উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
197

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৩
_________________

বদ্ধ একটা ঘরে ইরতিজাকে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো আততায়ী লোকটা। ইরতিজা সমানপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল লোকটার থেকে। লোকটার শক্তি খানিক দুর্বল হয়ে পড়লেই ইরতিজা সুযোগটা হাত ছাড়া করলো না। মুখে চেপে ধরে হাতটা সরিয়ে দিয়ে পিছন ঘুরেই আকস্মিক লোকটার পেটে খুব জোরে একটা ঘু/সি মারলো। লোকটা ব্যথায় কুকিয়ে গেল। পেট চেপে নুয়ে পড়লো হাঁটুর দিকে।
ইরতিজা কয়েক পা পিছিয়ে দূরে সরে এলো। উষ্ণ ভারী শ্বাস আতঙ্ক নিয়ে বেরিয়ে আসছে। মুখটা মলিন, ভয়ার্ত! সে চাইলে এখান থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু কী যেন একটা তাকে ঠাঁয় দাঁড় করিয়ে রাখছে।
নুয়ে পড়া লোকটা পেট চেপে রেখেই চোখ তুলে সামনে ইরতিজাকে দেখলো। তার মুখে লেগে আছে অদ্ভুত হাসি।
হাসিমাখা পরিচিত মুখটা দেখে ইরতিজার চোখে-মুখে খুব যত্ন সহকারে বিস্ময় খচিত হলো। হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেল যেন। সম্মুখের মানুষটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
“হাউ আর ইউ টিজা?”

ইরতিজার ওষ্ঠাধর একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন। সামনের দৃশ্যটাকে সে দৃষ্টি ভ্রম ব্যতীত অন্য কিছু ভাবতে পারলো না। তার দুর্বোধ্য মন ইদানিং কি চোখের উপরও প্রভাব ফেলছে? ইরতিজা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে চোখ খিঁচে ধরলো। মস্তিষ্কেও হালকা ব্যথার উপস্থিতি উপলব্ধি করছে। দুই হাতের আঙুলের ডগা দিয়ে মাথা চেপে ধরলো সে। সহসা গালে অনুভব করলো কারো আলতো অঙ্গুলি স্পর্শ। চোখের পাতা কম্পমান হয়ে খুলে গেল তার। পরিচিত নীল চোখে চোখ পড়লো প্রথমেই। থমকে যাওয়া হৃদয়ের স্পন্দন এবার উন্মাদিনী ঝড়ের মতো বয়ে চললো নিজ গতিতে। আননে অবিশ্বাসের গাঢ় লেপন প্রভাব ফেলে আছে। সামনের মানুষটা তা অবলোকন করে শান্ত সুরে বললো,
“কী ভাবছো টিজা? এটা আমি, জোনাস। এটা আমি, তোমাকে লুকিয়ে-চুরিয়ে যাকে ভালোবাসে তোমার মন! ইটস মি টিজা, ইটস মি…”

ইরতিজা বাকরুদ্ধ, অভিভূত! জোনাসের শীতল হাতদুটি তার উষ্ণ কপোল জড়িয়ে রেখেছে। হৃদয় ক্রন্দনের সুরে মেতে ওঠার র‍্যালিতে যোগদানের জন্য তীব্র প্রয়াস চালাচ্ছে। তার সামনে কি সত্যিই জোনাস দাঁড়িয়ে আছে? কাদঁতে ইচ্ছা করছে ইরতিজার। ইচ্ছা করছে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় জোনাসের নরম গালখানি। কিন্তু আবেগ সরে গিয়ে বিবেকের বস্তুটি নড়ে উঠলো। জোনাসের হাত সরিয়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল সে।

“তুমি এখানে কেন? কীভাবে এসেছো?”

জোনাস এক পা এগিয়ে এসে শুধালো,
“এর জন্য পুরোপুরি তুমি দায়ী। আমাকে এত স্মরণ কর যে, ওই স্মরণের টানে আমি না এসে থাকতে পারলাম না। তাই ছুটে এলাম, তোমায় দেখতে এলাম সুইটহার্ট!”

জোনাসের কথায় ভুল মিশে আছে। না, ইরতিজা তাকে খুব বেশি স্মরণ তো করেনি। আজ এবং গতকাল সময়টার এক অংশেও তার জোনাসের কথা মনে পড়েনি। সেই যে জোনাস ড্রিংকস করে কল দিয়েছিল, সেদিন কল কেটে দেওয়ার পর সকাল হতেই আর জোনাসের কথা মনে আসেনি তার। এর মানে জোনাস ভুল। সব সময়ই জোনাস ভুল ছিল! ইরতিজা তাকে ভালোবাসে এ ভাবনা তার ভুল। মনে বিরাজমান কথাটুকু মুখে ফুঁটে উঠলো ইরতিজার,
“তুমি ভুল জন। সব সময়ই তুমি ভুল!”

ইরতিজার আর ধৈর্য হলো না এখানে থাকার। হৃদয় মোচড়ানো কষ্টের তিক্ত অনুভূতি সহ্য করার শক্তি তার মাঝে বিদ্যমান নেই। জোনাস নামের ঘৃণিত মানুষটার কাছ থেকে যত দূরে সরে যাবে ততই সে শান্ত নিঃশ্বাস নিতে পারবে। ইরতিজা পিছন ঘুরলো স্থান ত্যাগের জন্য। দুই পা সামনে এগিয়েছে কি এর মাঝেই জোনাস এসে সামনে দাঁড়ালো। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“তুমি কোথাও যেতে পারবে না।”

“আমাকে আটকানোর শক্তি তোমার নেই।”

জোনাস ইরতিজার হাত ধরে টেনে ওকে কাছে নিয়ে এলো। ইরতিজার চোখে কিছু একটা হাতড়ে বেড়ালো নিপুণ ভাবে। ধীরে ধীরে তার চোখের কার্নিশে পানি জমলো। নীল চোখের উপর ভাসতে লাগলো স্বচ্ছ জল। ঠোঁট টেনে হাসলো সে। বললো,
“আমি তোমাকে কেন ভালোবাসি টিজা?”

