আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-১১

0
3385

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_11
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

কথা শেষে ফোন কেটে ঘুরতে নিব তখনই রিয়ানকে থমকে যাই। সে অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো সম্ভব লাল। আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমাকে তিনি তার এউ চোখ দ্বারাই ভস্ম করে দিবে। আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। তার এই রাগান্বিত চেহেরার পিছের রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করছি। অতঃপর কাহিনীটা বুঝতে পারি। নির্ঘাত আমার ফোনালাপ শুনে নিয়েছে এই খাটাশটা। এখন নিশ্চয়ই আমার হাল নাজেহাল করবে। এইভেবেই আমি ভয়ে কয়েকটা শুকনো গলায় ঢোক গিলি। মনে মনে ভাবি, “আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া থুরি রিয়ানা। ”

রিয়ান ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। চেহেরা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ভীষণ পরিমাণে রেগে আছে। যাকে এককথায় বলে ভয়ংকর রাগ। রিয়ান একদম সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুট করে আমার ডান হাতটি তার অতি শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দী করে নেয়। অতঃপর হাত উঁচু করে ধরে ফোনের দিকে ইশারা করে শান্ত কন্ঠে বলে,

— কার সাথে কথা বলছিলে? হু দ্যা হেল উইথ ইউ ওয়ের টকিং?

শেষের কথাটা একটু হুংকার দিয়েই বলেন। আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে স্মিত হাসার চেষ্টা করি। অতঃপর অস্পষ্ট স্বরে বলি,

— বেবি না মানে সাইফ এর সাথে।

না জানি কি হলো হুট করে রিয়ান আমার ডান হাতটা পিছনে মুচড়ে ধরে। সাথে সাথে আমি ব্যথায় ‘আহ’ করে উঠি। হাত থেকে মোবাইলটা নিচে পড়ে যায়। রিয়ান আমাকে একদম তার সাথে একদম মিলিয়ে নেয়। তার মুখটা আমার কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বলে,

— আর এই সাইফ কে?

আমি আর কি বলবো। রিয়ান এই এহেন কান্ডে আমার শরীর থরথর করে কাঁপচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। আমি এর আগে কখনো রিয়ানের এতটা কাছে আসে নি। যার ফলে নিজের মধ্যেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হচ্ছে। শব্দগুলো সব গলায় এসে দোলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে টু আওয়াজও বের করতে পারছি না। জীবনে আজ প্রথম নিজেকে এতটা অসহায়বোধ করছি। আমি এইবার কথা বলতে না পেরে কাঁদো কাঁদো একটা ভাব নিয়ে থাকি।
এইদিকে আমার কোন উত্তর না পেয়ে রিয়ানের রাগ আকাশ ছুঁই ছুঁই অবস্থা। সে অতি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— সে ইট ডেমিট! আদার ওয়াইস আই উইল কিল হিম।

আমি তাও কিছু বলতে পারছি না। ওই যে শব্দ গুলো সব গলায় দোলাপাকা অবস্থায় আটকে আছে। কথা বলবোই বা কিভাবে? রিয়ান আমার চুপ থাকা দেখে আরও রেগে উঠে। সে হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে বলে,

— তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। যেখানে আমি তোমাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি আমি ব্যতীত তোমার জীবনে সেকেন্ড কোন অপশন নেই সেখানে তুমি অন্য একজনকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিচ্ছ? যে শব্দগুলো শুনার জন্য আমি উন্মাদ হয়ে আছি সেই শব্দগুলো তুমি নির্দ্ধিধায় অন্যকে বলছো। ইচ্ছে তো করছে এখনই জানে মেরে ফেলি তোমায়।

এই বলে আমায় অল্প ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আমি তার নিকট থেকে ছাড়া পেয়ে দ্রুত গতিতে শ্বাস নিতে থাকি। এতক্ষণ আমার দম যায় যায় অবস্থা। উফফ! এই ডাঃ রিয়ান নির্ঘাত আমায় একদিন হার্ট এটাক করিয়ে দম নিবে। আমি লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেই। অতঃপর রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলি,

— আরেহ ভাই এই বেবি আমার ভাগিনা। ৭ বছর বয়সী একটা বাচ্চা ছেলে ও।

সাথে সাথে রিয়ান আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। বুঝাই যাচ্ছে তিনি এখন আকাশ থেকে পড়েছে। তার মুখ একদম চুপসে গিয়েছে। তার চেহেরা দেখে একটা প্রবাদ বাক্য ভীষণ মনে পড়ছে। আর তা হলো, ” খোদা পাহাড় নিকলা চুহা।”
ইশশ! আমার যেই পরিমাণে হাসি পাচ্ছে না। কিন্তু এখন হাসলে কপালে রবি শনি সোম সব আছে। তাই কোনমতে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছি। একটা কথা ভেবে বেশি হাসছে যে যাকে সে এতক্ষণ নিজের সতীন ভেবে আসছিল সে তার হাটুরও হাটুর বয়সী না।

