আড়ালে আবডালে পর্ব-০৪

0
5260

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________

ড্রয়িংরুমে উপমাকে একা একা বসে থাকতে দেখে অনামিকা ম্যাম জিজ্ঞেস করেন, ‘কী করছ?’
অনামিকা ম্যামের কণ্ঠ শুনেই ভড়কে যায় নিহি আর অনল। লম্বা দম নিয়ে অনল বলে,
“বাব্বাহ্!”
নিহি অনলকে ধাক্কা দিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। ম্যাম ততক্ষণে নিজের রুমে গিয়েছে পোশাক পাল্টে নিতে। ধিরিম করে উপমার পাশে বসে লম্বা লম্বা শ্বাস নেয় নিহি। মনে হচ্ছে কলিজা লাফাচ্ছে। যদি ম্যাম দেখে নিত তাহলে কী কাণ্ডটাই না হয়ে যেত। ম্যামের গলা শুনে প্রথমে তো ভেবেছিল ওদেরকেই জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। উপমার গলার স্বর শুনে বুঝতে পারে, ম্যাম প্রশ্নটি উপমাকেই করেছিল। নিহিকে এভাবে হাঁপাতে দেখে উপমা প্রশ্ন করে,
“কোথায় ছিলে তুমি?”
“একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।” নিজেকে সামলে নিয়ে বলে নিহি। আস্তে আস্তে আরো কয়েকজন আসে প্রাইভেট পড়তে। অনলের দরজার মুখোমুখি সোফায় বসেছে নিহি। বারবার না চাইতেও চোখজোড়া ঐ দরজার দিকে আটকে যাচ্ছে। যখন পড়ায় মনোযোগ দিতে যাবে তখন নিহির মনে হলো দরজায় দাঁড়িয়ে অনল তাকিয়ে আছে। তড়িৎগতিতে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। নিজের মনে নিজেকেই গালি দেয় নিহি। পড়া মুখস্থ করতে গিয়ে আবারও দরজার দিকে চোখ চলে যায়। তখন অনল দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিতেই নিহি স্তব্ধ হয়ে যায়। জোরে জোরে শব্দ করে পড়ছিল বিধায় হঠাৎ থমকে যাওয়ায় ম্যাম নিহির দিকে তাকায়। নিহির চোখকে অনুসরণ করে অনলের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা ভিড়িয়ে রাখা। ম্যাম নিহির হাত ধরে বলে,
“কী হলো?”
নিহি চমকে গিয়ে বলে,
“কিছু ছিল!”
ম্যাম মৃদু হেসে বলে,
“কিছু ছিল মানে?”
“ইয়ে মানে মনের ভুল হয়তো!”
“আচ্ছা পড়ো।”

নিহির আর পড়ায় মন বসছে না। নিহি কি আসলেই ঠিক দেখল নাকি মনের ভুল ভেবেই পাচ্ছে না। মনের সন্দেহ দূর করার জন্য আরেকবার দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় অনল শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বেরিয়ে আসছে। ম্যামের উদ্দেশ্যে বলে,
“মা আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি।”
“এখন আবার কোথায় যাচ্ছ?” জিজ্ঞেস করে ম্যাম।
“একটু বাহির থেকে হেঁটে আসি।”
“আচ্ছা তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে এসো।”
“আচ্ছা।”
যাওয়ার সময় সকলের দৃষ্টির অগোচরে অনল চোখ মেরে যায় নিহিকে। চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি। নিহির মুখটা হা হয়ে যায়। চোখ পিটপিট করে মনে মনে বলে,
“শালা লুচ্চা!”
অনল চলে যাওয়ার পর সহজেই পড়ায় মনোযোগ বসে গেছে। প্রাইভেট পড়ে ভাইকে ফোন করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
.
বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের টম এন্ড জেরির ঝগড়া আবার দেখতে পায়। তাদেরকে না ঘাটিয়ে সরাসরি রুমে চলে যায় নিহি। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ক্লাস আর প্রাইভেটের পড়া কমপ্লিট করতে বসে। রাতের ডিনার সবাই একসাথেই করে। তাই পড়া বাকি রেখেই চলে যায় খেতে। নীলম নিহির উদ্দেশ্যে বলে,
“মিহি তোকে যেতে বলেছে। যাবি?”
“আপু কি অসুস্থ নাকি?” খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলে নিহি।
“না, অসুস্থ না। অনেকদিন নাকি দেখে না তোকে। তাই ঘুরে আসতে বলল। যাবি? যদি যাস তাহলে কলেজে ফোন করে ছুটি চেয়ে নিব।”