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো ইরতিজার। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল সে। কারণহীন অশ্রু জমলো তার চোখেও। দুই জোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ তাকিয়ে রইল একে অপরের দিকে নির্নিমেষ। কিছু সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর ইরতিজা বললো,
“ভালোবাসা নয়, তুমি আমাকে ঘৃণা করো।”

জোনাস শব্দ করে হেসে বললো,
“ঠিক বলেছো টিজা, আমি তোমাকে ঘৃণা করি। প্রচণ্ড ঘৃণা করি! এত ঘৃণা আর কাউকে করি না, করিনি।”

‘ঘৃণা’ শব্দ জড়িত কথাগুলো শুনতে ইরতিজার হৃদয় ক্ষয় হলো। সত্যিই জোনাস তাকে এতটা ঘৃণা করে? এটা কি শুধু মুখেই বলছে? না কি আসলেই সে জোনাসের মনে ঘৃণার সর্বোচ্চ বৃহৎ স্তর জুড়ে আছে?
ভাবনার মাঝেই শুনতে পেল জোনাসের কণ্ঠস্বর,
“শুধু তোমার জন্য নিউ ইয়র্ক থেকে রেডমন্ড ছুটে এসেছি আমি। আর তুমি আমার কাছ থেকে ছুটে যেতে চাইলেই তো আমি তোমাকে যেতে দেবো না। আগামীকাল সকাল পর্যন্ত এখানে আছি আমি। এখন থেকে ঠিক সকাল পর্যন্ত আমার সাথে থাকা উচিত তোমার। না হলে যে ছুটে দেখতে আসার যথোপযুক্ত মর্যাদা অর্জিত হবে না।”

জোনাসের কথার প্রত্যুত্তর করলো না ইরতিজা। ঘরটার উপর চোখ বুলিয়ে বললো,
“এটা কোথায়?”

“তোমাদের এরিয়ারই একটা বাসা এটা। আজ রাত এখানেই থাকবো।”

“রেডমন্ড আসা উচিত হয়নি তোমার। সরো সামনে থেকে।”

“তোমাকে আটকে রাখতে চাইলেও আমি আটকাতে পারি না।”
জোনাস সরে গেল দরজার সামনে থেকে,
“যাও।”

ইরতিজা পা বাড়ালো। দরজা অতিক্রম করতে নিলে জোনাস বললো,
“সকালে একবার দেখা করতে আসবে। সেটাই হবে আমাদের শেষ দেখা। তুমি তো জানো টিজা, তোমায় আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করি!”

জোনাস ঘরের ওদিকটায় অগ্রসর হলো। ইরতিজা তাকিয়ে রইল অনিমেষ। হৃদয় ভারী বিষাক্ত মনে হলো তার। বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। বাইরের পরিবেশটা তার পরিচিত। তাদের বাসা থেকে এই জায়গাটা কিছুটা দূরে।

_______________

প্রকৃতি তিমিরাছন্ন। জ্বলে গিয়েছে শহরের বুকে থাকা সকল কৃত্রিম আলোর উৎস। মানুষের ব্যস্ততা এখনও চলছে। কেউ একটু সময় বসে নেই। চালিয়ে যাচ্ছে নিজ নিজ কাজ। ক্যানিয়ল মিরান্ডার এপার্টমেন্টের পার্কিং লটে আছে। মিরান্ডাকে নিয়ে বাড়িতে যাবে। ড্যাড স্বয়ং নিজে আদেশ দিয়েছেন যেন সে মিরান্ডাকে নিয়ে বাড়িতে আসে। খানা-পিনার ব্যবস্থা আছে। মিরান্ডার ড্যাড এলজেকেও তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রন করা হয়েছে। সে এতক্ষণে চলে গিয়েছে বোধহয়। মিরান্ডা কখন গাড়িতে এসে বসেছে খেয়াল করেনি ক্যানিয়ল। মিরান্ডার কণ্ঠে তার আনমনা কাটলো,
“লেট’স গো।”

ক্যানিয়ল পাশ ফিরে তাকালো। মিরান্ডাকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করলো সে। মিরান্ডার মুখে গাঢ় মেকআপ। পরনে ব্যালে ড্যান্স ড্রেস। ক্যানিয়ল প্রশ্ন করলো,
“কোথাও শো ছিল? এমন সাজসজ্জায় আছো কেন?”

“ছিল শো। সেখান থেকে ফেরার পথেই তোমার কল পেয়েছিলাম। বাসায় এসে চেঞ্জ করার সময় হয়নি।”

“তো এখন তুমি এই পোশাকে যাবে?”

“কেন সুন্দর লাগছে না?”

ক্যানিয়ল হেসে বললো,
“ফেইরি!”

“কী?”

ক্যানিয়ল গাড়ি স্টার্ট করে বের হলো পার্কিং লট থেকে। মিরান্ডার মুখ কালো থেকে অধিক কালো হয়ে চললো। এক সময় গম্ভীর স্বরে বললো,
“নেক্সট উইকে ইংল্যান্ড যেতে হবে আমার।”

“কেন?”

“ওখানে বিরাট আয়োজন করা হবে। পার্টিসিপেট করতে হবে। কয়েক মাস গিয়ে থাকতে হবে ওখানে।”

“ভালো।”

“ভালো? আমি কয়েক মাসের জন্য ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছি তোমার খারাপ লাগছে না?”

“খারাপ কেন লাগবে? আমার ফেমাস উডবি ওয়াইফ আরও ফেমাস হয়ে দেশে ফিরবে, আমার তো খুশি হওয়া উচিত।”
ক্যানিয়ল হাসতে লাগলো।
মিরান্ডা তাতে সঙ্গ দিলো না। তার যেতে ইচ্ছা করছে না ইংল্যান্ড। কিন্তু না গিয়ে উপায় নেই।

খাবার টেবিলে সবাই বসলেও ক্যানিয়ল বসলো না। সে বাড়ির সামনে লনে এসে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো। আজ বিকেলে বৃষ্টি হয়েছিল, শীত আংশিক বেশি নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। তার হাতে সফট ড্রিঙ্কসের বোতল। হাঁটতে হাঁটতে চুমুক দিচ্ছে বোতলে। বেলা লিমাস! মহিলাটা আজ মি. হেনরির কাছে তার জন্য বার্থডে গিফট পাঠিয়েছিল। আজ তার বার্থডে কথাটা হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছে। এ বাড়িতে বার্থডে পালিত হয় না বলে সবাই-ই কথাটা ভুলে বসেছে। সবাই যেখানে ভুলে বসেছে, সেখানে বেলা লিমাস কীভাবে কথাটা মনে রাখছে এখনও? হয়তো ছেলেটা তার মাধ্যমে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বলে সে দিনটার কথা অতি যত্ন সহকারে মনে রেখেছে। গিফট বক্সটা হাতে পেয়েছিল বিকালে। গিফটটার সাথে জড়িয়ে আছে তার অতীত। ছোটো বেলায় তার মম তার এবং নিজের একটা ছবি পেইন্টিং করতে নিয়েছিল। কিন্তু সেই ছবি আঁকা ছিল অসমাপ্ত। ছবিটা আঁকা সম্পূর্ণ করার আগেই তার মম চলে গিয়েছিল! আজ বহু বছর পর সেই অসমাপ্ত ছবিটা তার কাছে সম্পূর্ণ রূপে এসে পৌঁছালো। ছবিটার সাথে একটা ছোটো চিরকুটও দিয়েছে বেলা লিমাস।

‘হ্যাপি বার্থডে ক্যানিয়ল! তুমি সুখী একটা জীবনে আছো। দোয়া করি সারা জীবন তোমার জীবন এমনই কাটুক। ভালোবাসা মাই ডিয়ার!
ছবিটা অনেক বছর আগেই আঁকা সম্পন্ন হয়েছিল। তোমাকে দেবো দেবো করে দেওয়া হয় ওঠেনি। আজ দিলাম। মনে হলো ছবিটা তোমার কাছেই থাকা উচিত। মমকে ঘৃণা করো না। মম তোমায় ভালোবাসে!’

