আড়ালে আবডালে পর্ব-০৩

0
4947

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________________

নিহি এক দৌঁড়ে ক্লাশরুমে চলে আসে। বেঞ্চে বসে সমানে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। ক্যান্টিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সময় ক্লাসের অনেকেই উপস্থিত ছিল তখন ক্যান্টিনে। কয়েকজন উন্মুখ হয়ে বসে আছে নিহির কাছ থেকে পুরো ঘটনা জানার জন্য। কিন্তু সে গুড়ে বালি দিয়ে টিফিন শেষের ঘণ্টা বেজে যায়। সময় অপচয় না করেই অনামিকা ম্যাম ক্লাস নিতে চলে আসে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ায় হাঁপানো কিছুটা কমেছে। উপমা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে নিহির দিকে এগিয়ে দেয়। গলা এমনিতেই শুকিয়ে ছিল পানি দেখে তেষ্টা যে বহুগুণ বেড়ে গেছে নিহির। বাঘিনীর মতো বোতলটা কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে শুরু করে।

টিফিনের পর তিনটে পিরিয়ড হয়েই কলেজ ছুটি। ক্লাস থেকে বের হয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আগে দেখে নেয় কোথাও অনল আছে নাকি! তখনই ধাক্কা খায় অনামিকা ম্যামের সঙ্গে। নিহি ভয় পেয়ে গিয়ে বলে,
“স্যরি, স্যরি ম্যাম! আমি দেখিনি।”
“ইট’স অল রাইট। এমন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছ কেন? কাউকে খুঁজছ?”
“হ্যাঁ মানে না। মানে হ্যাঁ!”
নিজের কথার প্যাঁচে নিজেই পড়ে যায় নিহি। কী বলতে কী বলে ফেলছে বুঝতেও পারছে না। নিহির এরকম উলটপালট কথায় অনামিকা ম্যাম হেসে ফেলে। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলে,
“আচ্ছা শোনো, বাইরে তোমার ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।”
“ভাইয়া এসেছে?”
“হ্যাঁ। তোমার প্রাইভেট ঠিক করে গেছে। বিকেল সাড়ে চারটায় আমার বাসায় চলে আসবে।”
“জি ম্যাম।” বিনয়ীভাবে বলে নিহি। ম্যাম হেসে অফিসরুমে চলে যায়। নিহির রাগ হচ্ছে এখন ভাইয়ের ওপর। আরে মাত্র তো কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখন থেকেই কেন প্রাইভেট পড়তে হবে? প্রাইভেট পড়ার সময় কি হারিয়ে যাচ্ছিল? কলেজ লাইফটা ইনজয়ও করতে দেবে না। বিরক্তিকর! রাগে গজরাতে গজরাতে বাইরে যায় নিহি। উপমা পেছন থেকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে নিহিকে ডাকে। ভাইয়ের রাগ উপমাকে দেখিয়ে বলে,
“কী হয়েছে? পেছন থেকে ডাকাডাকি করতেছ কেন?”
“রাগ করো কেন?” অসহায়ের মতো মুখ করে বলে উপমা। নিহি নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে বলে,
“বলো।”
“তুমি কি সব প্রাইভেট পড়া এই মাস থেকেই শুরু করবে?”
ভাবলেশহীনভাবে নিহি বলে,
“ভাইয়ের তো এটাই ইচ্ছে।”
“তাহলে আমিও এই মাস থেকেই পড়ব। একা একা পড়তে ভালো লাগে না। অনামিকা ম্যাম বলল আজ বিকেলেই তার বাসায় যেতে।”
নিহির চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। প্রাইভেট পড়ার সঙ্গী না থাকলে প্রাইভেট পড়ে মজা নেই। দুজনে সময় ঠিক করে নিয়ে কলেজ থেকে বের হয়। কলেজের মাঠে নীলমকে বাইকের ওপর দেখতে পায় নিহি। দৌঁড়ে ভাইর কাছে চলে যায়। নীলম বলে,
“কীরে এতক্ষণ লাগে বের হতে?”
“উপমার সাথে কথা বলছিলাম।”
“আচ্ছা বাড়িতে চল।”

