আড়ালে আবডালে পর্ব-০৮

0
5293

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________

ড্যাবড্যাব করে এক পলকেই নিহি আমানের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্যাফেতে আরো কপোত-কপোতী রয়েছে। তারা তাদের মতো করেই কথা বলায় ব্যস্ত। কিন্তু নিহিকে এভাবে হঠাৎ করে এসে সামনে বসে থাকতে দেখে এবং পলকহীন তাকিয়ে থাকতে দেখে আমানও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। আমান খেয়াল করেছে, নিহির নাক ফুলছে। দাঁত কিড়মিড় করছে। কঠিন কঠিন কিছু বলার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছে। এদিকে নিহিও বুঝতে পারছে না কোথা থেকে কথা শুরু করবে। দিক-দিশা খুঁজে না পেয়ে নিহি বলা শুরু করে,
“আপনার লজ্জা করে না?”
আমান অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
“লজ্জা করবে কেন?”
“ওহ আচ্ছা, আচ্ছা! এখন আবার জিজ্ঞেস করছেন লজ্জা করবে কেন?” চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করে নিহি।

আমানের হাতে ফোন ছিল। ফোনটা টেবিলের ওপর রেখে বলে,
“কী আজব! না বললে বুঝব কীভাবে?”
“একদম নাটক করবেন না বলে দিচ্ছি। দেখা করতে এসে এখন নাটক করা হচ্ছে? আপনি কোন সাহসে দেখা করতে চেয়েছেন? গার্লফ্রেন্ড থাকতেও আপনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন! আপনি কি ভেবেছেন আমি আপনায় বিয়ে করব? নেভার!”

অবিশ্বাসী চোখে আমান তাকিয়ে আছে নিহির দিকে। নিহি অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমান বলে,
“আমার কিঞ্চিৎ সন্দেহ ছিল আপনি মানসিক রোগী নাকি! এখন সন্দেহ কেটে গেছে।”
নিহি আমানের দিকে ডান হাতের তর্জনী তাক করে বলে,
“কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?”
“আমি কিছুই বলতে চাই না। আর আপনার কথার মাথামুণ্ডুও আমিও বুঝতে পারছি না। আপনি যদি একটু ক্লিয়ার করে বলতেন তাহলে বুঝতে সুবিধা হতো আমার।”
“আপনার নাটক করার কারণটাই আমি বুঝতে পারছি না।”
“বিশ্বাস করুন, আমি কোনো নাটক করছি না।”
আমানের কথা শুনে ভড়কে যায় নিহি। চেহারার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না মিথ্যে বলছে। আমানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে দেখে অফ-হোয়াইট শার্ট আর কালো প্যান্টই পরেছে। তাহলে ভুল হবে কীভাবে? কল্পনা-জল্পনা করতে করতেই নিহির ফোনের রিংটোন বাজে। ফোনের স্ক্রিনে ফেসে উঠছে ‘শাহরিয়ার’ লেখা। বিস্ময় নিয়ে নিহি আমানের দিকে তাকায়। আমানের ফোনটা টেবিলের ওপরই আছে। ওর হাত দুটোও টেবিলের ওপর রাখা। তাহলে নিহি আবারও মিস্টেক করে ফেলেছে! প্রথমবার কলটা কেটে যায়। দ্বিতীয়বারে কল রিসিভ করে নিহি হ্যালো বলে। ওপাশ থেকে শাহরিয়ার বলে,
“আরে নিহি আমি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। কোথায় তুমি?”
নিহি ঢোক গিলে বলে,
“অপেক্ষা করছেন মানে? কোথায় আপনি?”
“কোথায় আবার! ক্যাফেতে। একদম পেছনে বসে আছি।”

নিহি একটু উকিঁ দিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলে,
“আসছি আমি।”
কলটা কেটে দিয়ে কাচুমুচু হয়ে আমানের দিকে তাকায়। আমান ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“কী?”
“স্যরি। আজও ভুল হয়ে গেছে।” মাথা চুলকে জবাব দেয় নিহি। আমান মুচকি হেসে বলে,
“আপনার অগোছালো কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম আবারও কোনো মিস্টেক করছেন। ইট’স ওকে।”
“ধন্যবাদ।” বলে, মৃদু হেসে নিহি পেছনে চলে যায়।
.
.
পর্দার আড়াল থেকে অনল উঁকি দিয়ে দেখে নিহি প্রাইভেটে এসেছে কী-না। নিহি অনুপস্থিত। বাকিরা সবাই পড়ছে। হঠাৎ করে মেয়েটার হয় কী? নিহিকে ফোন দিতে যাবে তখন সুইজারল্যান্ড থেকে হোয়াটসএপে কল করে অনলের বাবা। অফিসের কাজে বেশিরভাগ সময়টাই তাকে বাহিরের দেশে থাকতে হয়। শত ব্যস্ততা থাকলেও স্ত্রী আর সন্তানদের খবর নিতে তিনি ভুলেন না।অনামিকা ম্যাম ব্যস্ত বলে শুধু অনলের সঙ্গেই কথা বলে কল কেটে দেন তিনি। অনল এবার নিহির নাম্বারে ডায়াল করে।

