উল্টোরথে পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
184

উল্টোরথে-১৫

রেন্ট এ কার থেকে গাড়ি আসতে দেরি করেছে। ডিকেনের অস্থির লাগছিল। ড্রাইভারকে ফোনে পাচ্ছিল না। প্রায় মিনিট বিশেক পরে ড্রাইভার ফোন রিসিভ করে বলল, কাছাকাছি আছে।

পেছনের সিটে শাশুড়ী আর শ্যালিকাকে বসতে বলল ডিকেন।

ইরিন বলল, মাঝের সিটটা তো ফাঁকা থাকবে আমি একা বসলে।

ডিকেন বিরক্ত হয়ে বলল, আমি বসব।

ইরিন অবাক হয়ে গেল, এরকম কখনো হয় নি। ডিকেন সব সময় সামনেই বসে।

সিটে বসে ডিকেন বলল, আরাম করে বসো। বাবুকে আমার কোলে দাও।

বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে না। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। এতদিন ইরিনের মনে হয়েছে, ডিকেন কেমন বাবা হলো, একটা দিনও বাচ্চাটাকে নিজে কোলে নিতে চায় নি।
আজ নিজে থেকেই কোলে নিলো!

বাচ্চাটা কোলে নিয়ে ডিকেনের অসহায় লাগতে শুরু করল। এই বাচ্চাটা তার, নিজের অংশ। ইরিনকে ছাড়লে এই বাচ্চাও চলে যাবে। ইরিন হয়তো আবার বিয়ে করবে। তিথি কী অন্যের বাচ্চা আপন করে নিবে, কখনোই না। বাচ্চা মানুষ হবে নানীর কাছে বা মামার কাছে। নিজের বাবা মা থাকা সত্ত্বেও বাচ্চাটা এতিমের মত থাকবে!

কখনোই না! – ডিকেন একা একা বলে উঠল।

কি হলো? – ইরিন জানতে চাইলো।

কিছু না।

আমার কাছে বাবুকে দাও।

না থাকুক আমার কোলে।

এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিলো ডিকেন। বাচ্চাটা হাসছে, প্রায় সাত মাস হয়েছে, কখনো এভাবে এতক্ষণ বাচ্চাটা ধরা হয় নি। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ।

বাতাস চোখে লাগতে আর গাড়ির চলতে শুরু করতেই ঘুমিয়ে পড়ল ডিকেনের কোলে।

ইরিনের বিস্ময় কাটছেই না। তাহলে মায়ের কথাই ঠিক। ধৈর্য্য ধরলে স্বামীর মন ফেরে!

নাকি গতমাসেই সবেদা খালা যে চিনি পরার পায়েস দিলো, সেটা কাজ করছে!

কিন্তু ডিকেন কি খেয়েছিল! সেটাই তো মনে নেই!

ইরিন সাহস করে ডিকেনের হাতটা ধরল। ভাবল ডিকেন এখনি সরিয়ে দেবে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, ডিকেন সরিয়ে দিলো না।

চলবে

শানজানা আলম

উল্টোরথে-১৬

ইশিতা ভাবীর দুই বাচ্চাকে তিথি যত্ন করেই রাখল। বাসায় ফিরে দুই বাচ্চাকে শান্ত দেখে ইশিতার মন ভালো হয়ে গেল।

তিথি, তোমাকে ধন্যবাদ দিলে কম করা হবে বোন, বাচ্চা দুটোকে অনেক যত্ন করে রেখেছ- কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে ইশিতা ভোলে না।

আর তিথির শাশুড়ীও বিষয়টা খুব ভালো ভাবে নিলেন। থাকতেই পারে একটা মেয়ের কিছু অতীত। অতীত নিয়ে বসে থাকলে তো চলে না। বর্তমানে সে কেমন, সেটাই বড় বিষয়। পারভেজ ভালো আছে, পারভেজের কথা তিথি শুনে চলতেছে, এটাই অনেক। মেয়েটা সংসারী হওয়ারও চেষ্টা করছে।

ছোটো বৌমা, তোমাদের ওই বাসার সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয় নি একদিনও। একদিন ডাকো সবাইকে?

-পারভেজের মা বললেন।

তিথি অন্যমনস্ক হয়েছিল।

জি আচ্ছা, বলব।

সব কিছু করে তিথি, কিন্তু মনটা একটুও স্থির হয় না। পারভেজকে তার ভালো লাগে না। এই সংসারেও মন বসে না। কেবলি মনে হয় ভুল করেছে। ভুল তো আগেও করেছে, কি ই বা করার আছে! ডিকেন তো স্বীকার করল, সে পরিস্থিতির চাপে পড়ে গিয়েছিল। সিন ক্রিয়েট না করে তিথির ভালো ভাবে জানা দরকার ছিল! ডিকেনের চাইতে ওর বন্ধুকে বেশি বিশ্বাস করে গুরুত্ব দিলো!
মানুষ এই ভুলটা খুব করে, অন্যের কথায় গুরুত্ব দিয়ে নিজের কাছের মানুষটাকে ভুল বোঝে!

ডিকেন কেমন উত্তাল ছিল, সমুদ্রের মত! পারভেজ এমন হয় না! হলেও হয়তো তিথির মন ভরবে না।

পারভেজের প্রশ্নে হু হা করে উত্তর সারে তিথি।

তিথি, শপিং করবে?

না। কেন?

এমনিই, চলো তোমাকে কিছু থ্রিপিস কিনে দিই।

লাগবে না। তোমার ধারণা জামা কাপড় কিনে দিলেই মেয়েরা খুশি হয়?

