এক টুকরো নূর পর্ব-১৯

0
94

#এক_টুকরো_নূর
——————(১৯ পর্ব)
লেখা: উম্মে হানি মিম

নূরাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে।তার অবস্থা সূচনীয়।জ্ঞান হারাচ্ছে বার বার।ডাক্তাররা অপারেশনের সমস্ত ব্যবস্থা করছেন।নূরাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হলে সে একবার সাদমানের সাথে কথা বলতে চেয়েছে।সাদমান নূরার মাথায় হাত রেখে ওর মুখের কাছে কান নিতেই নূরা বললো,”আমি থাকি বা না থাকি আমাদের সন্তানকে আপনি দেখে রাখবেন।একজন যোগ্য মানুষ,আল্লাহর ধার্মিক বান্দা হিসেবে গড়ে তুলবেন।
নিজেকে পরিবর্তন করবেন।দুনিয়ার জীবন তো ক্ষুদ্র আমি আখেরাতের অসমাপ্ত জীবন আপনার সাথে কাটাতে চাই।জান্নাতে থাকতে চাই আপনার সাথে।আল্লাহর একজন যোগ্য বান্দা হয়ে উঠবেন।”
নূরার চোখ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।
সাদমানের হৃদপিণ্ড থমকে গেছে।নূরার কথায় তার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে।নূরাকে সে হারাতে চায় না।সাদমানের মুখ থেকে একটি কথাও বের হলো না।নূরাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।
সাদমান উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করেছে।কেউ তাকে শান্ত করতে পারছে না।তাওসিফ সাদমানকে অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে শান্ত হচ্ছে না।বার বার বলছে,”আমার মনে হচ্ছে আমি আমার জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি..আমার বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে তাওসিফ।আমাকে একটু শান্তির ঠিকানা বলে দে ভাই। আমি নূরাকে হারাতে চাই না।আমার হৃদপিণ্ড ছাড়া আমি বাঁচবো কেমন করে!
সাদমান এমন আচরণ করলো কিছুক্ষণ তারপর কিছুটা শান্ত হলো।
চারিদিকে শুনশান নিরবতা।অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগলো সে।তাওসিফও রয়েছে।
পাশে রাখা পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছেন হক সাহেব এবং মিসেস লিপি।হসপিটালের সংরক্ষিত নামাজের জায়গায় সেজদায় লুটিয়ে আছেন নূরার মা আলেয়া।পাশে কোরআন শরিফ নিয়ে বসেছে নোহা।মিহি কন্ঠে তেলাওয়াত করছে কিন্তু আজ গলাটা কাঁপছে ভিষণ।
অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন নার্সকে বের হতে দেখে সাদমান দৌড়ে গেল।
উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”ভিতরে কী অবস্থা?আমার নূরার কী অবস্থা?”
নার্স গম্ভীরভাবে বললেন,”অনেক র’ক্ত লাগবে।আপনার স্ত্রীর অবস্থা ভালো না।আপনারা র’ক্তের ব্যবস্থা করুন।”
সাদমানের যেন নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে।অধিক শোকে পাথর প্রায় অবস্থা তার।তাওসিফ র’ক্তের ব্যবস্থা করতে ছুটে গেল।সাদমান দুহাতে মুখ ঢেকে মেঝেতেই বসে পড়লো।
আরও কিছুক্ষণ অপারেশন চললো তারপর একটা বাচ্চা কোলে একজন নার্স বের হলেন।হক সাহেব আর লিপি এগিয়ে গেলেন।ফুটফুটে একটি মেয়ে।লিপি যত্নের সহিত বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন। সাদমান এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে গেল।বাচ্চাটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো,”আমার স্ত্রী?”