নীলম বাইক স্টার্ট দেয়। নিহি বাইকে উঠে এক হাতে নীলমকে জড়িয়ে ধরে। কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় ক্যাম্পাসে অনলকে দেখতে পায়। ওদের দিকেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তাকিয়ে ছিল। হয়তো টিফিনের সময়ে ভিম সাবান দিয়ে আপেল ধুয়ে খাইয়েছিল বলে এখনো রেগে আছে। তখনকার কথা মনে পড়তেই নিহি হেসে ফেলে। নীলম বলে,
“কীরে হাসছিস কেন?”
“না, এমনি। আচ্ছা ভাইয়া খুব কি দরকার ছিল এই মাস থেকেই প্রাইভেট পড়ার?”
“হ্যাঁ,ছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে সায়েন্স নিয়ে পড়া মুখের কথা নয়। প্রথম থেকেই মনোযোগী হতে হবে। হেলাফেলা করলে চলবে না। যা করার করবি। কিন্তু পড়াশোনা ঠিক রেখে করবি।”
“আচ্ছা।”
.
অনলের খুব পরিমাণ রাগ হচ্ছে। কেন যে এত রাগ হচ্ছে তা অনল নিজেও বুঝতে পারছে না। দুপুরের ঘটনার জন্য নাকি নিহিকে অন্য কোনো ছেলের বাইকে দেখে সেটা নিয়েও অনল কনফিউজড। অন্য যে কারো বাইকে উঠতেই পারে তাতে অনলেরই বা কী? এই ‘কী’ এর উত্তরই খুঁজে পাচ্ছে না অনল। মাঠে পড়ে থাকা একটা স্পিডের খালি বোতলে লাথি দিতে দিতে নিহির কথা ভাবছে। ওর থেকে কিছুটা দূরে সাকিব, মিলন, সুমাইয়া আর লিসা বসে আছে। সাকিব বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
“হলো কী হঠাৎ ওর?”
মিলন হেসে বলে,
“দেখ গিয়ে কার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”
“আচ্ছা আমি কথা বলে দেখছি।” বলে, সুমাইয়া অনলের কাছে যায়। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“তোর মন খারাপ নাকি?”
অনল কোনো ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই বলে,
“না তো!”
“তাহলে একা একা কী ভাবছিস?”
“কিছুই না।”
“সত্যি করে বল।”
“মিথ্যা মনে হচ্ছে?”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“তাহলে মিথ্যাই।”
অনল আর কথা না বাড়িয়ে কাউকে কিছু না বলেই বাইক নিয়ে বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমালেই রাগ সব মিটে যাবে। অহেতুক ভিত্তিহীন রাগ করার কোনো মানেই হয় না।
.
.
তিতিরকে নিয়ে ফোনে কার্টুন দেখছে নিহি। তিতির হলো বড় ভাই নীলমের মেয়ে। সে ছোট ফুপি বলতে পাগল। কলেজ থেকে আসার পরই আঠার মতো নিহির সাথে লেগে থাকবে। রাতে ঘুমাবেও নিহির সাথে। হুট করে কেউ দেখলে ভেবেই নিবে তিতির নিহির মেয়ে। নিহিও তিতিরকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে। তমা নিহি আর তিতিরের জন্য পাস্তা বানিয়ে নিয়ে এসে বলে,
“তুমি এখনো কার্টুন দেখছ? তোমার না একটুপর প্রাইভেট আছে?”
“উফ! আমি তো ভুলেই গেছিলাম।” বিছানায় বসে বলে নিহি। আলমারি থেকে কাপড় বের করে রেডি হতে চলে যায়। ভাবির বানানো পাস্তা খেয়ে ভাইয়ের সঙ্গে চলে যায় প্রাইভেটে। নীলম ম্যামের বাড়ির সামনে নামিয়ে দেয়।নিহিকে বলে,
“প্রাইভেট ছুটি হওয়ার দশ মিনিট আগে আমাকে ফোন দিবি। আমি এসে নিয়ে যাব।”
“আচ্ছা।”
নিহি সিঁড়ি ভেঙে উপরে যায়। দুই তলায় গিয়ে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় মধ্য বয়সী এক মহিলা। নিহিকে জিজ্ঞেস করেন,
“কারে চাও?”
“জি আমি অনামিকা ম্যামের কাছে প্রাইভেট পড়তে এসেছি।”
“ও। ভেতরে আইসা বসো। আপায় এখনো আসে নাই।”
“জি।”

নিহি গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে। প্রথমদিন একটু তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে এত তাড়াতাড়িই এসেছে যে সবার আগে এসে এখন একা বসে থাকতে হচ্ছে। উপমাকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলে নিহি। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকে নিহি। এত নিরব বাড়ি! কাউকে গুম করে রাখলেও কেউ টের পাবে না।