ক্যানিয়লের চোখে বিন্দু বিন্দু পানিকণা জমে উঠলো। শ্লেষাত্মক হেসে বললো,
“তুমি ভালোবাসার যোগ্য নও মিস বেলা লিমাস!”

এক চুমুকে পুরো বোতল শেষ করে ফেললো ক্যানিয়ল। লনে থাকা চেয়ারে বসে চোখ বুজলো। বন্ধ চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল। খানিকক্ষণ বাদে বাবার ডাকে চোখ খুললো সে,
“উমরান!”

মুহাম্মদ ইসহাক ক্যানিয়লের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখে হেলিয়ে দেওয়া মাথা সোজা করে বসলো ক্যানিয়ল। মুহাম্মদ ইসহাক ছেলের পাশে বসলেন। মানুষটার চুল এবং দাঁড়িতে কালো-সাদার সংমিশ্রণ। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। সুঠাম দেহের অধিকারী। শান্ত বিনীত কণ্ঠে বললেন,
“কিছু হয়েছে?”

“কী হবে?” বাবার চোখে চোখ রেখে বললো ক্যানিয়ল।

“কেউ কি তোমার দ্বারা গুরুতর আঘাত পেয়েছে আজকে?”

“না।”

“তাহলে এরকম বসে আছো কেন?”

“আমার কিছুই হয়নি ড্যাড।”

বাবার চোখে চোখ রেখে থাকতে পারলো না ক্যানিয়ল। চোখ জ্বালা করছিল জল ঝরানোর জন্য।

“তোমার মমের সাথে আজ দেখা হয়েছিল তোমার? জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে?”

ক্যানিয়ল বসা থেকে দ্রুত দাঁড়িয়ে বললো,
“আমার কোনো মম নেই! কখনও ছিলও না! কারো শুভেচ্ছা চাই না আমি।”

ক্যানিয়ল ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কতক দূর গিয়ে থামলো আবার। বললো,
“একটা পেইন্টিং দিয়েছিল, ছুরি দিয়ে কেটে ফেলেছি!”

দ্রুত পদে হেঁটে ঘরের অভ্যন্তরে ঢুকে গেল ক্যানিয়ল।

মুহাম্মদ ইসহাক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

________________

ইরতিজার মন ভালো নেই। পরনে সবুজ শাড়ি। উদাসী দৃষ্টি মেলে আছে আকাশে। হিমেল হাওয়া পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে যত্ন করে। গায়ে কোনো শীতবস্ত্র নেই। ঠান্ডা লাগছে বৈ কি, তবুও শীত পোশাক পরবে না। তার মনে জোনাসের চিন্তা বিরাজ করছে। জোনাস সত্যি সত্যি রেডমন্ড এলো? কাল কি সত্যিই চলে যাবে?

“টেইক ইট।” পাশ থেকে সাজিদের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে তাকালো ইরতিজা।

স্টারবাক্স থেকে কফি নিয়ে এসেছে সাজিদ। জোনাসের ওখান থেকে বাসায় আসার পর সাজিদকে উপস্থিত দেখতে পেয়েছে।
সাজিদ বাইরে ঘুরতে নিয়ে আসবে বললো। বাস, মা একটা শাড়ি পরিয়ে পাঠিয়ে দিলো।
ইরতিজা কফি নিলো। সাজিদ বললো,
“শীত লাগছে তোমার?”

“লাগছে বললে কি আপনার গায়ের কোট খুলে আমাকে দেবেন?”

“এটা কখনোই করবো না।”

সাজিদ গাড়ির দরজা খুলে ভিতর থেকে ইরতিজার ওভার কোটটা বের করলো। ইরতিজার মাথায় দিয়ে বললো,
“রোবট মেয়ে আপনি, শীতও লাগে না আপনার।”

ইরতিজা কোট পরে নিলো। এতক্ষণের শীত থেকে নিস্তার পেল শরীর। কফির মগে চুমুক দেওয়াকালীন শুনলো সাজিদ বলছে,
“আপনার প্রেমিক রেডমন্ড এসেছে দেখলাম!”

ইরতিজা ভীষণ রকম চমকে উঠলো।

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৪
_________________

“কী বললেন?”

“আপনার প্রেমিককে রেডমন্ডে দেখেছি!”

দ্বিতীয়বার সাজিদের মুখে ‘প্রেমিক’ শব্দটা শুনে ইরতিজা ক্ষুব্ধ হয়ে হাতের কফি ছুঁড়ে ফেললো রাস্তার পাশে। কণ্ঠে বিশেষ জোর দিয়ে বললো,
“ও আমার প্রেমিক নয়। সবাই জানে ও আমার বন্ধু। আপনার হঠাৎ ওকে আমার প্রেমিক মনে হলো কীভাবে?”

সাজিদ নীরব হাসলো। বললো,
“বন্ধু?”

“হ্যাঁ বন্ধু ছিল।”
‘ছিল’ শব্দটার উপর বেশি জোর প্রয়োগ করলো। বোঝাতে চাইলো জোনাস বন্ধু ছিল অতীতে। বর্তমানে তো সে ইরতিজার কাছে একজন ঘৃণার মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়!

“ও, তাহলে আমার ভুল হয়েছে? হ্যাঁ, ভুল তো হতেই পারে। কিন্তু আপনি এত রেগে গেলেন কেন? ভুল করাও কি আমার ভুল হয়ে গেল?”

“আমি আর এখানে থাকবো না, আমাকে বাসায় নিয়ে চলুন।”

“আপনার এতটা রেগে যাওয়াও আমার স্বাভাবিক লাগছে না ইরতিজা! আপনি সত্যিই আমাকে বিয়ে করবেন তো?”

সাজিদের প্রশ্নে ইরতিজা বোকা বনে গেল। প্রশ্নটার মানে ধরতে পারলো না। ঝাপসা চিন্তা ধারায় দ্বিধার চোখে চেয়ে থেকে বললো,
“আপনার জন্য মেয়ে খুঁজছি তো আমি। পেয়ে যাব শীঘ্রই।”

সাজিদ স্মিত হেসে গাড়ির দিকে মুখ করে বললো,
“চলুন।”

ইরতিজা গাড়িতে উঠে সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। সাজিদ ইরতিজার শূন্য অনামিকার দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা আংটিটা আঙুলে না পরে তুলেই রেখেছে! ভিতরের গুমোট সত্ত্বা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“আপনি আসলেই একজন ভালো মেয়ে নন ইরতিজা! আপনি খারাপ!”

