এল এ ডেইস পর্ব-১৬+১৭

0
167

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ১৬
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

‘না, না, না, না, না! উচ্চস্বরে বলল সাইলোহ।
মাহীন অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘প্লিজ। এই একটা মাত্র ফেভার চাচ্ছি।’
‘আচ্ছা দেখো আমি রাজি। আর সাইলোর ব্যাপারটা তুমিই সামলাও।’ টেবিলের ওপর উঠে বসে নির্বিকার চিত্তে বলল নায়েল।
মাহীন সাইলোহ ও নায়েলের সঙ্গে ক্লাসে বসে কথা বলছে। প্রচুর চিৎকার চেচামেচির শব্দ চারিদিকে। ঘন্টা মাত্র পরেছে পরের ক্লাসের জন্য। যেকোনো সময় স্যার ক্লাসে আসবেন। খোলা জানালা দিয়ে পরিষ্কার সুবিস্তীর্ণ নীল আকাশ চোখে পরে। বেশ কিছু ছেলে মেয়েরা এক ডজন কাগজ মুড়িয়ে বল বানিয়ে ছোড়াছুড়ি করছে। মাহীনের টেবিলে এসে একটা পরল। সাইলোহ বলল,
‘দেখো মাহীন তুমি যেটার কথা বলছো ওটা আমার স্বপ্নেরও অতীত। কিছুতেই এটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।’

মাহীন বলল,’না, না দেখো নায়েলও তো তোমার সাথেই থাকবে তুমি তো আর একা নও। এবং আমি তোমাদের ফ্রেন্ড হওয়ার পর কিন্তু এখন পর্যন্ত এটাই ফার্স্ট কোনো ফেভার চাচ্ছি।’

নায়েল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,’সাইলোহ রাজি হয়ে যাও না। এত খিটখিট করো কেন?’

সাইলোহ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল। তারপর বললো,
‘না তবুও না। তোমরা তো জানো আমার ওকে ভালোই লাগে না। সেখানে এমন একটা কাজ। ওফ কি মুশকিল!’

মাহীন অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকায়। সাইলোহ ওর মুখ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইতস্তত করে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু এটাই এমন কোনো কাজের জন্য লাস্ট। এরপর এসবের জন্য কিন্তু আর কিছু করবো না।’

মাহীন বলল,’ঠিক আছে। এমনিতেও এটাই লাস্ট স্টেপ আমার।’ তারপর একটু থেমে বলল,’অল দ্যা বেস্ট গাইজ। কোনো গন্ডগোল করো না আবার।’

নায়েল বলল,’ওকেই ডোন্ট..’

ওর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ক্লাসে স্যার ওয়ামস্লি প্রবেশ করলেন। নায়েল লাফ দিয়ে বেঞ্চ থেকে নামল। এখন জিওগ্রাফি ক্লাস। যেটা সাইলোহ ও মাহীনের একসাথে পরেছে। কিন্তু নায়েলের এখন ম্যাথ ক্লাস। ফলে সে এখান থেকে কিভাবে বের হবে তাই কূল কিনারা করতে ব্যস্ত এখন।
.
.
.
টেবিলে বেশ কিছু বই খাতা গুছিয়ে রাখা আছে। রায়েদ সেগুলো নিজের ব্যাগে অতি যত্নের সঙ্গে ঢুকিয়ে রাখছে। নায়েল ও সাইলোহ এসে দুজন টেবিলের সামনে দাঁড়াল তবে রায়েদ একবারও মুখ তুলেও চাইল না। গম্ভীর মুখে নিজের কাজই এক মনে করে যাচ্ছে। নায়েল হালকা ভাবে গলা খাঁকারি দিল। কিন্তু তবুও রায়েদ ভ্রুক্ষেপহীন। নায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো,

‘রায়েদ আমরা তোমার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি। আশা করি তুমি এতটুকু সময় দিতে পারবা।’

ব্যাগ গুছানো শেষে ও উঠে দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে উত্তর দিলো ‘পারবো না।’

সাইলোহ কিছুটা তিক্ত কন্ঠে বলল, ‘দেখো তুমি, মাহীন বলেছে বলে আমরা এসেছি। নাহলে আমাদেরও এখানে আসার কোনো ইচ্ছে…’

নায়েল ওর হাতে গুঁতা দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল। তারপর নিজে বলল, ‘দেখো আসলে সামনে পিকনিক জানোই তো। যদিও আমরা জানি তুমি কখনো পিকনিক জয়েন করো না। তবুও আমরা তোমাকে ইনভাইট করতে এসেছি মাহীনের তরফ থেকে।’

রায়েদের কথাটা শুনে এক তিক্ত অনুভূতি হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনের জানালার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বলল,

‘ওহ, মাহীন তোমাদের পাঠিয়েছে? এতটুকু নরম কন্ঠে বলল। তারপর তিক্ত কন্ঠে বললো, ‘আমি বুঝলাম না তোমরা কি ভেবে আর কি এক্সপেক্ট করে এখানে এসেছো। কিন্তু তোমরা আমার উত্তর জানো।’ বলে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও থেমে গেল। আবার মুখ ফিরিয়ে বলল, আর হ্যা তোমাদের বান্ধবীকে বলো আমাকে যেন এসব প্রস্তাব দিয়ে আর বিরক্ত না করে।’

বলেই সেলফগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। নায়েল ও সাইলোহ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সাইলোহ ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,

‘ওয়াও নায়েল! দেখো কি সুন্দর একটা ঘটনা ঘটল। মাহীন আমাদের এভাবে অপমানিত হতে পাঠিয়েছে? অবশ্য ওর দোষ নেই। আমরা তো জানতামই রায়েদ চিরকাল এমনই। মাহীন যে ওকে কি ভাবে সেটাই তো অবাক হওয়ার মতো বিষয়।’

নায়েল মাথায় হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল, ‘কি জানি আমিও জানতাম এমনই হবে। তবুও মাহীন ওর সম্পর্কে গত কয়েক দিন যেভাবে যা বললো তাতে আমার ধারণা একটু পাল্টেছিল।’

‘দেখো এই রায়েদ কখনো বদলাতে পারে না। তুমি যতই ঘষামাজা করো কয়লা তো আর হিরা হয়ে যাবে না! এখন চলো এখান থেকে।’ তীব্র কন্ঠে বলল সাইলোহ।

করিডোর ধরে রায়েদ হেঁটে যাচ্ছে দ্রুত পদক্ষেপ ফেলে। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির কাছাকাছি এসে পরল। সামনে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে একটা ষষ্ঠ গ্রেডের ছাত্র ওপরে উঠছিল। রায়েদ ধমক দিয়ে বলল,

‘আস্তে উঠতে পারো না!’

