আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-১২

0
3366

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_12
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

সময় কাউরো জন্য থেমে থাকে না৷ সে নিজস্ব গতিতে অতিবাহিত হতেই থাকে। সময় যে কিভাবে চলে যায় তা বুঝাই যায় না। এই তো কয়েকদিন আগেই চারদিকে ছিল শরৎ- এর রুপের ছড়াছড়ি। আর আজ হেমন্তের হিম বায়ুর ছড়াছড়ি। শীতের প্রকট চারদিকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘাসের উপর এখন মৃদু মৃদু শিশিরের ছোঁয়া। হিম হিম বায়ু বইছে। দক্ষিণা জানালা দিয়ে এক ফালি মিষ্টি রোদ এসে পড়ছে আমার খাটের কোনে। জানালার কার্নিশে দাঁড়িয়ে একটি কাক রোদ পোহাচ্ছে আর তার কর্কশ কন্ঠে অনবরত ডেকেই চলছে। আমি গায়ে ভালো মত কাঁথা জড়িয়ে নিয়ে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছি। শীতের সকালের ঘুম হয় অতি মধুর আর আরামের। আর এত আরামের মধ্যে যখন ব্যাঘাত ঘটে তখন সেটা হয় এক অসহ্যনীয় ব্যাপার। আর আপাতত আমার সাথে এই অসহ্যনীয় ব্যাপারটি হচ্ছে। মাথার পাশে পরে থাকা মোবাইলটি অনবরত বেজেই চলেছে। বাজতে বাজতে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় দম নিয়ে আবার মোবাইলটি বেজে উঠে। আমি চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় অতি অলস ভঙ্গিতে হাতরে মোবাইলটা খুঁজে মুখে সামনে উঁচু করে ধরি। আদো আদো চোখে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকাই। ‘আনিশা’ নামটি চোখে পড়তেই মুখে চলে আসে এক রাশ বিরক্ত। এই মেয়ের সাত- সকাল বেলা কি চাই কে জানে? আমি পুনরায় চোখ বন্ধ করে ফোনটা রিসিভ করে কানে দেই। ঘুম জোরা কন্ঠে ‘হ্যালো’ বলি। অতঃপর আনিশার কথা শুনার সাথে সাথে আমার ঘুম উড়ে যায়। এক লাফে উঠে বসি আমি। অবিশ্বাস্য গলায় বলি,

— আজকে পায়েলের বিয়ে মানে? কি বলছিস এইসব? পাগল হয়েছিস?

আনিশা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,
— সত্যি বলছি রিয়ানা। পায়েলের আজ বিয়ে। পায়েল ওর থেকে প্রায় ১৫ বছর বড় এমন এক বুইড়া ব্যাটাকে বিয়ে করছে। ব্যাটার নাকি আগে বিয়েও হয়েছিল সাথে ওই ঘরের একটা বাচ্চাও আছে। তার আগের বউ নাকি ১ বছর আগেই মারা গিয়েছে এখন এসেছে দ্বিতীয় বিয়ে করতে।

এইবার যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি অস্পষ্ট স্বরে বলি,

— হেস সি গোন মেড ওর হোয়াট? এই তুই কিভাবে জানলি?

আনিশা বলে,

— আন্টি ফোন করে বলেছে আমায়। আমাদের সেই বাসায় যেতে বলেছে।

আমি নিজেকে সামলিয়ে বলি,
— তুই তারাতাড়ি রেডি হয়ে বের হো। আমিও ১৫ মিনিটের মধ্যে বের হচ্ছি। আজ এর শেষ দেখেই ছাড়বো।

এই বলে ফোন রেখে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়ায়শরুমে ঢুকে পড়ি।

____________________________________________

খাটের এককোনে পায়েল গুটি মেরে বসে আছে। মুখ চোখ তার বেশ ফুলে আছে। নয়ন দুইটি তার অসম্ভব লাল। বুঝাই যাচ্ছে বেশ কেঁদেছে সে। কেঁদে কেটে এই অবস্থা করেছে। আমি আর আনিশা ওর বিপরীত পাশেই বসে আছি। আমাদের চোখে মুখে গাম্ভীর্যের ভাব স্পষ্ট। দুইজনই খুব নিখুঁতভাবে পায়েলকে পর্যবেক্ষণ করছি আমরা। আমি কঠোর গলায় বলি,

