একটি জটিল প্রেমের গল্প পর্ব-০৪

0
290

#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-৪
সুমাইয়া আমান নিতু

কবি শ্রেণীর জনপ্রিয় লোক, বিশেষ করে মেয়ে মহলে যারা জনপ্রিয় তাদের ভাবভঙ্গি যে রাষ্ট্রপতির কাছাকাছি এই ব্যাপারটা জানলাম আকিব ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়ে। দেখা করে ফেলাটা একেবারেই ঝোঁকের বসে। হুট করে মনে হলো লোকটাকে দেখে আসা যাক, কোন পুকুরের মাছ যে আফ্রিতার মতো মেয়েকে দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করিয়ে ফেলে!

তার সাথে দেখা করতে হলো হলে গিয়ে। সেখানে গিয়ে প্রথমবার এটাও জানতে পারলাম সে রাজনীতি করে, ছাত্রনেতা। তার কথা জিজ্ঞেস করতেই একেকজন অদ্ভূতভাবে চাইল। এক চ্যাংড়ামতো ছোকড়া আমাকে নিয়ে গিয়ে টিভি রুমের চেয়ারে বসিয়ে আমার পরিচয়ের আদ্যেপান্ত জেনে নিল। তারপর আকিব ভাইকে ফোন করে জানতে চাইল আমাকে তার ঘরে পাঠানো যাবে কি না। আকিব ভাই অনুমতি দিলে তবে আমাকে নিয়ে গিয়ে দোতলার কোণার দিকের একটা ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে ছেলেটা চম্পট দিল। সিনিয়র বলে সালাম দিয়ে তার ঘরে ঢুকলাম। আকিব ভাই দেখি খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। হাতে প্রমাণ সাইজের একটা ডায়েরি। তাতে বোধহয় কবিতা লিখছে। লোমে ভর্তি গা দেখে শিম্পাঞ্জির কথা মনে পড়ে গেল। চুলদাড়ি সব বড় বড়। হাতে কিন্তু তেমন লোম দেখতে পেলাম না। ট্রিম করে রাখে বোধহয়! তবে যত যাই হোক, কোনোভাবে এই লোকের চেহারা বা চুলের সাথে কাজী নজরুল ইসলামের দূর দূর পর্যন্ত মিল দেখতে পেলাম না।

আকিব ভাই লাল চোখ মেলে আমার দিকে চেয়ে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, “এইখানে কী চাস?”

কথা শুনে মনে হলো সে বিশাল অফিসের হেড আর আমি সামান্য দারোয়ান। অবশ্য সিনিয়রদের এসব ভাবভঙ্গির সাথে আমরা ফার্স্ট ইয়ার থেকে মোটামুটি পরিচিত। চমকালাম না। আগে থেকে কী বলব ঠিক করে আসিনি বিধায় কথাও খুঁজে পেলাম না। আকিব ভাই আমার উত্তর না পেয়ে ডায়েরির দিকে মনোযোগ দিল। কাগজে কলম ঘষার ঘষঘষ শব্দ আসতে লাগল। আমি ঘুরে ঘুরে বিশৃঙ্খল ঘরের এলোমেলো জিনিস দেখতে লাগলাম। প্রায় মিনিট বিশেক পর আকিব ভাই উঠে দাঁড়াল। একটা ঘিয়া রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে নিল। মুখে হালকা মেনস ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মেখে নিয়ে আমার কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, “চল ক্যান্টিনে যাই।”

আকিব ভাই আমাকে সত্যিকার অর্থেই জমিয়ে খাওয়ালো। মানে হলে যা পাওয়া যায় তার মধ্যেই। রুই মাছের পেটি, মুরগির মাংস, মুড়িঘণ্ট, ডালের বড়া আর কালোজিরার ভর্তা দিয়ে প্রায় তিন প্লেট ভাত সাবাড় করে ফেললাম। খাওয়ার সময় আবার আমার হুশ থাকে না। খেয়েদেয়ে মনে হলো আকিব ভাইয়ের মনটা সত্যি বিশাল। চেনে না জানে না, গেলাম আর খাইয়ে দিল? কিন্তু আকিব ভাইয়ের মন যদি আমার চেয়েও বড় হয় তবে? তাহলে কি আফ্রিতা তাকে ছেড়ে আমাকে পছন্দ করবে? তারচেয়ে বড় কথা আমি এসেছিলাম একপ্রকার দফারফা করতে, সেখানে কি না শত্রুর টাকায় খাচ্ছি! একটা ঢেকুর তুলে মন খারাপ করে বসে রইলাম৷ আকিব ভাই আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। মোবাইলে ব্যস্ত।

অবশেষে আমার দিকে তাকিয়ে টাকা দিয়ে বলল, একটা দুই লিটারের সেভেন আপ কিনা নিয়া আয়।”

আমি কথামতো কাজ করলাম। সে বলল, “শোন, তোর কথা আমি জানি। আফ্রিতাকে প্রেমে ডুবাডুবি করতাছোছ তাই না?”

“ভাই আপনাকে কে বলল?” আমি অত্যাশ্চর্য হয়ে বললাম। কথাটা আমি কাউকে বলিনি। আফ্রিতাকে তো ভুলেও না। তবে?

আকিব ভাই দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “জুবায়েরের কাছে তো তাই শুনলাম।”

অতি বিনয়ী লোকেরা যে অতি কিলিকবাজ হয় সেটা আরও একবার প্রমাণ করে দিল জুবায়ের। মনে মনে ওর মুণ্ডুপাত করে বললাম, “আমি এমনি আফ্রিতার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি।”

“তাইলে আমার কাছে কী করোছ?”