ছেলেটা থমকে দাঁড়ালো। তারপর মিনমিন করে বলল,
‘সরি।’ বলেই তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেল।

রায়েদ সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামছে। বুকের ভেতর তার বড় অস্থিরতা। তিক্ত পানির ঢেউ তিরতির করে ঢুকে যাচ্ছে মনের ভেতর। দ্রুত হাঁটার ফলে হৃদপিণ্ড ধকধক করছে। কড়া রোদের নিচে হঠাৎ করেই বোধহয় বাতাসের আদ্রতাটা বেড়ে গেল। কেমন হাসফাস লাগছে। ‘কি আশ্চর্য! মাহীন! মাহীন কি ভেবে ওদের দুজনকে এখানে পাঠাল! ইনভাইটই যখন করতে চেয়েছে নিজে এসেও বলতে পারত। হ্যা না যেটাই আমার উত্তর হোক না কেন আমি ওকেই বলতাম। কিন্তু নিজে না এসে এমন একটা ঘটনা ঘটানোর কি দরকার ছিলো? নিজেকে কি মনে করেটা কি ও? আমাকে এভাবে অপমান করল কেন ও? তার চাইতে কিছু না করলেই পারত। আমি কি ওর সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতাম যেমনটা অন্যদের সাথে করি? ও আমার সাথে যেমনটা ব্যবহার করতো তার পরিপ্রেক্ষিতে যথেষ্ট স্বাভাবিক আচরণ করেছি। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার কয়েকদিন আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াল। কি অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা করল। কিন্তু কেন? হঠাৎ করে ওর বোধহয় আর ভাল্লাগছে না এসব। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। আমার সাথে কারোও সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে তো তার দুনিয়ার ধৈর্য্য ধরতে হবে। আমি মানুষটাই এমন জটিল। কিন্তু দোষটা আমারও। আমার ধারণা ভুল ছিলো। ও আর অন্য সবার মধ্যে হয়তো পার্থক্য এটাই যে ওর সাহস আছে। ধৈর্য্য শক্তি অন্যদের তুলনায় বেশি কিন্তু তাই বলে এতটাও না যে আমি ধীরে ধীরে কাউকে বিশ্বাস করার সময়টা নেব এবং ততক্ষণ সে অপেক্ষা করবে।’ ভাবতে ভাবতেই স্কুল বিল্ডিংয়ের ভিতরে প্রবেশ করল। এবং দ্রুত গতিতে সিঁড়ি ভেঙ্গে তিনতলায় উঠে গেল।
.
.
.
.
বেলা পৌনে একটা বাজে। এই সময়ের দিকে স্কুলগুলো সব ছুটি হয়ে গিয়েছে। ছাত্র ছাত্রীরা সব বাড়ি ফিরছে বলে রাস্তায় জাম। এবং চারিদিকে হইহট্টগোল। মাহীনের বাড়ির সামনে দিয়ে বেশ কয়েকটা হলুদ স্কুল বাস চলে গেল। মাহীন বাসায় ঢুকছে মাত্র। বাড়িতে এই সময় শুধু মিসেস নাসরিনই থাকেন। মি.মোর্শেদ অফিসে থাকেন। এবং নাইম ভার্সিটি তে থাকে। যদিও সে দেড়টার মধ্যে চলে আসবে। মাহীন বাসায় ঢুকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে জুতা খুলে রেখে সোফায় এসে বসল। গরম লাগছে খুব। পায়ের মোজাটাও খুলে ফেললো। মিসেস নাসরিন নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে আসলেন, ‘কিরে বাসায় আসছিস অবশেষে? আজ এত দেরি হলো কেন?’
মাহীন ম্লান কন্ঠে বললো, ‘ধীরে ধীরে সাইকেল চালাচ্ছিলাম।’
‘তুই বোধহয় অনেক ক্লান্ত। এখন কিছু খাবি নাকি আগে গোসল করে নিবি?’
‘গোসল করেই তো স্কুলে গিয়েছিলাম। এখন আর গোসল করার ইচ্ছা নাই। এখন না পরে খাব’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু খিদা লাগলে ফ্রিজে খাবার রাখা আছে, গরম করে খেয়ে নিস।’ বলে নিজের কামরায় ফিরে যাওয়ার জন্য পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার থেমে গেলেন। এদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,
‘আর হ্যা তোর জুতা মোজা এগুলা উল্টা পাল্টা ভাবে যেন পরে না থাকে। সব জায়গা মতো রাখ।’ বলে চলে গেলেন।

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রইংরুম হতে বাগানে যাওয়ার বড় খোলা দরজার দিকে চাইল। কাঁচের স্লাইডিং ডোরটা হা করে খোলা। বাগানের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছটাও এখান থেকে চোখে পরে। লিলি ফুলের গাছটা সর্বপ্রথম চোখে পরে। তার ওপর তিনটি পাখি বসে আছে। এ পাখিগুলো ওর অচেনা।
মাহীনের সাধারণত এসব ভালো লাগলেও এখন ওর মনে হলো পাখিগুলোও যেন ওকে উপহাস করছে। মুখ ফিরিয়ে নিল সেদিক থেকে। মনে দারুন বিচলিত ভাব। কেমন রাগও হচ্ছে নিজের ওপর। সম্পর্ক কিছুটা ভালোর দিকে গড়িয়েছিল বলেই তো ও এমনটা করলো। তাছাড়াও আর কতবার নিজে থেকে গিয়ে সেই লাইব্রেরিতে হাজির হবে ও? কেনই বা হবে? এখন মাথায় খেলছে, আজকের কাজটাও ঠিক হয়নি। রায়েদের কথায় ওর অপমান হয়েছে। এতটুকু যে ওই অকৃতজ্ঞ, দাম্ভিক ছেলেটার জন্য ভেবেছে তাও বুঝি বড় ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো ওর কথা না ভাববে না ওর মুখদর্শন করবে। এটাই শেষ সিদ্ধান্ত মাহীনের। সাইলোহ ও নায়েলের কাছ থেকে কথাগুলো কানে আসার পর থেকেই বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথা। উৎকন্ঠা ও অস্থিরতা ওর বুকে আগুনের উত্তপ্ত শিখার মতো ঝাপটা দিচ্ছে। শুধুই মেঘ জমা মুখে চুপচাপ একা বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।

প্রায় আধাঘন্টা পর নাইম বাড়ি ফিরল। বাসায় এসে নিজের কামরায় পৌঁছে হাত পা ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিচে আসতেই মিসেস নাসরিন জানালেন মাহীনের মন মেজাজ খারাপ। ওর কি হয়েছে দেখার নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন নাইমকে। নাইম বাধ্য ছেলের মতো মায়ের নির্দেশে মাহীনের কামরার সামনে এসে হাজির হলো। ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো মাহীন বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে। লাউড স্পিকারে টেইলর সুইফটের রেড গানটা চলছে। যদিও খুব হাই ডেসিবল নয়। মাহীন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দরজা খোলার শব্দেও চোখ মেলে তাকায়নি। নাইম গানটা বন্ধ করে দিতে চোখ মেলে চাইল। বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ভাইয়া ডিসটার্ব করিস না। গানটা চালা।’

‘কি যে ঢং করিস না মাঝে মাঝে। কি হয়েছে তোর হ্যা? স্কুল থেকে ভাজা হয়ে আসছিস দেখি।’

মাহীন সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে ম্লান কন্ঠে বলল, ‘কি আর হবে? আমার ভালো লাগছে না শুধু। এতে খুব বিশেষ কিছু হওয়ার মতো কি দেখলি?’

নাইম মাহীনের বাহু আঁকড়ে ধরে টানতে টানতে বলল,
‘এ্যই ওঠ। আমরা বাইরে যাবো।’

মাহীন চোখ বড় বড় করে ওর দিকে চাইল। মুখ কুঁচকে বলল, ‘পাগল নাকি তুই? এই গরমে, ভর দুপুরে কড়া রোদের মধ্যে আমরা এখন বাইরে যাবো? সকাল থেকে ক্লাস করে এসে কি ক্লান্তি লাগে না তোর?’