নার্স মাথা নিচু করে বললেন,”ম্যাডাম আসছেন ওনার সাথে কথা বলুন।”
একজন মহিলা ডাক্তার তখনই বেরিয়ে এলেন।সাদমান ওনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,”আপনাদের এই মুহুর্তে ধৈর্য ধারণ করা জরুরি।”
সাদমান চেঁচিয়ে উঠলো, “কেন ধৈর্য ধরবো? আমার স্ত্রীর কী অবস্থা বলুন।”
ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,”আমরা তো ডাক্তার ইচ্ছে করে মানুষ খু’ন করতে পারি না।আমাদের চেষ্টা ছিল মা এবং সন্তান দুজনকেই সুস্থ রেখে অপারেশন শেষ করা।কিন্তু আপনার স্ত্রীর যে অবস্থা ছিল আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি।ওনার অবস্থা খুবই খারাপ।ওনার ভেন্টিলেশন জরুরি। লাইফ সাপোর্টে নিয়ে আমরা একটা শেষ চেষ্টা করতে চাই।আপনারা অনুমতি দিলেই সেটা সম্ভব হবে।”
সাদমানের নিশ্বাস যেন আটকে আসছে।দম বন্ধ লাগছে তার।অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার জন্য দৌড় দিলো সে কিন্তু দরজায় থাকা গার্ড তাকে আটকে দিলো।পাগলামী শুরু করলো সে।গার্ডকে আক্রমণ করে বসলো।তাওসিফ আর হক সাহেব কোনো রকমে ছাড়িয়ে আনলেন তাকে।ডাক্তার বললেন,”এখন প্রত্যেকটা মিনিট, প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমাদের জন্য জরুরি।পাগলামী করার সময় এখন না মিস্টার সাদমান।আপনি তাড়াতাড়ি বন্ডে সিগনেচার করুন।আপনার স্ত্রীর ট্রিটমেন্ট শুরু করা জরুরি এখন ।”
সাদমানের পাগলামী কমছে না।হক সাহেব বন্ড হাতে নিয়ে দ্রুত সিগনেচার করে দিলেন।
কিছুক্ষণ পরেই নূরাকে স্ট্যাচারে করে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করা হলো।সাদা চাদরে ঢাকা সমস্ত শরির।দেখে মনে হচ্ছে না দেহে প্রাণ আছে।নির্জিব,নিস্তেজ।সাদমান দৌড়ে গিয়ে স্ট্যাচার থামালো।নূরার দিকে তাকাতেই তার বুক ভেঙ্গে কান্না বের হয়ে আসলো।হাত ধরার চেষ্টা করেও ধরতে পারলো না।নূরাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো।সাদমান মেঝেতে বসেই আর্তনাদ করে উঠলো।পরমুহূর্তেই শান্ত হয়ে গেল।দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। তারপর তড়িৎ বেগে ছুটলো নূরার স্ট্যাচারের পিছে পিছে।তাওসিফও গেল পেছন পেছন।
———————
স্তব্ধতা বিরাজ করছে হসপিটালের করিডর জোরে।সবাই কেমন শান্ত হয়ে আছে।তার মধ্যেই সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাটার কান্না ভেসে বেড়াচ্ছে শুধু।কান্নার সুরটা করুন শোনাচ্ছে অথচ সদ্যোজাত শিশুর কান্নার সুরে মিশে থাকে খুশি।এখানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত।
মিসেস লিপি বাচ্চাটাকে বুকের কাছে জড়িয়ে রেখে নিরবে চোখের জল ফেলছেন।হক সাহেবের আবেগ কাজ করে কম।ভিষণ শক্তপোক্ত মানুষ তিনি।অথচ আজ নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না।নূরা তো তাদের শুধু পুত্রবধু না মেয়ে ছিল।তাদের ঘরের রহমত ছিল।লিপি ফুপিয়ে উঠছেন বার বার।হক সাহেব লিপির কাধে হাত রেখে বললেন,”শান্ত থাকতে হবে এই মুহুর্তে।বাচ্চাটাকে তো সামলাতে হবে তোমার।”
লিপি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,”আমার সাদমান শেষ হয়ে যাবে।তুমি আমার ছেলেটাকে সামলাও।ডাক্তারের সাথে কথা বলো।নূরা মাকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে।আমার সংসারটা শেষ হয়ে যাবে যদি কোনো অঘটন ঘটে।”
কথা শেষ করে লিপি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

আলেয়া বাচ্চার কান্না শুনে নামাজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।মিসেস লিপির কোলে বাচ্চাটাকে দেখতে পেয়ে,মুখে উচ্চারণ করলেন মাশা আল্লাহ তারপর এগিয়ে এলেন।লিপির চোখে পানি দেখে ওনার বুকটা কেঁপে উঠলো, ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”আপা নূরার কি অবস্থা?”
