একথোকা কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৮

0
207

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া
#পর্বঃ৮
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১৫,
” তোমরা দুজন রাতের এই সময়ে বাইরে কোথায় ছিলে? ”

সাজিয়ার প্রশ্নের কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছেনা ধারা। শ্রাবণেরও সবসময় মুখে কথার খই ফু”টে। অথচ এই মুহুর্তে যেনো সব কথা হারিয়ে গিয়েছে মুখ থেকে। মাথা নিচু করে ক্রমাগত কি উত্তর দিবে ভেবে যথা যাচ্ছে। ধারার মনেও সেই একই চিন্তা কি বলবে! বোনের কাছে তো কখনও কিছু লুকায় না। কিন্তু শ্রাবণ সম্পর্কিত সব কথা লুকিয়ে গিয়েছে সে। কি করবে সত্যটা বলবে? কিন্তু এই মুহুর্তে সত্যটা বলে শ্রাবণকে লজ্জায় ফেলতে ইচ্ছে করছে না তার। শ্রাবণ চলে যাক, এরপর না হয় বলবে। এই ভেবে সে বলে বসে,

” এমনিই আপু পড়তে উঠেছিলাম। তুমি জানো আমি রাতে পরিক্ষার সময় পড়ার জন্য উঠি। বাইরে এমনিই কিছু শব্দ শুনে মনে হলো বাড়ির বাইরে কেউ আছে। পরে গেট খুলা দেখে বাইরে গিয়ে দেখি উনি বাইরে পুকুরপাড়ের দিকটায় যাচ্ছেন। পরে কিছু যদি কামড়ে দেয়! এজন্য বাড়িতে আসতে বললাম। আসার সময় একসাথেই আসা হলো। এটাই আর কিছু না। ”

” ধারা! তুই যে মিথ্যা বলতে পটু না এটা তুই জানিস? ”

ধারার কথার উত্তরে কথাটা বলে সাজিয়াব। ধারা বোনের উত্তরে হাসফা”স করে চাহনী একবার ঘরের দিকে একবার উঠোনের মাটির দিকে নামিয়ে নিচ্ছে। শ্রাবণ বি”স্ফোরিত চাহনীতে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তো এতক্ষণ ভেবেচিন্তে সব সত্য কথাই বলে দিবে ভেবেছিলো। এখন ধারা এটা কি বলে বসলো। পুরো ঘটনা একটা মিথ্যায় মুড়িয়ে দিলো। সত্য বলে গলায় যদি ফাঁ”সির দড়ি উঠে সেটাও ভালো শ্রাবণের কাছে। তবুও ধারার কাছ অব্দি আসার জন্য অনেক মিথ্যে বলে ফেলেছে সে। রবের কাছে তওবা-ও করেছে সে। এখন রব জানেন তিনি শ্রাবণের তওবা কবুল করেছেন কিনা! মিথ্যা দিয়ে আর কিছু ঢাকতে চায় না বলেই সে সত্য টা বলতে উদ্ধত হতেই ধারা তখনই বলে,

” মানে কি বলতে চাও আপু?”

” তুই মিথ্যা বলে আমার কাছে কিছু লুকাতে চাইলে আমার চোখে চোখ মিলাতে পারিস না তুই। সব কথা অকপটে চোখে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলিস। কিন্তু এখন তো পুরো চোখ নামিয়ে কথা বলছিস। ”

ধারা দমে যায় বোনের কথা শুনে। সত্যই তার মিথ্যা বলার অভ্যাস টা খুব কম। প্রয়োজন ছাড়া কারোর কাছে কিছু আড়াল করতে মিথ্যা বলে না। মিথ্যা বলার মতো আত্মবিশ্বাস তার ভেতরে নেই, যতটা সত্য বলার জন্য আছে। শ্রাবণ দুইবোনের মাঝে কোনো রকম মনোমালিন্য হোক চায় না। তাই সে নিজেই বলে উঠে,

