আলোকবর্ষ পেরিয়ে পর্ব-১৩

0
576

#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে ( ত্রয়োদশ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র

কিন্তু এর পরের দুদিন ও একই রকম অবস্থা ছিল অভীকের। বরং বলা যায় খারাপের দিকেই গেছিল ছেলেটা। খুব জ্বরের জন্য হঠাৎ শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছিল ওর। ঐশীর হাতটা ধরে ছট্ফট্ করছিল অভীক একটু শ্বাস নেয়ার জন্য। ঐশীর সেই মুহূর্তে সব এলোমেলো হয়ে গেছিল হঠাৎ! অভীককে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলার ভয় এসে জড়ো হচ্ছিল মনে। কেমন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল যেন তখন। এতদিন তো ছেলেটা চোখের সামনেই ছিল! দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে শুধু ঐশীর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য! আর ঐশী ওইভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকলো! একবার কাছে গেল না অভীকের! কথাগুলো ভীষণভাবে মনে হচ্ছিল যেন ওর। তার মধ্যেই কোন মতে ডাক্তার কে কল করেছিল ঐশী। এরপর অক্সিজেন দিতে হয়েছিল অভীক কে, একটা গোটা দিন। ঐশী যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল সেই সময়। অভীক এর নিস্তেজ শরীর, ক্লান্ত মুখটাকে দেখে বার বারই চোখ টা ভিজে আসছিল ওর। শুধু মনে হচ্ছিল এতদিনে একবার যদি ঐশী অভীকের কথা ভাবতো, ওর একটু খেয়াল রাখতো, একবার যদি ওর এই ছন্নছাড়া জীবনটায় এসে হাতটা শক্ত করে ধরতো নিজে থেকে, তাহলে একটু একটু করে ধ্বংস করা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারতো হয়তো ছেলেটাকে। এইভাবে এতটা কষ্ট পেতে দেখতে হতো না ছেলেটাকে।
এর পরের দিন অভীকের শ্বাস কষ্টটা না থাকলেও এতটা উইক ছিল, যে সেন্স ছিল না বিশেষ। তবে মাঝে মাঝে এক দুবার জ্ঞান ফিরছিল ওর। ঐশী সেই সময় যেন আরো বেশি করে অভীকের কাছে আসছিল। অভীক তবে সেই সময়ে আবছা চোখে ঐশীকে দেখে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছিল যেন! জ্বরের ঘোরে ও নিজের মনেই বলে উঠছিল,
—-” তুমি! তুমি যাওনি এখনো? সবাই তো চলে গেছে! কেউ আর থাকতে চায় না আমার সঙ্গে। কেউ নেই আর।”
কথাগুলো কেমন এলোমেলোভাবে বলছিল অভীক। ঐশীর সেই মুহূর্তে কেন জানে না মনে হচ্ছিল, এই কারণে অভীক সুস্থ হচ্ছে না। ও চোখ খুলে তাকাচ্ছে না। এতদিনের এত যন্ত্রণা, এতটা একাকীত্বের জন্যই হয়ত আর ফিরতে চায় না ও জীবনে। কথাগুলো ভেবেই ঐশী অভীকের হাতটা শক্ত করে ধরছিল খুব। তারপর ওকে বিশ্বাস করানোর জন্যই যেন বলছিল খুব দৃঢ় গলায়,
—–” আমি কোথাও যাইনি অভীক। আমি সঙ্গেই আছি তোমার। প্লিজ একবার তাকাও। প্লিজ এইভাবে থেকো না আর! আই কান্ট সি ইউ লাইক দিজ…”
কথাগুলো বলতে বলতে ঐশীর চোখটা ভিজে আসছিল হঠাৎ। ও সত্যি আর পারছে না অভীককে এইভাবে দেখতে! ওই পুরনো সুস্থ, ছট্ফটে ছেলেটাকে মনে হচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে ও। অনেক বেশি শাস্তি দিয়ে ফেলেছে অভীককে।

