ইচ্ছে কথন পর্ব-০৩

0
655

#ইচ্ছে_কথন
#writer_falak_moni
#পর্ব_৩

৫বছর পর,

ফাগুনের শুভেচ্ছা জানাতে কলেজে এক বিষেশ আয়োজ করা হয়েছে স্টুডেন্টরা মিলে। তরু আয়নার সামনে মুখটা কাচু মাচু করে বসে আছে টিশার্ট আর পায়জমা পড়ে।

নাতাশা এসে তরুকে এমন ভাবে দেখে হেসে জরিয়ে ধরলো। তরু মুখটাকে বাঁকা করে কর্কুট্ট গলায় বলতে লাগলো,

সোনা আপু তুমি কিন্তু এভাবে হাসবে না বলে দিলাম। যদি হাসো তাহলে কিন্তু কল্প ভাইয়াকে বলে দিব। তোমার সাথে আমি রাগ করে আছি। কয়টা কল দিয়েছি তোমাকে। এতক্ষণে আসার সময় হলো

নাতাশা হেসে বলতে লাগলো,,

থ্রেড দিস আমাকে তাই না, আমারও সময় আসবে হুম।তখন দেখে নিব।

তরু নাতাশার হাতে চিরুনিটা দিয়ে রাগ রাগ ভাব নিয়ে বলতে লাগলো,

নাও সামলাও।কত করে তো বলেছি চুলগুলো কেটে ফেলি। আমি তো একা সামলাতে পারি না এত বড় চুল। কিন্তু না তোমার একই হুকুম চুল কাটা যাবে না। কি আর করার তুমি এবার সামলাও।

নাতাশা আয়নার সামনে তরুকে বসিয়ে তার কাঁধের উপর নিজের মাথাটা রেখে বলতে লাগলো,

জানিস তরু তর বরের পছন্দ বলে কথা। সে তো লম্বা চুল বেশ পছন্দ করে।

বরের পছন্দের কথা শুনে তরুর মুখটা সাথে সাথেই ফ্যাকাসে হয়ে যায়।নাতাশা সেটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টে বলতে লাগলো,

শাড়ি পড়বি নাকি সালোয়ার কামিজ,

শাড়ি।

নাতাশা কলা পাতা রঙের একটা শাড়ি বের করলো কাবার্ড থেকে। মেচিং করা চুরি জিনিস।সব কিছু দিয়ে তৈরি করে দিল। চুল গুলো ছেড়ে দিল।হাটুর নিচ অব্দি চুল পড়ে আছে তাদের ভাঁজে ভাঁজে। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে চিনতে কষ্ট হচ্ছে তরুর। খুশিতে নাতাশাকে জরিয়ে বলতে লাগলো,,

সোনা আপু প্রিয় ভাইয়া আমাকে যদি এভাবে কখনো দেখে তাহলে ফিদা হয়ে যাবে না??

নাতাশা নিজের চোখের কাজল নিয়ে তরুর ঘারে লাগিয়ে বলল,

পাগলি মেয়ে।

সোনা আপু আমি তো সাজলাম। কিন্তু তুমি, তুমি তো কোনো সাজ সাজলেই না।

কথটা বলে তরু কাবার্ড থেকে আরেকটা একই রকম শাড়ি বের করলো। নাতাশা বাধ্য হয়ে তরুর মতো করে সেজেগুজে বের হলো। নিচে নামতেই আফজাল চৌধুরি আর কল্প হা হয়ে থাকিয়ে আছে তাদের দিকে। কল্প তো নাতাশার দিক থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না। অসম্ভব রকমের সুন্দর লাগছে দুজনকে এক সাজে এবং এক ড্রেসে।।

তরু নাতাশাকে নিয়ে আজ কলেজে যাবে বলে ডিসাইড করে। নাতাশা তার পরিবারকে কম গুরুত্ব দিলেও তরুকে সচারাচর এক ধাপ বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কেন যে মেয়েটাকে বড্ড আপন লাগে।এক মায়ায় জরিয়ে গেছে মেয়েটার সাথে যে মায়া থেকে সরে যেতে চাইলেও পারছে এক অনেচনা বন্ধনের কারনে। নাতাশার পরিবার বলতে একটা ছোট ভাই, আর তার মা। বাবা নেই, ভাইটা হওয়ার পর পরই বাবা মারা যায় এক্সিডেন্টে।

তরু আর নাতাশা বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই দরজায় কে যেন কলিং বেল বাজতে শুরু করলো। নাতাশা আর তরু কল্পের দিকে দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে তাকিয়ে বলতে লাগলো এক সঙ্গে,,