— এইসব কি পায়েল? তুই বিয়ে করছিস। তাও আবার এমন একজনকে যার নাকি এর আগে বিয়েও হয়েছিল সাথে তার আগের ঘরের এক বাচ্চাও আছে। কি দেখে তুই এই বিয়েতে রাজি হলি বল? যেখানে আদিব ভাইয়া তোকে পাগলের মত ভালবাসে, সেখানে অন্য কাউরো কথা আসেই বা কিভাবে?

আনিশা কাঠ কাঠ গলায় বলে,

— কি রে কথা বল? আদিব ভাইয়াকে এত কষ্ট দিয়েছিস কি এই বুইড়া ব্যাটাকে বিয়ে করার জন্য? নিজের লাইফ নিজের হাতে বরবাদ কেন করছিস? ব্যাটার টাকা কি আদিব ভাইয়ার চেয়ে বেশি নাকি যে অন্য এক বাচ্চার সৎ মা হওয়ার জন্য তুই ঢ্যাং ঢ্যাং করে রাজি হয়ে গিয়েছিস?

আমি আনিশাকে ধমক দিয়ে বলি,
— আনিশা চুপ কর। আমায় কথা বলতে দে। পায়েল সোনা আমার দিকে তাকা। বল আমায় তুই কেন করছিস এমন। কেন এমন এক মানুষকে বিয়ে করছিস যে তোর যোগ্যই নয়। তোর সাথে তার কোন মিলই নেই। বল আমায়!

এই বলে পায়েলের হাত নিজের হাতে নিয়ে নেই। পায়েল এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

— এইটাই আমার নিয়তি রে। আগে হোক পরে হোক এমন একজন মানুষই আমার ভাগ্যে আছে। আদিবের মত ছেলের যোগ্য আমি নই।

আমি বিস্ময়কর চোখে পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলি,

— কি আবোলতাবোল বকছিস? আর ইউ গোন মেড?

পাশ থেকে আনিশা সাহেলা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— পায়েলের কথা না হয় বাদ দিলাম। আন্টি আপনি কিভাবে এই বিয়ে রাজি হতে পারেন? নিজের মেয়ের জীবন নিজের হাতে বরবাদ কে করছেন? হুয়াই?

এতক্ষণ সাহেলা বেগম দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছিলেন। আনিশার কথা শুনে সে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

— আমি কি স্বাদে এমন করছি মা? পায়েল আমাকে নিজের কসম দিয়ে রেখেছে যে আমি যেন ওকে এই বিষয় নিয়ে কিছু না বলি। কত বুঝিয়েছি ওকে কিন্তু ও বুঝতে নারাজ। ওর ভাইও ওকে অনেকবার বুঝিয়েছে। কিন্তু ও বুঝতে নারাজ। তাই বাধ্য হয়ে

আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে বলি,

— কিন্তু আন্টি এই প্রস্তাব এনেছে কে?

সাহেলার বেগম বলে,
— পাশে বাসার ভাবী। তারই আত্মীয় বর পক্ষরা। আমি তো মানা করে দিতে নিয়েছিলাম কিন্তু কোথ থেকে পায়েল কথাটা শুনে ফেলে এবং হ্যাঁ বলে দেয়।

আমি পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলি,
— পায়েল বল আমায় কি হয়েছে? তুই এমন এক সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিস? এইসব কেন করছিস বল? দেখ একদম মিথ্যে বলবি না বলে দিলাম। তা না হলে এখনই আমি গিয়ে আদিব ভাইকে ডেকে আনবো।

