এক টুকরো নূর পর্ব-১৭+১৮

0
114

#এক_টুকরো_নূর
—————-(১৭ পর্ব)
লেখা: উম্মে হানি মিম

নূরার মুখটা অন্ধকার দেখে মিসেস লিপি যেন তার মনের কথাটাই বুঝে গেলেন।নূরাকে আশ্বস্ত করে বললেন,”ভেবো না ওখানে জাহিদরা আসবে না।অন্য মেহমানরা থাকতে পারেন।তুমি যেভাবে স্বস্তিবোধ করো সেভাবেই বোরকা পরে যাবে।যেটাই হয়ে যাক লিপি আমার বোন, তাকে তো আর ছেড়ে দিতে পারবো না বলো?অনেক কষ্টে সাদমানকে রাজি করিয়েছি।এখন তুমি অমত করলে সাদমানও বিগড়ে যাবে।মাত্র কয়েক ঘন্টারই তো ব্যপার একটু ম্যানেজ করে নাও।”
নূরা শান্তভাবে বললো,মা আমি যাব সমস্যা নেই।আপনি চিন্তা করবেন না।
—————
নূরা একটা কালো বোরকা পরলো।হিজাব,নেকাবে পরে আপাদমস্তক ঢেকে দিলো।সাদমান কিছুক্ষণ হলো বাসায় ফিরেছে।ফ্রেশ হয়ে একটা নীল শার্ট পরলো সে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললো,”তোমার আনইজি লাগছে না তো নূরা?আমরা রাতের খাবার শেষ করেই চলে আসবো।”
নূরা মাথা নাড়ালো।
সাদমান নূরার নিকটে এসে বললো,”আমাকে কেমন লাগছে?”
নূরা মাথা নুইয়ে বললো,”ভালো লাগছে।”
সাদমান মৃদু হাসলো,”এই শার্টটা থাকবে নাকি অন্যকিছু পড়বো?”
“যেটা আপনার ইচ্ছা।”
“তোমার কোন রঙ সবচেয়ে বেশি পছন্দ?”
“সাদা আর কালো।”
সাদমান নীল শার্টটা বদলে সাদা কালোর মিশ্রণে একটা শার্ট পরে এলো,”এবার ঠিক আছে?”
নূরা লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বললো,”হুম।”