এমন ভাবে কথাগুলো বললো যেন বাড়ির বাইরে গেলেই এক মস্ত দানবীয় স্যাকামোর গাছের ভূত ওদের ধরে বসবে।

নাইম বলল,’কোথায় রোদ পাইলি তুই? আকাশ কেমন মেঘলা হয়ে আছে দেখিস না? বাতাসও হচ্ছে। চল আর কোনো বাহানা চলবে না।’ বলে মাহীনকে টেনে উঠাল।

মাহীন মুখ গোঁজ করে অগত্যা উঠে দাঁড়াল। তারপরও নড়তে চাচ্ছে না দেখে প্রায় টানতে টানতে ওকে নিচে নামাল নাইম। দুই ভাই বোনই স্নিকার্স পায়ে দিল। এরপর বাইরে বেরিয়ে গেল। ওদের এলাকা মন্টানা এভেনিউ বেশ শান্ত ও নির্জন এলাকা। এদিকে ছেলে মেয়েদের কোলাহল কম হয়। তবে কিছু দূরেই সামোহির আশেপাশে সারাদিনই ব্যস্ততা দেখা যায়। এখানে প্রতিটা বাড়ির বাগান রয়েছে। রাস্তার পাশেও ওক,সিডার বা স্যাকামোর গাছগুলো ছায়া আবরণী তৈরি করেছে। মাঝে মাঝে কোনো ডালের আড়াল থেকে অচেনা পাখির ডাক শোনা যায়। মাহীনের দেখাদেখি আকাশটাও যেন মন ভার করেছে। বড় বড় ভারি ভারি ধূসর মেঘ রাশি এসে জমা হয়েছে আকাশের বুকে। স্প্যানিস ধাঁচের বাড়ি গুলোর সামনে দিয়ে ওরা দুজন হেঁটে যাচ্ছে। নাইম অবশেষে বলল,

‘আচ্ছা তোর স্কুলে কি চলে না চলে সেসব তো কিছুই জানাস না আমাকে। আর তোর নতুন ফ্রেন্ডদেরকেও তো আমি চিনি না। এর আগে বাংলাদেশে থাকতে তোর একেকটা ফ্রেন্ডের নারী-নক্ষত্র, এমনকি দাদা-নানার পেশা কি ছিলো এসবও আমার জানা থাকত।’

মাহীন স্তিমিত কন্ঠে বলল,’হ্যা ভাইয়া। তোকে বলবো বলবো করে তো বলাই আর হচ্ছে না। কারণ কাহিনী অনেক কিছু ঘটে গেছে।’

‘তোর জীবনে এত ড্রামা কিভাবে হয় বুঝি না।’ টিপ্পনী কেটে বলল নাইম।

‘তোর বোঝা লাগবে না। তুই শুধু শোন।’ গাঢ় ভাবে বলল মাহীন। তারপর একদম প্রথম দিনের ঘটনাগুলো খুলে বললো। তারপর ক্রিয়েটিভ ইভেন্ট। এরপর একে একে প্রাইজ গিভিং সেরেমনি, বাস্কেটবল ম্যাচ।’ নাইম চোখ ছানাবড়া করে শুনলো। সবশেষে সবিস্ময়ের সঙ্গে বলল, ‘তোর স্কুলে কি একটাও স্বাভাবিক ছাত্র নাই? সবগুলো একেক ক্যাটাগরির একেকটা নমুনা দেখি।’

মাহীন হেসে ফেললো। বলল, ‘তা আর বলতে। আমি নিজেও অবাক এই বিষয়ে।’

‘ভালো কথা। তুই আবার সোশাল বাটারফ্লাই দেখে নতুন স্কুলের দেড় মাসের মাথায় সবকিছুর সাথে জড়িয়ে গেছিস।’

মাহীন নাটকীয় ভঙ্গিতে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।
নাইম বলল, ‘আচ্ছা এটা আগে বল যে, ওইযে র‌্যবিটের বাসায় গিয়ে বুঝলিনা কি করে যে ওটা কার বাসা? বাসার বাইরে নেমপ্লেট ছিল না? আর ওদের মায়ের পদবি তো এট লিস্ট জানিস।’

মাহীন রাস্তায় পরে থাকা একটা নুড়ি পাথরকে লাথি মেরে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘ভাই ওদের মায়ের নাম ফাতিমা রহমান। লাস্টে কোনো মাদিহ যুক্ত নাই। এবং আমার যতদূর মনে পরে ওদের বাড়ির বাইরে কোনো নেমপ্লেট নেই।’

‘কিন্তু যেহেতু তুই র‌্যবিটকে আগে থেকে চিনতিস, তোর তো ওর বাসায় গিয়ে কোনো না কোনো হিন্ট পাওয়ার কথা। আর রায়েদের কি? ওর মায়ের মুখে ওর কথাও শুনিস নি?’

‘আরে ওইটাই তো। ওর মায়ের বা দাদির কথা শুনে আমি ওগুলো কিছু বুঝতেই পারিনি। আর আমি যে রায়েদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি এটা নিশ্চয়ই রায়েদের জানার কথা। কিন্তু ওতো এরপর দেখা হওয়ার পরও কিছুই বলেনি এ সম্বন্ধে।’ বলল মাহীন।

নাইম চোখ ছোট করে সন্দিহান কন্ঠে বলল, ‘ঘটনা গোলমেলে।’

মাহীন বলল, ‘হবে নাই বা কেন? সত্যি বলতে ওই দুই মাদিহ ভাইকেই অনেক রহস্যময় লাগে। রায়েদের কথা বাদ। এট লিস্ট র‌্যবিট তো প্রানবন্ত চঞ্চল, মিশুক। ওর অনেক বন্ধুবান্ধব থাকা সত্ত্বেও ও তাদের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায় না কেন এটা একটা ভাবার মতো বিষয়। তারওপর রায়েদ কে নিয়ে কখনো ও মুখ খোলে না। আমার বন্ধুদের মুখে শুনেছি, অনেকজন অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু ওর মুখ থেকে একটা টুঁশব্দও বের হয় না।’

নাইম বলল, ‘হুম। তাহলে তুই ওদের থেকে সাবধান থাকবি। আমার কাছে ওদেরকে একদম সুবিধাজনক লাগছে না।’

মাহীন চট করে বলল, ‘আরেহ না। ওদের অদ্ভুত রহস্যময় লাগলেও ওদের কাউকেই কিন্তু মানুষ হিসেবে আমার খারাপ মনে হয়নি।’

‘এই যে শুরু করেছিস আবার তোর মানব দরদী আচরণ। এসব করতে গিয়ে তুই আবার ঝামেলায় ফাঁসবি। আর লাস্ট তোদের যখন দেখা হয়েছে তখন তো সবকিছু ঠিকই ছিলো, স্বাভাবিক ছিল। সেইসব কে ওমনি থাকতে দে। আর বেশি ঘাটতে যাস না।’ বিজ্ঞের মতো বলল নাইম।

ধূসর রঙের মেঘের পাহাড় গুলোর নিচ দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল।

মাহীন পানসে কন্ঠে বলল, ‘হ্যা আমি ইতোমধ্যে কিছু করেছি। যদিও মনে হচ্ছে এটা করাটা মোটেও উচিৎ হয়নি। এর ফলে ওই শেষ স্বাভাবিক ব্যাপারটা বোধহয় খুব খারাপ পর্যায় চলে গিয়েছে।

নাইম মাথায় চাপড় দিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল,’আল্লাহ! কিছু করার পূর্বে পাঁচজনের মতামত নিতে কি এমন ক্ষতি হয়? আর সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে তোর ভাল্লাগেনা, না?’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তীব্র কন্ঠে বলল, তবে যাই হয়ে যাক আমি আর ওর সাথে জীবনেও কথা বলবো না। ওর ধার দিয়ে আই মিন লাইব্রেরির ডিরেকশনেও তাকাবো না।’

কেমন মুখ ভার করে বলল মাহীন। নাইম কপাল কুঁচকে বলল, এমন কী হয়েছে আবার? ও না অনেক ভালো ছিল একটু আগে? দুই মিনিটে খারাপ হয়ে গেল?’