কথাটা কানে আসা মাত্র সাজিদের দিকে তাকালো ইরতিজা। সাজিদ তার অনামিকাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। ইরতিজার মুখ না দেখলেও মুখের ভঙ্গিটা এখন কেমন তা উপলব্ধি করতে পারছে সাজিদ। হাত বাড়িয়ে ইরতিজার মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
“সোজা তাকান। আমার দিকে তাকাবেন না। আপনার ক্ষুব্ধ দৃষ্টি আমাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। ওই ষড়যন্ত্রে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবেন না আমাকে।”

ইরতিজার কপালে ভাঁজ পড়লো। লোকটা কী বলছে, কী করছে কিছু বুঝতে পারছে না। আজব মানুষ তো!

মুখ হাঁ করে উষ্ণতা দিয়ে গাড়ির কাচে ধোঁয়ার মতো একটা আবরণ ফেললো ইরতিজা। অন্যমনস্ক মন তার আঙুলের ছোঁয়ায় যত্ন করে একটা হার্ট অঙ্কন করলো গাড়ির কাচে। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“স্টুপিড বয়!”

“কী?” সাজিদের কানে শব্দটা কিঞ্চিৎ পৌঁছাতেই প্রশ্ন করে বসলো সে।

ইরতিজার আনমনা কেটে গেল। চকিতে তাকালো সাজিদের দিকে। এইমাত্র কি সে ‘স্টুপিড বয়’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করেছে? সাজিদ শুনেছে সেটা? ইরতিজা বিস্ময়ে জড়িয়ে গেল। দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
“নাথিং।”
বলে মুছে ফেললো কাচে অঙ্কিত হার্টের চিত্রটি। হৃদয়ের চলন গতি বেড়ে গেল। বুকের ভিতর একটা প্রশ্ন বিদ্রোহে পরিণত হলো। কেন এলো জোনাস?

_________________

একটা ডিম পোচ, দুই পিচ পাউরুটি, আটটা খেজুর আর এক কাপ কফি নিয়ে নওরিনের বেজমেন্ট বেডরুমে প্রবেশ করলেন শারমিন আমেমদ। আজকের ব্রেকফাস্টে আর কিছু তৈরি করা হয়নি। নওরিন বেডের সাথে হেলান দিয়ে মোবাইলে মুখ ডুবিয়ে রেখেছিল। মুখ তুলে সামনে তাকালে শারমিন আহমেদের চোখে চোখ পড়ে গেল। শারমিন চোখ সরিয়ে নিয়ে টেবিলে ট্রে রেখে যেতে উদ্যত হলেই ডাকলো নওরিন,
“মা!”

থামলেন শারমিন। নওরিনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে সরলতা ছুঁয়ে মিষ্টি হাসলেন। সেদিন নওরিন পায়ে ব্যথা পাওয়ার পর যে সিনক্রিয়েট হয়েছিল তারপর থেকে আর কথা হয়নি দুজনের। নওরিন মুখ গোমড়া করে রাখতো, সেও আর কথা বাড়িয়ে ঝামেলা করতে চাইতো না। আজ নওরিনের মুখে ‘মা’ ডাকটা শুনে বড্ড ভালো লাগলো তার।

“কিছু বলবে?” সহজ গলায় জানতে চাইলেন শারমিন।

“স্যরি! সেদিন অতিরিক্ত করে ফেলেছিলাম আমি। উচিত হয়নি ওরকম বিহেভ করা। ভীষণ রকম দুঃখিত আমি।”

শারমিন হেসে শুধালেন,
“মায়ের সাথে মেয়ের ওরকম একটু-আধটু মনোমালিন্য হওয়া দোষের কিছু নয়। দ্রুত ব্রেকফাস্ট করে নাও।”

কান্নায় বুক ভার হয়ে আসছিল শারমিন আহমেদের। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন বেজমেন্ট থেকে। এমন সিনক্রিয়েটের সাথে তো সে সদ্য পরিচিত ছিল না। এমন আচরণ পেতে পেতে সহ্য হয়ে গিয়েছে সব। শারমিন কিচেনে ঢুকলেন।
আজাদ চৌধুরীকে এক কাপ রং চা দিয়ে ইরতিজাকে ডাকতে গেলেন। দরজা অর্ধ ফাঁক হতেই দেখলেন ইরতিজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে। মেকআপের উপর তাড়াতাড়ি করে সেটিং পাউডার দিয়ে নিচ্ছে।

“তুমি কি কোথাও বের হচ্ছো?”

“হুম।”

“এত সকালে কোথায় যাওয়ার প্ল্যান করেছো?”

ইরতিজা নিজের মেকআপ কমপ্লিট করে নিলো। ব্যাগ আগেই গুছিয়ে রেখেছিল, কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো তাড়াতাড়ি। মায়ের প্রশ্নটা সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়া দিলেই শারমিন এক হাত টেনে ধরলেন।

“কোথায় যাচ্ছ?”

“মা, আমি…” ইতস্তত করতে লাগলো ইরতিজা। জোনাসের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে এটা মাকে কীভাবে বলবে? পারবে না বলতে। খানিক সময় চুপ থেকে বললো,
“আমি যাচ্ছি ওদিকে একটু জুহির সাথে হাঁটাহাঁটি করতে। এসে পড়বো দ্রুত।” মিথ্যা বলতে বাধ্য হলো ইরতিজা। মায়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে দ্রুত চলে এলো। বাসা থেকে বের হওয়ার ক্ষণে আবার বাবার সম্মুখীন হতে হলো।

“এ সময়ে কোথায় যাচ্ছ?”

“একটুখানি কাজ আছে। একা বের হচ্ছি না তো, জুহির সাথে যাব।”

বাবাকে কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে চলে এলো ইরতিজা। বাইরে বের হয়ে বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস নিলো। রোদের দেখা নেই। আরও বেলা বাড়ার পর বোধহয় সূর্য্যি মামা কিরণ ছড়িয়ে দেবে। তখন রোদ ভাসবে প্রকৃতির বুকে। আলো ছায়ার বিচিত্র খেলা চলবে। আবহাওয়া খারাপ না হলে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত চলবে রোদের লুকোচুরি। মি. ফলক্রফট বাড়ির আঙিনায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। আজকাল আর মানুষের মাঝে অত পত্রিকা পড়ার বিষয়টা পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু মি. ফলক্রফটকে রোজ সকালেই একটা পত্রিকা হাতে বসে থাকতে দেখা যায়। মি. ফলক্রফট ইরতিজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে ‘গুড মর্নিং’ জানালো। ইরতিজাও হেসে ‘গুড মর্নিং’ জানিয়ে জোনাসের বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
কিছুক্ষণ হাঁটার পরই এসে পৌঁছালো। নক করার পর ভিতর থেকে কেউ দরজা খুললো না। এমনকি ভিতরে কারো সাড়া শব্দও পাওয়া গেল না। ইরতিজা আবার নক করলো। কোনো মানুষের অস্তিত্বই উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। জোনাস কি ভিতরে নেই?
ইরতিজা ভাবছে জোনাস ভিতরে নেই, কিন্তু জোনাস ঠিক বন্ধ দরজাটার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে ইরতিজাকে আসতে দেখেই এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ডোর ভিউতে ইরতিজার চিন্তিত মুখখানি সে দেখলো একবার। ইরতিজা আরও একবার নক করলো। জোনাস সাড়া দিলো না। সাড়া না পাওয়ার অনুভূতিটা বিরক্তিকর। ইরতিজার মুখেও বিরক্তির রেশ হালকা প্রভাব ফেললো।
জোনাস কি তবে চলে গিয়েছে? ইরতিজার হৃদয় বেয়ে কেমন একটা চাপা কষ্টের ধারা গড়িয়ে পড়লো। জোনাস তাকে দেখা করতে আসতে বলে একবার দেখা না করেই চলে গেল?
ইরতিজার বড্ড অভিমান হলো। সে আর না দাঁড়িয়ে যাবে বলে পিছন ঘুরলো। ঠিক এই সময়েই জোনাস দরজা খুলে তার একহাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে ঘরের ভিতর নিয়ে এলো। মাথাটা দেয়ালের সাথে লাগতেই একটু ব্যথা অনুভব করা গেল। খিঁচে ধরা চোখ দুটো মেলে তাকালো ইরতিজা। সে দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। তার সম্মুখে নীল এক জোড়া চোখ। চোখ জোড়া তার দিকে চেয়ে আছে।

