এক টুকরো নূর পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
136

#এক_টুকরো_নূর
—————-(২০পর্ব [অন্তিম])
লেখা: উম্মে হানি মিম

সাদমানকে ঘিরে প্রেসের লোকজন দাঁড়িয়ে আছে।উৎসুক হয়ে জানতে চাচ্ছে, হঠাৎ এমন ঘোষণা দেয়ার কারণ।খ্যাতি,সুনাম সবকিছুর শীর্ষে থেকেও কেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলো তাকে!
প্রেসের সামনে আসার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তার কিন্তু এই জগৎয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলে সবাইকে অবগত করা জরুরি। অসংখ্য প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সাদমান শান্ত কন্ঠে বললো,”আমি সিনেমা জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাই।এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।যে কাজগুলো আমার সাইন করা ছিল এবং যে কাজগুলো অর্ধেক করা সে সব কাজের পারিশ্রমিক হস্তান্তর করে দিবো।মাঝপথে ছেড়ে দেয়া কাজগুলোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। মেকার্সদের সাথে কথা বলেছি।
আরেকটা কথা যেটা আমার অনুরোধ থাকবে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে।আজকের পর থেকে কোথাও আমাকে দেখতে পেলে দৌড়ে এসে ভিড় জমাবেন না।ফটো কিংবা অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য অস্থির হবেন না।এতে আমি বিভ্রান্ত হবো।
হ্যাঁ অবশ্যই যারা আমাকে ব্যক্তি সাদমান হক হিসেবে ভালোবাসেন তারা দেখা হলে আর দশটা মানুষের মতোই আচরণ করবেন।
আজকের পর থেকে আমিও আপনাদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ। সাধারণ সাদমান হক।চিত্রনায়ক সাদমান হককে আর কেউ আমার মাঝে খুঁজে পাবেন না।আমার জন্য দোয়া করবেন।আল্লাহ হাফেজ।”
কথাগুলো বলে সাদমান বেরিয়ে গেল।প্রেসের আর কোনো প্রশ্নের উত্তরই সে দিলো না। মিহি প্রচন্ড বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কী করলো এটা সাদমান!
মিহি দৌড়ে সাদমানের পেছন পেছন গেল,অস্থির হয়ে জানতে চাইলো,”সাদমান এটা কি করলে তুমি?তোমার ক্যারিয়ার এক মুহূর্তে শেষ করে দিলে?এখনও সময় আছে পাগলামী বন্ধ করো আর গিয়ে প্রেসকে বলো তুমি সব মজা করেছো।
সাদমান হাঁটতে হাঁটতেই বললো,”আমি কোনো মজা করিনি মিহি।আর আমার ক্যারিয়ার আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত আমিই নিবো।পরিচিত হিসেবে তোমার পরামর্শ আমি নিতে পারি যদি সেটা আমার জন্য মঙ্গলজনক হয়।”
“সাদমান সব কিছুর মূলে ঔ মেয়েটা।শ’য়তান মেয়ে একটা।”
সাদমান ক্রোধান্বিত হয়ে বললো,” মিহি নিজের সীমানা ছাড়িয়ে যাবে না।দ্বিতীয়বার যদি তুমি নূরাকে নিয়ে কোনো খারাপ কথা বলেছো আমি ভুলে যাব তুমি একটা মেয়ে।”
মিহি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,” সাদমান তুমি আমাকে মা’রবে? মেয়েটা নিশ্চিত তোমাকে কালো’যাদু করেছে।শেষ করে দিয়েছে আমার সেই পুরোনো সাদমানকে।”
সাদমানের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে মুহুর্তে মিলিয়ে গেল,”ভাগ্যেস যাদুটা করেছে।শেষ করে দিয়েছে আমার আগের সত্তাটাকে।”
