ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-১+২+৩

0
964

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#সূচনা_পর্ব
©জারিন তামান্না

‘আমরা ভালোবেসে বিয়ে করবো নাকি বিয়ের পর ভালোবাসবো?’

প্রশ্নটা শুনে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পলক। হতভম্ব চোখে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে সাথের মানুষটাকে। সে এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছে যে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। বলতে গেলে,,পলক পলক ফেলতেই ভুলে গেছে। কিন্তু সামনের মানুষটা নির্বিকার। ভাব এমন যেন খুব স্বাভাবিক আর কমন প্রশ্ন করেছে সে। কিন্তু পলকের অবস্থা এমন যে সারা বছর পড়াশোনা না করার ফলে সবচেয়ে কমন প্রশ্নটাই তার কাছে একদম ভিনগ্রহী প্রাণীর মতই উদ্ভট আর অজানা লাগছে।

এদিকে নিবিড় নয়নে ফুরিয়ে আসা দুপুরের শুভ্র আকাশ দেখছিল সিফাত। এই আকাশের সাথেই তার যত প্রেম,যত টান। ছোট থেকেই আকাশের প্রতি তার এই টানটাই তাকে টানতে টানতে এগিয়ে নিয়ে গেছিল পাইলট হওয়ার ইচ্ছার দিকে। আর এখন সে জীবনের প্রায় সময় আকাশের বুকে,,মেঘের কোল ঘেঁষে উড়ে বেড়ায়।অবসরে একান্ত সময়ে আকাশ দেখে। এটা তার এক রকম শখ বলা চলে। কিংবা নিগূঢ় প্রেম থেকে অসীম ভালোবাসা।

বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে সিফাত আর তার পরিবার। আকাশের প্রতি টানটা তাকে টানতে টানতে পাইলট বানিয়ে দিলেও প্রেমিক পুরুষ হয়ে ওঠার সুযোগটা আর দেয়নি। অথবা সে নিজেই সেই সুযোগটা নেয়নি।আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েই কেটেছে কৈশোর থেকে যৌবনের একচোট। একজন পাইলট হিসেবে মানসিক দক্ষতার সাথে সাথে শারীরিকভাবেও একজন সুদর্শন ছেলে সে। স্টুডেন্ট লাইফে তো অনেক মেয়েরই পছন্দের শীর্ষ তালিকায় ছিলই আর চাকরিতে আসার পরে মেয়ে কলিগদেরও মন কেড়েছে। কিন্তু তার সে সবের খেয়াল কই! সে নিজের মতই থাকতে ভালোবাসে। কাজ, পরিবার,,অবসরে বন্ধুমহল আর এই সীমাহীন বিস্তৃত আকাশের প্রতি টানটাই তার সব। এর বাইরের দুনিয়ার রং তামাশা সব চুলোয় যাক। তাতে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু বয়স তো আর থেমে নেই। এবার বছর ৩২ পেরুলো। জীবনটাও এবার অন্যভাবে থিতু হতে চাইছে যেন। অনেক তো হলো একলা ছোটা।এবার সঙ্গে একান্ত নিজের বলে কেউ একজন থাকলে মন্দ হয় না। তবে তার এই থিতু হওয়ার চিন্তাভাবনার পেছনে সিংহভাগ ক্রেডিট তার পরিবারের। তারা এবার সংসারে নতুন প্রজন্ম চায়।তাই এবার তার বিয়ে করাটা অতি আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার কাছে।

কিন্তু সমস্যা হলো সিফাতের ধ্যান ধারণা আর যুক্তি। তার মতে, খুঁজে পেতে প্রেমে পড়ার বয়স, সময় কিংবা ধৈর্য্য তার নেই এখন আর। তাই পরিবার থেকেই শুরু হলো মেয়ে দেখার যত তোড়জোড়। সিফাতের তেমন সময় হয় না।তাই বেশিরভাগ সময় মেয়েদের ছবি আর বায়োডেটা দেখেই রিজেক্ট করে দেয় সে। কখনো কাউকে সিলেক্ট করা হলে ছুটির দিনে গিয়ে দেখা করে আসে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আলাপ চারিতার পরে সেসব সিলেক্ট করা মেয়েকেও সে পছন্দ করে উঠতে পারেনি। কারও ব্যক্তিত্ব তার মনে দাগ কাটে না। তার মতে, প্রতিটা মানুষের চেহারায় তার ব্যক্তিত্বের একটা ছাপ থাকে। সুন্দর মুখের চাইতে মানুষের কথায়, তার ভেতরের মন মানসিকতাটা চেহারার এক্সপ্রেশনে প্রকাশ পায় বেশি।তাই বাইরে থেকে দেখতে সুন্দর হওয়ার চাইতে মন থেকে সুন্দর হওয়া অতি আবশ্যক। কারণ,যে মানুষটা রাত দিন আকাশের বুকে ছুটে চলে,আকাশের বিশালতায় বুদ হয়ে থাকতে ভালোবাসে..তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার মনও হওয়া চাই আকাশের মতই বিস্তৃত। কিন্তু আজ অবদি এমন কোন মেয়েকে সে পাইনি। আর যতদিন না পাবে,, পরিবারের ধৈর্য্য থাকলে মেয়ে খুঁজুক আর নইলে ছেড়ে দিক। বিয়ে করাটা জরুরি না এতটাও। সে একলা হয়েও বেশ তো আছে।বাকি সময়টাও না হয় চলে যাবে এমনি করেই।

পলকের ব্যাপারটায় একটু নয় বরং বেশ আপত্তি ছিল সিফাতের পরিবারের সবার। মেয়ে শিক্ষিতা, ভদ্র হলেও ওমন একটা মেয়ে কি তাদের একমাত্র ছেলের সাথে মানায়! কিন্তু ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। আর সেই ভাগ্যের জোড়েই বোধয় পলকের ছবিটা সিফাতের চোখে পড়ে যায় কোন একভাবে। হাসি বিহীন একদম শান্ত চাহনির একটা মুখ। প্রথম দেখায় মনে হবে বেশ গোমড়া মুখ করে ছবিটা তোলা। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে আসল ব্যাপারটা। মুখটা গোমড়া নয় বরং ভেতরটা শূন্যতায় ভরপুর। কিচ্ছু নেই এমন। স্বচ্ছ আর ফাঁকা। ব্যস,এটুকুতেই কি যে কি খুঁজে পেল সে। একপ্রকার জেদ ধরেই বসলো,,এই মেয়েকে তারা দেখতে যাবে আর খুব সম্ভবত এই মেয়েকেই তারা তাদের বাড়ির বউ হিসেবে পাবে।

