আড়ালে আবডালে পর্ব-০৫

0
5460

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________

তিতিরের কথা শুনে ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করে নিহিকে ছেড়ে দেয় অনল। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে নিহির দিকে তাকায়। নিহির মুখটা তখন ভয়ে ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। নিহি ট্যারেস আর মিহিদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে দেখল কোথাও মিহি আছে নাকি। মিহিকে না দেখতে পেয়ে গোপনে একটা লম্বা শ্বাস নিল নিহি। ততক্ষণে অনল তিতিরের সাথে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসেছে। তিতিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,
“তোমার ফুপি পঁচা। আমি না।”
তিতির নাক ফুলিয়ে বলে,
“খবরদার। আমার ফুপিকে তুমি পঁচা বলবে না। আমার ফুপি কি তোমায় জড়িয়ে ধরেছে? ধরেনি তো। তুমি ধরেছ। তুমি পঁচা।”
“জড়িয়ে ধরলেই বুঝি পঁচা হয়ে যায় কেউ? আচ্ছা তুমি তোমার ফুপিকে জড়িয়ে ধরো না?”
“ধরি তো!”
“তাহলে তো তুমিও পঁচা।”
এই পর্যায়ে তিতির কিছুক্ষণ থম মেরে রইল। অনল উত্তরের আশায় তিতিরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে তার দুষ্টুমি হাসি। কিন্তু তিতিরও দমে যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। দুই কোমরে হাত রেখে বলে,
“আমি কেন পঁচা হব? আমি তো ফুপিকে ভালোবাসি। তাই জড়িয়ে ধরি।”

তিতিরের কথার ভাবভঙ্গি আর কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে অনল হেসে ফেলে। তিতিরের গাল টেনে দিয়ে বলে,
“আমিও তো তোমার ফুপিকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছি।”
“তাহলে কি তুমি আমার ফুপিকে ভালোবাসো?”
রাগে কান দিয়ে মনে হচ্ছে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে নিহির। বাচ্চাদের সঙ্গে এগুলো কী ধরণের কথাবার্তা। আর একবার যদি তিতির মুখ ফসকে এই কথা বাড়ির কাউকে বলে দিয়েছে তো কেল্লাফতে। মেজাজ চওড়া হয়ে যাচ্ছে নিহির। তিতিরকে এক টানে অনলের সামনে থেকে সরিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলে,
“মিনিমাম কমনসেন্সও কি নেই? বাচ্চার সঙ্গে এগুলো কী বলছেন?”

অনল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“কেন? খারাপ কী বলেছি? আমি শুধু ওর ভুল ধারণাটা ভাঙাচ্ছিলাম। বাচ্চাদের মনের ভুল না ভাঙালে বড় হলেও এসব ভুল ধারণা থেকে যাবে।”
“তিতির একদম ভুল ভাবেনি। ও ঠিকই ধরেছে। আপনি একটা পঁচা, বাজে লোক।”
“এতক্ষণে বুঝলাম তিতির এমন পাকনা কথা কীভাবে শিখেছে।”
নিহি কপাল কুঁচকে বলে,
“মানে?”
“মানে এই যে, তোমার ভাস্তি তোমার মতোই হয়েছে। একদম তোমার ডুপ্লিকেট।”
“আপনার ফালতু আলাপ শুনতে ইচ্ছুক নই আমি। এখানে কেন এসেছেন আপনি? আর কথা নেই, বার্তা নেই এরকম পাবলিক প্লেসে জড়িয়ে ধরেছেন কেন?”
“আহম্মকের মতো প্রশ্ন করছ কেন?”