“দেখা না করে চলে যাচ্ছিলে কেন?”

“আমি ভেবেছিলাম তুমি বাসায় নেই, চলে গিয়েছো।”

“আমি চলে গেলে তোমার খারাপ লাগতো?”

“খারাপ কেন লাগবে?”

“লাগবে না?”

ইরতিজা দুই পাশে মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝালো।

জোনাস দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিভিং রুমে এলো। ইরতিজাও ওর পিছন পিছন এসে দাঁড়ালো। জোনাস একটা টুল দেখিয়ে বললো,
“বসো।”

ইরতিজা বসলো। ঘরটা দেখলো ভালো করে। মাত্র একদিন থাকার জন্য এই ঘর কীভাবে ভাড়া করলো? এটা তো ইম্পসিবল!

“ম্যাংগো খাবে? আমার এখানে আপাতত আর কিছু নেই। চা-কফি কিছুই খাওয়াতে পারবো না।”

“কিছুর দরকার নেই।”

‘দরকার নেই’ বলা সত্ত্বেও জোনাস একটা কাঁচা আম কেটে আনলো। কাঁচা আম দেখে ইরতিজা মুখ বিকৃত করে তাকালো।
জোনাস বললো,
“এটা ভীষণ সুস্বাদু।”
বলে নিজে এক পিস খেয়ে নিলো।

“আমি তোমার এখানে কিছু খেতে আসিনি।” কোনো এক অগত্যা কারণে ইরতিজা ভীষণ বিরক্তবোধ করছে। তার মেজাজও খিটখিটে হয়ে উঠছে।

“তাহলে কী করতে এসেছো? নির্দয়ভাবে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছো?”

“নির্দয় কেন হবে?”

“কারণ তুমি হৃদয় দিয়ে কোনো কিছু উপলব্ধি করার ক্ষমতা অর্জন করোনি।”

ইরতিজা মুখ গোঁজ করে ফেললো।

ক্ষণকাল কথা বললো না দুজনের কেউ। পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। শুধু রাস্তা দিয়ে চলাচল করা যানবাহনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ ঘরটা রোডের খুব কাছে। জোনাস এক সময় বললো,
“আমি চলে গেলে আমাকে মিস করবে টিজা?”

“না।” দৃঢ় কণ্ঠের উত্তর ইরতিজার।

“…’না’ কেন?”

“পড়বে না তোমাকে মনে।”
সহজ ভাবে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো ইরতিজা। কিন্তু সে জানে, তার মন জানে, জোনাসকে মনে না করে থাকার উপায় তার নেই। মনে করতে না চাইলেও জোনাসকে মনে পড়ে যায় তার।
ইরতিজা ঘটনাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। জোনাস অকস্মাৎ সে যেই টুলে বসে আছে সেই টুলটাকে টেনে নিয়ে গেল নিজের খুব কাছে। ইরতিজা চমকে তাকালো। সে এখন জোনাসের খুব নিকটে। অপ্রস্তুত ভাবে সে জোনাসের চোখ দুটোকে পর্যবেক্ষণ করে চললো। জোনাসও ইরতিজার চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,
“তাহলে আমাকে যাতে সারাজীবন মনে রাখতে পারো এমন কিছু কি করবো আমি? অর্টন যা করেছিল সেটা অন্যভাবে করবো কি?”

ইরতিজার বুকে ঢিপঢিপ মতো শব্দ হচ্ছে। কপাল কুঞ্চিত, চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে আছে। দেখতে দেখতেই রাগান্বিত হয়ে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে বললো,
“তোমাকে আমি মে/রে ফেলবো জন!”

জোনাসের মাঝে ভাবান্তর হলো না। ভাবলেশহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লিভিং রুম থেকে চলে গেল। ফিরে এলো হাতে একটা ছুরি নিয়ে। ছুরিটা ইরতিজার হাতে দিয়ে বললো,
“এটা দিয়ে আঘাত করো। কিন্তু দেখো, আমাকে আঘাত করতে গিয়ে তোমার নিজের হৃদয়ে যেন রক্তক্ষরণ না হয়।”

ইরতিজা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল। জোনাস কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠছে না? সে ছুরিটা রেখে দিতে উদ্যত হলেই জোনাস হঠাৎ তার ছুরি ধরা হাতটা চেপে ধরে নিজের বুকের বাঁ দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। ছুরিটা জ্যাকেটের পুরু অংশে মৃদু চাপে ধরে রেখে বললো,
“আঘাত করো টিজা। এখনকার পরিস্থিতি থেকে এটা অনেক স্বস্তিদায়ক হবে। যদি পারতাম আমি মরেই যেতাম! করো আঘাত। মানসিক আঘাতের চেয়ে শারীরিক আঘাত অনেক স্বস্তির। শারীরিক ক্ষতের চিকিৎসা করার জন্য এ পৃথিবীতে অনেক ডক্টর রয়েছে। কিন্তু আমার মানসিক ক্ষত ভালো করবে এমন ডক্টর এই পৃথিবীতে একজন ছাড়া আর কেউ নেই। সেই ‘একজন’টা তুমি টিজা! কিন্তু তুমি তো আমার ক্ষত ভালো করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছো! আমি চাইছি না আর এমনটা চলুক। আমি তোমাকে একদম মনে করতে চাই না টিজা। তুমি এমন কিছু করো যাতে আমি তোমাকে সম্পূর্ণ রূপে ভুলে যাই। এমনটা চলতে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব! তুমি কিছু করো টিজা। তুমি সত্যি সত্যি মেরে ফেলতে পারো না আমায়?”

ইরতিজার শ্বাস রুদ্ধ। বুক ব্যথিত। চেয়ে আছে স্তব্ধ চোখে। জোনাস কী বলছে এসব? সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছে না কি ও?

