এল এ ডেইস পর্ব-১৪+১৫

0
163

#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ১৪
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

ফুরফুরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে স্যান্টা মনিকার অলিগলি দিয়ে। আকাশটা মেঘলা মেঘলা। সূর্য যেন আজ ক্লান্ত পরাজিত ম্লান আলোর থালার মতো আকাশের এক কোণায় ঝুলে রয়েছে। যখন ইচ্ছে ধূসর মেঘের ভেলাগুলো ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে সূর্যকে। ছুটির দিন আজকে। তবুও স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভিড় লেগেছে। আজ প্যাসাডেনা হাই স্কুলের সঙ্গে ওদের বাস্কেটবল ম্যাচ। মাহীন, লিও,জেনেট, নায়েল ও সাইলোর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে চত্ত্বর ধরে। অরিগন এস গাছগুলোর ছায়ায়।
জেনেট বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলছে,

“বিশ্বাস করতে পারো, গতকাল ও তিনটা নতুন ম্যাক এন চিজের প্যাকেট নষ্ট করেছে।”

লিও মুখ কুঁচকে বলল, “ইশ আমার একটুও ভালো লাগে না। তোমরা কি এমন মজা পাও ম্যাক এন চিজে?”

সাইলোহ বলল, “হুহ তুমি বুঝবানা। ম্যাক এন চিজ লাভাররাই এর মূল্য বোঝে।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কেন তোমার ভাই ওগুলো নষ্ট করেছে?”

জেনেট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “গতকাল বাসায় আমার সেকেন্ড কাজিনরা এসেছিল। ওদের সাথে প্র্যাঙ্ক করতে গিয়ে এসব করেছে। যদিও সেইরকম বকাও খেয়েছে মায়ের কাছে।”

মাহীন ওদের থেকে বেশ অনেক দূরে দেখলো র‌্যবিট নিজের বন্ধু লেক্সির সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে সামোহির বাস্কেটবল জার্সি পরে। ওকে দেখা মাত্র একটা কথা মনে একটি প্রশ্ন উদয় হলো। এবং বলল,

“আরেহ একটা কথা তো বলতেই ভুলে গিয়েছি।”

নায়েল জিজ্ঞেস করল, “কি কথা?”

“গতকাল আমি যখন লাইব্রেরি গিয়েছিলাম তখন দেখলাম র‌্যবিট লিটারেলি রায়েদের সঙ্গে বসে হাসতে হাসতে গল্প করছিলো। আর দুজনেই টার্কিশ ভাষায় কথা বলছিলো।” সবিস্ময়ে বলল মাহীন।

সাইলোহ বলল, “তো?”

মাহীন বলল, “তো মানে? আমি তো জানতাম রায়েদের কোনো বন্ধুই নেই। তাহলে…”ওর কথার মাঝখান দিয়ে লিও বলল,”এক মিনিট র‌্যবিট ওর বন্ধু হতে যাবে কেন? তুমি জানো না ওরা তো ভাই।”

মাহীন বিস্ফারিত নয়নে ওর দিকে চাইল। কিছুক্ষণ হতবাক চেহারাই বজিয়ে রাখল। তারপর অবাক কন্ঠে বললচ ‘ওহ তাই! আমি তো জানতামই না। আর তোমরাও আমাকে বলোনি!’

সাইলোহ শান্ত গলায় বলল, “হ্যা কারণ তুমি তো আমাদের জিজ্ঞেসই করোনি। আর ওই রায়েদ মাদিহ একমাত্র ওর ভাইয়ের সাথেই ভালো ব্যবহার করতে পারে। আর কারোও সাথে নয়।”

মাহীনের কথাটা শুনতে ভালো লাগল না। তাই ফট করে তীব্র কন্ঠে বলল, “মোটেও না। ও আমার সাথে এখন একদম স্বাভাবিক এবং ভালো ব্যবহার করে।”

সকলের চোখেই অবিশ্বাস ফুটে উঠল। নায়েল ভ্রু সূঁচালো করে বলল, “সিরিয়াসলি মাহীন?”

মাহীন বলল, “আর নয় তো কি? একটা মানুষ আদোতেই খারাপ হলে কি সে ভালো হওয়ার ভান করতে পারে? করলেও আমার সামনে এত সহজ না। এবং আমার মন থেকেই মনে হয় ও মোটেও খারাপ মানুষ না।”

লিও বলল, “তোমার কথা অবশ্য ফেলনা নয়। কারণ তুমিই হয়তো কয়েক বছর পর টানা ওর সাথে অনেকবার দেখা করেছো। কথা বলেছো, একসাথে ইভেন্টের কাজ করেছো।”

সাইলোহ মুখ বাঁকা করে বলল, “আমি বুঝলাম না তোমার ওকে এমন কিভাবে লাগে। কিন্তু আমার পক্ষে ওকে ভালো মনে করা সম্ভব নয়।”
তখনই ওরা হাঁটতে হাঁটতে দেখল ওদের থেকে বিশ গজ দূর দিয়ে লিম জু এবং আরো কয়েকটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এই সময় সকলেই বাস্কেটবল কোর্টের দিকেই যাচ্ছে। মাহীন চিৎকার করে ডাকলো ওকে। লিম জু থমকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চাইল। মাহীনকে যখন দেখতে পেল, তখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসল। ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলল,

“হেই কি খবর?”

