একথোকা কূষ্ণচূড়া পর্ব-০৭

0
197

#একথোকা_কূষ্ণচূড়া
#পর্বঃ৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১৩,
পুকুরপাড়ে ধারার জন্য অপেক্ষা করছে শ্রাবণ। মেসেজ দিয়ে তো বসে আছে শ্রাবণ। সে জানেও না ধারা আদৌও আসবে কিনা! এক নাম্বার তো ব্ল’ক দিয়ে রেখেছে, অন্য নাম্বার দিয়ে মেসেজ দিয়ে তো দিয়েছে। না এসে এটাও ব্ল’ক করে দিলে তো হয়ে গেলো। ধারার সাথে যোগাযোগ রাখার কোনো রাস্তাই থাকবেনা। যেভাবেই কন্টাক্ট করতে যাবে, ধারা এড়িয়ে যাবে। মেয়েটার মন পাথর বাধানো কিনা কে জানে! ধারা রাতের বেলা উঠে পড়তে বসে এটা সে ধারার বেস্টফ্রেন্ডের থেকেই জেনেছে। তার নিজের জন্য সেই ফ্রেন্ডশিপ টাও ভেঙেছে। এজন্য সে ধারার সব বান্ধবিকে সত্য টা বলে জানিয়েছিলো সে ধারাকে সত্যিই ভালোবাসে। ধারার স্বভাব, ধারা কেমন মানুষ পছন্দ করে এসব জানতে গিয়েই কথায় কথায় ধারার সম্পর্কে একটা সিঙ্গেল ওয়ার্ড বলতেও বাকি রাখেনি তারা যেগুলো ধারার সম্পর্কে জানে ওরা। ধারা মেয়েটাই কেমন বিচিত্র ময়। যে ওকে ভালোবেসে আগলে রাখতে চাইবে তাকে হয়তো ও গুরুত্বই দিবেনা। নিজে যাকে আগ্রহ নিয়ে ভালোবাসবে, সে যদি বাসে তবেই ধারা সম্পর্কে জড়াবে। এটাও ধারার ফ্রেন্ড’স রা বলেছে। সেই মেয়ে কি আদৌও তাকে ভালোবাসবে? মনের মাঝে নানান দ্বিধাদ্বন্দের দেয়ালে ভালোবাসা যেনো আড়াল হয়ে যাচ্ছে তার।

” বলুন! কি বলতে এতোরাতে আমায় এভাবে জরুরী তলব দিয়ে আনা? কি বলতে চান? ”

পেছন থেকে হুট করেই ধারার গলার স্বর শুনে ফোনের ফ্লাশ জ্বা’লিয়ে পিছ ফিরে তাকায় শ্রাবণ। ধারার মুখ বরাবর আলোটা গিয়ে পরে। ধারা সরাসরি চোখে আলো লাগায় একহাত মুখের উপর দিয়ে মুখটা আড়াল করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে যায়। শ্রাবণ অপলক সেই ব্যস্ত ধারাকে দুচোখ ভরে দেখছে। তখনই ধারা কঠিন গলায় বলে উঠে,

” আমি হারিয়ে যাচ্ছি না। পরেও দেখা যাবে। আপাতত দয়া করে লাইট বন্ধ করুন। ”

ধারার কথা শুনে তড়ঘড়ি করে শ্রাবণ টর্চ বন্ধ করে। এরপর ফোনের ডিসপ্লের নরমাল আলোয় পুকুরপাড়ে শান বাঁধানো জায়গায় ধারাকে বসতে বলে। ধারা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অকপটে বলে,

” প্রেম করতে এখানে আসিনি। এমনিই ঠান্ডা। পাকা জায়গায় বসবোনা। আপনি একটু তাড়াতাড়ি বলুন দয়া করে। শুনে আমি বিদেয় হই৷ ”

শ্রাবণ মুচকি হাসে ধারার উত্তরে। অন্ধকারে হাসিটা দেখতে পেলোনা ধারা। দেখলে হয়তো তেলেবেগুণে জ্ব”লে উঠতো সে৷ ধারা শ্রাবণের নিরবতায় ফের খ্যাঁক করে বলে,

” বলবেন আপনি? নাকি আমি চলে যাবো! ”

” আচ্ছা ধারা আমাকে কি সত্যিই ভালোবাসা যায়না? ”

