একটি জটিল প্রেমের গল্প পর্ব-০৩

0
350

#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-৩

সুমাইয়া আমান নিতু

দশটা লেখকের নাম একটা কাগজে টুকে নেবার পর মনে হলো, আমি কেন কষ্ট করে লাইব্রেরি ঘুরছি? ইন্টারনেটে খুঁজলেই তে পাওয়া যাবে বাকি দশটা লেখকের নাম! যেই ভাবা সেই কাজ। সার্চ দিয়ে দেখি লেখকের সংখ্যা শত শত। শুধু বাংলা ভাষার এত লেখক আছে কে জানত! এদের মধ্যে শতকরা দশ ভাগকে চিনলেও বর্তে যেতাম। আচ্ছা আফ্রিতা কি সবাইকে চেনে? সে চিনুক বা না চিনুক, আপাতত এখান থেকে দশটা লেখকের নাম নিয়ে সেগুলো মুখস্থ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় আজকের মধ্যেই করতে পারলে।

ডিপার্টমেন্টের করিডোর দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ দেখা জুবায়েরের সাথে। জুবায়ের আমার জুনিয়র। ছেলেটা কবিতা লেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সংঘের সদস্য। প্রায়ই সভার আয়োজন করে, সেখানে কবিতা আবৃত্তি, গান, গল্প পড়া ইত্যাদি হয়। এই ছেলেই বেশিরভাগ সময় সেসবের আয়োজন করে। আমাকে একবার জোর করে নিয়ে গিয়েছিল। গিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছিলাম। একেকজন ব্যর্থ প্রেমিক হৃদয়ের বেদনা কাব্যের আকারে প্রকাশ করতে গিয়ে পাতার পর পাতা লিখে মহাকাব্য বানিয়ে ফেলেছে। সেই মহাকাব্য পাঠের আসরে সবাই বসে মুগ্ধ হয়ে শুনছে। সেদিনের পর আর ওমুখো হইনি। আজ জুবায়েরকে দেখে প্রশ্নটা মাথায় এলো, আফ্রিতা কি ওদের সংঘের সদস্য?

আমি ডাক দিলাম ওকে, “জুবায়ের শোন!”

“জি ভাই বলেন।” বেশ বিনীত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো জুবায়ের। এই ছেলের আদব কায়দা দেখবার মতো। কথা শুনলে মনে হয় পৃথিবীর সব বিনয় ঢেকে তাকে বানানো হয়েছে।

“তোদের সাহিত্য সংঘে কি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের আফ্রিতা আছে?”

জুবায়ের একগাল হেসে বলল, “জি ভাই। আফ্রিতা আপু তো খুবই সক্রিয় সদস্য। যদিও তিনি নিয়মিত উপস্থিত থাকতে পারেন না, অনেক পড়াশুনা করেন তো! তবে অবসর থাকলে সময়মতো পৌঁছে যান।”

“ও কি কবিতা লেখে?”

“জি না ভাই। উনি শুধু শোনেন। মাঝেমধ্যে আমাদের গাইড করেন, সমালোচনা করেন। অবশ্য আকিব ভাই থাকলে ভিন্ন কথা। আকিব ভাই এর কবিতা আফ্রিতা আপু খুবই পছন্দ করেন। তিনি যদি আবৃত্তি করতে বলেন তাহলে আপু না করতে পারেন না।”

“আকিব ভাইটা কে?”

“ভাই আপনি চেনেন না? আকিব ভাই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। মাস্টার্সে পড়ে। তিনি তো খুবই জনপ্রিয়।”

“জনপ্রিয়তার কারণ কী?”