এক মুহুর্ত থেমে আবার বললো,”মিহি শুনো,নিজের জীবনকে নিজের মতো সাজিয়ে নাও।আমার সাথে তোমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও।আমার আর নূরার একটা মেয়ে হয়েছে।ইচ্ছে হলে তাকে গিয়ে দেখে এসো।ভালো থেকো।”
কথাগুলো শেষ করে সাদমান গাড়িতে উঠে গেল।
নামাজের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ায় মসজিদে এসে নামাজ আদায় করলো। আজকে নিজেকে অনেক হালকা লাগছে।দু’হাত তুলে আল্লাহকে বললো,” হে আল্লাহ আপনার অপছন্দের কাজের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছি আজ।আপনি আমার গুনাহের বোঝা হালকা করে দিন। আমার নূরাকে ফিরিয়ে দিন আমার কাছে।আর কষ্ট দিবেন না মেয়েটাকে।তার তো কোনো দোষ নেই, আমার পাপের শাস্তি তাকে দিবেন না। দয়া করুন হে মাবুদ।”
———————
বাচ্চাকে নিয়ে সবাই বাসায় ফিরে এসেছেন।শুধু আলেয়া হসপিটালে থেকে গেছেন।মেয়েকে ছেড়ে ফিরে আসতে নারাজ তিনি।
সাত দিন হয়ে গেছে সদ্যোজাত শিশুটির মায়ের স্পর্শ পাওয়ার ভাগ্য হয়নি।কেউ জানেও না কখনও সেই ভাগ্য হবে কী না তার।
সুহা আর নোহা বাচ্চাটার দেখাশোনা করছে।লিপি আর হক সাহেব আকিকার আয়োজন করছেন।আজকে ধর্মের বিধান অনুযায়ী আকিকা হবে নাতনির।সাদমানের এটাই ইচ্ছা। নামও আজকেই রাখা হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘জন্মের সপ্তম দিন নবজাতকের নাম রাখো।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৩২)
নূরা সজ্ঞানে থাকলে সুন্নতগুলো মেনে মেয়ের আকিকা এবং নাম রাখতো নিশ্চয়ই। সাদমানও তাই করছে।
নূরার ইচ্ছা ছিল মেয়ে হলে নাম রাখবে, “ওয়াজিহা বিনতে সাদমান।” সেই নাম করণই করা হয়েছে।

কেটে গেল আরও কয়েক দিন।ডাক্তার সাদমানকে ডেকে পাঠিয়েছেন।দশ দিনেও নূরার কোনো উন্নতি নেই।ডাক্তাররা মোটামুটি নিশ্চিত নূরার বাঁচার সম্ভাবনা কম।
সাদমান ডাক্তার তাবাসসুমের চেম্বারে প্রবেশ করে সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসে।তাওসিফও পাশের চেয়ারটাতে বসলো।
ডাক্তার তাবাসসুম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,”সাদমান সাহেব আপনার রোগী আজ দশ দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে আছে।আমরা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি ওনার ক্ল্যানিকালি ব্রেইন ডেথ।বাঁচার সম্ভাবনা একমই নেই।এই মুহুর্তে রোগীর পরিবার মানে আপনারা ঠিক করবেন রোগীকে কি ভ্যান্টিলেশনে রাখবেন নাকি..
এতটুকু বলে থামলেন তাবাসসুম।
সাদমান দুহাতে মুখ ঢেকে আছে।মনে হচ্ছে বিষাক্ত কোনো তীর তার বক্ষ ভেদ করে চলে গেল।চুলের মুঠি ধরে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতে পারছে না সে।তাওসিফ সাথে সাথে সাদমানকে শক্ত করে ধরলো।