<২৬>
এইসব এলোমেলো চিন্তার ভিড়েই সেদিনের রাতটা পেরিয়ে সকাল নেমেছিল শহরে। আর আজ প্রায় আড়াই দিন বাদে অভীক একটু সুস্থ্য হয়ে ছিল। জ্বরটা নেমেছিল ওর। সেদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই তবে স্থির হয়ে গেছিল যেন। ঐশীর বুকে মাথা রেখে ও চোখ খুলেছিল আসলে। তার মানে কি সারা রাত এইভাবেই ঘুমিয়েছিল ও! কথাটা মনে ভাবতেই ও অনেকদিন বাদে খুব কাছ থেকে দেখেছিল ঐশীকে। ওর এলোমেলো চুল, আলতো ঘুমের মধ্যে থাকা মিষ্টি মুখ, সব কিছুকে যেন নতুন করে দেখছিল ও! নিঃশব্দে। সেই মুহূর্তে ঐশীর ঘুম ভেঙে গেছিল হঠাৎ। ও চোখ খুলেই অভীক কে দেখে অবাক হয়ে বলেছিল,
—-” ঠিক আছো তুমি? জ্বর নেই তো? কষ্ট হচ্ছে না তো কোন?”
অভীক এত গুলো প্রশ্ন শুনে একটু অসংলগ্ন হয়ে গেছিল নিজে। ও কাল রাতে জ্বরের মধ্যে বেখেয়ালেই হয়ত ঐশীর এত কাছে চলে এসেছে! ঐশী এটা দেখে খারাপ ভাববে না তো! কথাটা ভেবেই ও নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে আস্তে গলায় উত্তর দিয়েছিল,
—-” আমার ঠিক লাগছে এখন। বেটার লাগছে।”
ঐশী এই কথায় ওর কপালে নিজের হাত ঠেকিয়ে দেখেছিল জ্বরটা। না, আর গা গরম নেই। তাহলে জ্বর নেমেছে অবশেষে। এটা ভেবেই ঐশী যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল অবশেষে। কিন্তু অভীক কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না ঠিক! ঐশী ওকে নিয়ে চিন্তা করছে! এটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না এখন।
যাইহোক, এরপর কিছুক্ষণ বাদে ঐশী ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছিল অভীকের কাছে। তবে অভীক খাবার দেখেই বলে উঠেছিল,
—-” আমি কিছু খাবো না। ইচ্ছে করছে না।”
ঐশী এটা শুনে জোর দিয়ে বলেছিল,
—-” ইচ্ছে না হলেও খেতে হবে। তুমি জানো, তোমার শরীরে হিমোগ্লোবিন কমে গেছে, প্রেশার লো। সব এই ঠিকঠাকভাবে না খেয়ে থাকার জন্য, দিনের পর দিন। এই তিনদিন তোমার কি অবস্থা হয়ে ছিল; জানো তুমি?”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল ঐশী। অভীক তখন নিজের মনেই যেন অল্প হেসে উঠেছিল। তারপর খুব আফসোসের গলায়ই বলেছিল,
—- ” মরলাম তো না! কি আর হলো! এত সহজে মনে হয় যাবো না।”
কথাটা শুনে ঐশী যেন থমকে গেছিল কেমন। অভীক এইভাবে বলছে! ও কি সত্যি আর বাঁচতে চায় না! কথাটা মনে হতেই ঐশী আর নিজেকে আটকায়নি। ও সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিল অন্য একটা কথা,
—-” মেঘনা কোথায় অভীক? কি হয়েছে তোমাদের মধ্যে? বলো আমাকে।”
কথাটা বলে ঐশী আজ অভীকের হাতটা ধরেছিল নিজে থেকে, এটা বোঝানোর জন্য, যে অভীক একা নেই। ঐশী আছে সঙ্গে।
সেদিন হয়ত এই স্পর্শটারই ভীষণ দরকার ছিল অভীকের। সমস্ত খারাপ লাগা গুলোকে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখতে রাখতে ও যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিল রোজ। তাই চোখটা ভিজে এসেছিল এই মুহূর্তে হঠাৎ। আর সেই আবছা চোখেই ও বলেছিল,
—–” মেঘনা চার মাস আগে এই বাড়ি ছেড়ে গিয়ে অমৃত বলে একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে করেছে। এখন ওর সাথেই থাকে। ছেলেটা খুব খারাপ। ড্রাগস নেয়, পুলিশ রেকর্ড আছে। আমি সব জানতে পেরে বলেছিলাম এটা ওকে। অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, অমৃত কে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ও আমাকেই ভুল বুঝলো। তুমি ঠিকই বলতে! খুব বেশি কন্ট্রোল করে ফেলেছিলাম হয়ত একটা সময় ওর লাইফ! তাই অনেক ডিসটেন্স তৈরি হয়ে গেছিল। সেই জন্য আমার কোন কথাই বিশ্বাস করেনি মেঘা। উল্টে এক রাতের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নিল! আর তারপর থেকে আজ অব্দি এতদিন, ও আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি। অমৃত প্রত্যেক মাসে এসে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। নিজে আসলে কোন রোজগার করে না। সংসার চালানোর সব টাকা আমার থেকেই নেয়। তার বদলে ওর কাছ থেকে আমি আমার বোনের খবর পাই। যদিও মেঘা এটা জানে না। জানলে হয়ত আমার টাকা নিত না ও! নিজের কষ্ট হলেও। আসলে এখন তো আমি সব থেকে দূরের লোক মেঘার! যার ফোনটাও একবারও রিসিভ করা যায় না!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল অভীক। ঐশী সেই মুহূর্তে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। অভীক কে আর ভেঙে পড়তে দেখবে না ও কিছুতেই।
সেদিন এরপর ঐশী অভীক কে কোনভাবে শান্ত করে আস্তে গলায় বলে উঠেছিল একটু ভেবে,
—–” আমার একটু অবাক লাগছে ব্যাপারটা! মেঘা তোমার সাথে যোগাযোগ না রেখে এতগুলো দিন থাকতে পারবে! এটা কিভাবে সম্ভব! ও তো দাদা ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না কখনো। মানছি, কিছু কিছু ব্যাপারে হয়ত মতের অমিল হতো; কিন্তু তার মানে এই না যে ও তোমার এগেনস্ট এ ছিল!”
কথাগুলো শুনে অভীক এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ই বলেছিল,
—- ” এখন সব বদলে গেছে। এতদিনে নইলে একবার আমার ফোনটা অন্তত ধরতো মেঘা!”
কথাটা শেষ হতেই ঐশী এই মুহূর্তে অন্য একটা কথা বলে উঠলো হঠাৎ। ও কিছুটা কৌতূহল নিয়েই বললো,
—–” তুমি মেঘার এড্রেসটা আমাকে একটু দিতে পারবে? আমি তো ওর খুব ক্লোজ ছিলাম! আমি কথা বললে যদি কিছু ঠিক হয়!”
এটা শুনে অভীক যেন নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছিল কেমন। ও নিস্পলক ভাবে ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল স্থির গলায়,
—–” তুমি কথা বলবে মেঘার সাথে! আমার জন্য!”
এটা শুনে ঐশী আলতো হেসে আরেকবার অভীকের হাতটা ধরেছিল শক্ত করে। তারপর খুব সহজ ভাবে বলেছিল ওকে,
—–” হ্যাঁ বলবো। কিন্তু তার আগে তুমি এই খাবারটা ঠিকঠাকভাবে খাও। প্লিজ..”

