ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-১৩

0
422

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৩

সিঁড়ির গন্ডি পেড়িয়ে এমন আশ্চর্যকর এক ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি ইরা। একরাশ বিষ্ময়, অবাকতা ঘিরলো ইরার ডাগর ডাগর দুটি চোখে। রিয়াদের পাশে স্বাভাবগত বাঁকা হাঁসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে আয়াত। চোখদুটি যেন ফেটে পড়লো চরম অবাকতায়। রিয়াদ আয়াতকে বসতে বললো। গম্ভীর স্বরে ইরাকে কাছে ডাকলো। কিন্তু ইরা তো স্তব্ধ! একপা এগোনোর শক্তি তার নেই। আকস্মিক এই বিপদে নিজেকে ভূ-মন্ডলের সবথেকে একা মনে হলো। রাগ হলো ভাগ্যের প্রতি। ঘুরে ফিরে তার জিবনে এই লোকটা চলে আসছে। কেন? যার প্রতি ইরার শতাধিক ঘৃনা, গিঁটে গিঁটে আকাশচুম্বী রাগ, সে মানুষটা তার জিবনে আসার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আয়াত তো কমার্স এর স্টুডেন্ট নয়! এই চরম মিথ্যে বলে টিউশনি নিয়ে এখানে আসার মূল কারন কি? তবে কি কালকের ঘটনায় সে রাগান্বিত? প্রতিশোধের আহ্বানে ছুটে এসেছে সকাল-সকাল? দেখো, মুখখানায় তবুও হাঁসি! এতো হাঁসি কই থেকে পায়? মানুষ এতো হাঁসতে পারে না। রাগ হলেও কি হাসে এই লোকটা? সিরিয়াস মুহুর্তে? তাও? হয়তো! ইরা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। সারা শরীরে বিরক্তির চিন্হের সাথে চরম রাগ ফুটে উঠলো। তার সাথে রেগে উঠলো রিয়াদ ও। কতক্ষণ আগে ডেকেছে, আর এখনো মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে ইরা। ধমকে উঠলো রিয়াদ,

‘ তুই কি ছোটবেলার মতো মার চাচ্ছিস? কথা বললে শুনছিস না! ‘

ইরার ভাবনার সুতো কাটলো। একপা একপা করে এগিয়ে গেলো সোফার সামনে। ইলিমা ট্রে-ভর্তি খাবার টেবিলে রেখে দু’হাত দূরে দাড়িয়ে রইলো। রিয়াদ আবারো গম্ভীর স্বর তুললো। যা বললো, এতে আবারো একশো চার ভোল্টের ঝটকা খেলো ইরা,

‘ পরিচিত হ, এনি’ই তোকে পড়াবেন আজ থেকে। সপ্তাখানেক বাড়িতে থাক। তারপর ভেবে দেখবো ভার্সিটি যাওয়ার অনুমতি দেয়া যায় কি’না। তোর যে সাবজেক্ট এ প্রব্লেম, আয়াতকে বলবি। যা ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বস, আয়াত যাচ্ছে। ‘

ইরা করুন চোখে তাকালো ভাই এর দিকে। অসহায় গলায় বললো,

‘ এখনো কিছুই খাইনি। কাল থেকে পড়লে হয় না? ‘

কটকটে লাল চোখদুটি মেলে তাকালো রিয়াদ। বললো,

‘ এখন আবার লেট রাইজারের খাতায় নাম তুলেছিস! তোকে উত্তম-মাধ্যম না দিলে সোজা হবি না দেখছি। জলদি ফ্রেশ হয়ে টেবিলে যা। নাস্তাটা শেষ করেই আয়াত যাচ্ছে। যদি শুনেছি এতটুকু ফাজলামো করেছিস তাহলে কিন্তু ভালো হবে না ইরা। যা ঝটপট! ‘

ইরা কাচুমাচু মুখ করে আয়াতের দিকে তাকালো। আবারো হাঁসলো আয়াত। ইরা একরাশ রাগ নিয়ে উপরমুখো হাটা ধরলো। যা বুঝছে, তার জিবন শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। নাহলে হঠাৎ এই আগুন্তকঃ এর আগুনে তাকে ঝলসাতে হতো না, দগ্ধ হতে হতো না! ইরা দোয়া করলো, অন্তত জিবনে আয়াতের মতো পুরুষ যেন কারো জিবনে না আসে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো ইরা। কমার্স এর ছাত্রী হয়ে সাইন্স এর স্টুডেন্ট এর কাছে পড়বে, এ ও সম্ভব?

__

গ্রীষ্মের সকাল। সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। মন মেজাজ আগুন হয়ে আছে আকাশের। তারউপর মায়ের কড়া আদেশ, সিগারেটে হাত দেয়া যাবে না। হাত দেয়া তো দূর, আড়াল থেকে দেখাও নিষিদ্ধ তার। উল্টাপাল্টা যত্তসব চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে আকাশের মাথা। ফ্যাপসা গরমে মাথাটা ধরেছে খুব। আঁকিবুঁকির বিস্তার আজ বড্ড এলোমেলো। কোনকিছু নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে আকাশের এখন ইচ্ছে করে না। আগে শরীর থেকে বৃষ্টির মতো ঘাম পড়লেও চুপচাপ, শান্ত থাকতে পারতো আকাশ। কিন্তু আজকাল পারে না। মাথা ঘুরায়, মাঝেমাঝে বমি পায়। হিজিবিজি লাগে নিজেকে। কেন? ইরা আসার পর তো জিবন আরও রঙিন হয়ে উঠেছিলো। প্রতিটা দিন তার কাছে ছিলো বসন্ত। ইরাকে দেওয়া, নেওয়া প্রতিটা সময় বসন্তের শুরু মনে হতো আকাশের। আজকাল আর ভালো লাগে না। দু’দন্ড স্থির হয়ে থাকতে অসহ্য লাগে। আরও যদি না থাকে সিগারেট, তাহলে তো কথাই নেই। রবিন! কে সেই ছেলে? তার একটি বাক্য বিশ্বাস করা কি উচিত ছিলো? আকাশের মতো পাগল’ই শুধুমাত্র অচেনা কারো কথা বিশ্বাস করবে। ‘আমার মেয়ে পবিত্র!কেউ মিথ্যা রটিয়েছে।’ ইরার মায়ের সে কি চিৎকার! বুক ভাঙা আর্তনাৎ! আকাশ তপ্তশ্বাস ছাড়লো। তবুও এতোটুকু কষ্ট কমলো না। বুকটা হালকা হলো না।

