ইচ্ছে কথন পর্ব-০৪

0
618

#ইচ্ছে_কথন
#writer_falak_moni
#পর্ব_৪

তরুর চিৎকার শুনে প্রিয় দৌড়ে রুমে গেল। গিয়ে দেখতে পেল ওয়াস রুমের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে।

প্রিয় চিন্তিত হয়ে দরজা বাহির থেকে নক করতে লাগলো।

তরু কি হয়েছে তর দরজা খোল?

প্রিয়র গলার আওয়াজ পেয়ে তরু সাথে সাথেই চিৎকারের আওয়াজ বন্ধ করে দিল। ভীষ্মের দর্প চুর্ণ অহমিকায় স্তব্ধতার পর্দা দিয়ে ডেকে আছে দরজার এপাশ ওপাশ।দুই কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রেমিকহীন ব্যক্তি।একজন প্রেমের টানে দীর্ঘ ৫বছর যাবত অপেক্ষা করে যাচ্ছে। আরেকজন নিজের অনুভূতিকে কবর দিয়ে এক বিষাক্ত ছোয়ার আশকারায় মেতে আছে। নীরবতা দুই দিক ভালোবাসার এ কেমন প্রহরের পরীক্ষা তাকে গুনতে হবে। তরু চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু টলটল করে গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে যা এখন মুখে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু পানির সাথে জমাটবদ্ধ হয়ে আছে। কাপা কাপা কন্ঠে উধকির্নতার আবেশে বলতে লাগলো,

ভাইয়া আপনি এখান থেকে চলে যান।

তরুর এমন কন্ঠ শুনে প্রিয় কিছুই বুঝতে পারলো না। আসলেই তো মেয়েটার ভেতর কি কেমন চলছে যার কারনে সে প্রিয় সামনে এখনো পর্যন্ত এসে দাড়ালো না। সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে চলল এখনো মেয়েটার দুটো চোখ বাদে আর কিছুই দেখেনি সে। এগুলো ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলার শব্দ কানে ভেসে এল। তরু দরজার ছিটকেটা খুলে একটু ফাক করে একটা চোখ দিয়ে বাহিরে দেখতে লাগলো প্রিয় দাড়িয়ে আছে কিনা। দরজার পাশে প্রিয়কে দেখে সে এবার একটু রেগে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতে লাগলো,

আমি আপনাকে এখানে দাড়িয়ে থাকতে বলিনি। আপনাকে যেতে বলছি।

প্রিয়ও নাছোর বান্দার সুদূরপ্রসারী ভাব নিয়ে দাড়িয়ে বলতে লাগলো,

কি হয়েছে সেটা যদি না বলিস। তাহলে এখান থেকে এক পা ও এগুবো না।

তরু এবার রেগে গেল।কিন্তু রেগে কি করার আছে যতক্ষণ না বলে ততক্ষণ তো এ আপদ বের হবে না রুম থেকে তাই বলতে লাগলো,

টিকটিকি দেখেছি সে জন্য।

প্রিয় এবার হাসবে নাকি কাদঁবে ভেবে পাচ্ছে না। এতদিন শুনে এসেছে মেয়েরা নাকি তেলাপোকাকে ভয় পায়। এই মেয়ে নাকি টিকটিকিকে ভয় পায়। এসব ভেবে হাসতে হাসতে চলে গেল।

প্রিয় আসার আজ ৫দিন হয়ে গেল।তরু একনো পর্যন্ত প্রিয়র সামনে আসলো না। আফজাল চৌধুরি সে বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত। তাই তিনি প্রিয়কে তার নিচে বসার রুমে ডাকলেন। প্রিয় আর কল্প এক সাথেই নিচে এসেছে। দুই ভাই বসে আছে। আফজাল চৌধুরি প্রিয় আর কল্পের থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে যেই না মুখ খুলতে যাবে তখনই দরজায় কে যেন কলিং বাজাতে লাগলো। এতটা জোরেই কলিং বেল চাপতে লাগলো যেন এই বুঝি দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ডুকে যাবে।

কল্প দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল।দরজা খুলে তো তার চোখ জোড়া ভীষ্ম পাণ্ডুর আমলে চলে যাওয়ার অতিকায় পর্বতের চূড়ায়। কারন দরজার এপাশে নাতাশা দাড়িয়ে আছে বুধূবেশে। নাতাশা কল্পকে সরিয়ে দৌড়ে আফজাল চৌধুরির নিকট এসে দাড়ালেন। আফজাল চৌধুরি আর প্রিয় তো স্টাচু হয়ে আছে। নাতাশাকে দেখে কল্প বুঝতে পেরেছে মেয়েটা হয়তো খুব বিপদে আছে। যার কারনে আজ তিন দিন ধরে ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। ।