সাদমান তাওসিফের দিকে এক পলক তাকিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো।তাওসিফ এই কান্নাটার অপেক্ষাই করছিল।আজ দশটা দিন সাদমানকে সে ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যেতে দেখেছে কিন্তু প্রাণখুলে কাঁদতে দেখেনি।সাদমান,ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,আমার নূরা চলে গেছে ভাই।আমার নূরা আমাকে ছেড়ে সারা জীবনের মতো চলে গেছে।কথাগুলো বলে সাদমান তাওসিফকে ছেড়ে শান্ত হয়ে গেল।চোখ মুছে দৌড়াতে লাগলো।তাওসিফ পেছন পেছন যেতে গেলে ডাক্তার তাবাসসুম তাকে থামিয়ে বললেন,”আপনারা সিদ্ধান্ত যা নেয়ার দ্রুত নিয়ে ফেলুন।এতে রোগীর জন্যও ভালো আর আপনাদের জন্যেও।”
তাওসিফ হক সাবেবকে কল দিতে ফোন হাতে নিলো।
সাদমান মসজিদে ঢুকে ধপাস করে পড়লো মেঝেতে।এত জোরে পড়লো যে হাটু ফেটে গেল খানিকটা।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সেজদায় লুটিয়ে পড়লো।আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলো,” হে মহান আল্লাহ এতদিন আমি নূরাকে ফিরে পেতে চেয়েছি আমার নিজের মর্জি, ইচ্ছা আপনার কাছে জানিয়েছি।এবার আমি আপনার মর্জি জানতে চাই।আপনি যে ফায়সালা করবেন আমি সেই ফায়সালা মেনে নিবো।নূরা সব সময় বলে, আপনি যা করেন ভালোর জন্য।যদি নূরার থেকে আমার মতো পাপিকে আলাদা করে দেয়া আপনি ভালো মনে করেন তবে তাই করুন।”
সাদমান নিস্তেজের মতো পড়ে আছে জায়নামাজে।হঠাৎ পকেটে থাকা ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো।কোনোরকমে সাদমান ফোনটা রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে তাওসিফের অস্থির আওয়াজ ভেসে এলো,”সাদমান নূরা রেসপন্স করেছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয় তুই।”
সাদমান যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে গিয়েও থেমে গেল। ছুটলো অযুর কক্ষে।অযু করে এসে দাঁড়িয়ে গেল নামাজে।আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে দু-রাকাত নামাজ আদায় করলো।তারপর জীবনের শ্রেষ্ঠ দৌড়টাই দিলো সে।আইসিইউর সামনে এসে হাপাতে হাপাতে থামলো। তাওসিফ এসে জড়িয়ে ধরলো সাদমানকে,উৎফুল্ল হয়ে বলতে শুরু করলো,”ভাই আংকেল আলেয়া আন্টির মত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন সব খুলে ফেলতে।ডাক্তার যখন নূরাকে শেষবার চ্যাকআপ করতে গেলেন তখনই সে রেসপন্স করা শুরু করলো।মিরাকেল হয়ে গেছে সাদমান।একদম মিরাকেল।”
সাদমান কাঁপা গলায় বললো,”মিরাকেল না ভাই মহান আল্লাহর দয়া।এটাকেই নূরা বলতো” আল্লাহ যখন কাউকে দয়া করেন তখন সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলেও নতুন রাস্তার আবির্ভাব ঘটান।”
তাওসিফ সাদমানের পিট চাপড়ে বললো,”একদম।”

আইসিইউর বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন হক সাহেব,মিসেস লিপি সুহা সহ সবাই।নোহা মাকে জড়িয়ে ধরে আছে।সাদমান, আলেয়া সহ সবাই উদগ্রীব হয়ে আছেন নূরার অবস্থা জানার জন্য।
কয়েক ঘন্টার মধ্যে নূরার জ্ঞানও ফিরে এলো।ডাক্তার তাবাসসুম হাসিমুখে সেই সংবাদটা জানাতে এলেন।মেডিকেল সায়েন্সে এমন ঘটনা কমই দেখেছেন তিনি।সবকিছু কেমন যেন ম্যাজিকের মতো ঘটছে।তাবাসসুম হাসিমুখে বললেন,”আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের রোগীর জ্ঞানও ফিরে এসেছে।কিছুক্ষণের মধ্যে পুরোপুরি সজ্ঞানে ফিরে আসবেন তিনি।তখন আপনারা চাইলে দেখা করতে পারবেন।তবে বড়জোর একজন।কে যেতে চান?”
