উল্টোরথে পর্ব-৩+৪+৫

0
237

উল্টোরথে-৩
দুদিন কেটে গেছে। তিথি ভালো আছে মনে হচ্ছে। কেউ ওকে বিরক্ত করে না। অবশ্য কথাও বলে না অপ্রয়োজনীয়। সকালে পারভেজ অফিসে চলে যায়। তিথি এই দুদিন ওঠে নি, ঘুম ভেঙে গেছে, তাও ওঠে নি। ফেরে রাত নয়টার পরে। তখন তিথি ফোন স্ক্রল করে। পারভেজ চলে যাওয়র পরে নয়টার দিকে কাজের বুয়া এসে ব্রেকফাস্ট করতে ডাকে। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। তিথি খাবার সময় ওর জা পাশে থাকে, কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে চলে যায়, সেটা আন্তরিকতা বিহীন।

দুপুরেও সেম অবস্থা। ভাসুরের লাঞ্চ দিতে হয়। ভাবী খাওয়ার সময় পায় না বাচ্চাদের খাইয়ে বসে একফাঁকে খেয়ে নেয়। শাশুড়ীর সুগার আছে, সোয়া একটার দিকে সে খায়। দুপুরে দুইটার পরে কাজের বুয়া আবার ডাকে, তিথি খেয়ে নেয়। মোটামুটি মনে হচ্ছে তিথি বেড়াতে এসেছে।
কোনো ঝামেলা নেই, এরকম।

তিথি অনার্স শেষ করে এমবিএ ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, এখন আর মনে হয় হবে না। মাস্টার্সে একদিনও কলেজে যায় নি। পরীক্ষার এখনো বেশ বাকি আছে। একটু খোঁজ খবর নেওয়া যেতে পারে।

এবাড়ি থেকে বের হতে কি কারো অনুমতি নিতে হবে?
তিথি কার কাছ থেকে অনুমতি নেবে!
পারভেজকে তাই রাতে বলল, আমার কিছু কাজকর্ম আছে বাইরে।

পারভেজ বলল, মাকে বলে যেও।

আর কোনো কথা হলো না, সপ্তাহখানেক পরে তিথি নাস্তা করার পরে শাশুড়ীর ঘরে গিয়ে নক করল।

তিথি, আসো ভেতরে আসো।

আন্টি আমি একটু বাইরে যাব।

পারভেজের মা বললেন, কোথায় যাবা? তোমাদের বাসায়?

জি না, আমার কলেজে। মনে মনে বলে ফেলল, তাতে আপনার কি দরকার!

আচ্ছা। পারভেজকে বলছ?

তিথি মনে মনে বলল, আমার তো ঠেকা পড়ছে, জনে জনে অনুমতি নিব!

মুখে বলল, বলছিলাম গত সপ্তাহে। আপনাকে বলে যেতে বলল।

আচ্ছা, তাড়াতাড়ি ফিরো।

কেন, কোনো কাজ আছে?

না কোনো কাজ নাই। বাইরে কাজ না থাকলে থাকার দরকার কি!

তিথির রাগ ধরে গেল। ভেবেছিল, সারাদিন বাইরে থাকবে। তাও এখনকার অবস্থা আগের চাইতে বেশ ভালো। ব্যাগে মনে হয় তিনশ টাকা আছে, এই টাকা দিয়ে খুব বেশি থাকা যাবে না বাইরে। যাই হোক, ঢাকা শহরে খালি ব্যাগে ফকির মিসকিনও থাকে না।

তিথি বের হতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলে দুই হাজার টাকা পেল। একটা কাগজে লেখা, তিথির জন্য।

তিথির মেজাজ আবারও খারাপ হলো, ও কি ফকির নাকি!
ওর জন্য টাকা রেখে গেছে, কিন্তু এখন ঝগড়া করতে ইচ্ছে করল না। তৈরি হয়ে রুম থেকেবের হলো, টাকাটা নিলো না সাথে।

পরে মনে হলো, জেদ করা ঠিক হবে না। কারো না কারো হেল্প তো তিথির লাগতোই, বাইরে গিয়ে হয়তো কারো কাছে ধারই চাইত।