পায়েল আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। অতঃপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— আমি কখনো মা হতে পারবো না রে। সমাজ যাদেরকে বন্ধ্যা বলে সম্মোধন করে তাদের মধ্যে আমি একজন। জানিসই তো একজন নারীর কাছে মা হওয়ার সুখটা হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুখ। আর আমি সেই সুখ থেকে বঞ্চিত। চিরতরের জন্য বঞ্চিত। কথাটি যখন জানি তখন নিজেকে অভিশপ্ত মনে হয়েছিল। পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। এরপর যখন আদিবের কথা মাথায় আসে তখন তো একদম সেই অন্ধকারের অতুল গভীরে তলিয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে ঠিক রাখা দায় হয়ে উঠেছিল। বার বার এই কথাই ভাবছিলাম যে, আদিব যদি আমার সাথে থাকে তাহলে সে নিজেও বাবা হওয়ার সুখটা থেকে বঞ্চিত হবে। সারাজীবনের জন্য অসুখী হবে সে। এইভেবেই বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার।

আমি কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলি,

— তার জন্যই তুই আদিব ভাইয়ার সাথে এমন আচরণ করছিলি? তাকে কষ্ট দিচ্ছিলি, নিজের থেকে সরিয়ে রাখছিলি, এভোয়েট করছিলি তাকে?

পায়েল মাথা নাড়ে। আমি এইবার চেঁচিয়ে বলি,

— আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড পায়েল? রিলেশনশীপে বাচ্চা কখনোই মেইন ফ্যাক্টর না। যেখানে ভালবাসা থাকে সেখানে কখনোই এইসব ব্যাপার মেটার করে না। একটা সম্পর্ক কখনোই বাচ্চার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় না। তৈরি হয় আন্ডারস্ট্যান্ডিং দিয়ে, কেয়ার দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে। একটি সম্পর্কে ভালবাসাটা যদি সত্যিকারের হয় তাহলে সেখানে ভালবাসার মানুষটিকে আগলে রাখাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চাওয়া। তাছাড়া এমন অজস্র দম্পতি আছে যাদের বাচ্চা হয় না অথচ তারা হ্যাপি। আর এখন তো বাচ্চা নেওয়ার কতশত অপশন আছে, উন্নত চিকিৎসা আছে। তা না বাচ্চা পালক নেওয়ার মত সুযোগ সুবিধা তো বহু যুগ ধরে আছে। আর তুই এই যুগের মেয়ে হয়ে কিভাবে এই ধারণা রাখতে পারিস বল? শুধু মাত্র বাচ্চার জন্য নিজের সম্পর্কে বলিদান দিচ্ছিলি? আদিব ভাইয়াকে এত কষ্ট দিচ্ছিলি?

পায়েল আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— কখনো কাউকে ভালবেসেছিস রিয়ানা?

পায়েলের এমন কথায় আমি হকচকিয়ে যাই। অবাক দৃষ্টিতে পায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকি। পায়েল তা দেখে মুচকি হেসে শান্ত কন্ঠে বলে,

— ভালবাসার মানেটা জানিস? হয়তো হ্যাঁ হয়তো না। ভালবাসা হচ্ছে নিঃস্বার্থ। এর মধ্যে কখনোই কোন স্বার্থ থাকতে পারে না। ভালবাসা হচ্ছে এমন এক জিনিস যেখানে তোর প্রত্যেকটা দোয়ায় মধ্যে থাকবে তোর ভালবাসার মানুষটি। তার জন্য নিজের মুখগুলো বিলিয়ে দিতেও তুই দ্বিধাগ্রস্ত হবি না। নিজের সবটা দিয়ে চাইবি যাতে সে ভালো থাকুক। তার যাতে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট না হয়। নিজে কষ্ট সইতে রাজি অথচ নিজের ভালবাসার মানুষটিকে নয়।

” ভালবাসা হচ্ছে বাগিচার সেই গোলাপ ফুলের মত যাকে আমরা সবসময় আগলে রাখি। নয়ন দুইটি ভরে দেখি। মনের তৃষ্ণা মিটাই। কিন্তু কখনো ছিড়ি না। বরং নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করি।”