সাদমান এগিয়ে এসে বললো,” প্লিজ আমি যেতে চাই।আমাকে যেতে দিন।”
“ঠিক আছে আসুন কিন্তু রোগীর সামনে উত্তেজনা দেখানো,বা অস্থিরতা প্রকাশ করা যাবে না।”
সাদমান মাথা নাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো তারপর ছলছল চোখে যেন সবার অনুমতি নেয়ার অপেক্ষায় রইলো।আলেয়া ইশারায় যেতে বলেন।হক সাহেব,লিপিও সম্মতি জানালেন।
সাদমান ভিতরে প্রবেশ করলো।হৃদ স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটছে তার।অবিশ্বাস্য লাগছে সবকিছু।
তাবাসসুম নূরার পাশে গিয়ে নূরার মাথায় হাত রাখলেন।নূরা চোখ মেলে তাকালো।তাবাসসুম মুচকি হেসে হাত ইশারায় সাদমানকে দেখিয়ে বললেন,”কে এসেছে দেখুন।”
নূরা জড়িয়ে যাওয়া ঝাপসা চোখে তাকালো সাদমানের দিকে।সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরিহিত একটা লোক।মাথায় সাদা টুপি।গালভর্তি দাড়ি।ঠিক যেমন নূরা স্বপ্নে দেখতো সাদমানকে।আজকেও কী স্বপ্ন দেখছে সে।সবকিছু কেমন অবাস্তব লাগছে তার।ঘোরের মধ্যে আছে যেন।চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না ঠিকমতো।
সাদমান এবার ডাক্তার তাবাসসুমকে অনুরোধের সুরে বললো,”ম্যাম আমি একবার নূরার পাশে গিয়ে বসে ওর হাতটা ধরি।প্লিজ একবার।”
তাবাসসুম মাথা নেড়ে বললেন,”হুম।কিন্তু বেশি সময়ের জন্য না।”
সাদমান মাথা নাড়িয়ে দ্রুত বেডের কাছে গিয়ে মেঝেতে বসলো। নূরার হাতটা আলতো করে ধরলো।চোখের পানি বাধ মানছে না।
নূরার নামটাও উচ্চারণ করতে পারছে না সে।কথাগুলো গলা পর্যন্ত এসেই যেন আটকে যাচ্ছে।অনেক চেষ্টা করেও মুখে কোনো শব্দ বলতে পারছে না।নূরার চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।সাদমান নূরার হাতে আলতোভাবে তার ঠোঁট স্পর্শ করালো।তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে ইশারায় আশ্বস্ত করলো,সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাবাসসুম মুগ্ধ দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখছেন।দুজন মানুষ মুখে কোনো শব্দ না বলেও চোখের ভাষায় কীভাবে কথা বলে ফেলছে।টিভিতে যে দাপটে সাদমান হককে তিনি দেখতেন সেই সাদমান হককেই হসপিটালের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি।অবিশ্বাস্য বটে।মুহুর্তে যেন মানুষটা বদলে গিয়েছে।
স্ত্রীর প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে একটা মানুষ এমন পরিবর্তন হতে পারে সেটাই ভাবছেন তিনি।
—————————-
নূরা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।লিপি ওয়াজিহাকে এনে নূরার কোলে দিলেন।এই প্রথমবার মেয়েটা মায়ের স্পর্শ পেলো।নূরা মেয়েকে অসংখ্য চুম্বনে ভরিয়ে দিয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখলো।অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে তার।পৃথিবীর সমস্ত অনুভূতিকে এক জায়গায় করলেও যেন এই অনুভূতির কাছে ফিকে হয়ে যাবে।সাদমান পাশে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে মা- মেয়ের প্রথম দর্শন।এই দৃশ্যটার জন্যই যেন আল্লাহর কাছে লক্ষ-কোটি শুকরিয়া আদায় করা যায়।আলেয়া এক পাশ থেকে নূরাকে জড়িয়ে রেখেছেন।মেয়েকে ফিরে পেয়ে তিনিও যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছেন।হক সাহেব আর লিপিও বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছেন আজ।
নোহা আর সুহা ইউটিউব দেখে রান্না-বান্না করেছে আজ।খাওয়াদাওয়া শেষে সেসব নিয়ে কতক্ষণ হাসাহাসি হলো।তারপর এই কয়দিন সাদমানের কী অবস্থা ছিল সব গল্প শুনালো সুহা, নূরাকে।সাদমান যদিও বার বার তাকে থামানোর চেষ্টা করছিল।
সবাই নূরার ঘরে বসেই গল্প করছেন।হক সাহেব সাদমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” তোমার সিদ্ধান্তে আমি অনেক খুশি হয়েছি সাদমান।তুমি সিনেমা জগৎ থেকে বেরিয়ে এসেছো।এবার আমাদের ব্যবসাটা নতুন করে শুরু করো তুমি।”
নূরা অবাক হয়ে সাদমানের দিকে এক পলক তাকালো।সাদমান অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে!নিজেকে এতটা পরিবর্তন করেছে যে বিশ্বাসই হচ্ছে না তার।
সাদমান মাথা নাড়িয়ে হক সাহেবের কথায় সম্মতি জানালো।
লিপি বললেন, “চলো এবার ঘরে যাওয়া যাক।এতদিন ঠিকমতো বিশ্রাম বলো আর ঘুম বলো কিছুই হয়নি।আজকে একটা শান্তির ঘুম দিতে হবে”
একে একে সবাই নিজের ঘরে চলে গেল।

সাদমান এসে নূরার পাশে বসলো।নূরা সাদমানের দিকে তাকিয়ে বললো,”অনেক বদলে গেছেন আপনি।নিজেকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে ফেলেছেন।আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।আবার ঘুম ভেঙ্গে এত সুন্দর স্বপ্নটা হারিয়ে যাবে না তো?”