লিপি হক সাহেবের দিকে এক পলক তাকালেন।হক সাহেবের খেয়াল হলো আলেয়াকে নূরার অবস্থা সম্পর্কে অবগত করা হয়নি।দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বললেন,”বোন আমাদের মেয়েটার অবস্থা ভালো নয়।তাকে ট্রিটমেন্টের জন্যই আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে।”
আলেয়ার পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল।প্রিয়জন হারিয়ে ফেলার অনুভূতি তিনি জানেন।
ভালো করেই জানেন।নতুন করে সেই অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে চান না তিনি।ভিতরটা হুহু করে উঠলো।সন্তান হারানোর বেদনা তাকে গ্রাস না করুক।দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ফরিয়াদ করলেন মহান আল্লাহর কাছে,”হে আল্লাহ,হে মালিক আমার কোল খালি করে দিও না মাবুদ।এই সদ্যজাত শিশুটাকে মা-হারা করো না।”

সাদমান ডাক্তারের সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে।নূরা তাকে সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে বলতো।সেও এখন তাই করছে।যত টাকা লাগে সে দিতে প্রস্তুত শুধু তার বিনিময়ে নূরাকে সুস্থ চায় সে।ডাক্তার বলে গিয়েছেন,তারা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করবে কিন্তু এখন সবটাই আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে।আল্লাহ চাইলেই এখন কেবল নূরা বেঁচে যাবে।
ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে সাদমান আইসিইউর সামনে বসে আছে শান্ত হয়ে।পাথরের মতো স্থির।ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে শুধু। ভিতরটাকে শান্ত করতে পারছে না।এমন পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল না সে।মুহুর্তটা তো অন্যরকম হলেও পারতো।নূরার সাথে বিগত দিনগুলো ছিল স্বপ্নের মতো।সেই স্বপ্নের পৃথিবীতে ছোট্ট একটা প্রাণও অংশ নিয়েছিল তাদের সাথে।মুহুর্তে সবকিছু বদলে গেল।
তবে কী সব কিছুর জন্য সে দায়ী!নূরা তো সব সময় বলতো তার কাজে আল্লাহ নারাজ হবেন।তিনি কি সত্যিই নারাজ হয়ে উঠেছেন সাদমানের উপর। শাস্তি সরূপ কেড়ে নিচ্ছেন প্রিয় মানুষটাকে।হারানোর বেদনা কেমন হয় সাদমান জানে না।কখনও হারানোর ভয় তাকে গ্রাস করেনি।যা চেয়েছে তার থেকে বেশি পেয়েছে।না চাইতেও সব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।সব সফলতা চলে এসেছে জীবনে। সম্পূর্ণ সফল আর পরিপূর্ণ মানুষ মনে করতো সে নিজেকে।অথচ জানতই না কতটা অসহায় সে।টাকা বা খ্যাতি কিছুই তার নূরাকে বাঁচাতে পারছে না এখন।তবে কীসের অর্থ আর খ্যাতি কামালো সে! কী হবে এসব দিয়ে?
পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষটা তো সে।যে তার নিজের কর্মফলের জন্য নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হারাতে চলেছে।অস্বাভাবিকভাবে সাদমানের শরির কাঁপছে।যেন ভূমিকম্প হচ্ছে ভিতরে।তাওসিফ সাদমানের কাধে হাত রেখে বললো,”সব ঠিক হয়ে যাবে দুস্ত।এত ভেঙ্গে পড়িস না।”
সাদমান বরফ শীতল কন্ঠে বললো,” ইনশাআল্লাহ বল।নূরা সম্ভাব্য সব কথার সাথে ইনশা আল্লাহ বলতো।”
তাওসিফ সাথে সাথে বললো,” ইনশাআল্লাহ।”
সাদমানের এই শান্ত হয়ে যাওয়া মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না তার কাছে। হঠাৎ করে এত শান্ত এত স্থির কেন হয়ে গেল ছেলেটা!