নিহি দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমি আহম্মক?”
“তা নয়তো কী? তোমার কথায় মনে হচ্ছে আগে থেকে সময়, সুযোগ, জায়গা নির্ধারণ করে তারপর জড়িয়ে ধরা উচিত ছিল। আরে, আমি কি শখে জড়িয়ে ধরেছি নাকি? এতদিন পর তোমায় দেখে হুট করে আমার কী জানি হয়ে গেল। কত কষ্টে তোমায় খুঁজে বের করেছি জানো না!”
“খোঁজার কী আছে? আমি কি হারিয়ে গেছি? এসেছি তো আপুর বাসায়। বাই দ্যা ওয়ে, আপনি ঠিকানা পেলেন কোথায়?”
“সেটা জানা কি খুব জরুরী?”
“অবশ্যই।”
অনল নিহির দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলে,
“বলব না।”

নিহি দু’পা পিছিয়ে যায়। অনল সানগ্লাস চোখে দিতে দিতে বলে,
“কালকে যেন কলেজে তোমায় দেখতে পাই। কালও যদি তুমি কলেজে না আসো তাহলে ডিরেক্ট বাড়ির ভেতর চলে যাব।”
“হুমকি দিচ্ছেন?”
“হ্যাঁ, দিচ্ছি। আর যেটা বলেছি সেটা করেই ছাড়ব যদি কাল তুমি কলেজে না আসো।”

নিহিকে আর কিছু বলতে না দিয়েই অনল চলে যায়। রাগে মাথার রগ দপদপ করে কাঁপছে। যেদিন খুশি সেদিন কলেজে যাব। নাকি সারাজীবন কলেজে যাব না সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুই নাক গলানোর কে রে? তোর কথা আমার কেন শুনতে হবে উল্লুক? হ্যাঁ, শুনতে হবে। তোকে দিয়ে তো আবার বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে সত্যিই পরে বাড়ির ভেতর চলে এসেছিস। ড্যাম ইট! কিন্তু ঠিকানা পেল টা কোথায়? উপমা বলেছে?
“ও ফুপি যাবে না?” তিতিরের কথায় ভাবনায় ছেদ পরে নিহির। মৃদু হেসে বলে, “হ্যাঁ, যাব।” দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“তিতির সোনা, এখন যা হলো বাড়িতে কাউকে কিন্তু কিছু বোলো না।”
“আচ্ছা। কিন্তু ঐ পঁচা লোকটা কে?”
“চিনবে না তুমি। বলো কী খাবে?”
“চিপস্ খাব।”

তিতিরের জন্য চিপস্ ও আরো কিছু খাবার নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে এসেই চলে যাওয়ার কথা বলে মিহিকে। এক সপ্তাহর আগে কিছুতেই যেতে দিতে রাজি নয় মিহি। কিন্তু নিহি তো জানে যে কোন আপদের পাল্লায় পড়েছে। কাল কলেজে না গেলে একদম সাড়ে সর্বনাশ করে ছাড়বে। মিহিকে যখন রাজি করানো গেল না তখন নিহি সৈকতকে ফোন করে। কান্নাকাটি করে ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইল করে। পড়াশোনার এক্সকিউজ দেখিয়ে অনেক কষ্টে রাজি করায়। দুপুরে লাঞ্চ করতে এসে সৈকতই মিহিকে রাজি করিয়েছে। তবে মিহি শর্ত দিয়ে দিয়েছে পরেরবার আসলে পনেরো দিনের আগে আর যেতে দেবে না। নিহি তাতেই রাজি হয়েছে। আগে বাড়িতে ফেরা দিয়ে হলো কথা। বাকিটা পরে দেখা যাবে। দুপুরে সবাই একসাথে লাঞ্চ করে সৈকত নিহি আর তিতিরকে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়।
.
.
দিগন্ত নীল আকাশে মাঝে মাঝে শুভ্রের ছোঁয়া। আকাশজুড়ে বিচরণ করছে নাম না জানা অসংখ্য পাখি। পাখিদের এই একটা দিক অনেক বেশিই ভালো লাগে। ওরা যেখানেই যাক না কেন ঝাঁক ধরে যাবে। আবার ওদের মতো পিঁপড়েকেও নিহির ভালো লাগে। পিঁপড়েরাও যখন সাড়ি ধরে যায় তখন মনে হয় সবসচেয়ে সুন্দর দৃশ্য সেটাই। ওদের একা একা খুব কমই দেখা যায়। ক্লাসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশের সৌন্দর্যে বিমোহিত হচ্ছিল নিহি। উপমা আজ আসবে না। সকাল থেকেই নাকি মাথা ব্যথা। মেয়েটা অসুস্থ হওয়ার আর সময় পেল না। আজই হতে হলো? ক্লাসের সব মেয়ের সাথেই কমবেশি কথাবার্তা হয় নিহির। তবে উপমার মতো নয়। কেন জানি, উপমাকে সব বলা যায়। উপমার সঙ্গ নিহির ভালো লাগে। তেমনি উপমাও খুব বেশি পছন্দ করে নিহিকে। উপমার নামের সাথে ওর অনেকটা মিল আছে। ওর সৌন্দর্যের উপমা ও নিজেই। সেই সঙ্গে ধৈর্যশীলও বটে। দুই বান্ধবীর মধ্যে একজন বদমেজাজি, রাগী হলে অপরজনকে হতে হয় শান্তশিষ্ট। সেই শান্তশিষ্টের উদাহরণ হচ্ছে উপমা। আর অপরদিকে রাগী, বদমেজাজি মেয়েটা হলো নিহি। উপমাকে নিয়ে গবেষণার এই পর্যায়ে ক্লাসের এক ছেলে নিহির সামনে এসে বলে,
“এই।”