সে আমার দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে। বুঝতেই পারছি এখনো তার মনে ডাউট আছে। তাই আমি এইবার পিছে ঘুরে ফোনটা খুঁজি। ফোন আমার বেচারা মেঝের সাথে লেপ্টে আছে। আমি ফোন উঠিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকি। ফোন অন করে দেখি মোবাইল ঠিকই আছে। গ্লাস কাভার আর মোবাইল কাভার ছিল বলে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। শুধু উপরের স্ক্রিনটা ফেটে গিয়েছে। এইটা খুলে আরেকটা লাগিয়ে নিলেই একবারে নতুন। আমি ফোন খুলে বিবিকে ফোন দেই। কিছুক্ষণের মাঝেই ফোন রিসিভ হয়। আমি ফোন স্পিকারে দিতেই এক মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে। সম্ভবত সুমি আপু ফোন ধরেছে। সে বলছে,

— কি রে রিয়ানা! তোর খবর কি?

আমি স্মিত হেসে বলি,
— ভালো! তোমার? বেবি কই?

সুমি আপু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
— ভালো। তোর বেবি তো মাত্র ওর বাবার সাথে বাইরে গেল। কেন একটু আগে না ও তোর সাথে ফোন দিয়ে কথা বললো।

আমি হাল্কা হেসে রিয়ানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলি,
— তা তো আছেই। কিন্তু ওর সাথে কথা বলে মন ভরে না।

সুমি আপু হেসে বলে,
— তুই আর সাইফ যেন দুইজনের প্রাণভোমরা। সাইফও সারাদিন রিয়ানা মাম্মাম করে। আমার ছেলেটার উপর যাদু করলি বলতো? সারাদিন রিয়ানা মাম্মাম করে মাথা খায় আমার।

আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলি,
— বাচ্চারা যার কাছে আদর বেশি পায় তারই গুনগান বেশি করে। সে যাই হোক! ও আসলে বলো রিয়ানা মাম্মাম ওকে খুঁজছিল। এখন রাখি কাজ আছে। বায়!

এই বলে খট করে ফোন রেখে দিলাম। আর রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলি,

— আমার খালাতো বোনের ছেলে সাইফ। আদর করে আমি বেবি ডাকি। এখনো কি ওকে মারার প্লেন আছে নাকি?

রিয়ান কিছু না বলে উল্টো পথে হাটা দেয়। একটু দূর গিয়ে বলে,

— গাড়িতে ওয়েট করছি জলদি এসো।

অতঃপর বিরবির কর‍তে থাকি,
— এই মেয়ে গভীর জলের মাছ রিয়ান। ঘষেটি বেগমও সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে এত ষড়যন্ত্র করে নি যতটা না এই মেয়ে তোর বিরুদ্ধে করে। তোকে পাগল না বানিয়ে এই মেয়ে দম নিবে না।

অতঃপর দ্রুত পায়ে রুম থেকে চলে যায়। আর আমি অট্টহাসিতে মেতে উঠি। ইশ! রিয়ানের মুখ দেখার মত ছিল। আমি কিছুক্ষণ হেসে রুমের দিকে অগ্রসর হই।

____________________________________________

ঢাকার কোলাহলপূর্ণ বাসস্থান থেকে বেড়িয়ে খোলা রাস্তায় মধ্যগতীতে গাড়ি চলছে। রাস্তার দুই পাশে হাল্কা গাছ-পালা। চারদিক খোলা মেলা। শা শা শব্দ করে বাতাস বইছে। দূর আকাশে মেঘের ভেলাগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। মিষ্টি রোদের এক ফালি এসে পড়ছে রাস্তার উপর। গাছের ডালে পাখিরা অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। আমি জানালার পাশে বসে প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। বেশ ভালো লাগছে আজ পরিবেশটা।

