আমি সেই চারুলতা পর্ব-০৯

0
215

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৯
_______________________

– শোন চারু, আইজ থাইক্যা শেফালী রে আম্মা ডাকবি আর তুই আর হামিদ দুইজনেই আপনে কইরা কথা কবি।
নাজিমুদ্দিনের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো হামিদ।
– বিয়া আপনে করছেন। আপনেই গিয়া তার লগে আহ্লাদী পানা করেন। আমরা পারুম না।
– আহা তুই ব্যাপারটা এত খারাপ ভাবে দেখতাছস ক্যান? তোর মা মইরা গেছে এখন তোগো দেখা শুনার জন্যও তো একজন মানুষ চাই। শেফালী হইলো আমাগো আপনা মানুষ। সারাজীবন তোরে আর চারুরে নিজের মাইনাই আদর করবো। অন্য বেডিরে বিয়া করলে কি আর আমাগো এত খেয়াল রাখবো?
– আপনে তো জানতেন না মা মইরা গেছে তাহলে ওরে বিয়া কইরা আনলেন ক্যান?
– এহন তুই বুঝবি না বাপ। কয়দিন যাইতে দে। মাথা ঠান্ডা কর দেখবি ব্যাপারটা এতো খারাপ না। শেফালী তোরে আর চারু রে মায়ের মতোই ভালোবাসবো। আগলায়া রাখবো।
– হইছে। এমন জঘন্য ভালোবাসা আমার আর চারুর লাগবো না। তাছাড়া আমরা পোলাপান না যে আমাগো দেইখ্যা রাখতে হইবো। সোজাসাপ্টা বলেন, আপনের রূচি বিকৃত হইয়া গেছিলো তাই আপনে নিজের আপন ভাতিজিরে বিয়া করছেন।
– হামিদ, বেশি কথা কইতাছস তুই। তোর মতামত শুনবার চাই নাই আমি। শেফালী রে যত তাড়াতাড়ি মাইনা নিবি তত তাড়াতাড়ি তোর ভালো। আর চারু তুই চুপচাপ বইয়া থাকিস না। শেফালী তোর আপন মা না। ওর কামে সাহায্য করবি। নিজের মায়ের কাছে রানীর হালে আছিলি বইলা ওর কাছে তো আর থাকতে পারবি না।
– ক্যান? ও ক্যান কাজ করবো? আপনি নাকি শেফালীরে বিয়া করছেন আমাগো দেখাশুনা করার জন্য। সব যদি চারুই করে তাইলে তারে কি দরকার?
– কিসের শেফালী? আম্মা ডাক। আর আমি তো কই নাই সব চারু একা করবো। কইছি শেফালীর কামে সাহায্য করবো। সাহায্য তো মনোরমার কাজেও করতো।
চারুর এইসব নিরব দর্শকের মতো দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মা মারা গেছে এখনো চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি।
– থাউক না। বাচ্চা পোলাডার উপর এমনে চিল্লাইতাছেন ক্যান? ওর এহন মন মেজাজ ভালা না। কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হইয়া যাইবো। বাপ তুমি খাইতে বসো। আর চারু রে নিয়া চিন্তা কইরো না। আমরা মা মাইয়া মিলা সব কাজ কইরা নিমু। তাই না মা?
শেফালীর কথায় বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলো হামিদ আর চারু। এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর পরেও তার যে এভাবে মুখ খোলার সাহস আছে তা কল্পনাও করেনি হামিদ। চারু হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। সে বুঝতে পারছে না তার কি উত্তর দেওয়া উচিত।
– কি রে কথা কস না ক্যা? তোর আম্মায় কিছু জিগাইছে না?
