আলোকবর্ষ পেরিয়ে পর্ব-১২

0
584

#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে পর্ব-১২
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২৪>
সেদিন রাতে অভীক যখন বাড়ি ফিরেছিল তখন ঘড়িতে এগারোটা। ইচ্ছে করেই আজকাল ও অফিসে কিছুটা বেশি সময় কাটায়; কারণ বাড়িতে একই ঘরে থেকেও ঐশীর সাথে যেই নিঃস্তব্ধতার সম্পর্কটা আজকাল তৈরি হয়েছে, সেখানে দম বন্ধ লাগে ওর। আর সত্যি আজকাল নিজেকে খুব বাড়তি অপ্রয়োজনীয় মনে হয় কেমন সবার কাছে। ঐশী, মেঘা এই দুজন কাছের মানুষই তো আজ ওর থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে, কেউ ওকে সামনে দেখতে অব্দি চায় না নিজেদের। তাহলে অভীক এক তরফা আর কত চেষ্টা করবে! কথাগুলো ভাবলেই সেদিন মেঘার ঘটনাটা মনে পড়ে যায় ওর। মেঘা অমৃত বলে ছেলেটাকে খুব খুশি মনেই আলাপ করাতে নিয়ে এসেছিল ওর সঙ্গে অফিসে। তিন বছরের রিলেশন ওদের। এখন অমৃত একটা নতুন ব্যাবসা শুরু করতে চাইছে। মেঘাও পার্টনার এই স্টার্ট আপে। তার জন্য কিছু টাকা ফান্ডিং দরকার। সেই কারণেই আরো মেঘা ওকে নিয়ে এসেছিল অভীকের কাছে। অভীকও সহজ মনে কথা বলেছিল ওর সঙ্গে প্রথমে। মেঘা যে ছেলেটাকে নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস, এটা ও শুরু থেকেই বুঝেছিল। কিন্তু তাল কাটলো অরূপের কথা শুনে। অরূপের পুরনো পাড়াতে থাকতো না কি এই ছেলেটা আগে। ছেলেটা ড্রাগস নেয়, এমনকি বাইক চুরির জন্য না কি জেলও খেটেছে এক মাস! অভীক কথাটা শুনে বিশ্বাস না করতে চাইলেও ফেলেও দিতে পারেনি সবটা। অরূপ ওর অফিসে এতদিন কাজ করছে; অভীকের খুবই বিশ্বস্ত লোক। অরূপ এত বাজে কথা বলবে না কখনো! কথাগুলো ভেবেই ও অমৃতের খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছিল ভালোভাবে। ব্যাবসার জন্য পুলিশের অনেক বড় বড় পোস্ট এর লোকেদের চেনা আছে অভীকের। তাদেরই কাজে লাগিয়ে সবটা জানতে পেরেছিল অভীক। ওই ভালো মানুষ চেহারাটার আড়ালে অমৃত আসলে একজন ড্রাগিস্ট। ক্রিমিনাল রেকর্ডও আছে ওর। শুধু তাই না, মেঘা আর অমৃতের ব্যাঙ্ক ডিটেলস চেক করে জানতে পেরেছিল মেঘার একাউন্ট থেকে বেশ কয়েকবার ত্রিশ চল্লিশ হাজার করে টাকার ট্রানজ্যাকশন হয়েছে অমৃতের একাউন্টে। এরপর অভীকের কাছে সবটা খুব স্পষ্ট হয়ে গেছিল। শুধুমাত্র টাকার জন্য এই ছেলেটা আছে মেঘার সঙ্গে। বাকি সবটা অভিনয়। আর মেঘার মতন সরল মেয়ে কে এইভাবে মিথ্যে কথা বলে ঠকিয়ে নেওয়া ভীষণ সহজ। কথাগুলো বুঝতে পেরেই অভীক অমৃতের এগেনস্ট এ লিগ্যাল স্টেপ নিয়েছিল। টাকা তছরুপের কেস করে দিয়েছিল ও অমৃতের এগেনস্ট এ। আর মেঘার থেকে যাতে ও দূরে থাকে, তার জন্য কমিশনারকে দিয়ে থ্রেট ও দেখিয়েছিল অভীক ওই ছেলেটাকে। কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটাই একসেপ্ট করতে পারেনি মেঘা কিছুতেই। অভীক এইসব হওয়ার দিন বাড়ি এসে মেঘাকে অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল অমৃতের সত্যিটা। কিন্তু মেঘা কোনভাবেই বিশ্বাস করেনি অভীক কে। কোন কথা শুনতেই চায়নি ওর। আসলে অভীক সব সময় মেঘাকে নিয়ে এতটা প্রটেক্টিভ ছিল বলেই হয়ত মেঘা মনে মনে বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে অভীক ইচ্ছে করে ভেঙে দিয়েছে ওদের সম্পর্কটা। কোন মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলের সঙ্গে অভীক নিজের বোনের রিলেশনটা মানতে পারেনি আসলে। তাই সব শেষ করে দিয়েছে এইভাবে।
সেদিন কথাগুলো মেঘা মুখের ওপর বলেছিল অভীক কে। তারপর রাত্রিবেলা কিছু না বলে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। এরপর অভীককে কিছু না জানিয়ে মন্দিরে গিয়ে অমৃতের সঙ্গে বিয়ে করে নিয়েছিল সেদিন। অভীক তবে অনেক চেষ্টা করেছিল মেঘার সাথে যোগাযোগ করার। পুলিশের থ্রু দিয়ে শেষে খুঁজে বার করেছিল বোনকে, কিন্তু মেঘা কিছুতেই কোন রকম কথা বলতে চায়নি অভীকের সাথে। আর মেঘা যেহেতু একজন এডাল্ট, তাই পুলিশও কোনভাবে জোর করতে পারেনি ওকে অভীকের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য। এরপর এতগুলো দিন কেটে গেছে। মেঘা অভীকের সাথে কোন রকম কনট্যাক্ট রাখে না। যদিও অমৃত আসে প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে অভীকের কাছে, হাত পেতে টাকা নিতে। নিজে তো কোন কাজকর্ম করে না আসলে। সংসার চালানোর সমস্ত খরচ তাই নেয় অভীকের কাছ থেকে। আর অভীকও কখনো এই টাকা দিতে না করে না নিজের বোনের কথা ভেবে। বোন মুখ ঘুরিয়ে থাকলেও অভীক তো কখনো পারবে না সেটা করতে! দূরে থেকেও সব রকম ভাবে চেষ্টা করবে মেঘার খেয়াল রাখার। টাকার জন্য যাতে ওর কোন রকম অসুবিধা না হয় রোজকার জীবনে, তাই অমৃত কে কখনো খালি হাতে ফেরায় না ও। আর মেঘার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য একমাত্র এই ছেলেটাই তো ভরসা! নইলে তো কোন যোগসূত্র নেই আর ওদের। মেঘা তো এতদিন হয়ে গেল, অভীকের কোন রকম ফোন অব্দি রিসিভ করে না আসলে। কোন কথা বলতে চায় না আর। ওর কাছে অভীক এখন ওর সব থেকে দূরের লোক, যে ইচ্ছে করে ওর এতদিনের রিলেশনটা শেষ করতে চেয়েছিল এক মুহূর্তে। তাই দাদার ওপর ভীষণ রাগ ওর। এমনকি অমৃত যে প্রত্যেক মাসে অভীকের কাছে আসে টাকার জন্য, এই কথাটাও মেঘা জানে না। জানলে না কি কোনদিন ওই টাকা ছুঁয়ে দেখতো না মেঘা। অমৃত ই প্রত্যেকবার এসে এইসব বলে যায় অভীক কে। আর অভীক কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে যায় যেন! বিশ্বাস করতে পারে না যে যেই বোন ছোটবেলা থেকে দাদা ছাড়া কিছু বুঝতো না, সে আজ মাসের পর মাস ওর থেকে এইভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে! এইভাবে ভুলে থাকতে পারে অভীক কে। তাহলে কি ঐশী ঠিকই বলতো! অভীকের প্রচণ্ড কনসার্ন, প্রচণ্ড প্রটেক্টিভ নেচারই মেঘার মনে খারাপ লাগা তৈরি করেছিল ওর জন্য! আর সেটা এইভাবে একটা ভুল বোঝাবুঝির জায়গা তৈরি করে দিল দুজনের। কথাটা যতবার মনে হয়, ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যায় যেন অভীক। প্রচণ্ড নিঃস্ব, একা মনে হয় ওর নিজেকে। মনে হয় শুধুমাত্র নিজের ভুলের জন্যই আজ ওর পাশে কেউ নেই। মেঘা ঐশী দুজনেই আজ ওকে ছেড়ে চলে গেছে বহু দূরে, আর কখনো না ফেরার জন্য।

