আহনাফ চৌধুরী পর্ব-০৭

0
88

#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
অর্ষা অনেকদিন বাদে আজ ভার্সিটিতে এসেছে। ওর আগমনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে সম্পা। অর্ষার ভার্সিটিতে সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী সে। স্কুলের বেস্টফ্রেন্ড অর্ষার থাকলেও দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা কথা হয় খুবই কম। অবশ্য এমন হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। বিয়ে হয়ে গেলে একটা মেয়ের জীবনে তখন অনেক পরিবর্তনই ঘটে। কলেজ পর্যন্ত এক সাথে পড়ার পর বেস্টফ্রেন্ড মিনির বিয়ে হয়ে গেছে। পড়াশোনা এখনো কন্টিনিউ রাখলেও ক্লাস করা হয় না।

সম্পা অর্ষাকে দেখেই বসা থেকে উঠে এসে শক্ত করে জাপটে ধরল। নিজের ওপর ভারসাম্য রাখতে না পেরে কয়েক পা পিছিয়ে গেল অর্ষা। হেসে সেও জড়িয়ে ধরে বলল,

“পরে যাব তো!”

“পড়বি না। তোকে ধরার জন্য কত আশিক আছে এখানে!”

“ফালতু কথা বলবি না তো সবসময়।”

“ফালতু কথা বলি নাকি সত্যি কথা বলি সেটা তুইও জানিস। এতদিন আসিসনি কত মিস করেছি জানিস?”

“এতদূর আসতে ভালো লাগে না। কিন্তু তুই আপুর এঙ্গেজমেন্টে না এসে কাজটা ভালো করিসনি।”

“বাসায় ম্যানেজ করতে পারিনি রে। সরি। তবে বিয়ে মিস করব না, প্রমিস।”

“মিস করতে দিলে তো? তুলে নিয়ে যাব।”

“এহ্! তুলে নিয়ে গিয়ে কী হবে? তোর তো আর ভাই নাই। থাকলে না হয় একটা কথা ছিল।”

একটু থেমে সম্পা উল্লাসিতস্বরে বলল,

“ভালো কথা, তোর দুলাভাইয়ের কোনো ছোটো ভাইটাই নেই?”

অর্ষা ঠোঁট উল্টে বলল,

“উম না! সে একাই। বোন আছে একটা ছোটো। বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটো বাবু আছে আপুর। তাই শীতের মধ্যে আসেনি। শ্বশুর-শাশুড়ি নাকি আসতে দেয়নি।”

“থাক! মেয়ে মানুষের ফিরিস্তি শুনে আমার কাজ নেই। আমার যে সিঙ্গেল ম’র’তে হবে বুঝতে পেরেছি।”

“সিঙ্গেল কেন ম’র’বি?”

“তাছাড়া আর কী করব? নিজে একটা রিলেশন করিস, তারও কোনো ছোটো ভাই নেই। ঐশি আপু বিয়ে করতেছে তারও কোনো ছোটো ভাই নেই। মানে একদম যা তা!”

অর্ষা হেসে বলল,

“এমনভাবে বলছিস মনে হয় দুনিয়াতে ছেলের খুব অভাব? শোন, ভাইয়ার অনেক সুন্দর সুন্দর বন্ধু আছে। বিয়েতে ট্রাই মারতে পারিস।”

“সত্যিই?”

“হ্যাঁ।”

সম্পা হেসে ফেলল। বলল,

“আচ্ছা সেসব পরে দেখা যাবে। ছবি তুলিসনি ভাইয়া-আপুর?”

“অবশ্যই।”

“দেখা।”

অর্ষা আর সম্পা নিজেদের জায়গায় এসে বসেই এতক্ষণ গল্প করছিল। অর্ষা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সবার ছবি দেখাল। ছবি দেখা শেষে সম্পা বলল,

“কিরে রিহান ভাইয়ার ছবি দেখলাম না যে? দাওয়াত দিসনি?”

অর্ষার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মলিনস্বরে বলল,

“বলেছিলাম। কিন্তু আসেনি। কাজ আছে নাকি!”

“ঘোড়ার ডিমের কাজ! একটা মানুষ এত ব্যস্ত থাকতে পারে?”