” আপু আমি সব সত্য টুকুই বলছি। আমি ধারাকে ভালোবাসি। সেজন্য তার অতীত টুকু জানতেই আমি ডেকেছিলাম ওকে৷ সকালে আপনার মায়ের সাথে বলা কথাগুলোর অর্থ বুঝতেই আমি ওকে ডেকেছিলাম। ”

ধারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ তাকে ভালোবাসে নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে স্বীকার করে নিলো তার বোনের কাছে। সাজিয়াও অবাক নয়নে বাকরুদ্ধ হয়ে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে। জড়ানো কন্ঠে ধীরে শ্রাবণের কথার উত্তরে সাজিয়া বলে,

” মানে কি শ্রাবণ? ধারাকে ভালোবাসো? কবে থেকে? কিভাবে এই ভালোবাসার সূচনা? ধারা কি তোমায় ভালোবাসে? ”

” না ভাবী, আমার ভালোবাসা একপাক্ষিক। ”

এরপর শ্রাবণ ধারার সাথে পরিচয়ের শুরু, কলেজে গিয়ে ওকে ফলো করা সবকিছুই বিস্তারিত বলে। ধারা এই সময় টায় মাথা নিচু করে শুধু শ্রাবণের বলা কথা আর মাঝে মাঝে বোনের দিকে তাকিয়ে তার প্রতিক্রিয়া বুঝার চেষ্টা করেছে। সব শুনে সাজিয়া শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বলে,

” ধারাকে ভালোবাসো? অথচ ওর অতীত জানতে চেয়ে অতীতের ক্ষ”তই তাজা করে দিলে শ্রাবণ? ”

” অতীত না জানলে, ক্ষ”তটা কিসে! এগুলো না জানলে ক্ষ”ত কি সাড়ানো যায় ভাবী? মানুষ বলে ভালোবাসলে নাকি মানুষ টাকেই ভালোবাসতে হয় শুধু। আগে পিছে কি আছে জানতে হয় না। আমার কাছে তো মনে হয়ে ভালোবাসলে তার অতীত হোক বা বর্তমান সবকিছুই জেনে ভালোবাসা উচিত। যেনো অতীতের ভুলটা দ্বিতীয়বার জীবনে আবার না হয়ে বসে। ”

সাজিয়া সব কথা শুনে শ্রাবণ বা ধারা কাউকে কিছু বললো না। শুধু বললো নিজেদের ঘরে যেতে। এরপর সেও ঘরে চলে যায়। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে সে পরে ভাববে। ঘরে এসে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে ধারা। কিন্তু শ্রাবণের এই অকপটে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি মনে একপ্রকার অজানা অনুভূতি অনুভব করতে বাধ্য করায়।