মাহীন বলল, “আচ্ছা বলো তো তুমি আগে রায়েদ কে যেমন মনে করতা, এখনো কি তেমনই মনে করো?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে লিম জু থতমত খেয়ে গেল যেন। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঞ্চিত করে কিছু একটা চিন্তা করে বলল,

“আসলে টু বি অনেস্ট, ও এতটাও খারাপ না। যদিও এটা বলতেই হবে মাহীনের সাথে যতটা স্বাভাবিক আচরণ করে আমার সাথে অতটা করে না। তবে খারাপ ব্যবহারও করেনি ও। এবং আমি এখনো বুঝতে পারছি না আমি কিভাবে এত বছর এত ভুল ধারণা পুষে রেখেছিলাম।”

মাহীন সাইলোহ এবং নায়েলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সি, এটা শুধু আমার কথা নয়।” তারপর লিমের দিকে ফিরে বলল,”থ্যাঙ্কস লিম।”

লিম জু আন্তরিক হেসে চলে গেল। নায়েল অবিশ্বাস্যের কন্ঠে বলল, “আমি শিহরিত।”

জেনেট ইতস্তত করে বলল, “বাই দ্যা ওয়ে। আমার কথাটা খুব স্ট্রেঞ্জ ঠেকলেও… আমার না মনে হয়, মাহীন তুমি রায়েদ কে পছন্দ করো।”

মাহীন থমকে গেল। রায়েদকে পছন্দ করতে পারে এই ধারণাটা মাথায় আসতেই আবারও সেই অস্বস্তি ও অদ্ভুত অনুভূতি জেঁকে ধরল ওকে। হৃদস্পন্দনের বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে মনে হলো। কী আশ্চর্য! এমন অতি সাধারণ কথায় আবার এমন হয় নাকি কারো সাথে? কিন্তু মাহীনের সাথে যে হচ্ছে। মাহীন নিজের সেসব অনুভূতিকে মনের গভীরেই ধামাচাপা দিয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে জেনেটের দিকে চাইল। বিস্মিত কন্ঠে বলল,

“জেনেট! সিরিয়াসলি? তুমি এমনটাও ভাবলা কি করে? ওর প্রতি এমন চিন্তা আমার মাথায়ও আসেনি কখনো!”

কথা বলেই মাথায় টোকা পরল। ও কী ভুল কিছু বললো? নাকি নিজেই মনের ভেতরের সুক্ষ্ণ সুতোর মতো একটি অংশকে পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে গেল।

সাইলোহ মুখ বাঁকা করে বলল, “তাই বলে এতটা জেনেট? আমার মনে হয় তোমার ওই ওয়াটপ্যাডের ক্রিন্জি ফ্যানফিকশনগুলো ইদানীং বেশিই পড়ছো। ওগুলো একটু কম পড়লে বাস্তবে ফিরে আসতে পারবা।”

নায়েল বলল, “আসলেই। মাহীন একটু এক্সট্রা উদারতা দেখাতে যায় বলে কি সেটা চাইলেই ভালোবাসা বানিয়ে দেওয়া যায়?”

জেনেট প্রতিবাদ করে উঠল, “আরেহ! আমি শুধু বলেছি যে আমার মনে হয়।”

সাইলোহ কাঠখোট্টা ভাবে বলল, “ওইটাই তো আমরাও বলছি যে ক্রিন্জি ফ্যানফিকশন কম পড়লে তোমার এমনটা মনেও হতো না।”

জেনেট বিরক্ত কন্ঠে বলল, “কিন্তু তোমরা এটা বঝোইনি যে আমি কথাটা কোন যুক্তিতে বলেছি। না জেনে বুঝে তো আর বলিনি।”

লিও বলল, “হ্যা সেটা ও ঠিক বলেছে। দেখো যদি এভাবে ব্যাপারটাকে দেখা হয়, মাহীন স্কুলে নতুন আসলেও ওদের প্রথম সাক্ষাতের বেলায় অন্য সবার সাথে রায়েদ যেমন ব্যবহার করে তেমনই করেছিলো। কাজেই অন্যদের মতো ও সরেও যেতে পারতো। কিন্তু ও সেটা করেনি। এখন এমনটা তো অনেকে ভাবতেই পারে যে কেন করেনি? কারণ ও ওকে পছন্দ করে। আর এমনিতেও রায়েদ কিন্তু দেখতে সুন্দর।’

মাহীন গাঢ় কন্ঠ বলল, “তা ঠিক বলেছো। আসলেও জেনেট তুমি কিছু ভুল বলোনি। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা এমন ভাবেও দেখা যেতে পারে। কিন্তু আদোতেও ওর প্রতি আমার ওমন কোনো ফিলিংস নেই।”

জেনেট নরম কন্ঠে বলল, “তুমিই শুধু আমার কথা বোঝো। আর আমার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তোমাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব নিয়ে। আমাকে কখনোই বোঝো না তোমরা।” বলে মুখ ফুলিয়ে লিওর পাশ থেকে সরে গিয়ে মাহীনের সাথে সাথে হাঁটতে লাগল।

লিও বলল,”আরেহ কি হলো? তুমি এখান থেকে চলে গেলা কেন? এখন এসবের মাঝে আমার কি দোষ? মানেহ কি আর বলবো সবসমসয় ঝগড়াটা করো তোমরা আর মাইনকারচিপায় পরি আমি। হুদাই আমার ওপর এখন রাগ দেখাচ্ছে।”

কিছুক্ষণ পর জেনেট বলল, “এবং আমি কোনো ক্রিন্জি ফ্যানফিকশন তো দূরের কথা। সাধারণ ফ্যানফিকশনও পড়ি না।”

সাইলোহ ঠোঁট বাকাল। ওরা আর কেউ কিছু বললো না। চুপচাপ এগিয়ে গেল বাস্কেটবল কোর্টের দিকে। লিও ও নায়েল স্কুল বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ক্যাফেটেরিয়া তে গেলো পপকর্ন আনতে। এবং বাকি তিনজন কোর্টে গিয়ে হাজির হলো। মাহীন এই প্রথম কোনো বাস্কেটবল কোর্টে আসল। ঠিক টেনিস কোর্টের মতোই দেখতে। চারিপাশের গ্যালারিগুলো ভরে উঠতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীতে। মাঝের কমলা রঙা ময়দানটার দুপাশে তাল গাছের মতো লম্বা দুটো বাস্কেট। সম্পূর্ণ কোর্টটাকে আলোকিত করতে চারিপাশে অতিরিক্ত আলো জ্বালানো হয়েছে। কাজেই দূরে গ্যালারিতে বসে ময়দানের সবকিছুই ঝকঝকে দেখাচ্ছে। যদি না কারোও দৃষ্টিশক্তির সমস্যা থাকে।
খেলোয়াড়রা একদিকে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খেলা কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। প্যাসাডেনা হাই স্কুল থেকেই প্রচুর শিক্ষার্থী এখানে এসে হাজির হয়েছে। মাহীন, সাইলোহ ও জেনেট গ্যালারিতে প্রবেশ করে তৃতীয় সারিতে পাশাপাশি বসে পরল। সাইলোহ বসেই জিজ্ঞেস করল,”গতবার তো সেই এক বুদ্ধি বের করলা ভিডিও কলের। এবার কি করছো ওকে ম্যাচ এটেন্ড করানোর জন্য?”