কথাগুলো সেদিন অফিস থেকে ফিরে মেঘার ফাঁকা ঘরটায় ঢুকে ভীষণ মনে হচ্ছিল আবারও অভীকের, আর স্থির দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে ছিল টেবিলে রাখা মেঘার হাসি মুখের ছবিটার দিকে। সেই মুহূর্তে ঐশী এসেছিল এই ফাঁকা ঘরে। একটা খাবারের প্লেট হাতে। অভীক তবে খেয়াল করেনি ওকে। ও আসলে কেমন নিস্পলক চোখে তাকিয়ে ছিল মেঘার ছবির দিকে, আর আকাশ পাতাল ভেবে যাচ্ছিল এক মনে। কিন্তু ঐশী এই মুহূর্তে খেয়াল করেছিল এই বদলে যাওয়া, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া অভীককে। কেমন যেন ফ্যাকাসে, দুর্বল লাগছিল ওকে। চোখ দুটোর মধ্যে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ছিল আজ। ঐশী যেন না চাইতেই খেয়াল করেছিল সবটা, আর মনে মনে থমকে গেছিল হঠাৎ। তাহলে কি অভীক খুব খারাপ আছে! মেঘা, ওর, দুজনের চলে যাওয়াটা কি মানতে পারেনি অভীক। ভীষণ বড় ধাক্কা লেগেছে ওর! কথাগুলো যেন আনমনে মনে হয়ে ছিল ঐশীর। আর সেই ভাবনার ভিড়েই ও আলতো স্বরে ডেকেছিল অভীককে।
অভীক এরপর নিজের চিন্তাগুলো থেকে বেরিয়ে তাকিয়েছিল ঐশীর দিকে। ঐশী এই মুহূর্তে খাবারের প্লেটটা ওর সামনে নিয়ে এসে বলেছিল আস্তে গলায়,
—–” কালকে আমার অতোটা রিয়্যাক্ট করা উচিত হয়নি তোমার ওপর। সরি.. আর খাবারটা এনেছি, খেয়ে নিও। কাল রাতের মতন না খেয়ে থেকো না আর।”
কথাগুলো এক সাথে বলে ঐশী চলে যেতে যাচ্ছিল সেদিন, কিন্তু থমকে গেল অভীকের কথায়। অভীক কেমন স্থির গলায় ওকে কিছু না ভেবেই বলে উঠেছিল,
—-” আজ আমার সঙ্গে খাবে প্লিজ! একটা দিনের জন্য। আসলে একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না রোজ। কষ্ট হয়।”
কথাটা শুনে ঐশী নিজেও কেমন স্থির হয়ে গেছিল হঠাৎ। অভীকের ভাঙা চেহারা, চোখের কোণের কালিটা যেন আরো বেশি করে চোখে পড়েছিল ওর, এই মুহূর্তে। আর খারাপ লাগছিল খুব মন থেকে, এই ছেলেটার জন্য।
সেদিন ঐশী এরপর কিছুটা নরম স্বরেই ওকে বলেছিল,
—–” তুমি একটু ওয়েট করো। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
এরপর ওরা অনেকদিন বাদে একসাথে খেয়েছিল আজ। যদিও সময়টা নিঃস্তব্ধতায়ই মোড়া ছিল সারাক্ষণ। কেউই কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না ঠিক বলার মতন! তবে আজ হঠাৎ এই এক আলোকবর্ষ সমান দূরত্বটা একটু হলেও যেন কেটেছিল দুজনের মধ্যে শব্দহীন ভাবে।
<২৫>