আশরাফ সাহেবদের বাসার বসার ঘরে পারিবারিক আত্মীয়স্বজনরা বসে আছেন।সবাই গল্প-গুজবে ব্যস্ত।আজকে পরশির পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা উপলক্ষে সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে।সাদমানরা পরশিদের বসার ঘরে প্রবেশ করলো।সেখানে জাহিদ সহপরিবারে উপস্থিত।জাহিদকে দেখেই সাদমানের মেজাজ বিগড়ে গেল।নূরারও অস্বস্তি লাগা শুরু হলো।
সাদমান পরশিকে ডেকে এনে রাগতস্বরে বললো,”খালামনি না বলেছিল জাহিদদের বলা হয়নি তো জাহিদ এখানে কি করে এলো?
পরশি আমতা আমতা করে বললো,”এমনিই চলে এসেছে।”
“এমনিই কেউ চলে আসে?”
সাদমানের রাগের তেজ বাড়ছে দেখে নূরা তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল।শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,”এখানে অনেক মানুষ আছে দয়া করে মাথা গরম করবেন না।আমরা তো একটু পরেই চলে যাব”
সাদমান নিজেকে সংযত করে বললো,”এখনই চলো।”
“এখন গেলে মা বাবাও আমাদের সাথে চলে যাবে।ওনাদের মন খারাপ হবে।মা আর চাচির মধ্যে এমনিতেই মনমালিন্য চলছে।একটু ধৈর্য ধরুন। আমরা চলেই তো যাব।”
সাদমান নূরার কথা ফেললো না। কাক ফুলিয়ে বললো, “কিন্তু তুমি জাহিদের সামনে আসবে না।ভিতরে যাও।”
নূরা বিষন্নভাবে বললো,”যেতাম কিন্তু পরশি বললো বসার ঘরেই বসতে হবে।”
সাদমান দাঁত কটমট করে বললো,”পরশি কিছু একটা করতে চাচ্ছে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।ঠিক আছে তুমি এসে আমার সাথে বসো।”
সাদমান আর নূরা পাশাপাশি বসলো।জাহিদ একদৃষ্টিতে নূরার দিকেই তাকিয়ে আছে আর মিটিমিটি হাসছে।সাদমানের গা জ্বলে যাচ্ছে।কোনো রকমে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সে।
কিছুক্ষণ পরেই মিহি এসে উপস্থিত হলো।সাদমান আগেই নিশ্চিত হয়েছিল মিহি আসবে কী না,অথচ পরশি এ ব্যপারেও তাকে মিথ্যে বলেছে।
মিহি বসার ঘরে প্রবেশ করেই সাদমানের দিকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে রইল।তারপর সাদমান এবং নূরার পাশাপাশি সোফাটায় এসে বসলো।বিদ্রুপ করে বললো,”আরে চিত্রনায়ক সাদমান হক যে। কী সৌভাগ্য! আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল।একটা অটোগ্রাফ তো আশা করতে পারি তাই না?”
সাদমান না শুনার ভান করে ভ্রুক্ষেপহীন বসে রইল।
জাহিদ কথাটা টেনে নিয়ে বললো,”কত ফটোগ্রাফ আছে তোমাদের আবার অটোগ্রাফ লাগে নাকি মিহি?”
মিহি ঠোঁট বাকিয়ে বললো,”সেগুলো তো অতীত এখন উনি নতুন সাদমান হক।অন্য মানুষ। এখন ওনার রুচি সহ সবই বদলে গেছে।”
জাহিদ আড়চোখে নূরার দিকে তাকিয়ে বললো”একটা মানুষের রুচি কত খারাপ হলে আরেকজনের ব্যবহৃত এঁটো তার পছন্দ হয় সেটাই ভাবছি।”
কথাটা বলা শেষে জাহিদ আর মিহি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
সাদমান উঠে দাঁড়ালো।জাহিদের কলার ধরে টেনে দাঁড় করালো তাকে, তারপর ক্রোথে ফেটে পড়ে বললো,”কী বললে তুমি?”
জাহিদ রাগতস্বরে বললো,”কলার ছাড়ো সাদমান আগেরবারের কথা ভুলে যেও না।যা বলেছি সত্যি বলেছি।আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েকে নিয়ে সংসার করছো তুমি।মানে আমার ফেলে দেয়া এঁটো জিনিসই তো এটা। ”
সাথমানের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল।চিৎকার করে উঠলো,”এত বড় সাহস তোর? কাকে নিয়ে কথা বলছিস তুই জানিস?”
মা’রতে শুরু করলো জাহিদকে।জাহিদও পিছিয়ে নেই সাদমানকে আঘাত করার চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে না।
নূরার ভয়ে হৃদপিণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সাদমানকে কোনো রকম ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।মিহি এসে নূরাকেই টেনে সরিয়ে দিলো।নূরার হাত শক্ত করে চেপে ধরে মুচড়ে দিলো।নূরা কুঁকিয়ে উঠলো। সাদমান জাহিদকে ছেড়ে নূরাকে এসে ধরে।ততক্ষণে হুলস্থুল শুনে সবাই এসে বসার ঘরে জড়ো হয়েছেন।জাহিদের মা এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন,রুক্ষকন্ঠে বললেন,”মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি এই ছেলের? আমার ছেলেটাকে এভাবে মা’রছিল কেন?”
সাদমান নূরার হাতটা ধরে রেখেই বললো,”আপনার ছেলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে এমন মন্তব্য করার সাহস পেলো কোথায় তাকে আগে জিজ্ঞেস করুন।”
মিহি বিদ্রুপ করে বললো,”সত্য কথা বললে সহ্য করার ক্ষমতা থাকা লাগে সাদমান।এই মেয়েটাকে এখনও চিনতে পারোনি তুমি।”
“আমি নূরাকে চিনি আর না চিনি তোমাকে চিনে ফেলেছি মিহি।এতদিন আমি স্বর্ণ ফেলে রেখে তামার পেছনে ছুঁটছিলাম। তুমিই আমাকে খাঁটি স্বর্ণ চেনাতে সাহায্য করেছো সে জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।আর শুনে রাখ জাহিদ নূরা আমার স্ত্রী।আমার সবকিছু এখন সে।আগে যা করেছিস, করেছিস। তখন নূরা আমার কেউ ছিল না।কিন্তু নূরা এখন সাদমান হকের স্ত্রী।তার হৃদপিণ্ডের একটা অংশ।যে আমার হৃদপিণ্ডকে আ’ঘাত করতে আসবে তাকে আমি ছেড়ে দিবো না।সাবধান হয়ে যা।”
সাদমান রাগে ফুসছে। হক সাহেব মিসেস লিপির দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসলেন।যে ছেলে এতদিন নিজের বাবা-মায়ের কাছেই মনের কথাগুলো স্বীকার করছিল না সে আজকে এক ঘর মানুষের সামনে চিৎকার করে মনের কথা বলে ফেললো।তিনি মিসেস লিপিকে ইশারা করলেন সাদমানকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।লিপি কোনোরকমে সাদমানকে শান্ত করে বাসায় নিয়ে গেলেন।