বেশ কিছুক্ষণ আমি রিয়ানের দিকে তাকাই। সে একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। সেই যে তার মুখ বন্ধ হতে তা আর খোলার নাম নেই। হয়তো ইতস্ততবোধ করছেন। এইটা অবশ্য নেহাত আমার ধারণা। তার মুখ ভঙ্গি দেখে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। সে তো সর্ব শান্ত। আমিও আর সেই ব্যাপারে কথা উঠাই নি। তার এই পজিসেভনেস যে কত প্রখর তা আমার জানা আছে। সাথে আমাকে হারানোর ভয় তো আছেই। দুটো অনুভূতির সংমিশ্রণে তিনি কখন কি রকম আচরণ করেন তা তিনি নিজেও জানেন না। এই ভেবে মুচকি হাসি। হঠাৎ টনক নাড়ে যে সে শুভ কে কেন মেরেছিল। এখন বুঝতে পারি যে তিনি কালকে অতি সাবধানে আমায় কথার জালে ফাঁসিয়ে কথা ঘুরিয়ে ফেলে। আর আসল কথাটা লুকিয়ে যান। কিন্তু কেন? আমার জানা মতে তিনি অকারণে কাউকে মারে না। আমার সাথে যারা অসভ্য আচরণ করে তাদেরই এমন অবস্থা করেন তিনি। কিন্তু শুভ তো তেমন কিছুই করে নি। তাহলে তিনি শুভকে কেন মারলো? এর পিছনে অবশ্যই সলেড কোন রিজন তো আছেই। আমি রিয়ানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলি,

— আপনি তো বললেন না আপনি কেন শুভকে মেরেছিলেন? আমার জানা মতে আপনি অকারণে কাউকে মারেন না। তাহলে?

রিয়ান আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
— আমি কি একবারও শিকার উক্তি করেছিলাম যে শুভকে আমি মেরেছি?

আমি একটু সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,
— তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি শুভকে মারেন নি? তাহলে ও হসপিটালে এডমিট কেন? আর আমার জানা মতে আপনিই ওকে এডমিট করিয়েছিলেন। আর ওর চিকিৎসার ফি ও আপনি দিয়েছেন। এইটা আপনি শুধু তখনই করেন যখন আপনি কাউকে মারেন। দ্যান!

রিয়ান এইবার গাড়ি সাইডে নিয়ে ব্রেক করে৷ আমার দিকে ঘুরে শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। আমি করুন কন্ঠে বলি,
— প্লিজ আই ওয়ান্ট টু নো।

সে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,

— শুভকে আমি মারি নি। কালকে সন্ধ্যায় ওর এক্সিডেন্ট হয়েছিল। আমি যখন ঘুরে ঘুরে পেশেন্ট দেখছিলাম তখন ওকে চোখে পড়ে। মাথায় ভালোই আঘাত পেয়েছিল সাথে হাতে পায়েও। পরীক্ষা করে দেখা যায় ওর রক্তশূন্যতা দেখা দিচ্ছে সাথে ওর শরীর প্রচন্ড উইক। ওকে এডমিট হতে বললে ও মানা করে দেয়। শুধু ব্যান্ডেজ করিয়ে চলে যেতে নেয়। আমি পরে ওকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারি যে ওর টাকা এর কমতি আছে যার জন্য ও এখন ট্রিটমেন্ট নিতে পারবে না। তাই আমি ওকে হসপিটালে এডমিট করি আর ওর চিকিৎসার খরচ দেই।
এইবার শান্তি হয়েছে? জবাব পেয়েছ?

আমি রিয়ানের দিকে একপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। এই রিয়ান নামক মানুষটিকে আমি আদৌ ঠিক মত বুঝে উঠতে পারি না। কখনো পারবোও কিনা সন্দেহ৷ কখন কি করে? কেন করে? তা কেউ জানে না। দুই একসময় মনে হয় রিয়ান রহস্যের মায়াজালে ঘেরা তো কখনো মনে হয় সে একদম খোলা বইয়ের পাতা। রিয়ান সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,

— তোমার একটা ধারণা হয়ে গিয়েছে যে, তোমার আশেপাশে যে থাকবে তাকেই ধরে আমি মারবো। তাই তো? রিয়ানা তুমি ভুলে যাও কেন তুমি একজন উডবি ডাক্তার। ডাক্তার হওয়ার পর কত শত মেল পেশেন্ট তোমায় দেখতে হবে। তো তখন কি আমি সবাইকে গিয়ে মারবো নাকি? স্ট্রেঞ্জ!
আমি শুধু তাদেরকেই মেরেছি যারা অন্যায় করেছে বা করতে চেয়েছে। এইটা জানার পরেও তুমি কিভাবে ভাবলে যে আমি শুভকে মারতে পারি?

শেষের কথায় একটা চাপা অভিমান ছিল তা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি চেয়েও কিছু বলতে পারছি না। কিভাবে বলবো? ভুল তো আমি তাকে বুঝেছি। সাথে সোজা তার উপর দোষও চাপিয়ে দিয়েছি। রিয়ান আগের ন্যায় থেকেই বলে,

— সবাইকে তোমার সাথে কথা বলতে মানা করেছিলাম কেন না কিছুটা ইনসিকিউরড ছিলাম আমি। বাট নাও নো মোর। তাই তুমি এখন সকলের সাথেই কথা বলতে পারবে। আমার তরফ থেকে কোন রিস্ট্রেকশন নেই। গট ইট!