শুরুতে খুব জোড় আপত্তি করলেও বাড়ির একমাত্র ছেলের জেদের কাছে সেই সব আপত্তি ঝেটে বিদেয় করতে বাধ্য হলো তার পরিবার। আর সেই সূত্র ধরেই আজ পলকের বাড়িতে আসা। সিফাত মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলার ইচ্ছেপোষণ করে। যার ফলশ্রুতিতে এই মূহুর্তে তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির ছাদের রেলিং ঘেঁষে।
_______________________________

পলকের তার দিকে এভাবে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকাটা পাশে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছিল সিফাত। তাই পলকের এহেন হতভম্বিতা বুঝতে পেরেই মৃদু হাসলো সে। পাশ ফিরে তাকালো পলকের মুখপানে। কি টলটলে মুখশ্রী তার। ঠিক যেন পদ্মপাতার জলের মত। উজ্জ্বল শ্যামবরণ গায়ের রংটাকে অনেকটা ভিজে মাটির মতই স্নিগ্ধ লাগে সিফাতের কাছে। হঠাৎ তার মনে হলো মেয়েটার নাম মৃণ্ময়ী হলে ভালো হতো। মানাতো বেশ। এরপর কি একটা ভেবে আপন মনেই মৃদু হাসলো। আর এদিকের সিফাতের এমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যেন হুশ ফেরালো পলকের। বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিল তাকে। চঞ্চল হলো তার দৃষ্টি। দ্রুত চোখ নামিয়ে এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগলো তার দৃষ্টি। পলকের এমন অবস্থা দেখে বেশ হাসি পেলেও নিজেকে সংযত করে নিল সিফাত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দিল, বললেন না তো! আমরা ভালোবেসে বিয়ে করবো নাকি বিয়ে..

তার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে পলক পাল্টা বলে বসলো,,এ আবার কেমন কথা! এরেঞ্জম্যারেজে কি কেউ ভালোবেসে বিয়ে করে নাকি…বিয়েটা তো সম্পূর্ণই পারিবারিকভাবেই হয়। আর তখন স্বামী স্ত্রী হিসেবে একে অপরকে ভালোবাসবে এটাই তো নিয়ম।

এই বলেই চুপ হয়ে গেল পলক। ভেতর ভেতর অপেক্ষা করতে লাগলো সিফাতের কিছু বলার।

নিয়ম! পলকের শেষের কথাটায় এই শব্দটার ব্যবহারটা কেমন বেমানান শোনালো সিফাতের কাছে। মনে মনে শব্দটা আওড়ালো একবার,নিয়ম! তারপর একদম ঝরঝরে গলায় বললো, হ্যাঁ,সেটা ঠিক। এরেঞ্জম্যারেজে প্রেম করে বিয়ে হয় না। তবে আমি যতদূর জানি আপনি পিওর সিঙ্গেল। কখনো কোন রিলেশনশিপে বা কমিটমেন্টও জড়াননি।কেন জড়াননি সেটা জানতে চাইবো না। আর যেহেতু এসব কোন পাস্ট প্রেজেন্ট পিছুটান আপনার নেই,তাই জানতে চাইছিলাম যে আপনি কি চান…আমি আপনার বিবাহিত প্রেমিক হই নাকি নিজের প্রেমিক আপনার বিবাহিত স্বামী হোক?

বিস্ময়ে এখন পলকের মাথা চক্কর দিচ্ছে। এতক্ষণে একটা বিষয় খুব ধীরে কিন্তু বেশ তীক্ষ্ণভাবে তার মাথায় ক্যাচ করেছে যে তার সামনে এই মূহুর্তে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে,কথা বলছে সেই মানুষটা নিজেকে তার স্বামী বলছে।এর মানে তো এই দাঁড়ায় যে, মানুষটা তাকে বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ফেলেছে। এও কি সম্ভব?!চেনা নেই, জানা নেই কেবলমাত্র দেখতে এসে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। প্রেম করে বিয়ে করবো নাকি বিয়ের পর প্রেম করবে এমন সব উদ্ভট কথা জিজ্ঞেস করছে। সেটাও তার মত একটা মেয়েকে! কি দেখে পছন্দ করলো তাকে?নাকি অন্য কোন মতলব আছে এই লোকের। এমন সুদর্শন, সুযোগ্য ছেলের জন্য তো মেয়েদের হুমরি খেয়ে পড়ার কথা। কথা কি..হয় তো রোজ রোজ, দিবা রাত্রি এসে পড়ে থাকে। আর সেই লোক কিনা তার মত অগোছালো,,,মেটে গায়ের রংএর মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাইছে?? আবার কি ভাবে বলছে দেখো..প্রেম করার কথা। আর অতীত নেই মানে!!!! এই লোক কি জানেটা কি তার ব্যাপারে যে এত কনফিডেন্টলি বলে দিল সে একদম পিওর সিঙ্গেল। না.. না এখানে নিশ্চয় কোন ঘাপলা আছে। বাবা আবার এদের টাকা টুকা অফার করে নাই তো? নাহ,,এদের তো এম্নিতেই অনেক টাকা। অনেক বড়ঘরের মানুষ এরা। মা বলেছিল কাল। তাহলে?!

সিফাতের দিকে চেয়ে পলক এসব আকাশ পাতাল ভাবনায় মশগুল।তা দেখে বেশ বিচলিত হলো সিফাত। ভ্রুকুটি কুচকে জিজ্ঞেস করলো,,এই যে কি এত ভাবছেন মৃন্ময়ী? সিফাতের প্রশ্নে নিজের আকাশ পাতাল ভাবনা ফুরে সোজা নিজ জগতে ফিরলো পলক। কিন্তু মৃন্ময়ী বলে ডাকায় আশে পাশে তাকিয়ে খুঁজলো কাউকে। তার এই খোঁজা খুঁজির দৃষ্টি দেখে সিফাতও এদিক ওদিক তাকালো। বিশেষ কিছু খুঁজে না পেয়ে সরাসরি পলকেই বললো,,কি খুঁজছেন এভাবে?

হ্যাঁ..হ্যাঁ.! সিফাতের প্রশ্নে এবার সত্যিই বিচলিত হলো সে। আরও একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,,ওই যে মৃন্ময়ী বলে কাউকে ডাকলেন না। তাই কে এলো এখানে সেটাই দেখতে চাইছিলাম।

এতক্ষণ বেশ গম্ভীর দৃষ্টিতে মনোযোগসহকারে পলকের কথা শুনছিল সিফাত। কিন্তু তার এহেন বোকা বোকা টাইপ চিন্তা আর কান্ড দেখে একগাল হেসে দিল সে পলকের দিকে তাকিয়ে। আর পলক! সে তো মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো সেই প্রাণবন্ত হাসিখানা। যেন শেষ দুপুরের রোদ চলে যাবার আগে একঝলক প্রশান্তির উষ্ণতা রেখে গেল কোথাও।

চলবে..

#ভালবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২
©জারিন তামান্না

পলক যখন মুগ্ধ নয়নে সিফাতের হাসিতে ধীরে ধীরে মশগুল হচ্ছিল ঠিক তখনই হাসিটা থেমে গেল আচমকাই।কিন্তু চোখ মুখ জুড়ে মৃদু হাসির আভা তখনো বিদ্যমান। ওই মৃদু হাসির রেশ ধরে রেখেই সিফাত বললো, ‘আরে ওটা তো আমি আপনাকেই বলেছি। আর তাছাড়া এই ছাদে আপনি আমি ছাড়া কেউ নেই আর আমি তো দিব্যি আছি..কিন্তু অন্যজন কোন একটা ভাবনায় ডুবে ছিল।তাকে উদ্ধার করতেই তো…’

সিফাতের মুখের কথা শেষ করতে না দিয়েই পালক বলে উঠল,’ _আপনি তো মৃণ্ময়ী বলে ডাকলেন কিন্তু আমার নাম তো..’

_হ্যাঁ,জানি। আপনার নাম পলক। সাজিয়া মেহরিন পলক। মৃন্ময়ী নামটা বেখেয়ালে বলে ফেলেছি আর কি! সিফাতের নির্বিকার উত্তর। ভাব এমন যে বেখেয়ালে এক মেয়ের সাথে থেকে তাকে অন্য মেয়ের নাম ধরে ডাকাটা খুব স্বাভাবিক কিছু।

সিফাতের এহেন কথা আর ভাব দেখে এবারে বেশ সরু চোখে তাকালো পলক তার দিকে। মুখে চিন্তার ভাঁজ।মনে মনে ভাবছে,’এই মৃন্ময়ীটা আবার কে? উনার এক্স গার্লফ্রেন্ড নয় তো! যার জন্য আমাকে সে ভেবে…’

_এই,,কি হলো আবার কোন ভাবনায় ডুব দিলেন আপনি?

সিফাতের এই প্রশ্নে এবার খুব বিরক্ত হলো পলক। যেন তার কোন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার মাঝে ব্যাগড়া দিয়ে দিয়েছে সে। মুখে সেই বিরক্তি স্পষ্ট ফুটে উঠলো তার। সেই বিরক্তি ঝাড়তে যেই না সে মুখ খুলছিল কিছু বলার জন্য ঠিক তখনই ছাদের দরজা থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

_এই বুবু, হলো তোদের? মা নিচে যেতে বলেছে তাড়াতাড়ি। ভাইয়াকে আর কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবি এখানে। চল, আয়..নিচে যাবি।

কথাগুলো এক নাগারে বলে দম নিল নিশাত। উত্তরের আশায় পলকের মুখের দিকে চাইলো। তা দেখে পলক কিছু বলতে যাবে নিশাত কে তার আগেই সিফাত বলে উঠলো,
_হ্যাঁ আপু। যাবো তো নিচে। তুমি যাও,আমরাও আসছি।

সিফাতের কথা শুনে মুচকি হাসলো নিশাত। আর একপলক দুজনকে দেখেই উলটো হাঁটা দিলো সিঁড়ির পথে। তার নেমে যাওয়ার আওয়াজ পেতেই সিফাতও তাড়া দিল পলককে নিচে যাওয়ার জন্য।

_এই,চলুন। নিচে যাই।
পলক যেন এমন ঘটনায় আরও বিরক্ত হলো। তার কথা যে অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।ধরতে গেলে,,কোন কথাই তো হলো না ঠিক করে। এই লোকটা নিজের প্রশ্নের পাঁচগুটি ছুঁড়েই তো তাকে একবার ভাবনায় ডুবালো আবার ধপাস করে তুলে আনলো আর আবার…। আর সে তো কিছু বলতে বা জিজ্ঞেস করতেই পারলো না। অবশ্য এমনিতেও সে নিজ থেকে কিছু বলতোও না। কখনোই বলে না।সব বারই ছেলে পক্ষ থেকে প্রশ্ন করে আর সে শুধু জবাব দেয়। কারণ সে জানেই প্রশ্ন করে লাভ নেই কোন। যেখানে সমন্ধটাই হবে না সেখানে নিজের থেকে কথা বলার, কিছু জানারই বা কি আছে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। এই মানুষটাও আলাদা লাগছে আর সবার থেকে। তাই নিজ থেকে কিছু বললেও হয় তো বলা হতো এবার। কিন্তু সে আর হলো কই! একটা ছোট্ট চাপা শ্বাস ফেললো সে। কানে ভেসে এলো কারো ডাক।
সিফাত ছাদের দরজায় কাছে দাঁড়িয়ে আছে,,তাকে যাওয়ার জন্য ডাকছে। পলকও আর কিছু না বলে পা বাড়ালো যাওয়ার জন্য।

_________________________________

পলকরা যে ভাড়া বাড়িতে থাকে সেটা ৫ তলা বিল্ডিং। আর তারা থাকে ৪ তলায়। তাই ছাদে যেতে আসতে খুব বেশিসিড়ি ভাঙতে হয় না। পলক যখন ছাদের দরজাটা লাগিয়ে দিল,সিড়ির দিকটা খানিক আবছায়া অন্ধকার হয়ে এলো। সিফাতের পিছু পিছু গেলেও ১ সিড়ির ফাঁক রয়েছে তাদের মাঝে। ৪ সিড়ি নামার পর হুট করেই দাঁড়িয়ে গেল সিফাত। ঘাঁড় ঘুরিয়ে একবার দেখলো পলকে। সিফাতের দাঁড়িয়ে পড়া দেখে সেও ২য় সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে গেল। সিফাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সিফাত পকেটে হাত দিয়ে কি যেন বের করছে। কয়েক সেকেন্ড গড়াতেই সিফাত তার মোবাইল ফোনটা বের করে অন করলো। সেটা দেখে পলক ভাবলো অন্ধকার হওয়ায় হয় তো ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করবে বলেই ফোন বের করেছে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সিফাত ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিলো। পলককে কোন প্রশ্ন করতে না দিয়ে সে নিজেই বললো।

_আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা আর সোশ্যাল মিডিয়ার আইডিগুলো…লাইক ফেইসবুক, হোয়াটস অ্যাপ,ইমেল এসব সেভ করে দিন। ঝটপট। বাসায় গেলে আর সুযোগ পাওয়া যাবে না।

এবার যেন পলক অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সিফাতের এইমাত্র বলা কথাগুলো একদম সহজ ভাষায় হুকুমের মত শোনাল তার কাছে। মনে মনে বলেই ফেললো,
_ইশ..কি লোক রে বাবা! কেমন হুকুম করছে দেখো। এএএএহহহহ…আমি যেন তার সেবাদাসী যে তার সব কথা হুকুমের মত পালন করতে বাধ্য আমি! মনে মনে এসব বললেও বাইরে তার কিছুই প্রকাশ পেলো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে” বার দুয়েক একবার সিফাতের দিকে আরেকবার ফোনের দিকে চাইলো সে। কিন্তু না কিছু বললো আর না ফোনটা হাতে নিল। পলকের এমন নির্বিকার ভাব দেখে এবার বেশ বিরক্ত হলো সিফাত।কিছুটা কড়া গলায় বললো,
_কি হলো নিন ফোনটা। ঝটপট হাত চালান।সব সময় সব কাজে এত স্লো হলে চলে নাকি। বাসায় যেতে হবে তো নাকি? সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