রাতের খাবার বাসায় এসেই খেলেন সবাই।সাদমান একটু খেয়েই উঠে চলে গেল।নূরাও সে জন্য ঠিকমতো খেতে পারলো না।লিপি বললেন,” কেন যে দাওয়াত খেতে গেলাম। অকারণে আমার ছেলেটা কষ্ট পেলো।ছেলের বউয়ের অপমান হলো।এখন বাসায় এসে ডিম ভেজে খেতে হচ্ছে।সাদমান তো খেলই না।”
হক সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,”এখন এসব বাদ দাও।যা হওয়ার হয়েছে।খা’রাপ মানুষ কোনোদিন ভালো হয় না।আর যেটা হয়েছে ভালোই হয়েছে, তোমার ছেলে অন্তত নিজের স্ত্রী-এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে।যেটা তার জ্ঞানশূন্য মাথায় ঢুকছিল না।”
লিপি মুচকি হাসলেন।
নূরা যেন লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছিল একেবারে। রান্নাঘর গোছানোর অযুহাতে উঠে গেল সে।
সুহাও তার পেছন পেছন গেল। তারপর নূরাকে ইঙ্গিত করে বললো,”ভাবী ভাইয়া তো আজকে পুরো ফাটিয়ে দিলো।আমি তো ভাবছিলাম কোনো সিনেমা দেখছি।একদম হিরোদের মতো করলো। হিরোইনের জন্য পারলে তো জানটাও দিয়ে দেয়।”
নূরা লাজুক হাসি হাসলো।
সুহা আবার বললো,”এটা আসলেই ভালো ছিল। তোমাকে একা প্রপোজ করার আগেই ভাইয়া সবার সামনে মনের কথা জানিয়ে দিলো।আমার তো সিনটা ভাবতেই ভালো লাগছে।”
নূরা লজ্জা মিশ্রিতকন্ঠে বললো,”কিন্তু আমার খুব ভয় লাগছিল।তোমার ভাইয়ার অনেক রাগ।আমার তো তখন কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল।”
“তোমার জন্যই তো রেগে গিয়েছিল।কত ভালোবাসে তোমাকে এবার বুঝতে পেরেছো?”
নূরা নিশব্দে মাথা নিচু করে রাখলো।

সাদমান বিছানায় শুয়ে ল্যাপটপে কিছু একটা কাজ করছিল তখন নূরা সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো।সাদমান সালামের উত্তর দিয়ে বললো,” এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
“রান্নাঘর গোছাচ্ছিলাম।”
“আমেনা খালা কোথায়?”
“আছেন তো।”
“তোমার এত কাজ করা লাগে কেন তাহলে?”
“আমেনা খালাকে সাহায্য করবো না?”
“ঠিক আছে যা খুশি করো।”
“আমার উপরও রাগ করে আছেন?”
“কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছিলাম তোমার?”
“কেন?”
“এমনিই”
“এত রাগ কেন আপনার?”
“আজকে তো জাহিদ * টাকে মে’রেই ফেলতাম।”
“এত রাগ করতে হয় না।মাথা ঠান্ডা রেখেও তো কিছু বলতে পারতেন।”
“কী বলেছিল শুনোনি? এরপরেও আমার মাথা ঠান্ডা কীভাবে থাকবে!
“রাসুল (সা.) বলেন, ‘সে ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে ব্যক্তি কুস্তি লড়ে অন্যকে ধরাশায়ী করে, বরং প্রকৃতপক্ষে সে ব্যক্তিই শক্তিশালী, যে রাগের সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৮০৯)