নাতাশার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ আসছে না। মেয়েটা দুর্বল শরীর নিয়ে আফজাল চৌধুরি দিকে তাকিয়ে আছে। আফজাল চৌধুরি তাকিয়ে আছে কল্পের দিকে। নাতাশা কল্পের দিকে কিছুক্ষণ তাকায় তারপর আবার আফজাল চৌধুরির দিকে। মেয়েটার এমন হাব ভাব দেখে। কাউকে কিছু না বলেই আফজাল চৌধুরি তাদের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে কাজী সাহেবকে কল করে। প্রিয় এক ধ্যানে নাতাশার দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটার চোখ দিয়ে জল বের হচ্ছে। তার উপর আবার কিছুই বলছে না। সব চেয়ে বড় কথা বধূবেশে সে আসলোই বা কই থেকে।

আফজাল চৌধুরি দৌড়ে গিয়ে কল্পকে জরিয়ে ধরলেন। বাবার এমন খুশির কারন কেউই বুঝতে পারছে না। নাতাশা তো আরো আগেই না। নাতাশা কিছু বলতে যাবে। তখন আফজাল চৌধুরি নাতামে থামিয়ে বলতে লাগলো,

মা তোমার এখন কিছু বলার দরকার নেই যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।

প্রিয়ও বুঝতে পারছেনা কি করতে চাইছে বাবা।

১৫ মিনিট পর কাজী সাহেব হাজির। কাজী সাহেবকে দেখে কল্প প্রিয় দুই ভাই বাবার দিকে তাকালো। নাতাশা তো বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছেনা এখানে হচ্ছেটা কি।

নাতাশা কিছু বলতে যাবে আফজাল চৌধুরি আবারো বাধা দিলেন। নাতাশাকে কিছু না বলতে দিয়েই কাজী সাহেব রেজিষ্ট্রেশন পেপার বাহির করতে লাগলেন। আফজাল চৌধুরি নাতাশার থেকে সাইন নিতে গেলেন। নাতাশা আবারো কিছু বলতে চাইবে, আফজাল চৌধুরি তাকে এমন দমক দিলেন সাথে সাথেই বেচারি ভয়ে সাইন করে দিল। তারপর রেজিষ্ট্রেশন পেপার নিয়ে কল্পের কাছে হাজির হয়।কল্প এই মুহূর্তে ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এক দিকে বাবার মান সম্মান অন্যদিকে জোর করে বিয়ে। কোন দিকে যাবে সে। প্রিয় দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব কিছু দেখেই যাচ্ছে। কিছু বলার ভাষা নেই এখানে। কারন সে জানেই আফজাল চৌধুরি পাগলামির কাছে এখন যদি কিছু বলতে যায় তাহলে সেটা আরো ভিন্ন কিছু হতে পারে। তাই সে কিছুই বলছেনা।

তবে একটা কথা ঠিক যে ৫বছর আগে নাতাশাকে নিয়ে যে আবেগ ভালোবাসা ছিল সব কিছু থেকে সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে প্রিয়।যার এক্সামপল এই বিয়ে। আবেগ ভালোবাসা বলতে তার জীবনে এখন কিছুই নেই না কোনোদিন হবে। এটাকেই বিশ্বাস করে আসছে প্রিয়।নাতাশাকে ভালোবাসার পরে আর কোনো মেয়ের দিকে এখনো পর্যন্ত নজর পড়েনি তার।

কল্প কিছু না ভেবেই সাইন করে দিল। দুই পক্ষের থেকে সাইন নিয়ে কাজী সাহেব বেরিয়ে গেলেন। কাজী সাহেব বের হতেই। কল্প টেবিলে থাকা কাঁচের জগ হাতে নিয়ে জোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারলেন । সাথে সাথেই চারদিকে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। আফজাল চৌধুরি ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি কি একটু বেশিই বুঝে নিলেন যার সরুপ এ চিহ্ন। জগ ভেঙ্গে যাওয়ার আওয়াজে তরু দৌড়ে গোমটা দিয়ে বের হয়। কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য। উপরতলা সিড়ি বেয়ে যখন নামতে নিবে তখন নিচে নাতাশাকে এভাবে দেখে তো চমকে উঠে। হঠাৎ প্রিয়র দিকে চোখ যেতেই ওখানে দাড়িয়ে পড়ে। কল্প রাগান্বিত হয়ে তার বাবাকে বলতে লাগলো,

বাবা এটা তুমি কি করলে?

ছেলের এমন প্রশ্নে আফজাল চৌধুরি থতমত খেয়ে যায়। তাহলে কি সে ভুল কিছু করে ফেলল যার কারনে ছেলে এমন রেগে একাধিক চৌচির শূঁড় হয়ে আছে।

কল্পের চোখ মুখ লাল বর্ন ধারন করে আছে।তেমন ফর্সা না হলেও তার ফেইস দেখে মনে হচ্ছে জলন্ত উনুনের অগ্নি শিখার প্রতিচ্ছবি স্পষ্টভাবে ভেসে আছে তার চেহারায়।
কল্প নাতাশার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।তার পর একটা বিকট শব্দে নাতাশাকে দমক দিয়ে বলতে লাগলো,,

কি যেন বলতে চাইছিলে??

