ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-১৪

0
540

#ইরাবতীর চুপকথা
#লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৪

সেদিনের পর কাটলো আরও একটি দিন। ব্যাস্ত শহরে সবার ব্যাস্ততার মাঝে ইরার কোন ব্যাস্ততা চোখে পড়ার মতো নয়। খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, পড়ছে! এই তিন নিয়েই তার জিবন চলছে। আর সবথেকে বেশি যে চিন্তাটা মাথায় ভর করছে তা হলো আয়াতকে নিয়ে! বিজ্ঞান এর মেধাবী শিক্ষার্থী হয়েও এতটুকু দ্বিধাবোধ কখনো চোখে পড়েনি। বেশ সাবলীল ভাবে পড়াচ্ছে আয়াত। এও বলেছে ইউটিউব নাকি সামলাচ্ছে সবটা। ভারী আশ্চর্য! যদি এই আধুনিক যুগে ইউটিউব নামক কিছু না থাকতো? তবে কেমন হতো? খুব খারাপ! আসলেই খারাপ। তাহলে আয়াত আর তার গল্পটা পুরোপুরি ভিন্ন হতো। যোগাযোগের মাধ্যম না থাকলে আজ হয়তো আয়াতকেই চিনতো না ইরা। আয়াত কিভাবে জানে ইরার এইস এস সি রেজাল্ট, এস এস সি রেজাল্ট, এ নিয়ে গভীর ভাবনায় মত্ত হয়ে ওঠে মাঝেমাঝে ইরা। নিশ্চই চেনাজানা কারো থেকে খোজ নিয়েছে। কি কেন? গোটা দুনিয়া, এমনকি ইন্ডিয়ার মতো বড় দেশটাতে কোটি কোটি মেয়ে থাকতে আয়াত কেন খোঁজ নিতো ইরার? চিন্তার ব্যাপার বটে। এ নিয়েও চিন্তার শেষ নেই ইরার। আয়াতের মনে কি তাকে নিয়ে কোন অনুভূতি আছে? আছে এতটুকু ভালোবাসা? কাল রাতেও ঠিকমতো ঘুম হয়নি। কালকে বলার চেষ্টা করবে বলেও বলে উঠতে পারেনি ইরা। মহারাজ বিকেলে আসবেন। সকালে নাকি তার অঢেল কাজ থাকে। তাই কালকেই বিকেলে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর নামলো। ভার্সিটি হীন জিবনটা বড্ড কষ্টের মনে হলো ইরার। কিন্তু রিয়াদের কঠোর,শক্ত কথা,’আমি না বলা অব্ধি কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না ইরা।’ সেই আদেশ’ই মেপে মেপে পালন করছে সে। এতটুকু নরচর করছে না। খা খা রোদ্দুর থাকলে বইছে বাতাস। শরীর ঠান্ডা কারার মতো শীতলতা সে বাতাসে। মরার মতো সোফায় বসে এগুলো ভাবছে ইরা। তখনি ফোনে আওয়াজ এলো। বড্ড চেনা আওয়াজখানা। ইরা নেতিয়ে যাওয়া হাতটা বাড়িয়ে ফোন হাতে নিতেই চমকে উঠলো। চোখদুটি প্রসারিত হলো। আয়াতের মতো নিকৃষ্ট মানুষের আইডি কে পাঠালো, এও যেন ভাববার বিষয়। আন্নন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। সুন্দর করে লেখা,’আপনার শিক্ষক এর আইডি-….’ কিন্তু কে পাঠালো? কার এই নাম্বার?

কয়েক মুহুর্ত থমকে রইলো ইরা। অতঃপর তড়িঘড়ি করে ফোনের ওয়াইফাই অন করলো। একগাদা রিকোয়েস্ট এর নোটিফিকেশনে বিরক্ত হয়েই ওয়াইফাই থাকা সত্ত্বেও বন্ধ রাখতে হয় ইরাকে। প্রয়োজন এর বাইরে চালু করেনা ইরা। ফেসবুক ওপেন করে নাম দিয়ে সার্চ করতেই চলে এলো আয়াতের আইডি। ভিআইপি একাউন্ট! কৌতুহল নিয়েই ডুকে পড়লো আইডিতে। কিন্তু প্রফাইল লক। বিশ্ব সুন্দরী হলে যা হয় আর কি! রিকোয়েস্ট পাঠালো ইরা। ইরাকে অবাক করে সাথেসাথে এক্সেপ্ট হলো। প্রবল আগ্রহ নিয়ে ডুকে পড়লো আইডিতে। রিকোয়েস্ট জমিয়ে তার ফলোয়ার হাজারো। প্রফাইল লক রেখে এই ফলোয়ার অপশন চালু করায় বেশ খানেক হাসলো ইরা।