অর্ষা হাসার চেষ্টা করে বলল,

“পারে হয়তো। ওর লাইফ তো আর আমাদের মতো সাধারণ কোনো লাইফ নয় তাই না?”

“হু! সে তো আবার সেলেব্রিটি! ড্যাম ইট! আমার মনে হয় কী জানিস?”

“কী?”

“সে তোকে ভালোবাসেই না।”

মুখের ওপর এমন একটা তিক্ত কথা শুনে বেশ কষ্ট লাগল অর্ষার। হজম করতে পারছে না ঠিক। মাঝে মাঝে যে তার মনেও এমন প্রশ্ন আসে না, ঠিক তা নয়। একাকি তার মনেও প্রশ্নগুলো আসে। কিন্তু যখনই রিহানের সাথে কাটানো ভালো মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে তখনই সে তার মনকে সামলে নেয়। রিহান তো আগে এমন ছিল না। আগে ঠিকমতোই সময় দিত, কথা বলত, দেখা করত। ওর ব্যস্ততা বেড়েছে ইদানীং। পরিবর্তনও এসেছে সাথে। অর্ষাও রিহানের কথা মেনে নিয়েছে যে, ব্যস্ততা ও কাজের চাপই এর একমাত্র কারণ।

অর্ষাকে চুপ করে থাকতে দেখে সম্পা বলল,

“যে ভালোবাসে সে হাজার ব্যস্ততার মাঝেও প্রিয় মানুষটার জন্য সময় বের করে। সময় দেওয়া না দেওয়াটা নির্ভর করে নিজের ওপর। আমরা ঐ মানুষদেরই সময় দেই, যাদের গুরুত্ব আছে আমাদের জীবনে। বুঝতে পেরেছিস?”

“বাদ দে এখন এসব কথা।”

“আমি তো বাদই দেই সবসময়। কিন্তু আমি তোর ভালো চাই অর্ষা। তাই বারবার বলি যে, পরে বেশি কষ্ট পাওয়ার চেয়ে আগেই নিজ থেকে সরে যা।”

অর্ষা বিষাদের হাসি হেসে বলল,

“বলা তো অনেক সহজ। কিন্তু করে দেখানো কঠিন। তোর জায়গায় আমি থাকলে আমিও হয়তো এই কথাগুলো অবলীলায় যে কাউকে বলে দিতে পারতাম। যেমনটা তুই, মা এবং আপু আমাকে সবসময় বলিস। কিন্তু তোদেরকে আমি কীভাবে বোঝাই যে আমি কেমন সিচুয়েশনে আছি? তোরা তো বলেই খালাস! রিহানকে আমি ছেড়ে দেবো এটা করা তো দূরে থাক; আমি ভাবতেও পারি না। ওকে ছাড়া আমি থাকতেই পারব না।”

“অর্ষা, আমি জানি তুই তাকে কতটা ভালোবাসিস। কিন্তু সে কি তোর ভালোবাসার যথাযথ মূল্যায়ন করছে বল? সে তোকে দিনের পর দিন অবহেলা করে যাচ্ছে, ভালোবাসার অভিনয় করে যাচ্ছে আর তুইও বোকার মতো সব সয়ে যাচ্ছিস। এভাবে আর কতদিন চলবে আমায় বল তো?”

অর্ষা চুপ করে আছে। সম্পা বলল,

“আচ্ছা তুই তাকে বিয়ের কথা বলেছিস?”

“হু।”

“কী বলেছে ভাইয়া?”

“এখন বিয়ে করতে পারবে না। আগে ক্যারিয়ার…”

সম্পা বিদ্রুপ করে হাসল। বলল,

“হাহ্! এতেও যদি তুই না বুঝিস! আচ্ছা যাই হোক, বাদ দে। দেখ এভাবে যেই কয়দিন যায়।”

দুজনে চারটা ক্লাস করে বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। অনেকদিন পর দুজনের দেখা হয়েছে বিধায় আজ দুজনে একসাথে কিছুক্ষণ ঘুরবে।