নাতাশা কল্পের এমন চিৎকারে সুরের দমকে ভয়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে কাপা কাপা কন্ঠে বলতে লাগলো,

আ আ আসলে তোমাদের পাশের বাসার ইয়াফি আজ তিন যাবতো আমাকে কিডন্যাপ করে রেখেছিলো।

নাতাশার কথা শুনে আফজাল চৌধুরি , প্রিয়, তরু সবাই অবাক হয়ে আছে। অবাক হওয়ারই কথা। আজ তিনদিন নিখোজ অথচ তারা কিছুই জানেনা। তবে তরু তো জানতো যে নাতাশা তার বান্ধবীর বাড়িতে। কারন নাতাশার ফোন বন্ধ পেয়ে নাতাশার মাকে কল দেওয়া তিনি বলেন নাতাশার বান্ধবী মৌয়ের বাড়িতে। তাহলে তিনি জানতেন না এসব ভাবছে তরু।

প্রিয় এবার মুখ খুলল।এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনে গেছে আর দেখে গেছে। প্রিয় এবার বলতে লাগলো,

আচ্ছা ওরা তোমাকে কিডন্যাপ করেছে ভালো কথা। কিন্তু তুমি এভাবে বধূবেশে কেন?

নাতাশা হাপাতে হাপাতে কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো,,

কারন ইয়াফি আজ ৬বছর যাবত আমার পিছু পিছু ঘুরছে। এখন তুমি দেশে এসেছো সে ভেবেছে তরুকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করে ফেলবে।তাই সে আমাকে কিডন্যাপ করে তুলে নিয়ে যায়।অনেক অত্যাচার করে আমার উপর। আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াতে রাজি না হওয়ায়।সে আমাকে অনেক মারধর করে।

নাতাশার প্রত্যেকটা কথা সবাই বুঝতে পারলেও তরু ঠিক এখনো বুঝে ওঠতে পারছে না। কারন নাতাশা আর প্রিয়র ব্যপারে সে এখনো কিছুই জানেনা। নাতাশা তাকে এসব বুঝতে দেয় নি। কল্প তো রেগে একাধিক হয়ে আছে। প্রিয় আর কিছু বলল না। সোজা উপরে চলে যেতে নিল।উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তরু বড় ঘুমটা দিয়ে দাড়িয়ের আছে যার কারনে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। এই মেয়েটার সমস্যাটা কি সেটাই বুঝতে পারছে না। সারাক্ষণ কি এভাবে ঘুমটা দিয়ে মুখ লুকিয়ে রাখে নাকি তার সামনে আসলেই এমন। প্রিয়কে দেখেই তরু দৌড়ে একেবারে রুমের ভেতর চলে গেল। একমিনিটও আর দাড়ালো না।

রাত ২টা বাজে নাতাশা বিছনার উপর বসে আছে। কল্প নাতাশার সাথে কোনো কথা বলছে না। বাবা এটা কি করলো।সবে মাত্র মেডিকেল শেষ করে একটা প্রাইভেট হসপিটালে নিজের চেম্বার খুলল। এখনই এই বিয়ের প্যারার সাথে তাকে নিয়ে বন্ধী করলো।

নাতাশা বসে বসে ফোন টিপছে হঠাৎ মেসেঞ্জারে প্রিয় তাকে নক করলো,যাতে লেখা সাদি মোবারক।

নাতাশা একটু হাসলো। আসলেই এত তাড়াতাড়ি যে প্রিয়কে সে ভুলতে পারবে সেটা তার জানা ছিল না। তবে আজ বড্ড কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কেন সেটা তার জানা নেই। নাতাশা চোখের পানি মুছে প্রিয়কে নক দিল,

ধন্যবাদ।

প্রিয়র হঠাৎ মনে পড়লো তরুর কথা। তাই সে নাতাশাকে আবারো বলতে লাগলো,,

আচ্ছা নাতাশা তরুর একটা পিক দিবে।

সাথে সাথে নাতাশা চোখে মুখে হাসির ঝলক ফুটে ওঠলো। যাক ছেলেটা তাহলে তরুর দিকটা এবার একটু ভাববে।

আমার যাই হোক না কেন, প্রিয় আর তরু যেন সুখী থাকে সেটাই আমার খোদার কাছে একমাত্র চাওয়া।

নাতাশা প্রিয়র ফোনে একটা ছবি পাঠায়।প্রিয় সাথে সাথেই ওপেন করে ফেলে।
#চলবে।