মেজাজ খারাপ করে বারান্দায় বসে ছিল নিহি। আকবর আজিজের ছেলেটাকে ভদ্র ভেবেছিল নিহি। কিন্তু ধারণা ভুল! পাক্কা ছেচ্রা। না, সবার কাছে ছেচ্রা নয়। শুধু নিহির কাছেই। তার অবশ্য যথাযথ কারণও আছে। শাহরিয়ারের কথাবার্তা, আচার-আচরণ কোনোটাই খারাপ নয়। এইক্ষেত্রে শাহরিয়ার খুব নম্র-ভদ্র। কিন্তু নিহিকে দেখার পর মাথায় ভূত ঢুকেছে। সময় আর অসময় নেই একটু পরপরই নিহিকে ফোন করছে। ভদ্রতার খাতিরে কয়েকবার ফোন রিসিভ করলেও এবার ইগনোর করছে। রিং বাজছে কিন্তু ফোন তুলছে না। এই পর্যন্ত কতগুলো নাম্বার দিয়ে যে ফোন করেছে তার ইয়ত্তা নেই। রাগ করে ফোন বন্ধ করে রাখতে যাবে তখন কল রিসিভ হয়ে যায়। নিজের ওপর নিজেই রেগে যায় নিহি। অনিচ্ছা নিয়ে ফোন রিসিভ করে বলে,
“কোনো কৈফিয়ত দিতে পারব না।”
“কীসের কৈফিয়ত?”
“কোনো কিছুরই না।”
“তুমি দেখি আমার মনও পড়তে পারো।”
“ফোন রাখলাম। ব্যস্ত আছি।”
“প্রাইভেটে আসলে না কেন?”

প্রাইভেটের কথা শুনে নিহি থতমত খায়। শাহরিয়ার তো আর প্রাইভেটের কথা জিজ্ঞেস করবে না। কান থেকে ফোন সরিয়ে একবার নাম্বারটা দেখে নেয়। এটাও তো আননোন নাম্বার। মাথায় প্যাঁচ লেগে গেছে শাহরিয়ারের জন্য। ফোনটা আবার কানে ধরে। ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো শোনা যাচ্ছে। নিহি জিজ্ঞেস করে,
“কে?”
“কণ্ঠ চেনোনি?”
“চিনতে পারছি না।”
“আমি অনল।”
নিহির হাতটা এবার হালকা হয়ে যায়। কপালের সূক্ষ্ম ভাঁজটুকু সমান হয়ে যায়। বুকের ভেতর ধুকধুক আওয়াজ শুরু হয়। শব্দগুলোও সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
“চুপ করে আছো কেন?” জিজ্ঞেস করে অনল।
“কী বলব?”
“প্রাইভেটে আসোনি কেন?”
“এমনি।”
“এমনি কেন?”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
“পড়া বাদে আবার কীসের ব্যস্ততা?”
“সব কৈফিয়ত দিতে হবে?”
“যদি বলি হ্যাঁ?”
“আমি বাধ্য নই।”
“হয়ে যাবে।”
“ফোন রাখলাম।”
“তুমি ভয় পাচ্ছ।”
“ভয় পাব কেন?”
“আমায় ভালোবেসে ফেলার ভয় পাচ্ছ।”
“এমন মনে হওয়ার কারণ?”
“তাই তো কথা বলতে চাইছ না। যদি ভালোবেসে ফেলো এই ভয়ে।”
“হাহ্! যা ভাবার ভাবেন। আমি ফোন রাখলাম।”

নিহি খট করে কল কেটে দেয়। কিন্তু মন চাইছে অনল আবার কল করবে। বারবার ফোন দেবে। ঠিক ততক্ষণ, যতক্ষণ না নিহি ফোন রিসিভ করবে। মন এমন কেন চাইছে তার উত্তর নিহির কাছে নেই। তবুও মন চাইছে এমনটাই হোক। কিন্তু মনঃক্ষুণ্ণ হয় নিহির। অনল আর একবারও ফোন করেনি। অদ্ভুত ছেলে তো!
___________________________

সন্ধ্যাঃ ৭টা ৪৫ মিনিট

নিহির ঘুম ভাঙে সালেহা বেগমের চিৎকার চেঁচামেচিতে। তমার সঙ্গে কাজ করছেন আর বিলাপ করছেন, ‘সন্ধ্যার সময়ও ঘুমাল। আর এখনো উঠার কোনো নাম নাই। সারাদিন খালি ঘুম আর ঘুম। কেমনে এত ঘুমায় একটা মানুষ।’

নিহি চোখ বন্ধ করে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে সব শুনে। তিতির দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে। চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে লাইট অন করে নিহির কাছে যায়। নিহির গালে হাত বুলিয়ে বলে,
“ও ফুপি, ফুপি তাড়াতাড়ি ওঠো। দাদু বকছে তোমায়।”
নিহি ঘুম জড়ানো চোখে তিতিরের দিকে তাকিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। সালেহা বেগম রুমে আসেন খুন্তি হাতে নিয়ে। নিহিকে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে বলেন,
“ঐ ওঠ তাড়াতাড়ি।”
“আরেকটু ঘুমাব।” ঝিমিয়ে বলে নিহি।
“উঠবি না তুই?”