‘না তেমন কিছু না। শুনলি না ও ওইরকমই?’
তারপর থেমে আবার বলল, ‘আর হ্যা পাঁচজনের মতামত নেওয়ার পরও, আমি ওইটাই করতাম যেটা আমার মনে চায়।’

নাইম মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘এহ! স্টাবার্ন ফ্রিক একটা।’ তারপর একটু বিরতি দিয়ে বলল,’তোর বন্ধুদের মধ্যে যে আমার একমাত্র নায়েল ও লিও কেই স্বাভাবিক লাগে। আর ওই যে…কি জানি চায়নিজ মেয়েটার নাম ওকেও বলতাম স্বাভাবিক। কিন্তু কোন স্বাভাবিক মানুষের সাথে এতো এক্সিডেন্ট হয়? বাই দ্যা ওয়ে ওর সাথে তুই কিন্তু কোথাও যাবি না। পরে ওর সাথে সাথে তোরও এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।’

মাহীন হালকা হাসল। বলল, ‘আসলেই তবে জেনেট আর সাইলোর মধ্যে কি সমস্যা? ওরাও তো স্বাভাবিক।’

‘মোটেও না। তোর বান্ধবী সাইলোহ এত খিটখিটে আচরণ করে কেন? অতিরিক্ত। আর জেনেট তো তোর থেকেও বড় ড্রামা কুইন।’

মাহীন মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘ইশ! আমি ড্রামা কুইন না।’

‘তুই বললেই হইলো নাকি। আর এটা বল যে, ওই যে ওই ছেলেটা। যে বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেইন। তার কি হলো না হলো সেটা নিয়ে তোর এত মাথা ব্যাথা কিসের? কি করতে ওকে কমফোর্ট করতে গিয়েছিলি?’

‘আমার খারাপ লেগেছিল তাই। আর ওকে ওভাবে বসে থাকতে দেখেও কিছু না বলেই চলে আসব ব্যাপারটা কেমন জানি দেখায় না?” জিজ্ঞেস করল মাহীন।

নাইম বলল,’মোটেও কেমন জানি দেখায় না। আহা কি দরদ! দরদের ফ্লেম থেকে বাঁচি না। ওই সময় বেচারা একটু একা থাকতে চেয়েছিল আর তুই কিনা ফ্রি তে জ্ঞান দান করতে গিয়েছিলি।’

মাহীন বলল, ‘আরেহ আমি জানি কখন কাকে কি বলতে হয়। এবং স্কুলের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ব্যাপারটা তো ক্যাপ্টেইনের জানা উচিৎ। এর আগে শুধু ওকে চিনতাম না এবং বলার সুযোগ হয়নি বলে বলাও হয়নি। সেই দিন সুর্বণ সুযোগ পেয়ে কেন হাতছাড়া করতাম।’

‘ওফ তুই কোথায় গিয়ে পরেছিস। ম্যাচফিক্সিং টাও বাদ রাখেনি এরা। আরেক আছে ধড়িবাজ মনিটর আবার তার মা নাকি জাদরেল টিচার। কোনো এক স্টুডেন্ট প্রথম দিনে স্কুলে এসেই আমার চুনোপুঁটিকে খুন করল। ওফ তোর স্কুলের নাম শুনেই সাফোকেশন হচ্ছে।’ জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল নাইম।

মাহীন ইতস্তত হাসল। বলল,’সামোহি কে নিয়ে কিন্তু একটা নেটফ্লিক্স ওয়েব সিরিজ অনায়াসে বানানো যাবে।’

নায়েল হেসে বলল,’তা বৈকি। ওহ হ্যা তুই কি চতুর্থ বার ফ্রেন্ডস দেখা শেষ করেছিস?’

‘নাহ দশ নাম্বার সিজনের শেষের তিনটা এপিসোড এখনো বাকি আছে। তোর ‘মানি হায়েস্ট’ শেষ হয়েছে?’

নাইম বলল, ‘নাহ। সময় পাই কোথায়? বাই দ্যা ওয়ে তুই শুনেছিস না টেক্সাসে গতকাল একটা স্কুলে বন্দুক হামলায় উনিশ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে এবং একুশ জুন হতাত হয়েছে?’

মাহীন বলল, ‘হ্যা শুনেছি। এবং নিশ্চয়ই খুনি আবার আত্নহত্যাও করেছে?’

‘হ্যা তা তো করেছেই। আজকাল এই বন্দুক হামলাগুলো প্রচুর বেরে গিয়েছে। এবং খুনি গুলো যে কোন পাগলাগারদ থেকে পালায় আসে আল্লাহই জানে। কিন্তু কথা হইল মানুষের জন্য বন্ধুক পকেটে পকেটে রাখা খুব বেশিই সহজলভ্য করেছে আমেরিকা সরকার।’

‘হুম এখনো মনে হয় যেন আমরা ওয়েস্টার্ন যুগেই থেমে গিয়েছি। শুধু পার্থক্য হলো স্থান-কাল, সংস্কৃতি পরিবর্তন হয়েছে। শুধু মাত্র অত্যাধিক বন্দুক তৈরির ওপর যদি একটা নির্দিষ্ট মাত্রা থাকত তাহলে পরিস্থিতি এতটা ভয়বহ হতো না।’

‘হ্যা বাইডেন সরকার এইদিক দিয়ে একেবারেই ব্যর্থ।’

‘তা ঠিক বলা যায় না। এর আগের সরকাররাও এ বিষয়ে নির্বিকার ছিল। এবং বাইডেন তো বন্দুক আইনের ওপর একটা বিল তৈরি করেছিল তবে হাফ সিনেটরদের ভোটের অভাবে তো তা পাশই হয় নি।’

‘তাও অবশ্য ঠিক। এবং তুই যে একা চলা ফেরা করিস, সাবধানে থাকবি কিন্তু।’ মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।
.
.
.
.
মি.মোর্শেদ কিছুক্ষণ পূর্বে বাসায় ফিরেছেন। মিসেস নাসরিন খাবার গরম করে টেবিলে রাখছেন। এখন প্রায় বিকেল হতে চলেছে। মি.মোর্শেদ হাত মুখ ধুয়ে এসে টেবিলে বসতে বসতে বললেন, ‘কি ব্যপার আমার ছেলে মেয়েরা কোথায়? বাড়ি খালি খালি কেন?’