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১৫
_________________

“এটাই আমাদের শেষ দেখা টিজা। আশা করছি আর কোনোদিন আমরা একে অপরের মুখোমুখি হবো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করো, যাতে আমাকে আর কোনোদিন তোমার কুৎসিত মনের সামনে এসে না দাঁড়াতে হয়।”

গোধূলি লগ্নে গুমোট হাওয়ার দল এসে শরীর স্পর্শ করতেই শিরশিরে একটা অনুভূতির সাথে জোনাসের কথাগুলোও মনঃস্থলে জাগ্রত হলো। যাওয়ার আগে এটাই ছিল জোনাসের শেষ কথা। জোনাস তার মনকে কুৎসিত বলে গিয়েছে! কুৎসিত কেন বললো? জোনাসের কি ধারণা ইরতিজা তাকে ভালোবাসলেও সেটা মুখে স্বীকার করছে না? এর জন্যই কি কুৎসিত বললো? চিন্তিত মুখে হট চকলেটের কাপে চুমুক বসালো ইরতিজা।
আকাশের দৃশ্যটা এখন ভারি নয়নাভিরাম! গোলাপি, বেগুনি, লাল সব মিলেমিশে একাকার আকাশের বুকে। পাহাড়ের ভ্যালিগুলো রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরতিজা ঝাপসা আঁধারে মিশে থাকা পাহাড়ের চূড়ায় তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ।
মোবাইলে কলের মৃদু আওয়াজে সেই ঘোর কাটলো। কল রিসিভ করলে রিশন বললো,
“তুমি কোথায়? সকাল থেকে তোমার দেখা পেলাম না!”

“আমি তো আন্টির সাথে আছি। তার বান্ধবীর বাসায় নিয়ে এলো আমাকে।”

“মমের বান্ধবীর বাসায়?” বিস্ময় নিয়ে বললো রিশন।

“হ্যাঁ, আসার সময় আমাকে বললো, ‘চলো ঘুরে আসবে’। আমার হাতে কোনো কাজ না থাকায় চলে এলাম। কিন্তু তুমি আমার খোঁজ করছো কেন?”

“তোমার সাহায্য প্রয়োজন আমার। তুমি কি একটা ভিডিয়ো ধারণ করতে সাহায্য করবে আমায়?”

ইরতিজা দ্বিধার কণ্ঠে বললো,
“ভিডিয়ো ধারণ? উমম…এক্ষেত্রে তো তুমি জুহির সাহায্য নিতে পারো।”

“দুপুর থেকে ওরও কোনো দেখা নেই। এমনকি ফোন পর্যন্ত সুইচ অফ করে রেখেছে। আই থিংক কোনো ছেলেকে পটানোর চেষ্টায় ব্যস্ত আছে ও। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে না?”

ইরতিজার সরাসরি না করে দিতে ইচ্ছা হলেও ভদ্রতার খাতিরে সেটা করতে পারলো না। অন্যভাবে বললো,
“দেখো আমি এই কাজে কখনও কাউকে হেল্প করিনি। কেউ কখনও ডাকেনি এ কাজে। আমি স্যরি! মনে হচ্ছে না আমি তোমার উপকারে আসবো।”

“উপকারে আসবে কি আসবে না সেটা তো তখন প্রমাণ হবে। তুমি জলদি বাসায় এসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।”

রিশন তাকে বেতন ভুক্ত কর্মচারী মনে করছে না কি বুঝতে পারছে না। এমনভাবে বলছে যেন ইরতিজাকে সে নিজের কাজে সাহায্য করার জন্য মাসে মাইনে দিয়ে নিয়োগ করেছে। ইরতিজার যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। মন থেকে রিশনের কাজে সহযোগিতা করার জন্য কোনো আগ্রহ অনুভব করছে না। কিন্তু শত হলেও রিশন তার চাচাতো ভাই। একটা কাজে সাহায্য চেয়েছে, সাহায্য না করে তো পারা যায় না। ইরতিজা চাচির সাথে কথা বলে বেরিয়ে পড়লো।

রিশন গাড়ি-টারি রেডি করেই অপেক্ষা করছিল বাড়িতে। ইরতিজা গাড়িতে উঠে প্রশ্ন করলো,
“কোথায় যাব আমরা?”

“সেটা বড়ো মনোরম একটা স্থান।”

রিশনের এই কথাটায় ভারি আনন্দ হলো ইরতিজার। আর কিছু না হোক মনোরম একটা স্থান তো তার ঘুরে দেখা হবে।
গাড়ি পার্ক করা হলো যে রাস্তায় তার এক পাশেই সুবিশাল অরণ্য রাজ্য। রিশন প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। অরণ্যের দিকটা ইঙ্গিত করে বললো,
“এর ভিতরে প্রবেশ করবো আমরা।”

কথাটা শোনা মাত্র ইরতিজার পিলে চমকে উঠলো। ভয়ের দীর্ঘ একটা হস্ত হৃৎপিণ্ড খাঁমচে ধরলো তার।

“জঙ্গলের ভিতর ভিডিয়ো শ্যুট করবে?”

“হুম। এখানে অনেক জোনাকি পোকা দেখা যায়। এর আগে এক রাত্রিকালে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এই জায়গাটার ভিডিয়ো বানিয়েছিলাম। চলো।”

রিশন পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। ইরতিজার ভীষণ ভয় করছে। রিশন যখন মনোরম স্থান কথাটা বলেছিল, তখন ভেবেছিল না জানি কত সুন্দর হবে জায়গাটা। কিন্তু এ কোন জঙ্গলের ভিতর নিয়ে এলো? এর ভিতর না কি জোনাকি পোকা দেখা যায়! ইরতিজার এক পা বাড়াতে ইচ্ছা করলো না। মনে হচ্ছে জঙ্গলের ভিতর থেকে কয়েক জোড়া মৃত আত্মার চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে! গা শিরশির করে উঠলো ইরতিজার। এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকতে মোটেই সাহস হলো না। উপায় না পেয়ে সে রিশনের দিকে দৌঁড়ে এলো। হাঁটতে লাগলো রিশনের একেবারে পাশ ঘেঁষে। উঁচু উঁচু গাছ। আকাশের বুকে অর্ধপূর্ণ চাঁদ আলো ছড়িয়েছে। গাছের ডালপালা চাঁদের আলোয় বাধা দিয়ে অদ্ভুত সব ছায়ার নকশা এঁকেছে। সেই সব ছায়ার নকশার দিকে তাকালে অজান্তেই অন্তর কেঁপে উঠছে ইরতিজার। রিশন বলেছিল এখানে অনেক জোনাকি পোকা দেখা যায়, কিন্তু জোনাকির সংখ্যা খুব অল্প। ইরতিজার ভয় করছে। এই জঙ্গলে কোনো হিংস্র প্রাণী নেই তো আবার? প্রশ্নটা মনে মনে যখন ভাবছিল ঠিক তখনই একটা নরম কিছু ইরতিজার পায়ের কাছ থেকে দৌড়ে চলে গেল। আঁতকে উঠলো ইরতিজা,
“আ…”

রিশন সামনে লাইটের আলো ফেলে দেখলো একটা কাঠবিড়ালি দৌঁড়ে যাচ্ছে। সে হেসে ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভিতু।”

ইরতিজা রাগ দেখিয়ে বললো,
“আমি ভিতু নই।”

“হ্যাঁ, তুমি তো ভীতু নও, তার প্রমাণ এই মাত্রই তো পেলাম।”
বলে ফিক করে হেসে দিলো রিশন।

ইরতিজার বেজায় মেজাজ খারাপ হলো। ছেলেটা তাকে এই জঙ্গলের ভিতর নিয়ে এসেছে! আবার তাকে ভিতু বলে সম্বোধন করে মজাও নিচ্ছে! ছেলেটা খুব একটা ভালো নয়!