সাদমান কিছুক্ষণ থেমে বললো, বুঝলাম।কিন্তু তোমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা আমার সহ্য হচ্ছিল না।স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করাটাও তো স্বামীর দায়িত্ব তাই না? আমি সে জন্যই প্রতিবাদ করেছি।আল্লাহ কি আমার উপর নারাজ হবেন?”
নূরা মাথা নিচু করে বললো,”আল্লাহ ভালো জানেন।”
“জাহিদ আছে এমন জায়গায় আর কোনোদিন আমি তোমাকে নিয়ে যাব না।আমিও কোনোদিন ওর মুখোমুখি হবো না।নাহলে নিজেকে সংবরণ করতে পারবো না।”
“একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?”
“অনুমতি নেয়া লাগে?”
নূরা ঢোক গিলে বললো,”মিহির সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিবেন?আরেকবার ভেবে দেখলে হয় না।রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তো?
“শুনো নূরা মিহির সাথে যদি আমার কোনো সম্পর্ক থাকতো তাহলে আজকে সে জাহিদের সাথে একজোট হয়ে আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতো না।আমি একদিনে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি।আমার মন থেকে মিহি অনেক আগেই উঠে গেছে।যদি মিহির জন্য আমার মনে সামান্য অনুভূতি বেঁচে থাকতো আমি তোমাকে ভালোবাসতাম না।আমি তোমার কথাটা অনুধাবন করতে পেরেছি।তুমি ঠিকই বলতে হালাল সম্পর্কগুলো একদম অন্যরকম।আস্তে আস্তে আমি হালালে অশক্ত হচ্ছি নূরা।তোমাতে আশক্ত হচ্ছি।তুমি আমার চিন্তাধারায় কত পরিবর্তন ঘটিয়েছো সেটা শুধু আমি জানি।তুমি যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে তখনই আমি তোমার অভাব বুঝতে পেরেছি।এক মুহুর্ত আমি ভালো থাকতাম না।একটা সেকেন্ড নেই যখন তোমাকে আমার মনে পড়তো না।বি’ষাক্ত লাগতো সবকিছু।ভালো লাগার কাজ,ভালো লাগার সবকিছু বিরক্ত লাগতো।শুধু মনে হতো কবে তোমাকে দেখতে পাবো।মায়ের অসুস্থতা তো বাহানা ছিল মাত্র। আসলে আমিই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গিয়ে ছিলাম।তুমিহীনতা নামক ব্যাধিতে আমি ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।তোমাকে তখন না নিয়ে এলে ম’রেই যেতাম বোধহয়।এই কথাগুলো তোমাকে বলতে না পেরেও ভিতরে ভিতরে দ’মবন্ধ লাগছিল।এখন অনেকটা হালকা লাগছে। ”
কথাগুলো বলে সাদমান বড়সড় একটা নিশ্বাস ছাড়লো।
নূরার হৃদ স্পন্দন যেন থমকে গেছে।নিশ্বাসের গতি দ্রুততার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে।
সাদমান নূরার নিকটে এসে বসলো।নূরার হাতদুটো আলতো করে ধরলো।
নূরার সারা শরির কম্পিত হয়ে উঠলো।সাদমান নূরার হাতদুটো আরেকটু শক্ত করে ধরলো।চোখের ভাষায় যেন সাহস সঞ্চয় করলো তার মনে।ফিসফিস করে বললো,”ভয় পেও না নূরা, এই হাত আর কোনোদিন ছাড়ছি না আমি।জন্ম-জন্মান্তরের জন্য ধরলাম এই হাত।”
নূরার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়লো।মনে মনে বললো,”এই মানুষটার হেদায়েতই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে আল্লাহ।আমি মানুষটার সাথে দুনিয়ার জীবন এবং আখেরাতেও থাকতে চাই।জান্নাতের সুখ তখনই আমার কাছে অধিক মনে হবে যখন মানুষটা আমার পাশে থাকবে।তুমি আমার জান্নাতের সঙ্গী বানিয়ে দিও মানুষটাকে।”
———————————-
নূরা ড্রেসিন টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।সাদমান খেয়াল করলো নূরার চুল কোমড় পেরিয়ে নিচে নেমে গেছে।মেঘের মতো ঘন কালো চুল।নায়িকাদের চুলগুলো কত রকমের রঙ করা।কত অভিনব হেয়ার স্টাইল তবুও তো কখনও সাদমানের ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়নি।কিন্তু আজকে নূরার চুলগুলো খুব ছুঁয়ে দেখতে মন চাচ্ছে তার।সাদমান উঠে গিয়ে বললো,”তোমার চুলগুলো আমি আঁচড়ে দেই?
নূরা খানিকটা লজ্জা মেশানো কন্ঠে বললো,”আপনি পারবেন? ”
সাদমান মাথা নাড়িয়ে চিরোনিটা হাতে নিলো।সযত্নে চুলগুলো আঁচড়ে দিলো।
নূরার মনে হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর সময় গুলোর একটা সে পার করছে।