সেই সকালে হসপিটাল এসেছিল নূরাকে নিয়ে।এখন গভীর রাত একফোঁটা পানিও স্পর্শ করেনি সাদমান ।আলেয়াও কিছু মুখে তুলতে চাননি রাতে লিপি জোর করে অল্প কিছু খাইয়েছেন নোহা আর আলেয়াকে।তারা না খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেলে বাচ্চাটাকে কে দেখবে এসব ভেবেই নামমাত্র দানা-পানি মুখে তুলেছেন।কিন্তু সাদমানকে কেউ জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারেনি।তখন থেকে আইসিইউর বাইরেই সিড়িতে বসে আছে।
কেবিনে বাচ্চাটাকে অনেক কষ্টে সামলাচ্ছেন আলেয়া নোহা আর লিপি মিলে।এভাবেই থমথমে রাতটা কেটে গেল।তাওসিফ বেশ রাত করে বাসায় চলে গিয়েছিল।ভোর হতেই আবার হসপিটালে ফিরে এসেছে।সাদমানকে সিড়িতেই ঘুমিয়ে আছে।সিড়িতে যাতায়াত করা কিছু মানুষ বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে।হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে এটা সাদমান হক কী না।অথচ এই মুহুর্তে বুঝার কোনো উপায় নেই।তাওসিফ সাদমানের গায়ে হাত রাখতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।ঘাড়ে মাথায় ব্যথা জমে গেছে।সারারাত তো জেগেই ছিল কখন চোখ লেগে গেল তার!সাদমান এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,কখন ঘুমিয়ে গেলাম আমি!নূরার কী জ্ঞান ফিরেছে?
হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালো সে।ছুটলো আইসিইউর সামনে।”একজন নার্সকে বেরোতে দেখে বললো,নূরা রেসপন্স করেছে?”
মহিলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,”উনি রেসপন্স করলে আমরাই আপনাদের জানাবো।”
সাদমানকে প্রচন্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে।চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে যেন।সব হারানো নিঃস্ব মানুষের মতো অনুভূতি হচ্ছে তার।এত অসহায় এর আগে লাগেনি।নূরার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব।নূরাই তো একমাত্র মানুষ যে তার মনের সমস্ত অশান্তি দূর করে দিতো।অথচ আজকে সেই মানুষটার জন্যই মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা ভাবলো সে,তারপর ভাঙ্গা গলায় তাওসিফকে বললো,”এখানে থাক কষ্ট করে।ডাক্তার কিছু বললে সাথে সাথে আমাকে কল দিবি।”
তাওসিফ অবাক হয়ে বললো,”তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
“সত্যিকারে সঙ্গ তালাশ করতে,কষ্ট কমাতে শান্তির ঠিকানায় যাব”
তাওসিফ উদগ্রীব হয়ে বললো,”এখন কোথাও যেতে হবে না। গত কাল থেকে তুই না খেয়ে আছিস।চল এখন গিয়ে কিছু খাবি তারপর নাহয় বাসায় গিয়ে রেস্ট নিস।আমি ততক্ষণ এখানেই থাকবো।”
সাদমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”যা খাওয়ার ওখানে গিয়েই খাবো।”
তাওসিফ এবার কড়াভাবে বললো,”পাগলামী করবি না সাদমান।তোর বউকে এই অবস্থায় রেখে