১৬,
ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসে অবস্থান রত কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচে এসে বসলো ধারা। পুরো ক্যাম্পাসে এইখানে শুধু ফাঁকা জায়গা পেলো সে৷ সবাই ক্যান্টিনের দিকে ছুটছে। ধারার কিছু খেতে ইচ্ছে করছেনা বলে এখানে এসে বসলো। শীত পেরিয়ে বসন্তের মাঝামাঝি সময় এসে গেছে। রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইংলিশে অনার্স করার সুযোগ পেয়েছে ধারা। এখন ক্লাস নেই, ব্রেক চলছে। এরপর আর একটা ক্লাস করেই বাসায় চলে যাবে ধারা। কলেজের হলে সীট পায়নি ধারা। বাসা কলেজ থেকে দূরে হলেও কিছু করার নেই। সময় নিয়ে বেরুতে হয়, সময় নিয়েই বাসায় পৌছাতে হয়। মাত্র কয়েক মাসেই হাপিয়ে উঠেছে ধারা। মাঝখানে কে*টে গেছে কতগুলা মাস। কিন্তু শ্রাবণের সাথে এরমাঝে দেখা হয়নি ধারার। সেদিন রাতে ওভাবে বড় বোনের কাছে ধরা পরে যাওয়ায় একপ্রকার রা”গ জমেছিলো তার শ্রাবণের উপর। কিন্তু শ্রাবণ তার কথা রেখেছে। চলে গিয়েছিলো সেদিন সকালে। এরপর আর ধারার সামনে এসে দাড়ায়নি, তাকে বিরক্তও করেনি। কিন্তু অস্বীকার করার জো নেই ধারা তাকে মিস করে, খুব করে মিস করে। শ্রাবণকে দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সে চেষ্টা করেনা দেখা করার। পরিক্ষা শেষে বোনের বাসায় যাওয়ার পর তাহিরার সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো একবার। তার কাছে শুনেছিলো, শ্রাবণ ঢাকায় চলে গিয়েছে। ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এসে শুধু মাত্র ধারার জন্য সে বাড়িতে ছিলো। সেখানে ধারাই ওকে গ্রহণ করেনি বলে ও চলে গিয়েছে ঢাকায়। তাহিরার কাছে এসব শুনতে চায়নি ধারা। কিন্তু তাহিরা আগ বারিয়ে বলেছিলো। শ্রাবণের জন্য ধারার মনে যে মায়া কাজ করে তা এড়িয়ে চলতে পারেনা ধারা। রোজ মায়ায় দং”শনে বি”ষাক্ত হয় তার মন। অবশ্য পরে তার বড় বোন জানতে চেয়েছিলো শ্রাবণের সাথে যদি তার বিয়ের কথা আগায়, মতামত আছে কিনা তাতে! ধারা মানা করেছিলো। কিন্তু এখন তো রোজ শ্রাবণের দ”হনে পু”রছে সে। লাজলজ্জা ভুলে শ্রাবণের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে কিভাবে সে! আনমনে গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে এসব ভাবছিলো ধারা। তার খুব কাছাকাছি কারোর নিঃশ্বাস অনুভব করছে সে। চট করে চোখ খুলে তাকায় ধারা। তার সামনে শ্রাবণকে বসে থাকতে দেখে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌছে যায় ধারা৷ শ্রাবণ আর তারমাঝে মাত্র ২-৩ইঞ্চির ফারাক। এতোটা কাছাকাছি বসে সে ধারার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে৷ ধারা শ্রাবণকে এই অবস্থায় নিজের কাছে দেখে চট করে চারদিকে তাকিয়ে দেখে কিছু স্টুডেন্ট’স তাদের দিকে তাকিয়ে আবার চলে যাচ্ছে। শ্রাবণকে এতো কাছে দেখে ধারা সরে যাওয়ার শক্তি টুকু যেনো হারিয়ে গিয়েছে। ধারা থতমত অবস্থায় বলে,

” আপনি? এখানে কি করে? আর আমার এতোটা কাছাকাছি বসেছেন কেনো? সরে বসুন বলছি। ”

” এভাবে শুধু আমার থেকে পালিয়েই বেড়ালেন মিস ধারা। উপস শুধু ধারা নয় শ্রাবণের ধারা। ”

শ্রাবণের এহেন কথায় আরেক দফা বিস্ময় প্রকাশ পায় ধারার চোখমুখে৷ শ্রাবণ ধারার এই অবস্থা দেখে মনে মনে ভীষণ মজা পাচ্ছে। ধারা তুতলিয়ে বলে উঠে,

” কিসের শ্রাবণের ধারা মিঃ শ্রাবণ। আপনি আগে আমার কাছ থেকে সরে বসুন বলছি। আমার দম আটকে আসছে৷ ”

” এতটুকুতেই এতোটা ভয় পেয়ে গেলেন মিস রেজিয়া সুলতানা ধারা। আমার কূষ্ণচূড়া। ”