কল্প ভাইয়া প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর ।

কল্প বেচারা কি আর করার। ৫বছর যাবতো এই দুই মেয়ের অত্যাচারে সে অবস্থ হয়ে গেছে। বাড়িতে সেই আসুক না কেন দরজাটা তাকেই খুলতে হবে। যদি টয়লেটে গিয়েও লুকিয়ে থাকে ঐ অত্যাচার থেকে বাচা যায় না। কল্প নাতাশার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে দরজাটা খুলতে গেল।এদিকে নাতাশা আর তরু তো কল্পের এমন ফেইজ দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। আফজাল চৌধুরি রুমে চলে যায়।কারন ওনার এখন বয়স হচ্ছে দিন দিন। তাদের এই চিল্লাচিল্লি ওনার ভালো লাগে না। তাই তিনি চলে যায়।

কল্প দরজা খুলতেই আহাম্মক এর মতো করে তাকিয়ে আছে। এটা কি সত্যি নাকি স্বপ্ন দেখছে সে। কল্প জোরে নাতাশা বলে চিৎকার দিল।নাতাশা কল্পের এমন চিৎকারে দৌড়ে এসে দরজার পাশে দাড়ালো।দরজার সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে সে নিজেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। কারন দরজার সামনের ব্যক্তিটি আর কেউ না সয়ং প্রিয় এসে দাড়িয়ে আছে। নাতাশা প্রিয় বলে ডাক দিতেই তরুর ভেতরটা কেমন মোচর দিয়ে উঠলো। দীর্ঘ পাঁচটা বছর পর আজ প্রিয় বাড়িতে এসেছে এটা ভেবে যেমনটা আনন্দ লাগছে তেমন ভয়ও হচ্ছে। তরু তাড়াতাড়ি করে সিড়ি বেয়ে আবারো উপরে ওঠে গেল । এই মুখটা যে প্রিয়কে দেখানো বারন। নাতাশা যেই না তরু বলে ডাক দিবে তখনই প্রিয় ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। প্রিয় নাতাশার দিকে এক গভীর চাহনিতে নিক্ষেপ করে আছে। কিন্তু নাতাশার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।নাতাশা গিয়ে কল্পের হাত ধরে বলতে লাগলো,

কল্প ভাইয়া আংকেলকে বলো নিচে আসতে।

নাতাশা কল্পের হাত ধরতে কল্পের কেমন যেন এক অনুভূতি হতে লাগলো যে অনুভূতির সাথে সে খুব গভীরভাবে পরিচিত।কল্প কিছুক্ষণ নাতাশার দিকে তাকিয়ে থেকে উপরে চলে গেল বাবাকে ডাকতে। নাতাশা এবার প্রিয়র মুখামুখি বসলো বসে বলতে লাগলো,

আরে প্রিয় তুমি তো দেখছি অনেক সুন্দর হয়ে গেছ।

প্রিয় ম্লানমুখে একটু হাসি দিয়ে বলতে লাগলো,,

তুমিও ও তো।

নাতাশা হাসতে লাগলো।প্রিয় নাতাশার হাসির দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। নাতাশা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টে বলতে লাগলো,

ধন্যবাদ প্রিয়,

কেন?

এই যে আমার কথা রাখলে। ৫বছর পর ফিরে এলে।

প্রিয় একটা মুচকি হাসি দিল। নাতাশা প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

তরুর খোজ নেবে না।

তরুর নামটা শুনেই প্রিয়র বুকের ভেতর এক হৃদকম্পন দিয়ে উঠলো। আসলেই মেয়েটাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এই ৫টা বছর অনেক ভেবেছে মেয়েটাকে নিয়ে। কিভাবে এই সম্পর্কের একটা বিহিত করা যায়।

প্রিয়র চোখ এদিক সেদিক তরুকে খুজতে ব্যস্ত। মেয়েটা হয়তো অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে। এসব ভেবে নিজে নিজেই হাসতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আফজাল চৌধুরি নিচে নামলো। নিচে নেমে নিজের পুত্রকে দেখে তিনি অনেকটা শান্তি অনুভব করেন। প্রিয়কে এসেই তিনি জরিয়ে ধরলেন। প্রিয়ও জরিয়ে ধরতেই পেছনে দেখতে পেল একটা মেয়ে কালো বোরকা পড়ে দাড়িয়ে আছে মাথায় হিজাব করা। সাথে নিকাব করাও যার কারনে মেয়েটার কাজল কালো দুটি চোখ বাদে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রিয় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এটা তরু নয়তো। এসব ভাবতে ভাবতে নাতাশা তরু বলে ডাক দিল। তরুর এমন হাব ভাব নাতাশার ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। কারন আজ মেয়েটার কলেজে অনুষ্ঠান বলে সকাল থেকে এত সুন্দর সাজুগুজু করে নিচে নামলো। এখন আবার বোরকা পড়া। কেমন যেন খটকা লাগছে মনের ভেতর।

