আমি সেই চারুলতা পর্ব-১০

0
204

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ১০ (প্রথম অংশ)
_______________________

চারুর একেবারে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে আছে শিহাব। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে চারুর দিকে। মাত্র তিনদিনে কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার। নাজিমুদ্দিন শিহাবকে উল্টোপাল্টা কথা শোনাবে ভেবেছিলো চারু কিন্তু এমন কিছুই হলো না। জমিদার বাড়িতে অনেক টাকার দেনা রয়েছে নাজিমুদ্দিনের তাই হয়তো শিহাবের সাথে না চাইতেও ভালো আচরণ করতে হচ্ছে তাকে। সে গেছে বাজার করতে, আজ নাকি শিহাবকে এখানে খেয়ে যেতে হবে। শিহাবের এসবে কোনো মাথাব্যথা নেই। ও এখানে এসেছে চারুর সাথে কথা বলতে। এইটাই হয়তো তার এই মেয়েটিকে শেষ বারের মতো দেখা। সে মনেমনে পণ করে নিয়েছে, যতই কষ্ট হোক আর আসবে না ওকে দেখতে। যে মেয়েটি তার নয় তাকে দেখতে চাওয়ার কোনো মানেই হয় না। শিহাবের একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে চারু তবে সেই চাহুনি তে কোনো কামনা নেই, আছে একরাশ ভালোবাসা কিন্তু সেই ভালোবাসার মূল্য দেওয়ার সামর্থ্য চারুর নেই। অনেকক্ষণ নিরবতা বজায় রেখে শিহাব তার ভরাট কণ্ঠস্বর নিয়ে বললো,
– কেমন আছো চারুলতা?
– আছি যে সেটাই কত, আবার কেমন আছি।
চারু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শিহাব ভেবে পায় না কতটা কষ্ট পেলে মাত্র পনেরো বছরের একটা মেয়ে এমন ভাবে কথা বলতে পারে। তার কথার মধ্যেই তার কষ্টের গভীরতা প্রকাশ পায়। শেফালী গিয়েছে শরবত বানাতে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেটা এনে শিহাবের সামনে রাখলো। নাজিমুদ্দিনের কাছে সে শুনেছে, শিহাবই নাকি চারুলতা কে বিয়ে করবে না বলে দিয়েছে। ব্যাপারটা শেফালীর কাছে খুব ভালো লেগেছে। মনে হয়েছিলো চারুর অহংকার ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে একেবারে। চারুলতাকে পছন্দ না করায় যেনো শেফালীর খুব বড় একটা জিত হয়েছে। শিহাব চারুর দিকে তাকিয়েই শেফালিকে ধন্যবাদ জানালো। চারু একবার শেফালীর দিকে তাকালো। তার পরনের ওড়না এলোমেলো। কোনোভাবে শুধু মাথাটা ঢাকা। বুকের অংশ ঢাকা নেই কিন্তু এর বুকের নীচের দিকে ঢাকা। চারু ভ্রু কুচকে শেফালীর দিকে তাকালো। কেমন বিশ্রী ভাবে ওড়না নিয়ে রেখেছে। শিহাব এখনো খেয়াল করেনি তাকে কিন্তু বাসায় একজন পরপুরুষের সামনে এভাবে ওড়না নেওয়ার কি মানে? লজ্জা নামক বস্তুটা কি তার মাঝে নেই? অবশ্য থাকার কথাও নয়, যে মেয়ে আপন চাচাকে বিয়ে করে তার অনুমতিতে আপন চাচাতো ভাইয়ের সাথেই শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে চায় তার আবার কিসের লজ্জা? শিহাব শরবত টা মুখে নিয়েই কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। চিনি বেশি হওয়ায় মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। সে ভদ্রভাবে গ্লাসটা সরিয়ে রাখলো। সেটা চোখ এড়ালো না চারুর।
– আপনি একটু বসুন, আমি শরবত বানিয়ে আনছি।
– তোমার বাড়িতে আমি খেতে আসিনি চারুলতা। তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।
– আমার সাথে?
– হ্যাঁ। তোমার ভাই সম্মন্ধে কিছু কথা।
শেফালী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শিহাবের দিকে। তার আশায় জল ঢেলে দিয়ে শিহাব বললো,
– আপনি কি একটু ঘরে যাবেন? চারুলতার সাথে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা ছিলো।
শেফালীর মুখ কালো হয়ে গেলো কিন্তু শিহাবের গম্ভীরমুখে বলা কথার প্রতিউত্তর সে দিতে পারলো না। শেফালী ভিতরে চলে যেতেই চারু বললো,
– কি করেছে আমার ভাই?
– কিছুই করেনি। তোমার সৎ মা কে সরানোর জন্য তোমার ভাইয়ের নাম ব্যাবহার করেছি। দুঃখিত!
– ওহ, তো কি বলবেন আমাকে?
– তুমি নাকি শাওনের সাথে কথা বলছো না?
– না। বলার প্রয়োজনও মনে করছি না। আমার একটা ভুলের জন্য আমার মাকে আমি হারিয়েছি। শাওন ভাইয়ের দোষ আমি দিচ্ছি না। সেই মুখও নেই আমার। দোষটা সম্পূর্ণই আমার। সে দোষের ভাগিদার আমি কাউকে করতে চাই না কিন্তু ভুলটা শুধরে নিতে চাই।
– তোমার কোনো দোষ নেই চারুলতা। ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে।
– ভাগ্যেরও কোনো দোষ নেই। বাবার কথা মেনে নিলে আমার মা আজ বেচে থাকতো।
– তোমার কি মনে হয়, তুমি না বললে আমি বিয়ে ভাঙতাম না? যেখানে আমার ছোট ভাই তোমাকে পছন্দ করে সেখানে আমি কিভাবে তোমাকে বিয়ে করতাম? আমি নিজেই এই বিয়ে ভেঙে দিতাম।
চারু কিছু বললো না। ও জানে শিহাব মিথ্যে বলছে। চারু না বললে ও বিয়ে টা ভাঙতো না। চারু যেনো অপরাধবোধে না ভোগে তাই এইসব কথা বলে যাচ্ছে।
– চারুলতা, দেখো যা হওয়ার হয়েছে। এইসব ভুলে যাও। শাওনের সাথে নিজের জীবন সুন্দর ভাবে শুরু করো। ও অনেক ভালোবাসে তোমাকে।
– ভালোবাসে বলেই কি আমাকে পেতে হবে? ভালো তো আপনিও বাসেন, আপনি কি আমাকে পাবেন?
– না। আমি তোমাকে পাবো না কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো না কিন্তু শাওন তোমাকে পাবে কারণ শাওনকে তুমি ভালোবাসো।
– বাসি না।
– মিথ্যে কথা। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তাহলে মানবো।
– আপনি প্লিজ আমাকে জোর করবেন না। আমি বাচ্চা নই, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারি আমি।
– বাচ্চা নও? বয়স কত তোমার?
– গ্রামের মেয়েদের বয়স কোনো ব্যাপার না। তারা বয়স হওয়ার আগেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়।
– বাজে কথা এসব। তুমি এখনো ছোট তাই বুঝতে পারছো না। আমার কথা শোনো, যা হয়েছে ভুলে যাও আর শাওনকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না। ও খুবই ভালোবাসে তোমাকে।
চারুলতা কোনো উত্তর দিলো না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো সে।
– চারুলতা আমি আশা করবো ব্যাপারটা তুমি ভেবে দেখবে। আসছি!
– খেয়ে যাবেন না?
– অন্য একদিন। আজ আসি।
– একটা প্রশ্ন করি?
– তোমার অনুমতির দরকার নেই। করতে পারো প্রশ্ন।
– আপনি কখনো আপনার আপন ভাতিজিকে বিয়ে করতে পারবেন?
– এক থাপ্পড় দিয়ে তোমার সব কয়টা দাত ফেলে দেবো ফাজিল মেয়ে। এইটা কোন ধরনের মজা? আমাকে মজার মানুষ মনে হয় তোমার?
চারু এইবার ডুকরে কেদে উঠলো। চারুর কান্না দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো শিহাব। ও ভাবেনি সামান্য রাগের বসে বলা এই কথার জন্য চারু কান্না করতে পারে।
– চারুলতা আমি দুঃখিত। তুমি প্লিজ কান্না করো না। আমি আর বকা দেবো না তোমাকে। এইটা খুবই বাজে ধরনের মজা ছিলো তাই এভাবে বকেছি। তুমিই বলো এইটা কখনো সম্ভব? তুমি প্লিজ কান্না করো না। আমি আর বকবো না তোমাকে।
– আপনার বকার জন্য কান্না করছি না আমি।
– তাহলে?
চারু চুপ করে গেলো। কি বলবে সে শিহাবকে? নিজের বাবার জঘন্যতম কাজের কথা? কিন্তু শিহাব ছাড়া এই কথাটা আর কাকে বলবে সে? হামিদের পর যেনো আজ শিহাবকেই ওর সবচেয়ে বেশি আপন মনে হচ্ছে। শাওনকে দেখেও তার এতটা আপন মনে হয়নি যতটা শিহাবকে মনে হচ্ছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধেও ওর মন বিশ্বাস করতে চায় শিহাব সব ঠিক করে দেবে। হয়তো তার ব্যক্তিক্তই এমন।
শিহাবের কিছু একটা ঠিক মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে যা চারু বলতে চাইছে না।
– কি হয়েছে চারুলতা?
এবারেও চারুলতা নিশ্চুপ রইলো কিন্তু উত্তর হিসেবে তার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। শিহাব সেটা মুছিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালেও সেটাকে আবার নিজের দিকে ফিরিয়ে আনলো। এইটা ঠিক নয়। চারু শুধুই শাওনের। তাকে ছোয়ার অধিকার শিহাবের নেই।
– আমাকে বলো চারুলতা। আমি সব ঠিক করে দেবো।
চারু একবার শিহাবের দিকে তাকালো। ওর খুব করে বিশ্বাস করতে হচ্ছে শিহাব সব ঠিক করে দেবে। কিন্তু আসলেই কি এটা হবে? হওয়া সম্ভব?
– বলবো। একদিন নিশ্চয়ই বলবো তবে আজ নয়।
– ঠিক আছে। তোমার বলায় অপেক্ষায় থাকবো। আসছি। আমার টেলিফোন নাম্বার টা রাখো। প্রয়োজনে যোগাযোগ করবে। যখন তোমার মনে হবে আমাকে তোমার প্রয়োজন নিঃসংকোচে ফোন করবে। শাওনের বড় ভাই হিসেবেই না হয় ফোন করো।