তুই ভাবছিস মন দিয়ে আর আমি ভাবছি প্র‍্যাকটিকালি। বাস্তব এত সহজ নয় রিয়ানা। বাস্তব বড় কঠিন। আদিব আমাকে মেনে নিবে আমি তা জানি। এমন কি বিয়েও করে ফেলবেন আমায়। কিন্তু আমাকে বিয়ে করলে তিনি কখনো সুখী হতে পারবে না রে। তাকে আমার জন্য লাঞ্চিত হতে হবে তার পরিবারের কাছে, তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে, সমাজের কাছে। এই সমাজ যতই উন্নতির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাক না কেন, এদের চিন্তাভাবনা সেই আগের ন্যায় থেকে যাবে। এই সমাজে একজন বন্ধ্যা, বিধবা, ডিভোর্সি, স্বামী অথবা বাবার পরিচয়হীন কোন নারীর কোন জায়গায় নেই। সমাজ এখনো মেয়েদের সেই নিম্ন শ্রেণির জীবই মনে করে রে। এর মূখ্য কারণ কি জানিস? আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। এই সমাজে একজন পুরুষ একজন নারীকে ছাড়া অলচ না বরং একজন নারী একজন পুরুষকে ছাড়া অচল। সমাজের কথা না হয় বাদই দিলাম। তুই এই বল আমি নিজেই বা কিভাবে নিজের ভালবাসার মানুষকে কষ্টে দেখতে পারি? জেনে শুনে তার সকল সুখ কেড়ে নিতে পারি বল?
তাই তো তার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য বিয়েটা করছি। নিজে তো মা হতে পারবো না। অন্যের এক বাচ্চার মা এই না হলাম। সেই মাবিহীন বাচ্চাটাও একটা মা পেল। সবাই সব দিক দিয়ে খুশি হবে।

সব শুনে আমি নিরব হয়ে যাই। পায়েলের কথা যে ভুল তা কিন্তু নয়। ওর কথা পুরোটাই সত্যি। এইটাই তো আমাদের সমাজের বাস্তবতা। যত যাই বলি না কেন? আমাদের মন মানসিকতা নিচু ছিল, আছে আর সবসময় থাকবে। একজন নারীর উপর পুরুষের ছাঁয়া নেই মানে সে অসহায়। তাকে সর্বোচ্চ করুণা করা যায় কিন্তু সম্মান না। একজন নারীকে এখনো মানুষ তার নিজস্ব পরিচয়ে নয় বরং তার বাবা অথবা স্বামীর পরিচয়ে চিনতে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর এইখানে পুরুষদের মধ্যে কোন ত্রুটি ধরা হয় না। বরং একজন নারীর মধ্যে হাজারো ত্রুটি ধরা হয়। বিয়ে করার সময় একজন পুরুষকে জিজ্ঞেস করা হয় শুধু মাত্র তার কোয়ালিফিকেশন আর স্ট্যাটাস। কিন্তু একজন নারীকে বাজারের পণ্যের মত উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখা হয়। যাকে একপ্রকার হেনেস্তা করাই বলা চলে। এর মধ্যে সামান্য ত্রুটি ধরা পড়লেই তিল ক্যা পাহাড় হয়ে যায়। আর সেখানে যদি মেয়ে হয় বন্ধ্যা তাহলে তো কথায় নেই। বিষয়টা যতটা সহজ দেখাক না কেন? বিষয়টা আসলে অতি জটিল। এইসব ভেবে আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। অসহায় দৃষ্টিতে পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলি,

— আমি বলবো তুই আদিব ভাইয়াকে সব বলে দে। এতেই দুইজনের ভালো হবে। এরপর যা হওয়ার হবে।

আনিশাও আমার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলে,
— হ্যাঁ পায়েল। রিয়ানা ঠিক বলছে। তুই আদিব ভাইয়াকে সব বলে দে।

পায়েল এইবার চেঁচিয়ে বলে,

— একদম না! না আমি আদিবকে কিছু বলবো না তোরা। তোদের দুইজনকে আমার কসম তোরা দুইজন আদিবকে কিছু বলবি না। যদি বলোস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি।

আমি চাপা চিৎকার দিয়ে বলি,
— পায়েল!

পায়েল দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখ দিয়ে ওর অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। আমি আর আনিশা দুইজনই দুইজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকি। নিজেকে আজ চরম অসহায় মনে হচ্ছে। এমনটা না হলে কি হতো না?