ওরা প্রথমেই দুপুরে খাওয়ার জন্য একটা নামিদামি রেস্টুরেন্টে গেল। যেহেতু সম্পা ঐশির এঙ্গেজমেন্টে আসতে পারেনি, তাই ওকে ট্রিট দেবে বলে ঠিক করেছে অর্ষা। দুই বান্ধবী খুশি মনে গল্প করতে করতে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে। কিন্তু সেই হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগল না। এইতো ওদের থেকে হাত তিনেক দূরে ছবি তোলার জন্য খুব সুন্দর একটা জায়গা আছে রেস্টুরেন্টে। দোলনাসহ চারপাশের সম্পূর্ণ জায়গাটুকু প্লাস্টিকের অর্কিড ফুল দিয়ে সাজানো। ঐখানেই পাশাপাশি হাত ধরে ছবি তুলছে রিহান এবং অপরিচিত একটা মেয়ে। ওদের ছবি তুলে দিচ্ছিল অন্য একজন। অর্ষার বুক কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। মুখ থেকে কোনো শব্দ যেমন বের হচ্ছিল না, ঠিক তেমনই আবার তার পা-ও চলছিল না। তার কষ্ট হয়তো ঠিকমতো ভাষায়ও সে প্রকাশ করতে পারবে না।

সম্পা শক্ত করে অর্ষার এক হাত চেপে ধরল। ওদিকে অর্ষার দুই চোখ তখন অশ্রুতে টইটুম্বুর। সে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রিহানের হাতের দিকে। কোনোভাবেই তার মানতে ইচ্ছে করছিল না যে, এটাই তার রিহান। তার ভালোবাসার মানুষ। ওরা ঠিক কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল নেই। তবে বেশ কিছুক্ষণ পর রিহানের সাথে অর্ষার চোখাচোখি হলো। ততক্ষণে অর্ষার চোখ থেকে গাল বেয়ে অশ্রুধার নেমেছে। রিহানকে বেশ অপ্রস্তুত দেখাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে এলো অর্ষার কাছে। বলল,

“তুমি এখানে?”

অর্ষা ক্রন্দনরতস্বরে বলল,

“আমাকে এখানে আশা করোনি নিশ্চয়ই?”

রিহান চুপ করে আছে। অর্ষা বলল,

“এই তাহলে তোমার ব্যস্ততা? অথচ আমি…”

কথাটুকু সম্পূর্ণ বলতে পারল না অর্ষা। কান্নায় আটকে গেল। ঢোক গিলে ফুঁপিয়ে বলল,

“অথচ আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম!”

“তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। আমি তোমার সাথে এটা নিয়ে পরে কথা বলব।”

“পরে কেন? যা বলার এখনই বলো। তা না হলে আর কখনো বলার দরকার নেই।”

“তুমি কাঁদছ কেন? এখানে তো কাঁদার মতো কিছু হয়নি। প্লিজ কান্না থামাও! এখানে আমার পরিচিত মানুষজন আছে।”

“রাইট! এখানে কাঁদার মতো কিছু হয়নি। সত্যিই? সত্যিই কিছু হয়নি? থ্যাঙ্কস! আমাকে আমার জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। আমার বিশ্বাসের মূল্য এভাবে দেওয়ার জন্য।”

এরপর সে হাতের উলটোপিঠে চোখ মুছে বলল,

“বিশ্বাস যে কতটা দামি, এটা তুমি ততদিন বুঝবে না; যতদিন না কেউ তোমার বিশ্বাস ভাঙছে!”

এরপর সে কাঁদতে কাঁদতেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসে। বেরোনোর সময় গেইটে আহনাফের মুখোমুখি হয় অর্ষা। তবে দাঁড়াল না। তৎক্ষণাৎ চলে এলো সেখান থেকে। রেস্টুরেন্টের পাশেই একটা পাবলিক পার্ক আছে। সকালে আর বিকেলে অনেক মানুষজন থাকলেও এই দুপুরবেলায় কোনো মানুষ নেই তেমন। একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে অর্ষা হাঁটু গেড়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ওর বুক ভাঙা কান্না দেখে সম্পা নিজেও নিজেকে সামলাতে পারল না আর। সে চাইতো অর্ষা সরে আসুক রিহানের জীবন থেকে। ভালো থাকার জন্যই। কিন্তু এভাবে হোক এটা চায়নি। সে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে ফেলল। অর্ষার কান্নার গতি বেড়ে যায়। তার আহাজারি কি ঐ মানুষ অবধি পৌঁছাবে কখনো?

চলবে…