শিহাব চলে যেতেই উঠে দাঁড়ালো চারু। কিছুক্ষণের মাঝেই হামিদ চলে আসবো। মা মারা যাওয়ার পর আজ প্রথমবার কাজে গিয়েছে সে। রান্না তো করতে হবে।

– আমার কি মনে হয় জানস?
– কি মনে হয়।
– মনে হয় ওরা বিয়া করে নাই। নইলে তুই বল কোন কাজি চাচার লগে আপন ভাতিজির বিয়া দেয়?
– হয়েছে বিয়ে।
– তুই ক্যামনে জানলি বিয়া হইছে? নাও হইতে পারে।
– ভাব দেখলেই বোঝা যায়। নইলে এত জোর গলায় তারা বলতে পারতো না বিয়ের কথা। তাছাড়া কাজি হয়তো জানতো না তাদের সম্পর্কের কথা। দূর থেকে শুধু বিয়ে করে নিয়ে আসছে।
– হ তা হইতে পারে। আইজ কাজটা ছাইড়া দিছি। নতুন একটা কাজের সন্ধান পাইছি। পাঁচশো টাকা দিবো। দুইজনের খাওয়া পড়া হয়ে গেলেও বাড়ি ভাড়া বা তোর পড়ার খরচ হইবো না। কমপক্ষে দেড় হাজারের মতো বেতনের একটা কাজ লাগবো ভালো কইরা দুইজনের থাকতে গেলে।
– এত টাকা বেতনের কাজ তোমাকে কে দিবো?
– যেইহানে যামু ওইহানে অনেক মানুষ কাজ করে। তাদের কাউরে ধইরা ভাবতাছি বড় জায়গায় কাজে লাইগা যামু।
– কতক্ষণ কাজ করতে হবে নতুন কাজে?
– বারো ঘন্টা। সকাল ৭ টার থেইকা রাত ৮ টা। মাঝখানে একঘন্টা খাওনের সময় দেয়। জায়গাটা একটু দূরে। তাড়াতাড়ি যাওন লাগবো।
– বাসায় আসবে না?
– সময়ে কূলাবে না। খাওন দিয়া দিস।
– আচ্ছা।
– তুই আমার লগে বইসা খাইয়া নে।
চারু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রান্নাঘরে চলে গেলো খাবার আনতে। শেফালীকে দেখে মেজাজটাই বিগড়ে গেলো তার কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। আজ সকালের কথা আর কাল রাতের কথা মনে পড়তেই চারু ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। শিহাব ভালো ছিলো বলেই আজ শেফালীর দিকে তাকিয়েও দেখেনি অন্য কেউ হলে তো,,,,। খাবার নিয়ে ঘরে চলে গেলো চারু। হামিদের সাথে বসে খেয়ে নিলো সে। গত রাতের কথা হামিদকে জানায়নি সে। জানানোর ভাষাও খুজে পায়নি। খাওয়া শেষে ঘরের বাইরে যেতেই শেফালী চারুকে ধান ভাঙার কাজে লাগিয়ে দিলো। চারু পড়লো মহা বিপাকে। এতদিন যাবত সব কাজই মনোরমা তাকে শিখিয়েছে কিন্তু ধান ভাঙার কাজ শেখায়নি। কিছুতেই ঢেকি টাকে নিজের আয়ত্বে আনতে পারছে না সে। এই বাহানায় শেফালী তাকে একটার পরে একটা ধমক দিয়ে চলেছে। সে বোধহয় এখনো খেয়াল করেনি হামিদ ঘরে আছে তাই এত সাহস নিয়ে এভাবে চিৎকার করছে চারুর উপর। শেফালীর চিৎকারে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো হামিদ। হামিদকে দেখে শেফালী ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো,
– তুমি? তুমি এহোনো যাও নাই?
– গেলে কি আর এইহানে থাকতাম? আপনে ওর উপর চিল্লাইতাছেন ক্যান?
– চিল্লাইতাছি না তো। আমি তো ওরে কাম শিখাইতাছি। বাচ্চা মাইয়া এইসব করতে পারেনা।
– ওরে আপনের শিখানো লাগবো না। আপনে নিজে আগে ওর কাছে রান্না শিখেন। বেহাল অবস্থা রান্নার। আমার বইন হাত পুরায়া রান্ধে আর আপনেরা খান। ও যা পারে তাই করবো ও।
হামিদের এই অপমান মুখ বুজে সহ্য করে নিলো শেফালী সে কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিলো তার আগেই হামিদ বললো,
– চারু, আমার জামা কাপড় গুলা ধুইয়া দিস তো। এহনই দে। এমনেও তো উনি কিছুই করে না। ধানটা না হয় ভাঙ্গুক। আর কয়দিন পরের মাইয়ার উপর খাইবো?
– পরের মাইয়া হইবো ক্যান? চারু তো আমার মাইয়ার মতোই। দাও তোমার জামাকাপড় দাও, আমি ধুইয়া দেই।
– লাগবো না। আপনের ধোয়ায় জামাকাপড় পরিষ্কার হয় না। চারু তুই যা।
হামিদের হাত থেকে জামাকাপড়গুলো নিয়ে চারু চলে গেলো কলঘরের দিকে। চারু জানে ধান ভাঙা থেকে বাচানোর জন্যই হামিদ ওকে জামাকাপড় ধুতে দিয়েছে। হামিদ যতদিন আছে চারুকে কষ্ট পেতে হবে না বলে সে নিশ্চিত হয়ে গেলো তবে চারু কি জানে এই সুখও তার বেশিদিন টিকবে না। খুব শীঘ্রই হামিদও আলাদা হয়ে যাবে তার কাছ থেকে।