নীল-শুভ্রের গগনে পাখিদের আনাগোনার দৃশ্য বিচ্ছিন্ন করে নিহি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তাকায়। কিন্তু তাকদির ভারী অসহায়। একই ক্লাসে পড়েও নিহি ক্লাসের কোনো ছেলেকেই এখনো চেনে না। যেখানে অনেক মেয়ের সাথে ক্লাসের অধিকাংশ ছেলের বন্ধুত্ব হয়েছে, পরিচয় হয়েছে। কেউ তো আবার আরো ধাপ এগিয়ে। মানে তারা রিলেশনে।
নিহি মৃদু হেসে বলে,
“জি?”
“পরিচিত হতে পারি?”
“শিওর।”
“ক্লাসে অনেক হট্টগোল। চলো বারান্দায় দাঁড়াই।”
নিহির ইচ্ছেই করছে না উঠতে। কিন্তু এভাবে রিফিউজও করা যাচ্ছে না। পরক্ষণেই মনে হলো একটু লাইব্রেরীতে যাওয়া দরকার ছিল। উপমা নেই বলে একা একা কলেজ ক্যাম্পাসে হাঁটতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না। এখন না হয় একেই নিয়ে যাওয়া যাক! নিজের বুদ্ধিতে নিজেই ফিদা নিহি। চওড়া হাসি দিয়ে বলে,
“বারান্দায় না। আমি একটু লাইব্রেরীতে যাব। যাবেন?”
“শিওর।”

কথা বলতে বলতে দুজনে বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লাইব্রেরীটা ভার্সিটি ক্যাম্পাসে। তার মানে অনলের সঙ্গে দেখা হওয়ার চান্স আছে। উপমা আসবে না শুনে নিহি সময়ের আগেই কলেজে চলে এসেছে যাতে আসার সময় মাঠে অনলের সঙ্গে দেখা না হয়। নিহিকে চুপচাপ থাকতে দেখে ছেলেটি প্রশ্ন করে,
“তুমি কি এরকমই চুপচাপ? ক্লাসেও দেখলাম চুপ করে বসে আছো। তাই নিজে থেকেই কথা বলেছি।”
“না, তেমন কিছু না।” ছোট করেই বলে নিহি।
“ওহ আচ্ছা। আমি দ্বীপ্ত বড়ুয়া। তুমি?”
“নিহি ইসলাম।”
“আনকমন নাম। কিন্তু সুন্দর।”
“আপনার নামও সুন্দর।”
“আমরা তো সেম ক্লাস। আপনি না বলে তুমি বা তুই বললেই খুশি হব।”