সিফাতের এমন গমগমে গলায় বলা সহজ কথাগুলো তথা ঝাড়ি যেন ম্যাজিকের মত কাজ করলো। পলক এক ঝটকায় ফোনটা হাতে নিয়ে ঝটপট টাইপ করতে লাগলো। মিনিট দুই পরে ফোনটা বাড়িয়ে দিল সিফাতের দিকে। ফোনটা নিয়ে এক নজর দেখলো স্ক্রিনের দিকে। তারপ্র ভ্রুকুটি কুচকে উপরের ঠোঁটের ভাঁজে নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরে কি যেন ভাবলো। সিড়ির দিকটা আবছায়া আঁধার হওয়ায় স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল না কিছু। কিন্তু এরমাঝেই পলক তাকিয়ে রইলো সামনের মানুষটার দিকে। কি যেন ভাবছে সে মনোযোগ দিয়ে। তার এই ভাবনা বিভোর মুখখানা বেশ লাগলো পলকের কাছে। মৃদু হাসলো সে আপনমনেই। কিন্তু সে হাসি মেঘের ফাঁকে খনিকের উঁকি দেয়া রোদের মতই মিলিয়ে গেল নিমিষেই।

_হুমমম…আইডির নাম তাহলে মেঘ বন্দী আলো।এই জন্যই বায়োডেটার নাম দিয়ে এতবার করে সার্চ করেও খুঁজে পাইনি। বাহ! আইডির নামটাও তো দেখছি বেশ রেয়ার। এই নামে একটাই আইডি সারা দুনিয়ায়। কথাগুলো ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বলছিল সিফাত। কন্টাক্ট ডিটেলইস দেখে ফেইসবুকে গিয়ে আইডি সার্চ দিয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টও পাঠিয়ে দিল। কথা শেষ করে এবার চোখ তুলে চাইলো পলকের মুখের দিকে। কিন্তু একদম উপরের দিকের সিড়িতে হওয়ায় কম আলোতে ভালোভাবে দেখা গেল না তাকে।

সিফাতের দৃষ্টিতে ঠিক কি ছিল বুঝে উঠতে পারলো না পলক।চেয়েও থাকা যাচ্ছিল না সেই দৃষ্টি পানে। তাই পরিস্থিতি সামলে নিতেই সে বললো,
_এবার দেরি হচ্ছে না? আমাকে তাড়া দিয়ে নিজেই তো এখন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তা বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে কি আছে নাকি এখানেই থেকে যাওয়ার প্ল্যান করছেন?

পলকের এহেন ধাঁচের কথায় কিছুটা ভড়কে গেল সিফাত। গলা ঝেড়ে সামনের দিকে ফিরলো। নামে যেতে যেতেই পলকের উদ্দেশ্যে বললো,মিসডকল গেছে আমার নাম্বার থেকে,,ঘরে গিয়ে সেভ করে নিবেন। রাতে কল দিবো আমি। রিসিভ করতে যেন ভুল না হয়। কথা গুলো বলতে বলতে হন হন করে নেমে বাসার ভেতরে চলে গেল সে। আর পলক আরও একবার পলক ফেলতে ভুলে গিয়ে ব্যাক্কলের মত সিফাতের চলে যাওয়া দেখলো সিড়িতে দাঁড়িয়েই।

_________________________________

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পলক। আজ বহুকাল পরে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। বিকেলে সিফাতরা চলে যাওয়ার পর ঘরে এসেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। মনে অনেক প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আজকের বিকেলের ঘটনাটা নিয়ে। লোকটা কি সব বলে গেল তাকে। কিসের জোরে সে এভাবে একজন অপরিচিত মেয়েকে এতসব কথা বলে গেল। কিসের এত অধিকারবোধ তার! প্রশ্নগুলোর সঠিক কোন উত্তর খুঁজে পায় না পলক। এসবের উত্তর যে কেবল ঐ মানুষটাই দিতে পারে।

শেষ কবে এভাবে নিজেকে ভালো করে দেখেছে মনে পড়ে না তার। কারণ, তার না আছে দেখার মত রূপ আর না আছে রঙ। তবে সেসব নিয়ে তার কোনকালে আফসোস না থাকলেও যেদিন থেকে সমাজের দৃষ্টি, মূল্যায়নের বাস্তব ধরণ বুঝতে শিখেছে একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছে সেসবের তোয়াক্কা করা। এখন কে কি বললো সেটাও কানে তুলে না। তুলেই বা কি লাভ, এমন রূপ রঙ তো আর সে যেচে নিজের করে নেইনি। সৃষ্টিকর্তা তাকে যে রূপে চেয়েছেন তাতেই গড়েছেন। তার সৃষ্টির গড়ন নিয়ে আফসোস করার প্রশ্নই আসেনা। তো লোকের কথায় কি আর মনে করবে। সে যেমন তেমনই নিজেকে পছন্দ করে। অন্য কেউ করলো কি করলো না সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু আজকে কিছুটা ভিন্ন ব্যাপার ঘটেছে। লোকটা তাকে বিয়ে করতে চাইছে। কিন্তু কেন? লোকটা..উউউউমমম,,কি যেন নাম তার! ও..হ্যাঁ,সিফাত। সুন্দর নাম। মানুষটা দেখতেও তো মাশাল্লাহ সুন্দর। বলতে গেলে গড়নে গঠনে মায়ের ভাষায় তো রাজপুত্র একেবারে। আর সেই রাজপুত্রের মত মানুষটা কি না তার মত শ্যামলা সাদামাটা মেয়েকে পছন্দ করলো? কেন?করুণা করছে? নাকি কেবল বাবার উপকারের প্রতিদান এসব?! নেই…কোন উত্তর জানা নেই তার।

এক এক করে বিকেলের ছাদের ঘটনাগুলো খন্ড খন্ড হয়ে ভেসে উঠতে লাগলো পলকের মস্তিষ্কে। খানিক বিস্ময়,কিছু অসম্পূর্ণ রয়ে যাওয়া কথার চিন্তা, অস্বস্তি,নানান প্রশ্নের ভিড়,আর কিছুটা নতুন ভালো লাগা অনুভূতির আনাগোনায় একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার। আয়নায় শেষবারের মত একনজর নিজেকে দেখে মৃদু হাসলো সে। তবে এ হাসি আনন্দের নাকি তাচ্ছিল্যের বোঝা গেল না।