সেদিন এরপর নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিল ঐশী অভীক কে, অনেকটা যত্ন নিয়ে। অভীক যদিও খুব আরষ্ট ছিল ঐশীর কাছে। আসলে এতদিনের দূরত্ব টা কে ভুলতে পারছিল না ঠিক! কিন্তু ও আর এরপর কিছুতেই না করতে পারেনি খাওয়ার ব্যাপারে ঐশীকে।
তবে ঐশী মনে মনে জানতো, শুধু এই টুকুতেই হবে না। মেঘাকে যে করেই হোক অভীকের কাছে নিয়ে আসতে হবে আবার। নইলে ছেলেটা বাঁচবে না! শেষ করে দেবে কোন না কোনভাবেই নিজেকে!
কথাগুলো ভেবেই ও সেদিন বেলার দিকে গেছিল অভীকের দেওয়া এড্রেসে, মেঘার খোঁজে। কিন্তু ওর কেন জানি না সব কিছু খুব গন্ডগোলের মনে হচ্ছিল শুরু থেকেই! মেঘা অভীকের এতটা ক্লোজ ছিল! এত ভালোবাসতো নিজের দাদাকে ও। তাহলে কি করে এতদিন এইভাবে না দেখা করে থাকলো মেয়েটা! এমনকি ফোনটা অব্দি রিসিভ করলো না! সব কিছুই কেমন ধাঁধার মতন লাগছিল ওর। মেঘার সাথে মেলাতে পারছিল না ও কোনোকিছুই ঠিক। আর এই অমৃত বলে ছেলেটাই বা কেমন! বিয়ের পর এতদিন ধরে টাকা নিয়ে যাচ্ছে অভীকের কাছ থেকে। কোন আত্মসম্মান ও নেই ছেলেটার না কি! কথাগুলো বার বার মনে হচ্ছিল ঐশীর। তবে তার সঙ্গে আরেকটা কথাও মনে হচ্ছিল খুব, অমৃত বলে ছেলেটা কিছু করেনি তো আসলে! ও কোন ভাবে মেঘার এই বদলে যাওয়ার পেছনে কারণ না তো! কথাগুলো ভেবেই ঐশী কলিং বেলটা বাজিয়েছিল সেদিন অমৃতদের বাড়ির। তারপর কিছুক্ষণের অপেক্ষার ভিড়ে দরজাটা খুলেছিল একজন অবশেষে।

চলবে।