নিহি হেসে বলে,
“বাবারে! তুমি হলেও ঠিক আছে। কিন্তু তুই? এক লাফে আগেই এতদূর এগোতে পারব না। আমি তো এখনো উপমাকেই তুই বলতে পারি না।”
নিহির হাসিতে দ্বীপ্তও যোগ দেয়। ততক্ষণে দুজনে নিচতলায় লাইব্রেরীর দিকে চলে এসেছে। মাঠে বসেই নিহিকে দেখতে পায় অনল। সঙ্গে পাগল করার মতো হাসি নিহির। হাতের ফোনটা নাড়াতে নাড়াতে অনল মিলনকে প্রশ্ন করে,
“নিহির সাথে ঐ ছেলেটা কে রে?”

মিলন সেদিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি কেমনে কমু মামা? তুই যেখানে আমিও তো সেখানে।”
মিলনের কথা শুনে অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে তাকায় অনল। অনলের চাহনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে উত্তর মনমতো হয়নি। মিলন আমতা আমতা করে বলে,
“ঠিকাছে, ব্যাপার না। জানিনা কিন্তু জানতে কতক্ষণ? আমি এখনই গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসতেছি।”
“তোর কিছু জিজ্ঞেস করা লাগবে না। দুজনকেই এখানে আসতে বল।”
“ঠিকাছে।”
“শোন, নিহি যদি আসতে না চায় তাহলে ছেলেটাকে একাই আসতে বলবি।”

মিলন চলে যাওয়ার পর সুমাইয়া বিড়বিড় করে লিসাকে বলে,
“এই পোলায় নির্ঘাত নিহির প্রেমে পড়ছে।”
লিসা কিছু বলে না। নির্বাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে।
দীপ্ত আর নিহি লাইব্রেরীতে আছে। নিহি বই ঘাটছে আর দীপ্ত পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। দারুণ মিশুক ছেলেটা। মনটাও ফ্রেশ তা ওর কথা বলেই বুঝা যায়। মিলন লাইব্রেরীতে এসে বলে,
“নিহি তোমায় অনল ডাকে।”

নিহি বই থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”
“জানি না।”
নিহি উত্তরে বলে,
“এখন যেতে পারব না।”
“আচ্ছা তুমি পড়ো তাহলে।”
তারপর দীপ্তর দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি আসো।”
এবার নিহি চোখ বড় বড় করে তাকায়। অনল দীপ্তকে কেন ডেকেছে? দীপ্তর সাথে ওর কী কথা থাকতে পারে? তাহলে কি নিহির সঙ্গে দীপ্তকে কথা বলতে দেখেছে বলেই ডেকেছে? যদি তাই হয় তাহলে তো অনল এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না দীপ্তকে। নিহি বেঁকিয়ে গিয়ে বলে,
“দীপ্তও যাবে না।”
“আচ্ছা ঘাড়ত্যাড়া মাইয়া তো তুমি!”
“হ্যাঁ, তাই-ই। আমরা কেউ যাব না।”
“আচ্ছা শুনে আসি কী বলে? গেলে সমস্যা কী?” জিজ্ঞেস করে দীপ্ত। নিহি দীপ্তকে ধমক দিয়ে বলে,
“চুপ। তোমায় এত কথা বলতে বলছি আমি? আমি যখন না করেছি, তখন তুমিও যাবে না।”