তুই গিয়ে দেবদাসের মতো ম’দ্যপান করবি তা হয় না।”
তাওসিফের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করেই হনহন করে বেরিয়ে গেল সাদমান।
সোজা বাসায় এসে নিজের ঘরে ঢুকলো।সারাঘর তন্য তন্য করে খুঁজে বের করলো নূরার দেয়া উপহারের বইটা।এতদিন প্রত্যেকটা মুহূর্তে নূরা তাকে সামলে নিয়েছে।কখন কী করা উচিৎ নূরা শিখিয়ে দিয়েছে।এই মুহুর্তে নূরার সেই সঙ্গটা নেই তার জীবনে।
কেন জানি মনে হচ্ছে নূরার সব অব্যক্ত কথা বইটা পড়লেই পাবে সে।দ্রুত বইটার পৃষ্ঠা উলটালো।একটা সাদা খাম।সাদমান দ্রুত খামটা খুললো।একটা চিঠি রয়েছে তাতে।নূরা বাড়িতে চলে যাওয়ার আগে এই বইটা সাদমানকে দিয়ে গিয়েছিল।নিশ্চয়ই তখনই কিছু লিখে রেখে গিয়েছিল তার জন্য।কিন্তু তখন বইটা খুলেনি বিধায় চিঠিটাও পায়নি।
সাদমান দ্রুত চিঠিটা পড়া শুরু করলো,”
প্রিয়,
আপনার উপস্থিতি আমার জীবনে ছিল এক পশলা রহমের বৃষ্টির মতো।সেই ভয়ংকর মুহূর্ত যেটা আমি দ্বিতীয়বার কল্পনাও করতে চাই না সেই মুহুর্তে আপনি আল্লাহর হুকুমে আমাকে হেফাজত করেছিলেন।আল্লাহ সবকিছুর পেছনেই ভালো কিছু রাখেন।সেদিনের ভয়ংকর ঘটনার প্রেক্ষিতেই আপনি আমার জীবনে এলেন।আর অপ্রকাশিতভাবে দুই মেরুর দুজন মানুষের জীবন আল্লাহতায়ালা জোরে দিলেন।আমার বিশ্বাস এর পেছনেও ভালো কিছু রয়েছে ইনশাআল্লাহ।আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ভেবেছি, আপনাকে কখনই আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারবো কি না।কিন্তু যখনই এই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলাম তখন থেকে ভাবনাটা পুরোপুরি বদলে গেল।মনে হলো আপনিই তো সেই মানুষ যাকে আমার আল্লাহ আমার জন্য নির্ধারণ করে রেখে ছিলেন।তাকে আমি অস্বীকার করি কীভাবে!এতবড় স্পর্ধা আমার হয়নি।স্বামীরূপেই গ্রহণ করলাম আপনাকে।ভালোবাসতে শুরু করলাম।কিন্তু আপনি তো ভালোবাসেন অন্য কাউকে।তাছাড়া আমি এমন একটা মানুষের সাথে জীবন কাটাতে চাই না যে তার নিজ ধর্মকেই ভালোবাসে না।আপনার জীবন-বিধান আমাকে বড়ই ব্যথিত করে।আপনার হারামে ডুবে থাকা,ফরজ বিধান পালন না করা।এগুলো আমাকে কতটা যন্ত্রণা দেয় আমি আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না।মাঝেমাঝে আফসোস করি আমি এমন একটা মানুষকে ভালোবাসি যে আমার আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না।তাহলে কেন আমি সেই মানুষটাকে ভালোবাসলাম!
আপনার সাথে অনন্তকাল কাটানোর স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে আমার জানি।এটাও জানি আমি আপনার পছন্দের পাত্রী না।আপনার মনের মতোও না।হয়তো আপনি কখনই আমাকে ভালোবাসবেন না আর ইসলামিক জীবন-বিধানকেও আপন করবেন না।তাই চলে গেলাম আপনার জীবন থেকে..
