আলোকবর্ষ পেরিয়ে পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
1460

#আলোকবর্ষ_পেরিয়ে ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২৭>
সেই মুহূর্তে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে অবাক হয়ে গেছিল ঐশী! চোখের কোণে কালশিটে, ক্লান্ত বিদ্ধস্ত চেহারা; এ কি অবস্থা হয়েছে মেঘার! কথাটা ভাবতেই মেঘাও কেমন চমকে উঠে ছিল ঐশীকে দেখে এতদিন বাদে! ও প্রথম কয়েক্ সেকেন্ড যেন কিছু বলার অবস্থাতেই ছিল না! তবে ঐশী কেমন থমকে গিয়েই বলেছিল মেঘাকে,
—-” কেমন আছিস তুই? এটা কি অবস্থা হয়েছে চেহারার তোর!”
কথাটা শুনে মেঘার চোখে জল চলে এসেছিল সেই মুহূর্তে। ও ভাঙা গলায় ই বলেছিল,
—-” বৌদি ভাই! তুমি এখানে কি করে!”
ঐশী সেই কথাটা শুনে কিছু বলতে যাবে, সেই সময়ই পিছন থেকে একটা লম্বা ছিপছিপে চেহারার ছেলে কেমন টলতে টলতে এসে খুব জোরে বলে উঠেছিল মেঘাকে,
—-” তুমি এইভাবে দরজা খুলতে এসেছ কেন! ভেতরে যাও এক্ষুনি। যাও বলছি!”
কথাগুলো বেশ ঝাঁঝালো গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে বলে ছিল ছেলেটা। ঐশী সেই মুহূর্তে মদের গন্ধ স্পষ্ট পাচ্ছিল ওর কাছ থেকে। আর এই সমস্ত কিছু দেখে এটা বুঝতে বাকি ছিল না যে ছেলেটা এই সকাল বেলাও ড্রিংক করে আছে! তাহলে এ ই কি অমৃত! কথাটা ভাবতেই ও দেখলো ছেলেটা কেমন টান দিয়ে সরিয়ে দিল মেঘাকে ঐশীর সামনে থেকে। তারপর ওকেও সেই একই ভাবে ঝাঁঝালো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—-” কে আপনি? কি চাই এখানে?”
কথাটা শুনে ঐশী কিছু একটা বলতে যাওয়ার আগেই ছেলেটা নিজের মনে কেমন জড়ানো স্বরে বলে উঠলো,
—–” বুঝেছি। সেলস্ গার্ল তাই তো? কিন্তু আমাদের এখন কিছু লাগবে না। দু চার পেগ ছাড়া আমার আর কিছুর দরকার নেই। কথাগুলো কেমন ঘোলাটে চোখে বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল ঐশীর ও। সেই মুহূর্তে সবটা দেখে ঐশীর যেন ধাক্কা লাগলো একটা! সব কিছু দেখে ও খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল, মেঘা একদম ভালো নেই এখানে।
সেদিন এরপর বুঝতে পারছিল না মেঘার সাথে যোগাযোগ করবে কিভাবে! কিভাবে ওর খোঁজ খবর নেবে! কথাটা ভাবতে ভাবতেই মনে হলো প্রতিবেশীদের কথা হঠাৎ। ঐশী এবার আর সময় নষ্ট না করে পাশের ফ্ল্যাটগুলোর দরজা ধাক্কালো। ওপর নিচে তিনটে ফ্ল্যাটের লোকেদের সাথে কথা বলেই ঐশী জানতে পরলো অনেক কথা সেদিন। মাঝে মাঝেই ওই অমৃত দের ফ্ল্যাট থেকে চিৎকার চেঁচা মিচি, অশান্তি শোনা যায় না কি। অমৃত তো প্রচণ্ড নেশাখোর, ড্রাগ এডিকট বলেই জানে ফ্ল্যাটের লোকজন। আর মেঘাকে ওরা আজ অব্দি কখনো বাইরে বেরোতে দেখেনি। বুঝতে পারে সবাই, মেয়ে টাকে আটকেই রাখা হয় বাড়িতে। কারোর সাথেই কোনভাবে কথা বলতে, মিশতে দেওয়া হয় না।
