এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১০

0
401

#এক ফোঁটা প্রেমের বিষ
#Tahmina Akhter

১০.

পুরো রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। শোয়েবের হুট করে আমার জীবনে আসা। তারপর, আমার জীবনে জোর করে তার জায়গা করে নেয়ার বৃথা চেষ্টা। শোয়েবের এই চেষ্টাকে এখন বৃথা বলা হয়তো উচিত নয়। এই যে সকলের আড়ালে সে আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে গেছে। এর কারণ কি দাঁড়ায়। আমি বুঝতে পারছি না।

সন্ধ্যায় শোয়েবরা চলে যাওয়ার পর আমি যখন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঠিক তখনি আমার মনে হয়েছে কেউ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে ঘুরে তাকানোর আগে শোয়েবের গলা শুনতে পেলাম। সে আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

—আজকের এই দিনটা মনে রেখো আমাদের এনগেজমেন্টের দিন হিসেবে। কাউকে এই আংটির কথা বলো না। সময় হলে তখন সবাই এমনিতেই দেখবে। সবশেষে বলব তোমার ইচ্ছা তুমি এই আংটি পরবে কিনা? কিন্তু, আমি চাওয়ামাত্র যেন তোমার কাছে এই আংটিটা পাই। একমাস পর হোক বা একবছর পর। আল্লাহ হাফেজ, মন।

কথাগুলো বলে আমার কানের কাছে ফু দিয়ে চলে যায় শোয়েব। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি শোয়েবের গমনের পথের দিকে।

সকাল হলে আমার রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলাম বাবার ঘরে। বাবা নিউজপেপার পড়ছেন। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বাবা নিউজপেপার টেবিলের ওপর রেখে আমাকে ইশারায় ঘরে আসতে বললেন। আমি বাবার চেয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— বাবা, ভাইয়ার ফ্লাইট তো পরশু দিন। কিছু আয়োজন করলে হয়তো ভাইয়ার ভালো লাগত সাথে আমাদের সবারও।

— সেটাই ভাবছি। আচ্ছা, সে-সব কথা থাক। তুই অনুমতি দিলে আমি একটা কথা বলব।

— কি এমন কথা বলবে বাবা। যার জন্য আমার কাছ থেকে অনুমতি চাইছো?

কথাটি বলে মিলি খাটের উপর বসে পরে। মিলির বাবা কিছু সময় নিয়ে বললেন,

— আমি গতকাল সারারাত ভেবে দেখেছি। শোয়েব তোর জীবনসঙ্গী হিসেবে উপযুক্ত। কারণ, সে তোকে আগলে রাখতে পারবে। এই যুগে ভালোবাসা কিংবা বিয়ে নামক সম্পর্ককে কয়জন মানুষ আগলে রাখে? তাছাড়া, ছয় বোনের এক ভাই শোয়েব। নারায়ণগঞ্জে ওর বাবার জুট মিলস আছে তিনটা। আর শোয়েব নিজেও সাইকিয়াট্রিস্ট। সবচেয়ে বড়ো কথা শোয়েবের পরিবার তোকে চায় শোয়েবের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে। যদি শোয়েব একা আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিত তবে আমি মানা করে দিতাম। কিন্তু, নারায়ণগঞ্জ থাকা অবস্থায় শোয়েবের মা আমার কাছে তোর হাত চেয়েছেন। এখন তুই কি বলিস, মিলি? আমার সিদ্ধান্ত কি ভুল?

— এই পাগল লোক আবার সাইকিয়াট্রিস্ট হলো কবে?

মিলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ওর বাবাকে। মিলির বাবা মিলিকে আরও একধাপ অবাক করে দিয়ে বলে,

— বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আছে। ছেলে দেখতে সুন্দর। ক্যারিয়ারে সফল। মোস্ট ইমর্পোট্যেন্ট সে তোকে চাইছে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে। তোর সময়ের প্রয়োজন হলে সময় দিব আমি। আর যদি বলিস শোয়েবকে তোর পছন্দ নয় তবে আমি আজই উনাদের কল করে না করে দিব।

মিলি ওর বাবার কথা শুনে চুপটি করে আজ সকালের কথা ভাবছে। শোয়েবের কল পেয়ে আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে মিলির। মিলি কল রিসিভ করার পর শোয়েব কোনো কথা বলেনি এমনকি হ্যালো পর্যন্ত না । মোবাইলের দুপ্রান্তে থাকা দুজনের মাঝে যেন জেদ চেপে গিয়েছিল। কেউ আগে কথা বলবে না। মিলি অধৈর্য হয়ে কল কেটে দেয়ার একমিনিট যেতে না যেতেই শোয়েব কল ব্যাক করে। এবার শোয়েব কথা বলে।

— আমাকে যদি তোমার হতে না দাও তবে বিষ কিনে পাঠিয়ে দিও। আমি মরে গেলে হয়তো তুমি বেঁচে যাবে আমার প্রেমের বিষ থেকে। কিন্তু, আমি বেঁচে থাকব আর তুমি আমার হবে না। এটা আমি কখনোই হতে দিব না। বেঁচে থাকো আর সংসার করো কিংবা ভালোবাসো সমস্যা নেই। কিন্তু, যাকে নিয়ে তোমার এতকিছু হবে সেই মানুষটাও যেন আমি হই।