এতোক্ষণ শ্রাবণ কি বলে জানতে উৎকন্ঠা হয়ে ছিলো ধারা। কিন্তু শ্রাবণের এই প্রশ্নে সে চুপসে যায়। শান্ত গলায় বলে,

” এই কথা জানতে আমায় ডেকেছিলেন? ”

” আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী ধারা। আমি আমার সমস্ত ভুলের জন্য আপনার কাছে আবারও ক্ষমা চাচ্ছি। রবের কাছে পাপ করে মন থেকে ক্ষমা চাইলে নাকি রবও ক্ষমা করেন! আপনি তো রবের বান্দী। আপনি কি ক্ষমা করবেন না আমায়? ”

” আপনার সাথে আমার তেমন ক্ষমা চাওয়া বা ক্ষমা করার মতো সম্পর্ক নয় শ্রাবণ সাহেব৷ আপনার উপর আমার রাগ ব্যতিত কিছু ছিলো না। আপনার কাজগুলো আমার কাছে বিরক্তির কারণ। আপনি জলদি দয়া করে এখান থেকে চলে যান। ”

” চলে যেতে বলছেন? আর দুদিন থাকি না? ”

ধারার কথার জবাবে করুণ স্বরে অনুরোধ টা করে শ্রাবণ। ধারা চোখ বন্ধ করে একনিশ্বাসে উত্তর দেয়,

” না থাকতে পারেন না। আপনাকে বললাম না আমি যথেষ্ট বিরক্তিকর মনে হয়। আমার পরিক্ষা আরও দুটো আছে। দয়া করে এখন এভাবে এসব কথা বলে আমার মানসিক অশান্তি সৃষ্টি করবেন না। ”

” আচ্ছা চলে যাবো ওয়াদা দিচ্ছি। কিন্তু তার আগে একটা কথা আমায় বলতেই হবে। নয়তে আমি ফিরবোনা আর সাজিয়া ভাবীকে বলে দিবো, আপনার সাথে আমার সম্পর্ক। আপনি অস্বীকার করলে এই যে রাতের একটায় আমার ডাকে পুকুর পাড়ে আসলেন! বলবো না ভালো বাসলে কেউ কারোর ডাকে আসে এভাবে? সাক্ষী হিসেবে কাজে লাগাবো আমার ভাবীকে। ”

” নিজেকে আমার চোখে আরও নিচে নামাচ্ছেন শ্রাবণ সাহেব? ”

” না ধারা। আপনি অনেক জেদি যার ফলে এভাবে বলতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু আপনি না বললে আমি সত্যি কিন্তু এমন করবো। ”

” আমার বোন আমায় যথেষ্ট বিশ্বাস করে। তবুও আপনার এই একটা ইচ্ছে আমি রাখবো। এরপর কাল সকালে এটার বিনিময় হিসেবে চলে যাবেন আপনি। ”

১৪,
পুকুরপারের শানবাঁধানো ঘাটেই বসে পরেছে ধারা। শ্রাবণ আর কিছু নয় তার মায়ের সঙ্গে অতীতের কি ঘটনা জড়িয়ে আছে এটাই জানতে চেয়েছে। ধারা প্রথমে একটু ক্ষি”প্ত হলেও পরে নিজেকে সামলে চুপচাপ বসে পরে। পায়ের স্যান্ডেল খুলে তার উপর বসেছে বলে ঠান্ডা তেমন লাগছেনা ধারার। শ্রাবণ ধারার থেকে একটু দূরত্বে ধারার দেখাদেখি সেও স্যান্ডেল খুলে বসেছে। দুজনেই শালচাদরে নিজেদেরকে আর একটু আকড়ে নিয়ে বসে রইলো। একটুপর ধারা ধীর গলায় বলতে শুরু করলো,

