ আর কখনো শাওনকে সেই গ্রামে দেখেনি আবার তার জানাযা কিংবা দাফনকাজও হয়নি।
– স্যার আমার মনে হয় শাওন বেচে আছে। অন্য কোথাও হয়তো আছে সে।
– হয়তো।
– চারুলতা কি শাওনের ব্যাপারে জানে?
– জানার তো কথা। যে মেয়ে পাঁচটা খুন করতে পারে সে শাওনকে খুজে বের করবে না এইটা ভাবা বোকামী। সে যদি বেচে থাকে তবে চারুলতা জানে সে কোথায় আর যদি মারাও যায় তাও সেটা চারুলতা জানবে।
– এই কথাটা আমরা তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি?
– আপনি খুবই অধৈর্য্য নিয়ে থাকেন। আপনার কি মনে হয় সে এখন আমাদের কিছু বলবে?
– চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই।
– ঠিক আছে। তাহলে দেখা যাক।

★★★

হামিদ সেদিন আটকাতে পারেনি শেফালীর গৃহ প্রবেশ। মূলত শেফালীকে দেখে হামিদ এত বড় একটা শক পেয়েছিলো যে তাকে আটকানোর সাধ্য তার ছিলো না। গ্রামবাসীরা যখন বললো এখন নাজিমুদ্দিনের বিয়ে জায়েজ না তখন নাজিমুদ্দিন যুক্তি তর্ক দিলো সে জানতো না মনোরমা মারা গেছে। তাছাড়া বিয়ে করে আনা এই মেয়েটাকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। একা মেয়েমানুষ, কোথায় যাবে সে? নাজিমুদ্দিনের যুক্তি তর্কের কাছে হার মেনে শেফালীকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। নাজিমুদ্দিনও দুজনকে হুমকি দিলো যেনো ভুলেও একথা পাঁচকান না হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় হামিদ ছেড়ে দিতো না তাকে কিন্তু মায়ের মৃত্যু শোক আর এমন একটা ঘটনায় সে এমনভাবে শোকাহত হয়েছে যে বাধা দেওয়ার উপায় তার ছিলো না। চারুও এখানে নিরব দর্শক ছাড়া কিছুই না। হামিদের তাও দুটো কথা বলার অধিকার আছে। সে ছেলে মানুষ। চারুর তো তাও নেই। পৃথিবীর জঘন্যতম রাত ছিলো মনোরমার মৃত্যুর প্রথম রাত। ওদিকে প্রথম স্ত্রীর কবরে সাওয়াল জবাব হচ্ছে আর এদিকে ঘরে তারই স্বামী আপন ভাতিজিকে বিয়ে করে তার সাথে বাসর সয্যা করছে। ছিহ! ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে আসে।
হামিদ হাটুতে মুখ গুজে বসে ছিলো। তার জীবনের মোর এভাবে পাল্টে যাবে তা সে কল্পনাও করেনি। চারুর জীবন টাও কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো। শেফালী তার মামা বাড়িতে থাকতো। তাদের যুক্তি হামিদ এখন বড় হয়েছে। একই বাড়িতে হামিদের সাথে ও কিভাবে থাকে? তার উপর দুই রুমের মধ্যে কোনো দরজা নেই। ঘরকেও আলাদা বলা যায় না। চারু যদি কোনো কারনে বাসায় না থাকে তাহলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে। কথাটা ভাবতেই একাধারে যেমন হামিদের হাসি পাচ্ছে অপরদিকে কান্নাও পাচ্ছে। হামিদের কারনে শেফালীকে এবাড়িতে দেওয়া হয়নি আর এখন কি না তারা নিজ কাকার সাথে আপন ভাতিজির বিয়ে করিয়ে দিলো। বাহ! কালনাগিনী টা হয়তো এইবার চারুর জীবন ধ্বংস করে দেবে। চারুকে তো সহ্যই করতে পারেনা সে। চারু ওর চেয়ে বেশি সুন্দর হওয়ায় নিজের চেয়ে ছয় বছরের ছোট একটা মেয়ের সাথে হিংসা করতেও রুচিতে বাধেনি তার। হামিদ থাকতে চারুর গায়ে একটা আচরও লাগাতে পারবে না ওই কালনাগিনী। উল্টাপাল্টা কিছু করলে একেবারে মেরে ফেলবে ওকে।
– কি হয়েছে তোমার? এইভাবে বসে আছো কেনো?
– কি আর করমু? সবই কপাল।
চারু এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও হামিদের উদাসীনতায় সেও বিষন্ন হয়ে পড়লো। হঠাৎই হামিদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো চারুকে। কান্নায় যেনো ভেঙে পড়লো সে। ছোট থেকেই চারুর সামনে কাদতো না ও। তার মনে হতো কান্নারত অবস্থায় চারু তাকে দেখলে সে মজা নেবে আর আজ তার কান্নার একমাত্র সঙ্গী এই চারু। চারু ছাড়া এই দুনিয়ায় ওর আপন কেউ এখন আর থেকেও নেই। এই প্রথম বোনকে জড়িয়ে ধরে নিজের আবেগ প্রকাশ করলো সে। চারু হামিদকে শান্তনা দিতে চাইলো কিন্তু কি শান্তনা দেবে সে নিজেই তো তার কান্না আটকাতে সক্ষম না।