কথাগুলো শুনে সেদিন ঐশী যেন নির্বাক হয়ে গেছিল কেমন! মেঘার জীবন টা যে পুরো নষ্ট হয়ে গেছে এই বিয়েটা করে, এটা বুঝতে আর ওর বাকি ছিল না কিছু। কিন্তু তাও কোনভাবে মেঘার সাথে কথা না বলে তো ও কোন স্টেপ নিতে পারবে না! এটা ভেবেই সেদিন অপেক্ষা করেছিল অনেকক্ষণ ফ্ল্যাটের নিচে। ও সবার সাথে কথা বলে জানতে পেরেছিল একজন কাজের লোক রোজ বিকেলে আসে অমৃতদের বাড়ি কাজ করতে। কল্পনাদি নাম মহিলার। তাকে ধরেই কোনভাবে যোগাযোগ করা যেতে পারে মেঘার সঙ্গে। এইসব ভেবেই ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল ঐশী অনেকক্ষণ। এর মধ্যে ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ডের সাথেও আলাপ পরিচয় করে নিয়েছিল ঐশী। সব খুলে বলেছিল ওনাকে। সিকিউরিটি গার্ড ও অমৃতের নাম শুনেই ভ্রু কুঁচকে ছিল নিজের। ওর মতন খারাপ নেশাখোর ছেলে না কি একটাও হয় না! বেশ রাগের স্বরেই বলেছিল কথাটা উনি ঐশীকে।এরপর কল্পনা দি কাজে আসতেই ওই সিকিউরিটি গার্ড ই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ঐশীর সাথে ওর। ঐশী সেই সময় একটা কাগজে নিজের ফোন নাম্বার লিখে কল্পনা দির হাতে দিয়ে বুঝিয়ে বলে ছিল কাগজটা যাতে মেঘার হাতে দিয়ে দেয় ও কোনভাবে। এর জন্য ঐশী কল্পনা দি কে টাকাও দিয়েছিল কিছু। এরপর ওর ফেরা না অব্দি অপেক্ষা করেছিল এপার্টমেন্ট এর বাইরে এটা কনফার্ম হওয়ার জন্য, যে কাজটা হয়েছে। এরপর কল্পনা দি কাজ শেষ করে ফিরলে ঐশী আবার ধরেছিল ওকে রাস্তায়, তারপর সব জিজ্ঞেস করে কিছুটা শান্ত মনে ফিরেছিল বাড়িতে অবশেষে। ঐশীর ফোন নাম্বারটা মেঘা পেলে যদি ওকে ফোন করে কথা বলে নিজে থেকে! মেঘার সাথে কি হয়েছে, এটা জানা টা খুব দরকার আসলে ঐশীর!

যাইহোক, এইসব ভাবনার ভিড়ে সেদিন সন্ধ্যে বেলা বেশ আনমনে ঢুকেছিল ঘরেতে। কিন্তু ঘরে এসে থমকে গেছিল হঠাৎ যেন ও অভীক কে দেখে! অভীক আসলে নিজের পুরনো ঠিকানায় ফিরে গেছে আবার। ও চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল সেই মুহুর্তে সোফায়। ঐশী তবে এই দৃশ্য দেখে চুপ করে থাকতে পারেনি আর। ও অভীকের কাছে গিয়ে বেশ রাশভারী গলায় ই ওকে ডেকে বলেছিল,
—-” কি ব্যাপার! তুমি এই শরীরে খাট থেকে নেমে সোফায় এসে শুয়েছ কেন? মাথা ঘুরে পড়েও তো যেতে পারো কোনভাবে! এমনিতেই তো উইক খুব!”
কথাগুলো বেশ রাগের স্বরেই বলেছিল ঐশী। কিন্তু অভীক এর উত্তরে শান্ত ভাবেই বলেছিল,
—-” আমার শরীর আগের থেকে এখন অনেকটাই বেটার। জ্বর ও আসেনি আর সারা দিনে! আর তুমি আর সাতদিনই আছো এই বাড়িতে! তারপর ই তো মাস শেষ। চলে যাবে। তাই এই কদিন একটু কম্ফর্টেবলি থাকো এখানে। আমার সোফাতে শুতে কোন প্রব্লেম নেই।”
কথাগুলো শুনে ঐশী সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিল এবার,
—-” আমারও তুমি খাটে শুলে কোন প্রব্লেম নেই। আর শোন, একটা সময় ছিল, যখন তোমার কথা মতনই সব কিছু হতো। কিন্তু এখন আমার কথা মতন সব কিছু হবে, বুঝলে।”
কথাটা বেশ জোর দেখিয়ে বলেছিল ঐশী সেই মুহূর্তে। কিন্তু অভীক ও এবার একটু অবাক হয়েই বলেছিল,
—-” কিন্তু আমি তো তোমার কথাই শুনছি। তোমারই তো একদিন আমার সাথে বেড শেয়ার করতে প্রব্লেম ছিল, তাই আমি!”