সাদমান নূরার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,”সব সত্যি।এই সত্যিটা কখনই হারিয়ে যাবে না নূরা।”
“এই কয়দিন অনেক কষ্ট পেয়েছেন তাই না?খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো করেননি বোধহয়। চেহারা একদম শুকিয়ে গেছে।”
“নিজের চেহারা দেখেছো? কত কষ্ট, যন্ত্রণা পেয়েছো এই কয়দিন।তোমার নিস্তেজ মুখটা দেখলেই আমার পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যেতো নূরা।আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর কাছে লক্ষ-কোটি শুকরিয়া আদায় করি সবকিছু কাটিয়ে উঠতে পেরেছো।তিনি তোমাকে আমার জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছেন।আমার জীবনের নূর আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।এই নূর ছাড়া আমার জীবন যে অন্ধকার পুরীতে পরিণত হতো।”
নূরা সাদমানের বুকে মাথা রেখে বললো,” আমার কোনো কষ্ট নেই। বরং আল্লাহর কাছে আমার শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ যে এই কষ্টটা আমাকে তিনি দিয়েছেন।নাহলে তো আমার ওয়াজিহার বাবার হেদায়েত আমি দু-চোখ ভরে দেখতে পারতাম না।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন এখন বুঝতে পেরেছেন?”
সাদমান নূরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,”হ্যাঁ আল্লাহ মহান।পরম দয়ালু।”

ওয়াজিহা ঘুম থেকে জেগে গেছে।নূরা কোলে নিতে চাইলে সাদমান তাকে বাধা দিলো।
সে ওয়াজিহাকে ফিডারে দুধ খাওয়ালো।তারপর তাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘুম পাড়ালো।
নূরা মুগ্ধ চোখে এসব দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।সেই অপরিপক্ব মানুষটা কত তাড়াতাড়ি পরিপক্ব বাবা হয়ে উঠেছে।
————————-
ফজরের আযানের মধুর সুর ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে।কেউ একজন নূরার নাম ধরে ডাকছে।
নূরা ঘুম জড়ানো চোখে তাকালো।সাদমান বসে আছে নূরার মাথার কাছে।নরম কন্ঠে বলছে,”নূরা উঠবে না? ফজরের নামাজের সময় হয়েছে?”
নূরার বুকটা তৃপ্তিতে ভরে গেল।চোখ দুটি খুশিতে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।এই দিনটার জন্যই তো সে কতগুলো দিন অপেক্ষা করেছে।এই ভোরটা পাবার জন্য আল্লাহর কাছে কতশত ফরিয়াদ করেছে।অবশেষে আল্লাহ তাকে দান করেছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ ফজরের ওয়াক্ত।নূরা মোহগ্রস্ত হয়ে উঠে বসলো।সাদমান তাকে হাত ধরে বিছানা থেকে নামালো।
অযু করে এসে দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করলো।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো।নামাজ শেষে নূরা কোরআন তেলাওয়াত করতে বসলো।সাদমান পাশে বসে মনোযোগ সহকারে শুনছে।
এক পর্যায়ে সাদমান বললো,” নূরা আমাকে তেলাওয়াত করা শেখাবে না?”
নূরা মাথা নাড়িয়ে হাস্যজ্বল মুখে বললো,” ইনশাআল্লাহ।”
———————
কেটে গেল কয়েকটা বছর।নূরার সংসার খুশিতে ভরপুর।এই পরিবারের সবাই এখন আল্লাহভিরু,ধর্মপরায়ণ।আগামীকাল থেকে রমজান মাস শুরু হবে।সবাই মিলে চাঁদ দেখে এসে বসে বসে খোশগল্প করছে।তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো।সাদমান উঠে গিয়ে দেখলো দরজার ওপাশে জাহিদ তার মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সাথে আশরাফ সাহেব এবং পলিও আছেন।সাদমান ইশারায় নূরাকে ভিতরে যেতে বললো।নূরা উঠে চলে গেল।
সাদমান দরজা খুললে তারা ভিতরে প্রবেশ করলো,আর জাহিদ লুটিয়ে পড়লো সাদমানের পায়ে।আচমকা এরকম কিছু হওয়ায় সাদমান অপ্রস্তুত হয়ে সরে গেল,”কী করছেন এটা?”