মিসেস নাসরিন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলল,
‘ওফ আর বলো না। তোমার দুজন ছেলে মেয়েই পাগল। সেই স্কুল থেকে ফিরেই বাইরে বেরিয়েছিল এখনো ফিরেনি। মাহীন দেখি ফোন বাসায় ফেলে থুয়ে গিয়েছে আর নাইম ফোন ধরছে না।’

মি.মোর্শেদ বললেন, ‘আরেহ চিন্তা করো নাতো। অনেক দিন পর দুইজন ঘুরতে বেরিয়েছে। ব্যস্ততার মধ্যে তো ওদের গল্প করতেই দেখি না।’

মিসেস নাসরিন চিন্তিত কন্ঠে বলছেন, ‘আমার সত্যিই খুব চিন্তা হচ্ছে মাহীনকে নিয়ে। দেড়মাস মাত্র হলো এখানে এসেছি। এখনো স্যান্টা মনিকাই ভালো করে চিনলো না আর ও একা একা যাচ্ছে অন্য শহরে।’

‘তা বৈকি। চিন্তা তো আমারও হচ্ছে। না জানি কোন ঝামেলায় পরে আবার।’ উৎকন্ঠিত স্বরে বললেন মি.মোর্শেদ।

মিসেস নাসরিন বললেন, ‘আরেহ তুমি তো ওর কারিশমা দেখোনি কিছুই। দেশে থাকতে তো বাসায়ই থাকত। স্কুলে শুধু একা যেত, তাই সে চরম চরম রেকর্ড আছে ওর। আর এখানে আরোও স্বাধীন ও।’

মি.মোর্শেদ বললেন, ‘তবে একটা ব্যাপার যে ও অবুঝ না। যথেষ্ট ম্যাচিউর। একটু যা খামখেয়ালী।’

মিসেস নাসরিন বললেন, ‘শুধু কি খামখেয়ালী? মানুষের জন্য উদারতা দেখাতে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। জানো তো আমরা যখন গাড়ো পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। তখন পাহাড়ের মধ্যে কিভাবে একটা গাড়ো বাচ্চার খোঁজ পেয়েছিল ও যে হারিয়ে গিয়েছিল। সেই বাচ্চাকে কোন ফাঁকে নিজের বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেছে। চিন্তা করো! তারপর ভাগ্য ভালো চেকপোস্টের আর্মিদের হাতে গিয়ে পরেছিল বলে ওকে আবার খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। শুধু এটাই ওর বড় ধরনের রেকর্ড না। আরো আছে। এই যেমন দুইবছর আগেরই তো কথা, কমলাপুর স্টেশনে কোন চোর এক যাত্রীর ছোট একটা ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই যাত্রীকে হেল্প করতে গিয়ে সেফটিপিন ফুটিয়ে দিয়েছিল চোরের হাতে। ইশ সেকি লঙ্কাকাণ্ড!’

মি.মোর্শেদ হালকা হেসে উঠে বললেন, ‘হ্যা হ্যা জানি। সেই কাহিনী কতবার নাইম শুনিয়েছে আমাকে। কিন্তু কথা হলো আসলেও ওই হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাটা কিন্তু পরে মাহীনের জন্যেই নিজের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল। এবং সেই চোরও ধরা পরেছিল।’

মিসেস নাসরিন বিরক্ত কন্ঠে বললেন, ‘তুমি হাসছ! যদিও প্রতিটা কাজই ওর কোনো না কোনো ভাবে সফল হয় কিন্তু এর বিপরীতও হতে পারত। যদি আমরা ওকে সেই বার পাহাড়ে খুঁজে না পেতাম? আর যদি সেই চোর ওর কোনো ক্ষতি করে দিত? ওর ভাবসাব দেখলে মনে হয় তেইশ চব্বিশ বছর। কিন্তু আসলে তো মাত্র সাড়ে ষোল বছর বয়স ওর। নতুন বন্ধু বান্ধব জুটেছে। কিভাবে যে স্কুলের প্রথম দুইতিন দিনেই এত ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে তারা ওকে বিচে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসায় এসে হাজির হয়েছিল তা এখনো আমার বোধগম্য হয়নি। আদৌও কেমন যে ওরা আল্লাহই জানে। আর এখানকার ছেলে মেয়েদের যে উচ্ছন্ন লাইফস্টাইল সে আর বলার নয়। এদের সাথে থাকতে থাকতে কখন না আবার মাহীনও কাউকে জুটায় ফেলে। ওই যে ওর ওই বান্ধুবীটা যার সোনালি চুল ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। তাও আবার সেও মাহীনের ফ্রেন্ড। দুইজনই আসছিল সেদিন বাসায়। তাদের ভরসায় তাদের সাথে কিভাবে ওকে অন্য শহরে পাঠাবো বল? ‘

মি.মোর্শেদ শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘দেখো নাসরিন, চিন্তিত আমিও। কিন্তু ওকে এখন যেতে না দিলে ওর মন খারাপ হয়ে যাবে। আর ও অসম্ভব জেদি জানতো। ওর সব বন্ধুরা যাবে আর ও, নিজের প্রথম পিকনিকটা মিস করবে তা তো ও মেনে নিতে পারবে না। এত কান্ড করার পর যে তুমি ওকে কম শাসন করেছো তা তো নয়। আমাকে ফোন করে করে সেকি কান্নাকাটি করে বিচার দিত। তারপরও কি ও বদলেছে? ওর স্বভাবই ওরকম। স্বভাব তো আর বদলাবে না। বিপদ ওর কপালে থাকলে বাসায় বসেও হতে পারে, অন্য যেকোনো জায়গায় হতে পারে। এখন অন্য শহরে যাচ্ছে যখন, আমরা যা করতে পারি তা হলো ওকে বুঝিয়ে বলতে পারি সাবধান হওয়ার ব্যাপারে। ও সেন্সিবল একটা মেয়ে একসেপ্ট যা কিছু করে ও। ওতো ভালো করেই বোঝে কোনটাতে ওর বিপদ আছে। ইচ্ছে করে তো আর বিপদে পরবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা বাচ্চাদের স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এইটুকু একা ছেড়ে না দিলে কি হয়? ‘

মিসেস নাসরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ তোমার কথাও ঠিক। কিন্তু ও যেভাবে যেভাবে বিপদে পরে সেগুলো ইচ্ছে করে বিপদে পরারই সামিল।’

চলবে ইনশাআল্লাহ।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ১৭
লেখনী-মাহীরা ফারহী

সাই সাই করে তীব্র বাতাসের বিপরীতে ছুটে চলেছে নীল ক্যাডিলাক। হাইওয়ের দুইপাশে সারি সারি পাইন গাছ গুলো দ্রুত গতিতে পেছনে সরে যাচ্ছে। ইওসেমিতে পৌছতে আর অল্প কিছু সময় বাকি। মাহীন চুপচাপ ব্যাকসিটে বসে ওয়ারলেস হেডফোন কানে গুজে জন ডেনভারের কান্ট্রি রোড গানটা শুনছে। পাশে নাইম নিজের মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে গভীর মনোযোগে চেয়ে আছে। মিস্টার মোর্শেদ ড্রাইভ করছেন এবং মিসেস নাসরিন পাশের সিটে বসে আছেন। বাইরে থেকে কি যেন একটা উড়ে এসে হঠাৎ নাইমের নাকের ওপর পরল। নাইম চমকে উঠে মৃদু চিৎকার দিতেই পাশে থাকা মাহীনও ভড়কে গেল। সামনে থাকা মি.মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি হলো নাইম কোনো সমস্যা?’

নাইম উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘ইয়া আল্লাহ আমার মুখে পোকা বসেছিল। ওটা আশেপাশেই কোথাও রয়েছে।’

মিসেস নাসরিন বললেন,’কিসের পোকা। ওখানে কিছুই নোই।’
মাহীন বিরক্ত দৃষ্টিতে ভাইয়ের পানে চাইল। খেয়াল করল নাইমের টি-শার্টের কলারে একটা শুকনো পাতা আটকে আছে। মাহীন হাত বাড়িয়ে পাতা খুলে নিতেই নাইম পুনরায় উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘খাইছে! তুই পোকাটাকে হাতে ধরলি!’

