এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-০৯

0
361

#এক ফোঁটা প্রেমের বিষ
#Tahmina Akhter

৯.

— ব্রো, তুমি কোত্থেকে এলে বলো তো? মিলি, ইজ মাই উড বি ওয়াইফ। মানে আমার হবু স্ত্রী। সেখানে তুমি কোত্থেকে এসে জুড়ে বসলে! যাও আজকের জন্য মাফ করে দিলাম। নেক্সট টাইমে যেন পুনরায় এই ভুল করার সাহস না হয় তোমার। আজ হয়তো তোমার গাল ফাটিয়েছি আগামীকাল তোমার কি হবে আমি নিজেও বলতেও পারছি না।

কথাটি বলে ছেলেটার কলার ছেড়ে দেয় শোয়েব। ছেলেটা একনজর শোয়েবের দিকে তাকিয়ে চলে যায় ওদের দলের সঙ্গে।

রাস্তায় উপস্থিত থাকা সকলের মাঝ থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে। মিলির কি সত্যি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? এই ছেলে নিশ্চয়ই কোনো দলীয় পার্টির লোক। নয়তো, এই এলাকায় এসে এই এলাকার ছেলেকে মাঝ রাস্তায় ঘুষি মারে!

একেকজনের কাছ থেকে একরকম মন্তব্য শুনে মিলির রাগ এবং লজ্জা মিলিয়ে এক অসহ্য অনুভূতির আঘাতে মিলির মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

নিঝুম মিলির কাছে একবার প্রশ্ন করেছিল শোয়েবের ব্যাপারে। কিন্তু, মিলি উত্তর না দেয়ায় নিঝুম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মিলির পাশে।

কিন্তু, এরইমাঝে একটি অভাবনীয় কান্ড ঘটে। আর এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি অবাক হয় মিলি। কারণ, শোয়েব ওর সাথে কোনো কথায় না বলে সোজা একটি কারে উঠে চলে যায়।

মিলি কিছু বুঝতে পারছে না। সত্যিই কি শোয়েব এসেছিল নাকি সবই ভ্রম? আর যদি এসেও থাকে তবে ওর সঙ্গে কথা না বলে যাওয়ার লোক শোয়েব তো নয়ই।

—কি ভাবছিস, মিলু?

নিঝুমের কথায় মিলি প্রশ্ন জগত থেকে বের হয়ে আসে। তারপর, নিঝুমের সাথে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্য।

মিলি যখন বাড়িতে পৌঁছায় তখন মাগরিবের আজান চলছে। মিলি বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো কেউ নেই। হয়তো, ওর বাবা মসজিদে গিয়েছে নামাজ পড়ার জন্য।

মিলি ওর পড়নের শাড়ি না খুলে সোফায় শুয়ে পড়ে এককাত হয়ে। দরজার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে মিলি। যেন কেউ বাড়িতে প্রবেশ করলে মিলি দেখতে পারে।

কিছু সময় পর দরজা খোলার শব্দ শুনে মিলি চোখ খুলে তাকায়। আবছা দৃষ্টিতে দেখতে পায়, মেরুণ রঙা পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি পড়নে এক যুবক ওদের বাড়িতে এসে ঢুকেছে। পুরোপুরি দৃষ্টি নিয়ে মিলি তাকিয়ে দেখলো, শোয়েব এসেছে। তাও আবার শোয়েবের পেছনে ওর বাবা এবং দুই ভাই সহ শোয়েবের বাবা শাফায়াত আহমেদ।

মিলি এক ঝটকায় শোয়া থেকে ওঠে বসে তারপর, চোখ কচলে নিজের হাত চিমটি কেটে দেখছে, আসলে ও যা দেখছে তা সত্যি দেখছে তো? নিজের হাতে ব্যাথা পেয়ে মিলি বুঝতে পারে । সত্যি শোয়েব এবং ওর বাবা ওদের বাড়িতে এসেছে।

—কিরে মিলি তুই কখন এলি?

মিলির বাবা মিলিকে প্রশ্ন করলে মিলি দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়।

—আজানের সময় এলাম বাবা।

—যা তুই ঘরে যা। যখন ডাক দিব তখন চলে আসিস কেমন?

এই কথাটির অপেক্ষায় ছিল মিলি। বলা মাত্র মিলি কোনোমতে ওর ঘরে চলে এলো।

ঘরে এসে সর্বপ্রথম দরজা লক করে দেয় মিলি। মোবাইল ফোন বের করে কল দেয় ওর খালার নাম্বারে। ওর খালা কল রিসিভ করলে মিলি জিজ্ঞেস করে,

—খালা, আমাদের বাড়ির ঠিকানা ওদের দিয়েছে কে?