সকাল থেকেই নিজেকে কিছুটা হালকা লাগছে। এই অনুভূতি টা আগে কখনো হয়নি। মনোরমার মৃত্যুর পর থেকে বুকের ভিতরটা কেমন ভার হয়ে ছিলো, মনে হচ্ছিলো কোনো বড় পাথরের নীচে আটকে আছে সে। আর আজ মনে হচ্ছে বুকের ভিতর থেকে সে পাথরটা নেমে গেছে। কি তার কারণ? সকালে ঘুম থেকে ওঠার পড়েও এই অনুভূতি টা ছিলো না তার। তাহলে কখন থেকে হলো? চারুর অবচেতন মন উত্তর দিলো শিহাব আসার পর থেকে। হুম আসল উত্তর সেটাই। শিহাব আসার পর থেকেই নিজেকে খুব হালকা লাগছে। আজ অবধি কেউ ওকে বলেনি, “আমি সব ঠিক করে দেবো।” শিহাব বলেছে। তার কথার ধরনেই যেনো মন ভালো হয়ে গেলো চারুর। চারু অনুভব করলো, শিহাবকে ভালো বাসে না ঠিকই কিন্তু শিহাবকে খুব ভরসা করে সে। শিহাব যেমনি ওর ভরসার জায়গা তেমনি খুব সম্মানের জায়গাও অধিকার করে নিয়েছে। শিহাব সত্যিই খুব ভালো তবে পৃথিবীর সবাই হয়তো সাক্ষী, ভালো মানুষদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। বিকেল বেলাই হামিদ বাসায় ফিরে এলো। কাজে গেলে সে এমন সময় আসেনা। কাজ ছেড়ে দেবে বলেই হয়তো আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছে,
– তুমি আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?
– তোরে কইলাম না কাজটা ছাইড়া দিছি। কিছু কাজ কইরা বেতন নিয়া আসলাম।
– নিশ্চয়ই পুরোটা দেয়নি। এরমাঝে তো চারদিন কাজে গেলে না।
– না পুরাই দিছে। আজ শেষ আজ শুইনা ভালোবাইসা ৫০ টাকা বাড়ায়াও দিছে। আমারে পুরা নিজের পোলার মতো ভালোবাসে উনি।
– যাও হাত মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে বসো। শরবত বানিয়ে দিবো?
– হুম দে। ক্লান্ত লাগতাছে। তোর রেজাল্ট কবে দিবো? আর স্কুল কবে খুলবো?
– জানুয়ারিতে স্কুল খুলবে আর রেজাল্ট এই মাসের শেষে দিকে কোনো একদিন দিবে। মাস্টারমশাই জানাবেন বলছেন।
– ভালো কইরা পড়াশোনা চালায়া যাবি চারু। যাই হইয়া যাক।
– হুম।
চারু চলে গেলো শরবত বানাতে। ঠান্ডা হোক, গরম হোক হামিদ শরবত খেতে খুব পছন্দ করে। শরবত বানিয়ে ঘরে নিয়ে যেতেই হামিদের হাতে দুটো প্যাকেট দেখলো সে। চারুর হাত থেকে শরবত নিয়ে এক চুমুকে খেয়ে নিলো।
– আস্তে আস্তে খাও। কেউ নিয়ে যাবে না।
– নিতেও পারস। তোরে দিয়া বিশ্বাস নাই।
নিজের কথায় নিজেই হাসলো হামিদ। তবে চারু হাসলো না, ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো হামিদের দিকে। হামিদ প্যাকেট দুটো চারুকে দিয়ে বললো,
– তোর জন্য আনছি। দেখ কেমন হইছে।
– কি এটা?
– দেখ।
চারু বড় প্যাকেটটা খুলতেই সেখান থেকে একটা চাদর বেড়িয়ে এলো। অন্য প্যাকেটে এক ডজন কাচের চুরি।
– এইসবের কি দরকার ছিলো?
– এমনেই দিলাম। তোরে তো কহোনো কিছু দেই নাই।
– টাকা গুলো সব খরচ করেছো না?
– সব না। কিছু আছে।
চারু চাদর টা গায়ে জড়িয়ে দেখলো। খুব পছন্দ হয়েছে তার। কাচের চুরি গুলো একহাতে পড়লো সে।
– কেমন লাগছে আমাকে?
– শেওড়া গাছের পেত্নীর মতো।
– ধুর, আমাকেই যতই সুন্দর লাগুক তুমি সবসময় শেওড়া গাছের পেত্নীর সাথেই আমাকে তুলনা করো।
চারুর বাচ্চামিতে হেসে ফেললো হামিদ।
– সবসময় শেওড়া গাছের পেত্নী লাগে না। মাঝে মাঝে বট গাছের পেত্নীও লাগে।
– তুমি হয়তো নিজের চেহারাটা কোনোদিন আয়নায় দেখো নাই। পুরো বিড়ালের মতো দেখতে তোমাকে। আমি কি কখনো কিছু বলেছি? বাইরে হাটতে যাচ্ছি আমি। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।
– হ যা। আমি একটু ঘুমায়া নেই তোর বিছানায়। ওই খুপরিতে আর ঘুম আহে না।
চারু চলে গেলো বাইরে। চারুর বাইরে যাওয়াটা চোখ এড়ালো না শেফালীর তবে সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালো না। হামিদকে বাসায় দেখেছে সে। চারুকে কিছু বললেই সে আবার গর্জে উঠবে। যদিও নাজিমুদ্দিন এখন বাসায় কিন্তু নাজিমুদ্দিনের হাবভাবও আজকাল খুব একটা ভালো লাগছে। মনে হয় যেনো সেও আজকাল হামিদকে কিছুটা সমীহ করতে শুরু করেছে। নিজের ছেলেকে সমীহ করার কারণ কি, নাকি সে হামিদ কে ভয় পাচ্ছে? শেফালী ভেবেছিলো চারু হয়তো আশেপাশেই আছে কিন্তু আধা ঘণ্টা পার হওয়ার পরেও তাকে বাসায় আসতে দেখা গেলো না। সে একবার চারুর ঘরের দিকে উকি দিলো। হামিদ ঘুমাচ্ছে। আজ হয়তো দূরে কোথাও গিয়েছিলো তাই তার পরনে লুঙ্গির বদলে প্যান্ট রয়েছে। এইটা নাকি নাজিমুদ্দিন তাকে জমিদার বাড়িতে যাওয়ার আগের দিন দিয়েছিলো। হামিদকে ঘুমাতে দেখে শেফালী ঘরের ভিতরে ঢুকলো। প্যান্টের সাথে একটা গেঞ্জি রয়েছে হামিদের পরনে। কাথাটা হাটুর একটু উপরে টানা। ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে হামিদের। নিশ্চয়ই সে গভীর ঘুমে। চারুও বোধহয় এখনো আসবে না। নাজিমুদ্দিনও পাশের ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। অবশ্য সে জেগে থাকলেও সমস্যা হতো না। শেফালী সদ্য যৌবনে পা দেওয়া এই ছেলেটাকে দেখছে। প্রতিবারই যেনো এর সৌন্দর্য বেড়ে চলে। ওর সুদীর্ঘ পল্লব বিশিষ্ট চোখ, খাড়া নাক ও হালকা চাপ দাড়ি যেনো ওর সৌন্দর্যকে হাজার গুনে বাড়িয়ে তুলছে। শেফালী গিয়ে খুব সাবধানে হামিদের বুকে হাত রাখলো। নাহ, হামিদের ঘুম ভাঙে নি। শেফালীর সাহস যেনো কিছুটা বাড়লো। সে শুয়ে পড়লো একেবারে হামিদের পাশে। খাটের পায়া থেকে একটা শব্দ হলো কিন্তু এবারেও হামিদের ঘুম ভাঙে নি। হয়তো সে খুবই ক্লান্ত বিধায় গভীর ঘুমে মগ্ন। শেফালী অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে খুব জোরে জড়িয়ে ধরলো হামিদকে। ফলাফলস্বরূপ, ঘুম ভেঙে গেলো হামিদের। হামিদ খুব জোরে একটা ঝাড়ি দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো শেফালীকে। শেফালীও পাগলের মতো আবার জড়িয়ে ধরতে গেলো হামিদকে। হামিদ হতভম্ব হয়ে গেছে। কিছুই যেনো মাথায় ঢুকছে না। শেফালী এমন করছে কেনো? শেষ পর্যন্ত নিজেকে শেফালীর কাছ থেকে ছাড়াতে না পারলে খুব জোরে একটা লাথি মারলো শেফালীকে। শেফালী খাট থেকে নিচে পড়ে গেলো। সেই অবস্থাতেই হামিদ কষিয়ে এক থাপ্পড় মারলো শেফালীকে,
– সমস্যা টা কি আপনের? এমন করতাছেন ক্যান?