মিলন বিরক্ত হয়ে বলে,
“ঠিকাছে আমি তাহলে অনলকেই পাঠাচ্ছি।”
মিলন ফিরে গিয়ে অনলকে সব বলে। নিহির ওপর রাগ হয় অনলের। সব সময় ঘাড়ত্যাড়ামি করার কোনো মানে হয়? সুমাইয়া বলে,
“আচ্ছা ভাই কী সমস্যা আমায় বল তো? ওদের ক্যান ডাকতেছিস?”
অনল নিশ্চুপ। লিসা বলে,
“তুমি কি জেলাস ফিল করছ অনল? নিহি যার সঙ্গে ইচ্ছে কথা বলুক। তাতে তোমার কী?”
অনল লিসার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়,
“আমার অনেককিছু।”
“তুমি একটু বেশিই করতেছ না?”
অনল আর কোনো উত্তর না দিয়ে লাইব্রেরীতে যায়। সাথে মিলন আর সাকিবও আসে। লাইব্রেরীতে গিয়ে অনল নিহিকে বলে,
“ডেকেছি আসোনি কেন?”
“ব্যস্ত আছি তাই।” নিহির সোজাসাপ্টা উত্তর। অনলের রাগ বেড়ে যাচ্ছে। তবুও নিজেকে কন্ট্রোল রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। অনল এবার দীপ্তকে প্রশ্ন করে,
“তুমি আসোনি কেন?”
দীপ্তর উত্তর নিহি দিয়ে বলে,
“আমিই যেতে দেইনি।”

অনল আর রাগ কন্ট্রোলে রাখতে পারে না। নিহিকে জোরে ধমক দিয়ে বলে,
“আমি তোমায় প্রশ্ন করেছি? তুমি কেন উত্তর দিচ্ছ?”
অনলের ধমকে নিহি কেঁপে ওঠে। অনল আবারও ধমক দিয়ে বলে,
“আমি যাকে যেই প্রশ্ন করব শুধু সেই উত্তর দেবে। বাড়তি কথা আমার পছন্দ না।”
নিহি এই মানুষটাকে বুঝতে পারে না। কখনো ভালোবাসায় টইটুম্বুর তো কখনো রেগে বম। অনল দীপ্তকে বলে,
“নাম কী তোমার? নিহির সাথে কী সম্পর্ক?”
অনলের হুট করে করা এমন প্রশ্নে চমকে যায় দীপ্ত। আজই তো প্রথম কথা হলো এরমধ্যে আবার কীসের সম্পর্ক হতে পারে? দীপ্তকে চুপ থাকতে দেখে অনল দীপ্তকেও ধমক দেয়। ধমক খেয়ে দীপ্ত বলে,
“আমি দীপ্ত। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। আর আজই প্রথম কথা হলো। তেমন কোনো সম্পর্ক নেই আমার মাঝে।”
“গুড। তেমন কোনো সম্পর্ক যেন নাও হয়। নিহির সাথে কথা বলবে লিমিট রেখে। আর খেয়াল রাখবে ক্লাসের অন্য ছেলেরা যেন নিহির ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা না করে। এমনকিছু দেখলেই সরাসরি আমায় জানাবে। এটা তোমার দায়িত্ব। মনে থাকবে?”
“জি ভাইয়া।”
“এবার তুমি যাও।”

দীপ্ত একবার নিহির দিকে তাকিয়ে চলে যায়। অনল সাকিব আর মিলনকে বলে,
“তোরাও যা।”
বিনাবাক্যে ওরাও দীপ্তর সঙ্গে বাইরে চলে যায়। নিহি চুপ করে সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে। নিহির হাতের বইটা নিয়ে অনল বলে,
“কী বই পড়ছ দেখি?”
নিহি তবুও কিছু বলে না। অনল বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে,
“ভেবো না তোমায় এমনি এমনি ছেড়ে দেবো। তোমায়ও যেন না দেখি কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলতে। এমনকি ঐ দীপ্তর সঙ্গেও নয়। ঐ দীপ্ত ছেলেটা কি হিন্দু? দেখে তো তাই মনে হলো। চোখ দুটো চাকমাদের মতো। সে যাই হোক বা ও যেই ধর্মের হোক তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই কিন্তু…কিন্তু তোমাকে যেন দেখি না আর কথা বলতে।”