সেদিনের পর কটা দিন কেটে গেছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে। আজ বাইশে ফেব্রুয়ারি। প্রত্যেক বছরের মতন এই বছরও দিনটা খুব স্পেশ্যাল অভীকের জন্য, কারণ আজ মেঘার বার্থ ডে। আজকের দিনে অভীক মন্দিরে যায়, অনাথ আশ্রমে বাচ্চাদের খাওয়ায়, গিফ্ট দেয়। সব ওই বোনটার ভালো থাকার জন্য। যদিও এই বছর সবই আলাদা। মেঘা আজ ওর থেকে অনেক দূরে! তাও ওর বিশ্বাস আজকের দিনে মেঘা কিছুতেই নিজের দাদার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না। আজ ও অভীকের সাথে অন্তত একবার কথা বলবে। কথাগুলো ভেবেই সকালে উঠে ছিল ও। রোজের মতন কাল রাতেও ঠিকভাবে ঘুম হয়নি অভীকের। মাথার এক পাশটা ভার হয়ে আছে তাই খুব। তবে এটা নতুন না। কদিন ধরেই খুব ক্লান্ত লাগে অভীকের। খেতে কিছুই ঠিক ইচ্ছে করে না। ভেতরে ভেতরে খুব উইক লাগে যেন। তবে এগুলোকে আর কোন কষ্ট বলে মনে হয় না অভীকের। মনের মধ্যে সারাক্ষণ দুজন মানুষের জন্য যেই ফাঁকা ভাব, শূন্যতাটা ঘিরে থাকে ওকে, তার যন্ত্রণার কাছে শরীরের অন্য কোন কষ্টই ফিল হয় না বিশেষ। কথাটা আনমনে ভাবতে ভাবতেই উঠতে যাচ্ছিল সেদিন সোফা থেকে; কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ঠিক যেন। অভীক এর মাথাটা ঘুরে গেল হঠাৎ এখনই, ও টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল মাটিতে সেই মুহূর্তে, কিন্তু তখনই ঐশী এসে ওকে আঁকরে ধরলো শক্ত করে। ও অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হতে হতে আনমনে অভীক কে দেখছিল আসলে। কাল রাতে জল তেষ্টায় যখন ঘুম ভেঙে গেছিল ওর, অভীক কে তখন ভীষণ কুঁকরে শুয়ে থাকতে দেখেছিল সোফায়। কেমন কাঁপছিল ও ঘুমের ঘোরে। ঐশী এই দৃশ্য দেখে নিজেকে আর আটকাতে পারেনি। অভীকের কাছে গিয়ে চাদর চাপা দিয়ে দিয়েছিল ওকে। কিন্তু ঘুমের মধ্যেই ওর চোখ মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছিল ছেলেটার শরীর ঠিক নেই বিশেষ। আর আজ সকালে মিলেও গেল সেটা। কথাগুলো আনমনে ভাবতে ভাবতেই ও অভীক কে জিজ্ঞেস করেছিল সেদিন,
—-” কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে? আজকের দিনটা রেস্ট নাও তাহলে। বেরিও না কোথাও!”
কথাগুলো কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়েই বলেছিল ঐশী অভীক কে। কিন্তু এই মুহূর্তে অভীক একটু যেন অবাকই হয়ে ছিল! ওকে নিয়ে ঐশীর কনসার্ন দেখে। তবে জানে, এটা সাময়িক। কিছুক্ষণ পরে আবার সব আগের মতন হয়ে যাবে। ঐশী এই শক্ত করে ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দেবে নিজের। কথাগুলো মনে আসতেই অভীক একটু ক্লান্ত স্বরে বলেছিল,
—-” কিছু হয়নি আমার। ঠিক আছি। আর আজ তো বাড়িতে বসে থাকলে হবেই না আমার! মেঘার জন্মদিন যে। অনেক কাজ। মন্দিরে যেতে হবে, ওর নামে পুজো দিতে, তারপর অনাথ আশ্রমে! আসলে বাচ্চাদের খাওয়াই আজকের দিনটা আমি! তাই কোনভাবেই বাড়িতে থাকলে হবে না।”