★★★

অনেক দিন পর বিকেলে হাটতে বেড়িয়েছে চারু। এই কয়েকদিনেই গ্রামটা তার কাছে অপরিচিত লাগছে। চারু হাটতে হাটতে পৌছালো নদীর পাড়ে। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। মাঝেমধ্যে দু একটা পাখির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নদী প্রায় শুকিয়েই গেছে। সন্ধ্যায় আর কারো কাজ নেই এখানে তাই বাড়ি ফেরার আগে কেউই এখানে এসে নিজের সময় নষ্ট করতে চায় না। ব্যতিক্রম চারু, এই নদীর পাড়ে, নদীকে ঘিরে কত স্মৃতি তার। ছোটবেলায় নদীর পারের এই বড় গাছটার নীচে বসে মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল বানিয়ে খেলতো সে। হামিদ খেলতে না চাইলে জোর করে নিয়ে খেলতো। না খেললে কান্নাকাটি করতো তাই মনোরমা তাকে বন্ধুদের আসর থেকে উঠিয়ে তাকে চারুর সাথে খেলতে বসিয়ে দিতো। হামিদের এইসব মেয়েলি খেলা নিয়ে কম আপত্তি ছিলো না। কতবার যে চারুর গায়ে দু ঘা বসিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। শুধু যে হামিদকে নিজের খেলায় ডাকতো সেটা নয়। সে নিজেও গিয়ে হামিদের খেলায় অংশ নিতো। কানামাছি, গোল্লাছুট, সাত পাতা। হামিদ সহ হামিদের বন্ধুরা সবাই চারুর উপর প্রচন্ড বিরক্ত হতো। বিরক্ত হতো না কেবল শাওন। শাওনই তাকে প্রতিবার খেলায় নিতো। সে সবসময়ই চারুকে দুধভাত রাখতো কিন্তু তখন এর মানে চারু জানতো না। এখন ভাবতেই কেমন হাসি পাচ্ছে। ছোটবেলার সবচেয়ে বড় অপমান ছিলো খেলা না পারার কারণে দুধভাত। হঠাৎই কোথাও থেকে আগমন ঘটলো শাওনের। তার পরনে কালো রঙের শার্টের সাথে প্যান্ট। এই নিয়ে আজ দ্বিতীয় বারের মতো চারু শাওনকে শার্ট-প্যান্ট পরহিত দেখছে। এই ছেলেটার মায়া যেনো অফুরন্ত। কখনোই ফুরাবে না এই মায়া। সে এসে চারুর পাশেই সেই গাছটার নীচে বসে পড়লো। আজ সকালের আগে হলেও বোধহয় চারু এখান থেকে উঠে চলে যেতো কিন্তু এখন গেলো না। এখনও শাওনের সাথে কথা না বললে শিহাবের অপমান করা হবে। শিহাব তো আর যেমন তেমন মানুষ নয়। তাকে অপমানের সাধ্য চারুর নেই তাছাড়া শাওনের থেকে দুরে থেকে যে সে খুব একটা ভালো আছে তেমনটাও নয়,
– কেমন আছস চারু?
– দূরে সরে বসো শাওন ভাই। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।
– কেউ দেখবো না। এইহানে কেউই নাই।
– আসতে কতক্ষণ?
– ভাইজানের সাথে কথা হইছিলো তোর?
– হুম।
– আমি জানতাম আজ তুই আমার লগে দেখা করতে আসবি তাই তোর বাড়ির আশেপাশেই ছিলাম।
– তুমি তোমার ভাইকে খুব ভালোবাসো তাই না? বিশ্বাস করো।
– হুম বাসি তো কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভাইজান আমারে ভালোবাসে।
– একটা কথা বলি?
– কি কথা?
– তোমাকে খুবই সুন্দর দেখতে শাওন ভাই। তুমি তোমার বংশের সমতূল্য কোনো ভালো ও সুন্দরী মেয়ে পেয়ে যাবে।
– আমি ভালা চাই না চারু, আমি তোরে চাই।
– আফসোস হবে না আমাকে পেলে? মনে হবে না, তুমি জীবনে আরো ভালো মেয়ে পেতে পারতে? আমি কারো দীর্ঘশ্বাসের কারণ হতে চাই না শাওন ভাই।
– তোর প্রতি তো আমার ভালোবাসা আজকালের না চারু। সেই ছোট্টবেলা থেইকা তোরে ভালোবাসি। বড় ডাগর ডাগর আঁখির সেই মায়াবতীর প্রেমে তো আমি অনেক আগেই পড়ছিরে চারু। তুই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর বাকি রইলো, পরে আফসোস করার কথা। আমি বড় হইছি চারু। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হইছে আমার। আজ অবধি তোর প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমে নাই বরং বাইড়াই চলছে। এইটারে কি বলবি তুই?
– আমি কি তোমার এত ভালোবাসার যোগ্য শাওন ভাই?
– তোর চেয়ে যোগ্য কেউ নাই।
– তোমার মা হয়তো আরো ভালো মেয়ে খুজবে তোমার জন্য।
– আমি ভালা চাই না চারু। আমি তোরে চাই। আর কতবার কইলে তুই বুঝবি? আমার অনুভূতিটারে একটু বুঝার চেষ্টা কর। একটু আমার দিকে তাকা। দেখ আমি কত অসহায়। ছোট থেইকা আমার মনে শুধু তোর বিচরণ। ওই মনে অন্য কাউকে জায়গা দেওয়া কি সম্ভব? এর চেয়ে তো মইরা যাওয়াও ভালা। চারু আমি ভালোবাসি তোরে। তুইও আমাকে ভালোবাস। নইলে আমারে মাইরা ফ্যাল। এই দুনিয়ায় আমি তোরে ছাড়া এক মূহুর্তও বাচতে চাই না।
শাওনের গলা ধরে এলো। খুব কষ্টে হয়তো কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করছে সে। ব্যর্থ হয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। একটা ছেলে কতটা অসহায় হলে এভাবে কাদতে পারে? কতটা ভালোবাসা তার মন পিঞ্জরে লুকিয়ে থাকলে এভাবে সে তার আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়? চারু গাছের শিকড় থেকে উঠে দাঁড়ালো। শাওন এখনো সেখানে বসে রয়েছে।
– কান্না করো না শাওন ভাই। ছেলেদের কান্না করলে মানায় না।
– ক্যান কান্না করুম না? আমি মানুষ না? পোলারা মানুষ না? পোলাগো কষ্ট হয় না? কান্দনের অধিকার শুধু মাইয়াগো থাকবো ক্যান?
– বাচ্চামো করো না। কান্না থামাও।
– চারু আমারে একটু ভালোবাস না চারু। কথা দিতাছি তোরে সারাজীবন আগলায়া রাখমু আমি। অনেক ভালোবাসমু। তুই যা চাইবি সব করমু। কহোনো কোনো কষ্ট তোরে দিমু না চারু।
– ভালোবাসা এক জলন্ত অগ্নিকুণ্ড শাওন ভাই। সেখানে সবাই জলতে পারে না। সাহস থাকে না। সেই অগ্নিকুন্ডে জ্বলার সাহস যখন তোমার নেই তাহলে সেখানে ঝাপ দেওয়া উচিত হয়নি তোমার।
– আমি জ্বলতে অভস্ত্য নই চারু আমি ভালোবাসতে অভস্ত্য। আমি ভালোবাসি তোরে। আমার জীবনে সবচেয়ে দামি তুই চারু। আমি তোরে চাই।
– সব চাওয়া কি পুরন হয় শাওন ভাই?
– আমার সব চাওয়াই পুরণ হয়। আমি জানি তোরেও আমি পামু। তুই শুধু আমার হইতে রাজি হয়ে যা। আর কাউরে পরোয়া করুম না আমি।
শাওনের টকটকে লাল দুই চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। কাদতে অভ্যস্ত নয় শাওন। সে তো চাওয়ার আগেই সব পেয়ে যায়। তবে তার বহু আকাঙ্ক্ষার চারু কেনো তার হবে না? চোখমুখ লাল হয়ে আসছে শাওনের। কান্নার দমকে ঠিকমতো কথা অবধি বলতে পারছেনা সে। আচ্ছা, শাওনের মাঝে এত মায়া কেনো? এই ছেলেটা কেনো এত ভালোবাসে তাকে? এই ছেলেটার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার যোগ্যতা কি তার আছে? কেনো এত ভালোবাসে শাওন তাকে? ভালোবাসা কি এতটাই যুক্তিহীন যে কারণ ছাড়াই হয়ে যায়। শাওনের এই পাগলামি কিশোরী চারুকে কিভাবে ভেঙে দেয় সেটা কি শাওন জানে? তার প্রতিটা কথা, প্রতিটা চাহুনি কিভাবে ক্ষতবিক্ষত করে চারুকে সেটা কি বোঝে সে? নাকি সে শুধু ভালোবেসেই যায়। ভালোবাসার অনুভূতি গুলো অনুভব করতে পারে না সে? আচ্ছা এত কেনো অদ্ভুত শাওন? এত বছর চারুর সাথে থেকেও চারুর ভালোবাসা সে কেনো অনুভব করতে পারে না? এইটা কি শুধু শাওনের বোকামি নাকি চারুর ভালোবাসার খামতি?
– উঠো পড়ো শাওন ভাই। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এলো। বাসায় যেতে হবে।
– না আমি যামু না। উঠমুও না। যতক্ষণ না অবধি তুই আমারে বলবি তুই আমারে ভালোবাসোস ততক্ষণ আমি এক চুলও সরমু না এইহান থেইকা।
– পাগলামি করো না। উঠো ওখান থেকে।
– না। আগে তুই বল তুই আমারে ভালোবাসোস।
চারু খেয়াল করলো তার প্রচন্ড লজ্জা লাগছে শাওনকে কিছু বলতে। ঠোঁট গুলো যেনো একটার সাথে একটা লেগে গেছে। উফফ, কি অস্বস্তিকর অনুভূতি এইটা। কিন্তু শাওনও যে পাগলামি শুরু করলো।
– কি হইলো বলস না ক্যান?
– কি বলবো?
– বল তুই আমারে ভালোবাসোস।
– আচ্ছা বললাম। এখন উঠো।
– না বলস নাই। নিজের মুখে বল, শাওন ভাই আমি তোমাকে ভালোবাসি। বল বল, তাড়াতাড়ি বল।
চারু স্বলজ্জ হাসলো। বহু কষ্টে উচ্চারণ করলো,
– শ শাওন ভাই আমি তোমাকে ভালোবাসি।
শাওনের ঠোঁটে দেখা গেলো প্রাপ্তির হাসি। সে দ্রুত উঠে জড়িয়ে ধরলো চারুকে। সাথে সাথেই কপালে একে দিলো ভালোবাসার স্পর্শ। চারু হতভম্ব হয়ে গেলো। তার জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ। হয়তো সেটা খুবই ছোট কিন্তু ভিষণ লজ্জায় পড়ে গেলো সে। অদ্ভুত এক অনুভূতি। আজ অবধি কখনো কেউ এভাবে জড়িয়ে ধরেনি সে। এই ছোট স্পর্শের গভীরতা চারুর কাছে অনেক বেশি বলে মনে হলো। চারু শাওনকে ছাড়িয়ে দৌড়ে বাড়ির দিকে পালিয়ে গেলো। তার লজ্জা মাখা মুখখানা শাওনের চোখ এড়ালো না। এতদিন বাদে সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আজ চারু স্বীকার করেছে সে পুরোপুরি ভাবে সম্পূর্ণই শাওনের। এর চেয়ে বেশিই বা আর কি চায় শাওন? চারুলতাই তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

বিঃদ্রঃ প্রথমেই দুঃখিত। অসুস্থতার কারণে দেরি হলো গল্পটা দিতে। ভ্যাক্সিন নেওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম একটু। আর গল্প সম্মন্ধে অনেকেই বলেছেন গল্পটা আপনাদের বিরক্ত লাগছে(আগের পর্বটা)। আমি এর জন্য দুঃখিত। আমি বিনীত ভাবে এর কারণ জানতে চাইছি। আমার জানা প্রয়োজন এই বিরক্তির কারণ। আমাকে মোট দুজন কারণ টা বলেছে। আমি বাকিদের কাছেও জানতে চাই। আর হ্যাঁ দয়া করে কেউ বলবেন না নিজের মতো লিখতে। আমি শুধু নিজের জন্যই নয় আপনাদের জন্যেও লিখি। আপনাদের সমস্যাও আমার দেখা প্রয়োজন। আমি চাই না আপনাদের মূল্যবান সময় বিনোদনের বদলে বিরক্তিতে কাটুক। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ১০ (খ)
_______________________