নিহি কিছুক্ষণ চুপচাপ খেতে খেতে ভাবে, শুরুতেই পড়াশোনার যেই চাপ! পরে তো মাথার ওপর পড়ার পাহাড় পড়ে যাবে। চাইলেও তখন যেখানে,সেখানে যাওয়া সম্ভব না। তারমধ্যে আরেক আপদ ঐ অনল পাজি ছেলেটা ঘাড়ে চেপে বসেছে। ওর জ্বালাতেই আরো কলেজে যেতে ইচ্ছে করে না। এই সুযোগে একটু আপুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। তাই খুশিমনেই উত্তর দিয়ে নিহি বলে,
“হ্যাঁ, যাব। মাহিরকেও দেখি না অনেকদিন হলো।”
“তাহলে কাল সকালেই চলে যা।”
“আচ্ছা।”
তিতির তখন বায়না করে বলে,
“ফুপির সাথে আমিও যাব। আমিও মাহির বাবুকে দেখব।”
নীলম হেসে বলে,
“পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা না?”
“না পাপা। আমি বাড়িতে ফিরে ঠিকমতো পড়ব।”
“সত্যি তো?”
“হ্যাঁ, সত্যি। প্রমিজ।”
“আমার লক্ষী মা।” আদর করে বলে নীলম।
.
.
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে ছাদে যায় নিহি। আবহাওয়া এখন তীব্র। সূর্যের তীব্র আলোয় শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে। তবুও ভালো লাগছে নিহির ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে। আকাশে গুটি কয়েক পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে। ছাদে কয়েকটা পেয়ারা গাছ, লেবু গাছ লাগানো আছে। গাছের ডালে পাতার ছায়ায় কয়েক জোড়া চড়ুইপাখি বসে আছে। কিছু পাখি কিচিরমিচির করতে করতে এক ডাল থেকে অন্য ডালে যাচ্ছে। মিহির বাসায় আসতে আসতে দুপুর বারোটা পার হয়েছে। দুপুরের খাবার খেয়েই ছাদে চলে এসেছে। কেন জানি এই বাড়ির ছাদটা নিহির খুব ভালো লাগে। মৃদু মৃদু রোদের আলোতে শরীরের উষ্ণতা বাড়ছে। রোদের মধ্যে কয়েকটা ছবি তুললে মন্দ হয় না। তখন তিতির দৌঁড়ে ছাদে আসে। তিতিরকে এভাবে আসতে দেখে নিহি জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
“ঐ আঙ্কেলটা আমায় বকবে!”
“কোন আঙ্কেলটা?”
“ঐযে ট্যারেসের ওখানে।”
“কার এত্ত বড় সাহস যে আমার ভাস্তিকে বকবে? চলো তো দেখি।”

নিহি তিতিরকে নিয়ে ফ্ল্যাটে যায়। ট্যারেসে গিয়ে বলে,
“কার কথা বললে?”
সম্মুখ ফ্ল্যাটের ব্যালকোনির দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে তিতির বলে,
“ঐযে ঐখানেই ছিল।”
নিহি গলার সাউন্ড বাড়িয়ে বলে,
“কে আছে ওখানে? কে বকা দিয়েছে?”
ব্যালকোনিতে একটা ছেলে আসতেই তিতির বলে,
“ঐযে সে।”
নিহি বাঘিনীর মতো ক্ষেপে বলে,
“আপনার সমস্যা কী হ্যাঁ?”