“তার চুল।”

“মানে?” এই মুহূর্তে নিজের মুখ আয়নায় না দেখলেও আমি জানি আমার মুখের প্রতিটা পেশি কুঁচকে গেছে বিরক্তিতে। প্রেম শুরু না হতেই বাগড়া! তাও নাকি কোন জনপ্রিয় আকিব ভাই! অসহ্য দুনিয়া! আর এই দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি হতভাগ্য মানুষটি হলো মাসুদ রানা।

জুবায়ের হাসি হাসি মুখে বলল, “আকিব ভাইয়ের বাবরি চুল। একেবারে কাজী নজরুল ইসলামের মতো। সেই বাবরি চুল দুলিয়ে যখন গান গায়, কী যে সুন্দর লাগে! তার আবার মেয়ে ভক্ত বেশি।”

আমি বিরক্তিতে আরও বেশি কুঁচকে গিয়ে বললাম, “ওহ আচ্ছা। যা তাহলে।”

জুবায়ের দুই হাত কচলে আরও বিনীত ভঙ্গিতে বলল, “ভাই কি সাহিত্য সংঘে যোগ দেবেন নাকি?”

“নাহ।”

জুবায়ের চলে গেল কাচুমাচু মুখ করে। সে হয়তো ভেবেছে আমি তার ওপর বিরক্ত। এই ছেলে ঘুরে একটু পর আবার আসবে। আমি তার ওপর রাগ কি না সেটা জিজ্ঞেস করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলবে!

যাহোক, সেদিন আকিব ভাইয়ের কথা শোনার পর মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়ায় আর নাম মুখস্থ হয়নি। বাসায় গিয়ে অবশ্য রাগ পড়ে গেল। দেখি গরুর মাংস আর খিচুড়ি রান্না হয়েছে। সাথে ইলিশ মাছ ভাজাও আছে। আব্বা কোথা থেকে এই বৃষ্টির মধ্যে পদ্মার ইঁলিশ পেয়েছেন তার গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করলেন। আমি এর মাঝে কখন যেন আকিব ভাইয়ের কথা ভুলে গেছি। আফ্রিতার কথা কিন্তু ভুলিনি!

পরদিন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেই আফ্রিতাকে খুঁজে বের করলাম। সে বলল, “মুখস্থ হয়েছে ঠিকঠাক?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ।”

“আচ্ছা বলতে থাক। বিশটা নাম বলবি গুনে গুনে।”

আমি বলতে শুরু করলাম। প্রথমগুলো ঠিক ছিল, কিন্তু পরের নামগুলো শুনে আফ্রিতা কিছুক্ষণ হা করে আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, শিতালং শাহ এসব নাম কোথায় পেয়েছিস?”

আমি হেসে বললাম, “আমি এসব আগে থেকেই জানতাম, গতকাল বলিনি ইচ্ছে করে।”

আফ্রিতা ভুরু ওপরে তুলে বলল, “ওহ আচ্ছা! বেশ! তাহলে এবার সমূদ্র গুপ্তের কিছু সাহিত্যকর্মের নাম বল।”

আমার মুখ চুপসে গেল। এ তো প্রশ্নের ভান্ডার। কেন বড় গলায় বলতে গেলাম আগে থেকে চিনি! ধুর! আমি আবার সার্চ দিয়ে পাওয়া লেখকদের নামের মধ্যে থেকে সবচেয়ে ইউনিক নামগুলো খুঁজে বের করেছি। মনে হচ্ছে আফ্রিতা এদের নাম শোনেনি। উল্টোপাল্টা বললে কি ধরতে পারবে?

“কিরে বল?”

আমি মুখটা হাসি হাসি করে বললাম, “বিষাদের নৌকো।”

আফ্রিতা দুই কাঁধ উঁচু করে বলল, “তুই তো দেখি আমার চেয়েও বেশি জানিস, আমি তো বাপু এত লেখকের কথা জানি না! আমার কাছে এসে তাহলে কী লাভ? নিজে নিজেই পড়গে!” বলে উল্টোদিকে ঘুরে ক্লাসের দিকে রওনা দিল।

আমি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ধীর পায়ে ফেরার সময় মনে হলো এই মেয়ের সামনে বেশি ভদ্র সেজে থাকতে গেলে সে আমাকে এক হাটে বেঁচে অন্য হাট থেকে কিনে আনবে অনায়েসে। কিন্তু তা হতে দেয়া যাবে না৷ একে হাত করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে।

(চলবে)