মাহীন সাইলোহ ও জেনেটের মাঝের সিটে বসে ছিল। বলল, “আসলে আমি এবার কিছুই করছি না। যদিও আমি ওকে ইনভাইট করেছিলাম। কিন্তু…”

সাইলোহ ওর কথার মাঝখান দিয়ে বলল, ” অন্য কিছুর ব্যাপারটা অন্যরকম। কিন্তু বাস্কেটবল ম্যাচের ব্যাপারে ও কখনো রাজি হবেই না। ওকে ইনভাইট করে এমনিতেও কোনো লাভ নেই।’

মাহীন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “কেন? বাস্কেটবল ম্যাচের জন্য কি কোনো বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে ও?”

“ওহ তুমি মনে হয় জানো না যে রায়েদ আগে বাস্কেটবল টিমের খুব ভালো প্লেয়ার ছিলো।”

আরেক দফা বিস্মিত হলো মাহীন। আজ যেন ওর শুধু বিস্মিত হওয়ার দিন।
“তাহলে ও খেলা ছেড়ে দিলো কেন?” জিজ্ঞেস করল মাহীন।

জেনেট পাশ দিয়ে বলল, “ওইটাই তো সবাই জানতে চায়। এই তো কয়েকবছর আগেও খেলতো। তারপর ওর বন্ধুরা সব হঠাৎ আলাদা হয়ে গেল। এরপর ও সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে গেল।”

মাহীন কপাল কুঁচকে বলল, “ওর বন্ধুরা? তাদের আবার কি সমস্যা হয়েছিলো?”

সাইলোহ বলল, “দেখো এই রায়েদের প্রতিটা ব্যাপার নিয়েই প্রচুর জট ঝামেলা আছে। আমার যতদূর মনে পরে রায়েদের তিনজন বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। দুইজন অন্য স্টেটে শিফট হয়ে গিয়েছিলো। আরেকজন ছিলো কিন্তু তার সাথে ওর সাপে নেউলে সম্পর্ক।”

মাহীন অবাক কন্ঠে বলল, “বন্ধুত্বের মাঝে আবার এমন সম্পর্ক হলো কি করে?”

জেনেট বলল, “আরেহ আমার তো মনে হয় দুইজন একে-অপরকে দেখলেই মাথার কোষগুলো সব উল্টাপাল্টা চলতে শুরু করে। গত বছর ওদের মধ্যে স্কুলেই মারামারি বেঁধে গিয়েছিল। কেউ ওদের থামাতেই পারছিলো না।”

মাহীনের মুখমন্ডল থেকে যেন বিস্ময় সরার নামই নিচ্ছে না। মাহীন জিজ্ঞেস করল,”তো ওর সেই ফ্রেন্ড যে থেকে গিয়েছিল সে এখন কোথায়?”

সাইলোহ বলল, “আছে তো। সামনে দেখো খেলোয়াড়দের মাঝে, ওইযে যার হাতে ক্যাপ্টেন ব্যান্ড লাগানো।”

মাহীন পুনরায় বিস্মিত কন্ঠে বলল, “টিমের ক্যাপ্টেনই ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো!”

জেনেট বলল, “বললো না যে ওরা একসাথে বাস্কেটবল খেলতো। এবং এজন্যেই রায়েদ কখনো বাস্কেটবল কোর্টের ত্রিসীমানায়ও আসে না। আর বিল মুরেই কখনো লাইব্রেরির দিকে যায় না।”

মাহীন কতক্ষণ থম মেরে স্থির চোখে খেলোয়াড়দের দিকে তাকিয়ে রইল। পনেরো মিনিটের মধ্যে ও বোধহয় একটু বেশিই জেনে ফেলেছে। হজম হচ্ছে না ঠিক। যতই জানছে রায়েদকে নিয়ে ঘটনা আরো জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এরপর ওরা তিনজনই নিশ্চুপ রইলো। কিছুক্ষণ পর নায়েল ও লিও পপকর্ন নিয়ে হাজির হলো। একটু পরেই খেলা আরম্ভ হলো। মাহীন বাস্কেটবল খেলায় খুব একটা আগ্রহ পায় না বলে কখনো দেখেনি। তবে আজ ওর স্কুলের টিমকে জিততে দেখার আশায় মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছে। সামোহি টিম যতবার বাস্কেটে বল ফেলছে ততবার গ্যালারি হতে সকল সামোহিদের করতালি ও চিৎকার চেচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। টিমে র‌্যবিটও রয়েছে। কিন্তু মাহীন খুব অবাক হয়ে দেখলো র‌্যবিট খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে আঘাত খাওয়ার ভান করে অপর টিমকে ফাউল খাইয়ে দিচ্ছে। মাহীন অবাক কন্ঠে বলল,

“এই র‌্যবিট একটু পর পর উল্টায় পাল্টায় পরছে কেনো?”