নিহির এমন ধরাবাঁধা নিয়ম বাড়িতেও নেই। অনলের এমন টর্চারে রীতিমতো বিরক্ত নিহি। এতদিন মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা সব রাগগুলো ঝেড়ে দিয়ে বলে,
“আমি কার সঙ্গে কথা বলব,কার সঙ্গে কথা বলব না সেটা কি আপনি ঠিক করে দেবেন? কে আপনি? কে হন আমার? না, আপনি আমার কিছু! আর না আমি আপনার কিছু। আপনার কেনা প্রোপার্টি নই আমি। আপনি ছেলে হয়ে যদি আপনার মেয়ে বন্ধু থাকতে পারে তাহলে আমি মেয়ে হয়ে আমার ছেলে বন্ধু কেন থাকতে পারবে না? আমি যার সাথেই কথা বলব আপনি তাকেই থ্রেড করবেন। কেন? আমার কোনো স্বাধীনতা নেই? আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার দিয়েছি আমি আপনাকে? দেইনি তো। তাহলে কেন? কেন করছেন এগুলো?”

হাতের বইটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় অনল। ডান হাতে নিহির দু’গাল চেপে ধরে বলে,
“কেন, কেন আর কেন! জানতে চাও কারণ? কারণ এটাই যে আমি তোমায় ভালোবাসি। ভালোবেসে ফেলেছি আমি। প্রথমদিনই খোলাচুলে দেখে আমার কী যেন হয়ে গিয়েছিল। পরেরদিন তোমায় শাড়ি পরা দেখে আমি নিজের মাঝেই ছিলাম না। এরপর তোমার প্রতিবাদ, তোমার সাহস, তোমার হাসি, তোমার কথাবার্তা সবকিছু সবকিছুই আমায় মুগ্ধ করেছে। তোমার অনুপস্থিতি আমায় ভাবিয়েছে। আমায় ঘুমাতে দেয়নি। হন্যে হয়ে এই দু’চোখ শুধু তোমাকেই খুঁজেছে। আমি সহ্য করতে পারি না অন্য কারো সঙ্গে তোমাকে। মাথা ঠিক রাখতে পারি না আমি। এই কয়েকদিনে তোমায় এত ভালোবেসে ফেলেছি যা এত বছরেও অন্য কোনো মেয়েকে বাসতে পারিনি। আর কীভাবে বোঝাব বলো? আর কীভাবে বোঝাব কতটা ভালোবাসি?”

কথাগুলো বলতে বলতে অনলের চোখে পানি চলে আসে। নিহির গাল ছেড়ে দিয়ে চলে যায় অনল। যাওয়ার আগে বইটা তুলে সালাম করে টেবিলের ওপর রেখে দেয়। অনুতপ্ত হয়। রাগের মাথায় বইটা ছুঁড়ে ফেলা উচিত হয়নি। নিহি অশ্রুশিক্ত চোখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঘণ্টার আওয়াজ শুনে চোখ মুছে লাইব্রেরী থেকে বের হয়। মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখে অনল চুপ করে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে। আর বন্ধুরা ও’কে ঘিরে কথা বলছে। সেদিন সারাদিন নিহির কোনো ক্লাসেই মন বসল না। বারবার শুধু অনলের বলা প্রতিটা কথা প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বেজেছে।
কলেজ ছুটির পর বারান্দা থেকে মাঠের দিকে তাকিয়ে অনলকে খোঁজে। মাঠে থাকলে সবসময় ঐ গাছটার নিচেই বসে থাকে। কিন্তু জায়গাটা ফাঁকা। হয়তো চলে গেছে। নিচে নেমেও কোথাও দেখা গেল না অনলকে। বিকেলে প্রাইভেট পড়তে গিয়েও অনলের রুমের দরজা বন্ধ পাওয়া গেল। যতক্ষণ ম্যাম প্রাইভেট পড়িয়েছে একটাবারও রুম থেকে অনল বের হয়নি। অনলের এমন লুকিয়ে থাকাটাই যেন নিহিকে আরো বেশি অস্থির করে তুলছে। একটাবার অনলকে দেখার জন্য পাগল করে ফেলছে। অথচ অনল লুকিয়ে আছে নিহির থেকে। বাড়িতে ফিরেও এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি পায়নি নিহি। তিতিরের সাথে কার্টুন দেখার সময়ও নিহি অমনোযোগী ছিল। অন্যসময় হলে তিতিরের সঙ্গে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা হতো। কিন্তু আজ সময়টা ভিন্ন। বাবা-মায়ের ঝগড়ার মাঝেও নিহিকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেছে। যেন নিহি আর এই জগতে নেই। পৃথিবীর সমস্ত ভাবনা নিহির ওপর জেঁকে বসেছে। পড়তে বসেও পড়ায় মনোযোগ আনতে পারেনি। শুধু অনলের কথাই মনে পড়েছে। খাওয়ার টেবিলে সবাই যখন গল্পগুজবে মত্ত নিহি তখন ভেবে চলেছে অনল কেন এমন লুকিয়ে আছে? সারা রাতটাও অনলের কথা ভাবতে ভাতেই পার হলো। ঘুম আসলো ভোরের দিকে। এলার্ম দিয়ে রেখেছিল তাড়াতাড়ি কলেজে যাওয়ার জন্য। তাই ঘুমও তেমন হলো না। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়েই কলেজে চলে গেল। আজ উপমাও কলেজে এসেছে। দুজনে মিলে সারা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপমা নানান কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু নিহির কানে কিছুই যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে কলেজের লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে। অনলকে এক পলক দেখার জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিহি হাঁপিয়ে উঠেছে। অনলের বন্ধুরা এসেছে কিন্তু অনল আসেনি এখনো। তবে কি আসবে না অনল?