হামিদের চিৎকারে অন্যঘর থেকে নাজিমুদ্দিন বেড়িয়ে এলো।
– কি হইছে? এমনে চিল্লাইতাছোস ক্যান?
– আমারে জিজ্ঞেস না কইরা আপনের পরানের বউরে গিয়া জিজ্ঞেস করেন সে আমার ঘরে কি করে।
– তোর ঘরে আইসে তো কি হইছে? তার কি এই ঘরে আসা মানা?
– হ মানা। আমার আর আমার বইনের ঘরে আমি আবর্জনা সহ্য করমু না। আর এই জঘন্য মহিলা কি করতাছিলো আপনে জানেন?
– কি করতাছিলো?
– ছিহ, মুখে আনতেও আমার ঘেন্না হচ্ছে। ঘরে কি বেশ্যা ঠাই দিছেন আপনে?
– হামিদ, মুখ সামলায়া কথা ক। মায়ের মতো একজন মানুষরে নিয়া এইগুলা কি ধরনের কথা?
– মা? মা নামের কলঙ্ক আপনের এই বউ। আপন ভাতিজির লগে বিয়া হয় জীবনে শুনছেন? হয় না। যতই বিয়া করেন, ওর লগে আপনের বিয়া হয় নাই। ও আমাগো মা না। আর মা কখনো বেশ্যা হয় না। এই কালনাগিনী একটা চরিত্রহীন।
– হামিদ্দা, মেজাজ গরম করাবি না আমার। কিছু কইতাছি না দেইখা যা খুশি কইয়া যাবি ভাবছস? সে কি এমন করলো যে তুই তারে বেশ্যার অপবাদ দিলি?
– আমার ঘুমের সুযোগ নিয়া খারাপ মতলবে সে আমারে জরায়া ধরছিলো।
– পাজি হইছো না পাজি? তোর মা তোরে ঘুমের মধ্যে আদর করতাছিলো আর তুই তারে এত বড় অপবাধ দিলি? এইটার জন্যই কয়, পর কোনোদিন আপন হয় না। মা কি তার পোলারে জরায়া ধরে না? মনের মধ্যে এত কুমতলব ক্যান তোর?
হামিদ হতভম্ব হয়ে গেলো, শেফালীকে দুটো কথা শোনানোর বদলে তাকেই কথা শোনাচ্ছে নাজিমুদ্দিন। সে তো কোনো দোষ করেইনি।
– শুনেন, আমি বাচ্চা না। যথেষ্ট বড় হইছি। কোনটা কোন ধরনের স্পর্শ হেইডা আমি ভালোই বুঝি।
– ছিহ, ছিহ হামিদ্দা, মা পোলার সম্পর্ক টারে তুই এমন নোংরা বানাইলি? ছিহ! ভাবতেই শরম লাগে তোর মতো কুলাঙ্গার আমার পোলা।
হামিদের মাথায় যেনো রক্ত উঠে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে পৃথিবীর জঘন্যতম নরনারী দুজনকে এখানেই খু*ন করে ফেলতে। সে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই উঠোনে দেখা গেলো চারুকে। খুবই খুশি মনেই বাড়ি এসেছে সে। হামিদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। চারু এখনো বাচ্চা। ওর সামনে এইসব আলোচনা ঠিক হবে না। বাচ্চাদের মনে এইসবের প্রভাব তীব্র ভাবে পড়ে। আচ্ছা, হামিদ যদি জানতো চারু আগেই সব জানে তাহলে ও কি করতো?
বাড়িতে ঢুকেই কিছুটা চেচামেচির আওয়াজ পেলো চারু। চারু খুব ভালো করেই জানে হামিদের সাথে ঝামেলা হয়েছে। এই পরিবার এখন অলিখিতভাবে দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটা চারুর আর হামিদের দল আরেকটা শেফালী আর নাজিমুদ্দিনের দল। আর ঝগড়া লাগা মানেই দুই দলের মধ্যে ঝগড়া। চারু দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলো। সে যা ভেবেছিলো তাই ঘটেছে, নাজিমুদ্দিন হামিদের উপর চিৎকার করছে। তার কথার সারমর্ম হামিদ নাকি শেফালীকে বাজে কথা বলেছে। কি অসম্ভব কথাবার্তা! হামিদ সবসময় মেয়েদের থেকে নিজের দৃষ্টি নত রাখে আর হামিদ কি না শেফালীকে বাজে কথা বলেছে। কে জানে ওই চরিত্রহীন মহিলা আবার কি করেছে তার দায়ভার গিয়ে পড়ছে হামিদের উপর। চারুর ইচ্ছে করছে একটা অর্ধ ভাঙা ইট নিয়ে শেফালীর মাথা ফাটিয়ে দিতে। সে জানে না এখানে কি হয়েছে কিন্তু সে নিশ্চিত হামিদ নির্দোষ। সে চুপিসারে হামিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো,
– ওইযে আইছে নবাবের বেটি। আমার ভালা পোলাটার মাথায় সবসময় শয়তানি বুদ্ধি ঢুকায়। নইলে আগে যে পোলা আমার লগে কথা কওনের আগে দশবার ভাবতো হে নাকি আমার মুখের উপর কথা কয়। মা রে ডাকে বেশ্যা।
– ও মা না আমার। আমার মায়ের নাম মনোরমা। শুনছেন আপনে? আমার মায়ের নাম মনোরমা। শেফালী আমার কাছে ক্ষুদ্র নরকের কীট ব্যতীত আর কিছুই না। ওই চরিত্রহীন মহিলার লগে আমার মায়ের নাম একদম জড়াইবেন না আপনে।
– আমার বাড়িতে থাকো আমার টা খাও আবার আমার মুখে মুখে কথা কও? সাহস তো কম হয় নাই তোমার। আইজ আমার বাড়িতে তোর ভাত বন্ধ।
কথাটা জোরে জোরে বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো নাজিমুদ্দিন। তার পেছন পেছন শেফালীও।
– খামু না আপনের ভাত। নিজের টাকা দিয়া যতদিন খাইতে পারমু ততদিনই খামু আমি।
– মনে থাকে যেন। ওই চারু, আজ তিনজনের খাওন রানবি। ওর আইজ থেইকা এই বাড়িতে খাওন নাই।
নাজিমুদ্দিন বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে। সে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হামিদও বেরিয়ে গেলো। এই জাহান্নামে এক মূহুর্ত স্থির হয়ে বসতে পারছেনা সে।

ধানের খেতের আইল ধরে হেটে চলেছে হামিদ। অস্বস্তিকর এক অনুভূতি ঘিরে ধরেছে তাকে। এই দুনিয়া বড়ই নিষ্ঠুর লাগছে তার কাছে। সে আজ ক্লান্ত! এক পৃথিবীতে আর কত খেলা দেখতে হবে কে জানে? দুনিয়ায় মায়া আর সে করে না। ইচ্ছে করে সব ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে মনোরমার পায়ে লুটিয়ে পড়তে। বারবার মনোরমাকে বলতে ইচ্ছে করছে, “মা দেখো, তোমার পোলা কত কষ্টে আছে। আমারেও তোমার লগে নিয়া যাও মা।” কিন্তু সেটা বলার উপায় নেই। এই কথাটা শোনার জন্য আজ মনোরমা বেঁচে নেই। দুনিয়ার বুকে এতিম করে দিয়ে গেছে সে হামিদকে। আজ এই নিঠুর ধরনীতে তার দুঃখ শোনার কেউ নেই, তার কষ্টে কষ্ট পাওয়ারও কেউ নেই। আর কাছে এখন শুধু মুক্তির একটা পথই খোলা আর সেটা হলো আত্মহত্যা। কিন্তু হামিদ সেইটাও করতে পারবে না। মনোরমা মরার আগে তার কাছে দিয়ে গেছে এক গুরুদায়িত্ব। চারুকে আগলে রাখতে হবে সব বিপদ থেকে। এই দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে কিভাবে যাবে সে? এত বড় কাপুরষ তো নয় সে। তাছাড়া সে আত্মহত্যা করলে চারুরই বা কি হবে? এই দুনিয়ায় তো হামিদ ছাড়া ওর কেউ নেইও। মেয়েটা একেবারে ভেসে যাবে। চরিত্রহীনা এই শেফালীকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই হামিদের। হামিদ না থাকলে শেফালী যে চারুর প্রতি কতটা জঘন্য আচরণ করতে পারে তা হয়তো ও কল্পনাও করতে পারে না। রাত হয়েছে খুব। বাড়ি যাওয়া উচিত কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। কেনো যাবে বাড়ি? কি আছে বাড়িতে? আগে তো মনোরমা হামিদ না যাওয়া পর্যন্ত জেগে বসে থাকতো। এখন তো জেগে বসে থাকার সেই মানুষটাও নেই।