ঘরের তেমন আলো নেই। একটি মাত্র জানালা তাও কোনমতে খোলা। বিছানার এক কোনে যখন এসব ভাবতে মত্ত আকাশ, তখনি প্রবেশ করলো রুমি। ঘরে ডুকেই বলে উঠলো,

‘ আকাশ ভাই ঘুরতে নিয়ে যাবে আমায়? আজ সারাদিন শুধু আমায় টাইম দেবে তুমি। ‘

রুমি আবদার করলো, অথচ আকাশের কোন হেলদোল দেখা গেলো না। নিজের স্থান হতে এতটুকু নড়লো না অব্ধি। রুমি হতাশ শ্বাস ফেললো। আকাশের পাশে ধপাস করে বসে পড়ে বললো,

‘ আহারে বিরহ, এমনি হওয়া উচিত ছিলো! জানো? ‘

আকাশ সাথেসাথে তাকালো। অবাক গলায় বললো,

‘ কেন? ‘

‘ কারন তুমি আমায় যে পাত্তা দাওনা। তাই…’

আকাশ নড়েচড়ে বসলো। মুখচোখ শক্ত করে তাকালো রুমির দিকে। বললো,

‘ তুই আবার শুরু করলি? ‘

‘ তুমি কি জানো, আজ আমার বার্থডে? ‘

আকাশের অনিমেষ কন্ঠ,’হুম।’

এবারে অভিমান করে বসলো রুমি। মুখচোখ লাল করে কাঁদো কাঁদো চোখে তাকালো। অসহায় গলায় বললো,

‘ তবুও একবার উইশ করলে না। ‘

আকাশ উঠে দাড়ালো। আঠারো বছর বয়সি রুমির ছেলেমানুষী আজ মনে ধরছে না আকাশের। রুম থেকে বের হয়ে গেলো আকাশ। সেখানেই জুবুথুবু হয়ে বসে রইলো রুমি। মামাতো ভাইরা এতো সুন্দর হয় কেন? আর সুন্দর মানেই এটিটিউট! একটু পাত্তা দিলে কি হয়? রুমি এতো ভাবে, তবুও তার ভাবনার শেষ নেই। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেরে বললো রুমি,
‘ আজ না হোক কাল,তুমি আমার আকাশ ভাই! ‘

__

পড়ার টেবিলে বসলো ইরা। বইগুলো এলোমেলো, অগোছালো। আগে থেকে ছিলো না। ইরা মনের দুঃখে সবে করলো ও রকম। একটু বাদেই রুমে আয়াত এলো। মুখে হাসি নেই। কেমন আসল স্যারদের মতো গম্ভীর সে। ইরা মনে মনে স্থির, চড়া কয়েকটা কথা বলবে লোকটাকে। ইরার পাশে বসলো আয়াত। মুখে হাসি নেই, এ যেন অবিশ্বাস্য! ইরা এতক্ষণ যা ভেবে রেখেছিলো, তার একটাও বলার সাহস আর পেলো না আর। আয়াত পাশে বসেই সূক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে তাকালো ইরার দিকে। বললো,

‘ কোন কোন সাবজেক্টে অসুবিধা তোমার? ‘

‘ আপনি তো সাইন্স টর স্টুডেন্ট। আমি কিন্তু সাইন্স এর স্টুডেন্ট নই। ‘

‘ তো? ‘

‘ তো কিভাবে পড়াবেন? ‘

‘ সেটা আমার ব্যাপার! তুমি বই বের করো। ‘

‘ একটা কথা বলি? ‘

‘ স্যারের সন্মানটুকু রাখতে পারলে, বলো! ‘

‘ এখানে আসার কারণ? ‘

আয়াত রয়েসয়ে বসলো। কিছুটা প্রসারিত হলো ঠোঁট। বললো,’ আমার হয়েও না হওয়া বউকে পড়াতে এসেছি। এতে আবার কারণ কি? ‘

আবারো ধুপ করে জ্বলে উঠলো শরীর। রাগে কিড়মিড় করতে করতে বললো ইরা,

‘ ভাইকে সবটা জানাতে বাধ্য হবো কিন্তু। ‘

‘ জানাও, আমার কাছেও প্রচুর এক্সকিউজ আছে। ‘

ইরা কিছু বললো না। একাউন্টিং এর মোটা বইটা সামনে ঠেলে দিলো। আনমনে বললো,

‘ এটাতে প্রবলেম৷ ‘

‘ আমার রুমমেট, কয়েকটা ফ্রেন্ড ছিলো তোমার ডিপার্টমেন্টের। ওদেরকেও সাহায্য করতাম। মূলত ওদের থেকেই আগে শুনে নিতাম। মোটামুটি পারি। বাকি ইউটিউব সামাল দেবে। বুঝলে? ‘

‘ কিহ্? আপনি টিচার নন! একটা আস্ত চিটার। ‘

‘ একদম। ‘

#চলবে…