অতঃপর আয়াতের করা অতি ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর পোস্টগুলি দেখতে লাগলো। অসাধারণ সব ফটোয় মোড়ানো তার প্রফাইল। আর অপ্সরীদের কমেন্টের তো অভাব নেই। ইরার মাথায় আবারো ভর করলো দুষ্ট একখানা বুদ্ধি। হা হা রিয়েক্ট মানেই আগুন! মারামারি, কাটাকাটির অব্ধি খবর সে শুনেছে এই হা হা রিয়েক্ট নিয়ে। এইতো সেদিন’ই ‘বাংলার শব্দ’ থেকে সে দেখলো ‘মনের জমা ক্ষোভ ছিল, রাতারাতি বন্ধুর সব পোস্টে হাহা;অতঃপর খুন!’ কি আশ্চর্য! এই আপাদমস্তক কাজটা করে বসলো ইরা। একে একে সব পোস্টে দিতে লাগলো ‘হা হা’। তারপর স্ক্রল করে হাঁপিয়ে উঠতেই অপেক্ষায় থাকলো মেসেজের। মেসেজ এলো। তবে ফোনের ওপাড়েও যে আয়াত হাসছে, তা বুঝতে বাকি নেই ইরার। বুঝলো খানিক পর,

‘ তুমি কি পাগল? ‘

এই কথাখানায় যে কত আনন্দ, বুকভর্তি ভালালাগা ইরা পেলো, সে বোঝাবার মতো নয়। ইরা হাসলো কিছুক্ষণ। তারমানে ক্ষেপেছে আয়াত। ইরা বললো,

‘ হুম। পাগল আমি। ‘

‘ তুমি কি মনে করেছো তুমি হা হা দেবে আর আমিও রেগে যাবো? ‘

‘ আপনি তো অলরেডি রেগে গেছেন’ই।’

‘ আচ্ছা, আমার সব পোস্টে রিয়েক্ট কেমন? মানে কত?’

ইরা কিছুক্ষণ ভাবলো। বললো, ‘ দুইশো’র ও বেশি। ‘

‘ তাহলে তুমি ভাবো কিভাবে এতো রিয়েক্ট এর মাঝে তোমার একটা হা হা রিয়েক্ট সো করবে? ‘

সচকিত হলো ইরা। কথা তো সত্যিই। এদিকে আয়াত ফান ইমোজি দিয়েই চলেছে। ইরা বিরক্ত হলো। কপালে ভাজ করলো আবারো অপমানের। রাগ নিয়ে লিখলো,

‘ আপনাকে সায়েস্তা করবো কিভাবে? আপনিই বলেন। ‘

‘ বিয়ে করো! ‘

রাগে, দুঃখে মেজাজ তিরতির করে খারাপ হতে লাগলো ইরার। নেট থেকে বেড়িয়ে এলো সে। তখুনি ইলিমা নিয়ে এলেন সু সংবাদ৷ এতো খারাপ লাগার মাঝে এই সংবাদটাই যেন চাইছিলো ইরা। হাতে খারারের প্লেট ইলিমার। ইরার পাশে বসলেন তিনি। প্রথমে মজা করে বললেন,

‘ ননদ গো, তোমার কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না! ‘

ইরা তাকালো না। কিছু বললো না। চুপচাপ নিজেকে সংযত রাখতে ব্যাস্ত হয়ে রইলো সে। ইলিমা নাক টানলেন নিজের। যেন সর্দি হয়েছে এমন ভাব। বললেন,

‘ কলেজ যাইবা? ‘

ইরা ছোট করে বললো,’ না। ‘

‘ তাহলে? ‘

‘ ভার্সিটি যাব। ‘

‘ আচ্ছা কাল থেকে যেও। ‘

‘ তোমার স্বামী আমায় আস্ত রাখবে? ‘

‘ আমার স্বামীই বললো। ‘

ইরা চমকে উঠে বললো,’ সত্যি? ‘

‘ তিন সত্যি।’

খুশিতে চকচক করে উঠলো ইরার মুখ। চোখেমুখে লেপ্টে খুশি খুশি ভাব। এই একটি কথাই মনের সব ক্লান্তি, বিরক্ত ভাব কাটিয়ে দিলো একদম। ইরা একছুটে উপরে চলে গেলো।

ঠিক চারটা বাজে। আয়াতের আসার সময় হলো বলে। তবুও বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করে চলেছে ইরা। বলতে বলতেই হাজির আয়াত। ইরাকে টেবিলে না দেখে রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো আয়াত,

‘ এতো ইরেসপন্সিবল একটা মেয়েকে আমি পড়াই ভাবলেই কেমন লাগে। আপনি এখনো বিছানায় কি করেন? ‘

ইরা বিরক্ত চোখ মেলে তাকায়। বলে, ‘ আপনি যান। আমি আসছি। ‘

আয়াতের মন চাইলো ফোন কেড়ে নিতে। ম্যাসেন্জ্ঞার, ইমো, ওয়াটস্এপ চেক করতে। কিন্তু তবুও কিছু না বলে টেবিলে চলে গেলো আয়াত। ইরা অলস শরীরে গিয়ে বসলো টেবিলে। বইগুলো আজ বেশ করে গুছিয়ে রাখা।