নিহি তিতিরকে বলে,
“আম্মু তুই এই মহিলাকে নিয়ে যা তো!”
তিতির মুখে হাত দিয়ে হাসে। সালেহা বেগম ক্ষেপে বলেন,
“দিদিভাই ও মহিলা কাকে বলল? আমি মহিলা?”
“না গো! তুমি আঠারো বছরের যুবতী।” শোয়া থেকে উঠে বসে নিহি। তিনি রেগে বলেন,
“মশকরা করিস তুই আমার সঙ্গে?”

নিহি খিলখিল করে হেসে সালেহা বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। সালেহা বেগম নিহিকে সরিয়ে দেওয়ার ভান ধরে বলেন,
“সর, সর! ভালোবাসা দেখাতে আসবি না।”
নিহি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“দেখাব। একশো বার দেখাব। হাজারবার দেখাব।”
“দেখিস তোকে এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেবো যে তোকে শায়েস্তা করতে পারবে। এমনিতেও তুই যে মেয়ে! তোর জন্য রাগী ছেলে খুঁজব।”
“ইশ! আমার স্বামী অনেক ভালো হবে। আমাকে অনেক ভালোওবাসবে। দেখিও তুমি ” ভেংচি কেটে বলে নিহি ওয়াশরুমে চলে যায়।

ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে টেবিলের ওপর গরম কফি রাখা। বিছানার ওপর বসে আছে তিতির। তোয়ালে দিয়ে নিহি মুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে,
“কফি কে রেখে গেছে?”
“দাদু।”
নিহি মুচকি হাসে। কফিটা হাতে নিয়ে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে। ৭৫+ কল। ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমানোর কারণে শুনতে পায়নি। প্রত্যেকটা কল ছিল অনলের। নিহির রাগ হয় খুব। তখন কল দিতে পারল না আর এখন আসছে ভালোবাসা দেখাতে। নিহি কলব্যাক করে। অনল রিসিভ করে না। কল কেটে যাওয়ার পর অনল নিজেই কলব্যাক করে। নিহি ফোন রিসিভ করে চুপ করে থাকে। অনল জিজ্ঞেস করে,
“ফোন রেখে কি মঙ্গলগ্রহে ঘুরতে যাও?”
অনলের ত্যাড়াব্যাকা কথা শুনে নিহিও বাঁকা উত্তরে বলে,
“হ্যাঁ, যাই। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে তো সেখানে। তাই দেখা করতে গেছিলাম।”
“তোমার কলিজা দেখি খুব বড়।”
“অনেএএএক!” একটু টেনে বলে নিহি।
অনল মুচকি হাসে কিন্তু বুঝতে দেয় না। জিজ্ঞেস করে,
“কলিজাটা দেখা যাবে?”
“না।”
“কেন না?”
“কারণ এটা সম্ভব না।”
“কে বলল?”
“আমি বললাম।”
“আমি দেখবই।”
“আমায় খুন করে?”
“তার আগে নিজে খুন হব।”

নিহি কিছুটা শব্দ করে হাসে। অনল চুপ থেকে নিহির হাসি শুনে বলে,
“ঘুমিয়েছিলে বিকেলে?”
“হুম। কী করে বুঝলেন?”
“কণ্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে। তাছাড়া মনটাও ফ্রেশ মনে হচ্ছে।”
“হয়তো।”
“এটাই সত্যি।”
“হুম।”
“ভালোবাসি।”
“খুব ভালো।”
“ব্যলকোনিতে আসো ”
“কেন?”
“আগে আসো।”
নিহি ফোন নিয়েই ব্যলকোনিতে যায়। অনল বাড়ির সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“আপনি এখানে কেন?” নিহি প্রশ্ন করে।
অনলের উত্তর,
“যখন থেকে কল করেছি তখন থেকেই এখানে অপেক্ষা করছি। আর তুমি তো পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছ।”
“কেন এসেছেন?”
“তোমার জন্য।”
“আমি তো আসতে বলিনি।”
“তুমি তো ভালোও বাসতে বলোনি। আমি তাও ভালোবেসেছি।”
“তর্কে যেতে ইচ্ছে করে না।”
“যেয়ো না। শুধু একটু ভালোবাসো।”

নিহি নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। শাহরিয়ার আসছে। অনলের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে। যদি শাহরিয়ার বুঝতে পেরে বাড়িতে জানিয়ে দেয়? আর অনল যদি একবার বুঝতে পারে শাহরিয়ার নিহিকে বিয়ে করতে চায়, তাহলে আল্লাহ্ মালুম কী যে হবে!

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]