উল্টোরথে-১৮
পারভেজ তিথিকে বুঝতে পারছে না। তিথির কোনো বিষয়েই কোনো আগ্রহ নেই। পারভেজ ভেবেছিল হয়তো তিথি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। সংসারে মন দেবে। এত বড় একটা ঘটনার পরেও পারভেজ তিথিকে ভালোবেসে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। ওর মনের গভীরতা বা চাওয়া পারভেজ বুঝতে পারেনি। নিজের দুর্বলতাও বুঝতে পারে নি।
তিথি সব কিছুই করে কিন্তু কোনো কিছুতেই তার মুখে হাসি ফোটে না৷ মাঝে মাঝে ঝিম দিয়ে বসে থাকে।
তিথি, তুমি কি মন থেকে আমার সাথে থাকতে চাও না?
-পারভেজ জিজ্ঞেস করে ফেলল।
তিথি বলল, জানি না।
এটা কেমন উত্তর হলো তিথি। দিন পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তোমার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এভাবে কি সংসার হবে?
তিথি বলল, আমি তো আগেই বলেছিলাম, আমাকে দিয়ে সংসার হবে না।
হ্যা বলেছ, অস্বীকার করছি না। কিন্তু মানুষ কি বদলায় না?
তিথি উঠে দাঁড়াল। পারভেজকে তার অসহ্য লাগছে। কেন লাগছে, এই ছেলেটা তো তার কোনো ক্ষতি করেনি। অথচ ওকে দেখলেই তিথি অস্বস্তি হয়, রাগ লাগে।
তিথি, তুমি কিছুদিন তোমার বাবার বাসায় গিয়ে থেকে আসো।
পারভেজ, আমি এভাবে থাকতে পারছি না। আমাকে ছেড়ে দাও। ডিভোর্স দিয়ে দাও।
পারভেজ কিছুক্ষণ চুপ করে তিথির দিকে তাকিয়ে রইল।
তিথি, তোমার মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন। তুমি কি সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যেতে চাও?
তোমার আমাকে পাগল মনে হচ্ছে! –
মেন্টাল সাপোর্ট নিলে কেউ পাগল হয় না তিথি।
তিথি চুপ করে গেল। কোনো মানসিক সাপোর্ট লাগবে না। তিথির প্রয়োজন ডিকেন কে। ডিকেন কাছে থাকলে সে এই পৃথিবীর সব চাইতে সুখী মানুষ হয়ে যাবে। ডিকেন বলেছে, সে তার বউকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।
এরকম কি হয় না! কত বাঁধা, কত সমস্যার পরে দুজন এক হয়।
তিথি উঠে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। সে কিছুদিন বাবার বাসায় থাকবে। এখন তো আর সমস্যা নেই। কারো সাথে কথা না বললেও সমস্যা হবে না। এখানে দম বন্ধ লাগে।
তাছাড়া বের হতেও সুবিধা হবে। একশবার শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে বের হতে বিরক্ত লাগে।
পারভেজ একবার জিজ্ঞেস করল, সত্যি ওখানে গিয়ে থাকবে?
চলো কোথাও ঘুরে আসি!
তিথি মনে মনে বলল, তোমার সাথে স্বর্গে গেলেও ভালো থাকব না।
★★★
ইরিন বেশ ভালো রকম বদলে গেছে। ডিকেনের সামনে একেবারেই আসে না৷ যা প্রয়োজন হয় ছোটো বোনকে দিতে বলে না হয় কাজের মেয়েটাকে খাবার দিতে বলে। কয়েকদিনে ডিকেন হাঁপিয়ে উঠল। কি আশ্চর্য, যে মেয়েটাকে এত বিরক্ত লাগত৷ এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত, তার জন্য মন পোড়ে!
কেন! কেন এরকম হবে! তিথিকেও ফোন করতে ভালো লাগে না। তিথি বাবার বাসায় চলে গেছে। হয়তো বছরখানেক লাগবে সব গুছিয়ে তিথিকে বিয়ে করতে।
ডিকেন অবচেতন মনে ভাবল, একটা ভুল হয়ে গেছে, বিয়ের পরে তিথিকে নক করা উচিত হয় নি। এখন তো তিথিও মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলছে।
ওর জন্য সংসার ছেড়ে একরকম বের হয়ে এসেছে। তিথিকে তো ডিকেন ইগনোর করতে পারবে না। তাহলে, কি হবে!
এটাই ভাগ্য! ইরিনকে ছেড়ে দিয়ে, তিথিকে বিয়ে করবে ডিকেন! আগে তো এটাই চেয়েছিল, এখন আর এটা চাচ্ছে না কেন!
চলবে
শানজানা আলম
উল্টোরথে-১৯
রাতে খেতে বসেছে ডিকেন। ইরিন সামনে আসে নি।সামনে আসেও না একেবারে। ইরিনের বোন খাবার এগিয়ে দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে।
ডিকেন প্লেটে ভাত নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ।
ইরিন কোথায়? -ডিকেন জিজ্ঞেস করল।
আপু রুমে আছে।
বাবু কোথায়? বাবু আম্মার কাছে।
ইরিন রুমে একা?
হ্যা ভাইয়া। আপনাকে মাছ দেই।
না দরকার নাই। ইরিন খেয়েছে?
আর বলবেন না। তিন চারদিন ধরে তো ভাত খেতে পারছে না।
ডিকেন উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে রুমে ঢুকল। ঢুকে ইরিনের রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।
ইরিন বসে ছিল। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
ইরিন, কী শুরু করেছ? চলো খাবে আমার সাথে।
ইরিন উত্তর দিলো না।
ইরিন, প্লিজ, এরকম চুপ করে থেকো না।
ইরিন শান্ত স্বরে বলল, আমার কি তাহলে খুব খুশি হয়ে খাওয়া দাওয়া করা উচিৎ? আমার জায়ায় তুমি হলে তাই করতে?