পরে টাকাটা ব্যাগে ভরে বের হয়ে গেল।

চলবে

শানজানা আলম

উল্টোরথে-৪
কলেজের দিকে বের হয়ে তিথির একটু হালকা লাগল। এতগুলো দিন বাসায় দম বন্ধ অবস্থা। ডিকেনের সাথে পরিচয়টা বছর দুয়েকের বেশিই ছিল। তিথি দুই বছরে একবারো বুঝতে পারে নি, ওর সাথে আলাপ হওয়ার পরেই ডিকেন বিয়ে করেছে, বউ নিয়ে বিদেশে গিয়েছে, হানিমুনে।

এতটা কিভাবে পারে ছেলেরা! তিথির মত শক্ত, বেপরোয়া মেয়ের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে নরম মেয়েগুলো তো মরে যাওয়ার দশা!

ডিকেন ছিল রোজির ফেসবুক ফ্রেন্ড। ফেসবুক থেকে আলাপের পরে একদিন দেখা করতে চাইল রোজির সাথে৷ রোজি তিথি আর সপ্নাকে জোর করে সাথে নিয়ে গেল, ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে।

ডিকেন একাই এসেছিল, বেশ খানিকটা লম্বা, পোশাকে বেশ কেতাদুরস্ত। একটা সানগ্লাস পরা।তিথির দেখেই ভালো লেগেছিল তবে কাউকে এভাবে ভালো লাগতে পারে তিথি সেটা বোঝেই নি।

ডিকেন বেশ বুদ্ধিমান, তিথির মুগ্ধ দৃষ্টি তার চোখ এড়িয়ে যায় নি।

কি অবস্থা!

রোজিকে প্রশ্ন করলেও মিটিমিটি হাসছিল তিথির দিকে তাকিয়ে।

তিথি অন্যদিকে তাকালেও কয়েকবার ডিকেনের দিকে দেখেছে, আর প্রতিবারই দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে।

রোজি, তোমরা কি খাবে বলো?

তিথি কিছুই নিলো না। ওরা পাস্তা, কোল্ড ড্রিংক নিলো। ডিকেন উঠে গিয়ে তিথির জন্য একটা জুস নিয়ে এলো।

শেষে বের হওয়ার সময়, ডিকেন সবার সামনেই তিথিকে জিজ্ঞেস করল, আপনার ফেসবুক আইডিতে রিকোয়েস্ট পাঠালে আপনি কি মাইন্ড করবেন?

রোজি বলল, কেউই মাইন্ড করবে না। তার তিথি অন্যরকম মেয়ে।

অন্যরকম? মানে কি রকম?

এই প্রেম বিয়ে ডেট এগুলো নিয়ে ও খুব একটা আগ্রহী না।

পুরোটা সময় তিথি কোনো কথা বলে নি। কিন্তু তিথি ভীষণ অবাক হয়েছিল, যখন রাতেই ডিকেন ওকে ফোন করল। শুধু প্রথমবার ফোনেই তিথি ৪০ মিনিট কথা বলেছিল।

তিথি ডিকেনকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিল! আর কক্সবাজারে… থাক সেসব কথা মনে করতেও অস্বস্তি লাগছে। পারভেজকে কেন মিথ্যা বলল প্রথমদিন! তিথি তো এমন না! নিজেকে খুব সতী প্রমাণ করার কি দরকার ছিল! পারভেজকে তো ও ভালোবাসেনি। এখন অবধি বাসে নি। সারাক্ষণই মনে হচ্ছে বাড়ি ছাড়া থেকে এখনকার সময় অবধি সবটাই দুঃস্বপ্ন। এখনি ডিকেন আসবে, এসে ওকে আগের মতোই ভালোবাসি বলবে। বাকি সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে তখন।

চলবে

শানজানা আলম

উল্টোরথে-৫

কলেজে ঢুকে অফিসের কাজগুলো শেষ করল তিথি। দুই মাসের বেতন বাকি ছিল, সেটা দিয়ে দিলো। অফিস থেকে বের হতেই রোজির সাথে দেখা। রোজি ওকে দেখে বাঁকা হাসি হেসে জানতে চাইল, তারপর, কেমন কাটছে নতুন জীবন!

তিথি বলল, ভালো। তোর কি খবর?