না, সেরকম কিছু বলি নি।

তাহলে?

মনে হলো তাই বললাম আর কি! বাইরে কোথাও যাবে?

না।

তিথি বিষন্ন হয়ে থেকো না।

তিথি বলল, বিষণ্ন হয়ে থাকব কেন। আমি এরকমই!

না তুমি এরকম না৷

পারভেজ, একটা কথা বলি। আমি ভীষণ বাজে পরিস্থিতি পার করেছি জীবনে। হয়তো স্বার্থপরের মতো তোমাকে বিয়ে করেও নিয়েছি নিজের ভালোর জন্য। কিন্তু এই জীবনটা আমার নয়। এখানে মানিয়ে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছে।

তাহলে তুমি কি চেয়েছিলে?

জানি না!

তিথি নিজের অস্বস্তি দ্বিধা কাউকে বোঝাতে পারে না।

পারভেজ অন্যরুমে চলে গেল। তিথি ফোনটা হাতে নিয়ে ডিকেন কে কল করে ফেলল।

ডিকেন তখন ইরিন আর বাচ্চাকে নিয়ে রিসোর্টের মধ্যে হাঁটছে। তিথির ফোনটা দেখে অস্বস্তি লাগলেও সে কলটা কেটে দিলো!

তিথির কান্না পেলো খুব। ডিকেন এর সাথে আবার যোগাযোগ করাটা খুব একটা ভালো হয় নি! ওর একটা সংসার, বাচ্চা আছে। তাদের সরিয়ে কি তিথি ভালো থাকবে!
আচ্ছা মরে গেলে কী কষ্ট কমে! তাহলে তিথি মরে যেতে পারে না!

চলবে

শানজানা আলম

উল্টোরথে-১৭

সত্যি বলতে, ডিকেনের ইরিনকে ভালো লাগছে বা ভালোবাসতে পারছে তেমন না৷ তিথিকেই ভালো লাগে ডিকেনের। প্রথমে ভেবেছিল তিথি বিয়ে করে ফেলবে। তারপর জানলে তিথি হয়তো মেনে নিবে, বা তিথি কে তো ডিকেন ভালোবাসে, এটা হয়তো বুঝে যাবে।
সরাসরি বিয়ে করা সম্ভব ছিল না, কারণ ডিকেনের বিষয়ে তিথির পরিবার খোঁজ করলেই জেনে যাবে ইরিনের কথা।
তিথিকে তাই বলেছিল, চলো, আমরা কক্সবাজার চলে যাই। ওখানে বিয়ে করে তারপর বাসায় জানাই।
কক্সবাজারে ওরা চলে গিয়েছিল। তিথিও আপত্তি করে নি ডিকেনের সাথে থাকতে। ঝামেলা করল ডিকেনের বন্ধু।তিথিকে সবটা জানিয়ে দিলো।

এখন বাচ্চাটার জন্য খারাপ লাগতেছে এটাও সত্যি।
ডিকেন তাও ইরিনকে কথা বলার জন্য ডাকল।
ইরিন ঘুরছিল। তার মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল।
ডিকেন ডাকল বলে, বেশ খুশি মনেই চলে এলো।

আমাকে ডেকেছ?

হ্যা। কিছু কথা ছিল- ডিকেন বলল।

বলো।

বাবু কই?

আম্মার কাছে।

ইরিন তোমার তিথির কথা মনে আছে?

ইরিন একটু চমকে উঠল৷ কোন তিথি? ওই যে বাসায় এসেছিল, ওই মেয়েটা?

হ্যা।

মনে আছে? কি করেছে আবার?

কিছু করে নি। ইরিন তিথি যা বলেছিল সব সত্য। ওর সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল।

ইরিন স্তব্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণ কি ভেবেছিল, এখন ডিকেন কি বলবে?

সম্পর্ক ছিল, এখন নেই, এরকম কিছু?

না সেরকম কিছু না৷ আমি তিথির সাথে থাকতে চাই, মানে আমি তিথিকে বিয়ে করতে চাই।

ইরিন হতভম্ব হয়ে বলল, আমি তাহলে বাবুকে নিয়ে….

তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি আমার দায়িত্বে কোনো অবহেলা করব না। বাবুর সব দায়িত্ব আমি নিব।

মানে তুমি দুই বউ রাখবে?
-ইরিন যেন শক্ত হয়ে উঠল। এরকম আগে কখনো ইরিনকে দেখে নি ডিকেন।

ডিকেন উত্তর দিতে পারল না।

উত্তর দাও।

মানে আমি তোমাকে চলে যেতে বলব না কখনো। মা তোমাকে পছন্দ করে এনেছে, তুমি খুব ভালো মেয়ে।

ইরিন শক্ত ভাবে বলল, সতীন নিয়ে আমি সংসার করব না।
আমার মা এতদিন জোর করেছে বলে আমি চেষ্টা করেছি তোমার সংসারে সব মানিয়ে নেওয়ার। কিন্তু এতবড় অপমান আমি মেনে নিতে পারব না। তুমি ছাড়াছাড়ির ব্যবস্থা করো। আমি সই করে দেব।

ইরিন উত্তরের অপেক্ষা না করে চলো গেল। ডিকেন নির্বাক হয়ে বসে রইল। ইরিনের কাছ থেকে কান্নাকাটি আশা করেছিল কিন্তু এরকম কিছু হতে পারে সেটা সে ভাবে নি।

চলবে

শানজানা আলম