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই সে কঠোর গলায় বলে উঠে,

— রিস্ট্রেকশন উঠিয়েছি তার মানে এই না যে যা ইচ্ছা তা করবে। ক্লাসমেট হিসাবে যতটুকু দরকার ততোটুকুই কথা বলবে। এর বেশি যদি কিছু আমার চোখে পড়ে তাহলে তোমার খবর আছে। মাইন্ড ইট!

এই বলে চোখ খুলে সটান হয়ে বসে। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করে। আমি রিয়ানের কথাগুলো শুনে হাল্কা হেসে দেই৷ মনে মনে বলি, “খাটাশ একটা!” রিয়ানের কথাগুলোর কি প্রতিক্রিয়া দেখাব তাই ভেবে আমি কুল পাই না। কথার ধাঁচ এত দ্রুত চেঞ্জ করেন যে কোনটা রেখে কোনটা ধরবো তাই বলা মুশকিল। উফফ! হি ইজ এ কনফিউজড ক্যারেক্টর।

আমি আর তাকে না ভেবে বাইরের দিকে তাকাই। মনের ভিতরে একটা গিল্ট কাজ করছে। কিন্তু তা এখন চেয়েও প্রকাশ করতে পারছি না। কেন না এইটি প্রকাশ করা মানেই তার প্রতি করুণা দেখানো অথবা তার কথাগুলোকে শো অফে পরিনত করা। কিছু কিছু সময় আমার চেয়েও চুপ থাকতে হয়। কেন না তখন কথাগুলো পজিটিভলি ভাবে বলা হলেও অপর পাশের ব্যক্তিটি সেটা নেগেটিভলি নেয়। এখনকার পরিস্থিতিও সেম। এই ভেবে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম।

অতঃপর গাড়ি এসে থামলো সোনারগাঁওতে এসে। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এইখানে আশার। কিন্তু আশা হয় নি। আজ রিয়ানই আমার ইচ্ছাটা পূরণ করলো। সে গাড়ি একপাশে পার্ক করে নেয়। তারপরই তিনি আমায় নিয়ে বেড়িয়ে যান পুরো জায়গায়টা ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে।

___________________________________________

রাত প্রায় গভীর হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে পুরো ঢাকা নগরী তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের রাজ্যে। চারদিকে পিনপিন নিরবতা। হিম শীতল বায়ু বইছে। বিছানার এক কোনে পড়া থাকা ফোনটি বার বার বেজে উঠছে। পায়েল সেইদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। মৃদু পরিমাণে হাত পা কাঁপছে তার। কেন না ফোন করা ব্যক্তি যে আর কেউ নয় বরং আদিব। ফোন যে তার তুলতে ইচ্ছে করছে না এমন কিন্তু না। তীব্র করে সে চাইচ্ছে ফোনটা তুলতে। কিন্তু বার বার নিজেকে সংযত করেই চলেছে। এই নিয়ে আদিবের ১০ টা নাম্বার সে ব্লকলিস্টে ফালিয়েছি। কিন্তু আদিব যে দমে যাওয়ার পাত্র নয়।
দেখতে দেখতে ফোন কেটে গেল। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে আসলো আদিবের ৩১ টি কল। কিছুক্ষণের মাঝেই আবার দম নিয়ে ফোনটি বেজে উঠলো। পায়েল এইবার না পেরে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে। কানের কাছে ফোন ধরতেই এক পুরুষালি কন্ঠ কানে ভেসে আসে,

— অবশেষে ফোনটা ধরলে প্রেয়সী।

পায়েল নিশ্চুপ হয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তার কিন্তু কিছু বলছে না। আদিব আবার বলতে শুরু করে,

— কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি জানো? এতবার ফোন দিতে বুঝি আমার কষ্ট হয় নি।

আদিবের কথা শুনে পায়েল বুঝে যায় আদিব আজ ড্রাংক। যে ছেলেটা কখনো সিগারেট ছুঁয়েও দেখে নি আজ সে নেশায় ভূত। কথাটা কিভাবে মানবে পায়েল? আজ তার জন্যই তো আদিবের এই অবস্থা। এইটা বুঝার সাথে সাথে পায়েলের কান্না বৃদ্ধি পেয়ে যায়। অপর পাশ থেকে আদিব পায়েলের কান্না শুনে বলে,