বিকেলে সাদমান নূরার জন্য বেলিফুলের মালা নিয়ে এলো।যত্ন করে সেই মালা নূরার চুলে পড়িয়ে দিলো।নূরা একটা সাদা শাড়ির সাথে নীল রঙের ব্লাউজ পরেছে।অপূর্ব দেখাচ্ছে।স্নিগ্ধতা যেন মুড়িয়ে রেখেছে তাকে।সাদা শাড়ি আর খোঁপায় সাদা বেলি ফুল নূরার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ করে দিয়েছে।
সাদমান একদৃষ্টিতে নূরার দিকে তাকিয়ে বললো,”একদম পুতুলের মতো সুন্দর লাগছে আমার বউটাকে।”
নূরা ভ্রু কুচকে বললো,”পুতুল কে বানায়?”
“মানুষ। ”
“মানুষকে কে বানায়?”
“আল্লাহ।”
“তাহলে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের প্রশংসা করতে সামান্য পুতুলের উদাহরণ টানতে হবে কেন?”
সাদমান নড়েচড়ে বসে বললো,” আসলেই তো।তাহলে কি আমার বলা উচিৎ, আমার বউটা মানুষের মতো সুন্দর?”
“আপনি আসলেই পাগল।” কথাটা বলে নূরা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। এভাবে হাসতে তাকে কখনই দেখেনি সাদমান।কি সুন্দর সমুদ্রের ঢেউরের মতো প্রাণবন্ত হাসি।ঝর্ণার কলরবের মতো মধুর সুরের ঝংকার তুলছে।এই হাসি দেখে দেখে তো এক জীবন কাটিয়ে দেয়া যায় অনায়াসে। সাদমান আনমনে বলে উঠলো,
” মায়াপুরির রাজকন্যার রাজ্য কোন দেশে?
হৃদয়হরণ করল যে মায়াবিনীর বেশে!
যাদুর কৌটো মুখখানি তার মায়াতে ভরা,
লাজুক লাজুক চাহনি যার পুরোটাই হৃদয়হরা।
ঐ মায়াবী মেয়ের অক্ষিদয়ে আঁটকে গেছি ফেঁসে,
হৃদয় যেন ঘায়েল করে ধনুকের ন্যায় হেসে।”
নূরা অপ্রস্তুত হয়ে হাসি থামালো।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সাদমানের দিকে।কী সুন্দর পংক্তিমালা।এত সুন্দর করে কথা বলে কীভাবে এই মানুষটা! কথার মায়ায় হৃদয়হরণ করে নেয় বার বার।
——————-
কয়েক মাস কেটে গেল, সাদমানের হঠাৎ দেশের বাইরে শুটিংয়ের কাজ পড়েগেল।নূরাকে ফেলে যেতে তার মন সায় দিচ্ছিল না তবুও কাজের সূত্রে যাওয়া তো লাগবেই।নূরা সাদমানের কাজ নিয়ে এখন আর কিছু বলে না।সুযোগ পেলেই সাদমানকে হাদিস শুনায়,কোরআনের আয়াত শুনায়।আর একান্তে মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে সাদমানের হেদায়েতের জন্য।আল্লাহর উপরই ছেড়ে দিয়েছে সবকিছু।সকাল থেকে মনমরা হয়ে সাদমানের জিনিসপত্র গোছাচ্ছে নূরা।মাথায় প্রচন্ড ব্যথা করছে তার।কয়েক বার বমিও হয়েছে কিন্তু সাদমানকে আর জাগায়নি।
সাদমান অন্যদিনের তুলনায় আজকে একটু তাড়াতাড়িই জাগলো।কারণ বারোটায় তার ফ্লাইট।উঠে হাতমুখ ধুইয়ে এসে দেখলো নূরা সব গুছিয়ে রেখে দিয়েছে।সাদমান গলা চওড়া করে ডাকলো নূরাকে।নূরা সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো।
সাদমান মৃদু হেসে বললো,”এত কাজ করতে কে বলেছে?”
“এত কাজ কোথায়?”
সাদমান খেয়াল করলো নূরার চেহারা অন্ধকার দেখাচ্ছে।কেমন যেন অসুস্থ অসুস্থ লাগছে তাকে।
নূরার বাহু ধরে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কী হয়েছে তোমার?”
নূরা কিছু বলার আগেই হুড়হুড় করে বমি করে দিলো।সাদমান পুরোপুরি আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে।নূরাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ডাকলো,”মা তাড়াতাড়ি এসো।”…
চলবে….