না, কথাটাকে এবার আর শেষ হতে না দিয়েই ঐশী আচমকা হাতটা ধরে ফেলেছিল ওর শক্ত করে, তারপর বেশ অর্ডার করার মতন করে বলেছিল,
—–” হয়েছে? ওঠো এবার। খাটে শোবে চলো।”
কথাটা বলেই আলতো টেনেছিল ওর হাতটা। অভীক তবে এরপর আর কোন কথা খুঁজে পায়নি বলার মতন। আর ঐশীর জোর টা এত বেশি ছিল,যে না করতে পারেনি কিছুতেই আর অভীক! চুপচাপ খাটে গিয়ে শুয়েছিল বিনা প্রতিবাদে।

ঐশী এরপর একটু সময় নিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করে ছিল অভীক কে ,
—-” ওষুধ খেয়েছ তুমি? না কি সেটাও খাওনি?”
অভীক প্রশ্নটা শুনে চোখটা নামিয়ে নিয়েছিল নিজের। ঐশী এটা দেখে একটু ক্লান্ত স্বরে বলেছিল,
—-” জানতাম খাওনি। এইরকম নিজের প্রতি কেয়ারলেস ছিলে বলেই এতটা শরীর খারাপ বাঁধিয়ে বসলে!”
কথাটা বলে ঐশী নিজেই ওষুধের স্ট্রিপ টা এগিয়ে দিল অভীকের দিকে। সেই মুহূর্তে অভীক কেমন উদাসীন একটা হাসি হেসে নিজের মনেই বলে উঠেছিল যেন,
—–” করেই বা কি লাভ হলো! মরতে কি পারলাম!”
ঐশী কথাটা শুনে কেমন থমকে গেছিল যেন। ও বেশ রাগ দেখিয়েই বললো এবার,
—-” থামবে তুমি! কেন এইসব বলছো!”
তারপর কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে আবার বলে উঠলো ঐশী একটু স্থির গলায়,
—-” বেঁচে তো তোমায় থাকতেই হবে। আর কেউ না হোক, অন্তত মেঘার জন্য। আজ গেছিলাম আমি ওদের ফ্ল্যাটে, বেলার দিকে।”
কথাগুলো শুনে অভীক নিজেও কেমন স্থির হয়ে গেল হঠাৎ! ও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুধু কয়েক সেকেন্ড ঐশীর দিকে। তারপর নিজেকে একটু সামলে জিজ্ঞেস করলো,
—–” দেখা হলো মেঘার সাথে? কেমন আছে ও? বলেছে কথা কিছু?”
প্রশ্ন গুলো শুনে ঐশী কিছুটা অস্থির হয়েই বললো এবার,
—-” না, হয়নি কথা। আসলে সেই সুযোগটাই দেওয়া হয় নি! অভীক, আমি ওকে দেখে এইটুকু বুঝেছি, মেয়েটা ভালো নেই। ওই অমৃত বলে ছেলেটা খুবই খারাপ। ওর সমস্ত প্রতিবেশীরাও বললো, ছেলেটা ড্রাগ এডিক্ট মাতাল! ইন ফ্যাক্ট আজও ড্রিংক করে ছিল সকালে! আর যেইভাবে মেঘার সাথে কথা বলছিল, বিহেভ করছিল, সেটা খুবই খারাপ। এমনকি ও তো মেঘার হাত ধরে টেনে সরিয়ে দিল ওকে দরজার সামনে থেকে! অমৃত মনে হয় কারোর সাথে মিশতে,কথা বলতে দেয় না মেঘা কে! ইন ফ্যাক্ট ওর আসে পাশের ফ্ল্যাটের লোকগুলোও বলছিল, যে ওরা এতদিনে মেঘাকে কখনো বাইরে বেরোতে, কারোর সাথে কথা বলতে দেখেনি!”