—কাদের দিয়েছি?
অবাক হয়ে উল্টো প্রশ্ন করেন জেসমিন।

—কেন, শোয়েবকে? একটু আগে শোয়েব উনার বাবাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে।

জেসমিন এসব কথার প্রেক্ষিতে কি জবাব দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শোয়েব যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মিলিকে পাওয়ার জন্য তা খুবই স্পষ্ট। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেসমিন সেদিনের ঘটনা বলতে যাবেন। তার আগে মিলির বাবা এসে মিলিকে দুবার ডাক দিয়ে রুমের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। তাই মিলি কল কেটে দিয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।

মিলির বাবা মিলির ঘরে ঢুকে নীচু কন্ঠে আক্ষেপের সুরে বললো,

— তুই নাকি সেদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে শোয়েব নামের ছেলের কোনো একটি ব্যাপার নিয়ে রাগ করে চলে এসেছিস?

মিলি ওর বাবার কাছে এই কথা শুনে চমকে যায়। তার মানে সাইকো সাহেব তার বাবাকে সব ঘটনা বলেছে?

— কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না, কেন?

—আসলে, বাবা। শোয়েব ছেলেটা ভালো নয়। অত্যন্ত বদমেজাজি। সে কি করেছে তুমি জানো না। আমি দেখেছি সে কি করতে পারে?

—যা করেছে নিশ্চয়ই তোর জন্য করেছে,তাই না?

মিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর বাবার দিকে।

—শোয়েবের বাবা আমাকে সবকিছু খুলে বলেছে। তুই ওকে অপছন্দ করতে পারিস, সমস্যা নেই। কিন্তু, তাকে ছোট করে কথা বলার অধিকার তো তোর নেই।

—কিন্তু, সে তো বলেছে অন্য কথা।

—কি কথা?

— সে আমাকে ভালো..।
কথাটি বলতে গিয়ে মিলি আঁটকে যায়।

— আমি আজ নয় বছর ধরে তোর খালার বাসায় গেলে। শোয়েবের সাথে প্রায়শয় দেখা হতো আমার। স্বভাবগতভাবে ওদের পরিবার রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে ওর মাঝে কিছুটা সেই রকম স্বভাব তৈরি হয়েছে।

—তুমি কি আমার কাছে ওর ব্যাপারে প্রশংসা করতে এসেছো,বাবা ?

— না। শোয়েব কেমন আমি তোকে বলতে চাইছি। তুই এটা ভাবিস না যে নারায়ণগঞ্জ কি কি হয়েছে আমি ওসব জানি না। আমি সব জানি। তোর খালা গতকাল রাতে আমাকে সব ঘটনা বলেছে।

— বাবা,জীবনে তো এমন হাতেগোনা মানুষ আসে আমাদের জীবনে। কিন্তু, যাকে আমার পছন্দ হবে সেই আমার জীবনসঙ্গী হবে। যাকে আমি পছন্দ করি না তাকে কোনোভাবে প্রশ্রয় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

— তুই যাকে পছন্দ করিস এমনও তো হতে পারে সে তোকে পছন্দ করে না।

এমন কথা শুনে মিলি ওর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যিই কি তার বাবা যা বলছে এমনটা হওয়া সম্ভব? কিন্তু, এমনটা যদি হয় মিলি বোধহয় মরেই যাবে।

— সম্পর্কে যেমন সম্মানের প্রয়োজন তেমনি ভালোবাসা থাকাটাও জরুরি। সেই ভালোবাসা হয়তো আজ শোয়েবের মাঝে আছে তোর জন্য। হয়তো, এক ছাঁদের নীচে থাকতে থাকতে শোয়েবের প্রতি তোর মনে ভালোবাসা জন্মাবে।

—আমি যদি বলি সে অতি মাত্রায় পাগল। তখন তুমি কি বলবে?

মেয়ের এমন প্রশ্ন শুনে মাহতাব সাহেব মুচকি হেসে বললেন,

— সে পাগল তোর কাছে। কারণ, ওর পাগলামির কারণ তুই। সারা দুনিয়ার কাছে সে যদি ভদ্র, গম্ভীর হয়ে থাকে তাহলে সে তোর কাছে পাগল ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, তুই আজ পর্যন্ত ওর পাগলামি দেখে এসেছিস।

মিলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর বাবার বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবছে। সত্যিই কি তাই!