কল কেটে দেয় শোয়েব। মিলি ঝিম মেরে বসে থাকে। তারপরই, মিলি ওর বাবার ঘরে চলে আসে।

মিলি ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে ওর বাবাকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

— বাবা, আমি জানতাম তুমি আজ না-হয় কাল এই ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলবেই। আর আমিও এই ব্যাপারটা নিজেকে গতকাল রাত থেকে প্রস্তুত করে রেখেছি। কারণ, শোয়েব নামক মানুষটাকে আমি তিনদিন দেখেছি। এবং তিনদিন যথেষ্ট ছিল আমার তাকে চেনার জন্য। কিন্তু, বাবা একজন জেদি মানুষকে নিয়ে সংসার করা আর যুদ্ধ করা আমার কাছে সমান মনে হয়।

— আল্লাহ তাআ’লা আমাদের একেক জায়গায় একেক রকম পরীক্ষা নেন। কেউ জীবনের চরম সফলতার কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আবার কেউ না চাইতেও সবটা পেয়ে যায়। যেমন: তুই ওকে এক পলক দেখার জন্য কি পাগলামি না করেছিলি? আত্মহত্যা করতে অব্দি চেয়েছিলি। কই সে তো এলো না! তাই আমি বলছি যে তোকে ভালোবাসে তোর কদর করে তুই তার হাতে হাত রেখে বাকি জীবন অনায়েসে পাড় করে দে। তুই যাকে ভালোবাসিস সে হয়তো তোকে মনেও রাখেনি। শুধু শুধু তার অপেক্ষায় থেকে নিজের জীবন নষ্ট করার কোনো মানে হয় না, মিলি।

মিলির চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরার আগে মিলি অতি সন্তর্পনে মুছে ফেললো। তারপর, কান্নামাখা সুরে বললো,

—বাবা, আমি এই বিয়েতে রাজি।

কথাটি বলে মিলি একদৌঁড়ে ওর বাবার ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

— মিলি???

কারো ডাকে পুরনো স্মৃতিচারণ থেকে বের হয়ে আসে মিলি। চারপাশে তাকিয়ে আবারও মনে পড়ে যায় যে মিলি জেল নামক স্থানে আজ ছয়দিন।

—মিলি???

পুনরায় সেই ডাক শুনে মিলি মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখে শোয়েব এসেছে। মিলি শোয়েবকে দেখে চটে যায়। জোর গলায় বললো,

— কেন ডাকছেন, আমায়? আমি মরে গেলে আপনি শান্তি পাবেন, বলুন? আমি মরে গেলে হয়তো আপনার শান্তি মিলবে তার আগে নয়।

—মিলি..ই। মরার কথা একবারও বলবে না। নয়তো..

— নয়তো, কি বলুন?? যেদিন থেকে আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আপনি আমাকে কতটুকু সুখ দিয়েছেন?

— তুমি আমাকে কতটা সুখ দিয়েছো, মিলি? তোমার ওই চোখে তাকালে অন্যের জন্য এক আকাশ সমান ভালোবাসা তোমার চোখে দেখেছি আমি । একজন স্বামীর স্ত্রীর কাছে থেকে পাওয়া এরচেয়ে বড়ো আঘাত আর কি হতে পারে?

— সেজন্যই আপনি সাইফকে, আমার ভালোবাসাকে মেরে ফেলেছেন! আর সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। যেন আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে পারেন।

মিলির মুখ থেকে সাইফ ওর ভালোবাসা কথাটি শুনে শোয়েবের মাথায় যেন আগুন ধরে গিয়েছে। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে শোয়েব মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— মিলি তুমি আমাকে আর রাগানোর চেষ্টা করো না। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। হয়তো, সেই কথা শোনার পর তুমি তোমার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতেও পারো। হয়তো, এই জেলখানায় থাকতে চাইবে না তুমি।

মিলি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জেলখানার ফ্লোরে বিছানো মাদুরের দিকে। কন্সটেবল দরজার লক খুলে দিতেই শোয়েব ভেতরে প্রবেশ করে। ধীরপায়ে মিলির পাশে বসে তারপর বলতে থাকে তার কথা।

সবটা শুনে মিলির দুচোখ ভরে আসে। কি করে পারল সে এমন একটা কাজ করতে? এই কাজের জন্য কখনোও কি মিলি নিজেকে নিরপরাধ ভাবতে পারবে। নাকি ওপর ওয়ালা কখনো ওকে মাফ করবে?

— এখন তুমি বলো কি করবে?

শোয়েবের কথায় জবাবে মিলি উত্তর দেয়।

— যেটা আপনার করা উচিত। আমি সব কিছু করতে রাজি আছি। কারণ, আজ থেকে ওর জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি ।

শোয়েব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বের হয় যায়। কারণ, মিলি যেহেতু রাজি হয়েছে তবে আর দেরি করা ঠিক হবে না।

—কিন্তু, এই সব কিছু একমাত্র তোর জন্য। নয়তো, মিলির আমাকে ধোঁকা দেয়ার পর ওর জন্য আমার মন থেকে কেন যেন ভালোবাসা আসে না।

কথাটি আনমনে কারো উদ্দেশ্য বলে গাড়িতে উঠে রওনা হয় এক উকিল বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্য।

#চলবে