তরু প্রিয় দিকে এক এক গভীরতার চাহনিতে নিক্ষেপ করে আছে। যেথায় রয়েছে বিরাজ সমান ভালোবাসার এক বিশাল পাহাড়। এই পাঁচটা বছর শুধু প্রিয় ছবি দেখেই কাটিয়েছে। আর তার বলা প্রত্যকটা বাক্যগুলো মনে করিয়ে কাঁদিয়েছে।

তরু নিচে নামতেই নাতাশা গিয়ে তরুর কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,

কি রে তুই তো দেখি তর বরকে দেখে ফিদা হয়ে গিয়েছিস। কোনো কথাই বলছিস না। একদম স্টাচু।

নাতাশার কথার কোনো শব্দই তরুর কানের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সে এখন প্রিয়কে দেখায় ব্যস্ত৷ প্রিয়ও তরুর দিকে তাকিয়ে আছে স্টাচু হয়ে। আসলেই তো মেয়েটা অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এভাবে মুখ বেঁধে আছে কেন। এসব ভাবতেই কল্প বলতে লাগলো।

আরে তরু তুই তো কিছুক্ষণ আগে নাতাশার মতো করে সেজেগুজে বের হইছিলি এখন আবার এমন কেন। তকে তো একদম চেনাই যাচ্ছে না।

তরুর কল্পের কথাও কানের ধারে নিলো না। আস্তে আস্তে গিয়ে প্রিয়র সামনে দাড়ালো।তারপর ধীরালো কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়ে বলতে লাগলো,

ক ক কেমন আছো ভাইয়া।

প্রিয় কিছুই বলল না। প্রিয়র কোনো রিয়েকশন না পেয়ে তরুর মনটা নিমিষেই অন্যরকম হয়ে গেল। যেটা নাতাশা দূর থেকে দাড়িয়ে বুঝতে পেরেছে। সাথে কল্পও। আফজাল চৌধুরি বুঝেও না বুঝার মতো করে তাকিয়ে আছে। প্রিয় সোজা তার রুমে চলে যায়।

নাতাশাও প্রিয়র পেছন পেছন যেতে নেয়। হঠাৎ নাতাশার ফোন বেজে ওঠে ফোন বাজতেই দেখে কল্প কল করছে। সেটা দেখে নাতাশা হাসতে লাগলো। ছেলেটা এমন কেন। তাকে সারাক্ষন প্যারায় রাখে তবুও একটু পেরেশানি দেখায় না। নাতাশা ফোনটা রিসিভ করে বলতে লাগলো,

কি জনাব ফোন করছেন কেন?

আসলে তরু তো একা একা কলেজে গেল।তুমি তো তার সাথে যাওয়ার কথা।

নাতাশার হঠাৎ মনে হলো সত্যিই তো। আজ তো মেয়েটার সাথে তার যাওয়ার কথা। তরু সাথে সাথেই কল্পকে বলতে লাগলো,

কল্প তুমি গাড়ি বের করো আমি আসছি,

সারাদিন কলেজ শেষ করে বাড়ি ফিরলো তরু। নাতাশা চলে গেল তার বাড়িতে। কল্প আর তরু রুমে ডুকেই দেখতে পেল আফজাল চৌধুরি আর প্রিয় বসে আছে। তরু এখানে না দাড়িয়ে উপরে চলে গেল। প্রিয় তরুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

কল্প ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলতে লাগলো,

তরু রাগ করছে তোমার সাথে।

প্রিয় কল্পের দিকে তাকিয়ে বলল,

কেন, আমার সাথে আবার রাগ করতে যাবে কেন?

কারনটা তুমি নিজেই খুজে নিও।

বলেই কল্প চলে গেল। প্রিয় এবার বুঝতে পেরেছে তরুর রাগের কারন। সত্যিই তো মেয়েটা সকালে তাকে বলেছিলো । সে কেমন আছে। কিছু না বলেই সে চলে গেল। এটা একদম উচিত হয়নি। এসব ভেবে প্রিয় তরুর রুমের দিকে গেল।

আফজাল চৌধুরি হাসতে লাগলো, ছেলের এমন কান্ডে। প্রিয় তরুর রুমের সামনে গিয়ে অনেকক্ষন যাবত দাড়িয়ে রইলো কিভাবে যাবে সে ভেবে পাচ্ছে না, এক অজানা আনইজি ফিল হচ্ছে মনের কোনে। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট লাগলে তার কাছে, যে নাতাশা তাকে ভুলতে পেরেছে। কারন মেয়েটাকে যতটুকু সময় চোখের সামনে দেখেছে সবসময়ই অন্যরকম লেগেছে। হয়তো মনের মতো কাউকে পেয়েও গেছে। এসব ভেবে প্রিয় একটা বড় করে শ্বাস নিলো। মনের ভেতরটা একটু হালকা লাগছে। কিন্তু সে কি পেরেছে নাতাশাকে ভুলতে। এসব ভাবতেই তরুর রুম থেকে জোরে একটা চিৎকার আসলো,,,,

#চলবে