লিও বলল, “কারণ ওই র‌্যবিট খেলা থেকে বেশি মানুষকে ফাউল খাওয়াতে ওস্তাদ। তাই হুদাই উল্টায় পাল্টায় পরে।”

মাহীন হেসে উঠল। ওদের টিমের একজন খেলোয়াড় ল্যারি ম্যাকমিলান। দেখা গেল যতবারই তার হাতে গোল করার সুযোগ আসছে বা হাতে বল আসছে ততবারই তা কোনো ভাবে খুইয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত অনেকগুলো সুযোগ করে দেওয়ার পরও সে একটাও গোল করতে পারল না। সাইলোহ বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল,

“এই ল্যারির সমস্যাটা কি? ও যদি কিছু নাই পারে তাহলে খেলতে আসছে কেন?”

নায়েল মুখ গোঁজ করে বলল, “ধুর ভাল্লাগে না! ওর জন্যেই আজকে আমরা হারবো। তাও তো র‌্যবিট কিছু একটা কাজ করতেসে। কিন্তু ল্যারি তো পুরাই অকর্মা।”

ম্যাচের শেষ অংশে দেখা গেল সামোহির পয়েন্ট তেইশ এবং প্যাসাডেনার পয়েন্ট আটাশ। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও দুই পয়েন্টের জন্য সামোহি হেরে গেলো। গ্যালারিতে উপস্থিত সকল সামোহিদের ওপর বিষন্নতার চাদর ঢেকে গেল। তারা সকলে নিশ্চুপ, নিরাশ। নিষ্প্রভ দৃষ্টি ও হতাশ মুখভঙ্গি। তবে এখনো হইচই হচ্ছে ঠিকই। প্যাসাডেনার ছাত্র ছাত্রীরা আনন্দে আটখানা। কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে সকলে বাস্কেটবল কোর্ট ত্যাগ করতে শুরু করলো। মাহীনরাও একসাথে গ্যালারী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এখন কোথায় যাবে ওরা ঠিক নেই। তাই বাইরে রেবিয়ে ধীরে ধীরে চত্ত্বর ধরে হাঁটতে লাগল। ওদের থেকে কয়েক হাত দূর থেকে ওদেরই ক্লাসমেট ম্যারিকা, ইনদাহ এবং মার্টিন হেঁটে যাচ্ছিল। এবং ম্যারিকা উচ্চস্বরে বলছে,
“ওফ! স্যার বললো পিকনিক সম্ভবত মেয়ের প্রথম সপ্তাহের দিকে ঠিক হতে পারে।”

ওদের কথাগুলো মৃদু ভাবে মাহীনদের কানে আসল। গাছের ছায়ায় চত্ত্বর ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছিল তাঁরা। ওদের কথা কানে আসা মাত্র সাইলোহ উচ্চস্বরে বলল,

“ম্যারিকা এদিকে শুনো!”

ওরা তিনজনই থেমে গিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে কন্ঠের মালিককে খুঁজল। তারপর এখানে জট বেঁধে সকলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা এগিয়ে আসল। লিও জিজ্ঞেস করল, “এই পিকনিকের ডেট ঠিক হয়েছে?”

মার্টিন বলল, “নাহ সিওর না। বাট মেয়ের প্রথম দিকেই হতে পারে।”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “কোন কোন জায়গা ফিক্স হয়েছে?”

ইনদাহ বলল, “ওয়েল দেখো পিনাকেল মাউন্টেইন। এটা আরকানসাসে। ডেডিস পার্ক ইন কলোরাডো। এবং উইস্যাহিখন ভ্যালি পার্ক, ফিলাডেলফিয়া পেনসিলভেনিয়ায়।”

মার্টিন বলল,”এই জায়গাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা যেকোনে একটাতেই রেজিস্ট্রি করতে পারবো।

নায়েল উচ্ছাসের সঙ্গে বলল, “বাহ জায়গাগুলো বেশ ভালোই। তোমরা কোনটায় যাবা বলে ঠিক করসো?”

ম্যারিকা বলল,”উম ডেডিস পার্ক অথবা পিনাকেল মাউন্টেইন এর মধ্যে যেকোনোটায় যেতে পারি। কারণ উইস্যাহিখন ফিলাডেলফিয়ায়। অনেক দূর হয়ে যায়।”

সাইলোহ বলল,”তা ঠিক। তবে বলতেই হয় উইস্যাহিখন খুবই সুন্দর জায়গা।”

জেনেট বলল,”হ্যা তবে ক্যাম্পিং, হাইকিং, ফিশিং এসবের জন্য আদর্শ জায়গা পিনাকেল মাউন্টেইন।”

মাহীন চুপচাপ ওদের কথা গিলে যাচ্ছিল। ওর এইসব জায়গা সম্বন্ধে খুব বেশি ধারণা নেই। কতগুলোর তো কখনো নামই শোনেনি। কাজেই মাঝখান দিয়ে কিছু না বলাটাই সমিচিন মনে হলো।

ইনদাহ স্মিথ হেসে বলল, “মনে তো হচ্ছে তোমরা ওখানেই যাবা।”

লিও হেসে বলল,”হতেও পারে।”

মাহীনের ফোনে বেজে উঠলো টেইলর সুইফটের ব্ল্যাঙ্ক স্পেস গানটা।

জেনেট ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “এই সুইফট সং কোথায় বাজে?”

মাহীন জিন্সের পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করতে করতে বলল, “আমার ফোন।”

মোবাইলের স্ক্রিনে দেখল, মা ফোন দিচ্ছে। ওদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল। বলল, “আসসালামু আলাইকুম আম্মু।”

ওপাশ থেকে মিসেস নাসরিন বললেন,”ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুই কোথায়?”

“কোই আবার? স্কুলে। বলেছিলাম না আজকে বাস্কেটবল ম্যাচ।”

“ওহ হ্যা। ম্যাচ শেষ?”

“হ্যা শেষ। কিন্তু তুমি ফোন করেছো যে?”