নাজিমুদ্দিনের কথায় ভড়কে গিয়ে চারু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। হামিদের সব কিছু বিরক্ত লাগছে। শেফালী আবার ওকে খেতে বসতে বললো। ইচ্ছে করছে শেফালী কে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতে। শেফালীর কথায় সে তো খেতে বসলোই না বরং এখান থেকে উঠে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো কিন্তু তাকে আটকে নিলো চারু।
– বসো খেয়ে যাও। আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি।
– ঘরে নিয়া আয়। এমন জঘন্য দৃশ্য চোখের সামনে থাকলে খাওয়া যায় না।
শেফালী কে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে হামিদ ঘরের দিকে চলে গেলো। চারু রান্নাঘরে গেলো হামিদ কে ভাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে। আজ রান্না শেফালী করেছে। রান্না করার অবস্থায় চারু আজ নেই। পাড়া প্রতিবেশী রাও এসে দেখে গেছে ওদের। সবার সামনে শেফালীর কি ভালো আচরণ চারুর সাথে। লোকজন দেখে বলে গেলো সৎ মা হলেও মা টা ভালোই পেয়েছে চারু আর হামিদ কিন্তু এর পেছনে থাকা জঘন্য সত্য সম্পর্কে কেউই জানতে পারলো না। চারু দেখলো শেফালী ইলিশ মাছ রান্না করেছে। অতিরিক্ত কাটার জন্য ইলিশ মাছ নিজের হাতে খেতে পারতো না হামিদ। মনোরমা সবসময়ই তাকে খায়িয়ে দিতো। ইলিশ দিয়ে হামিদ খেতে পারবে না উল্টো মনোরমার কথা মনে করে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে। চারু মুরগির খামারে চলে গেলো। এটি মনোরমার তৈরি খামার। নিজের হাতে তৈরি করেছে এটিকে। সেখান থেকে একটি ডিম নিলো। এক ডিম দিয়ে নিশ্চয়ই দুজনের খাওয়া শেষ হয়ে যাবে। হামিদকে ডিম দিয়ে চারু ইলিশ খেতে পারবে না। এমন নির্দয় এখনো হয়ে যায়নি সে। ডিম ভাজার সময়ে রান্নাঘরে আগমন ঘটলো শেফালীর।
– দাও আমি কইরা দেই।
– দরকার নেই। আমার ভাই সবার হাতের রান্না খেতে পারে না। আপনি গিয়ে বাবাকে খাওয়ান।
শেফালীর মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। তার হামিদকে খাওয়ানোর ইচ্ছে ছিলো না। সে চেয়েছিলো ডিম ভাজার নাম করে সেটা নষ্ট করে দিতে। হামিদের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলো সে। ও যেন আজ খেতে না পারে তাই ইলিশ মাছও রান্না করেছিলো কিন্তু এই চারু সেটা হতে দিলো না। এখন সে নতুন। বাড়ি এসেছে চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি। এর মাঝেই ঝামেলা করতে চাইছে না। দুটো দিন যাক। ছোট থেকেই চারুকে সহ্য করতে পারে না সে। চারুর গায়ের রঙ উজ্জ্বল। অপরদিকে সে শ্যামলা। সবাই ছোট থেকেই তার সামনে চারুর গুনগান গাইতো। নিজের চেয়ে বয়সে এত ছোট চারুলতার প্রসংসা সে মানতে পারলো না। হিংসে হতে লাগলো চারুর প্রতি আর তারপর একসময় তার বাবা মা নিহত হয়। ঘটনা ও যতদুর জানে রাতে রাস্তা দিয়ে আসার সময় ডাকাতের কবলে পড়ে। ওর বাবা কে সাথে সাথেই খুন করে আর ওর মা কে নিয়ে যায় ডাকতদের ডেরায়। দুইদিন পর একই রাস্তায় ওর মায়ের লাশ পাওয়া যায় বিবস্ত্র অবস্থায়। তারপর থেকেই মামা মামী এসে ওকে এখান থেকে নিয়ে যায়। কোনো সন্তান ছিলো না তাদের। মাঝে মাঝেই হামিদ আর চারুকে নিয়ে নাজিমুদ্দিন সেখানে ঘুরতে যেতো। যখন একইসাথে থাকতো তখন হামিদ আর শেফালীর সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুর মতোই ছিলো। ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে দুরুত্ব। হামিদ শেফালীর দুই বছরের ছোট। বড় হওয়ার সাথে সাথে শরীর স্বাস্থ্য বাড়তে থাকে হামিদের। ছোট থেকেই হামিদ ছিলো সুন্দর। আর সেই সৌন্দর্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তেই থাকলো। হামিদ পরিনত হলো সুদর্শন কিশোরে। হামিদকে পছন্দ করতে শুরু করলো শেফালী। কিন্তু সেই প্রথম থেকেই হামিদ ওর প্রতি উদাসীন। খেলার ছলে শেফালী যখন ওকে জানালো ও তাকে ভালোবাসে হামিদ উত্তর দিয়েছিলো তোমার মতো কালা মাইয়া রে কে ভালোবাসবো? হামিদ তখন ছোট ছিলো। হয়তো সেসময়কার কথা মনেও নেই কিন্তু কথাটা মনে গেথে যায় শেফালীর। সে ভুলতে পারে না। প্রতিশোধ নিতে চায়। যদিও নাজিমুদ্দিনের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর কারণ হামিদ না কিন্তু সুযোগ বুঝে এই ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে ফেললো সে। গত তিন বছর যাবত নাজিমুদ্দিনের সাথে গভীর সম্পর্ক তার। কয়েকবার শারীরিক ভাবে মিলিতও হয়েছে তারা তবে মামার বাড়িতে থাকতো বিধায় খুব একটা সুযোগ হয়নি। নাজিমুদ্দিন ওকে ঘোরানোর নাম করেও নিয়ে আসতো। মামাও মানা করেনি। সরল মনেই নাজিমুদ্দিনের সাথে পাঠাতো। মামা মামী এখনো জানে না নাজিমুদ্দিন কে বিয়ে করেছে সে। তবে যাই করেছে ভালো করেছে। হামিদের উপরও প্রতিশোধ নেবে আর চারুর উপরেও। নাজিমুদ্দিনের সাথে সম্পর্কে জড়ানো খুব একটা খারাপ বুদ্ধিও ছিলো না।

– ইলিশ রান্না করেছে সে। ডিম ভেজে এনেছি এইটা দিয়ে খাও।
– ইচ্ছা কইরা ওই কালনাগিনী এমন করছে যেনো আমি খাইতে না পারি।
– আজ কি কাজে যাবে? যেও না। আমার এখানে একা ভালো লাগবে না।
– লাগনের কথাও না। এই বাড়ি এহন জাহান্নাম আর জাহান্নামে কেউ ভালো থাকে না। তুই খাইছস?