#এক_টুকরো_নূর
——————-(১৮ পর্ব)
লেখা: উম্মে হানি মিম

নূরাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে।কিছু টেস্ট করাতে দিয়েছেন ডাক্তার।রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছে সাদমান।তাওসিফও ততক্ষণে হসপিটালে পৌঁছে গেছে।সাদমানকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।তাওসিফ সাদমানের দুশ্চিন্তা দূর করতে বললো,”কীরে সুখবর আছে নাকি কোনো?”
“কীসের সুখবর?”
“ফোনে বললি বউ বমি করছে তাই হসপিটালে নিয়ে এসেছিস।”
“হ্যাঁ। ”
“মেয়েরা কখন বমি করে জানিস না?”
“কখন?”
“আরে বল’দ যখন মা হতে চলে।”
সাদমানের চোখদুটো চকচক করে উঠলো। কথা বলার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছে সে।উৎফুল্ল হয়ে বললো,”সত্যি? এটা তো আমি ভাবিনি।যদি তোর কথা সত্যি হয় আজ যা চাইবি তাই তোকে দিয়ে দিবো।”
“সত্যিই দিবি?”
“হ্যাঁ যা চাইবি সব।আমার এত আনন্দ হচ্ছে তাওসিফ।আমার মতো একটা অগোছালো ছেলে এবার বাবা হয়ে যাবে!ভাবতেও পারছি না।ছোট্ট একটা বাবু আসবে। আমাকে বাবা বলে ডাকবে।
সাদমান উত্তেজনায় দুহাতে মুখ চেপে ধরলো।একবার উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটছে, তো একবার বসে তাওসিফকে জড়িয়ে ধরছে।
তাওসিফ সাদমানের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে।
তৎক্ষণাৎ একজন নার্স এসে বললেন,” সাদমান সাহেব আপনার মা ডাকছেন আপনাকে।ভিতরে যান।
সাদমান চট করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর তাওসিফকে বললো, তুই এখানেই থাক তাহলে, নূরা তো এখন পর্দায় নেই তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।”
তাওসিফ মুচকি হেসে বললো, আরে কোনো ব্যপার না।তুই যা তাড়াতাড়ি। ”
সাদমান কেবিনে প্রবেশ করে দেখলো মিসেস লিপি নূরার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।সাদমানকে দেখতে পেয়ে বললেন, রিপোর্ট এসে গেছে দেখেছিস? আমার দুইটা এতটুকু বাচ্চা আবার নাকি বাবা মা হচ্ছে।
সাদমান খুশিতে আত্মহারা প্রায়।দৌড়ে গিয়ে মিসেস লিপিকে জড়িয়ে ধরলো।লিপি হাসতে হাসতে বললেন,পা’গল ছেলে তোর বাবাকে জানাতে হবে তো এই খুশির সংবাদটা।তুই থাক আমি বাইরে থেকে কল করে আসি।”
লিপি সাদমানকে ছাড়িয়ে ফোন হাতে বেরিয়ে গেলেন।নূরা আধশোয়া অবস্থায় বসে ছিল।মাথাটা একেবারে নুইয়ে রেখেছে।লজ্জা মিশ্রিত মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে।আরও লাবন্যময় দেখাচ্ছে তাকে।সাদমান নূরার পাশে গিয়ে বসলো।নূরার একটা হাত আলতো করে ধরে বললো,”তুমি আমাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ খুশিটা উপহার দিলে আজ নূরা।বলে বুঝাতে পারবো না আমি কতটা খুশি।আমার তো ইচ্ছে করছে সারা শহরে রটিয়ে দেই যে সাদমন হক বাবা হতে চলেছে।আমার নূরা মা হতে চলেছে।”
নূরা লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বললো,”পা’গলামী করবেন না।”
“আজকে তো আমি খুশিতে পাগলই হয়ে যাব নূরা।”
কথাটা বলে সাদমান নূরাকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো।একেবারে হৃদপিণ্ড বরাবর নিয়ে গেল তাকে।
নূরা, লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,”আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি নাকি এত জাপটে ধরে রাখছেন কেন?
সাদমান হাসতে হাসতে বললো,”পারলে তোমাকে আমি আমার বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখতাম নূরা।তুমি তো আমার জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন।হৃদয়ে যদি ছোট্ট একটা ঘর থাকতো সেখানে সিংহাসন বানিয়ে রানীর মতো বসিয়ে রাখতাম তোমাকে।তুমি বসে বসে আমার হৃদয় শাসন করতে।”
নূরা চোখে একবিন্দু জল চমে উঠলো।কষ্টের না,আনন্দের জল।তার জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা রইল না।পরক্ষণেই..সাদমানের জীবন বিধান আবারও ব্যধিত করলো তাকে।একটা বাচ্চা আসছে দুনিয়ায়।বাচ্চারা তো বাবার মতো হয়।সাদমানের যদি পরিবর্তন না আসে!মনে মনে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলো,”আমার আল্লাহ এমন কিছু চমৎকার ঘটাও যেন মানুষটা বাবা হওয়ার আগে তোমার যোগ্য বান্দা হয়ে উঠে।”

নূরাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে থেকে সাদমান বিছানা ছেড়ে উঠতে দিচ্ছে না।নূরা উঠতে চাইলেও ধমক দিচ্ছে তাকে।তখন থেকে সবাই সাদমানের কান্ড দেখছে আর হাসছে।হক সাহেবও পিছিয়ে নেই ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন আজকে থেকে নূরার রান্নাঘরে যাওয়া বন্ধ।আর আজকে নূরার পছন্দে সব রান্না করা হবে।জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া হবে আজ।বাসার পরিবেশ উৎসব মুখোর হয়ে উঠেছে।
এই বাসার লোকজন যেন পারলে নূরাকে মাথায় তুলে রাখবে।নূরার এত খুশির মধ্যে মা আর নোহার কথা খুব মনে পড়লো।কে জানে তারা কতটা খুশি হয়েছে!