“আচ্ছা তো তুই মল থেকে দুধ আর মধু নিয়ে আসবি।”

“আচ্ছা আসার সময় আনবো।”

“না, এখনই।”

“মা, ভাইয়া কোথায়? ওকে বলো না।”

“আরেহ নাইম ওর বন্ধুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়েছে। এর মাঝখান দিয়ে কিভাবে ওকে বলি। তুই একটু এনে দে না।”

“আচ্ছা আচ্ছা। আমি আসছি।” বলে লাইন কেটে দিলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো। দেখলো এখনো বাকিরা সেখানেই জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যারিকারা চলে গিয়েছে। মাহীন কাছে গিয়ে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বড় গেটের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ মনে পরল যে ওর হাতে থাকা ছোট ব্যাগটা ওর হাতে নেই। সেটায় ওর ছোট ফার্স্টএইড কিট এবং আরোও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে। মাহীন ভাবতে লাগল, ওটা তো বাস্কেটবল কোর্ট পর্যন্ত হাতেই ছিলো। এরপর কি হলো? গ্যালারিতে ফেলে আসিনি তো? ওফ ড্যাম ইট! এখন আবার ওখানে যেতে হবে চেক করার জন্য। এমন সময় ঢেউ ঢেউ লাল চুলো এক মেয়ে ছুটে এসে মাহীনের পাশে দাঁড়াল। মাহীন ক্যারোলকে দেখেই বিরক্তিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্যারোল উচ্ছাসের সঙ্গে বলল,
‘হেই ম্যহিন!’

‘আমার নাম মাহীন!’

‘ওহ ওকে সরি সরি। তো আমি বলছিলাম যে তুমি কি আমাকে মাফ করে দিয়েছে?’

‘কিসের জন্য?’ মাহীন স্কুলের গেট দিয়ে বের হতে হতে বলল।

‘ওই যে ওইদিন যেটা হলো তার জন্য।” মিনমিন করে বললো ক্যারোল।

‘তো যেটা হয়েছে সেটা হয়ে গিয়েছে।’

‘কিন্তু এটা তো আমি বুঝতে পারছি না যে তুমি আমাকে মাফ করেছো কিনা?’

মাহীন বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো, “আমার মাফ করা বা না করা দিয়ে কি যায় আসে? তুমি নিজের মতো থাকো না।’

ক্যারোলের কপালে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো। বলল, ‘কিন্তু না, আমার নিশ্চিত হতে হবে। এবং অবশ্যই তোমার আমাকে মাফ করতে হবে। নাহলে অমঙ্গল হবে।’

ওর মুখ দেখে মনে হলো কত বড় সর্বনাশটাই না হতে চলেছে। রীতিমতো ভয়ে অস্থিরতায় ফ্র্যাকলে ভরা নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মাহীন থমকে দাঁড়ালো। ওর ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বলল,

‘অমঙ্গল? তুমি আবার এসবে কিভাবে বিশ্বাস করো?’

‘অবশ্যই করি। আমার দাদু আমাকে প্রতিনিয়ত এটাই শেখান। এবং তুমি আমাকে মাফ না করলে আমার সাথে শুধু অমঙ্গল হবে। দেখো প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো!’

মাহীন এখনো অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ঠাহর করতে পারছে না কোন অমঙ্গলের কথা বলছে মেয়েটা। খ্রিস্টানরা কী এত দৃঢ় ভাবে অমঙ্গলে বিশ্বাস করে নাকি! মাহীন গাঢ় কন্ঠে বলল,

“সিরিয়াসলি তুমি আসলে নেটিভ আমেরিকান না?”

“হ্যা আমি নেটিভ কিন্তু আমি আবার পেরুভিয়ান বংশদ্ভূত। এবং এটা আমার পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি। আর… মাহীন ওর কথার মাঝখান দিয়ে বলল,

“আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে। করলাম তোমাকে মাফ। এখন শান্তি?”

“সত্যি!’ অবাক হয়ে একই সঙ্গে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল ক্যারোল। মাহীন অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঠোঁটের কোণ প্রচারিত করে হাসল। এবং ক্যারোল ঝট করে জড়িয়ে ধরল। মাহীন চমকে উঠল। ওর প্রায় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। তারপর ক্যারোল ওকে আলিঙ্গন মুক্ত করে বলল,

“উফ ম্যহিন তুমি খুবই ভালো। তোমাকে একদিন আমার বাড়ি নিয়ে যাবো। এবং আমার পেরুভিয়ান পরিবারের অনেক কাহিনী শুনাবো।”

মাহীন ইতস্তত করে সায় জানিয়ে মাথা ঝাকাল। তারপর হঠাৎ বলল,”ইয়া আল্লাহ আমার ছোট ব্যাগটা তো আনাই হয়নি তোমার চক্করে পরে। ওফ তোমার জন্য ভুলেই গিয়েছি।”

ক্যারোল আঁতকে উঠে বলল, “আমি আবার কি করলাম?”

“কিছু না।” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহীন স্কুলের দিকে ফিরে গেলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব-১৫
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

নিরব, নির্জন, শূন্য গ্যালারি। কোর্টে একটি মাত্র মানুষ ভিন্ন আর কেউ নেই। সকল বাতিগুলো নিষ্প্রভ হলেও একটি বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। মস্ত বাস্কেটবল কোর্টের একদিকের বড় বড় খোলা জানালা গুলো দিয়ে বাকি যা আলো আসছে তাই আলোকিত করে রেখেছে জায়গাটা। ফাঁকা গ্যালারির সামনের সারির একটি সিটে বিষন্ন মনে মাথা নত করে বসে আছে একটা ছেলে। কোর্টের বড় গেটটা হালকা একটু খুলে ভেতরে প্রবেশ করেছে একটা মেয়ে। ভেতরে ঢুকে নিঃশব্দে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। ছেলেটাকে এখানে একা একা বসে থাকতে দেখে মাহীন প্রথমে থমকে দাঁড়ালো। নিরবে কিছুক্ষণ ম্লান আলোয় তাকে পরখ করল। কিছুক্ষণ পর সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। প্রথমে নিজে যেখানে বসেছিলো আধা ঘণ্টা পূর্বে সেখানে গেল। ছেলেটা একবার মুখ তুলে চাইল ওর দিকে। তারপর আবার মাথা নিচু করে বসে রইল। মাহীন সেই সিটের আনাচে কানাচে খুঁজে দেখার পর পাশের সিটের নিচে পরে থাকতে দেখল ছোট ব্যাগটিকে। সেটা তুলে নিয়ে পকেটে ভরল। তারপর দৃষ্টি ফেরাল ওর থেকে দুই সারি পরে বসে থাকা ছেলেটার দিকে। ধীরে ধীরে সিট গুলো পেরিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। প্রথমে একটু ইতস্তত করে তারপর ছেলেটা থেকে দুই সিট দূরে বসলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল। চারিদিকে নিরবতা এতটাই প্রখর যে একে অপরের নিশ্বাস ফেলার শব্দও কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে। অবশেষে মাহীন নিজের সিটে হেলান দিয়ে বসে শান্ত কন্ঠে বলল,