“খালা, ও খালা আমার খাবারটা ঘরে দিয়ে যান।”
বাম পাশের রুম থেকে বিকট শব্দে কথাগুলো ভেসে আসে ড্রয়িংরুমে। আরো কয়েকবার একই কথা বলে পুরুষালী কণ্ঠটি। নিহির এখন কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। রান্নাঘর থেকে পানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তার মানে মহিলাটি এখন রান্নাঘরেই আছে। এর মাঝেই সেই রুম থেকে গানের শব্দ পাওয়া যায়। একই তো তার কথা রান্নাঘর পর্যন্ত যাচ্ছে না তারমধ্যে আবার বক্সে গান ছেড়েছে। বিরক্ত হয়ে নিহি রান্নাঘরে যায়। মহিলাটি থালাবাসন মাজছে। এই অবস্থায় তো খাবারও দিতে পারবে না। টেবিলে তাকিয়ে দেখে খাবার বেড়ে রাখা আছে। মানবতার খাতিরে নিহি নিজেই খাবারের প্লেটটা নিয়ে যায়।

রুমের ভেতর গিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে আয়নার দিকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুল ঝাড়ছিল অনল। আয়নার মধ্যেই নিহিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে। এবার অনল নিজেই কনফিউজড। মনে মনে বলছে, ‘নিহি বাসায় আসবে কী করে? এটা বোধ হয় আমার হ্যালুসিনেশন।’ হ্যালুসিনেশন ভেবে দৃশ্যটাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যটা কিছুতেই অগোচরে যাচ্ছে না। বিরক্ত নিয়ে অনল নিহির দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করে নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি কি সত্যিই এসেছ?”
নিহি মাথা ঝাঁকিয়ে ঘোর থেকে বের হয়ে বলে,
“এ্যা?”
“এ্যা কী? হ্যাঁ বা না বলো। এমনিতেই কিন্তু তোমার ওপর আমার প্রচুর রাগ। কনফিউজড করে আরো রাগিয়ে দিও না আমায়।”

নিহি বড় বড় ঢোক গিলতে থাকে। মানবতার খাতিরে সাহায্য করতে গিয়ে এখন নিজেই ফেঁসে গেল। অনল যে অনামিকা ম্যামের ছেলে এবং বাড়িতে প্রাইভেট পড়তে আসলে যে তার সাথে দেখা হবে এটা ভুলেই গিয়েছিল নিহি। ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়’ বাক্যটি বোধ হয় এখনকার সময়ে নিহির জন্য একদম পার্ফেক্ট উদাহরণ। নিহির দিকে নেশাতুর দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসে অনল। নিহি তুতলিয়ে তুতলিয়ে বলে,
“আ..আপনার খাবার!”
অনল নিজের ঠোঁটেই আঙুল রেখে বলে,
“শসস! কোনো কথা কথা বলবে না।”

প্লেটটা পাশের টেবিলে রেখে নিহি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই দরজার পাশে হাত দিয়ে আটকে ফেলে নিহিকে। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিহি। অনল তার দু’হাত দেয়ালে রেখে আবদ্ধ করে রেখেছে নিহিকে। ভারী কণ্ঠে অনল বলে,
“এভাবে বার বার ঢোক গিলছ কেন? তোমার চিবুক ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার।”
“নাউজুবিল্লা।”
অনল মুচকি হেসে বলে,
“তোমার কথা শুনে, তোমায় দেখে আমার নেশা লেগে যাচ্ছে।”
“আগেই ভেবেছিলাম, আপনি একটা নেশাখোর।”
“হু, আমি নেশাখোর। শুধুমাত্র তোমার নেশায় মত্ত আমি।”
“আল্লাহ্ গো! পাগল হয়ে গেছে এই ছেলে।”
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কথার স্টাইল চেঞ্জ হয়ে যায় অনলের। রেগে রেগে বলে,
“ঐ ছেলেটা কে?”
“কোন ছেলেটা?”
“যার বাইকে করে গেছ।”
“যে খুশি সে হোক! আপনাকে বলব কেন?”
এক হাত দিয়ে অনল নিহির দু’গাল চেপে ধরে বলে,
“খবরদার! আমার সাথে রাগ দেখানোর চেষ্টা করবে না। ফার্দার যেন, আমি তোমাকে অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে না দেখি।”

“কী করছ?” জিজ্ঞেস করেন অনামিকা ম্যাম।
সঙ্গে সঙ্গে অনল নিহিকে ছেড়ে দেয়। ভয়ে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে…

চলবে…