মাহীন মড়া পাতাটা সামনে ধরে বলল,’গাধা এটা একটা শুকনো পাতা। পোকা না। আগে দেখবি তো কি হইসে তারপর প্যা প্যা করবি।’

নাইম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বলল, ‘আমি কিভাবে জানবো ওটা মড়া পাতা।’

মি.মোর্শেদ মুচকি হাসলেন। কিছুক্ষণ পর ওদের গাড়ি রাস্তার পাশে সারি সারি স্থির দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। একটা সময় সাউথ এনট্রেন্সে এসে থামল ওরা। ইউসেমিতে পার্কে প্রবেশ করার মোট ৫ টি গেট রয়েছে। বিগ ওক ফ্ল্যাট ও এরচ রক গেট দুটোয় বেশ জাম থাকে। তবে সাউথ এনট্রেন্সে তুলনামূলক কম ভিড় থাকে। তারপরেও প্রায় সাত আট মিনিট খরচ হয়েছে শুধু রাস্তার পাশে সারি সারি রাখা গাড়িগুলোকে পাশ কাটাতে। এল এ থেকে আসলে সাউথ এনট্রেন্সকেই বেছে নেয় মানুষ। গাড়ি থামতেই নাইম ও মাহীন এবং মিসেস নাসরিন নেমে গেলেন গাড়ি থেকে। মি.মোর্শেদ গাড়িটা পার্ক করে তারপর আসলেন। ওরা যেখানে থেমেছে সেখান থেকে রাস্তা সামনে লম্বা লম্বা গাছগুলোর মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে। সামনে ওয়াওনা হোটেলের বড় গেটটা হা করে খোলা। গাড়ি পার্ক করার স্থান বাইরে। হোটেলের সামনে রাস্তার মাঝে টেলিফোন বুথের সমান দুটো কাঠের বুথে রোড পুলিশ রয়েছে যারা প্রতিটা গাড়ি চেক করছে। হোটেলের গেটে বড় মাপের আমেরিকার লাল,সাদা ও নীল রঙের পতাকা পৎ পৎ করে উড়ছে।ওরা গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। সামনে একটা বড় ফোয়ারা। তার থেকে বারো তেরো গজ দূরে দুই তলা সাদা খোলা বারান্দা বিশিষ্ট কাঠের তৈরি হোটেল। নীলচে ধূসর রঙের ডাচ ছাদ। হোটেলটা উনিশ শতকের নকশায় তৈরি। এখনো সবকিছুই সেরকমই থেকে গিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে নাইম মাহীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আরেহ জানিস এই হোটেলটায় অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আছে।’

মাহীন আগ্রহ ভরা কন্ঠে বলল, ‘ভৌতিক ঘটনা?’

নাইম ঠোঁট বাকিয়ে বলল,’আমি ঐতিহাসিক বলেছি।’

‘কি হয়েছিল?’

‘প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট জন মুইরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ১৯০৩ সালে এই হোটেল থেকে তিন দিনের জন্য ঘুরে গিয়েছেন।

‘ওয়াও হোয়াট আ হিস্টোরিক্যাল প্লেস! বাই দ্যা ওয়ে তুই এতকিছু কখন গবেষণা করলি?’

‘কখন আবার? যখন তুই যেখানে সেখানে টো টো করে বেড়াস তখন আমি এসব করি। তুই জানবি কি করে? তোর তো সময়ই নাই আমি কি করি না করি দেখার।’ কিছুটা অভিমানী কন্ঠে বলল নাইম।

‘কোই কালকেই না কত কী খুলে বললাম তোকে।’ প্রতিবাদ করল মাহীন।

‘আমি অন্য সময়ের কথা বলছি।’

ওরা হোটেলের সামনের খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। খোলা বারান্দায় পাশাপাশি এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত চেয়ার টেবিল, সোফা সবই আছে। মাঝের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে সামনে কাউন্টার। সেখানেই আবার দুইপাশে বড় বড় সোফা রাখা। মি.মোর্শেদ কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সাথে সাথে নাইমও এগিয়ে গেল। রিসেপশনিষ্টের সঙ্গে কথা বলছে ওরা। এদিকে মিসেস নাসরিন ও মাহীন সোফার নিকট দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষণকাল পর মি.মোর্শেদ দুটো চাবি হাতে ফিরে এলেন। ওদের রুম প্রায় চৌদ্দ পনেরো দিন আগে থেকে বুক করা হয়েছিল। দুই তলায় যেতে হবে। সেখানকার কেয়ারটেকার রা ওদের ব্যাগ কামরায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন। সকলে ওপরে উঠে গেল। আশপাশটা মোটামুটি অতিথিদের উপস্থিতিতে কলরব মুখর। মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদের আলাদা কামরা এবং তার পাশের কামরাটাই দুই ভাই বোনের জন্য। মাহীন কামরায় প্রবেশ করে দুটো সিঙ্গেল বেডের একটিতে ধপ করে বসে পরল। কামরায় সবকিছুই উনিশ শতকের পুরনো আসবাবপত্র। এখানে সেই পুরোনো আমলের কনক্রিটের ম্যানুয়েল ফারায়প্লেস রয়েছে। বাদামি সোফার রঙ মলিন হয়ে এসেছে। নাইম নিজের এবং মাহীনের স্যুটকেস দুটো সেন্টার টেবিলের পাশে রাখল। তারপর এ্যটাচ বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। সোফার পেছনে দুটো জানালা পাতলা সাদা পর্দায় মোড়া। মাহীন উঠে দাঁড়িয়ে কামরার ভিতরটা পরক্ষ করতে লাগল। এখানে একমাত্র কাঠের ক্লজেটটার পাশে একটা অনেক পুরনো রাস্ট রঙের রুম হিটার দেখা গেল। যদিও সেটা অকেজো, শুধু মাত্র ঐতিহাসিক আবহ বজায় রাখতে এসব জিনিস এখনো যত্নের সঙ্গে সাজিয়ে রাখা আছে। বিছানা দুটোর পেছনের লোহার রেলিঙগুলো সরু সরু। কিছুক্ষণ পর নাইম বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু একটা খুঁজে বের করতে ব্যস্ত হয়ে পরল। মাহীন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,

‘ভাইয়া জানিস তো, এখানকার সেই বিখ্যাত ঘটনা গুলো?’

নাইম ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করল, ‘আবার কোন ঘটনা? আমি তো বললামই ঐতিহাসিক ঘটনা গুলো।’

মাহীন নিগূঢ় গলায় বলল,’সেইসব ঘটনা যেগুলো মানুষ যুগযুগ ধরে চাপা দিয়ে এসেছে।’

নাইম এবার বিরক্ত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ওফ এত প্যাচাল না পেরে সোজাসুজি বল কি বলছিস।’

‘সেই উনিশশো বিশ সালের ঘটনা। একজন পাইলট এখানে মৃত্যু বরণ করেছিল। মুরস কটেজে। এবং তারপর থে.. ‘

নাইম শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, ‘এহ! আসছে আমাকে ভয় দেখানোর ফন্দি এটে। এতই ভূতুড়ে ঘটনা থাকলে আমি যখন রিসার্চ করলাম তখন পেতাম না।’

মাহীন শ্রাগ করে বলল, ‘তোর ইচ্ছা। বিশ্বাস করলে কর না করলে না কর।’ তারপর বাথরুমে চলে গেল ও।