“একমাস পূর্বে যখন প্রথম স্কুলে আসলাম, সেই প্রথম দিনই সিক্রেট ট্রি থেকে একটা চিরকুট নিয়েছিলাম। সত্যি বলছি সিক্রেট ট্রি সম্বন্ধে আমার এর পূর্বে কোনো ধারণা ছিলো না। সেখানে প্রথমেই সেই চিরকুটে যা লেখা ছিলো, পড়ে বিস্মিত না হয়ে উপায় ছিলো না।”

বলে থামল ও। তারপর আর কিছু বললো না। দৃষ্টি সামনের সিটের দিকে নিবদ্ধ। ক্ষণকাল পর ছেলেটাই মুখে তুলে চাইল এবং প্রথম কথা বলল,

“কি লেখা ছিলো?”

“লেখা ছিল একজনের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জবানবন্দি।”

ছেলেটা বিস্মিত হয়ে সরাসরি তাকাল ওর দিকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকল। ওর মুখভঙ্গি দেখে যে কারোও মনে হবে যেন পৃথিবী বুঝি ধ্বংস হতে চলেছে। সে উৎকন্ঠিত গলায় বলল, ”

ম্যাচ ফিক্সিং!? হোয়াট দ্যা হেল! আমাদের টিমের কেউ ম্যাচ ফিক্সিং করেছে?”

কথাটা একটু বেশিই উচ্চস্বরে বলে ফেললো। ফলে প্রতিটি শব্দ খালি হলে প্রতিধ্বনিত হয়ে বাজতে লাগল। মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ছেলেটার দিকে। ওভাল আকৃতির মুখ, হালকা বাদামি চুল, ধূসর চোখ। সব মিলিয়ে যারপরনাই সুন্দর দেখতে।
মাহীন ভাবছে, ‘খুব চেনা চেনা লাগছে বিলকে। কিন্তু কোথায় দেখেছি? একই স্কুলে পড়ি আগে দেখে থাকতেই পারি। কিন্তু অনেক পরিষ্কার ভাবেই দেখেছিলাম। চেহারা সম্পুর্ণ মনে আছে।’

“হেই?” ছেলেটার ডাকে ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। তার কপালে গভীর ভাজ।

মাহীন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, “হ্যা ইয়ে আরকি ওই চিরকুট কত পুরনো জানি না। তবে আমার কাছে বেশিদিন আগের মনে হয়নি।”

ছেলেটা অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে নিজেকেই যেন বলল, “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার টিমের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।”

মাহীন বলল, “আমি শুধু বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের টিম হেঁড়ে গেলেও দোষটা তোমার একার নয়। তার জন্যে তুমি ব্যার্থ ক্যাপ্টেন নও। একটা টিম খেলায় জয় লাভ করলে ক্রেডিটটা খেলোয়াড় থেকে শুরু করে কোচরাও নেয়। আর হেরে গেলেই সব দোষ ক্যাপ্টেনের? মোটেও না। এই যেমন ধরো কেউ এবার ম্যাচ ফিক্সিং করে থাকতে পারে। পারে না? একবার করলে আবারও পারে। তাহলে সেটা তোমার দোষ? সবসময় কি আকাশ একই রকম পরিষ্কার ও উজ্জ্বল থাকে? এক টুকরো মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিলেই ব্যস। তাহলে যেকোনো মানুষই সবসময় নিজের সেরাটা দিতে পারে না। কিন্তু দেখো কঠোর পরিশ্রম করলে আর কে থামায় তোমাকে?”

মাহীন অন্য দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কথা গুলো বলে গেল। ছেলেটা এক দৃষ্টিতে ওর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে। মাহীন এবার ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

“বিল তোমার ভেঙ্গে পরলে তো চলবে না। কারণ তোমাকেই পুরো টিমকে সামলাতে হবে। আর সেই বিশ্বাসঘাতক কে নিয়ে এলার্ট করে দেওয়াটা আমার দায়িত্ব ছিলো। এখন তুমিই ইনভেস্টিগেশন করে বের করো সেটা কে। নাহলে ওইযে একটা কথা আছে না, এক ঝুড়ি আপেলের মধ্যে একটি নষ্ট আপেল থাকলে সবগুলো আপেলই নষ্ট হয়ে যায়। সেই অবস্থা দাঁড়াতে বেশি দিন নেই।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর উঠে দাঁড়াল। বলল, “আসি তাহলে।”

তারপর ঘুরে দাঁড়াল। এবং গেটের দিকে এগিয়ে গেল। নিরব হলে পদশব্দের মৃদু ঝঙ্কার উঠল। গেটের সামনাসামনি পৌঁছে গিয়েছে সেই সময় পেছন থেকে ছেলেটা উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল,

“ধন্যবাদ!”