‘ কার সাথে কথা বলো দিন রাত? ‘

আয়াতের এমন প্রশ্নে ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে এলো ইরার। গাম্ভীর্য নিয়ে বললো ইরা,

‘ সেটা আমার ব্যাপার। ‘

‘ খুব ভালো। ‘

‘ তা আপনি আমায় মেসেজ করেছেন তাই না? নাম্বার কই পেলেন? ‘

‘ কুহু দিয়েছে। ‘

‘ একটা প্রশ্ন করি? ‘

আয়াত চমকে উঠলো। ইরা যেমন মেয়ে সবকিছু সোজাসাপটা বলে দিতে পারে। তাহলে ঘটা করে জিজ্ঞেস কেন করছে এটাই বোধগম্য হলো না আয়াতের। সন্দিহান গলায় বললো,

‘ করো। জিজ্ঞেস করছো কেন? ‘

‘ আমার বিয়েটা ভাঙার কারণ কি? আজও বললেন না কিন্তু। ‘

‘ একটা কথা বলি? ‘

‘ আমারটা আগে! ‘

‘ তোমারটার উত্তর’ই আমার প্রশ্নে থাকবে। আমার বলা প্রতিটা বাক্যে থাকবে। জানতে চাও? ‘

ইরা শ্বাসরুদ্ধকর গলায় বললো, ‘ হুম। ‘

‘ তুমি এর আগে যে কলেজে অধ্যায়ন করেছো, সে কলেজে আমার এক মামা শিক্ষক। ইরহাম স্যারকে চেনো নিশ্চই? ‘

‘ চিনি। ‘

‘ সেদিন শনিবার। সকাল থেকেই প্রচন্ড বৃষ্টি। আর এই বৃষ্টির মাঝে আমার মা বললেন তার ভাইকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিতে। আমি তো কিছুতেই রাজি নই। একপ্রকার জোর করেই পাঠানো হলো সেই বৃষ্টির মাঝে। তবুও যেতাম না, যদি ইমোশনাল ব্লাকমেল না করতো। ‘

কথার মাঝেই শব্দকরে হেঁসে উঠলো ইরা। চকচকে দাঁত বের করে বলে উঠলো,

‘ আপনার মা ও? সেইম! কিন্তু এতে আমার বিয়ে ভাঙার কারণটা কই? ‘

‘ আগে বলতে তো দিবে? আচ্ছা শুনো, সেই সকাল সাতটায় বের হলাম, আর পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেলো ন’টা। আটো করে আসায় ভিজে গেলাম অনেকটা। প্রথম বিল্ডিংয়ের বারান্দায় দাড়িয়ে কাকভেজা হয়ে মামার অপেক্ষা করছিলাম যখন, তখনি চোখদুটি আটকে গেলো এক অপরুপ সুন্দর নারীর দিকে। সাদায় মোড়ানো তার সর্বাঙ্গ। সেই বৃষ্টির মাঝে একদম ভিজে গেছে অপরূপা। ভেজা চুলগুলো ঠিক করতে করতেই আমার থেকে দু’হাত দূরে দাড়িয়েছিলো সে। সে কি সৌন্দর্য তার! যে আয়াত একটি মেয়ের দিকে একেবারের বেশি তাকায় না, সে যেন নিজের চোখ সামলাতে ব্যার্থ হলো সেদিন। নজর সরাতে ব্যার্থ হলো। তার কন্ঠ জানো? রিনরিনে! প্রতিটা কথাই ঝনঝন শব্দ তুলে। আমার হৃদপিণ্ড তখন কি গতিতে লাফাচ্ছিলো, যদি কেউ কাছে থাকতো, নির্ঘাত ভাবতো আমার হার্ট এট্যাক হতে চলেছে। আমি ক্রাশ খেলাম! প্রথম ক্রাশ! ক্রাশ বললে ভুল হবে, আমিতো তাকে নিয়ে কতদূর অব্ধি ভেবে ফেলেছিলাম। মামার থেকে তার ব্যাপারে সব শুনলাম। সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করলাম মামার থেকেই। মাঝেমাঝেই আসতাম, দেখতাম তাকে। অনেক দূর থেকে। এ যেন আলাদা ভালোলাগা, অনুভূতি। কিন্তু এর’ই মধ্যে আমার বিদেশ যেতে হলো। তবুও খোজ নিয়েছি। মামার থেকেই। জেনেছি সবটা! কিন্তু যেদিন দেশে ফিরবো, শুনলাম সেদিন’ই তার বিয়ে। আমার তখন দুনিয়া ছাড়খাড় করে ফেলতে মন চেয়েছিলো। কি করবো? কি করলে আমি আমার সপ্নের মায়াবতি কে কাছে পাবো? বাধ্য হয়েই চরম মিথ্যে বলতে হলো। আমার মায়াবতীকে সবার সামনে শুনতে হলো অনেক কটু কথা। জমলো আমার প্রতি তার অনেক ঘৃনা। ‘

#চলবে…..