___________________________________________

পায়েলের বাসার ড্রয়িংরুমে বর এবং তাদের আত্মীয়স্বজনরা বসে আছে। আন্টি আর পায়েলের ভাইও উপস্থিত। আমি আর আনিশা এক জায়গায় মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশটা দেখে চলেছি। ইতি মধ্যে কাজি সাহেবও এসে পড়েছে। সোফার একপাশে পায়েল মাথা নত করে বসে আছে অন্য পাশে ওর হবু বর। শুধু হবু বলে সম্মোধন করলে ভুল হবে। সে আসলে হবু ভুড়িওয়ালা বুইড়া বর। এর মূখ্য কারণ, একে তার বয়স আকাশ ছুঁই ছুঁই। তার উপর এক আস্ত ভুরি নিয়ে ঘুরছে। উফফ অসহ্য!

আনিশা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

— জামাইকে তো দেখে মনে হচ্ছে ৮ মাসের বাচ্চা পেটে। এই বুঝি ঠুস করে পেট থেকে বাচ্চা বেড়িয়ে এলো।

আমি আনিশার কথ শুনে ওর দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাই। আনিশা সেইদিকে তোয়াক্কা না করে আবার বলে,

— ভাই পায়েলের চয়েস বহুত খারাপ। বিয়া যখন করবি তখন হ্যান্ডসাম দেখে কোন বাচ্চার বাপকে করতি। মানানসই একটা ব্যাপার স্যাপার আছে নাকি বল।

আনিশার কথা শুনে আমার পেট ফেটে হাসি আসছিল। কিন্তু এমন এক মোমেন্টে হাসা যায় না বিধায় ঠোঁট টিপে হাসছি। নিজের হাসি চাপিয়ে বলি,

— ওই আনিশা দেখ না কোথায় পপকর্ন পাস কি না অথবা কোল্ড ডিংক্স। এখন যে সিনেমা হবে না তা দেখতে দেখতে খাওয়া যাবে আর মজা নেওয়া যাবে।

আনিশা চট জলদি রান্নাঘরের দিকে যায়। অতঃপর একটা কোকের বোতল নিয়ে এসে বলে,

— পায়েল যে কিপ্টা তা জানতাম। বাট এত বড় হার কিপ্টা তা জানতাম না। তন্নতন্ন করে খুঁজেও দ্বিতীয় একটা কোকের বোতল পাইলাম না। বইন বিয়াতে আসছি কই টাংকি ভরে ভরে কোন খামু তা না। একটা কোকের বোতল নিয়ে এখন কাজ চালাতে হচ্ছে। এমন হার কিপ্টা মাইয়া যে আমার বান্ধবী তা বলতেই আমার লজ্জায় কচু গাছের সাথে ফাঁসি দিতে ইচ্ছে করছে।

আমি কোকের বোতলটা নিয়ে বলি,

— আপাতত ফাঁসি দেওয়ার ইচ্ছাটা বাদ দে আর ক্লাইমেক্সের দিকে নজর দে। সময় হয়ে গেছে।

কথাটা শেষ করতেই কানে ঢাক-ঢোলের শব্দ ভেসে আসে। সবাই শব্দটা পেয়ে দরজার দিকে তাকায়। আজ বিয়ে বিধায় দরজা খোলাই রাখা হয়েছে। সবাই অতি আগ্রহের সাথে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে যে কে এসেছে। পায়েলও মাথাও তুলে সামনে তাকায়। ঠিক এমন সময় বরের সাজে আদিব ভাইয়া বাসায় এন্টি নেয়। আদিব ভাইয়াকে দেখার সাথে সাথে পায়েলের নয়ন দুটি চড়কগাছ। সে মোটেও আদিবকে এইসব এইখানে আশা করে নি। তাও আবার এমন সাজে। আদিব ভাইয়া ভিতরে আসতেই রিয়ান তাদের পিছে পিছে আসে। এর পরে আসে একটি মেয়ে আর একটি ছেলে। সম্ভবত মেয়েটি হচ্ছে আদিব ভাইয়ের বড় বোন আর ছেলেটি হচ্ছে তার হাসবেন্ড। সর্বশেষে ঢাক-ঢোল বাজানো লোকগুলো ভিতরে আসে। রিয়ান ইশারা করতেই তাদের ঢাক-ঢোলের বাজনা বন্ধ হয়। আদিব ভাইয়া কিছু না বলে সোজা পায়েল আর ওই ভুড়িওয়ালা জামাই এর মাঝখানে বসে যায়। আদিব ভাইয়ের এহেন কান্ডে সকলের মুখ হা হয়ে যায়। আদিব ভাইয়া মিষ্টি হাসি দিয়ে আন্টির দিকে তাকিয়ে বলে,

— আসসালামু আলাইকুম হবু শ্বাশুড়ি মা। কেমন আছেন? জামাই দেখে খুশি হয়েছেন তো?