কথাগুলো শুনে অভীক যেন স্তব্দ হয়ে গেছিল হঠাৎ। কিছুই মেলাতে পারছিল না ঠিক! যদি ঐ ছেলেটা মেঘার সাথে এতটা খারাপ করছে দিনের পর দিন, তাহলে মেঘা চুপচাপ ওই বাড়িতে আছে কেন! আর এতদিন তো অভীক মেঘার সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেছে। হাজার বার ফোন করেছে। কিন্তু মেঘা তো কখনো কথা অব্দি বলতে চাইনি ওর সাথে! কথাগুলো ভেবেই অভীক বলেছিল,
—–” কিছু বুঝতে পারছি না আমি! ছেলেটা খারাপ সেটা তো আমি প্রথম থেকে জানি। তাই তো প্রত্যেক মাসে এত এত টাকা দিই ওকে, যাতে আমার বোনটাকে অন্তত ভালো রাখে। আর মেঘার ই বা এত কি রাগ আমার ওপর; যে দিনের পর দিন আমাকে নিজের থেকে দূরে রেখে এইরকম বাজে নোংরা একটা ছেলের সাথে থাকছে!”
কথাটা শুনে ঐশী অভীক কে একটু শান্ত করে বলেছিল,
—–” আমি ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছি আমার, মেঘার কাছে। ওদের বাড়িতে যে কাজ করে, কল্পনা দি, তার হাতে একটা কাগজে নিজের নাম্বার লিখে পাঠিয়েছি আমি। আমার মনে হয়, মেঘা নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করবে। ওর সাথে কথা হলেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বলেছিল ঐশী। অভীক এই মুহূর্তে চুপ হয়ে গেছিল একটু, বোনের চিন্তায়। মেয়েটা এতদিন ধরে কেমন আছে! কিভাবে আছে, এই চিন্তায়।
<২৮>
সেদিন রাতে এরপর অভীকের কিছুতেই ঘুম আসছিল না ঠিক। ঐশীর মুখে মেঘার কথা শুনে যেন এলোমেলো লাগছিল নিজেকে। বার বার মনে হচ্ছিল, মেয়েটা ঠিক আছে তো! একই শহরে থেকেও অভীক আজ কতটা নিরুপায় যে নিজের বোনের কাছে পর্যন্ত যেতে পারছে না! কথাটা ভেবেই কেমন অস্থির লাগছিল আজ।
যাইহোক, এইসব ভাবনার ভিড়ে ঘড়ি যখন ভোর তিনটের কাঁটা ছুঁলো, তখন একটু চোখটা লেগে আসছিল অভীকের তন্দ্রায়। সেই মুহূর্তেই হঠাৎ ঐশীর ফোনটা বেজে উঠলো সেদিন। অভীক এর তন্দ্রা টা কেটে গেল এক লহমায়। ঐশী যদিও তখন গভীর ঘুমে। কিন্তু ফোনটা বেজেই চলেছে! তাই অভীক ওর হাতটা ঝাঁকিয়ে ডাকলো এখন ঘুম থেকে। আর ঐশীর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললো,
—-” তোমার ফোন বাজছে দ্যাখো।”
ঐশী কথাটা শুনে ঘুমের ঘোরেই বলে উঠেছিল,
—-” এখন! এখন কে ফোন করলো আমাকে!”
তারপর মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতে দেখেছিল একটা আন নোন নাম্বার! ঐশী এবার কিছু না ভেবেই ফোনটা ধরেছিল, আর ওপার থেকে ভেসে এসেছিল সেই চেনা গলার স্বর,
—-” বৌদি ভাই আমি মেঘা বলছি।”
কথাটা শুনে ঐশী নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
—-” মেঘা তুমি!”
কথাটা বলেই ও স্পিকারে দিয়েছিল ফোনটা। অভীক এই সময় উঠে বসে পড়েছিল বিছানায়। কেমন এলোমেলো লাগছিল ওর। এতদিন বাদে মেঘা ফোন করেছে! কথাটা ভাবতেই ঐশী ও উঠে বসে জিজ্ঞেস করেছিল সঙ্গে সঙ্গে,
—-” কেমন আছো? আজ সকালে তোমাকে দেখে একদম ঠিক লাগেনি আমার!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল ঐশী। সেই মুহূর্তে মেঘা কেমন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল হঠাৎ। ও ভাঙা গলায়ই বলেছিল,
—-” ভালো নেই বৌদিভাই। একদম ভালো নেই। অমৃত খুব খারাপ ছেলে। ও কথায় কথায় গায়ে হাত দেয় আমার। সারাক্ষণ নেশা করে থাকে! মদ ড্রাগস কিছু বাদ নেই ওর। আমি খুব বড় ভুল করেছি। ওকে বিয়ে করে! খুব বড় ভুল!”