“দেখা করতে আসলাম ভাই। জুবায়েরের কাছে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি।”

আকিব ভাই দুই লিটার বোতলের অর্ধেক গিলে নিল প্রায় এক ঢোকে। ঝাঁঝওয়ালা তরল পানীর কেউ পানির মতো গিলতে পারে প্রথমবার দেখলাম৷ আকিব ভাইয়ের কোনো কর্মকাণ্ড প্রথমবারের মতো আমাকে একেবারে মুগ্ধ করে দিল। হা করে চেয়ে থাকতে দেখে বোতলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটুকু খাইতে খাইতে যাইছ। এবার কথা শোন।”

আপনাআপনি আমার হাবভাবে গদগদ ভাব চলে এলো। বললাম, “বলেন ভাই।”

সে নিচু গলায় বলল, “সবাই মনে করে আফু আমার গার্লফ্রেন্ড। আসলে তা না। ওয় আমার আপন মামার মাইয়া। ক্যাম্পাসের কেউ ওইটা জানে না। তুইও কাউরে কবি না। ইচ্ছা কইরা আমরা ভাব ধইরা থাকি জানি আমগে মধ্যে কিছু আছে৷ আমার ডরে কেউ ওর কাছে আসে না। এই প্রথমবার দেখলাম তুই খালি আশেপাশে ঘুরোছ নাই, আমার কাছে পর্যন্ত আইসা পড়ছোছ। তুই কী জিনিস ওইটা এখনো ভালোমতো বুঝি নাই। হয় বলদ আর নয়তো বিরাট সাহসী। যেইটাই হছ, আমার আফুর লাইগা তোরে পছন্দ হইছে। যা পারলে প্রেম কর।”

আমি অতি আনন্দে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ নড়ার শক্তি রইল না। মনে হলো নড়লে ঘুম ভাঙবে আর চলমান স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে।

এবার আকিব ভাই আরো নিচু গলায় বলল, “আফুও মনে হয় তোরে একটু আধটু পছন্দ করতেও পারে। এমনিতে ওর পিছনে কেউ ঘুরলে লগে লগে কইয়া দেয় আমারে। কিন্তু তোর কথা কিছু রিপোর্ট দেয় নাই।”

আমি এতক্ষণে মুখ খুললাম, “ভাই যা বললেন সত্যি?”

আকিব ভাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার কথা শ্যাষ। একটা কথা মনে রাখিছ, সুযোগ দিলাম, কিন্তু বেশি তেড়িবেড়ি করলে ভুড়ি ফাঁসায় দিমু এক্কেবারে৷”

“আচ্ছা ভাই।”

আকিব ভাই এমনভাবে চলে গেল যেন আমি ছেঁড়া কার্পেটের একটা উঠে যাওয়া সুতো। একবার ভুরু কুঁচকে দেখে গটগট করে বেরিয়ে গেল।

আমি অবশ্য কিছু মনে করলাম না। আনন্দে নাচতে নাচতে পৌঁছে গেলাম ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে। তখন লাঞ্চের পর ক্লাস শুরু হওয়ার তোড়জোড় চলছে। আফ্রিতা কয়েকটা ফটোকপি করা কাগজ সাজিয়ে স্টেপল করে পাশে দাঁড়ানো মেয়েটাকে গুছিয়ে দিচ্ছে। আমি ওর কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সে আমাকে দেখেছে আগেই। এবার এগিয়ে এসে বলল, ” মাসুদ রানা! এবার কী দরকার?”

“তোমার সাথে একটু কথা ছিল।”

“কী কথা?”

“এখন তো তুমি ক্লাস করবা তাই বলা যাবে না সবটা। ফোন নাম্বারটা দিবা তোমার?”

“তুই হঠাৎ আমাকে তুমি বলছিস কেন? ঘটনা কী? আর আমি কাউকে নাম্বার টাম্বার দেই না।”

“ওহ।”

“তুই সারাদিন টইটই করিস কেন? যখনই দেখি তখনই চরকির মতো ঘুরছিস আর খাচ্ছিস?”

আমি খানিক লজ্জা পেলাম। গলা দিয়ে উঠে আসা ঢেকুরটাও কোনোমতে আটকে নিলাম৷ আফ্রিতা বলল, “আমার সাথে প্রেম করার ইচ্ছা থাকলে কেটে পড়। আমার তোকে পছন্দ না।”

“সত্যি পছন্দ না?”

“না।”

“কেন?”

“কারণ তুই একটা প্রথম শ্রেণির গাধা।”

আমি রেগে গিয়ে বললাম, “তুই এটা বলতে পারলি আফ্রিতা?”

আফ্রিতা কাছে এসে বলল, “তুই যে গাধা তার একশোটা প্রমাণ দিতে পারি। একটা বলি, তুই আমাকে তুই বা তুমি কোনোটাই জোর দিয়ে বলতে পারছিস না। তোর পার্সোনালিটি একেবারেই নিচের স্তরের। এবার তুই আমাকে শুধু একটা প্রমাণ দেখা যে তুই চালাক।”

আমি চালাকির কী প্রমাণ দেখাব সেটা বহু ভেবেও পেলাম না। আফ্রিতা ততক্ষণে ক্লাসে ঢুকে গেছে।

(চলবে)