– না এখনই খাবো।
– আমার লগে বইসা খা। কে জানে ওই কালনাগিনীর মনে কি আছে।
– আমি ভাবতেও পারছি না এমন হতে পারে। একটা মানুষ কতটা বিকৃত মস্তিষ্কের হলে নিজের ভাতিজিকে বিয়ে করে বলতে পারো?
– তাও যদি দেখতে সুন্দর হইতো তো মানতাম।
– সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নিয়ে বিদ্রুপ করতে হয় না। সে যেমনই হোক আল্লাহই তাকে বানিয়েছে।
– আমি বুঝি না আল্লাহ এইসব জঘন্য মানুষ বানায়া এই দুনিয়াটারে এত নোংরা বানাইতাছে ক্যান।
– আল্লাহ সবাইকে পবিত্র করেই সৃষ্টি করে। পবিত্র ভাবেই পাঠায়। কিন্তু তারা শয়তান হয় পৃথিবীতে এসে। ছিহ! ভাবতেও ঘৃণা লাগছে এমন একটা মানুষের সাথে আমাকে এখন থেকে থাকতে হবে।
হামিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এখানে থাকার ইচ্ছে তারও নেই। মনে হচ্ছে এখন চারুকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারলেই ও বাচে কিন্তু ভাগ্য ওর সহায় নেই। এখনো অবধি ওর আয় এত বেশি হয়নি যে দুইজন মানুষ চলা যায়। মাত্র ১৫০ টাকা বেতনের কাজ করে সে। এতে কোনোমতে নিজের সারামাস টেনেটুনে চলে গেলেও চারুকে কিভাবে এই বেতনে রাখবে? তাছাড়া একটা ভালো বাড়িও ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যাবে না। যদি ও একা হতো তাহলে না হয় ৪০-৫০ টাকার মধ্যে ঘর নিয়ে কোনোমতে থাকা যেতো। ছেলেদের জন্য সহজ হলেও মেয়েদের জন্য সেটা অনিরাপদ। সেখানের পরিবেশও ভালো না। চারুকে নিয়ে সে তো আর ওখানে উঠতে পারে না। তার উপর খাওয়া, দাওয়া, জামাকাপড়, অসুস্থ হলে কবিরাজের চিকিৎসা, চারুর লেখাপড়া এইসব কিভাবে করবে সে? নাহ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা ভালো কাজ খুজে চারুকে এই জাহান্নাম থেকে নিয়ে যেতে হবে।

বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে শিহাব। নিজের ভিতর কেমন যেনো এক অস্থিরতা অনুভব করছে সে। আজ তিন দিন হতে চললো গ্রাম থেকে এসেছে কিন্তু তার মন এখনো পড়ে রয়েছে করিমপুর নামক গ্রামের সেই ছোট্ট কিশোরী টার কাছে। কি আছে ওই মেয়ের মাঝে? কেনো তাকে টানে চারুলতা? আর এতই যদি টানে তবে সে কেনো তার নয়? গল্পের আসল লেখিকা স্নেহা ইসলাম প্রিয়া। আচ্ছা শাওনের কি ওকে পছন্দ করা খুব প্রয়োজন ছিলো? অনেক তো মেয়ে ছিলো, তাদের পছন্দ করতে পারতো। শাওনেরও বা কি দোষ? ও নিজেও তো এত মেয়ে থাকতে চারুলতাকে পছন্দ করেছে। আচ্ছা ওদের দুজনের মাঝে মিল হওয়াটা কি খুব বেশি জরুরি ছিলো? এখনো অবধি সব জিনিস এক পছন্দ করেছে। এমনকি চারুলতাকেও দুজনেই পছন্দ করলো। আচ্ছা, শিহাব তো দুর্বল নয়। ও তো নিজেকে সামলে নিতে পারে তবে এখন কেনো পারছে না। শিহাব শাওনের হাসি মুখ টা কল্পনা করার চেষ্টা করলো। শাওনের খুশি দেখলেই সে আর চারুকে চাইতে পারবে না কিন্তু মনটা বড় বেইমান, কিছুতেই শাওনের মুখ চোখের সামনে ভেসে আসছে না। ভেসে আসছে চারুলতা নামক সেই কিশোরী টার ভয়ার্ত মুখ। যাকে প্রথমবার দেখেই নিজের অজান্তে এতটা ভালোবেসে ফেলেছে। এই মানব জাতি কতই না আজব! যেই মানুষটা ভাগ্যে নেই তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেলে। নিজেরই অজান্তে। আবার তাকে ভালোবেসে কষ্ট ও পায়। হাজারও চেষ্টা করেও শিহাব থাকতে পারলো না এখানে। একবারের জন্য হলেও সে দেখতে চায় চারুলতা কে। ও জানে