“এই জঙ্গলটা কীসের?” রিশনের সাথে কোনো কথা বলবে না প্রতিজ্ঞা করেও মুহূর্তেই প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেললো ইরতিজা।

“জানি না। জঙ্গল তো জঙ্গলই। জঙ্গল হওয়ার জন্যও জঙ্গলের কারণ লাগে না কি?”
রিশন মুখ টিপে হাসলো। তার এমন একখানা ভাব যেন ইরতিজার এমন প্রশ্ন করাটা খুব বড়ো বোকামি।
ইরতিজার মেজাজ আবারও চটে গেল। কিছু বলতেও পারছে না। ভিতরে ভিতরে শুধু পুড়ে খাঁক হয়ে গেল তার রাগ।

অনেকক্ষণ ধরে হেঁটে আসার পর রিশন বললো,
“দাঁড়াও।”

দাঁড়িয়ে গেল ইরতিজা। এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। রিশন অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো,
“ওই ট্রি হাউজটায় উঠে ভিডিয়ো শ্যুট করবো আমরা।”

ইরতিজা দেখলো তাদের থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ছোটো একটা ট্রি হাউজ। সে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“এটা কার ট্রি হাউজ? তোমার?”

রিশন ট্রি হাউজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“না। জানি না এটা কার। অনেক আগে থেকেই এটাকে এখানে দেখে আসছি। মনে হচ্ছে কোনো বিদেশি পর্যটকেরা এটা নির্মাণ করেছে। এটা একটা পরিত্যক্ত ট্রি হাউজ। এখানে কাউকেই থাকতে দেখা যায় না।”

ইরতিজার কিন্তু তা মনে হলো না। বিদেশি কোন পর্যটক এখানে এটা নির্মাণ করবে? নির্মাণ করা এতই সহজ কাজ? রিশনের পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে উঠলো ইরতিজা। ছোটো একটা অলিন্দ আছে। অলিন্দের এক পাশে দুটো গোলাপ গাছ। বসার জন্য দুটো চেয়ারও আছে। চেয়ারগুলো দেখে মনে হচ্ছে না এগুলো দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত। গাছগুলোও সতেজ। যদি এটা পরিত্যক্ত হতো তাহলে টবে এত সুন্দর ভাবে কি বেড়ে উঠতে পারতো গাছগুলো? ইরতিজা লাইটের আলোতে দেখলো ট্রি হাউজের পাশে গাছের সাথে একটা দোলনা ঝুলছে। ইরতিজা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখছিল। ভূতুড়ে পরিবেশ ছাড়া বিশেষ কিছু আর নজরে পড়লো না।
রিশন আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে বোধহয় বেশি জোনাকির দেখা পাওয়া যাবে। চলো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। একটা দুটো জোনাকি দিয়ে ভিডিয়ো চলবে না।”

রিশন অলিন্দে থাকা একটা চেয়ারে বসে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। বসার আগে চেয়ারের ধুলা মুছে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। ইরতিজা অপর চেয়ারটি হাত দিয়ে ঝেড়ে ময়লা দূর করার চেষ্টা করলো। অতঃপর বসলো। আশেপাশে তাকাতেই ভয়ের যে দীর্ঘ হস্ত তার হৃৎপিণ্ড খাঁমচে ধরেছিল, সেটা আরও জোরে খাঁমচে ধরে। বার বার কেবল ঢোক গিলছে ভয়ে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন আর জোনাকির দেখা মিললো না তখন ইরতিজা ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
“চলো রিশন বাসায় ফিরে যাই। মনে হচ্ছে জোনাকিরা আজ আসবে না। তাড়াতাড়ি চলো এখান থেকে।”

“তুমি কি ভয় পাচ্ছ?”

“ভয় না, আমার ভালো লাগছে না এখানে থাকতে।” সত্যটা চেপে গেল ইরতিজা।

“তোমার কণ্ঠে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ টিজা!”
রিশন ইরতিজার থেকে খানিক দূরে বসা ছিল। চেয়ার নিয়ে সে এবার একেবারে ইরতিজার পাশ ঘেঁষে বসে বললো,
“তুমি এত কেন ভয় পাচ্ছ টিজা? আমাকে তোমার কী মনে হয়? আমি খুবই সাহসী। ভূতেরা যদি তোমায় ধরতে আসে আমি ওদের মারধর করে তাড়িয়ে দেবো। ডোন্ট ও্যরি! আমি খুবই সাহসী, কথাটা মাথায় রাখবে।”

ইরতিজার মন সাহসের ভরসা খুঁজে পেল না। রিশনকে তার একদমই সাহসী বলে মনে হয় না। কিন্তু রিশনের কণ্ঠে ভয়ের লেশমাত্রও নেই। ইরতিজা কিছু না বলে নীরব হয়ে গেল।
হঠাৎই একটা আলোর ধারা এসে পড়লো ইরতিজা আর রিশনের উপর, সেই সাথে কানে এলো একটা গম্ভীর কণ্ঠ,
“ওখানে কে?”

ইরতিজা ভয়ে চেপে ধরলো রিশনের একটা হাত। দু চোখে ভয় বিস্ফোরিত। চেয়ে আছে রিশনের দিকে। রিশনও ভীষণ অবাক। এই অরণ্যে এই সময় তারা ব্যতীত অন্য কেউও থাকতে পারে এটা তার বিশ্বাস করতে খানিক সময় লাগলো। সে ইরতিজার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। আলোর ধারা কাটিয়ে সে দেখার চেষ্টা করলো মানুষটাকে। একজন নয়, দুজন মানুষকে দেখতে পেল। একটু যেন পরিচিত ঠেকলো মানুষ দুটোকে। নিচের মানুষ দুটোও বোধহয় তাকে চিনতে পারলো। একজন তো প্রশ্নও করলো,
“তুমি কি রিশন?”

রিশন এবার পুরোপুরি চিনে ফেললো মানুষ দুটোকে। রিশন উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“তোমরা দুজন এখানে কেন?”

