আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-১৩

0
2980

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_13
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

পুরো আকাশ জুড়ে খন্ড খন্ড মেঘের ছড়াছড়ি। তারই মধ্যে সূর্যমামা মাঝে মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছেন নিজের উপস্থিতি সকলকে জানিয়ে দেবার জন্য। হিম হিম ভাব চারদিকে। হিম শীতল বায়ুর স্পর্শ পেতেই কেমন শির শির ভাব তৈরি হচ্ছে ভিতরে। চোখের সামনে দিয়ে দুই একটা চড়ুই পাখিরা কানামাছি খেলার মত ছুটাছুটি করে চলেছে আর কিচিরমিচির শব্দ করে চলেছে। আমি ব্রিজের এক প্রান্তে রেলিং এর উপর দুই হাত ভর করে দাঁড়িয়ে এইসব পর্যবেক্ষণ করছি। বাতাসের ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চুলগুলোও মেতে উঠেছে ছিনিবিনি খেলায়। সামনের দিকে ছোট ছোট চুল গুলো বার বার চোখের সামনে এসে পড়ছে। বিরক্তিকর ভঙ্গি নিয়ে আমি বার বার চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে নিচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি পাশ ফিরে তাকাই। পাশেই রিয়ান নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। পিঠটা রেলিং এর ধারে ঠেকিয়ে দুই পা ক্রস করে দাঁড়িয়ে আছে। বা হাত পকেটে ঢুকিয়ে ডান হাতে মোবাইল স্ক্রোল করছে। পড়নে তার চকলেট কালার টি-শার্ট আর হোয়াইট প্যান্ট। কালো ঘন চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি তার বা পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় তার বা গালে উপস্থিত তিলটি আমার চোখে বার বার বিঁধছে। আমি দ্রুত তার থেকে চোখ সরিয়ে নেই। তানা হলে কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলি কে জানে? এই তিলের উপর আমার শুরু থেকেই দূর্বলতা কাজ করে। যার জন্য দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও প্রবল। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলি,

— থেংক ইউ ডাঃ রিয়ান! আপনি না হলে আজকে হয়তো আদিব ভাইয়া আর পায়েলের বিয়েটা সম্ভব হতো না।

রিয়ান মোবাইলের দিকেই তাকিয়ে বলে,

— হুম!

আমি আবার বলি,

— আদিব ভাইয়া আর পায়েলকে একসাথে খুব মানায় তাই না?

সে আগের ন্যায় মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়েই বলে,

— হুম!

আমি এইবার রিয়ানের দিকে ভ্রুকুটি একত্রিত করে তাকাই। বুঝার চেষ্টা করি সে কি আদো আমার কথা শুনছে কি না। এইটা পরীক্ষা করার জন্য বলি,

— মাছির সাথে মশার বিয়ে হলে তাদেরকেও বেশ মানাবে তাই না?

সে আগের ন্যায় মোবাইলে মগ্ন হয়ে বলে,

— হুম!

আমি এইবার তার কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয়। রিয়ান এইবার মোবাইলের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকায়। ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে থাকে আর আমার এই হাসির পিছে লুকিয়ে থাকা রহস্যটি বুঝার চেষ্টা করে। অতঃপর ব্যর্থ হয়ে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— হোয়াট?

আমি কোনে মতে হাসি থামিয়ে বলি,

— মনে করেন? একটু আগে আমি কি বলেছিলাম আর আপনি কি উত্তর দিয়েছেন?

এই বলে আবার হাসতে থাকি। রিয়ান কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়তেই সে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

— দিন দিন বাদর হচ্ছ। আমার সাথে মশকারা করা হচ্ছে?

আমি হাসি থামিয়ে মিষ্টি হাসি হেসে বলি,

— আমার কি আর সেই সাহস আছে বলুন? আমি তো শুধু দেখতে চাচ্ছিলাম যে ‘হুম’ বলাটা কি আপনার মুদ্রাদোষ কি না?

রিয়ান মুখ ঘুড়িয়ে নিয়ে মোবাইল অফ করে পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে,

— নোট সো ফানি!

আমি মুখটা গোমড়া করে বিরবির করি,

— খাটাশ একটা। হুহ!

রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— কিছু বললে?

আমি কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে বলি,

— না কই? আপনি কানে বেশি শুনেছেন মনে হয়। হেহে!

রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— পায়েলের প্রবলেম ছিল ভালো কথা। কিন্তু তার জন্য ও এমন এক বয়স্ক লোকের সাথে কেন গেল? এর চেয়ে অনেক ভালো ভালো অপশন ছিল ওর কাছে।