ওর কথাটা ফাঁকা গ্যালারিতে প্রতিধ্বনি তুললো। মাহীন আর একবার ফিরে না তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসল। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। যত বেলা বাড়ছে ততই রোদের তাপ বাড়ছে। চোখ ছোট করে তাকাতে হচ্ছে। স্কুল চত্ত্বর এখন একদম নির্জনই বলা যায়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা চলে গিয়েছে। কেউ থেকে থাকলেও সে বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকবে। কড়া রোদের নিচে বসে কপাল পোড়াবে না। মাহীন হাঁটছে ও ভাবছে, ‘এখন মনে পরেছে। এই বিল মুরেই কে কোথায় দেখেছি। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার সাথেই এমন কেন হয়? এখানে আসার পর প্রথমে রায়েদের সঙ্গে দেখা হলো স্বাভাবিক ভাবে। তারপর জানলাম ওকে নিয়ে মেলা গ্যান্জাম। তারপর দেখা হলো র‌্যবিটের সঙ্গে। তখন ওকে চিনতামই না। তারপর জানলাম ওই নাকি স্কুলের টপ ফাজিল। শুধু তাই নয় রাবিতের বাড়ি থেকেও ঘুরে এসেছি। ওহ না! আমি তো এতক্ষণ খেয়ালই করিনি ব্যাপারটা। রাবিত আর রায়েদ ভাই হলে তো ওটা রায়েদেরও বাড়ি। ওএমজি! তাহলে আমি রায়েদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি। ওফ আমি তো ভেবেছিলাম রায়েদের বাড়ি হবে এডওয়ার্ড কুলিনের মতো ঠান্ডা নির্জন পরিবেশে। কিন্তু ঐ বাড়িটা তো দেখি উল্টা। ওর তো সুইট হোম সুইট টাইপের বাড়ি। এনিওয়েজ আর এই বিল মুরেইকে দেখে ভাবলাম হয়তো ওকে প্রথমই দেখছি। কিন্তু নাহ! আমার জীবন তো অনেক ড্রামাটিক। এই বিলই তো ওই ছেলেটা যে আমাকে প্রথম দিন C-2 নং কক্ষটা দেখিয়ে দিয়ে তাল গাছ নিয়ে বাণি দিয়েছিল। ওফ! কেন? কেন? কেন? আমার সাথে এত নাটকীয় ঘটনা ঘটে যে ভাইয়াকে বললে তো বিশ্বাসই করবে না। এর সাথে এত পরে পরিচয় জানাজানি হলেও সবার আগে ওর সাথেই দেখা হয়েছে। সাইলোহ আর নায়েল থেকেও আগে। কিন্তু আমার এই ব্যাপারটা কিছুতেই হজম হচ্ছে না যে ছোট বেলার বন্ধুরা কিভাবে একে অপরের চরম শত্রু হয়ে যেতে পারে? রায়েদের সাথে যে চার বছর আগে কি হয়েছিলো সে এক মস্ত বড় রহস্যই বলতে হবে। এমন রহস্য যে তিন গোয়েন্দা বা সার্লক হোমসকে দিয়ে যদি তা উন্মোচন করানো যায়। আর কি অদ্ভুত ভাবে এই তিনজনই একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে। র‌্যবিট রায়েদের ভাই। ওহ হ্যা! এটা আমার মাথায় আসেনি কেন। র‌্যবিট যদি রায়েদের ভাই হয় তাহলে অবশ্যই ও বলতে পারবে যে রায়েদের সঙ্গে কি হয়েছিলো? কিন্তু এক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। ও তো নাও জেনে থাকতে পারে। কারণ রায়েদের পারিবারিক কোনো সমস্যা আছে বলে তো মনে হয় না। অবিশ্বাস্য হলেও রায়েদের বাড়ি থেকে তো ঘুরে এসেছি। ওর মা এবং ওর নানি…দাদি নাকি নানি ওফ যাই হোক তাদের ব্যবহার সবকিছু মিলিয়ে ওর ঘরের পরিবেশটা তো আসলে খুব সুন্দর। এবং আসলেই পারিবারিক কিছু ঘটনা থেকে থাকলে অবশ্যই র‌্যবিট জানতো। এবং এতদিনে ওকে জিজ্ঞেস করে অন্যরাও জানতো। কেউ অন্ধকারে থাকত না। আর যদি ব্যাপারটা পারিবারিক না হয় তাহলে র‌্যবিট নাও জেনে থাকতে পারে। হয় ও জানেই না কারণটা অথবা হয় ও জেনেও মুখ বন্ধ করে রাখে। এবং এটা কোনো ভাবেও বন্ধুদের জন্য হতেই পারে না। বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে মানুষ একেবারে এমন হয়ে যায় না। বরং কোনো একটা ঘটনা ঘটেছে যার জন্য ওর বন্ধুত্বই নষ্ট হয়েছে। তাহলে কি এটা কোনো প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক সমস্যা হতে পারে? কিন্তু ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড কখনো থেকে থাকলে তো অন্যরাও দেখতো যদি সে এই স্কুলেরই ছাত্রী হতো। অন্য দিক থেকেও সে এসে থাকতে পারে তাই তাকে কখনো কেউ দেখেইনি। যাই হোক আমিই এখন ওভার থিংকিং করছি বোধহয়। রায়েদের ব্যাপারে আমারই বা এত মাথা ঘামানোর কি আছে? এত মাথা ঘামাই দেখেই না জেনেট ভাবে আমি নাকি ওকে পছন্দ করি। ওয়েল ও দেখতে সুন্দর সেটা আলাদা ব্যাপার। তবে আমি আর ওর লাইব্রেরির ধার দিয়ে যাচ্ছি না। অর্থাৎ আমাদের অফিসিয়ালি দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এবং আসলেই ওকে নিয়ে বেশি চিন্তা করাও উচিৎ না।’
মাহীন হাঁটতে হাঁটতে স্কুল থেকে অনেকক্ষণ পূর্বেই বেরিয়ে গেছে। এখন রাস্তার পাশের সাইড ওয়াক ধরে হাটছে। হঠাৎ একটা মেয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভ্যালি গার্ল এক্সেন্টে বলল,

“হেই দেয়ার! ইওর হ্যান্ড ব্যাগ ইজ ওয়ান্ডারফুল!”