নূরাকে সাদমান নিজের হাতে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে।নূরা কিছু খেলেই বমি করে দিচ্ছে।এর জন্য সাদমান বার বার এটা ওটা জোর করে খাওয়াচ্ছে তাকে।নূরা চরম বিরক্তি নিয়েও অল্প অল্প খাচ্ছে।খাওয়া শেষে সাদমান বললো,”এবার চোখ বন্ধ করো।নূরা চোখ বন্ধ করলো।
সাদমানের কথা অনুযায়ী তাকাতেই দেখলো,আলেয়া আর নোহা দাঁড়িয়ে আছেন।
নূরা দ্রুত উঠতে যাচ্ছিল সাদমান তাকে আটকে বললো,”উহু একদম তাড়াহুড়ো করে উঠা যাবে না।নোহা আর আলেয়া এসেই একসাথে নূরাকে জড়িয়ে ধরলেন।আলেয়া নূরার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,”আমার আম্মাটা নাকি মা হয়ে যাচ্ছে।আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না মা।অনেক অনেক দোয়া তোদের জন্য।”
নোহা বললো,”আপা আমি খালা হবো ভাবতেই এত খুশি লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না।”
নূরা লজ্জা লজ্জা চেহারায় আবদারের সুরে বললো,”এবার কিন্তু বেশ কিছুদিন আমার সাথে থেকে যাবে মা।”
সাদমান নূরাকে আস্বস্ত করে বললো,”বেশ কিছুদিন না এবার থেকে আম্মা আর নোহা আমাদের সাথেই থাকবেন।”
নূরা বিস্মিত হয়ে সাদমানের দিকে তাকালো।
“আম্মা কিন্তু একদম অমত করতে পারবেন না।নূরার পাশে এখন আপনার থাকা জরুরি। আর নোহার স্কুলও তো এখানে। এতদিন থেকে সে ক্লাস করতে পারছে না।সামনে পরীক্ষা চলে আসবে।যদি নিজের ছেলে মনে করেন তবে বারন করবেন না।
মিসেস লিপি ঘরে প্রবেশ করে বললেন,” আপনি থাকলে আমারও একজন সমবয়সী সঙ্গী হবে আপা।দুই বোন মিলে মেয়েটার যত্ন নিবো।সাদমান আর তার বাবা তো শুটিং আর ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত।
আলেয়া সংকোচ করে বললেন,কিন্তু আপা এটা উচিৎ না।আমি বেশ কিছুদিন থাকতে পারি কিন্তু একেবারে থেকে যাওয়াটা আমাদের জন্য সম্মানের না।”
সাদমান আপত্তি জানিয়ে বললো,”কেন আমার মায়ের তো আমার সাথে থাকতে আপত্তি হয় না।আপনার কেন আপত্তি হবে? আমি কী আপনার ছেলে না নাকি আপনি আমার মা না?।আপনাদের উপর আমার একটা দায়িত্ব আছে আম্মা সেটা আমাকে পালন করতে বাধা দিবেন না দয়া করে।অন্তত যতদিন নোহার পড়াশোনা শেষ না হয়।
আলেয়া হার মানলেন এই ছেলের সাথে কথায় পারা যাবে না।আজ উপলব্ধি করতে পারছেন তিনি নূরাকে কোনো ভুল মানুষের হাতে তুলে দেননি।

সাদমান আর দেশের বাইরে শুটিংয়ে গেল না।তবে শুটিংয়ের কলিগদের সাথে বেরোলো।সাদমানের মুখে খুশির খবর শুনে সবাই একটা পার্টির আবদার করলো।সাদমান সবাইকে নিয়ে জমিয়ে পার্টি করলো।খাওয়া-দাওয়া করলো।শেষ রাতে ম’দের আসর বসতেই প্রথমে আপত্তি করলো কিন্তু নিজেকে বেশিক্ষণ সংযমে রাখতে পারলো না।সেও পান করলো অল্প পরিমাণে।”
সাদমান বাশায় ফিরে দেখলো, “নূরা এখনও তার জন্য জেগে অপেক্ষা করছে।সাদমানের নে’শা হয়ে গেছে সেটা নূরাকে বুঝতে না দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে বললো,” তুমি ঘুমাওনি এখনও? তোমার কিন্তু এখন রাত জাগা বারন।”
“আপনি আবার দেরী করে ফিরলেন?”
“না মানে বন্ধুদের সাথে ছিলাম একটু দেরী হয়ে গেল।”
“আপনি নে’শা দ্রব্য পান করেছেন তাই না?”
সাদমান কাচুমাচু করে বিছানায় এসে শুলো।জড়ানো কন্ঠে বললো,”আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।তুমিও ঘুমাও।”
নূরা সাদমানের থেকে আশা গন্ধ সহ্য করতে পারলো না দৌড়ে গেল বাথরুমে।বমি চলে এলো তার।আবার এসে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো কয়েকবার। বেশ কয়েকবার বমি করে নূরার অবস্থা কাহিল।ধপাস করে সোফায় শুয়ে পড়লো।সাদমান ভয়ে নূরার কাছেও যেতে পারছে না।উঠে জামা বদলে ফ্রেশ হলো।চোখেমুখে পানি দিলো।রান্নাঘরে গিয়ে লেবুরজল খেলো।তারপর আস্তে আস্তে সজ্ঞানে ফিরলো সে।
ঘরে এসে দেখলো নূরা কাহিল অবস্থায় সোফায় পড়ে আছে এখনও।সাদমান নূরার মাথার কাছে গিয়ে বসে তার কপালে হাত রাখতেই নূরা চোখ মেলে তাকালো।সাদমান কাতরভাবে বললো,”আর কোনোদিন এটা করবো না আমি।আমার একটা অভ্যাস যদি তোমাকে এত কষ্ট দেয় সেই অভ্যাস আমি সারা জীবনের জন্য বিসর্জন দিয়ে দিবো।তোমার ভালো থাকাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
নূরা সাদমানকে ধরে কোনোরকমে উঠে বসলো।তারপর বললো,”শরিরের কষ্ট অনুভব করতে পেরেছেন কিন্তু মনের কষ্ট অনুভব করতে পারেন না।আপনার এই কাজগুলো আমাকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে দেয় একদম।”
“বন্ধুদের সাথে ছিলাম ওরা জোর করে খাইয়ে দিছে।আর কোনোদিন হবে না এটা।”
নূরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”এর জন্য ইসলাম বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক থাকতে বলেছে।সৎসঙ্গী আর অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সৎসঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হচ্ছে, আতর বিক্রেতা ও কর্মকারের হাপরের ন্যায়। আতর বিক্রেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করলে কখনও তাদের থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসবে না। হয় তুমি আতর খরিদ করবে, না হয় তার থেকে সুঘ্রাণ পাবে। আর কর্মকারের হাপর হয়তো তোমার ঘর অথবা তোমার কাপড় পু’ড়িয়ে দেবে, না হয় তুমি তার থেকে দুর্গন্ধ পাবে।’ (বুখারি : ২১০)।”
সাদমানকে বেশ লজ্জিত দেখালো।নূরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো,”তাহাজ্জুদের সময় হয়ে গেছে।চলুন নামাজ পড়ি।”
সাদমান বিমুঢ় মুখে বললো,”তুমি পড়ে নাও আমি অন্যদিন পড়বো।”
নূরা বিষন্ন মনে অযু করতে চলে গেল।