” আম্মুর যখন নতুন সংসারে বাচ্চা হচ্ছিলো না, আর উনার নতুন স্বামীরও আগের পক্ষের কোনো বাচ্চা ছিলো না। উনারা সন্তানের অভাবে প্রতিনিয়ত হয়তো মুষড়ে পরতেন। আমার আম্মু আমার দায়িত্ব নিতে ফিরে আসলেন। পুলিশ, কেস অনেককিছুই চললো। যেহেতু সন্তানের বয়স সাতবছর হওয়া অব্দি বাবা না থাকলে বা কোনো সমস্যা হলে মায়েরই দায়িত্ব থাকে। তখন ছোট্ট ছিলাম, বয়স কত হবে, সবে ৫বছরে পা দিয়েছিলাম। বাবা মা”রা যান যখন, তখন আমার বয়স আড়াই বছর ছিলো। আম্মু উনার নতুন সংসারে আড়াই বছর চেষ্টা করে বাচ্চা না পেয়ে আমায় নিতে আসলে বড়বাবা, ফুফু,আপু,ভাইয়া নিয়ে যেতে রাজী ছিলো না। পুলিশ, কেস এসব করে আমার বয়স সাতবছর হওয়া অব্দি নিজেদের কাছে রাখে। উনারা যথাযথ ভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতেন৷ কিন্তু আমি ঐ মহিলাকে ঘৃ’ণা ব্যতিত কোনো অনুভূতিতে রাখতে পারতাম না। একটু একটু বুঝে ভাইয়া,আপু সবার থেকে দূরে রাখার ফলে ঘৃণাটা আরও প্রগাঢ় হয়। বয়স সাত হতেই আরেক দফা কেস,কোর্ট পুলিশ দৌড়ে আপুর কাছে চলে আসলাম। যেহেতু একটু করে বুঝতে শুরু করেছিলাম, মনে ওনাদের সাথে কাটানো বিষাক্ত দিনগুলো মনেও ছিলো। আপু দেখতে গেলে দেখতে অব্দি দিতো না। উনার সন্তানের এতো লোভ, আমাদের তিন ভাইবোনকে নিতে পারতেন। নেননি, এটাও একটা ঘৃণার কারণ হয়ে দাড়ায়। এরপর এভাবেই আপুর কাছে আসার পর আমার একটা করে ক্লাস পার হয়, উনি বছরের শেষে এসে উনার অস্তিত্ব জানিয়ে দিয়ে যান। উনি চাইলেই পারতেন বাবা মা”রা যাওয়ার পর আমাদের আগলে রেখে জীবন কা”টাতে। বাবার জীবনের শেষদিন অব্দি বাবার পাশে থাকতে উনি থাকেননি। আমাকে কোনোভাবে কাছে রাখতে না পেরে উনার নতুন সংসারে পাওয়া ভাসুরের ছেলেকে দিয়ে আমি ক্লাস নাইনে উঠতেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন।কেউ তো বিয়ে দিবেই না। ছেলেটা ভালো ছিলো, বিয়ের জন্য যাকে বলে পারফেক্ট। কিন্তু ঐ বিয়ে সম্ভবই না। পারফেক্ট পাত্র, তাকে আমার মতো শ্যামলা রঙের অধিকারী মেয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে, ওনার আত্মসম্মানে লাগে। স্কুলের পথঘাটে রাস্তা আটকে বি’রক্ত করতে শুরু করেন। আপুকে জানাই ব্যাপারটা। গ্রামের মাতব্বরদের নিয়ে একটা ছোটোখাটো বিচারও হয়ে যায় এই ঘটনা নিয়ে। ছেলেটার আত্মসম্মানে গিয়ে আবারও লাগে। শহরে নিজের চাকরি ছেড়ে এসে আমার পিছনে আদাজল খেয়ে পরে থাকতে লাগলেন। এরপর একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ঐ ছেলেটা কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে, উনার বন্ধু হয়, তারা সহ এসে রাস্তা আটকায়, আমাদের গ্রামে হাইস্কুল নেই। পাশের গ্রামে যেতে হতো। পাচ টাকার রাস্তা অটোভ্যানে। হেঁটে আসতাম যেতাম। পিরিয়ড শুরু হয়েছিলো, স্কুলেই। বিপাকে পরে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সেদিনও উত্যক্ত করতে ওনাদের রাস্তায় দেখতে পাই। দুপুরের সময়, রাস্তা ফাঁকা। আশেপাশে ক্ষেতে খামারেও লোকজনের দেখা নেই। গ্রামের দিকে সবাই খা খা রোদ্দুরে বাড়িতে আরাম করতে ব্যস্ত। বুঝলাম বাজে কিছু হলে হতেও পারে। তবুও সাহস নিয়ে এগিয়ে চললাম। তাদের মুখোমুখি হতেই সেদিন সবকিছুর সীমা লঙ্ঘন করে আমার কাপড়ে হাত পৌছায় তাদের। স্কার্ফ থেকে সব পিন খুলে জামার পকেটে রেখেছিলাম, একটা বই হাতে ছিলো। স্কুল ব্যাগ ফেলে দিয়ে ঐ বই দিয়েই বারি দিতে লাগলাম। এরপর স্কুলড্রেসের জামার পকেট থেকে পিন বের করে ফু”টিয়ে দেই। এরকম ধ্বস্তাধ্বস্তির একপর্যায়ে আমায় ঐ ছেলেটা থা”প্পড় মে”রে বসে। মাথা ঘুরে উঠে, ছিটকে পরি রাস্তায়। এরপর আর কিছু মনে ছিলো না। সেন্স ফিরতেই দেখি আমার রুমে। পরে জানতে পারি রাস্তায় তখন আমাদের গ্রামেরই এক বড় ভাই জেলাশহর থেকে নিজের মোটরসাইকেলে ফিরছিলেন। উনি এই ঘটনা দেখে ভাইয়াকে ফোন দিয়ে ডেকে নেয়৷ ওদের সাথে ধ্ব’স্তাধ”স্তি করে আমায় নিয়ে আসে। ঘটনাগুলো মোটামুটি পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেলে অনেকে সহানুভূতি দেখায়, অনেকে কটু কথা বলে যে মা যেমন, মেয়েও তেমন। শুধু পুরুষের প্রতি ছুঁক ছুঁক স্বভাব৷ এগুলো শুনে উনার প্রতি আরও ঘৃণা জমে যায়। আর ঘৃণা জমে ভালোবাসা শব্দের প্রতি। জিদ হয় নিজের প্রতি যে এমন ভাবে চলবো যেনো কেউ কথা শুনানোর সুযোগ না পায়। এগুলো কারণের জন্যই মানুষের সাথে মিশতে পারিনা আমি। মায়ের সাথে সব স্মৃতি আমার মনে ছিলো না। বড় আপুর কাছে আমি ছোটো থাকতে আমার সাথে ঘটানো ঘটনা গুলো শুনেছি আমি। আবছা মনে পরতো, আপুকে জিগাসা করলে সবটুকু বলতো। আর বড় হয়ে আমার সাথে কি ঘটনা ঘটিয়েছেন তা তো আমি নিজেই মুখোমুখি হয়েছি। এই নাকি উনি মা! হাসি পায় উনাকে মা ডাকতে। আপনি যেমন কলেজের আশেপাশে গিয়ে বলতেন, ভালোবাসেন,আপনাকে যেনো ক্ষমা করে ভালোবাসি। আপনার এই স্বভাবগুলোয় আমার অতীতের ক্ষ”ত তাজা হয়। তাই অনুরোধ চলে যান আপনি। ”