— এই প্রেয়সী! তুমি কি কান্না করছো? দেখ একদম কান্না করবে নাম তুমি কান্না করলে আমার অনেক কষ্ট হয়। বুকের বা পাশটা চিনচিন করে। প্লিজ কেঁদ না।

পায়েলের কান্না যে এতে কমেছে তা কিন্তু না। বরং আরও বেড়ে গিয়েছে। কান্নার ফলে কিছু বলতে পারছে না সে। আদিব আবার বলতে শুরু করে,

— তুমি এমন কেন বলতো? খালি আমাকে কষ্ট দাও। ফোন দেরিতে ধরে কষ্ট দাও, কান্না করে কষ্ট দাও, দূরে গিয়ে কষ্ট দাও, রাস্তায় অমন আচরণ করে কষ্ট। তুমি কি খালি আমায় কষ্টই দিবে? একটু ভালবাসা দিবে না? ওওও প্রেয়সী! ভালবাসার জন্য বড্ড কাতর আমি। সাথে বড্ড তৃষ্ণার্ত। একটু ভালবাসা দাও না গো।

পায়েল ধরা কন্ঠে বলেন,

— যে ভালবাসা আপনি চাচ্ছেন তা অসম্পূর্ণ। এইটা কখনো পূর্ণতা পাবে না। তাই বলছি ভুলে যান। অন্য কাউরো মাঝে ভালবাসা খুঁজুন ঠিকই পাবেন।

আদিব পায়েলের কথা শুনে বাচ্চামো করে বলে,

— না আমার তোমার ভালবাসা চাই। তোমাকে চাই আমার। তোমার কোলে মাথা রেখে আমি ঘুমাতে চাই। তোমাকে আপন করতে চাই আমি। তোমার ওই নরম ঠোঁটে….

পায়েল এইবার একটু চেঁচিয়ে বলে,
— আদিব চুপ। এর পরে আমি শুনতে পারবো না।

আদিব হেসে বলে,
— হেহে! প্রেয়সী তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো? জানো তোমায় না লজ্জা পেলে অনেক অনেক সুন্দর লাগে। তোমার লজ্জামাখা মুখ দেখলে বার বার তোমায় ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
ওও প্রেয়সী! তোমার গাল গুলো কি দিবে আমায়? আমি সযত্নে তুলে রাখবো। কাউকে দিব না।

পায়েল বুঝতে পারে আদিব এখন আউট অফ কান্ট্রোল। তাই আবোলতাবোল বকছে। পায়েল এইবার কঠোর কন্ঠে বলে,

— আদিব আপনি এখন নিজের জ্ঞানে নেই। যান এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। কালকে কথা হবে আপনার সাথে।

আদিব বাঁচামো করে বলে,

— না আমি ঘুমাবো না। আমি তোমার সাথে গল্প করবো। অনেক গল্প করবো। গল্প করতে করতে তোমায় আদর করবো। তারপর তোমাকে জ্বালাবো। খুব জ্বালাবো! হিহি!

পায়েল চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। ফোনের ওপাশ এখন নিরব। দুইজনের মধ্যে পিন পিন নিরবতা। দুইজনই দুইজনের শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করতে পারছে। কিন্তু কেউ কিছু বলছো না। শেষে আদিব মৃদু কন্ঠে বলে,

— প্রেয়সী! খুব ভালবাসি তোমায়। খুব! থাকতে পারছি না তোমায় ছাড়া। বড্ড কষ্ট হচ্ছে। একটু কি ভালবাসবে আমায়? একটুখানি!
ও প্রেয়সী! খুব ভালবাসি। ভালবাসি! ভ…ভা..ল..বা…….

আর কোন সারাশব্দ পাওয়া গেল না। শুধুমাত্র ওর শ্বাস-প্রশ্বাস গুলো শুনা গেল। হয়তো আদিব ঘুমিয়ে পড়েছে। পায়েল ফোনটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়। ও তো নিজেও আদিবকে অনেক বেশি ভালবাসে। পাগলের মতো ভালবাসে। আদিবের এই কষ্ট যে সে সইতে পারছে না। পায়েল ফোনটা কেটে দিয়ে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়ে। কথায় আছে, “ভালবাসা যেমন সুখের তেমনই কষ্টের। ভালবাসা যেমন গড়তে জানে তেমনে পোড়াতেও জানে। ” কথাটির মর্ম আজ পায়েল হারে হারে টের পাচ্ছে। ভালবাসায় যে এত কষ্ট তা আগে জানলে সে হয়তো কখনো ভালবাসার মত দুঃসাহসিকতা দেখাত না। কখনো না!

#চলবে