জাহিদ মেঝেতেই বসে থেকে কান্নাজোরে দিলো আর মুখে বললো, “আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাই।তোমার স্ত্রীকে একবার ডাকো আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব।আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো।”
সাদমান পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছে না।তবুও জাহিদকে তুলে সোফাতে বসালো।সবাইকে বসতে বললো।
জাহিদের পাশে বসে তার মাও কাঁদছেন।
হক সাহেব বললেন,”কি হয়েছে বলুন তো।”
জাহিদ হাত জোর করে বললো,”সেদিন আমি নূরাকে অসম্মান করতেই তাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে ছিলাম।সাদমান তো নূরাকে সেদিন রক্ষা করেছিল মাত্র।সাদমান বা নূরার কোনো দোষই ছিল না।তারা তো একে অপরকে চিনতোও না ঠিকমতো। নূরা মেয়েটা এতটাই পবিত্র যে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া সত্যেও হবু স্বামীর সাথে একা দুই মিনিট কথা বলতে পর্যন্ত নারাজ ছিল।সেই মেয়েটিকে আমি কলঙ্কিত করেছি।সাদমানের মতো নিরপরাধ ছেলেকে জোরে দিয়ে কুৎসা রটিয়েছি।আল্লাহ কেন আমাকে ক্ষমা করবেন! আমি আমার শাস্তি পেয়ে গেছি।”
জাহিদের মা এবার বললেন,”জাহিদ অনেক অসুস্থ। ডাক্তার বলে দিয়েছে তার হাতে আর সময় বেশি নেই।আপনারা আমার ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিন সবাই।আত্মগ্লানিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে।”
সাদমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”উনি ওনার ভুল বুঝতে পেরেছেন তাই আমি ওনাকে ক্ষমা করে দিলাম।তাছাড়া ক্ষমা যা চাওয়ার আল্লাহর কাছে চাইবেন।আমরা ক্ষমা করার কে বলুন?”
জাহিদ অনুনয় করে বললো,” নূরাকে একবার আসতে বলুন।ওনার কাছে আমি ক্ষমা না চাইতে পারলে কিছুতেই শান্তি পাবো না।”
সাদমান নূরাকে ডেকে আনলো।সে নেকাব পরিহিত অবস্থায়ই সবার সামনে আসলো।
জাহিদ মাথা নিচু করে বললো, “আপনার পা স্পর্শ করার স্পর্ধা আমার নেই।নাহলে আপনার পা ধরেই মাফ চাইতাম।আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
নূরা মাথা নাড়িয়ে বললো, ” কারোর পা ছুয়ে ক্ষমা চাইতে হয় না।আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিক।আমি এই দোয়াই করবো।আপনার হেদায়েত দেখে ভালো লাগছে।ইনশাআল্লাহ আল্লাহ চাইলে সুস্থও হয়ে যেতে পারেন আপনি।নিরাশ হবেন না।”
জাহিদ আবারও সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
আশরাফ সাহেব নূরার হাত ধরে বললেন,”এই অপরাধী মানুষটাকে ক্ষমা করবে না মা।তোমার মতো মেয়েকে ভুল বুঝে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে অনেক বড় পাপ করে ফেলেছি আমি।চাচা হয়ে নিজের রক্ত চিনতে ভুল করেছি।”
নূরা নরম গলায় বললো, ” আমাকে লজ্জা দিবেন না চাচা।আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন এতেই আমি খুশি।”
আশরাফ আলেয়ার কাছেও ক্ষমা চাইলেন।এবং তাদের নিজেদের বাসায় ফিরিয়ে নিতে চাইলেন।

সাদমান এসে নূরার পাশে দাঁড়ালো,ফিসফিস করে বললো,”আল্লাহ আমাদের সেই অপবাদ থেকেও মুক্ত করে দিলেন নূরা।”
নূরা সাদমানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো এবং তার মনে পড়ে গেল কোরআনের সেই আয়াতটি “হে আল্লাহ, আমি তো কখনো আপনাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি” [সুরা মারইয়াম: ৪]

—- সমাপ্ত —-