১৭,
শ্রাবণের কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারছেনা ধারা। মুখে কুলুপ এটে বসলো সে। আর কোনো প্রশ্ন করলো না। শ্রাবণ নিজ থেকেই সরে ধারার পাশে বসলো। ধারার মতে গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ করে বসলো। ধারা এবার নিজেই শ্রাবণের দিকে সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে৷ শ্রাবণ চোখ বন্ধ করা অবস্থাতেই বলে,

” এভাবে দেখবেন না আমার কৃষ্ণচূড়া। মনের মাঝে ঝ”ড় উঠে৷ ”

ধারা চমকে যায়। শ্রাবণ তো চোখ বন্ধ করে আছে। তাহলে সে তাকিয়ে শ্রাবণকে দেখছে বুঝলো কিভাবে!

” আমার দিকে তাকিয়ে আছেন এটা বুঝতে চোখ খুলে দেখতে হবেনা মিস কৃষ্ণচূড়া। আপনার কাছাকাছি থাকলে আপনার প্রতিটা অনুভূতি আমি অনুভব করতে পারি৷ ”

” আজব তো আপনি না দেখতেই, না বলতেই আমার গতিবিধি কিভাবে ধরে ফেলছেন বলুন তো! ”

ধারা শ্রাবণের এমন হেয়ালিতে বিরক্ত হয়ে কথাটা বলে। শ্রাবণ মুচকি হাসে। সেও এবার চোখ খুলে ধারার চোখের দিকে পিপাসিত চাহনীতে তাকায়। কতদিন না দেখার পিপাসা যেনো এই চাহনীতেই মিটিয়ে নিবে আজ। ধারা অসস্তিতে পরে যায় শ্রাবণের এমন কর্মে। সে মাথা নিচু করে নেয়। শ্রাবণ ধীর গলায় ধারার উদ্দেশ্যে বলে,

” কৃষ্ণচূড়া! আপনি লজ্জা পেলে তো আপনার সৌন্দর্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আপনি কি এটা জানেন? ”

” কি তখন থেকে কৃষ্ণচূড়া কৃষ্ণচূড়া বলে ডেকে যাচ্ছেন? আমি ধারা, কৃষ্ণচূড়া নই৷ ”

শ্রাবণ সেই আগের মতোই রয়ে গেছে বিরক্তিকর৷ খিটখিটে মেজাজে কথাটা বলে ধারা। শ্রাবণ এবার শব্দ করে হাসে। এরপর উত্তর দেয়,

” রেজিয়া তো কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম তাইনা মিস রেজিয়া সূলতানা ধারা। ”

” রেজিয়ার সাথে আরও একটা শবদ যুক্ত আছে মিঃ শ্রাবণ। ”

” হুম জানি। ডেলোনিক্স রেজিয়া৷”

” আপনি আমার পুরো নাম জানলেন কি করে? কে বলেছে? ”

” যাকে ভালোবাসি, কিছুদিন পর উপরওয়ালা চাইলে বিয়েও করবো৷ তার নামটুকু জানবোনা? ”

শ্রাবণের এমন উত্তরে ভেবাচেকা খায় ধারা। এ লোক বিয়ে অব্দি গড়িয়ে গিয়েছে! ধারা সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলে,

” একটা কথা বলুন তো। ”

” কি কথা? ”

” আপনি না ঢাকায় ছিলেন, তাহিরা আপু বলেছিলো। কিন্তু আপনি এখানে কেনো? আমি এই সময় এখানে আছি জানলেন কিভাবে? ”

” আমি বলেছি। ”

তখনই তাহিরা সামনে এসে উত্তর টা দেয় ধারার প্রশ্নের৷ ধারা তাহিরাকে দেখে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে তাকায়৷ এরপর বলে,

” তাহিরা আপু তুমি এই কলেজে পড়ো জানি। সেজন্য অবাক হলাম না তোমায় দেখে। কিন্তু তোমাদের ভাবী দেবরের মতলব কি বলো তো?”

চলবে?