কথাগুলো শুনে অভীক আর ঐশী দুজনেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিল কেমন! সব অন্ধকার লাগছিল চোখের সামনে ওদের। সেই অন্ধকারের ভিড়ে ই ঐশী কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বলেছিল,
—- ” এতকিছু হয়ে গেছে, আর তুমি কারোর সাথে যোগাযোগ করনি কেন! কেন এতদিন ধরে সহ্য করছো এইসব মেঘা? অন্তত তোমার দাদাকে একটা তো ফোন করে সব বলতে পারতে!”
ঐশীর কথাটা শুনে মেঘা যেন আরো কেঁদে ফেলেছিল সেইদিন। ও ভাঙাচোরা গলায় ই বলেছিল,
—–” পারতাম না বৌদি ভাই। কিছুতেই পারতাম না। যেইভাবে দাদাকে অপমান করে এক রাতের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বিয়ে করেছি! তারপর কোন মুখে এইসব বলতাম ওকে! আর অমৃত ও বলে রোজ, এখন আমার আর কেউ নেই নিজের। দাদা তো নিশ্চয়ই আমার ওপর এত রেগে, যে ও আমার মুখটাও দেখবে না আর কখনো!”
কথাটা কেমন থমকে বলেছিল মেঘা। কিন্তু অভীক এবার আর চুপ করে না থেকে বলেছিল,
—-” থামবি তুই ! পাগল হয়ে গেছিস না কি! আমি তোর থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবো, এটা ভাবলি কি করে! প্রত্যেক মাসে অমৃত কে আমি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিই শুধুমাত্র তোর খোঁজ পাওয়ার জন্য। তোকে তো আমি হাজার বার ফোন করেছি এতদিনে! কিন্তু তুই একবারও কল রিসিভ করিসনি আমার! একবার কথা বলিসনি!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল অভীক। মেঘা তো যেন অবাক হয়ে গেছিল সেই মুহূর্তে। ও ভেজা চোখেই বলেছিল এলোমেলো ভাবে,
—-” দাদা তুই! তুই সত্যি কথা বললি আমার সঙ্গে! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। অমৃত এতদিন আমাকে শুধু এটাই বলেছে, যে তুই আর কোন দিন আসবি না আমার কাছে! কখনো কথা বলবি না! আর ও তো আমার ফোনটাও নিজের কাছে রেখেছে এতদিন। কারোর সাথে যোগাযোগ করতে দেয় নি। একরকম ঘরবন্দী করেই আমাকে!”
কথাগুলো আর শেষ করতে পারলো না মেঘা। গলায় কান্না এসে জমা হলো ওর। কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই মেঘা কেমন অস্থির হয়ে বলে উঠলো,
—” আর কথা বলতে পারবো না আমি। অমৃত মনে হয় উঠে গেছে ঘুম থেকে। আমি লুকিয়ে ওর ফোন থেকে ফোন করেছিলাম বৌদি ভাই কে। তোমরা কেউ আর কল ব্যাক কোরো না এই নাম্বারে। তাহলে খুব মারবে আমাকে ও।”
কথাগুলো বলেই মেঘা তাড়াহুড়ো করে ফোনটা কেটে দিয়েছিল সেদিন। অভীক আর ঐশী তবে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল যেন! মেঘা এতগুলো দিন এরকম ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে আছে, এটা ভেবেই যেন কেঁপে উঠছিল দুজনে। তবে আর দেরি করলো না অভীক। সেই মুহূর্তেই এসিপি কে ফোন করলো নিজে। বিজনেসের জন্য আসলে অনেকদিনের ই চেনা উনি। সবটা খুলে