ছেলেটার হাতে একটা ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটা রোলের মতো করে নিয়ে দু’হাত ভাঁজ করে বলে,
“কীসের সমস্যা?”
“কীসের সমস্যা বুঝেন না, না? এতটুকু একটা বাচ্চাকে বকতে আপনার বুক কাঁপল না? আর কেনোই বা বকবেন আপনি ও’কে?”
“আপনি আমার কথাটা শুনুন।”
“ঘেচু কথা শুনব আপনার। কোন সাহসে আপনি আমার ভাস্তিকে বকেন? আপনার মুখ আমি সেলাই করে দেবো।”

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে রুম থেকে ট্যারেসে আসে মিহি। নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছিস কেন?”
“দেখো না আপু, এই ছেলেটা তিতিরকে বকেছে।”
মিহি ব্যালকোনির দিকে তাকিয়ে বলে,
“এনিথিং রং আমান?”
মুচকি হেসে আমান বলে,
“না, আপু। তেমন কিছু না। উনি কি আপনার ছোট বোন?”
“হ্যাঁ।”
নিহি চোখমুখ বড় করে বলে,
“কী ব্যাপার আপু? তুমি এই পাজী ছেলেটাকে চেনো?”
মিহি বলে,
“আহ্! আগেই চেঁচাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে বলবি তো?”
“আমি কী বলব? তুমি তিতিরের থেকেই শোনো।”
তিতির নিহির আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে আছে। এক হাতে নিহির ওড়না চেপে ধরেছে। মনে হচ্ছে এখানে তিতিরই অপরাধী। আমান আগের মতোই হেসে বলে,
“আমিই বলছি। আপনার ভাস্তি গুল্টি দিয়ে ইটের টুকরা ছুঁড়ে মেরেছে ঘরে। সেটা গিয়ে লেগেছে আমার পিঠে। কে মেরেছে তা জানতেই আমি যখন ব্যালকেনিতে আসি তখন তিতির দৌঁড়ে চলে যায়। হয়তো ভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল আমি বকব। কিছুক্ষণ পর আপনার বোন এসে কিছু না শুনেই আমায় রাগ দেখাচ্ছে।”

মিহি নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“শুনলি তো আসল কাহিনী? তুই শুধু শুধু এত রেগে যাস।
আর তিতির, তুমি গুল্টি দিয়ে ইট মেরেছ কেন? যদি কিছু হতো?”
তিতির ভয়ে তটস্থ হয়ে বলে,
“আমি তাকে মারতে চাইনি ফুপি। ওখানে একটা পাখি ছিল তখন। আমি পাখিটাকে মারতে চেয়েছিলাম।”
“খুবই অন্যায় কাজ এটা। তাকে স্যরি বলো।”
তিতির আমানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“স্যরি আঙ্কেল।”
“ইট’স ওকে বেবী।”

মাহিরের কান্নার শব্দ পেয়ে মিহি চলে যায়। এতক্ষণে নিহিও বুঝতে পারে আসল কাহিনী। অতিরিক্ত আদর দিয়ে ভাস্তিকে মাথায় তোলার ফল ভোগ করছে এখন। অযথাই সব না শুনে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে কোনো লাভ হলো? উল্টো এই লোকটার কাছে এখন ছোট হতে হলো। ইশ! সেটা তো আর বুঝতে দেওয়া যাবে না তাকে। নিহি গাল ফুলিয়েই তিতিরকে বলে,
“চলো এখান থেকে।”
নিহির মনোযোগ পেতে আমান গলা খাঁকারি দেয়। নিহি ভ্রু বাঁকিয়ে আমানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“যক্ষ্মা হয়েছে নাকি?”
আমান হেসে ফেলে নিহির কথা শুনে। হেসেই বলে,
“এত রগচটা স্বভাব ভালো নয় ম্যাম।”
“সেটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। নিজের চড়কায় তেল দেন।”