আন্টি এখনো হ্যাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে। যেন কথা বলাই ভুলে গিয়েছেন। এইদিকে পায়েল এতক্ষণ হা হয়ে থাকলেও আদিবের কথায় ওর হুস আসে। অতঃপর নিজেকে সামলিয়ে বলে,

— এইসব কি হচ্ছে আদিব? আপনি এইখানে কেন এসেছেন?

আদিব ভাবলেশহীনভাবেই বলে,

— আর কেন বিয়ে করতে।

পায়েল অবাক করা কন্ঠে বলে,

— কার বিয়ে?

আদিব নিজের নখ দেখতে দেখতে বলে,

— আর কার তোমার আর আমার।

পায়েল এইবার চেঁচিয়ে বলে,

— পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি। কিসব আবোলতাবোল বকছেন? আমার বিয়ে আপনার সাথে না বরং তার সাথে হচ্ছে।

আদিব এইবার ওই ভুড়িওয়ালা ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে বলে,

— অহহ তাই নাকি! তা ভাই আপনার কি লজ্জা শরম নাই? নিজের বোনের বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছেন? তার উপর সেই মেয়ে আবার অন্যের প্রেমিকাও। কেমন মানুষ আপনি?

কথাটি শুনে সে রাগান্বিত হয়ে যায়। সাথে তার আত্নীয়স্বজনরাও। সকলেই সাহেলা বেগমকে কড়া কথা শুনাতে শুরু করে। তখন রিয়ান গলা খেকিয়ে বলে উঠে,

— দেখুন এইখানে তামাশা করে লাভ নেই। আজ এই মহাশয়ের বিয়ে হচ্ছে না আর হবেও না। তাই বলছি সসম্মানে চলে যান । আর হ্যাঁ যাওয়ার আগে বিয়ের খাবারটা খেয়ে যাবেন কেমন।

এই বলে রিয়ান আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর আমার হাত থেকে কোকের বোতল নিয়ে কোক খেতে থাকেন। তার এহেন কান্ডে আমি তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাই। সে আড়চোখে তা দেখে কোক খাওয়ার পর আমার দিকে ঘুরে সকলের দৃষ্টির আড়ালে আমায় চোখ টিপ দেয়। তা দেখার সাথে সাথে আমি মুখ ঘুড়িয়ে নেই। লজ্জায় এখন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। উফ! এই ছেলে এমন কেন?

এইদিকে রিয়ানের কথা বরযাত্রীরা অপমানিতবোধ করে। তারা বুঝে যায় এই বিয়ে আর হচ্ছে না। তাই তারা নিজেদের মধ্যে কানা গুসা শুরু করে দেয়। কিছুক্ষণ পর ফুসতে ফুসতে চলেও যায়। তাদের যাওয়ার পর আদিব ভাইয়া নিজের জায়গা ছেড়ে সাহেলা আন্টির সামনে চলে যায়। তার সামনে গিয়ে সে মাথা নত করে বলে,

— আন্টি আমি আসলে দুঃখিত। আপনাদেরকে আমি এইভাবে সকলের সামনে অপমান করতে চাই নি। কিন্তু পায়েল আমার জন্য কোন রাস্তায় খুলে রাখে নি। তাই বাধ্য হয়ে এমন করতে হলো। সরি! আমি এখন সরাসরি আপনার কাছে পায়েলের হাতটা চাচ্ছি। আমি ওকে আজ এখন এই মূহুর্তেই বিয়ে করতে চাই যদি আপনার অনুমতি থাকে। চিন্তা করবেন না আন্টি আমি পায়েলকে সবসময় খুশি রাখবো। কখনো ওকে কষ্ট পেতে দিব না।