এইটা সঠিক নয় কিন্তু ওর মন মানতে চায় না। আর তো মাত্র কিছুদিন। শাওনের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে তো আর এমনিও চারুকে দেখার মতো দুঃসাহস সে করবে না। যতক্ষণ অবধি না ও শাওনের হয় ততক্ষণ অবধিই না হয় দেখুক। প্রতিটি মানুষই নিজের কল্পনায় একজন মানুষ কে প্রচন্ড ভালোবাসে। শিহাবও বাসে। ভালোবেসে তার নাম দেয় স্বর্ণলতা। প্রতিনিয়ত সেই স্বর্ণলতার সাথে তার কত কথা, কত ভালোবাসা! কে জানতো, বাস্তব জীবনের তার স্বর্ণলতা তার গ্রামেই আছে। কিন্তু বাস্তব সেই স্বর্ণলতা তার নয়। নাহোক তার, কল্পনায় তো স্বর্ণলতা শুধুই তার। কেউ তাকে নিতে পারবে না। শাওনও না। শিহাব শুধু কিছু টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো গ্রামের উদ্দেশ্য। সে তো আর থাকতে যাচ্ছে না। যাচ্ছে একনজরের জন্য তার স্বর্ণলতাকে দেখতে।

মায়ের মৃত্যুর তৃতীয় দিন। অসহ্য যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে চারু আবার সে কষ্ট কাউকে বলার মতো ভাষাও নেই। দুই রাত নির্ঘুম সে। ঘুমটাও কেমন বেইমানি করছে। একটু ঘুমালেও চোখের সামনে ভাসছে নাজিমুদ্দিনের ভয়ানক সেই রূপ। বারবার মনে পড়ে যায় ওর জন্য আজ ওর মা এই পৃথিবীতে নেই। আচ্ছা, ভালো তো সবাই বাসে। সবাই কি ভালোবাসাকে নিজের করে পায়? ও নিজেও নাহয় পেতো না। কিন্তু ওর মা তো বেচে থাকতো। একটু কষ্টের বিনিময়ে যদি ওর মা বেঁচে থাকতো তাহলে তো ও সারাজীবনও এই কষ্ট সহ্য করতে পারতো। ঘরে প্রবেশ করলো হামিদ, সে কিছুতেই চারুর এই বিষণ্ণ চেহারা সহ্য করতে পারছেনা।
– চারু কি করস?
– কি আর করবো?
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হামিদ লক্ষ্য করলো চারুকে। আগের মতো লাবণ্য নেই চেহারায়। দুচোখের নিচে কালি পড়েছে। দুদিনেই কত শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। ফর্সা মুখটাও কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।
– মাছ ধরতে যাবি চারু?
– আমার ভালো লাগছে না। তুমি যাও।
– আয় না। তুই না জন্মদিনের উপহার হিসাবে মাছ ধরতে চাইছিলি? তোর জন্য বরশিও কিনা রাখছিলাম। তাছাড়া বাড়ির বাইরে গেলে ভালো লাগবো। চার দেয়ালে বদ্ধ থাকিস না।
– আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। আমি যাবো না।
– মা যদি জানে তুই কষ্ট পাইতাছস তাইলে মাও তো কষ্ট পাইবো।
– মা আমাদের রেখে কেনো গেলো? ওই লোক কেনো আমার মা কে মেরে ফেললো?
– বেইমান গো কোনো কিছু করতে কোনো কারণ লাগে না। এমনকি মা যে মারা গেছে সেইটাও নানাজান রে জানায়ও নি সে।
– জানাবে কিভাবে? যখন দেখবে মেয়ের কবর দেওয়ার আগে সে আরেকটা বিয়ে করেছে তখন কি নানা তাকে ছেড়ে দিবে?
– এইহানে আর থাকতে ইচ্ছা করে না। আয় তোর মাছ ধরতে হইবো না। আমি ধরমু তুই দেখিস কিন্তু এই জাহান্নাম থেইকা তোর বাইরে যাওয়া জরুরি। এইহানে কোনো সাধারণ মানুষ থাকলে এমনিই মইরা যাইবো।
চারু কিছু বললো না। আসলেই এখানে ওর ভালো লাগছে না। সারারাত নির্ঘুম থেকে সারাদিন কাজ করে যাওয়াটা অনেক কষ্টকর। হামিদের সাথে একটু বাইরে বের হলে যদি একটু ভালো লাগে। চারু উঠে চুলগুলো খোপা করে নিয়ে তার উপর ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে দিলো। বাইরে যাওয়ার সময় সদর দরজায় দেখা গেলো শেফালীকে,
– তোমরা কই যাও?