বললো অভীক মিস্টার মিত্র কে সেই ভোরে। তারপর একটু সকাল হতেই ফোর্স নিয়ে হাজির হলো অভীক, ঐশী মেঘার বাড়িতে। পুলিশ দেখেই যদিও অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল অমৃতের। প্রথমে তো পালানোর চেষ্টা অব্দি করেছিল। কিন্তু অভীকের রাগে আজ মাথা ঠিক ছিল না একদম। পুলিশ ওকে হাতে না হাতে ধরতেই অভীক নিজে গিয়ে দু গালে দুটো থাপ্পড় লাগিয়েছিল ছেলেটাকে। মেঘা সেই মুহূর্তে ছুটে এসে আঁকরে ধরেছিল নিজের দাদাকে। অভীক আজ এত কাছ থেকে মেঘাকে দেখে থমকে গেছিল কেমন! চোখে কপালে কালশিটে র দাগ! কি অবস্থা করেছে বোনটার এই ছেলেটা! কথাটা ভেবেই পেশী শক্ত হয়ে উঠেছিল ওর রাগে। কেমন তীক্ষ্ম স্বরেই সেদিন অমৃত কে বলেছিল ও,
—-” আই উইল মেক সিওর, যে আর লাইফে কোনদিনও তুমি এই বাইরের পৃথিবীটা যেন দেখতে না পারো! জেলটাই হচ্ছে তোমার আসল জায়গা। সারা জীবন পচে গোলে মরতে হবে ওখানে।”
কথাটা শেষ হতেই অমৃত কে সেদিন তুলে নিয়ে গেছিল পুলিশ। অভীক ওপর মহল থেকে ইনস্ট্রাকশন দিয়েছিল, যেন থার্ড ডিগ্রি চালানো হয় ছেলেটার ওপর। যতোটা কষ্ট ও ওর বোনকে দিয়েছে, তার তিন চার গুণ কষ্ট যেন ফেরৎ পায় অমৃত।
সেদিন এরপর ঐশী মেঘাকে আগলে রেখেছিল সারাক্ষণ। নিজে ডাক্তার কে কল করেছিল মেঘার চেক আপের জন্য। মেয়েটার চেহারা টা র যা অবস্থা হয়েছে! চোখে দেখা যায় না। হাতে পায়ে কোন না কোন জায়গায় মারের দাগ, কালশিটে। ডাক্তার তবে বলেছিল ওকে দেখে, শুধু শরীরেই না, মনেও প্রচুর আঘাত লেগেছে মেঘার। এত কিছু সহ্য করে কিছুটা ডিপ্রেশনেও থাকতে পারে ও! তাই ভালো কোন সাইকোলজিস্ট দেখিয়ে কাউন্সেলিং করানো উচিত ওর। ঐশী কথাটা গিয়ে অভীক কে বলেছিল। অভীক এটা শুনে খোঁজ নিয়ে শহরের বেস্ট সাইকোলিস্ট কে এপয়েন্ট করেছিল মেঘার ট্রিটমেন্ট এর জন্য।
এরপর কদিন ঐশী অভীক দুজনেই সারাক্ষণ ছিল মেঘার কাছে। কথা বলে, যত্ন নিয়ে, যত রকম ভাবে সম্ভব ওর মন আর শরীর দুটোই ঠিক করার চেষ্টা করেছিল ওরা। কিন্তু এইসবের ভিড়ে মেঘা জানতে পেরেছিল অভীকের কাছ থেকে যে ঐশী মাত্র এক মাসের জন্য এই বাড়িতে থাকতে এসেছে। কথাটা জেনে কেমন নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিল ওর। মনে হচ্ছিল ওর এক্সিডেন্ট এর জন্যই তো ঐশী আর অভীকের মধ্যে এতটা দূরত্ব তৈরি হয়ে ছিল! সেই কথা ভেবে মনটা ভারী হয়ে যাচ্ছিল খুব বার বার। তাই সেই রাত্রে ঐশীকে একা পেয়ে মেঘা বলেছিল হঠাৎ নিজে থেকে,
—-” বৌদি ভাই, একটা রিকয়েস্ট করছি তোমাকে। আসলে আমার দাদাটা এতদিন আমার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছে। এরপর তুমি চলে গেলে আবার ও শেষ হয়ে যাবে! আর সামলাতে পারবে না নিজেকে। তাই প্লিজ, প্লিজ আর ওকে এই শাস্তিটা দিও না। আর আমাদের একা রেখে চলে যেও না তুমি!”