ডিকেন বলল, আমার কথা শুনো, আমাকে একটু সময় দাও, আমি সব…
ইরিন বিদ্রুপ করে বলল, সব ঠিক করে ফেলবে?
তাই তো!
ডিকেন বলল, ইরিন, আমি একটা প্যাচে পড়ে গেছি। প্লিজ তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।
আমি তো তোমাকে কোনো প্যাচে ফেলে দিই নাই।
আমি চলে যাব। কয়েকটা দিন সময় চাই, আমার তো মা বাপ আছে, তাদের বুঝতে হবে।
আমি তোমাকে যেতে দিব না- ডিকেন বলল।
কিন্তু আমি তো থাকব না-ইরিন বলল।
যেখানে সবটা দিয়েও এক টুকরো কিছু প্রতিদানে পাওয়া যায় না বরং অপমান আর লাঞ্চনা প্রতিদিন, আমি কিছুতেই সেখানে থাকব না। ডিকেন ইরিনের কাছে গিয়ে ইরিনকে জড়িয়ে ধরল।
প্লিজ, এইভাবে বলো না। তোমাকে আমি সব কিছু খুলে বলব, তুমি বুঝতে পারবে আমি জানি৷
ইরিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, কিন্তু পারল না। ডিকেন শক্ত করে ওকে ধরে আছে।
ইরিন বলল, আমি আর এই সংসার করতে চাই না। এতদিন আসলে আমি থাকতামও না। আমার মা বারবার বলতেন, ভালোবাসলে সবার মন ফেরে। আমি ভালোবাসতেই পারি নাই। নাহলে আমার স্বামীর মনে অন্য একটা মেয়ে! তার সাথে কিনা….. ছি ছি, আমি ভাবতেও পারছি না। আগে তুমি আমার গায়ে হাত দিলে আমার মনটা খুশি হয়ে যেত। এখন আমার ঘেন্না লাগতেছে।
ডিকেন ইরিনকে ছেড়ে দিলো।
আমাকো এত নিকৃষ্ট মনে করো তুমি! আমি ধরলে তোমার ঘেন্না লাগতেছে! এত বড় কথা তুমি আমাকে বলতে পারলে!
এর চাইতে অনেক বড় অপমানজনক কথা তুমি আমাকে বলেছ। যে কয়টা দিন আছি তুমি আমার এই ঘরে ঢুকবে না। আমি কোনো ঝামেলা করব না। চুপচাপ চলে যাব, তুমি চুপচাপ ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে।
এখন এই ঘর থেকে যাও!
ডিকেন কিছুক্ষণ ইরিনের দিকে তাকিয়ে রইল। এই সেই ইরিন, যে সারাক্ষণ ওর পিছনে ঘুরঘুর করত! ও একটু কাছে ডাকলে খুশিতে চোখ মুখ ঝলমল করত! ডিকেন মেলাতে পারছে না।
আমি এই রুম থেকে চলে যেতে বলেছি। তুমি না গেলে আমিই যাচ্ছি।
ডিকেন বের হয়ে গেল। খাবার প্লেটে মাছি পড়েছে, বলদ মেয়ে ঢেকে রাখে নি৷ ইচ্ছে করছে ছুড়ে ফেলে দিতে কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না।
ডিকেনের ফোন বাজছে, তিথি ফোন করছে, ডিকেন ফোন কেটে দিলো। অসহ্য লাগতেছে, এত সারাদিন ফোন করার কি আছে! একবার তো বলেছে, ব্যবস্থা হলে জানাবে!
ডিকেন ভাবল, তিথির প্রতি সেই ভালোবাসা বা টান এখন সেটা কোথায় গেল! এখন তিথিকে এত অসহ্য লাগছে কেন!
★★★
তিথি বাবার বাসায় আছে। এখন ওর সাথে সবাই আগের মত ভালো ভাবেই কথা বলছে। তাই থাকতে সমস্যা হচ্ছে না। তিথি ভাবছে, সবাই তিনমাস যে খারাপ আচরন করেছে, সেটা রাতারাতি ঠিক হওয়ার কারন হচ্ছে পারভেজের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে বা পরোক্ষভাবে পারভেজ। তিথি আবার চলে এলে বা ডিকেনকে বিয়ে করলে তখন কি হবে?
তিথি বসে বসে কিছু চাকরির জন্য এপ্লাই করে ফেলেছে। টাকার জন্য কারো কাছে হাত পাতা খুবই অসম্মানের। তিথি নিজে একটা কিছু করতে পারলে বেশি ভালো হবে। তাছাড়া ডিকেনের সাথে থাকলেও তো খরচ থাকবে! ডিকেন কি নিজের সংসারে টাকা না দিয়ে পারবে! তার চাইতে ভালো তিথির নিজের কিছু হোক!
এতদিন তিথি ভেবেছে কারো সংসার ভাঙবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এরকম তো কত হয়, হয় না! সবার জীবন তো সোজা সরল হয় না! ডিকেন ওর সাথে থাকলেই হলো।
তবে ডিকেনকে তিথি বুঝতে পারছে না। আজকাল একদমই কথা বলতে চায় না। চারবার ফোন করলে তিনবারই কেটে দিচ্ছে। তাহলে তিথি কাকে বিয়ে করার কথা ভাবছে!
এত চিন্তার মাঝে কখনো পারভেজের কথা তিথির মনে হয় না! অদ্ভুত!
চলবে
শানজানা আলম