একহাতে চারু রান্নাবান্নার সকল কাজ একা করছে। শেফালী কিছু এগিয়ে তো দিচ্ছেই না বরং ছোট ছোট ভুল হওয়াতেও ধমকাচ্ছে। একবারে পরিমাণ মতো দেখে দেখে তিনজনের খাবার রান্না করাচ্ছে সে। আজ হামিদের উপর প্রচন্ড রেগে গেছে সে। এই ছেলে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে একটু বেশিই অহংকারী। তার শিক্ষা পাওয়ার দরকার আছে। হামিদের রাগ সে প্রবল ভাবে চারুর উপর ঝাড়ছে। চারু বিরক্ত হয়ে শেফালীর কাজকর্ম লক্ষ্য করছে। ভয় হচ্ছেনা তার কিন্তু মেজাজ বিগড়ে আছে। ইচ্ছে করছে জলন্ত উনুনের মাঝে শেফালীকে ফেলে দিতে। কিন্তু আফসোস এইসব ইচ্ছা সে শুধু কল্পনাতেই করতে পারে। বাস্তবে এত সাহস নেই তার।
– ফেল ফেল, জিনিসপত্র সব ভাইঙ্গা ফেল। কাজ কর্ম যদি একটা ঠিক মতো করতে পারতো। সামন্য একটু রান্ধে এর মধ্যেই ওত গুলা প্যাচ লাগাইতাছে।
শেফালীর এই কথাটা সহ্য হলো না চারুর। শক্ত গলায় জবাব দিলো,
– এতই যখন আমার রান্না নিয়ে সমস্যা নিজে রান্না করে খেলেই পারেন। নিজে রান্না করলে তো একবেলা সেটা মুখে দেওয়ার যোগ্য হয় না আবার আমার রান্না বিচার করতে এসেছেন।
– কি কইলি? আমার মুখের উপর কথা কস তুই আবার?
– হ্যাঁ বলছি। অনেক সহ্য করছি আপনার এই কুকীর্তি। যান বের হন এই রান্নাঘর থেকে। নইলে পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে চিৎকার করে ডেকে এনে আপনাদের আসল রূপ আমি দেখাবো।
– কি কইলি তুই?
– কালা নাকি আপনি? কানে শুনেন না? বের হন রান্নাঘর থেকে।
– তোর রান্ধনঘর এইটা?
– আমার মায়ের রান্নাঘর এইটা। অপবিত্র মানুষের ছায়াও মা এই রান্নাঘরে পড়তে দিতো না। তারই মেয়ে হিসেবে এই মহান দায়িত্ব পালন করছি আমি। যদি চুপচাপ বসে থাকতে পারেন তো বসে থাকেন নইলে আপনি বাইরে যান।
শেফালী মেজাজ দেখিয়ে বাইরে চলে গেলো। আসলেই যদি চারু এখন চিৎকার করে সবাইকে ডাকে তাহলে সম্পূর্ণ পরিবেশই বদলে যাবে। আর ঘুণাক্ষরেও যদি কাউকে জানায়, নাজিমুদ্দিন শেফালীর চাচা তাহলে তো এই গ্রামে ওর আর নাজিমুদ্দিনের থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। আজকাল চারুও যেনো কেমন বদলে গেছে। রান্না শেষ করে চারু নিজেই নাজিমুদ্দিন আর শেফালীকে ভাত বেড়ে দিলো। তাদের অগোচরেই নিজের খাবারটা ঘরে নিয়ে এলো সে। হামিদ সারাদিন কাজ করে। তার খাবারের প্রয়োজন আছে৷ চারুর দুই একদিন না খেলে তেমন কিছুই হবেনা। কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরেও হামিদ আসলো না। চারুর একটু চিন্তা হতে লাগলো। কে জানে হামিদ কোথায় আছে। রাত দেড়টার পরে বাড়ি ফিরলো হামিদ। কে জানে এতক্ষণ কোথায় ছিলো সে। চারু সেসব কথায় গেলো না। হামিদ ভেতরে ঢুকতেই চারু দরজা বন্ধ করে দিলো। হামিদ সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই বললো,
– এহোনো ঘুমাস নাই ক্যান? বেশি রাত জাগা ভালো না।
– তুমি বাসায় আসো নি আর আমি ঘুমিয়ে যাবো? ঘুম আসবে আমার?
হামিদ একবার তাকালো চারুর দিকে। যে মেয়ের রাত দশটা বাজলেই ঘুমে চোখ খুলে রাখতে পারে না সেই মেয়ের চোখে কি না এখন ঘুমের লেশমাত্র নেই। হামিদ বুঝতে পারলো, রাতে দেরি করে আসাটা তার বড্ড ভুল একটা সিদ্ধান্ত ছিলো। আজ হয়তো তার জন্য মনোরমা জেগে থাকবে না তবে জেগে থাকার আরো একজন মানুষ রয়েছে। আর সেটা হলো চারু। চারুই তো এখন হামিদের জন্য মায়ের আরেক রূপ।
– নিচে মাদুর বিছানো আছে। তাড়াতাড়ি বসে যাও।
– ক্যান?
– এতো প্রশ্ন করো কেনো? বসে যাও না।
হামিদ কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সেখানে বসে গেলো। চারু তাড়াতাড়ি ভাতের প্লেট টা হামিদের সামনে রাখলো।
– তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। প্লেট রেখে আসতে হবে।
– না খামু না। এই বাড়ির একটা দানাও আমি মুখে দিমু না।
– বাজে কথা বলো না। এই সংসারে টাকা তুমিও দাও। জানি সেটা খুবই কম। কিন্তু দাও তো। নিজের টাই খাবে তুমি।
হামিদ একবার ভেবে দেখলো চারুর কথা। আসলেই তো সে এই সংসারে টাকা দেয়। তবে সে কেনো না খেয়ে থাকবে? এই সংসারে কর্মহীন যদি কেউ হয়ে থাকে তাহলে সেটা শেফালী। সারাদিন কাজ না করে শুধু দেখায় যে সে কাজ করে। হামিদ খাবারের প্লেট টা হাতে তুলে নিলো। কিছুটা খাওয়ার পরে হামিদের মনে পড়ে গেলো আজ তিনজনের রান্না হয়েছে। নাজিমুদ্দিন আর শেফালী নিশ্চয়ই খেয়ে নিয়েছে। তাহলে সে কি খাচ্ছে? হামিদ একবার চারুর দিকে তাকালো। গ্লাসে পানি ঢালছে সে,
– চারু।
– হুম।
– তুই খাইছস?
– হুম খেয়েছি। তুমি তাড়াতাড়ি খাও।
হামিদ স্পষ্ট ধরতে পারলো চারুর মিথ্যেটা। মিথ্যে বলার সময় চারু চোখের দিকে তাকাতে পারেনা। এইবারও সে অন্যদিকে তাকিয়েই কথাটা বললো। হামিদ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তার মনে পড়ে গেলো ছোটবেলায় মনোরমার বলা কথাটা। চারুর সাথে খাবার কোনোকিছু নিয়ে ঝগড়া হলেই মনোরমা বলতো সেটা চারুকে দিয়ে দিতে। বড় হয়ে একসময় এই চারুই নাকি তাকে না খেয়ে নিজের খাবারটা খাওয়াবে। হামিদ সবসময় ভেঙচি কেটে বলতো, ” নিজের টা খেয়েও আমারটা খাইতে চায়, ও নাকি আবার বড় হইয়া আমারে খাওয়াইবো। তাও আবার নিজের খাবার।” তখন মনোরমা কোনো প্রতিউত্তর দিতো না কিন্তু তার সেদিনের কথা যে এভাবে ফলবে তা হামিদ কখনো কল্পনাও করেনি।
– চারু।
– হুম।
– তুই খাইছস না?
– হুম।
– আমি যদি খায়িয়ে দেই তাইলে আবার খাবি?
চারু অপরাধী দৃষ্টিতে হামিদের দিকে তাকালো। সে যে খায়নি সেটা বুঝতে পেরে গেছে হামিদ। চারুর উত্তরের অপেক্ষা করলো না সে। নিজের হাত দিয়েই খায়িয়ে দিলো চারুকে। চারুও বিনা বাক্য ব্যয়ে সেটা খেয়ে নিলো। এক প্লেট খাবারে হয়তো দুজনের কারোরই পেট ভরেনি তবে মনটা দুজনেরই যেনো দুজনেরই ভরে গেলো।
চারু প্লেট টা নিয়ে চুপিসারে কলঘরের দিকে চলে গেলো। ফিরে আসতেই হামিদকে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখলো সে।
– কি হয়েছে?
চারুকে এতক্ষণ খেয়াল করেনি হামিদ। হঠাৎই চারুর গলা পেয়ে চমকে উঠলো সে। নিজেকে কোনোমতে সামলে বললো,
– কিছুই হয় নাই। আচ্ছা অনেক রাইত হইলো। তুই এহন ঘুমা। আমিও ভিতরে চইলা যাই।
– আমাকে কি বলা যাবে না?
– আরে তেমন কিছুই হয় নাই। একটা বড় কাজের অফার পাইছিলাম।
– কিভাবে? না মানে, একদিন দিয়ে একদিনেই ভালো বেতনের কাজ জোগাড় করে ফেললে আবার নাকি আরো ভালো কাজের অফারও পেয়ে গেছো। এইটা কিভাবে হলো?
– আগে থেইকাই পরিচয় ছিলো। তহন কাজে এত মনোযোগ দেই নাই তাই এই কাজ গুলা করি নাই। এহন তো আমার ভালো বেতনের কাজ লাগবো। দেখিস, খুব তাড়াতাড়ি তোরে এইহান থেইকা নিয়া যামু আমি। অনেক বেশি পরিশ্রম করমু।
– তাহলে ভালো কাজের অফার যেটা পেয়েছো সেটা করো।
– কাজটা মনে কর ভালোই। দুই হাজার টাকার বেতন। কিন্তু দুইটা সমস্যা। খালি সমস্যাই না। বিরাট সমস্যা। প্রথমেই নাকি কাজটা করতে শহরে যাইতে হইবো। শহরে গেলে তো আর লগে লগে তোরে নিতে পারমু না। আগে জায়গাটা দেখতে হইবো। তারপর চিনতে হইবো। তোর থাকার মতো ভালো একটা ঘর লাগবো। ভালো পরিবেশ লাগবো। এইগুলা করতে কমপক্ষে চার-পাঁচ দিন তো লাগবোই। তাছাড়া গ্রামে যেমন আমাগো দুইজনের দেড় হাজার টাকায় হইয়া যাইবো শহরের খরচ কেমন সেটাইও তো জানি না। বেতন যেহেতু দুই হাজার তাইলে হইয়াও যাইতে পারে।
– আর দ্বিতীয় সমস্যা?
– দ্বিতীয় সমস্যা আরো বড়। কাজে লাগতে নাকি ৪৫০০ টাকা লাগবে। এত টাকা কই পামু? আমার কাছে যা আছে তা বড়জোর ৫০০-৬০০ হইবো।
– এই কাজটাই মনে হয় ভালো হবে। শহরে চলে গেলে আর এই দুইজনের চেহারা আমাদের দেখতে হবে না। আর খরচের দিক হিসাব করলে বলবো প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হলেও পরে মানিয়ে নেবো।
– হ্যাঁ তা ঠিক আছে কিন্তু এতগুলা টাকা কই পামু? কেউ তো এতগুলা টাকা ধার দিবো বইলা মনে হয় না।
চারু কোথাও একটা উঠে গেলো। কিছুক্ষণের মাঝেই আবার ফিরে এলো সে। হাতে একটি বক্স।
– এইটা কি?
– কিছু টাকা আছে এতে।
– তুই টাকা কই পাইলি?
– ছোট বেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় মা প্রতিদিন দুই টাকা করে দিতো। সেটাই জমিয়েছি।
হামিদের মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার কথা। হামিদকে প্রতিদিন পাঁচ টাকা দেওয়া হতো। আর চারুকে দুই টাকা। এ নিয়ে চারুর অভিমানের শেষ ছিলো না। সে সবসময় বলতো, “ভাইকে তো সবসময় পাঁচ টাকা দাও। আমাকে দুই টাকা কেনো দাও?” মনোরমার উত্তর একটাই ছিলো, হামিদ ছেলে মানুষ। ছেলেদের টাকা লাগেই। নাজিমুদ্দিন বিনা বাক্যে হামিদকে পাঁচ টাকা দিয়ে দিলেও চারুর টাকা দেওয়ার সময় বলতো, মাইয়া মানুষের প্রতিদিন এত ট্যাকা লাগে ক্যান? চারুও উত্তর দিতো, হামিদের কাছ থেকে কেনো কখনো টাকার হিসেব চাওয়া হয় না। চারুর এই কথার জন্য কম বকা খেতে হয়নি তাকে। আর আজ চারুই কি না হামিদকে সেইসব টাকাই দিয়ে দিচ্ছে। বাক্স খুলে ৪৭৬০ টাকা পাওয়া গেলো। নিশ্চয়ই এইটা চারুর অনেকদিনের জমানো টাকা। অনেকদিন বললে ভুল হবে। হয়তো অনেক বছর। ছয় বছরেরও বেশি সময় লেগেছে নিঃসন্দেহে। আরো বেশিও হতে পারে। আচ্ছা মেয়েরা এতো ত্যাগী কেনো হয়? তাদের কি উচিত নয়, একটু স্বার্থপর হওয়া? কেনো তারা সারাজীবন শুধু দিয়েই যায়?
– টাকা না হয় ব্যবস্থা হইলো কিন্তু আমি তোরে ছাইড়া যামুই বা কিভাবে? কে জানে ওই শেফালী আবার কি করে।
– কি করবে? আমার কিছু করার সাধ্য শেফালীর নেই। ভয় পেতে হয় তো তোমার বাবাকে পাও। তাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। তাকে তো আমার বাবা ডাকতেও ঘৃণা হয়।
– কিছুদিন সাবধানে থাকতে পারবি চারু? বেশি না, খুব বেশি হইলে এক সপ্তাহ। এর মাঝেই আমি সবকিছু ঠিকঠাক কইরা তোরে এইহান থেকে নিয়ে যামু।
– পারবো।
– সত্যিই পারবি? আমার কিন্তু অনেক চিন্তা হইবো তোরে রাইখা শহরে গেলে।
– চিন্তা করো না। মাত্র তো এক সপ্তাহের ব্যাপার। জানি তুমি চলে শেফালী আমার উপর কম অত্যাচার করবে না কিন্তু এই এক সপ্তাহ অত্যাচারের বদলে যদি আমি সারাজীবনের মতো এদের থেকে দূরে যেতে পারি তাহলেই আমি খুশি। আর এখন আপাতত বিয়ে দিতে পারবে বলেও মনে হয় না। মা মারা গেছে এখনো তো চল্লিশ দিন হয়নি। নিজে বিয়ে করে আনলো আবার যদি আমাকেও বিয়ে করায় তাহলে তো পাড়া প্রতিবেশী ছেড়ে কথা বলবে না। ধর্মেরও তো একটা ব্যাপার আছে।
– ধর্ম মানে এরা? ধর্ম মানলে কি আর আপনা ভাতিজিরে বিয়া করতে পারে?
– যাই হোক, বাদ দাও সেসব। তুমি চিন্তা করো না আমি সামলে নেবো। তুমি ঘুমাতে চলে যাও।
চারুর কথায় হামিদ নিজেদের সেই ছোট ঘরটার ভিতরে ঢুকে গেলো। কে জানে আজ ওর ঘুম হবে কি না। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চারুকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে।