________________________________

_এই নিয়ে ৫ বার কল করলাম কিন্তু ভুলেও একটাবার রিসিভ করার সময় হলো না ম্যাডামের। কি করছেটা কি? ‘কিছুটা রাগ আর অস্থিরতা নিয়ে সারারুমে পায়চারি করছে সিফাত। একের পর এক কল করে যাচ্ছে পলকের নাম্বারে। কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না বলে মেজাজ খিঁচে আছে সিফাতের।

_আরেএএএএ….রিল্যাক্স ব্রো। এত অস্থির হওয়ার কি আছে! হয় তো ব্যস্ত আছে কোন কাজে। নয় তো ফোন কাছে নেই। আর এখন ঘড়ি দেখ..রাত ১১:৩০ টা বাজে। ঘুমিয়ে গেছে হয় তো। পরে কথা বলে নিস না হয়।

_কিসের ঘুম? কিসের ব্যস্ততা, হ্যাঁ? আমি তো বলে এসছিলাম যে রাতে কল দিবো। রিসিভ যেন করে। তো সে কথা কি চিলেকোঠার ঘরেই ফেলে চলে এসছে? কেন রিসিভ করছে না সে..হাউ কুড বি সি সো ইরেসপন্সিবল!!!

_বাপ রেএএএ..এত রাগ? একবেলার পরিচয়েই এতদূর? ক্যায়া বাত হে ভাই!! বাট এখন..এদিকে আয় তুই, শান্ত হয়ে বস তো একটু। আর এত অস্থির হওয়ারই বা কি আছে বল তো…তোর মত ছেলের বেলায় এটা যে এটমবোম পড়ে দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার থেকেও ভয়ংকর ব্যাপার এটা তুই বুঝতে পারছিস? সিরিয়াসলি ব্রো!আই জাস্ট কান্ট বিলিভ দিস। ইভেন আই কান্ট ইমাজিন যে তুই.. ব্রো তুইইই…এত বছরের লাইফে যে কিনা একটা মেয়ের দিকে একবার ছেড়ে দুবার ফিরে দেখলো না, সেই মি.সাফওয়ান সিফাত..আজ এমন একটা মেয়ের জন্য অস্থির হচ্ছে। ওয়াও..ও গড..এইদিনও আমার দেখার ছিল!!

_আহ, রিহান..থামবি তুই? কি সব বলে যাচ্ছিস তখন থেকে। দেখছিস তো একে তো সে ফোন তুলছে না,আর তুই কিনা কন্টিনিউয়াসলি কি সব বকবক করে যাচ্ছিস। আর হ্যাঁ,,এমন একটা মেয়ে কি রে? কি মিন করছিস তুই? তোর ভাবী হবে কদিন পরে.. সম্মান দিয়ে কথা বল তার সম্পর্কে।

একে তো পলক ফোন তুলছে না পলক। তারওপর রিহানের এমন কথাবার্তায় মেজাজ যেন আরও বিগড়ে গেল সিফাতের। এমনিতে বেশ ঠান্ডা মেজাজের মানুষ হলেও নিজের কাজ বা চাওয়া ঠিকঠাক না হলে সে মেজাজ বিগড়াতেও সময় লাগে না। যদিও সেটা প্রত্যেক্ষভাবে অন্যের ওপর খুব কমই প্রকাশ করে। তবুও, নিজের কিছু কিছু বিষয়ে বেশ সেনসেটিভ সে। তাই এই মূহুর্তে রিফাতের কথার রিয়্যাকশন হিসেবে এই ঝাড়িটা বেচারার কপালে জুটলো আর কি।

_আচ্ছা..আচ্ছা…স্যরি ব্রো। আর বলবো না ওভাবে। বাট ইউ জাস্ট সীট হিয়ার এন্ড রিল্যাক্স।

_হুম

রিহানের কথায় কিছুটা শান্ত হয়ে ওর পাশেই বিছানায় বসে পড়লো সে। রিল্যাক্স হওয়ার জন্য মাথাটা নিচু গভীরভাবে শ্বাস নিলো বার কয়েক।

_আচ্ছা,তুমি কি সত্যি সত্যি ডিসাইড করে নিয়েছো যে উনাকেই বিয়ে করবে?আই মিন আরও তো মেয়ে আছে.. চাইলে একবার মিট করে নিতে পা…

রিহানের কথাটা আর শেষ করা হলো না..তার আগেই সিফাত এমন ভাব নিয়ে তার দিকে তাকালো যেন সে যা বলতে যাচ্ছিল তার মত ভুল কথা আর কিছুই হতে পারে না। এর সাজা সোজা মৃত্যুদন্ড। তাই শেষ যে দুটো অক্ষর মুখের কাছে এসেছিল সেগুলোকে সে একটা শুকনো ঢুকে আবার গিলে ফেললো। আর ক্যাবলাকান্তের মত একটা হাসি দিয়ে চুপ করে গেল।

সিফাতের এই মূহুর্তে মেজাজ খুব বিশ্রীভাবে খিঁচে আছে। তবুও সে নিজেকে সামলে খুব শান্তস্বরে বললো,
_হ্যাঁ। আমি ওকেই বিয়ে করবো। কারণ আমার জন্য ওর থেকে পার্ফেক্ট কেউ আর হবে না। আমি এতদিন নিজের জন্য যেমন মেয়েকে এক্সপেক্ট করেছি,সে একদম তেমন না হলেও অনেকটাই কাছাকাছি। আর বাকিটা আমি নিজে গড়ে নিবো। সো,এটা নিয়ে যেন আর কোন কথা না হয়। আন্ডারস্যান্ড?

_ওকে, ব্রো। আই গট ইট। এনওয়ে,,কংগ্রাচুলেশনস ব্রো। ফাইনালি ইউ গট ইউর লেডি। ‘বলেই জড়িয়ে ধরলো সিফাতকে।

সিফাতও সব ভুলে আগলে নিলো তার প্রিয় ভাইটাকে।

আদতে সিফাতের কাজিন, বন্ধু অনেক থাকলেও সবচেয়ে প্রিয় আর কাছের তার এই ভাইটাই। বছর ৫ এর তফাৎ দুজনের।সম্পর্কে ছোট খালাতো ভাই হলেও বন্ডিংটা একদম বন্ধু আর নিজের ভাইয়ের মত স্ট্রং এন্ড পিওর।

রিহানকে ছেড়ে আরও একবার ফোনের দিকে চাইলো সে। নয়টা মিসডকল। কিন্তুরেসপন্স। এবার রাগ ছেড়ে হতাশ ভঙ্গিতে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো বিছানার এক কোণায়। বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেল ব্যালকনিতে। এখন তার এই সময়টা,এই মন খারাপ,রাগ কিংবা হতাশা যাই হোক না কেন..সেটা কাটানোর একমাত্র উপায় আকাশের গভীরতায় বিলীন হওয়া।

