আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-১০

0
3333

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_10
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

আমি একবার রিয়ানের মুখের পানে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেই। অতঃপর দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলি,

— আপনি শুভকে কেন মেরেছেন? বেচারা এখন হসপিটালে এডমিট।

কথাটি শুনে রিয়ানের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা দিল না। সেই আগের ভঙ্গিমায় সংকোচহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সে অতি শান্ত কন্ঠে বলে,

— শুভ হসপিটালে এডমিট জানতাম না তো। কেন এডমিট ও? ডায়রিয়া হয়েছে নাকি?

রিয়ানের এমন ভাবলেশহীন কথায় আমি তেতে উঠি। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— একদম ন্যাকা সাজবেন না বলে দিচ্ছি। নিজে মেরে বলছেন ও কেন এডমিট।

রিয়ান আমার কথা শুনে আমার দিকে ফিরে। ভ্রু কুটি আড়া আড়ি ভাবে উঁচু করে তাকায় সে। হুট করে আমার দিকে ঝুঁকে মৃদু কন্ঠে বলে,

— আমি যে ওকে মেরেছি তার প্রমাণ কি? ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রুভ?

আমি রিয়ানের দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— এই কাজ যে আপনার ছাড়া কাউরো না তা আমি ভালো করেই জানি। আমার আশে পাশে কোন ছেলে ঘুরা মানেই তার হসপিটালের ৪০৪ নাম্বার সিট বুক হওয়া। এই পর্যন্ত কতজনকে এইভাবে হিসাব আছে?

রিয়ান ঝুঁকে থাকা অবস্থায় বলে,
— তুমি হিসাব রেখছো তো তাতেই হবে। তুমি আর আমি আলাদা নাকি যে আলাদা আলাদা হিসাব রাখতে হবে।

আমি রিয়ানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— আপনার আচরণ যে আমার মাথার উপর দিয়ে যায় জানেন? একে তো নিজেই মারবেন আবার হসপিটালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসার জন্য নিজেই টাকা দিবেন। তো কথাটা দাঁড়াচ্ছে যে, জুতা মেরে গরু দান করা হচ্ছে।
এক মাত্র আপনার জন্য মেডিক্যালে কোন ছেলে আমার আশেপাশে ঘেষার দুঃসাহস দেখায় না। আমাকে দেখলেই উল্টো পথে দৌঁড় দেয়। আপনি যে সব ছেলেদেরকে আমার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন তা মনে হয় আমি জানি না।

কথাটা শুনার সাথে সাথে রিয়ানের মুখ ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। সে আমার বাহু দুইটি চেপে ধরে বলে,

— কেন কষ্ট হচ্ছে এর জন্য? অন্য ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করতে পারছো না বলে? কেউ তোমার আগে পিছে ঘুরছে না বলে?
একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো তোমার আশে পাশে আমি ব্যতীত কখনো কেউ থাকতে পারবে না। তোমার শুরুও আমি, শেষও আমি। আমি ব্যতীত তোমার জীবনে কোন সেকেন্ড অপশন নেই। মাইন্ড ইট!

বাহু দুইটি অতি শক্ত হাতে ধরায় আমি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি। আহত গলায় বলি,

— ডাঃ রিয়ান ছাড়েন আমায়। লাগছে আমার।

রিয়ান সাথে সাথে হাতের বাঁধন আলগা করে দেন। কিন্তু ছেড়ে দেন না। অতঃপর সহজ গলায় বলে,

— আর আমার যে বুকে লাগছে তার বেলায় কি? সব কিছুর খবর রাখ তুমি অথচ আমার মনের খবরই রাখ না।

আমি এইবার রিয়ানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালাম। কিন্তু কিছু বললাম না। বেশ কিছুক্ষণ পর ছোট করে বলি,

— সময় হোক সব হবে।

রিয়ান আমার কথা শুনে একপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ধীর গতিতে তার শীতল হাত দুটো আমার গালে রাখে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার কপালে ভালবাসার একটি পরশ এঁকে দেন। সাথে সাথে শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। পুরো মন জুড়ে ভালোলাগার স্নিগ্ধ বায়ু বয়ে যায়। আমি আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলি। একটুপর তিনি সরে আসেন আর দ্রুত পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে যান। আমি চোখ খুলে মুচকি হাসি। তার এই ছোঁয়ায় তিনি আমায় কি বুঝাতে চেয়েছিলেন তা বুঝতে আমার বেগ পেতে হলো না। এই স্পর্শের মধ্যে লুকিয়ে ছিল “অপেক্ষা” শব্দটি। তিনি যে অপেক্ষায় থাকবেন তারই ইঙ্গিত ছিল এই স্পর্শটি।

আমি মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলি,
— পরিস্থিতি নামক পীঞ্জারা থেকে যে কবে মুক্তি পাব কে জানে। আদৌ কি আমার মুক্তি আছে? নাকি সারাজীবনের জন্য বন্দী রয়ে যাব আমি।

এই ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস নিলাম। ভালো লাগছে না কিছু। বিষাদময় লাগছে সব কিছু। অতি বিষাদ!