কথাটা বলতে বলতে মেঘা কেঁদে ফেলেছিল শেষে। ঐশীর এই মুহূর্তে নিজেরও কষ্ট হচ্ছিল কেমন! ও কিছু না বলেই মেঘাকে আগলে নিয়েছিল আবার, শক্ত করে। তবে এইসব কিছুই যে অভীক আড়াল থেকে দেখছিল সেদিন, এটা ওরা দুজনের কেউই খেয়াল করেনি ঠিক। অভীক সেই সময়ে থমকে গেছিল কেমন। মনে হচ্ছিল ঐশী আর কত কি করবে ওদের জন্য! ওর এত এত ভুলের পরও ঐশী প্রত্যেকটা সময় পাশে থাকলো ওর। অভীক এর শরীর খারাপের সময় দিন রাত ওর খেয়াল রেখে সুস্থ্য করলো ওকে! তারপর মেঘাকে ও ঐশী ই তো ফিরিয়ে আনলো আবার। ওর বোনটাকে নতুন জীবন দিল আবার যেন মেয়েটা! তার বদলে অভীক ঠিক কোন মুখে ওকে থেকে যাওয়ার কথা বলবে এখানে! অভীক সত্যি ওর জন্য কি করতে পেরেছে! এই সম্পর্কে এক তরফা কষ্টই তো দিয়ে গেছে ও! সেদিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘরে এসেছিল অভীক। এরপর ঐশী ঘরে আসতেই অভীক আজ নিঃস্তব্ধ তা ভেঙে নিজেই বলে উঠেছিল স্থির গলায়,
—–” ঐশী তুমি মেঘার কথা নিয়ে কিছু ভেবো না। ও আসলে আমার কষ্টটাই দেখছে শুধু! কিন্তু আমার খারাপ গুলো নিয়ে একবারও ভাবছে না। আমি সত্যি তোমাকে ডিসার্ভ করি না! কোনদিন করিনি। আমি শুধু এই সম্পর্কে তোমার কাছ থেকে নিয়ে গেছি! একতরফা ভাবে নিয়ে গেছি। কিন্তু তার বদলে কখনো তোমাকে ভালো রাখতে পারিনি! উল্টে ভুল বুঝে, অপমান করে দূরে সরিয়ে রেখেছি দিনের পর দিন। আমি বেসিক্যালি খুব খারাপ মানুষ! খুব খারাপ। কোন মুখ নেই আমার, তোমাকে আটকানোর! তোমাকে থাকতে বলার!”
কথাগুলো মুখ নিচু করে বলেছিল অভীক। চোখ দুটো আসলে ভিজে গেছিল সেই সময়, নিজের অজান্তেই। কেমন নিঃস্ব লাগছিল নিজেকে আজ ওর, যে ঐশীর মতন মানুষকে পেয়েও ধরে রাখতে পারলো না নিজের ভুলে। এইসবই ভাবছিল আনমনে, তখনই ঐশী এসে আচমকা জড়িয়ে ধরলো ওকে। অভীক এর যেন ধাক্কা লাগলো এই স্পর্শে হঠাৎ! কি বলবে ঠিক ভেবে পেল না নিজে। ঐশী তখন আলতো স্বরে অভীকের কানের কাছে বললো ভেজা গলায়,
—-” পারবো না আমি। পারবো না আর চলে যেতে! কিছুতেই পারবো না। আসলে আমি জড়িয়ে পড়েছি আবার, তোমার সাথে। ভীষণভাবে জড়িয়ে গেছি। সেই তিনদিন, যখন তোমার কোন সেন্স ছিল না জ্বরের ঘোরে! যখন একবার চোখ খুলে তাকাচ্ছিলে না, কথা বলছিলে না কোন! তখন বুঝেছি, কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয় ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর হয়! তারপর আর পারবো না ছেড়ে থাকতে; শাস্তি দিতে! কোনভাবেই পারবো না।”
কথাগুলো বলে আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরলো ঐশী অভীক কে। অভীক ও এবার সেই এক আলোকবর্ষ সমান দূরত্বটা কাটিয়ে ঐশীকে ভীষণ শক্তভাবে আঁকরে ধরলো এখন। ওর কপালে ঠোঁটে ভীষণভাবে ছুঁয়ে দিল নিজের ঠোঁট। কিছু না বলেই নিজের সর্বস্ব দিয়ে আরেকবার বেঁধে ফেললো ঐশীকে, সারা জীবনের জন্য।

এইভাবেই হয়ত অনেক আলোকবর্ষ পার করে দু প্রান্তের দুটো মানুষ এক হয়ে যায় সহস্র কোটি বার! আর সেই মিলনের সাক্ষী থাকে অন্তহীন ছায়াপথ, অজস্র নক্ষত্রেরা; নিশ্চুপে, ভাষাহীন হয়ে।

——-< সমাপ্ত >——–