—————————————

কলেজ গেইটের মাঠে বাইকের ওপর বসে আছে অনল। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে ওর বাকি বন্ধুরা। অনলকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে অস্থির হয়ে আছে কোনোকিছু নিয়ে। আজ চারদিন হয়ে গেছে নিহি কলেজে আসে না আর প্রাইভেট পড়তে বাড়িতেও যায় না। ইগোর কারণে কাউকে নিহির কথা জিজ্ঞেসও করা যায় না। অনলকে মন মরা হয়ে বসে থাকতে দেখে সাকিব বলে,
“চল দোস্ত আজকে সিনেমা দেখে আসি।”
“না, রে। ভালো লাগছে না।”
সুমাইয়া বলে,
“সত্যি করে বল তো ভাই, তুই প্রেমে পড়েছিস নাকি?”
“কী আজগুবি কথা বলছিস? মানুষের কি মন খারাপ থাকতে পারে না?”
“পারে। কিন্তু কোনো একটা কারণ তো থাকে।”
“কোনো কারণ নেই।”
“অদ্ভুত তুই!”
“হ্যাঁ, তাই-ই।”

বেশিক্ষণ কলেজে না থেকে বাড়িতে চলে যায় অনল। ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দেয়। একমাত্র ঘুমই সব চিন্তাভাবনা থেকে দূরে রাখতে পারে। নিহির এমন লাপাত্তা হওয়ার বিষয়টি ভাবাচ্ছে অনলকে। এমন কী হলো যে কলেজ, প্রাইভেট কোনোটাতেই আসে না! খোঁজ করতে হবে মেয়েটার।
.
.
সন্ধ্যার দিকে মিহির হাজবেন্ড সৈকত বাড়িতে আসে। নিহি তখন ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল। সৈকত জুতো খুলতে খুলতে বলে,
“শালীকা কী করে?”
“নাচে।”
“বসে বসে নাচা যায় নাকি?”
“দেখতেছেন যে টিভি দেখতেছি তাও কেন জিজ্ঞেস করেন?”
“আজকেও কি ঝগড়া লাগছে আমানের সঙ্গে?” মুখ টেপে হেসে বলে সৈকত। সেদিন মিহির কাছে ঝগড়ার কথা শুনে এখন প্রায়ই নিহিকে ক্ষেপায় আমানের কথা বলে। নিহিও বুঝতে পারে সৈকত যে ক্ষেপানোর জন্যই বলে তবুও নিহি ক্ষেপে যায়। দাঁত কটমট করে বলে,
“উনি কে? উনার সঙ্গে কি আমি প্রতিদিন ঝগড়া করার জন্য বসে থাকি?”

নিহির রাগ দেখে সৈকত হো হো করে হাসা শুরু করে। এতে নিহি আরো ক্ষেপে যায়। মিহিকে ডেকে বলে,
“আপু তুমি কি দুলাভাইরে কিছু বলবা? নাকি আমিই মেরে ভূত বানাব?”
মিহি সৈকতকে মেকি ধমক দিয়ে বলে,
“অফিস থেকে এসেই আমার বোনের পিছে লেগেছ? যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।”
“যাচ্ছি। আচ্ছা শোনো, সন্ধ্যার নাস্তা বেশি করে বানিওতো।”
“কেন?”
“পরে বলব।”
সৈকতের কথামতো মিহি বেশি করেই সন্ধ্যার নাস্তা বানায়। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে নিহি যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে আমানকে দেখে বলে,
“কী চাই?”
ড্রয়িংরুম থেকে সৈকত বলে,
“আমিই ডেকেছি। আসতে দাও।”