কথাগুলো খুব জোর দিয়ে বলেছিল অভীক। যদিও ওর চোখ মুখ পুরো বসে গেছিল যেন! অভীকের যে ভেতরে ভেতরে কষ্ট হচ্ছে শরীরে, সেটা ওকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্ট। কিন্তু সবটা খেয়াল করেও ঐশী আর আটকায়নি ওকে। জোর করেনি বাড়িতে থাকার জন্য। আসলে ওদের সম্পর্ক টা তো আর সেই জায়গায় নেই, যেখানে অনেক চিন্তা, অনেক কনসার্ন দেখানো যায় একজন আরেকজনের প্রতি! ঐশীর মনে পুরনো দিনগুলো, পুরনো খারাপ লাগা গুলো যে এখনো জমে আছে ভীষণভাবে। তাই অভীকের সাথে মাপা দূরত্ব রেখে চলাটাই নিয়ম। সেই জন্যেই ঐশী আর আজ কোন কথা বাড়ালো না এই মুহূর্তে। যেতে দিল অভীক কে ওই শরীরে, নিশ্চুপে।
তবে এরপরও সারাদিন ঐশী কোনভাবেই নিজেকে আটকাতে পারেনি অভীকের চিন্তা থেকে। কারণে অকারণে বার বার শুধু অফিসে মনে পড়েছে ওর অভীকের ওই ফ্যাকাসে মুখটা! যেইভাবে মাথা ঘুরছিল আজ ছেলেটার সকালে, যদি শরীরটা আরো খারাপ হয়! কথাটা যেন মাঝে মাঝেই মনে এসে ভিড় করেছে ঐশীর। আর সেদিন কাজের মাসি তো বললো, অভীকের খাওয়া দাওয়া অনেকদিন ঠিক নেই একদম; তার ওপরে বিয়ের পর পরই তো ওর এনিমিয়া ধরা পড়েছিল। লো প্রেশারের প্রব্লেমও ছিল ছেলেটার। সেই সময় ঐশী অভীকের খাওয়া দাওয়ার সব সময় খেয়াল রাখতো খুব; মনে করে ওষুধ দিত ওকে আয়রনের। কিন্তু এখন এইভাবে যত্ন কি অভীক নিজের নেয়! মেঘা থাকলেও না হয় ওকে দেখার কেউ একজন থাকতো। কিন্তু মেঘার চলে যাওয়াটা ও তো অভীকের কাছে কম ধাক্কা নয়! সবটা মিলিয়ে অভীকের শরীরটা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে না তো! কথাগুলো যেন না চাইতেও আজ ভেবে ফেলছিল ঐশী কাজের ভিড়ে, সারাক্ষণ।

যাইহোক, এইভাবে দিনটা কেটে যাওয়ার পর ঘড়ির কাঁটা যখন সাতটা, তখন ঐশী বেরিয়েছিল অফিস থেকে। আজ আবার বাবাকে কিছু ওষুধ কিনে দেওয়ার আছে! সেইসব করে বাবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যখন এই বাড়ি এসেছিল, তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা। তবে আজ ঘরে ঢুকে থমকে গেছিল ও। অন্ধকারের মাঝে অভীক কেমন নিঃস্তব্ধ হয়ে বসে আছে একা মাটিতে। ঐশীর ওকে দেখে হঠাৎ কেমন লেগেছিল যেন! ছেলেটা ঠিক আছে তো! কথাটা মনে আসতেই ও তাড়াতাড়ি গেছিল অভীকের কাছে, তারপর ওর পাশে বসে আস্তে গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
—-” কি হয়েছে তোমার? এইভাবে মাটিতে বসে আছো কেন! শরীর ঠিক আছে তো?”
প্রশ্নগুলো এক সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল ঐশী। কিন্তু অভীক এই প্রশ্নে কিছুটা সময় নিয়ে কেমন ক্লান্ত স্বরে উত্তর দিয়েছিল,
—-” মেঘা আজকের দিনেও একবার কথা বললো না আমার সঙ্গে! একবার ফোন অব্দি রিসিভ করলো না! অমৃত এসেছিল আজ অফিসে, টাকা নিতে। আমি ওকেও বললাম। একবার অন্তত মেঘার সাথে যদি কথা বলিয়ে দেয় আমার! কিন্তু অমৃত বললো, মেঘা আমার নামটাও করেনি না কি আজ সকাল থেকে! ও কোন রকম যোগাযোগ করতে চায় না আর!”