কেটে গেল বেশ কয়েক মাস। বাসার সবাই মিলে নূরাকে মাথায় তুলেই রাখে।আর কিছুদিন পরেই সে মা হবে।সাদমানের এসব নিয়ে খুশির অন্ত নেই।শুটিং একটু কমিয়েছে।বেশিরভাগ সময় নূরাকে সময় দেয়ার চেষ্টা করে।নিজ হাতে খাইতে দেয়।ব্রাশ করিয়ে দেয়।প্রয়োজনীয় ঔষধ খাওয়ায়।
যত সময় যাচ্ছে নূরার অবস্থা কেন জানি তত খারাপ হচ্ছে।যদিও সে কাউকে এসব বুঝতে দেয় না।আজকেও তেমন নূরা ফজরে উঠেছে।এই সময়টা নূরা রোজ একা একাই জাগে।সাদমান ঘুমে বিভোর থাকে।নূরা ফজরের নামাজ আদায় করলো।সাদমানের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করলো।তার হেদায়েতের জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলো।
হঠাৎ কেন জানি নূরার খুব গরম লাগা শুরু হলো। ভাবলো গোসলটা করে নেয়া যাক।তাহলে হয়তো স্বস্তি মিলবে।নূরা জামা-কাপড় নিয়ে গোসলের উদ্দেশ্যে বাথরুমে ঢুকলো।গোসল প্রায় শেষ পর্যায়ে তখনই নূরার পা পিছলে গেল।ধপাস করে মেঝেতে পড়লো সে।পেটের মধ্যে প্রচন্ড আ’ঘাত পেল।আর্তনাদ করে উঠলো।”
সাদমানের কানে নূরার চিৎকার ভেসে আসতেই সে হুরমুর করে উঠে বসলো।পাশে তাকিয়ে নূরা নেই দেখেই দৌড় দিলো বাথরুমে।দরজা খুলতেই সাদমানের বুকটা কেঁপে উঠলো। নূরা র’ক্তাক্ত মেঝেতে পরে আছে।আর ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
সাদমান নূরা বলে ভুবন কাঁপানো এক চিৎকার দিলো।

নূরাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে।তার অবস্থা সূচনীয়।জ্ঞান হারাচ্ছে বার বার সে।ডাক্তাররা অপারেশনের সমস্ত ব্যবস্থা করছেন।নূরাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হচ্ছে।নূরা একবার সাদমানের সাথে কথা বলতে চেয়েছে।সাদমান নূরার মাথায় হাত রেখে ওর কানের কাছে মুখ নিতেই নূরা বললো,”আমি থাকি বা না থাকি আমাদের সন্তানকে আপনি দেখে রাখবেন।নিজেকে পরিবর্তন করবেন।দুনিয়ার জীবন তো ক্ষুদ্র আমি আখেরাতের অসমাপ্ত জীবন আপনার সাথে কাটাতে চাই।জান্নাতে থাকতে চাই আপনার সাথে।আল্লাহর একজন যোগ্য বান্দা হয়ে উঠবেন।”
নূরার চোখ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।
সাদমানের হৃদপিণ্ড থমকে গেছে।নূরার কথায় তার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে।নূরাকে সে হারাতে চায় না।সাদমানের মুখ থেকে একটি কথাও বের হলো না।নূরাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।
সাদমান উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করেছে।কেউ তাকে শান্ত করতে পারছে না।তাওসিফ সাদমানকে অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে শান্ত হচ্ছে না।বার বার বলছে,”আমার মনে হচ্ছে আমি আমার জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি..আমার বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে তাওসিফ।আমাকে একটু শান্তির ঠিকানা বলে দে ভাই। আমি নূরাকে হারাতে চাই না।আমার হৃদপিণ্ড ছাড়া আমি বাঁচবো কেমন করে…
চলবে…