নিহি সরে দাঁড়ায় আমানকে যাওয়ার জায়গা দিয়ে। সৈকত লুডু নিয়ে এসে বলে,
“আজকে সবাই মিলে লুডু খেলব। তাই আমানকে আসতে বলেছি।”
নিহি বেঁকিয়ে গিয়ে বলে,
“আমি লুডু খেলব না। আপনারা খেলেন।”
সৈকত দাঁত কেলিয়ে বলে,
“বুঝলে আমান, আমার শালীকা হেরে যাওয়ার ভয়ে এখন লুডু খেলবেই না।”
“দুলাভাই ভাব নিয়েন না। যতবার লুডু খেলছি আপনার সঙ্গে আপনি হেরে গেছেন। আর আজকে বলতেছেন আমি হেরে যাওয়ার ভয় পাই?”
“আচ্ছা তাহলে আজকে খেলো। জোড়ায় জোড়ায় খেলব। তুমি আর তোমার বোন এক দলে। আমি আর আমান এক দলে। সাহস থাকলে আজকে খেলো।”
“আপনি কি আমায় চ্যালেঞ্জ করতেছেন?”
“হ্যাঁ, করতেছি।”
“ওকে, ঠিকাছে তাহলে।”

খেলা শুরু হওয়ার পর আমান আর সৈকতের গুটি আগে ওঠে। তা দেখে সৈকতের খুশি দেখে কে! সৈকতের গুটি যখন নিহির কোটে আসে তখন নিহির দুই ছয় পাঁচ ওঠে। এক ছয় পাঁচে সৈকতের গুটি খেতে গেলে সৈকত বলে,
“আমার গুটি চারের ঘরে ছিল। আমি ভুলে পাঁচের ঘরে দিয়ে ছিলাম।”
নিহি ক্ষেপে গিয়ে বলে,
“কাইট্টামি করবেন না কিন্তু দুলাভাই। আপু কিছু বলো না কেন?”
“কী বলব? ও এরকম কাইট্টামি করে বলেই আমি খেলতে চাই না।”
আমান হেসে বলে,
“আরে ভাই একটা গুটিই তো।”
সৈকত ভাব নিয়ে বলে,
“শুধু তুমি বললা বলে কিছু বললাম না।”
“হইছে ঢং কম করেন।” ভেংচি কেটে বলে নিহি।
ফোনের রিংটোনে খেলার মনোযোগ নষ্ট হয় সবার। আমানের ফোনটা নিহির পাশেই ছিল। ফোনের স্ক্রিনে ফেসে ওঠে ‘জান’ লেখা। তৎক্ষণাৎটা ফোনটা রিসিভ করে আমান একটু দূরে গিয়ে কথা বলে। সৈকত লুডুর দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে যাতে কেউ দুই নাম্বারি করতে না পারতে। অথচ সবার মধ্যে সে একাই চোরামি করে। আমান কথা শেষ করে এসে যখন বসে তখন নিহি বিড়বিড় করে বলে,
“মানুষের যে কত জান, কলিজা, অক্সিজেন, ফুসফুস আল্লাহ্ জানে!”

আমান নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“এক্সকিউজ মি ম্যাম! তাকে নিয়ে কিছু না বললেই খুশি হব।”
“কিছু বলতেও চাই না। আপনার চাল এখন। খেলেন।”
অবশেষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে নিহি আর মিহিই জিতে। সৈকতের মুখটা তখন দেখার মতো। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে সৈকত আমানকে বলে,
“ধুর! যদি প্রথম গুটিটা তোমার কথামতো খেতে না দিতাম তাইলে আমরাই জয়ী হতাম।”
নিহি খিলখিল করে হেসে বলে,
“একেই বলে শান্তনা বাণী।”

রাতে এখানেই ডিনার করে আমান চলে যায়। তিতির আর নিহি এক রুমে যায় ঘুমাতে। উপমা তখন ফোন দিয়ে বলে,
“কী ব্যাপার কেমন আছো?”
নিহি বালিশ ঠিক করে শুয়ে বলে,
“ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“ভালোই। জানো আজকে কী হইছে?”
“না বললে জানব কীভাবে?”
“প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পর অনল ভাইয়া তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে।”