নিস্তব্ধ শীতের রাত! চারিদিকে ঝিঝি পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পূর্ণিমার রাত বিধায় চাঁদের আলো টিনের চাল ও দেওয়ালের ফুটো দিয়ে ঘরে ঢুকছে। তবে সে আলো খুব বেশি নয়। কুয়াশার আড়ালে পৃথিবীটা যেনো লুকিয়ে গেছে। সেই কুয়াশাই চাঁদের আলোকে ঘরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। আকাশের পূর্ণ চন্দ্রের মাঝে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কলংক। চাঁদটাও হয়তো কিছুটা লালচে। দূরে কোথাও একটা শেয়াল ডেকে উঠলো। ভীতু ব্যক্তির কাছে পরিবেশটা যেমন খুবই ভয়ংকর তেমনি সাহসী মানুষের জন্য পরিবেশটা রোমাঞ্চকর। নিস্তব্ধ এই রাতে নারী কণ্ঠের ক্ষীণ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আওয়াজটা ক্ষীণ নয় কিন্তু ঘুমন্ত হামিদের কাছে শব্দটা ক্ষীণ লাগছে। কিন্তু, চোখ খুলতে ব্যর্থ সে। ঘুমরাজ যেনো খুব ভালো ভাবে তার চোখে অবস্থান করেছে। ঘুমটা একটু ভালো হওয়ার জন্য চাদরটা একটু টেনে নিলো। উষ্ণ চাদরে ঘুমটা যেনো আরেকটু জাকিয়ে বসলো তার চোখে। কিন্তু ঘুমটা স্থায়ী হচ্ছে না। শব্দটা যেনো বেড়েই চলেছে। ঘুমের সাথে যুদ্ধ শেষ করে জেগে উঠলো হামিদ। চারুর ঘর থেকে আওয়াজ টা। খুব জোরে অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছে চারু। ব্যাপারটা হামিদ বুঝতে পেরেই দৌড়ে তার ঘরের দরজার ফাকা জায়গাটা দিয়ে বের হলো। সেখান দিয়ে বের হলেই চারুর ঘর। বিছানায় শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে চারু। হামিদ দৌড়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিলো।
– চারু, কি হইছে তোর চারু?
চারু কিছুই বলতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় যেনো তার হাত পা মুখ সব অবস হয়ে যাচ্ছে। দুহাত দিয়ে পেট চেপে শুয়ে আছে সে।
– কি হইলো চারু? এমন করতাছস ক্যান?
চারু এখনো কিছুই বলছে না। অসহ্য রকমের পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে তার। পেটে হাত চেপে রাখাটা চোখ এড়ালো না হামিদের,
– কি হইছে? পেট ব্যথা করতাছে? ডাক্তারের কাছে যাবি?
চারু কিছু না বললেও মাথা উপর নীচ দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছে সে। হামিদ এখনো হতভম্ব হয়ে বসে আছে। সে বুঝতে পারছেনা হঠাৎ কি হয়ে গেলো চারুর? চারুর অবস্থা এখন খুব খারাপ। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার মতো অবস্থায় চারু এখন নেই। ডাক্তারকে বাসায় ডেকে আনতে হবে। নাজিমুদ্দিনের সাথে হামিদের এখন কিছু মন কষাকষি চললেও এখন সেটা ধরা যাবেনা। এখন নাজিমুদ্দিনের সাহায্যই তাকে নিতে হবে। এই অবস্থায় সে কিছুতেই চারুকে একা ফেলে যেতে পারবে না। চারু এখনো চিৎকার করে যাচ্ছে। চারুর চিৎকারে হামিদ একেবারে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। সে দৌড়ে গিয়ে নাজিমুদ্দিনের ঘরে করাঘাত করছে। নাজিমুদ্দিন যতক্ষণ না দরজা খুললো হামিদ একটানা দরজায় করাঘাত করছিলো,
– কি হইলো? বাসায় ডাকাত পড়ছে? এমন করতাছস ক্যান?
– চারু, চারু প্রচন্ড অসুস্থ। পেটের ব্যথায় চিৎকার করতাছে ও। ডাক্তার লাগবো। আপনে দয়া কইরা একটা ডাক্তার আইনা দেন।
– ডাক্তার কি হাতের মোয়া? এই রাইত বিরাতে আমি ডাক্তার কই পামু? সকাল হউক কবিরাজ দেখায়া আনিস।
– আপনে বুঝতাছেন না ক্যান? চারুর অবস্থা খুব খারাপ। এহনই ডাক্তার লাগবো।
– আমি এত রাইতে ডাক্তার কই পামু? আর ডাক্তার কি এত রাইতে কারোর বাসায় আসতে চাইবো?
এমন সময় ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো শেফালী। এই শীতের রাতেও ঘামছে হামিদ। তাকে দেখেই সরল মুখ করে শেফালী বললো,
– তুমি চিন্তা কইরো না। যাও গিয়া শুইয়া থাকো। প্রতিমাসে একটা বিশেষ সময়ে মাইয়াগো ওমন পেটে ব্যথা হইয়াই থাকে। ওইডা কোনো ব্যাপার না। সকালে ঠিক হইয়া যাইবো।
নাজিমুদ্দিনও তাল মেলালো শেফালীর কথায়। হামিদকে চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে বললো। ব্যথা না কমলে সকালে নাকি সে কবিরাজ দেখাবে। কিন্তু হামিদ কিভাবে শুয়ে থাকবে? ও তো জানেই না এইটা আসলেই পিরিয়ডের ব্যথা কি না। যদি না হয়ে অন্য কিছু হয় তখন? আর চারু তো আগেও তার সাথেই ঘুমাতো। কই কখনো তো যন্ত্রনায় এমন চিৎকার করেনি। এভাবে বিছানাও পড়ে যায়নি। এমন কিছু তো ওর মনে পড়ছে। হামিদ ছুটে ঘরের দিকে গেলো। চারু এখনো যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। হামিদের কিছুটা সংকোচ হচ্ছে চারুকে কিছু জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু সে অপারগ, তাকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। হাজারো সংকোচ নিয়েও হামিদ চারুকে প্রশ্নটা করেই ফেললো। হ্যাঁ পিরিয়ডের ব্যথা কিন্তু চারু এও জানালো আগে কখনো এত ব্যথা হয়নি। এমনকি মনোরমার মৃত্যুর সময় নাজিমুদ্দিন ওর তলপেটে একটা লাথি মেরেছিলো। এই কথাটাও বলতেও ভুললো না সে। সেই লাথির কারণেই হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে আর সেটা প্রকাশ পাচ্ছে পিরিয়ডের সময়। হামিদের মাথায় আগুন জ্বলছে। আজ চারুর এই অবস্থার জন্যেও নাজিমুদ্দিনই দায়ী। যতদিন না অবধি নাজিমুদ্দিনকে ও খুন করবে ততদিন অবধি শান্তি পাবেনা সে। চারু এখনো কষ্ট পাচ্ছে। চারুর কষ্ট দেখে হামিদের যেনো কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে। চারুর কি আসলেই এত কষ্ট পাওয়ার আছে? মেয়েটা কি কখনো সুখ পাবে না? হামিদ দৌড়ে বাড়ির বাইরে ছুটে গেলো। টুনির মায়ের দরজায় করাঘাত করলো সে। টুনির মা দরজা খুলেই হামিদকে দেখে অবাক হলো,
– কি রে এত রাইতে তুই এইহানে কি করস? বাসায় কিছু হইছে?
– খালা আমার চারু রে বাচাও খালা। ও মইরা যাইতাছে খালা।
– কি হইছে? কি হইছে চারুর?
– তুমি আহো। দেইখ্যা যাও।
টুনির মা হামিদের পেছন পেছন গেলো। সে অবাক হয়ে দেখলো চারুর এই অবস্থা অথচ শেফালী আর নাজিমুদ্দিন দুজনেই দরজায় খিল দিয়ে রেখেছে। টুনির মা সাথে সাথে উনুন জ্বালিয়ে গরম পানি করে সেটার সেক দিয়ে দিলো চারুকে। ডাক্তারের কাছে সে শুনেছিলো গরম পানির সেক দিলে নাকি পিরিয়ডের ব্যথা কমে। গরম পানির প্রভাবেই হয়তো চারুর ব্যথা কিছুটা কমলো। চারু ঘুমিয়ে গেলো নিজের অজান্তেই। চারু ঘুমিয়ে যাওয়ার পরেই টুনির মা চলে গিয়েছিলো তবে ঘুমাতে পারলো না হামিদ। সারারাত জেগে বসে রইলো চারুর পাশেই। চারুর মলিন মুখটা দেখেই যেনো কলিজাটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তার।