ইরতিজা ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না, সেও উঠে এসে রিশনের পাশে দাঁড়ালো। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুটোকে দেখে সে ভীষণ চমকে গেল। দূর হলেও, ভালো আলো না থাকলেও, তার চিনতে একদমই অসুবিধা হলো না, ওখানে যে দুজন দাঁড়িয়ে আছে তারা ক্যানিয়ল আর সামুরা! ইরতিজার কপালে গভীর ভাঁজ পড়লো। ক্যানিয়ল আর সামুরা এখানে কেন?

রিশনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে চিনতে বেশি সময় লাগলো না ক্যানিয়লের। মেয়েটার সাথে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। রিশনকে দেখে সে অবাক হয়েছিল, ইরতিজাকে দেখে অবাকের মাত্রা একগুণ বেড়ে গেল। ইরতিজার উদ্দেশ্যে বললো,
“তাহলে তুমি আমাকে মারার জন্য এখান অবধিও চলে এসেছো?”

ক্যানিয়লের প্রশ্নে সবাই অবাক হয়ে ক্যানিয়লের মুখের দিকে তাকালো। ইরতিজা কী করবে বুঝতে পারছে না। ছেলেটা আবারও তাকে ভুল বুঝছে!

“আমি তোমাকে মারার জন্য কেন আসবো? আমি আর রিশন তোমাদের আগে এখানে এসেছি।”

“মিথ্যা কম বলো মিথ্যাবাদী!”

ক্যানিয়ল হনহন করে উঠে এলো ট্রি হাউজের অলিন্দে। ইরতিজা আর রিশনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
“তাহলে তোমরা কি একই দলের সদস্য? কে কে আছে তোমাদের দলে? তোমরা দুজন… তোমার প্লে গার্ল বোনটাও এই দলে আছে না কি?”

শেষের কথাতে জুহিকে নির্দেশ করে রিশনের উদ্দেশ্যে বললো ক্যানিয়ল।

রিশন অবাকের সুরে বললো,
“কীসের দল?”

“আততায়ী গ্যাং!”

রিশন অবুঝের মতো ইরতিজার দিকে তাকালো। ইরতিজা রাগে ফুলছে। ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ক্যানিয়লের দিকে। মিথ্যা অপবাদ কতদিন সহ্য করা যায়?

“কীসব গ্যাং-ট্যাংয়ের কথা বলছো? কীসের গ্যাং? আমরা এখানে ভিডিয়ো শুট করতে এসেছিলাম।” বললো রিশন।

“এখানে কেন ভিডিয়ো শ্যুট করতে আসবে? এটাকে কি তোমার বাবার প্রোপার্টি মনে হয়?”

“তাহলে কি এটা তোমার বাবার প্রোপার্টি?” পাল্টা আক্রমণ করলো রিশন।

“না, এটা আমার ড্যাডের প্রোপার্টি তো নয়, এটা আমার মাদারের প্রোপার্টি। এই ট্রি হাউজ আমার মাদারের।”

কথাটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না রিশনের। সে সন্দেহের চোখে বললো,
“এটা হতেই পারে না। তোমাকে অথবা তোমার ফ্যামিলির কাউকে কখনও দেখিনি এখানে। এটা একটা পরিত্যক্ত ট্রি হাউজ। এটা বিদেশি পর্যটকরা তৈরি করে রেখে গিয়েছে।”

ক্যানিয়ল মজার কোনো জোক শুনেছে এমনভাবে হাসলো,
“হোয়াট? কী জোক শোনাচ্ছ তুমি রিশন? বিদেশি পর্যটকরা এটা তৈরি করেছে এসব মাথায় আসে কী করে তোমার? আর আমাকে অথবা আমার ফ্যামিলির কাউকে কখনও দেখোনি এটা কি আমার ব্যর্থতা? এখানে আসার আগে আমি কি তোমাকে নক করে আসবো যে, রিশন আমি এই মুহূর্তে এই ট্রি হাউজে যাচ্ছি, তুমিও চলে এসো, বিশাল অরণ্যের বুকে মিষ্টি একটা ডেট হবে আমাদের দুজনের! এটাই কি বলতাম?”

“তোমার মুখের কন্ট্রোল নেই ক্যানি!”

ক্যানিয়ল ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। তারপর বললো
“এখানে এসে চরম ভুল করেছো তোমরা। এর যথোপযুক্ত শাস্তি তোমাদের পাওয়া উচিত। আমি এখনই পুলিশকে…”
থেমে গেল ক্যানিয়ল। ভুল হয়েছে এমনভাবে দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
“নো, পুলিশ নয়। আই হেইট পুলিশ! পুলিশরা কোনো কাজের নয়। ওরা একটা ঘটনা পেলে সেটাকে শুধু পেঁচিয়ে যায়। আমি নিজেই তোমাদের ব্যবস্থা করবো। জানি না আমার এই দামি ট্রি হাউজে কত বার কদম ফেলেছো তোমরা। কতবার কদম ফেলেছো সেটা তোমরাই ভালো জানো। প্রত্যেক কদমের জন্য এক হাজার ডলার করে জরিমানা দেবে। দাও।”

ইরতিজা সব শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেল,
“হোয়াট?”

ক্যানিয়লের ধ্যান ইরতিজার দিকে ঘুরে গেল,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল, কতবার কদম ফেলেছো তুমি এই দামি কাঠের মেঝেতে? পাই টু পাই হিসাব করে প্রত্যেক কদমের জন্য এক হাজার ডলার করে জরিমানা দাও।”

“তুমি কি পাগল হয়েছো ক্যানি?”
পাশ থেকে বলে উঠলো রিশন।

তর্ক-বিতর্ক শুরু হলো দুজনের মাঝে। দুজনই রাগান্বিত। উত্তর-প্রত্যুত্তর চলতে লাগলো। হাঁপিয়ে গিয়ে দুজনই থেমে গেল এক সময়। রিশন নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বললো,
“চলো টিজা, এখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালে অসুখ করবে।”

ইরতিজা রিশনের পিছন পিছন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নিলেই ক্যানিয়ল ইরতিজার গায়ে থাকা হুডি টেনে ধরলো। পিছন দিকে টান পড়তেই থেমে যেতে হলো ইরতিজার। পিছন ফিরে বললো,
“এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি?”

ক্যানিয়লের হাতে একটা নভেল বুক ছিল। সেটা দিয়ে ইরতিজার মাথায় আস্তে আঘাত করলো। ‘আ’ মতন শব্দ করে আঘাত করা স্থান চেপে ধরলো ইরতিজা।

“তোমার মাথার হিজাব কোথায় পাকিস্টানি গার্ল?”

ইরতিজা কিছু বললো না। শুধু রেগে তাকিয়ে রইল।

“তোমার মাথার টুপি কোথায় পাকিস্টানি গার্ল?”

এবারও কিছু বললো না ইরতিজা।

ক্যানিয়ল আগের মতো সুরে বললো,
“তোমার মাথায় চুল কেন আছে পাকিস্টানি গার্ল? তোমার মাথার চুলগুলো আমি যত্ন সহকারে কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলতে চাই!”

বলে নিজের মাথার টুপিটা খুলে পরিয়ে দিলো ইরতিজার মাথায়।

(চলবে)