যাওয়ার আগে রিহানকে তার রুমে চলে যেতে বলে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা হাতে তুলে নিল সিফাত।

বেলকনির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো সে।সিগারেট জ্বেলে লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়ার বেশে হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো এই মূহুর্তের তার সব অনুভূতি।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_৩
©জারিন তামান্না

‘হ্যাঁ রে,সাজি…কেমন দেখলি ছেলেটাকে? আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে। কি সুন্দর ব্যবহার! মুখখানা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনটাও খুব ভালো মনে হয়। তুই তো কথাও বললি,কেমন লাগলো তোর?’ বিছানায় বসে পলকের মাথায় তেল ঘঁষে দিতে দিতে কথাগুলো বলছিলেন তার মা মিসেস শাহনাজ বানু।অন্য সবাই তাকে পলক নামে ডাকলেও তিনি সাজি নামেই ডাকেন।

মেয়ের কোন সায় শব্দ না পেয়ে এবার কিছুটা বিচলিত হয়ে তেল দেওয়া থামিয়ে দিলেন। সামনে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাকে।মেয়েকে অন্যমনস্ক দেখে কাঁধে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন।
_এইই সাজি…কি রে! কি ভাবছিস এভাবে? ছেলেকে তোর পছন্দ হয়নি?

মায়ের কথায় ধ্যান ভাংলো পলকের। একটা বিদ্রুপের হাসি হেসে বললো, হাহ্….আমার আবার পছন্দ অপছন্দ! তুলেই তো দিচ্ছিলে এইট পাশ ছেলের হাতে। কপালে ছিলনা বিধায়.. তাই তখন যখন পছন্দ অপছন্দের কথা জিজ্ঞেস করোনি, ভাবোনি তো এখন আর এসব জেনে কি করবে!

মেয়ের কথা শুনে মূহুর্তেই মুখটা কালো হয়ে গেল শাহনাজ বানুর।খারাপ লাগলেও এই সত্যি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার জো নেই তার। কিন্তু তিনিই বা কি করতেন স্বামীর মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। তাই তো মেয়েটার প্রতি অন্যায় জেনেও ওমন একটা ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। মেয়েটা হাতে পায়ে অবদি ধরেছিল তার। খুব কেঁদেছিল।কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারেননি মেয়েটার জন্য শুধু নিরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া। একটা নিদারুণ অপরাধবোধে ভরপুর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। নিজেকে সামলে কিছুটা অপরাধী সুরেই বললে,আমার তো তখন কিছুই করার ছিল না রে..জানিস তো তুই সব। তোর বাবা..
_হ্যাঁ,তার কথাই তো সব তোমার কাছে। সেটা তো আমরা চার ভাই বোন খুব ভালো করেই জানি।
_কিন্তু এবারের ছেলেটা কিন্তু সত্যিই ভালো রে সাজি। আর সে নিজে থেকেই তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে। পরিবারের সবাইও বেশ ভালো মনে হলো।বোন দুটোরও তো বিয়ে হয়ে গেছে। ননদ ননাসের ঝামেলাও নেই কোন। তাছাড়া তাদের তোকে পছন্দ হয়েছে বলেই তো বলেছে। আজ তো বলেও গেলো ছেলের সাথে কথা বলে বিয়ের ডেট ফাইনাল করে জানাবে। পাইলট ছেলে,দেখতেও মাশাল্লাহ। এমন ছেলে তোর ভাগ্যে ছিল বলেই সেদিন বিয়েটা হতে গিয়েও হলো না।এই জন্যই বলে, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। শুকরিয়া কর তাঁর।

পলকের মুখে কোন কথা নেই। চুপচাপ বসে আছে সে।কি-ই বা বলবে সে। সত্যিই কি এটাই তার ভ্যগ্য? এই মানুষটার জন্যই কি তার জন্ম?
এসব ভাবনার ফাঁকে হঠাৎই আরেকটা বিষয় উঁকি দিল তার মাথায়। মনে পড়ে গেল বিকেলের কথা।লোকটা যে বললো,তার (পলকের) কোন অতীত নেই বলেই সে জানে। তবে কি সে সত্যিই কিছুই জানে না? কিছু জানে না বলেই কি বিয়ে করতে রাজি হয়েছে?!

চটকরে ঘাঁড় ঘুরিয়ে সে তার মাকে প্রশ্ন করলো,,’আচ্ছা মা,উনারা কি আমার অতীত সম্পর্কে জানে?বলেছো তাদের সব?!’

পলকের চোখে প্রশ্ন আর উৎকণ্ঠা। কিন্তু শাহনাজ বানু নিশ্চুপ। মেয়ের প্রশ্নের সত্যি উত্তর দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। আবার মেয়েটাকে মিথ্যা বলতেও তার বিবেকে বাঁধছে। তাই কিছু না বলে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলেন তিনি।

মায়ের এমন লুকাতে চাওয়া দৃষ্টি আর নিরবতা বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিল পলককে তার প্রশ্নের উত্তরটা। একটা ক্লান্তির শ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো মায়ের থেকে।
বসা থেকে উঠে যেতে যেতে বললো,,তবে এবারের বিয়ের আশাটাও ছেড়ে দাও তোমরা। সত্যি জানার পরে এই ছেলেও বিয়ে করবে না তোমার সস্তা মত মেয়েটাকে।

তোর কি এবারেও সর্বনাশটা না করলেই নয়? আমরা তো আর কোন মিথ্যা বলিনি তাদের। (শাহনাজ)

মিথ্যা বলনি কিন্তু সত্যিটা লুকিয়েছ। আর সত্যি লুকানো মিথ্যার থেকেও ভয়ংকর।তাছাড়া নিজের স্বার্থে অন্যকারো সাথে প্রতারণা করা, তার জীবন খারাপ করার মত এতটাও স্বার্থপর তোমাদের মেয়েটা হতে পারেনি এখনো। কথাগুলো বলেই গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

আর তেল চিটচিটে হাতে বিছানাতেই বসে রইলেন শাহনাজ বানু। মুখে অনাগত ভবিষ্যতের চিন্তার ছাপ।

_________________________________

ঘরে এসে চুল আঁচড়ে বেণী করে নিল পলক। নিজেকে একনজর দেখলো আয়নায়।চোখগুলো কেমন লালচে লাগছে। যেন মরিচছোঁয়া লেগেছে তাতে। কিন্তু সে তো জানে এটা তার ভেতরকার গোমট ভাবটার বাহ্যিক রূপ। কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে তার। কান্না করতে পারলে ভালো হতো। নিজের এহেন ভাবনায় বেশ অবাক হলো সে নিজেই। কাঁদবে?কিন্তু কেন? এটা তো নতুন কিছু নয় তার কাছে। এর আগেও তো কয়েকদফায় এমন ঘটনার সম্মুখিন হয়েছে সে। এখন তো বেশ শক্তপোক্ত মন হয়ে গেছে তার। তাহলে এবারেও একই ঘটনা ঘটবে জেনেও কেন এমন হচ্ছে তার! খারাপ লাগছে কি? কিন্তু কেন? তবে কি তার নিজের অজান্তেই মন কোন ভালো কিছুর আশা করেছিল?!এতবড় স্পর্ধা মনের!তার অজান্তেই সে এতকিছু ভেবে নিয়েছে! নাহ..এমন কিছুই না। নিজের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে তার। মনের আশকারায় ভেসে যাওয়ার মেয়ে এখন আর সে নেই।