কথাগুলো বলতে বলতে অভীক কেঁদে ফেলেছিল হঠাৎ নিঃশব্দে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল ও। ঐশী যে অমৃতকে চেনে না; এটা মাথাতেই ছিল না অভীকের! তবে ঐশী সবটা না বুঝলেও এটা বুঝেছিল যে ছেলেটা অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে আজ! মেঘার এইভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকা, ওর থেকে অচেনা হয়ে থাকা অভীক কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না! ছেলেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে তাই ভেতরে ভেতরে। কথাটা মনে হতেই ঐশী খেয়াল করলো অভীক কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে যেন। কথা বলার অবস্থাতেও আর ঠিক নেই। ঐশী এবার আর চুপ না থেকে বলে উঠলো,
—–” ওঠো তুমি মাটি থেকে। তোমার শরীর ঠিক নেই। ওঠো প্লিজ।”
কথাটা বলেই ঐশী অভীকের হাতটা ধরেছিল, আর হঠাৎ বুঝতে পেরেছিল ওর শরীরের উষ্ণতাটা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার! ঐশী এটা দেখে ওর কপালে, গালে হাত দিয়েছিল। সত্যি ছেলেটার ভীষণ জ্বর! সেই জন্যই এরকম নিস্তেজ হয়ে গেছে একদম। কথাটা ভেবেই ঐশী সেই মুহূর্তে অভীক কে ধরে তোলার চেষ্টা করেছিল মাটি থেকে। কিন্তু অভীকের কোন শক্তিই ছিল না আর ঠিক। সমস্ত শরীরের ভারটাই তাই ঐশীর ওপর দিয়ে দিয়েছিল আজ। ঐশী তবে অভীককে খুব শক্ত করে আঁকরে ধরেছিল এই সময়ে। আর অনেকদিন বাদে এই প্রথম অভীকের শরীরের গন্ধটা পেয়েছিল যেন হঠাৎ, খুব কাছ থেকে। অভীক কে এই অবস্থায় দেখে আসলে ঐশী আর আগের রাগ, অভিমানগুলো রাখতে পারেনি নিজের মনে। বরং তার জায়গায় এক রাশ চিন্তা এসে জড়ো হয়ে ছিল মনে।
সেদিন এরপর ঐশী অভীককে আর দূরে রাখেনি নিজের থেকে। খাটে এনে শুয়েছিল ওকে। তবে এরপর অভীক পুরোপুরি সেন্সলেস হয়ে গেছিল সেদিন। ঐশীর ওর এরকম অবস্থা দেখে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল যেন। ও তাড়াতাড়ি ওদের চেনা ডাক্তারকে ফোন করেছিল। ডক্টর বসু এর আগেও দেখেছে অভীক কে। উনিই বুঝবে ভালো ওর অবস্থা।
এরপর প্রায় এক ঘন্টা বাদে ডক্টর বসু এসে দেখেছিল অভীক কে। অনেকদিন ধরে ঠিকভাবে কিছু খায়নি ছেলেটা। শরীরে রক্ত একদম কম। আর প্রেশারও খুব লো। তার ওপরে এতটা টেম্পারেচর! তাই রিকভার হতে টাইম লাগবে। কথাগুলো বেশ চিন্তা নিয়েই বলেছিলেন উনি।
ঐশী সেই মুহূর্তে এইসব শুনে থমকে গেছিল যেন। অভীক এর ফ্যাকাসে চেহারা, নিস্তেজ শরীরটা দেখে ও কেমন শেষ হয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। মনে হচ্ছিল ঐশী কেন একটু দেখলো না অভীক কে! ও তো এসে শুনেছিল, অভীক ঠিকভাবে খায় না কিছু। তাহলে কেন কথাটার কোন গুরুত্ব দিল না ও! এত কিসের রাগ; যে এতটা শরীর খারাপ, এটা বুঝেও বুঝলো না ঐশী!
সেদিন এসব ভাবনার ভিড়েই সারা রাত বসেছিল ঐশী অভীকের মাথার কাছে। ভিজে রুমাল দিয়ে বার বার কপালটা ভিজিয়ে দিচ্ছিল ওর, যাতে জ্বরটা কমে। অভীক যতবার জ্বরের ঘোরে কেঁপে উঠছিল কষ্টে, ঐশী ওকে সামলাচ্ছিল ধরে। মাঝে মাঝেই শক্ত করে হাতটা আঁকরে ধরছিল অভীকের।

চলবে।