নিহি এবার নড়েচড়ে শোয়। জিজ্ঞেস করে,
“কী বলেছে?”
“বলেছে তুমি কলেজে আসো না কেন, প্রাইভেটে আসো না কেন।”
“তুমি বলে দিছ আমি যে আপুর বাসায়?”
“না, তার আগেই ম্যাম চলে আসছে। পরে আর দেখাও হয়নি।”
“ওহ। শুনো, আবার জিজ্ঞেস করলে বলবা না একদম।”
“আচ্ছা। কিন্তু কেন?”
“এমনিতেই তার জ্বালায় বাঁচি না। তাছাড়া আমি আসি বা না আসি তাতে তার কী?”
“আমার কী মনে হয় জানো?”
“কী?”
“সে মনে হয় তোমাকে পছন্দ করে।”
“সবই লোক দেখানো।”
“সত্যিইও তো হতে পারে।”
“না, সত্যি না। তাছাড়া সে না তোমার ক্রাশ? ক্রাশ তোমারই বান্ধবীকে পছন্দ করে এটা বলতে কষ্ট হচ্ছে না?”
“না তো! তবে একটু হিংসে হচ্ছে।”

নিহি শব্দ করে হেসে ফেলে। আর কিছুক্ষণ উপমার সঙ্গে কথা বলে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
.
সকাল ১০ টার দিকে নিহির ঘুম ভাঙে তাও মাহিরের জন্য। মিহি মাহিরকে নিহির পাশে বসিয়ে দিয়েছে। এক বছরের ছোট্ট মাহির তার ছোট ছোট আঙুল নিহির নাকের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। নিহির চুল টানছে, গাল টানছে, কামড় দিচ্ছে। বেশিক্ষণ আর শুয়ে থাকতে পারল না। চোখ মেলে তাকাতেই মাহির শব্দ করে হেসে উঠল যেন তার উদেশ্যই ছিল নিহিকে ঘুম থেকে জাগানো আর সে তার কাজে সফলও হয়েছে। মাহিরকে হাসতে দেখে নিহিও হেসে ফেলে। মাহিরকে চুমু খেয়ে পেটের ওপর বসিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে। মাহির বুঝে না বুঝেই খিলখিল করে হাসে। নিহি মাহিরের মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলে,
“আমার গুলুগুলু বাবা!”

মিহি মাহিরকে কোলে নিয়ে নিহিকে তাড়া দেয় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। দশটা পার হয়ে গেছে এখনো বিছানাই ছাড়েনি মেয়ে। গোসল করে এসে সকালের খাবার খেয়ে নেয়। তিতির বায়না করেছে দোকানে যাবে। সৈকত সকালেই অফিসে চলে গেছে। তাই নিহিই তিতিরকে নিয়ে দোকানে যাওয়ার জন্য বের হয়। নিচ তলায় এসে গেট থেকে বের হয়েই মুখোমুখি হয় অনলের। নিহির থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে অনলকে দেখে নিহি হতভম্ব হয়ে যায়। অনল গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিহির দিকে। নিহিকে অবাক করে দিয়েই লোক সমাগমে অনল নিহিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমায় না বলে চলে এসেছ কেন? জানো তোমায় কত খুঁজেছি আমি?”

অনলের এহেন কাণ্ডে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় নিহি। কথা বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে।বুকের ভেতর হাতুরী পেটানোর ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। মাটি যেন নিহির পা দুটো আকঁড়ে ধরেছে। পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এ কেমন শিহরণ! ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে নিহি। মানুষ কী ভাবছে। ছিঃ!
তিতির অনলের হাত ধরে টেনে বলে,
“এই পঁচা ছেলে আমার ফুপিকে ছাড়ো। নয়তো কিন্তু কামড়ে দেবো।”

চলবে…