_____________________________________________

আজকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অথচ বাসায় আজ রিয়ান আর আমি ব্যতীত কেউ নেই। আন্টি আর আঙ্কেল গিয়েছেন গাজীপুর। আঙ্কেলের কোন এক ক্লাইন্টের বিয়েতে গিয়েছেন তারা। আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে যাবে। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে পিন পিন নিরবতা। রিয়ান তো দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। আর আমি রুমের মধ্যে পাইচারি করছি। আজ কিছুতেই বাসায় থাকতে ইচ্ছা করছে না। ঘুরতে যাওয়ার তীব্র বাসনা মনের কোনে বাসা বেঁধেছে। তাও আবার রিয়ানের সাথে। কিন্তু রিয়ানকে এই কথা বলতে ইতস্ততবোধ করছি। যদি ছেঁচড়া বা হ্যাংলা ভাবে আমাকে। অবশেষে এত শত না ভেবে রিয়ানের রুমের দিকে অগ্রসর হই। পর পর তিনটা টোকা দেওয়ার পর রিয়ানের সারাশব্দ পাওয়া গেল। হয়তো এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। দরজার ওপাশ থেকে তিনি আমাকে তার জন্য কফি বানাতে বললেন এবং বসার রুমে অপেক্ষা করতে বললেন। আমি আর কিছু না বলে চলে যাই কফি বানানোর উদ্দেশ্যে।

সোফায় এক পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন রিয়ান। ডান হাতে থাকা কফির মগে ক্ষণে ক্ষণে চুমুক দিচ্ছে। বা হাতে দিয়ে মোবাইল ঘাটছেন। আমি তার অপর পাশের সোফায় জড়সড় হয়ে বসে আছি। মাথা নিচু করে দুই হাত কচলাচ্ছি। ডান পায়ের নখ দিয়ে মেঝেতে অনবরত ঘর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি। পরিবেশটা বেশ থমথমে। রিয়ান মোবাইলের স্ক্রিনের দিয়ে দৃষ্টি বুজিয়ে রেখে আমাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,

— আমায় কি কিছু বলবে?

আমি মাথা তুলে রিয়ানের দিকে তাকালাম। সে এখনো মোবাইল স্ক্রোল করতে ব্যস্ত। আমি ইতস্তত গলায় বলি,

— না মানে আসলে। বাসায় আজকে মন টিকছে না। ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। তাই বলছিলাম কি…

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রিয়ান পকেটে মোবাইল পুরতে পুরতে বলেন,

— যাও রেডি হয়ে আসো। বাইরে যাচ্ছি আমরা।

এই বলে রুমের দিকে চলে গেলেন। আমার খুশি আর দেখে কে? পারলে এখনই লুঙ্গি ডান্স দেওয়া শুরু করে দেই। কিন্তু না তা যদি এখন করি তাহলে রিয়ানের সামনে মান ইজ্জতের ফালুদা। সো প্লেন ক্যান্সাল। আমি দৌঁড় দিলাম রুমের দিকে। রিয়ান আবার দেরি পছন্দ করেন না। তাই চটজলদি রেডি হয়ে নেই। আমি প্রায় রেডি হয়ে গিয়েছি এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠে। আমি ফোন হাতে নিয়ে দেখি “বেবি” ফোন করেছে। আমি চটজলদি ফোনটা ধরে নি। অতঃপর মিষ্টি সুরে বলি,

— আমার বেবিটা কেমন আছে শুনি?

…………

— সকালে ব্রেকফাস্ট হয়েছে?

…………

— আমাকে তো এখন তোমার মনেই পড়ে না। আমাকে ভুলে গিয়েছ তাই না?

…………

কথা বলতে বলতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। অতঃপর বলি,
— আরেহ মজা করছিলাম। আমি তো জানি আমার বেবি আমাকে কখনো ভুলতেই পারে না। ও আমাকে অনেক ভালবাসে তাই না? আমিও তোমায় অনেক ভালবাসি।

…………

— আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। এইবার আসলে তোমার কাছেই থেকে যাব। আর কোথাও যাব না।

…………

— পাজি হচ্ছো দিন দিন। বিচার লাগাবো কিন্তু!

…………

— হিহি! তোমার সাথে আমি পারবো না। আচ্ছা এখন রাখি। বাইরে যাব আমি। তুমি নিজের খেয়াল রাখবে কেমন।

…………

— আই অলসো লাভ ইউ। বায়!

কথা শেষে ফোন কেটে ঘুরতে নিব তখনই রিয়ানকে থমকে যাই। সে অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো সম্ভব লাল। আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমাকে তিনি তার এউ চোখ দ্বারাই ভস্ম করে দিবে। আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। তার এই রাগান্বিত চেহেরার পিছের রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করছি। অতঃপর কাহিনীটা বুঝতে পারি। নির্ঘাত আমার ফোনালাপ শুনে নিয়েছে এই খাটাশটা। এখন নিশ্চয়ই আমার হাল নাজেহাল করবে। এইভেবেই আমি ভয়ে কয়েকটা শুকনো গলায় ঢোক গিলি। মনে মনে ভাবি, “আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া থুরি রিয়ানা। ”

#চলবে