আমি রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলি,

— মেয়েদের জীবন এইভাবেই সহজ নয় ডাঃ রিয়ান। তার উপর যদি সেই মেয়ের মধ্যে কোন ত্রুটি থাকে তাহলে তো কথাই নেই। তাকে তো সব জায়গায় অপদস্ত হতে হয়। বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে। পায়েলের মধ্যে যেহেতু ত্রুটি ছিল তাই ওকে কেউ কখনোই নিজের বাড়ির বউ বানাতে চাইতো না। কেন না এইখানে কম বেশি সকলেই তাদের বংশধর নিয়ে চিন্তিত। আর এই সমাজের তো একটা ধারণা আছেই,
” নিজের রক্ত নিজের রক্তই হয়। অন্যের রক্ত কখনো নিজের হয় না।”
তাদের ভাষ্যমতে এই দুইটা কখনো এক হয় না। আর হবেও না। যার জন্য বন্ধ্যা নারীদের কখনোই একটা ভালো ফ্যামিলিতে জায়গায় হয় না। তাদের আসলে এই সমাজে তেমন কোন জায়গায়ও নেই৷ এমন কি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও না। যদি এমন নারীদের বিয়ের কথা উঠেও তখন সমাজের দৃষ্টি কোণ থেকে এমন নারীদের বিবাহিত অথবা যার আগের ঘরের বাচ্চা-কাচ্চা আছে সেই সব পুরুষদের কাছে বিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। এতে দুইপক্ষই সন্তুষ্ট হয়। এই হচ্ছে আমার সো কোল্ড সোসাইটি উরফে সমাজের ধারণার বিষয় বস্তু।
সেইদিক দিয়ে যখন পায়েলের বন্ধ্যা হওয়া সম্পর্কে ওর প্রতিবেশী জানতে পারে তিনি তখন এমনই এক সমন্ধ নিয়ে আসে। আর পায়েল তো তখন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিলাম সাথে মাথায় জীদ চেপে বসেছিল ও আদিব ভাইয়ার থেকে দূরে চলে যাবে। নিজেকে তার সাথে লাইফের সাথে জড়িয়ে কষ্ট দিবে না। নিজের লাইফ নষ্ট করবে কিন্তু আদিব ভাইয়ার না। তাই ওই ও রাজী হয়ে যায়। কথায় আছে, ” ভালবাসা মানুষের হেদায়েত জ্ঞান সব কেড়ে নেয়।” পায়েলের বেলাও এই কথাটা বেশ খানিকটা প্রযোজ্য। অন্যথায় এমন ডিসিশন নেওয়ার মত মেয়ে পায়েল না।

রিয়ান বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বলে,

— এইখানে কি আরও কিছুক্ষণ থাকবে বা খিদে পেয়েছে কিছু খাবে?

আমি মুচকি হেসে চারদিক তাকিয়ে দেখতে থাকি কি আছে খাওয়ার মত। সামান্য পরিমাণ খিদে তো পেয়েছেই। পাশেই বাদাম ওয়ালাকে চোখ পড়তেই আমি বলি,

— বাদাম খাওয়া যায়। কি খাওয়াবেন আমায়?

রিয়ান ভ্রুকুটি আড়া আড়িভাবে কুঞ্চিত করে বলে,

— এইটা রিকুয়েষ্ট ছিল নাকি প্রশ্ন?

আমি সামনে এগুতে এগুতে বলি,

— আপনার মন যেটা বলে সেটাই।

রিয়ান কিছু না বলে ডান দিতে চুলগুলো ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসে। আমি চারপাশটা দেখতে থাকি। ব্রিজের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে কাপলরা। তারা টুকিটাকি কথা বলছে আর হাত করে হাটছে। কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে আর বাদাম চিবুচ্ছে। এইসব যখন আমি পর্যবেক্ষণ করছি তখন ইটের টুকরো পায়ের নিচে এসে পড়ে। আর আমি তাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে নেই। তা দেখে রিয়ান আমায় দ্রুত আগলে নেন। সে আমার পিছনে থাকায় এক দিক দিয়ে সুবিধাই হয়েছে। প্রথমত ঘটনাটা বুঝতে আমার বেশ সময় লাগে অতঃপর বুঝতে পেরে দেখি আমি তার বাহুদ্বয়ের মাঝে। সাথে সাথে আমি সরে দাঁড়াই আর চারপাশে তাকাতে থাকি। সকলেই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ মিটিমিটি হাসছে তো কেউ কানা ঘুষা করছে। এতে লজ্জা লাগছে আমার বেশ। কিন্তু বাইরে দিয়ে প্রকাশ করছি না। মনে মনে নিজেকে কয়েকশো বকা দিচ্ছি রাস্তায় ঠিক মত না হাটার জন্য। আমি রিয়ানের দিকে তাকাই তার ভাবভঙ্গি বুঝার উদ্দেশ্য। তাকিয়ে দেখি তার এতে কোন ভাবান্তর নেই। সে অতি শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে মনে আনমনে এইবার ভাবতে থাকি, সে এমন কেন? হুয়াই?