সারাটা রাত নির্ঘুম অবস্থায় কাটিয়ে দিলো হামিদ আর চারু। শেষ রাতের দিকে হামিদ একটু ঘুমালেও ঘুমাতে পারেনা চারু। বারবার মনে হচ্ছে আজ ওর কারণেই ওর মা বেচে নেই। ও যদি শিহাবকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যেতো তাহলে আজ ওর মা বেচে থাকতো। মাঝে মাঝে ডুকরে কেদে উঠছে সে। হামিদ শান্তনা দেওয়ার ভাষা পায় না। কিভাবে দেবে শান্তনা? সে নিজেই তো মায়ের এমন অকাল মৃত্যুতে শান্ত হতে পাচ্ছে না। একটা ছেলে হওয়ার শর্তেও মনটা ভেঙে গুড়িয়ে গেছে তার। গল্পের আসল লেখিকা স্নেহা ইসলাম প্রিয়া। আর চারু তো নিষ্পাপ, নিরীহ, বাচ্চা একটা মেয়ে। মা ছাড়া কিভাবে বাচবে সে? সারারাত ঘুমালো না সে। দূর থেকে আজান শোনা যাচ্ছে। নামাজের প্রতি এত আগ্রহ চারুর কোনো কালেই ছিলো না কিন্তু যেনো তাকে নামাজ টানছে। বারবার মৃত্যুর কথা স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে। তার মা এখন আল্লাহর কাছে আছে। আল্লাহর কাছেই মায়ের ভালো, সুখ, শান্তি চাইতে হবে। কলঘর থেকে ওযু করে এলো। সিজদায় লুটিয়ে পড়ে কাদলো সে। মোনাজাতেও ফেললো চোখের জল। তার কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় হামিদের। চারু নামাজ পড়ে যাচ্ছে। তাকে কিছু না বলে সেও টুপি নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। মায়ের জন্য আল্লাহর কাছে চাইতে হবে তো। নামাজ শেষ করে উঠোনে এসে বসলো চারু। এই উঠনেই কত স্মৃতি মনোরমার। এই বাড়ির প্রতিটি কণা মনোরমার নিজের হাতে গড়া। আর আজ সেখানে রাজত্ব করবে কি না অন্য কেউ। এমন কেনো হয় নিয়তি? হামিদ চলে যাওয়ায় দরজা খোলাই ছিলো। ভিতরে প্রবেশ করে শাওন। কিছুই বললো না চারু।
– এইহানে আয় চারু।
ইচ্ছে না থাকার শর্তেও বের হলো। ওর সাথে কিছু কথা আছে। বাড়িতে বলা যাবে না।
– এইসব ক্যামনে হইলো? খালাম্মা তো,,,
– তুমি আর আমার কাছে এসো না শাওন ভাই। আজ আমার জন্য আমার মা বেচে নেই। তোমার ভাইকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে আজ এইটা হতো না। যাই হোক, এইটাই বলতে আসছিলাম। তোমাকে আর কিছু বলার নেই। কিছু শোনারও নেই। আর হ্যাঁ, তোমাকে দায়ী করছি না আমি কিন্তু আমি চাই না আমার কোনো কাজের জন্য আমার ভাইয়ের কিছু হোক। সে ছাড়া এখন আর আমার কেউ নেই। তুমি চলে যাও। আর এসো না।
চারু শাওনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো সেখান থেকে।

#শুভ্রা_আহমেদ_প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….