নিহির নিজেরই এখন বিরক্ত লাগছে। বিরক্ত ভাবটা কাটাতে হবে। এজন্য লাইব্রেরীতে যাওয়া দরকার। লাইব্রেরীতে যাওয়ার সময় লিসা সামনে এসে দাঁড়ায়। নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”
“জি, বলুন।”
“এখানে নয়। এদিকে আসো।”

লিসার পিছু পিছু নিহি আর উপমা দুজনই যায়। লিসা এবার বলে,
“কলেজে এসেছ কেন?”
নিহি আর উপমা দুজনই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। এগুলো আবার কেমন প্রশ্ন! নিহি বিনয়ের সাথে বলে,
“বুঝলাম না আপু।”
“থাপ্রে তোমার গাল ফাঁটিয়ে ফেলব আমি বেয়াদব মেয়ে। এখন বুঝোনা না? নাটক করো? কলেজে আসো কি প্রেম-পিরিতি করতে? তাও আবার অনলকে প্রেমে ফেলতে চাইছ?”
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
“কীসের ভুল? আমার ভুল ধরতে আসো তুমি? আচ্ছা তুমি এটা বলো, কোন সাহসে তুমি অনলের সাথে সম্পর্ক করার সাহস দেখাও? কী আছে তোমার মাঝে? আমি তো এটাই বুঝি না অনল কী দেখে তোমার জন্য পাগল হলো। আজকে ভালোমতো বলে যাচ্ছি, অনলের থেকে দূরে দূরে থাকো। শরীর আর সৌন্দর্য দেখিয়ে ছেলেদের ঘায়েল করানোর টেকনিক অনলের সাথে লাগাতে এসো না। অনল আমার। আমি ভালোবাসি অনলকে। তোমার মতো দুই টাকার রাস্তার মেয়ের জন্য আমি অনলকে হারাতে পারব না। ওয়ার্নিংটা মাথায় রেখো।”

লিসা চলে যাওয়ার পর ডুকরে কেঁদে ওঠে নিহি। অপমানে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। কেউ কখনো নিহিকে কটু কথা পর্যন্ত বলেনি সেখানে বিনা অপরাধে এত বাজে বাজে কথা বলে গেল লিসা। লজ্জায়, অপমানে মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। তৎক্ষণাৎ দৌঁড়ে কলেজ থেকে চলে যায় নিহি। উপমা পেছন থেকে অনেকবার ডাকলেও নিহি দাঁড়ায় না।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]