____________________________________________

খাটের এক কোনে বসে আছে পায়েল। চোখে মুখে তার এক রাশ ভয় সাথে কিছুটা সংশয়। আদিব ওয়াশরুমে গিয়েছে ফ্রেশ হতে। পায়েল আগেই ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়েছে। আপাতত পায়েল আদিবের বেড়িয়ে আশার জন্য অপেক্ষা করছে। বিয়ের হওয়ার পর থেকে আদিব এই পর্যন্ত পায়েলের সাথে কথা বলে নি। পায়েল অনেক বার চেষ্টা করেছে কথা বলার কিন্তু আদিব কথা বলতে নারাজ।
তারা আপাতত আদিবের বড় বোনের বাড়িতে উঠেছে৷ আজকে এইভাবেই অনেক কাহিনী হয়ে গিয়েছে তার উপর বাসায় গিয়ে যদি নতুন কোন কাহিনী হয় সেই কথা চিন্তা করে আদিব আজ বাসায় যায় নি। আগে নিজেকে একটু সামলে নেওয়া প্রয়োজন। আদিবের বোন আর দুলাভাই তারা দুইজনও এই বিষয়টা বুঝতে পেরে আদিব আর পায়েলকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে। কাল সকলে একসাথেই আদিবের বাসায় যাবে। যদি আদিবের বাবা-মা সহজেই তাদের ব্যাপারটা মেনে নেয় তাহলে তো হলো এই। আর যদি না মানে তখন এরটা তখন বুঝবে তারা।

বেশ কিছুক্ষণ পর আদিব চুল মুচতে মুচতে বেড়িয়ে আসে। পড়নে তার লাল টি- শার্ট আর কালো ট্রাউজার। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারায় বিন্দু বিন্দু পানির ফোটা জমে আছে। চোখের নিচে বেশ কালি পড়ে গিয়েছে। আগের চেয়ে অনেকটা শুকিয়েও গিয়েছে বটে। কিছুটা রোগা রোগা লাগছে। বুঝাই যাচ্ছে অনেক দিন যাবৎ ঠিক মত খাওয়া-ঘুম হয় না আদিবের। আদিবের এমন অবনতি দেখে পায়েলের কান্না পাচ্ছে। আদিবের এইসব পরিবর্তনের পিছে যে পায়েলেরই অবদান। আদিব বারান্দায় টাওয়াল মেলে দিয়ে বিছানার কাছে আসে। তা দেখে পায়েল দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে আদিবের উদ্দেশ্যে বলে,

— আদিব প্লিজ আমায় মাফ করে দিন। আমি আপনাকে কষ্ট…..

আদিব কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলে,

— মাফ করা কি এতই সহজ? আমাকে তুমি ঠিক কি পরিমাণ কষ্ট দিয়েছ তার আন্তাজও আছে তোমার? আমার প্রেয়সী আমাকে ভালবাসে না কথাটি শুনার পর আমার কি অবস্থা হয়েছিল তুমি কি তা আদৌ জানো? যখন আমার ভালবাসাকে অপমান করেছ,বার বার ফিরিয়ে দিয়েছ, ইগনোর করেছ তখন আমার কতটা কষ্ট হয়েছে জানো? আমার প্রতি ভালোবাসা গুলোকে যখন তুমি আবেগের নাম দিলে তখন কেমন লেগেছিল জানো? ডু ইউ হ্যাভ এনি ডাউট তুমি কি কি করেছ?
কিসের কিসের জন্য ক্ষমা করবো তোমায় বলো? আমাকে আঘাত করার জন্য নাকি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নাকি আমাকে ভেঙে চুড়ে দেওয়ার জন্য নাকি আমাকে তিলে তিলে শেষ করার জন্য? বলো!!!!

পায়েল এইবার ফুপিয়ে উঠে। তা দেখে আদিব পায়েলের কাছে এসে ওর বাহু দুইটি চেপে ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে বলে,

— একবার কি আমাকে বিশ্বাস করা যেত না? বলে দেখা যেত নিজের সমস্যার কথা? কি ভেবেছিলে সব শুনে আমি তোমায় ছেড়ে দিব? নাকি পরিবারের দোহাই দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিব? এতটা অবিশ্বাস ছিল আমার প্রতি? আমি তো সবসময় তোমাকে চেয়েছিলাম, তোমার সেই পাগলামো ভালবাসা চেয়েছিলাম। তাহলে এর মাঝে বাচ্চার বিষয়টা আসেই বা কিভাবে? এন্সার মি ডেমিট?

পায়েল কিছু না বলে ফোঁপাতে থাকে। তা দেখে আদিব পায়েলের বাহুদ্বয় ছেড়ে গালে হাত রেখে মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বলে,

— একদম কান্না করবে না। তোমার কান্না দেখে আমি এইবার গলবো না। অনেক কষ্ট দিয়েছ আমায় তুমি। বুকের বা পাশটা একদম জ্বালিয়ে ছাড়খার করে দিয়েছ তুমি। তোমাকে ক্ষমা আমার পক্ষে সম্ভব কি না জানি। কিন্তু তাই বলে যে তোমাকে ছেড়ে দিব তা না। আমার তুমি বুঝলে? তোমাকে সারাজীবন এই আদিবেরই হতে হবে। তুমি আমার ভালবাসা না আমার আসক্তি। যাকে ছাড়া বাঁচা আমার পক্ষে কোন কালেই সম্ভব না। বুঝলে!

পায়েল কিছু না বলে আদিবকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু আদিব ওকে ধরে না। আদিবের মনে একটু একটু করে জমতে থাকা অভিমান গুলো আজ পাহাড় ন্যায় সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা আদৌ ভাঙ্গবে কি না তা অজানা।

#চলবে