– আমরা কই যাই ওইটা কি আপনারে বলা লাগবে? যান গিয়ে নিজের কাজ করেন।
– রাগ করো ক্যান? আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করতাছিলাম এই ভরসন্ধ্যায় তুমি মাইটারে লইয়া কই যাও। আজকাল তো দিনকাল তেমন ভালা না।
– দিনকাল কেমন সেইটা আমি বুইঝা নিবো। আমাকে কিংবা আমার বোনরে নিয়ে আপনের ভাবা লাগবো না। ওরে ক্যামনে সুরক্ষা দিতে হয় সেইটা ওর ভাই খুব ভালো কইরা জানে।
– কিন্তু তাই বইলা এই সন্ধ্যার সময় মাইয়াটারে নিয়া,,,
– আপনের সমস্যা কি বলেন তো? আমার বোনরে নিয়া আমি যহন খুশি যেইহানে খুশি যামু। আপনের কি? খবরদার আমার চারুর কাছ থেইকা আপনে দূরে থাকবেন। আমি চাই না আপনের কালো ছায়া আমার বোনের উপর পড়ুক। তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ওর ভাই এহনো বাইচা আছে। আপনের কিংবা আপনের জামাইয়ের ভাবতে হইবো না।
হামিদ শেফালীকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো। শেফালীও যেনো চুপ করে গেলো। হামিদ তার চেয়ে দুবছরের ছোট হলেও তার মধ্যে একটা আলাদা তেজ আছে। তার কথাবার্তা, আচার আচরণ তাকে সবকিছু থেকে আলাদা করে। হামিদের দুবছরের বড় হয়েও শেফালী আজ অবধি হামিদের উপর কথা বলার সাহস অর্জন করতে পারেনি। তার প্রতিটা ধমকেই যেনো শেফালীর অন্তরাত্মা অবধি কেপে উঠে। শেফালী নাজিমুদ্দিন কে বিয়ের আগেই জানতো, হামিদের উপর তার রাজ চলবে না কিন্তু চারুকে ইচ্ছেমতো কষ্ট দিতে পারবে এমন ভাবনা নিয়েই ছিলো সে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ কাহিনী বদলে গেছে। হামিদকে নিজের কথার উপর রাখা তো যায়ই না উল্টো চারুকেও কিছু বলা যায় না। হামিদ নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আগলে রেখেছে চারুকে। এই তিনদিনে চারুর সাথে কোনোরকম উল্টাপাল্টা আচরণ করার সাহস সে পায়নি। নাজিমুদ্দিন চলে যায় কাজে। বাসায় শুধু সে, হামিদ আর চারু তাই তাদের দুজনের উপর বিশেষ করে হামিদের উপর কথা বলার সাহস রাখতে পারেনা শেফালী। কিন্তু এমনটা হওয়ার ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই ওদের দেখে আসছে শেফালী। হামিদের সাথে চারুর সম্পর্ক তেমন ভালো ছিলো না। আর পাঁচটা পিঠাপিঠি ভাইবোনের সম্পর্কে যেমন ঝগড়া হয় হামিদ আর চারুর সম্পর্কও তেমন ছিলো। এমনকি হামিদ কখনো চারুকে কাদানোর একটা সুযোগও ছাড়তো না। চারুও ঠিক তাই। এমনই দেখে নাজিমুদ্দিনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিলো কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ দৃশ্যপটই পরিবর্তন। কি এমন হলো যে, হামিদ এতটা বদলে গেলো? আর মনোরমার মৃত্যুর পর চারুর প্রতি এত ভালোবাসাই তার কিভাবে বেড়ে গেলো?

সম্পূর্ণ খালি হাতে শিহাবকে বাসায় দেখে অবাক হলেন বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ। এই সময় শিহাবকে কেউই এখানে আশা করেনি। গ্রাম থেকে যাওয়ার পর তিনমাসের মধ্যে শিহাব আগে কখনো গ্রামে আসেনি আর এইবার তিনদিনও হয়নি শিহাব বাড়ি পৌঁছে গেছে। নিশ্চয়ই সকালে গাড়িতে উঠেছিলো তাই রাতে পৌছেছে। তিন দিনের মাথায় হঠাৎ কি এমন প্রয়োজন পড়লো যে শিহাব নিজের সব প্রয়োজন ও কাজ ফেলে মাত্র তিনদিনের মাথায় গ্রামে ফিরে এলো?
– তুই? হঠাৎ এইহানে? মানে কাউরে না জানায়া আসলি যে?
– আসলে মা ওই তাড়াহুড়োয় আমি আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেগুলোই নিতে এসেছি।
– তাইলে তুই ফোনে জানায়া দিতি। কাউরে দিয়া পাঠায়া দিতাম। তুই আবার এত কষ্ট করতে গেলি ক্যান বাপ?
– কেনো? আমি এসে কি তোমাদের সমস্যায় ফেলে দিলাম?
– না না তা হইবো ক্যান? আমি তো এমনেই কইতাছিলাম।।
– আসলে মা কাগজ গুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাই যাকে তাকে দিয়ে সেগুলো নিতে চাইছিলাম না। নিজে এসে নিজে যাওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হলো তাই চলে এসেছি।
– ভালো করছস। কয়দিন থাকবি তো?