এতটুকু পড়ে থামলো সাদমান।ছ্যাঁত করে উঠলো বুকের ভিতরটা।চিঠিটা হাতে রেখেই হন্তদন্ত হয়ে একটা কলম খুঁজে বের করলো।”তাই চলে গেলাম আপনার জীবন থেকে” লাইনটার উপর কলম দিয়ে অজস্র দাগ টেনে মুছে দিলো লেখাটা।কালিতে লেখাটা ঢেকে গেলেও থামলো না সে।একের পর এক দাগ টেনেই যাচ্ছে।বেশ কিছুক্ষণ পর যখন তার মনে হলো চিঠিটা ছিড়ে যাচ্ছে তখন থামলো।কলমটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিঠি পড়ায় মনোযোগ দিলো আবার।
“একটা অনুরোধ করি আপনাকে,এই বইটা পড়বেন।এখানে অনেক মূল্যবান কোরআনের আয়াত রয়েছে অর্থসহকারে।এবং সহি হাদিস রয়েছে।যেগুলো আপনার জীবন বিধান বদলে দিতে হয়তো সাহায্য করতে পারে।ইসলাম নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারবেন বইটা পড়লে।জানি পড়বেন না তবুও দিয়ে গেলাম যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয় হয়তো কোনো একদিন বইটা হাতে নিবেন।সেদিন আমার চিঠিটাও পেয়ে যাবেন।এই বইটা আপনি এমন কোনো দিনেই হয়তো হাতে নিবেন যেদিন আপনি আমার শূন্যতা অনুভব করবেন।হয়তো এমন দিন আসবে না।আর যদি আসে তবে একটা কথা মনে রাখবেন,আপনি কখনই একা নন।মহান আল্লাহ সব সময় ওনার বান্দার পাশে আছেন।নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সানিধ্য তালাশ করবেন।ক্ষমা চাইবেন আল্লাহর কাছে।নিজের উপর জুলুম করবেন না দয়া করে। মহান আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন,
হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল। পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার : ৫৩)। তিনি আরও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা : ২২২)

আরেকটা কথা নেশাদ্রব্য পান করবেন না।নিজেকে কষ্ট দিয়ে কোনো কাজ করবেন না।আল্লাহ এটা খুব অপছন্দ করেন।
আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত নসিব করুন এই দোয়াই করবো সারা জীবন। আল্লাহ হাফেজ।”

পড়া শেষ করে চিঠিটা বুকের কাছে নিয়ে রাখলো সাদমান।চোখ বন্ধ করে ভাবছে,গতকাল থেকেই সে ভেবেছে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে কিন্তু কোথাও একটা সংকোচ,ভয় ছিল।মনে হচ্ছিল আল্লাহ তার ডাকে আর সাড়া দিবেন না।কিন্তু চিঠিতে এই আয়াতগুলো পড়ে যেন সে তার সংশয়ের উত্তর পেয়ে গেল।আল্লাহ ক্ষমাশীল।পরম দয়ালু। তিনি তাকে দয়া করবেন ইনশাআল্লাহ।
সাদমান চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। চিঠিটা যত্ন করে রেখে ওয়াশরুমে গেল।ফ্রেশ হয়ে এসে ফ্রিজ খুললো। নূরার রান্না করা খাবার আছে ফ্রিজে। সেগুলো বের করলো।গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না।জোর করে অল্প একটু খেলো।নূরা তো বলেছে নিজেকে কষ্ট দিয়ে কোনো কাজ না করতে, আল্লাহ পছন্দ করেন না।খাবার শেষ করে নূরার দেয়া বইটা হাতে নিয়ে বসলো।বইটাতে নামাজ পড়ার নিয়ম থেকে শুরু করে মোটামুটি ইসলামিক জীবন বিধান সম্পর্কে সবটাই লেখা আছে।একটা পাতায় গিয়ে সাদমানের চোখ আটকে গেল।

হজরত আবু রাফে রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘ফাতেমার ঘরে হাসান ইবনে আলি ভূমিষ্ঠ হলে, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার কানে আজান দিতে দেখেছি।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)

মনে পড়ে গেল আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্য মূল্যবান উপহারটার কথা।নূরা অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে তো তার দায়িত্ব তাকেই দিয়ে গিয়েছে।সাদমান কী করে নূরার কথাগুলো ভুলে গেল।সাদমান বইটা হাতে নিয়েই দ্রুত বেরিয়ে পড়লো।হসপিটালে গিয়ে আগে নূরার খবর নিলো।নূরার রেসপন্স নেই।নিজেকে সামলে চলে গেল কেবিনে।আলেয়া কোরআন তেলাওয়াত করছেন একপাশে বসে।লিপি আর নোহা মিলে বাচ্চাটাকে দেখছেন।সাদমানকে ঢুকতে দেখে লিপি এগিয়ে গেলেন।বিচলিত হয়ে বললেন,কোথায় ছিলে বাবা?কিছু খেয়েছো?