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন মাহতাব সাহেব। শোয়েবদের বাড়ি থেকে মিলির জন্য নারায়ণগঞ্জ থাকতেই প্রস্তাব দেয় শোয়েবের মা। কিন্তু সময়ের অভাবে সেই ব্যাপারে আলাপ করা হয়ে উঠেনি। কিন্তু, গতকাল রাতে জেসমিনের সাথে কথা বলার পর তিনি জানতে পারেন, শোয়েবের করা কিছু আকস্মিক ঘটনা দেখে মিলি নারাজ শোয়েবের ওপর। মাহতাব সাহেব জানেন শোয়েব কেমন স্বভাবের। তাই বলে ওর মিলির প্রতি অনুভূতি কিংবা শোয়েবের মায়ের দেয়া বিয়ের প্রস্তাবকে সরাসরি নাকচ করে দেয়া যায় না। কিছু সময়ের প্রয়োজন মিলির জন্য এবং মাহতাব সাহেবের জন্য। যাতে এই বিষয়টা নিয়ে আরও কিছুদিন ভাবা যায়।

—আমার সঙ্গে নীচে চলে। শোয়েবের বাবা অপেক্ষা করছে তোর সাথে দেখা করার জন্য।

—কিন্তু, বাবা?

মেয়ের আড়ষ্টতা দেখে মাহতাব সাহেব মেয়ের হাত ধরে আস্বস্ত করে বলছেন,

— তুই ভাবিস না যে উনারা তোকে দেখতে এসেছে। শোয়েব তোর কাছে মাফ চাইতে এসেছে সেদিনের ঘটনার জন্য। আর বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমরা পরে আলাপ করব।

মিলি ওর বাবার পেছনে পেছে যাচ্ছে। ড্রইংরুমের সামনে এলেই সর্বপ্রথম শোয়েবের মুখটা দেখতে পায় মিলি। একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে শাফায়াত আহমেদকে সালাম দেয় মিলি। শাফায়ত সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে মিলিকে বললো,

— তোমাকে সেদিন অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। পরে তোমার খালার কাছ থেকে জানতে পারি তুমি নাকি কুমিল্লায় তোমাদের বাড়িতে চলে এসেছো।

— জি আঙ্কেল। সামনে ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা আছে তাই চলে এসেছি।

— তাহলে, আমরা উঠি ভাই সাহেব। নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্য এখন রওনা না হলে বেশ রাত হয়ে যাবে পৌঁছেতে পৌঁছেতে। মিলি ভালো থেকো। খুব শীঘ্রই আমাদের আবারও দেখা হবে।

শাফায়াত আহমেদ সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ান। মিলির বাবা এসে শাফায়াত আহমেদকে নিয়ে বাড়ির বাইরে এগিয়ে যাচ্ছেন।

মিলি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। শোয়েব সোফায় ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়। তারপর, দুই কদম এগিয়ে মিলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,

— আমি তোমাকে অনেক বেশি মিস করেছি মন।

শোয়েবের মুখ থেকে এই কথাটি শুনে মিলি চোখ তুলে তাকায়। শোয়েবের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে মিলি। কিছু তো একটা আছে এই লোকের কথায়।

—আমি জানি তুমি আমার ওপর অনেক অনেক বিরক্ত সেদিনের ঘটনার জন্য। আমি অনেক অনেক দুঃখিত মিলি। আমি চাইনি কিংবা কখনো চাইব না আমার কোনো কাজে তুমি কষ্ট পাও। পারলে আমাকে মাফ করে দিও।

— ইটস ওকে।

মিলি কোনোমতে কথাটি বলে ওর ঘরের দিকে চলে আসছিল এমন সময় শোয়েব পেছন থেকে মিলির হাত টেনে ধরে। মিলি স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। অজানা ভয়ে মিলির গা কাঁপতে শুরু করেছে। তবুও, নিজেকে শক্ত রেখে শোয়েবকে কিছু বলবে তার আগে শোয়েব মিলিকে বললো,

— কালো শাড়িতে তোমাকে অনেক মানায়।

কথাটি বলে মিলির হাত ছেড়ে দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যায় শোয়েব।

মিলি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের বামহাতের দিকে। কারণ,ওর অনামিকা আঙুলে এস লেটারের একটি রিং পরিয়ে দিয়ে গেছে শোয়েব।

#চলবে