গ্রামে সচারাচর ডাক্তার পাওয়া যায় না। এত কষ্ট করে ডাক্তারী পাশ করে তারা গ্রামে থাকবে কি করতে? তারা চলে যায় শহরে। তেমনই হামিদও ডাক্তার খুজে পেলো না। বাধ্য হয়েই একজন কবিরাজকে দেখালো সে। সে কিসব গাছের শিকড় পাতা দিয়ে গেলো আর কিসব অদ্ভুত কথা বলে গেলো। মোটকথা কবিরাজকে হামিদ একদমই পছন্দ করলো না। সে ঠিক করে নিলো, শহরে গিয়ে আগে খুব ভালো একটা ডাক্তার দেখাবে সে চারুকে। কিছু টাকা আগেই আলাদা করে রাখতে হবে। এই কবিরাজি কোনো কাজের না। সাতটা দিনই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে কাটালো চারু। হামিদেরও কিছুই করার ছিলো না। এই সাতদিনে বোধহয় এমন একটাও দিন নেই যেদিন সে ডাক্তার খুজতে বের হয়নি। অপরদিকে শেফালী, এইসবই শুধু চারুর অযুহাত বলতো। চারুকে কাজ করতে বলতে চাইলেও হামিদের কারণে বলতে পারতো না। নাজিমুদ্দিনকে বললে সেও বলে দিলো, অসুস্থ অবস্থায় চারু যেনো কিছুই না করে। শেফালী বুঝলো না হঠাৎ নাজিমুদ্দিনের চারুর প্রতি এত ভালোবাসা উদয় হলো কেনো? তবে এইটা যে তার নিজের ইচ্ছেতে সে বলেনি সেটা কিভাবে জানবে শেফালী? তাকে তো সমস্ত আদেশ নিষেধ একজন দিয়েই চলেছে।
অসুস্থতা যেনো ছোয়াচে রোগের ন্যায়। চারু সুস্থ হয়ে উঠতেই অসুস্থ হয়ে পড়লো হামিদ। হামিদের অবশ্য অসুস্থ হওয়ার অনেক কারণ আছে। এই সাতদিনে সে ঘুমিয়েছে খুবই অল্প। বেশি হলে চব্বিশ ঘণ্টায় দুই ঘন্টা সে ঘুমিয়েছে। তার উপর আবার অত্যাধিক পরিশ্রম। শহরে যাওয়ার সমস্ত জোগাড় যন্ত্র করা। সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা। না ঘুমানো এবং অতন্ত্য পরিশ্রমের কারণেই মূলত হামিদ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজ সকালেই চারু দেখেছে হামিদের জ্বর। আজ চারু একপ্রকার জোর করেই বের হতে দেয়নি হামিদকে। আজ রান্নার সময়ও শেফালীর সাথে ঝামেলা বেধে যায় চারুর। শেফালী ভেবেছিলো, হামিদ অসুস্থ বিধায় এখন চারুকে কিছু বললেও বাধা পাওয়া যাবেনা কিন্তু চারুর পাল্টা জবাবগুলো সে সহ্য করতে পারছেনা। এই নিরীহ চারু এত কথা কোথায় শিখলো তা ভেবে পেলো না শেফালী। সে গিয়ে সত্য মিথ্যা ইচ্ছামতো নালিশ করলো নাজিমুদ্দিনের কাছে। অতিরিক্ত রাগে নাজিমুদ্দিন গিয়ে চারুর চুলের মুঠি ধরলো,
– বেয়াদব হইছো না? বেয়াদব? মায়ের লগে ক্যামনে কথা কইতে হয় হেই জ্ঞান নাই তোমার?
প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো চারু। সে নিজেকে ছাড়ানোর প্রানপন চেষ্টা চালালো। হামিদ শুয়ে ছিলো, তখনই চারুর চিৎকার কানে এলো তার। অত্যাধিক জ্বরে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করছেনা তার। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো যা হওয়ার হবে উল্টোপাল্টা কিছু করলেই আজ নাজিমুদ্দিনকে খুন করবে সে। হাতে দা নিয়ে সেই ঘরের দিকে ছুটে গেলো হামিদ।
রক্তলাল দুইচোখে হাতে দা নিয়ে নাজিমুদ্দিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হামিদ। এক মূহুর্তের জন্য হামিদকে দেখে থমকে গেলো নাজিমুদ্দিন। তার হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে আজ তার মাথা ঠিক নেই। কিছু একটা করে ফেলতে পারে সে।
– ভালোয় ভালোয় চারুরে ছাড়েন নইলে আপনেরে খু*ন করতে দ্বিতীয় বার ভাবমু না আমি।
নাজিমুদ্দিন একটা শুকনো ঢোক গিলে ছেড়ে দিলো চারুকে। ছাড়া পেয়েই চারু দৌড়ে গিয়ে হামিদের পেছনে লুকিয়ে গেলো। হামিদ একহাত দিয়ে নিজের পেছন থেকে চারুকে সামনে নিয়ে এলো,
– ভয় পাবি না তুই। এই জানোয়ারগো ভয় পাইতে হয় না। ঘৃনা করতে হয়।
– আমার বাড়িতে থাইকা আমারটা খায়া আমারে ঘৃনা করতে মন চায়?
– কিসের বাড়ি আপনের? এই বাড়ি নানাজান আপনেরে যৌতুকে দিছিলো। আমার মায়ের পর এই বাড়ির মালিক আমি আর চারু। আপনেগো যে থাকতে দিছি হেইডাই অনেক। এমন নরপিশাচ লাথি মাইরা ঘর থেইকা বাইর করে দেওয়া উচিত।

★★★

এই অবধি বলে চারু ছোট একটা শ্বাস নিলো। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। সীমা তাকে পানির বোতলটা এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে সম্পূর্ণ পানিটা শেষ করলো সে,
– সেদিন রাতেই একসপ্তাহের কথা বলে বেড়িয়েছিলো আমার ভাই। সে বলেছিলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে সেখান থেকে নিয়ে যাবে। হয়তো এক সপ্তাহও লাগবেনা। কিন্তু এরপর আর কখনো ফিরে আসেনি সে। অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু সে এলোনা। আমার জীবনের বিপর্যয় আমার মায়ের মৃত্যুর পর শুরু হয়নি, শুরু হয়েছিলো যখন আমার ভাইয়ের ছায়া আমার মাথা থেকে সরে গেলো।
নরম কণ্ঠে কথাটা বলে একটু থামলো সে। তারপর যথাসম্ভব কঠিন গলায় বললো,
– আর কিছু বলবো না আমি। বেড়িয়ে যান এখান থেকে।
সীমার মেজাজটাই বিগড়ে গেলো চারুর কথা শুনে। এমনভাবে কথা বলছে যেনো মামা বাড়িতে বেড়াতে এসেছে সে। সে কিছু একটা বলতেই যাবে কিন্তু তাকে আটকে দিলো সাজিদ। চারুর কথার জবাব দিলো হিমেল,
– এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? বারবার থেমে যাও কেনো? পুরোটা একসাথে বলো। বললে আমি তোমাকে পুরান ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াবো।
চারু সশব্দে হেসে উঠলো। ভয়ংকর সে হাসি।
– খাসিতে আর রুচি হয় না আমার। আমি তো শেফালীর মাংসের বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করি। ডেডবডি নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে আছে? এনে দেবেন আমাকে? আপনাকেও নাহয় শেফালীর মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াবো। অবশ্য শেফালীকে খাসির সাথে তুলনা করলে খাসির অপমান হবে।
হিমেল হতভম্ব হয়ে গেলো। সে ভুলেই গিয়েছিলো চারুর ইতিহাস। বহুকষ্টে বমিটা আটকে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে। তার পেছনে সাজিদ ও সীমাও।
– স্যার মেয়েটা প্রচন্ড রকমের অসভ্য। এ নিয়ে দুবার আমার বিরিয়ানি খাওয়ার উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো। আর হামিদও কেমন হারামি, বোনের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে কিভাবে চম্পট দিলো। ওকে আমি ভালো ভেবেছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও কি না চারুর সাথে বেইমানি করে পালালো?
– না হিমেল। এখানে কিছু একটা ঝামেলা আছে। হামিদ পালানোর মতো ছেলে না। যতদুর শুনলাম হামিদ প্রচুর সাহসী ও তেজী ছেলে। এমন ছেলে আর যাই হোক পালিয়ে যাবে না। কিন্তু তাহলেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, হামিদ যদি নাই পালায় তাহলে সে ফিরে এলো না কেনো? কি হয়েছিলো তার সাথে?

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া