– না মা থাকবো না। কাল সকালেই বেড়িয়ে পড়বো। রাত না হলে তো আজই চলে যেতাম।
জমিদার গিন্নি আবার কিছু একটা বললেন কিন্তু সেটা কানে গেলো না শিহাবের। কিছুটা দুরেই বিষন্ন মুখে বসে আছে শাওন। সে হয়তো এখনো শিহাবকে খেয়ালই করেনি। কিন্তু শাওন হঠাৎ বিষন্ন কেনো? ওর তো খুশি থাকা উচিত ছিলো। চারুর সাথে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে শিহাব। চারু এখন তার। হ্যাঁ প্রথমে হয়তো কিছু সমস্যা হবে কিন্তু মা কে বোঝালে নিশ্চয়ই মেনে নেবে। এই সাময়িক সমস্যার জন্য নিশ্চয়ই শাওন বিষন্ন নয়। তাহলে ওর কি হয়েছে? শাওনের বিষন্ন মুখ সহ্য হয় না শিহাবের।
– কি রে কি করছিস?
শিহাবের কথায় শাওন ওর দিকে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো সে। বুকে কয়েকবার থুতু ছেটালো সে।
– ভাইজান তুমি? তুমি সত্যিই আসছো নাকি শুধু আমিই তোমারে দেখছি?
শিহাব ভ্রুকুটি করলো। শাওনের কথার মর্মদ্বার করতে পারেনি সে।
– আমি খুব কইরা চাইতাছিলাম তুমি এইহানে আসো কিন্তু আমার এই চাওয়াটা যে পূরণ হইবো সেইটা আমি কল্পনায়ও ভাবি নাই।
– কেনো? কি হয়েছে?
– তোমার লগে আমার অনেক কথা আছে। এইহানে বলা যাইবো না। কিন্তু শুইনা রাখো আমার সমস্যার সমাধান তোমারে করতেই হইবো। কি করবা না?
– সমস্যা জানলে তো সমাধান করবো।
– সমস্যা জানবা কিন্তু তুমি আমারে কথা দাও সমাধান তুমি করবা।
– আজ অবধি তোর কোনো চাওয়া অপূর্ণ রেখেছি আমি? তাহলে এইটা কেনো রাখবো?
শাওনের চোখেমুখে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো। এতক্ষণে তার মুখ থেকে বিষণ্ণতা দূর হয়েছে। সে জানে শিহাব যখন একবার বলেছে তার সমস্যার সমাধান হবেই। শিহাব চুপচাপ উঠে নিজের ঘরের উদ্দেশ্য চলে গেলো। ভেবেছিলো সকালে চারুকে দূর থেকে দেখেই এখান থেকে চলে যাবে কিন্তু কে জানে শাওনের আবার কি সমস্যা? ওর অনুমান ভুল না হলে কিছুক্ষণের মাঝেই শাওনের ওর ঘরে আসার কথা। হলোও তাই, শিহাবের বিছানাতেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো সে।
– কি রে তোর কি বিছানা নাই? আমার বিছানায় কি?
– এমন করো ক্যান? তোমার জিনিস আর আমার জিনিস কি আলাদা? যা তোমার তা আমার।
শিহাব একবার বিড়বিড় করে শাওনের কথাটা আওড়ালো। ঠিকই বলেছে সে। শিহাবের সবকিছুই তো শাওনের। এমনকি ওর ভালোবাসার মানুষটা পর্যন্ত শাওনের।
– বিড়বিড় কইরা কি বলো ভাইজান?
– কিছু না। তুই কি একটা সমস্যার কথা বলছি না?
শাওন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই দীর্ঘশ্বাসই প্রমান করে কতটা কষ্টে আছে সে। চারুকে ছাড়া একমুহূর্তও থাকা তার জন্য সম্ভব না। সেদিনের পর থেকে আজ অবধি চারুর সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছে সে কিন্তু বরাবরের মতো ও ব্যর্থ। আজ অবধি কোনো কাজই সঠিকভাবে করতে পারেনা সে। শিহাবের সাথে ওর পছন্দ এক হলেও কাজকর্মে দুজনই ভিন্ন।
– চারু আমার সাথে কথা বলে না ভাইজান
– কেনো?