নিজেকে নিজেই প্রবোধ দিল সে। অতঃপর এতসব ভাবনার জাল থেকে বেরিয়ে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ালো । চোখ জ্বালা করছে ভীষণ। চোখ মুখে পানি দেওয়া দরকার।

_________________________________

বিছানা পরিপাটি করে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল পলক। বেড সাইডের টেবিলের উপর ফোনটা নজরে পড়লো তার। মিসডকল নোটিফিকেশনের গ্রীন লাইট জ্বলছে। ফোনটা হাতে নিয়ে অন করতেই চোখ তার চড়াক গাছ। মোট ১১ টা মিসডকল। তার মধ্যে ১০ টা কলই এসেছে একটা আননোন নাম্বার থেকে। আর বাকি একটা তার ফ্রেন্ড রুবির। কললিস্ট চেক করে দেখলো আননোন নাম্বারটা থেকে বিকালে একবার কল এসেছিল। এরপরের গুলো সব রাতে।এবার পলকের মাথার পোকা নড়লো।এবং সেটা বেশ জোরে সোড়েই নড়লো। ফট করেই মনে পড়ে গেল সিফাতের কথা। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলেছিল তার ফোন থেকে মিসডকল গেছে।নাম্বার সেভ করতে বলেছিল। রাতে কল দেবে এও বলেছিল। কিন্তু পলক..সে তো সেই যে দুপুরে রুবির সাথে কথা বলে ফোনটা সাইলেন্ট করে টেবিলের উপর রেখে গেছিল আর ধরেইনি সেটা। নাম্বারটাও সেভ করা হয়নি। আর এতক্ষণ মায়ের ঘরে ছিল বলে সিফাত এতবার কল করেও পায়নি তাকে। সিফাতের কথা মনে হতেই মৃদু শিহরণ বয়ে গেলে পলকের শরীর জুড়ে। সে নিজেও বেশ অবাক হলো এতে। মৃদু বেগে হার্টবিট বেড়ে গেল।কেমন যেন একটা অনুভূতি।অনেকটা হৃদপিন্ড ধরে অনবরত খাঁমচে দেওয়ার মত। ঠিক যেমন সেই সময়গুলোতে হতো যখন…।

নাহ! আর বেশি কিছু ভাবতে পারলো সে। এই অতীতকে সে নিজের মাঝেই দাফন করে নিয়েছে বহু আগেই। মাঝে বেশ ক’টা বছরও পেরিয়ে গেছে। নতুন করে সেসব মনে করার কোন মানে নেই। সে নিজেও মুভ অন করে নিয়েছে। অযথা এসব ভাববে না আর।একদমই ভাববে না। নিজেই নিজেকে বোঝালো সে। কিন্তু সিফাতের বেলায় কেন এমন হচ্ছে…মাত্র একবেলার পরিচয় তার মানুষটার সাথে..সেটাও খুব বিশেষ কিছু নয়। আবার একেবারে সাধারণও নয়। মাঝ বরাবর কিছু একটা। তবে এটাকে পাত্তা না দিয়ে এবার ফোনের স্ক্রীনে সময় দেখে নিলো। ১১:৪৯ বাজে। এত রাতে কলব্যাক করবে কি করবে না এই নিয়ে বেশ দোটানায় পড়লো সে। ভাবলো মানুষটা এতবার করে কল দিলো, জরুরি কিছু বলার ছিল কি? একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবো? এতরাতে কলব্যাক করবো,যদি ঘুমিয়ে যায় তো? নাহ,লাস্ট মিডসকল দেখাচ্ছে ১১:২৭ মিনিটে। খুব বেশি সময় তো হয়নি। একবার ফোন দিয়েই দেখি। রিসিভ করলে তো করলোই নইলে নাই।

এইসব ভাবতে ভাবতেই ডায়াল করলো সিফাতের নাম্বারে। রিং হচ্ছে…কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না।তবে কি ঘুমিয়ে গেল মানুষটা?!
________________________________

রিং হয়ে কেটে যাবে ঠিক সেই মূহুর্তে কলটা রিসিভ হলো। ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশ আর নিকোটিনের ধোঁয়ায় বুদ হয়ে ছিল সিফাত। হঠাৎই কানে এলো ফোনের রিংটোনটা। কিন্তু সে নড়লো না সেখান থেকে। এক অবাধ্য অভিমান আটকে দিল তাকে। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে ফোন বেজে চলেছে।স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। তারপর যেন কি ভেবে পা বাড়ালো রুমে। বিছানার এককোণে নিরিহভাবে পড়ে থাকা মোবাইলটার আলো জ্বলছে।কোনরকম তাড়াহুড়ো ছাড়াই সিফাত হাতে নিল ফোনটাকে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে…Mrinmoyi calling. পলকের নামটা সে মৃন্ময়ী দিয়েই সেভ করেছে। তার মৃণ্ময়ী! আর ফটোতে আজকে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় একটা ছবি। মাথায় গাঢ় সবুজ রঙের ওড়না দেওয়া। মাঝবরাবর করা লম্বা সিঁথির থেকে সামনের কিছু চুল বেরিয়ে আছে। বোচা নাকে ছোট্ট একটা সোনার নাকফুল।মুখে হালকা রোদ পড়ায় চিকচিক করছিল।যেন ভিজে মাটিতে একফালি সোনা রোদ্দুর।সামনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। দৃষ্টি অনির্দিষ্ট কোথাও। ঠিক তখনই বা’পাশ থেকে থেকে টুক করে একটা ছবি তুলে নিয়েছিল সিফাত। পলক টেরও পায়নি এসবের কিছুই। যদিও এটা একপ্রকার অন্যায় কিন্তু সে যেন এই মূহুর্তটুকুর, সেই অদূরের দৃষ্টি ফেলা অন্যমনস্ক চাহনীর মানবীটিকে স্মৃতিপটে বন্দী করার লোভটুকু সামলে নিতে পারেনি। কিসের যেন একটা অদৃশ্য অধিকারবোধও জেগে উঠেছিল তার। যেন অধিকারটুকু তার পিঠ চাপড়ে বলছে,,আরেএএ ব্যাটা..এতো তোরই। একটা ছবিতে কিছু হবে না। তুলে নে। মন মস্তিষ্কের সাপোর্ট পেয়ে এই অন্যায়টুকু করতেও আর বাঁধলো না তার।

ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে আছে সিফাত। রিং বেজেই চলেছে। কলটা দেখে সে খুশি হলো কিনা বোঝা গেল না।ভাব সাব নির্জীব। শেষমেষ কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ঠেকিয়ে চুপ করে রইলো।
____________________________________________

আর এদিকে বেশ কিছু সময় পরেও ফোনের ওপার থেকে কোন সাড়া পাওয়া না যাওয়ায় পলক ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে স্ক্রীনে চেক করলো। কল রিসিভ হয়েছে ৩৩ সেকেন্ড রানিং। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না অপর পাশ থেকে। এবার সে নিজে থেকেই সালাম দিল।

_আসসালামু আলাইকুম।
——
_হ্যালো?
——
নাহ এবার সত্যিই বাড়াবাড়ি হচ্ছে। কল রিসিভ করে চুপ করে থাকার মানে কি? আচ্ছা,কলটা কি উনি না করে অন্য কেউ রিসিভ করেছে…তাই জন্য কথা বলছে না!

ধুর.. ভাল্লাগে না। কি একটা ফাইজলামি। না বলুক কথা। আমিও আর কিছু বলবো না। এই বলেই কলটা কেটে দিল সে।

আর ওদিকে কলটা কেটে যাওয়ার পরেও ফোনটা কানে কাছেই ধরে রইলো সিফাত। কি যেন এক অবাধ্য অভিমান ভর করেছে আজ তাকে। এ অভিমান তার মৃন্ময়ীর প্রতি নাকি নিজের অনিয়ন্ত্রিত আবেগের জানে না সে। জানার ইচ্ছেটাও হচ্ছে না তার।

খানিকবাদে ফোনটা নামিয়ে এনে তাকিয়ে রইলো স্ক্রীনে ভেসে ওটা নামটা আর ছবির দিকে। চকিতেই সে ডায়াল করলো সেই নাম্বারে।পলক ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। তাই একবার রিং হতেই রিসিভ করলো কলটা। কিন্তু এবার সেও চুপ করে রইলো। তবে ওপাশ থেকে সিফাত বিলম্ব না করেই ‘হ্যালো’ বললো।

সিফাতের কন্ঠ শুনে একরকম ঝটকা খেলো পলক। কি ভরাট অথচ শান্ত সে কণ্ঠস্বর! সিফাত আবারো বললো,

_হ্যালো,মৃন্ময়ী?

এবার পলকের হুঁশ হলো। তড়িঘড়ি করে সালাম জানালো।
_আসসালামু আলাইকুম, পলক বলছিলাম।

_ওয়ালাইকুম আসসালাম।হ্যাঁ, জানি আমি। বলুন।

এবার দুপাশেই খানিক নিরবতা। পলক ঠিক কি বলবে ভেবে না পেয়ে প্রশ্ন করলো।
_এতবার কল করেছিলেন…কোন দরকার ছিল কি?
সিফাতের আবারও মেজাজ খিঁচে গেল পলকের কথা শুনে। কিছুটা গমগমে স্বরেই বললো,

_দরকার ছিল না কিছু।কিন্তু আপনি বোধয় খুব ব্যস্ত মানুষ। তাই এতবার করে কল করেও পাওয়া যায় না আপনাকে।

সিফাতের এমন ধাঁচের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল পলক। এই লোকটা তাকে খোঁচা মেরে কথা বলছে!

মূহুর্তেই আবার তার রাগ হলো। কেন মানুষটা তাকে খোঁচা মেরে কথা বলবে? সে তো আর ইচ্ছে করে কল রিসিভ না করে বসে ছিল না। ফোনটা কাছে ছিল না। সাইলেন্ট থাকায় শুনতে পায়নি সে। এখন এটা কি তার অপরাধ হয়ে গেল??

পলকে চুপ থাকতে দেখে সিফাতও এবার বেশ রাগ হলো। মনে মনে বললো, ‘এই মেয়েটা এমন কেন! একে তো তখন এত করে কল করার পরেও রিসিভ করলো না আর এখন রিসিভ করেও চুপ করে আছে।

_প্রতিশোধ নিচ্ছেন?’ সিফাতের এমন কথায় হকচকিয়ে গেল পলক। নিজেকে সামলে সেও পাল্টা প্রশ্ন করলো,
_এটা আবার কেমন কথা! আমি কিসের প্রতিশোধ নিব?আপনার সাথে আমার কোন জন্মের শত্রুতা ভাই,শুনি?

পলকের মুখে ভাই শব্দটা শুনেই সিফাত চেঁচিয়ে উঠলো।

_এইইই….ভাই কাকে বলতেছো? আমি তোমার কোন জন্মের কোন ক্যাটাগরির ভাই হই, হ্যাঁ??খবরদার আর কখনো ভাই বলবা না আমাকে। আমি বাদে তামাম দুনিয়ার যত ছেলে আছে তাদের ভাই বলো। যত খুশি ভাই বানাও।সারা দুনিয়ার ছেলেরা আমার শালা হলেও সমস্যা নাই।কিন্তু আমাকে ওটার আউট অফ লিস্ট রাখবা। আমি তোমার অন্য লিস্টের বিশেষ ক্যাটাগরির অনলি ওয়ান পার্সোন। ওখানে আর কারো জায়গা হবে না।আমিই ফার্স্ট আমিই লাস্ট। পুরো লিস্টটাই হবে কেবল আমার নামে। গট ইট?!

এবারে পলক পুরোদমে হতভম্ব, বিস্মিত!সামান্য ভাই বলাতে সিফাতের এমন কড়া ডোজের লেকচার তার কপালে ছিল ভাবতেই মাথা চক্কর দেয় দেয় অবস্থা। কানে ফোনটা ধরেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো সে সামনের দিকে।

পলকের কোন সাড়া না পেয়ে সিফাত আরও চড়া গলায় বললো,,’কি হলো বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?

এবার সামান্য কেঁপে উঠলো পলক।বোকার মত তাড়াতাড়ি করে জোরে জোরে মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোঝালো। আরেকটু হলেই মাথা খুলে আসার উপক্রম হয়ে যাবে এমন।কিন্তু অডিও কলে ফোনের ওপারে সেটা সিফাত দেখলো না। তাই, আবার চেঁচালো।

_এই মেয়ে কি হলো….ভোকাল কর্ডে কি জ্যাম লাগছে তোমার? নাকি বোবা হয়ে গেছে একেবারে?

এবারের ঝাঁড়িতে পুরোপুরি হুঁশে ফিরলো পলক। কিছুটা তোলানো স্বরে বললো,
_ হ্যাঁ..? হ্যাঁ..বুঝেছি।

ফোনের ওপাশে মুচকি হাসলো সিফাত। মুখে বললো,’গুড।’

চলবে…