একদমে কথাগুলো বলে ধারা উঠে হাটা ধরে নিজের ঘরের দিকে। শ্রাবণ নিরবে পুকুরপাড়ে দুফোঁটা অশ্রু ঝড়ায়। তার নিজের জন্য খারাপ লাগছেনা। বরং খারাপ লাগছে ধারার জন্য। ছোটো থেকে এতো ঝড়-ঝাপটা আর বড় হয়ে এতো অসম্মানের ক্ষ”ত নিয়ে প্রতিটা দিন সমাজের সাথে ল’ড়াই করে চলছে সে। ধারা চলে যেতেই সেও উঠে দাড়ায়। একটু জোড়ে হেটে ধারার পাশে গিয়ে পাশাপাশি হাটে। ধারা একবার দেখে নিয়ে নিশ্চুপে গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে। এরপর শ্রাবণও ঢুকে পরে। ওরা ঢুকতেই দেখতে পায় বারান্দায় সাজিয়া দাড়ানো। বারান্দায় দেওয়া সিমেন্টের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে সে দাড়িয়ে আছে। ধারা আর শ্রাবণ ঢুকতেই সে ওদের সামনে গিয়ে দাড়ালো। ধারা তো বড় বোনকে এভাবে জেগে থাকতে দেখে ভয়ে ভেতরে ভেতরে জমে গিয়েছে। শ্রাবণ আর তাকে একসাথে দেখে সাজিয়ার কি রিয়েকশন হবে ভাবতেই ভয়ে মন কেঁপে উঠছে ধারার।

চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আসসালামু আলাইকুম।