– তুমি যহন বিয়াতে মানা কইরা দাও তহন ওর বাবা ওর মা রে অনেক মারছে। এমনকি একেবারেই মাইরাই ফেলে। এতেও শান্তি হয় নাই তার। ওইদিনই আবার অন্য এক মাইয়ারে বিয়া কইরা আনছে। বয়সও বেশি না। এহন চারু মনে করে ওর জন্যই খালাম্মা মারা গেছে কিন্তু ভবিষ্যতে যেনো এই নিয়া আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় তাই সে আর আমার লগে কথা বলে না। ওর মনে হয় যদি ও তোমারে বিয়া করতে রাজি হইয়া যাইতো তাইলে ওর মা বাইচা থাকতো।
শিহাব স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। চারুর মা মারা গেছে? তার মনে পড়ে গেলো সেদিনের চারুর বলা কথাটা, “আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না। বাবা আমার মা কে খুব মারবে। একেবারে মেরেও ফেলতে পারে।” শিহাব নিজের ভিতরে একধরনের অপরাধবোধ অনুভব করলো। সে যদি মানা না করতো তাহলে আজ একজন মানুষ পৃথিবীতে বেচে থাকতো।

সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ পরেই বাসায় ফিরে এসেছে হামিদ আর চারু। এইবার মাছ ধরার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে। প্রতিবার দুইজন প্রতিযোগিতা করে মাছ ধরে আর এইবার দুজন মিলে মাছ ধরেছে। অনেকগুলো মাছই ধরেছিলো তারা কিন্তু সেগুলোকে বাসায় আনেনি। নদীতেই ছেড়ে দিয়ে এসেছে। দুজনের ইচ্ছাতেই হয়েছে এটা। তারা তো মাছ খাওয়ার লোভে মাছ ধরেনি। এই জাহান্নামের ক্লান্তি আর অবসাদ কাটিয়ে কিছুটা শান্তির আশাতেই মাছ ধরতে এসেছিলো। মাছ ধরা শেষে আবার সেগুলো কে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। বাড়িতে ফিরেই দেখতে পেলো নাজিমুদ্দিন চলে এসেছে। দুজনকে একসাথে দেখে কিছুই বললেন না তিনি। আজকাল এই দুজনকে খুব একটা সুবিধার মনে হয় না তার কাছে। আগে তো দুইজন দুইজনের ছায়া দেখলেও ঝগড়া করতো আর এখন কি না এই দুজনকে আলাদাই করা যায় না। গ্রামবাসীর মুখে নাজিমুদ্দিন শুনেছে মরার আগে মনোরমা দুজনের কানে কানে কিছু একটা বলে গেছে কিন্তু কি বলেছে তা তাদের জানা নেই। মনোরমা ওদের দুজনকে কি এমন বললো যে রাতারাতি ওদের মধ্যে এতটা পরিবর্তন। তাছাড়া আজকাল চারুও যেনো মুখেমুখে কথা বলতে শিখেছে। কাল হামিদকে একটা গালি দেওয়ায় চারু নাজিমুদ্দিনের মুখের ওপর কেমন পাল্টা জবাব দিলো। চারু তাকে ঘৃণা করতো সবসময়ই কিন্তু মুখের ওপর কথা বলার এত সাহস তো আগে তার ছিলো না।
ঘরে ঢুকেই নিজের ছোট্ট চৌকিতে গা এলিয়ে দিলো হামিদ। খুব ক্লান্ত লাগছে আজ তাকে কিন্তু ক্লান্ত হলেও আজ সে কিছুটা প্রশান্তি পেয়েছে। মায়ের মৃত্যুর পর এই প্রথমবার একটু খুশি হয়েছিলো চারু আজ। ওর মা তো ওকে বলেছে চারুর খেয়াল রাখতে। যদি চারুকে খুশিই না রাখতে পারে তবে সে কেমন খেয়াল রাখলো?
– এই অসময়ে শুয়ে আছো কেনো?
– শরীর টা ভালো লাগতাছে না। কিছু বলবি?
– না। এই অসময়ে শুয়ে আছো তাই জিজ্ঞেস করলাম। কিছুক্ষণ আগে তো ঠিকই ছিলে হঠাৎ কি হলো? জ্বর এলো নাকি?
চারু হামিদের কপালে হাত দিয়ে দেখলো শরীর গরম কি না। নাহ, তাপমাত্রা একেবারে স্বাভাবিক আছে। কিন্তু এই স্বাভাবিক তাপমাত্রা দেখে চারু যেনো আরো চিন্তায় পড়ে গেলো। স্বাভাবিক তাপমাত্রা তাহলে হামিদের কি হলো? হামিদ অবাক হয়ে দেখছে চারুর কাজকর্ম। এমন একটা ভাব যেনো হামিদের কি না কি হয়েছে।
– আমার কিছু হয় নাই। এমনেই একটু ক্লান্ত লাগতাছে। তুই চিন্তা করিস না।