শান্ত স্থির পর্দাগুলো হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় উড়তে লাগল। নাইম চমকে তাকায় সেদিকে। শুকনো ঢোঁক গিলে আয়াতুল কুরছি পড়া শুরু করল।
.
.
.
মস্ত দানবাকৃতির স্যকোয়েয়া গাছগুলো গম্ভীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে যেন। প্রতিটা গাছই একশ হতে দেড়শো ফিটের বেশি লম্বা। চওড়ায়ও চার পাঁচ গজের মতো হবে। দর্শনার্থীরা কেউ কেউ হেঁটে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। কদাচিৎ গাছের আড়াল থেকে অচেনা পাখিরা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে।
এক ডাল হতে আরেক ডালে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে আদুরে কাঠবিড়ালিরা। কোনো গাছের গোড়ায় ফাঁক সৃষ্টি হয়ে মস্ত গুহায় পরিণত হয়েছে। মাহীন ও নাইম একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর আবার মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদের ছবি তুললো ওরা। তারপর এগিয়ে যেতে লাগল। জায়গাটার নাম ‘ম্যারিপোসা গ্রোভ’। এই জঙ্গলটা ইয়োসেমিতে ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত। এখানে সবচাইতে উঁচু গাছের নাম ‘গ্রিজলি জায়েন্ট’। যা একইসাথে পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু গাছগুলোর মধ্যে পঞ্চম। সেটাই ম্যারিপোসার মূল আকর্ষণ। সমতল ভূমি তাই চলতে অসুবিধে হয় না। মাহীনরা হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছে। এখন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে রোদের তেজ। যদিও এই জঙ্গলে দানবাকৃতির গাছগুলোর ছায়ায় তেমন একটা রোদ গায়ে লাগে না। গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে রোদের কিরণ ঝিলিক দিয়ে উঠছে। হাঁটতে হাঁটতে মি.মোর্শেদ মাহীনকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা শোন, তোদের স্কুল পিকনিক স্পটটা সদূর আরকানসাসে ফেললো কেন? এখানে করলেও তো পারতো। জায়গাটা তো বিশাল এবং ক্যাম্প করার জন্যেও ভালো।’

মাহীন একটা নুরি পাথর লাথি মেরে বলল,’আসলে গত দুই বছর নাকি টানা এখানেই পিকনিক ফেলেছিল। তাই এবার একটু দূরে দূরে স্পটগুলো ঠিক করেছে।’

মিসেস নাসরিন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,’কলোরাডোও বেছে নিতে পারতি। সেটা তূলনামূলক ভাবে ক্যালি থেকে কাছাকাছি আছে। কিন্তু তোরা নিয়েছিস সেই আরকানসাস। দেশের মাঝখানে।’

সামনে থেকে একটা মধ্য বয়স্ক লোক দুটো বড়সড় জার্মান শেফার্ড নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই দেখে ওরা মুহূর্তের জন্য থামল। লোকটা পার হয়ে যেতেই আবার হাটতে হাটতে মাহীন জবাবে বলল,

‘জানি মা। কিন্তু কলোরাডো বলো, আরকানসাস বলো আর ফিলাডেলফিয়াই বলো না কেন। সবই ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দূরেই। শুধু পার্থক্যটা কম এবং বেশি দূরত্বের।’

মি.মোর্শেদ বললেন, ‘তবুও চিন্তা তো হয়। তুই ছোট মানুষ একা একা সেই আরেক শহরে যাবি। কোথায় কি বিপদে পরবি।’

‘আর তোকে জিজ্ঞেস করছে যে, তুই আরকানসাস কেন বেছে নিলি? দূরত্বের পরিমাপ কেউ জিজ্ঞেস করেনি।’ এতক্ষণে নাইম কিছু বলল।

মাহীন চোখের মণি ঘুরিয়ে বলল, ‘উম..কারণ পিনাকেল মাউন্টেইন অনেক সুন্দর! এবং ওইখানে মাছ ধরার ব্যাবস্থা আছে। এবং সবচাইতে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে ওখানে কাছেই একটা বড় পরিত্যক্ত দূর্গ আছে। আমার এসব অনেক ভালো লাগে। এবং সবচাইতে বড় কথা আমার বন্ধুরা সবাই ওখানেই যাচ্ছে। তাহলে অন্য জায়গায় গিয়ে কী আমার একা একা ভালো লাগবে?’

নাইম টিপ্পনী কেটে বলল, ‘হ্যা তা ঠিক আছে। তাই বলে আবার মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে যাইস না। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পরে যাইস না। আর সবচাইতে বড় কথা দূর্গ এক্সপ্লোর করতে গিয়ে আবার হারিয়ে যাইস না যেন। ‘

ওরা একটা কাঠের ব্রিজ পার হচ্ছে। এর নিচ দিয়ে চলে গেছে এক নজর কারা ক্রিক। ইচ্ছে করে সারাদিন ক্রিকের পাশে গাছে হেলান দিয়ে বসে পানি বয়ে যাওয়ার কলকল ধ্বনি শুনতে। এখানে ক্রিকের আশেপাশে আবার ভালো ভাবেই রোদের আলোর হাতছানি। ক্রিকের স্বচ্ছ পানি রোদের কিরণে রুপোর মতো চিকচিক করে উঠে। মিসেস নাসরিন বললেন বললেন,
‘নাইম! সবসময় এমন নেগেটিভ কথাবার্তা বলিস কেন?’
নাইম আর কিছু বলল না কিন্তু মুখ বাঁকা করে রইল।
কিছুক্ষণ পর ওরা সকলে গ্রিজলি জায়েন্টের সামনে আসল। এই গাছটা লম্বায় ২০৯ ফিট লম্বা। ফলে এর গোড়ায় দাঁড়িয়ে এর অগ্রভাগ দৃষ্টিগোচর হয় না। গোড়াটা বিশাল গুহার মত। ওপরের দিকে দৃষ্টিপাত করে পুরো ঘার বাঁকালেও গাছের আগাটা আর চোখে ধরা দেয় না। মাহীনরা এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। ছবি তুললো। এক কৃষ্ণকায় বাচ্চা গাছের গোড়ার গুহার মধ্যে দিয়ে দৌড়ে আসতে গিয়ে বারি খেয়ে পরে গেল। তাঁর মা বাবা ছুটে গেলেন সেদিকে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর ঠিক হল আরেকটু সামনে গিয়ে বিরতি নিবে। মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদ নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পরেছে বলে ওরা ধীরে ধীরে হাঁটছে।