সাহেলা বেগমের এইবার চোখজোড়া ভিজে আসে। তার তো এমনেও আগের বিয়েতে মত ছিল না। পায়েলের জীদের জন্য তাকে মানতে হয়েছিল। সে তো শুরু থেকেই চেয়েছিল পায়েল যেন আদিবের ঘরই করুক। ওর সাথে খুশি হোক। সাহেলা বেগম চোখের জল মুছে সম্মতি জানান। অতঃপর আদিব পায়েলের ভাইয়ের থেকেও সম্মতি পেয়ে যায়। ঠিক এমন সময় পায়েল বলে,

— কিন্তু আমি রাজি নই। আমি আদিবকে বিয়ে করতে পারবো না।

পায়েলের কথা শুনে আদিবের এইবার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। সে কঠোর গলায় বলে,

— এইখানে তোমার মতামত কেউ চায় নি। সো জাস্ট শার্ট আপ। তুমি চাও আর না চাও আজ তোমার আর আমার বিয়ে হবেই।

পায়েল কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

— আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না। আমি পারবো না আপনাকে বিয়ে করতে। আপনি হয়তো জানেন না যে….

কথার মাঝে আদিব ফোড়ন দিয়ে বলে,

— এইতো যে তুমি মা হতে পারবে না? হু কেয়ারস এবাউট দ্যাট ডেম ইট? আই জাস্ট ওয়ান্ট ইউ।

পায়েল ধরা কন্ঠে বলে,

— আপনার পরিবার মানবে না আমাদের বিয়েটা। প্লিজ বুঝার চেষ্টা করুন।

আদিব কঠোর গলায় বলে,

— ভুলে যেও না আমি স্ট্যাবলিশ একটা ছেলে। বাবার টাকায় চলি না। নিজের টাকাতেই চলি। যদি বাসায় আমাদের বিয়ে না মেনে নেয় তাহলে আমি তোমায় নিয়ে অন্য কোন জায়গায়ও সাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবো। তোমার ভরণপোষণ জোগার করার মত এবেলেটি আমার আছে। তাই এই কথা ভুলে যাও যে ফ্যামিলির কথা ভেবে আমি তোমায় ছেড়ে দিব। তোমাকে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়ছি না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও।

এই বলে আদিব ভাইয়া পায়েলের কাছে চলে গিয়ে ওকে জোর করে সোফায় বসিয়ে দেয়। অতঃপর কাজীকে বলে বিয়ে পড়াতে। দেখতেই দেখতে পায়েল আর আদিব ভাইয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। দুইজনই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। বিয়ে পড়ানো শেষে পায়েল আমাদের কাছে আসতে নিলে আনিশা আগেই চেঁচিয়ে বলে,

— তোর ওই ভুড়িওয়ালা না হওয়া জামাইয়ের কসম আমি আদিব ভাইয়াকে কিছু বলি নি। তোর মরা মুখ দেখার ইচ্ছা আমার পরকালেও নাই।

আমি পায়েলের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলি,

— দেখ বইন আমি তোর কসম ভাঙ্গি নি। তুই বলেছিলি আমরা যাতে আদিব ভাইয়াকে কিছু না বলি। অন্য কাউকে তো আর বলতে মানা করিস নি। তাই আমি ডাঃ রিয়ানকে তোর ব্যাপারে সব বলে দিয়েছিলাম আর তাকে বলেছিলাম হেল্প করতে। আর এই বিয়ে আটকাতে। বাদ বাকি যত কান্ড ঘটেছে তা সব ইহার এই মেহেরবানী। আমি এইসবের কিছুই জানি না।

পায়েল কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। আর অস্পষ্ট সুরে ‘থেংক ইউ’ বলে। পায়েলের কথা শুনে আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে। আমিও ওকে আগলে নেই। তা দেখে আনিশা বলে,

— আমি বাদ যাব কোন দুঃখে?

এই বলে পাশ থেকে আনিশাও আমাদের দুইজনকে জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে তিনজনে হাল্কা শব্দ করে হেসে উঠি।

#চলবে