হামিদের কথায় নিশ্চিন্ত হতে পারলো না চারু। মা তাকে বলে গিয়েছে ভাইয়ের খেয়াল রাখতে। আর মা চলে যাওয়ার কিছুদিনের মাঝেই কি না হামিদ অসুস্থ হয়ে পড়লো। হামিদের অবাকের সীমা যেনো বেড়েই চলেছে। হামিদকে সুস্থ করার জন্য এই বাচ্চা মেয়েটার কত প্রচেষ্টা। হামিদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে। হঠাৎ সে আরো একটা জিনিস আবিষ্কার করলো, চারুর দিকে তাকিয়ে থাকলে ওর মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। বড় বোন নাকি মায়ের আরেক রূপ হয়, আচ্ছা ছোট বোনও কি মায়ের রূপ? হ্যাঁ নিশ্চয়ই মায়ের রূপ নইলে চারু কেনো এত উতলা হবে ওর জন্য? চারু হামিদকে সাবধানে থাকতে বলে রান্নাঘরে চলে গেলো। আজ দুপুরে শেফালী রান্না করেছিলো। এক কথায় অখাদ্য যাকে বলে। ও কিংবা হামিদ একটা দানাও মুখে দিতে পারেনি অপরদিকে নাজিমুদ্দিন চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে কিন্তু খাওয়ার পরে উঠে চারুকে বলেছে চারু যেনো তিনবেলা রান্না করে। বলাই উচিত, শেফালীর করা রান্না ও নিজেই খেতে পারে কি না কে জানে। দুপুরে প্রায় সব খাবারই পচেছে। চারু ভালোই বুঝেছে, ও রান্না না করলে বাড়িতে প্রত্যেকের অভুক্ত থাকতে হবে। কে জানে শেফালীকে কি দেখে বিয়ে করেছে নাজিমুদ্দিন। অবশ্য মানুষের রূচি বিকৃত হলে সে আর কত কিছুই তো করতে পারে। চারু রান্নার সময়ে শেফালীকে বললো সবজিগুলো কেটে দিতে। শেফালী মানা করলো না তবে তার কাজ এতটাই ধীরগতির যে চারুর রান্নার সাথে কিছুতেই সেটা তাল মেলাতে পারলো না। প্রথম দিন থেকেই চারু এইটা লক্ষ্য করেছে। শেফালী সব কাজ ধীর গতিতে করে। চারু যেখানে তিন-চার টা কাজ করে ফেলে শেফালী সেখানে একটা কাজ নিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। ফলাফল সকল কাজ চারুকে একাই করতে হয় কিন্তু বাইরে থেকে মনে হয় দুজন মিলে কাজ করছে। এমনকি মনোরমা থাকতে যেসব কাজ চারু ছুয়েও দেখেনি সেসব কাজ পর্যন্ত করতে হচ্ছে ওকে। কে জানে শেফালী এইসব ইচ্ছে করে করে নাকি আসলেই ওর কাজ ধীত গতির।
– কি রে চারু, তোর রান্না শেষ হয় নাই?
– হ্যাঁ প্রায় হয়ে এসেছে।
– হইয়া আইছে আবার কি কথা? এক হইছে নইলে হয় নাই। নবাবের বেটি একটু পর পর ঘরে চইলা যাও তোমার রান্না কি হইবো?
– ভাইয়ের শরীর টা ভালো না। তাই দেখতে যাচ্ছিলাম তার কিছু লাগবে কি না।
– কি রান্না করলি?
– ভাত, শাক, আলুর ভর্তা আর ডিম।
– ডিম টা আবার রানতে হইবো ক্যা? সব একবারে খাইতে মন চায়?
– ভাইয়ের শরীর ভালো না। শুধু আপনার জন্য আর ওর জন্য রান্না করেছি।
– হ আমার কষ্টের কামাই এমনেই ধ্বংস কর।
– সংসারে তো টাকা আমার ভাইও দেয়। তাহলে সে অসুস্থ হলে ডিম খেতে পারবেনা কেনো? সে নিজের টাকাতেই খাচ্ছে।
– মুখে বুলি ফুটছে না তোর?
চারু আর কিছু না বলে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। ও আর হামিদ ঘরে বসেই খেয়েছে। আর নাজিমুদ্দিন আর শেফালী বারান্দায় খেয়েছে। এইটা নিয়েও কম কথা বললো না নাজিমুদ্দিন। হামিদ কোনো জবাব দিলো না। আজকাল এমন মানুষের সাথে কথা বলার রূচি হয় না তার।
রাতে হঠাৎই কোনো কারণ ছাড়া ঘুম ভেঙে গেলো চারুর। বারবার চেষ্টা করেও ঘুম এলো না। হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলেই আবার ঘুম আসবে। চারুর ছোট থেকে একটা স্বভাব, ঘুম ভাঙলে যদি হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে শুতে যায় তাহলে তার তাড়াতাড়ি ঘুম আসে। আজকের রাতটা চারু নির্ঘুম কাটাতে চাইলো না। কলঘরের দিকে যেতেই ফিসফিসিয়ে শেফালীর আওয়াজ শোনা গেলো,
– আপনের পোলার সমস্যা টা কি?
– তুমি ওরে লইয়া এত ঝামেলা করতাছো ক্যান? তুমি তোমার মতো থাকো না।
– আপনে বুঝেন না আমি ক্যান ঝামেলা করতাছি? সরাসরি একটা কথা শুইনা রাখেন আপনের পোলারে আমার পছন্দ।
– জানি আমি। এহন আমারে কি করতে কও?
– আপনের মাইয়ারে কোনোরকমে ওই ঘর থেইকা সরান। আমি রাইতে হামিদের লগে থাকতে চাই।
– মাথা খারাপ হইছে তোমার?
– মাথা খারাপ হওয়ার কি আছে? বিয়ার আগে যদি আমি আপনের লগে রাইত কাটাইতে পারি তাইলে ওর লগে কাটাইলে কি সমস্যা?
– আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি জানি আমারে ছাড়াও তুমি অনেকের সাথেই শুইছো। কিন্তু হামিদ তোমারে মানবো না। ও ওমন পোলা না।
– ওইটা আমি বুঝমু। আপনে চারু রে সরান।
চারু স্তব্ধ হয়ে গেলো। আর কিছু শোনার শক্তি নেই তার। একটা মানুষ আর কত জঘন্য হয়?

শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….