ওরা বন পেরিয়ে খোলা মাঠে এসে পরেছে কিছুক্ষণ পূর্বে। খোলা মাঠেরই ছাউনিতে টেবিল চেয়ার রাখা আছে বিশ্রামের জন্য। মি.মোর্শেদ ও মিসেস নাসরিন একটা কাঠের টেবিলে ছাউনির নিচে বসে আছেন। আর মাহীন ও নাইম কিছুটা দূরে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে। মাথার ওপর নীল আকাশের বুকে এসে ভিরেছে বড় বড় পেলব সাদা মেঘের ভেলা। সমতল মাঠ পেরিয়ে সামনের বনে কোনো স্যকোয়া গাছ নেই। রয়েছে বড় বড় সিডার এবং ওক গাছ। আবার রয়েছে বিভিন্নরকম মস্ত ফুলের গাছ। এর মধ্যে ক্যাবঅ্যাপল এবং চেরিব্লসোমের গাছগুলো চিনতে পারলো মাহীন। বাকিগুলো অচেনা ঠেকল।
.
.
.
বাতাসের ঝাপটায় সাদা পর্দাগুলো ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের মতো উড়ছে। নিয়ন আলো ভরা কামরা। চারিপাশের পিনপতন নীরবতার মাঝে বাইরে তীব্র ঝিঁঝি পোকাদের সোরগোল। মাঝে মাঝে কাঠের মেঝেতে খুটখাট শব্দ হয়। হঠাৎ পুরনো ফায়ারপ্লেসের ওপর রাখা একটা প্লাস্টিকের প্রায় খালি হয়ে আসা বোতল তীক্ষ্ণ শব্দ করে কাঠের মেঝেতে পরল। এবং সাথে সাথে নাইমের নিদ্রা ভঙ্গ হল। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। কিছুটা ঘেমে উঠেছে শরীর যদিও তাপমাত্রা পনেরোর কোঠায়। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে এদিক ওদিক চাইল। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই দেখলো মেঝেতে একটা প্লাস্টিকের বোতল পরে আছে। নাইম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ভাবল, ‘এই বোতল নিচে কিভাবে পরল? বাতাসে? কিন্তু এটা তো জানালার কাছ থেকে অনেক দূরে ছিল। মাহীন কিছু করেছে?’ ভাবতে ভাবতে পার্শ্বের বিছানায় নিদ্রারত মাহীনের দিকে চাইল। আবার ভাবতে লাগল,’নাহ মাহীন তো ঘুমিয়ে আছে। মনে হয় না ও কিছু করেছে। আর মরার কপাল এই সময় আবার মাহীনের শোনানো সেই ভূতের থিওরিটা কেন মাথায় আসছে? লা হাওলা ওলাকুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আলিউল আজিম।’ পরে নিচু গলায় মাহীনকে ডাক দিলো। কিন্তু মাহীনের কোনো সাড়াশব্দ নেই। নাইম মাঝের বেড টেবিলে রাখা মাহীনের ছোট একটা কাঁকড়া ব্যান্ড নিয়ে ওর দিকে ছুড়ে মারল। ওটা গায়ে লাগতেই মাহীন লাফ দিয়ে উঠল। এবং উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“আ আ আ! তেলাপোকা! ভাইয়া তেলাপোকা!’

নাইম বলল, ‘চুপ! ওটা তোর মাথার ক্লিপ ছিলো। কোনো তেলাপোকা না।’

মাহীন সেটা হাতে নিয়ে দেখল আসলেই ওর চুলের কাঁকড়া ব্যান্ড। এতক্ষণে শান্ত হয়ে অলস ভঙ্গিতে বসে চোখ ডলছে সে। বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘তোর সমস্যা কি? কাল সকাল সকাল উঠতে হবে জানিস না? এই রাত দুপুরে ফাজলামো শুরু করেছিস কেন?’

নাইম বলল,’আমি কোনো ফাজলামো করছি না। আগে তুই বল তুই পানির বোতলের সাথে কি করেছিস? ওটা পরল কেন?’

মাহীন কিছুক্ষণ এমন ভাবে নাইমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল যেন এর চাইতে আশ্চর্যজনক কথা ও এর আগে কখনো শোনেনি। তারপর বলল,

‘আজ তুই ছাগল বলে তোর এতটুকু আক্কেল নাই যে ওটা বাতাসে পরে যেতে পারে?’

নাইম ধমক দিয়ে বলল, ‘বাজে কথা বলবি না। ফায়ারপ্লেস কোথায় আর জানালা কোথায় দেখতো। ওই পর্যন্ত বাতাস গিয়ে হাফ পানি থাকা বোতলটা ফেলে দিলো? তুই তো কচু পাতার মতো কথা বলছিস।’

মাহীন ঠোঁট বাঁকা করে বলল, ‘তাহলে তুই এখন রাত তিনটার সময় বোতল পরে যাওয়ার কারণ বের করতে বায়ুচাপ নিয়ে গবেষণা কর। আমি গেলাম ঘুমোতে।’

বলেই মাহীন বালিশে মাথা এলিয়ে দিতে যাচ্ছিল নাইম তড়িঘড়ি বলল, ‘এই ইয়ে না মানে তুই ঘুমোতে পারবি না। আমি পাক্কা সিওর বোতলের পেছনে তোর কোনো হাত আছে।’

মাহীন পুনরায় উঠে বসে চোখ সরু করে বলল,
‘আসলেই সত্যি করে বলতো তোর ভয় লাগছে তাই না? মানে সিরিয়াসলি ভাইয়া তুই আমার বড় ভাই আর আমি তোর ছোট বোন নাকি আমি তোর বড় বোন এবং তুই আমার ছোট ভাই এটা আগে ঠিক কর।’

নাইম বলল, ‘আরে ধুর ভয় কে পায়। আমি মোটেও তা বলছিনা। শুধু তোর বোতলের জন্য আমার আর ঘুম আসছে না। তো তুই এখন আমাকে গান শোনা। এমনিতেও তোর গানের গলা শুনে মনে হয় যেন এজমায় আক্রান্ত গাধা গান গাইছে।’

মাহীন বলল, এজমায় আক্রান্ত গাধা কাকে বলছিস তুই হ্যা! আর এই রাত তিনটায় তোর গান শোনার শখ উঠছে! তাহলে শোন। বলে লম্বা এক শ্বাস ফেলে গান ধরল,
”One day, the only butterflies left will be in your chest.
As you march towards your death. Breathing your last breathe. I hate you say ‘i told you so’, but look how the bruises show…”

নাইম ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই থাম থাম, তুই আবার এই অদ্ভুত গানটা গাচ্ছিস! তোকে কতবার বলেছি না যে এটা শুনলে আমার সাফোকেশন হয়।’

মাহীন বলল,’ঢং করতে পারিস বাবা। গান শুনে নাকি মানুষের সাফোকেশন হয়। ঠিক আছে তাহলে এটা শোন,

‘বাদনাম হ্যায় কোই, গুমনাম হ্যায় কোই।
কিশকো খাবার কন হ্যা ওও
আনজান হ্যায় কোই….’

নাইম আবারও মাহীন কে মাঝপথে থামিয়ে বলল, ‘হইসে বাবা আমার গান শোনার শখ শেষ। তুই এইসব অদ্ভুত আর ভুতূরে গান গাওয়া বন্ধ কর। আমি এমনিই ভালো ছিলাম।’

মাহীন দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ‘না,না সমস্যা কি আমার তো আরো গান গাইতে ইচ্ছে করছে। গাই না।’

নাইম বলল, ‘না না, দরকার নাই। পরে দেখিস সবাই ভাববে আমরা উইচক্র্যাফট করছি। রাতদুপুরে গান করে শয়তানের উপাসনা করছি।’

মাহীন হাই তুলে বলল, ‘সেটাই তো আমি আগে বলতে চাইছিলাম। বোকা। আমি গেলাম ঘুমোতে। এবার ডিস্টার্ব করলে ওই বোতলের পানি তোর মাথায় ঢালবো কিন্তু।’

বলে পেছনে ঘুরে বালিশে মাথা রাখল। নাইম এদিক ওদিক একবার ভিত দৃষ্টিতে পরখ করল। তারপর আবার শুয়ে পরল। কিছুক্ষণ পরই মাহীন ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল। কিন্তু নাইমের চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ সেই বোতলটা গড়িয়ে এসে নাইমের বিছানার পায়ের সঙ্গে বারি খেল। নাইম যেন এবার পাথর হয়ে গেল। ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। চোখের পাতা ফেলতেও যেন ভয় পাচ্ছে। ভাবছে, ওফ আজকের রাতটা যেন কোনো ভাবে পার হয়ে যায়। কালকের সকালে তো চলেই যাব। তারপর এখানে আসলেও এই হোটেলে ওঠার আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আর কখনো এখানকার ধার দিয়ে যাচ্ছি না আমি।’

চলবে ইনশাআল্লাহ।