সাদমান মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে নিলো।নিষ্পাপ একটা চেহারা। একদম নূরার মতো দেখতে হয়েছে।মনে হচ্ছে নূরারই প্রতিচ্ছবি।ক্রন্দনরত বাচ্চাটা হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল।অবুঝ শিশুটাও যেন বাবার গায়ের গন্ধ চিনে ফেলেছে।সাদমান হাতে থাকা ফোনটা মায়ের হাতে দিয়ে বললো একটু আমার সামনে ধরে রাখো।লিপি সেটাই করলেন।ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই মেয়ের ডান কানের কাছে মুখ নিয়ে আযান দেয়া শুরু করলো।
সাদমানের আযানের ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে গেল চারিপাশ।লিপি, আলেয়া, নোহা বিস্মিত হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলেন।
—————

সাদমান হসপিটালের মসজিদে নামাতে নামাজ আদায় করেছে।নামাজ শেষে সবাই বেরিয়ে গেলেও সাদমান জায়নামাজে বসে আছে।দু’হাত তুলে মোনাজাতে ক্ষমা প্রার্থনা করছে,হে মহান আল্লাহ।আপনি তো পরম দয়ালু।নূরা বলে আপনি সব পাপ ক্ষমা করে দেন আমার মতো পাপিকে কি ক্ষমা করে দিবেন? আমার পাপের শাস্তি আমার নূরাকে দিবেন না আল্লাহ।নিষ্পাপ মেয়েটাকে তার সন্তানের থেকে আলাদা করে দিবেন না আল্লাহ।আপনার কাছে ভিক্ষা চাইছি আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিন আমার আমার কাছে।নূরা আমার জীবনের এক টুকরো নূর।নূরের মতোই আলোকিত করে রাখে তার চারিপাশ।সেই নূরকে রোশনাই থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।আমার জীবন থেকে এই নূরের আলো কেড়ে নিয়ে অন্ধকার পুরীতে পরিণত করবেন না আমার জীবন।দয়া করুন আল্লাহ।ক্ষমা করে দিন আমাকে।ফিরিয়ে দিন আমার নূরাকে।
সাদমান ক্রন্দনরত অবস্থায় সেজদায় লুটিয়ে পড়লো।নিজেকে আজ সমর্পণ করে দিয়েছে তার রবের কাছে।
—————–
কেটে গেল কয়েক দিন।নূরার কোনো উন্নতি নেই।সাদমান নাওয়া-খাওয়া ভুলে মসজিদেই পড়ে থাকে।আবার কখনও উন্মাদের মতো দৌড়ে গিয়ে বসে থাকে আইসিইউর সামনে আবার কখনও পরিপক্ব বাবার মতো কেবিনে গিয়ে বাচ্চার দেখভাল করে।
সেরকমই একদিন হসপিটাল থেকে বের হচ্ছিল সে তখন মিহি সামনে এসে দাঁড়ায়।সাদমানের বাহু ধরে বিচলিত হয়ে বলে,”কী হাল করেছো নিজের?সাদমান তোমাকে চেনা যাচ্ছে না একদম।তুমি কী নিজেকে শেষ করে দিতে চাও? এরকম পাগলের মতো দিন কাটাচ্ছো কেন? আমি বলে ছিলাম না মেয়েটা তোমাকে নিঃশেষ করে দিবে। সেটাই হচ্ছে।এখনও সময় আছে সাদমান।সব ছেড়েছুড়ে আগের জীবনে ফিরে এসো।সেই পুরোনো ঝলমলে জীবনে।আগের সেই চিত্রনায়ক সাদমান হক হয়ে উঠো।সবাই তোমার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে আমাকে কল দিচ্ছে।নতুন অনেকগুলো সিনেমার অফার আছে।পুরোনো কাজ বাকি।
প্লিজ চলো আমার সাথে।”
সাদমান মাথা নিচু করে আছে।কিছু একটা যেন ভাবলো সে।। তারপর মিহির দিকে না তাকিয়েই বললো,”ঠিক আছে চলো।যেতে তো আমাকে হবেই।দুনিয়ার যে মোহে আটকা পড়েছি আমি সেই মোহ-মায়া থেকে আমার কী আর এত সহজে মুক্তি মিলবে!এবার শেষ পদক্ষেপটাই নিতে হবে।”….
চলবে..