রোজি সরাসরি বলল, ডিকেনের সাথে প্রেম করার শখ মিটল? বড় চাকরি করে দেখে ঝুলে পড়তে চেয়েছিলি তাই না!

তিথি বিব্রত হলেও বলল, আমার স্বামী ডিকেনের চাইতেও বড় চাকরি করে।

তাহলে আর কি! ডিকেন কি একেবারে খেয়ে ছেড়ে দিছে তোকে? কক্সবাজার গিয়েছিলি ওর সাথে?

তিথি বলল, এত বিশ্রী ভাষায় তুই কথা বলতে পারিস, জানতাম না। তোর তো বরং খুশি হওয়া উচিৎ, যে বিপদ আমার হয়েছে, সেটা তোর হতে পারত!

রোজি চুপ করে গেল। তিথির কথা মিথ্যা না। ডিকেন কে রোজি খুবই পছন্দ করে। এখনো করে, ডিকেনের খরচের হাত বেশ ভালো। ফ্রেন্ডশিপ থাকা অবস্থায় অনেক শপিং করে দিয়েছে রোজিকে। তিথির সাথে এ্যাফেয়ারে জড়িয়ে গেল তারপর দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল।
ডিকেন যে বিয়ে করেছে, সেটা শুনেছে ওর আরেক বন্ধুর কাছ থেকে। তিথি কথাও সেই বলেছে। তিথির সাথে সম্পর্কের কথা ডিকেন বলেছিল।

তাও কত নাটক করে, রোজি আমি জানি তুমি খুশি হবে, তোমরা ভালো বন্ধু। তবু তিথি আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছে তোমাকে জানাতে। সেই থেকে তিথিকে দুই চক্ষে দেখতে পারে না রোজি৷

তিথি কলেজ থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগল। ব্যস্ত সড়কে বড় বড় প্রাচীন গাছগুলোর নিচ বাঁধানো। দুই পাশে অনেকে বসে গল্প করছে। কেউ প্রেমিক প্রেমিকা কেউ বন্ধু!
হাত ধরাধরি করেও বসেছে৷

তিথির বিষন্ন লাগতে শুরু করল। ডিকেন একদিন বৃষ্টির মধ্যে এসেছিল অফিস থেকে। লাঞ্চ আওয়ার চলছিল। একটা শেডের নিচে দাঁড়িয়ে তিথিকে বলেছিল, তিথি, একটু আসতে পারবে? জরুরি দরকার।

তিথি জরুরি প্রয়োজনটা বুঝতে পারে নি। ক্লাশ শেষ না করেই বের হয়ে গেল।

ডিকেন একটা গোলাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তিথিকে দেখে বলল, তিথি, আমার তোমাকে খুব ভালোলাগে। আই লাভ ইউ!

তিথি বলল, মানে?

হ্যা বা না কিছু একটা বলো।

এভাবে বলা যায়?

যাবে না কেন? না বললে আর কখনো ফোন করব না। ডাকবও না। প্রমিজ!

তিথির এটা ভাবতে কষ্ট হলো, ডিকেন আর যোগাযোগ রাখবে না! তাই একটু চুপ করে থেকে বলল, হ্যা!

এই সব জ্যাম, ভীড় সব উপেক্ষা করে ডিকেন তিথিকে জড়িয়ে ধরল।

তিথি বলল, কি হচ্ছে এসব, ছাড়ো!

তিথি, তোমাকে একটা চুমু খাই? প্লিজ – তিথিকে না ছেড়েই ডিকেন বলল।

তিথি শরীর কেঁপে উঠেছিল তিরতির করে!

প্রথম অনুভূতি! কি অদ্ভুত ছিল!

না প্রথম চুমু সেদিন খায় নি ডিকেন। তিথির জড়তায় সরে গিয়ে হাত দিয়ে ভেজা কপালের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বলেছিল, সহজ হও, আমি এতটা খারাপ না। তুমি যেদিন সহজ হয়ে চুমু খেতে চাইবে, সেদিনই হবে। কি অভিনয় জানে ছেলেটা!
হিসেব করে দেখেছে তিথি, ডিকেন তখন বিয়ে করে ফেলেছে!

ডিকেন অতোটাও খারাপ ছিল না। কিন্তু তার চাইতেও অনেক বেশি খারাপ ছিল!

চলবে

শানজানা আলম