মাহীন চমকে উঠল। মেয়েটার দিকে চেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে স্মিত হেসে বলল,”থ্যাঙ্কস বিউটিফুল!”

মেয়েটা জবাবে মিষ্টি করে হেসে চলে গেল। মাহীন যখন ভালো ভাবে চারিদিকটা পরখ করল তখন ও রিতীমত বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে গেল। ও আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্যান্টা মনিকার বিখ্যাত রাস্তা “থার্ড স্ট্রিট প্রমোনেড” এ এসে থেমেছে। স্যান্টা মনিকা হাই স্কুল থেকে মাত্র পাঁচ ছয় মিনিটের দূরত্বে এই রাস্তা। থার্ড স্ট্রিট প্রমোনেড শুধু মাত্র পথচারীদের জন্য। এখানে কোনো যানবাহন চলে না। কারণ এটা এককথায় একটি শপিং মল যা রাস্তার ওপর তৈরি করা হয়েছে। এখানে বিশটির মতো সিনেমা হল আছে। একশোটির বেশি দোকান। এবং অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। তাছাড়া রাস্তার পাশে সাইড ওয়াকের মধ্যে মিউজিসিয়ান এবং সার্কাষ্টিক ওর্নামেন্টস নিয়ে তো অনেকে বসেই আছে। রাস্তার পাশে সাইড ওয়াকগুলোর গোড়ায় ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তাল গাছ। এবং তাল গাছের পত্র ছায়ায় আবার তার থেকে খাটো অসংখ্য গাছ বিস্তর ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব গাছগুলোকে আরোও একটু বেশি সুন্দর রুপ দিতে বেশির ভাগের ডাল পালায় বৈদ্যুতিক তাঁরওয়ালা বর্ণিল মরিচবাতি জড়িয়ে পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় প্রচুর ভির। ঝকঝকে ছবির মতো জায়গাটা। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন বর্ণের মানুষরা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা ধরে। মাহীন মুগ্ধতায় কতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তা ও নিজেও বলতে পারবে না। আপনা আপনি কখন ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে তাও বলতে পারবে না। ও ধীরে ধীরে শুধু হাঁটছে ও চারিদিকে মণি ঘুরিয়ে সবকিছুকে একসাথে ধারণ করার চেষ্টা করছে। এদিক ওদিক প্রচুর রঙের সমারোহ। দোকানগুলো একেকটা একেক রঙ্গে রাঙানো। আবার এদিক ওদিক নানা রঙের ছোট ছোট তেকোনা পতাকা উড়ছে। দেওয়াল গুলোয় রঙিন মুরাল অর্থাৎ দেয়ালচিত্র আঁকা। পশ্চিমাদের ভিন্ন সংস্কৃতি পদে পদে ভাবতে বাধ্য করে। কি অদ্ভুত না এরা। এই তল্লাটে রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে যাকে চেনেও না জানেও না তাকে হাসি মুখে গ্রিট করে যায়। একটা কমপ্লিমেন্ট দিয়ে যায়। তাতে হয়তো কোনো মানুষের সারাটা দিনও ভালো হয়ে যায়। মনে হয় যেন নাহ এখনো এমন মানুষ আছে যারা তোমাকে চেনেও না, স্টিল তোমাকে এপ্রিসিয়েট করবে। বাংলাদেশে থাকতে যখনই এর ছবি দেখত মাহীন তখনই ভাবত, ইশ বাবা ওই দেশটায় থাকে না শুধু, ওই স্টেটেই থাকে। আর আজ সবকিছু কত আলাদা। সে নিজেই এখানে চলে এসেছে। যেন নিজের স্বপ্নের মধ্যে অনপেক্ষিত ভাবে ঢুকে গিয়েছে। আহা হঠাৎ এখন ভাইকে অনেক মিস করছে। আগে যখন দেশে ছিল দুই ভাই বোন মিলে কত কত রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছে। সেই নীলক্ষেতে শুধু একটু বইয়ের দোকানের মামাদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার বাহানায় ঢুকা আর এক ডজন বই নিয়ে বের হওয়া। বাইরে বের হলেই ফুচকা খাওয়ার কম্পিটিশন তো মাস্ট ছিলো। বইমেলার সময় বারবার ভাইকে বিরক্ত করে টেনে নিজের সাথে বই মেলায় নিয়ে যাওয়া। দুনিয়ার বই কিনে সব ব্যাগগুলো নাইমের হাতে চাপিয়ে দিয়ে নিজে মুক্ত হস্তে ঘুরে বেড়াত। আর এখন? এখন তো নতুন বন্ধুদের পেয়ে ভাইয়াকে ভুলেই গিয়েছে প্রায়। আগে সুখ দুঃখের একমাত্র সাথী ভাইয়া ছিলো। যতই মারামারি কাটাকাটি করুক না কেন দিন শেষে ওর সামনেই দুনিয়ার সমস্যার কথা উগলে দিত। আর গত একমাসে কত কি ঘটে গেল মাহীনের জীবনে কিছুই জানানো হয়নি ভাইকে। আহ! যদি এখন ভাইয়াও এখানে থাকত ওর সাথে। কি মজাটাই না হতো! তখনই টেইলর সুইফটের ব্ল্যাঙ্ক স্পেস গানটা বেজে উঠল, অর্থাৎ ওর মোবাইল বাজছে। মাহীন চমকে উঠলো। তারপর তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনে দেখল, মা লেখা। সাথে সাথে কপাল কুঁচকে গেল। ভাবল, ‘ইয়া আল্লাহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম মায়ের মধু আর দুধের কথা। এখন কি বলবো মাকে?’ ভাবতে ভাবতেই একবার শুকনো ঢোঁক গিলে কলটা রিসিভ করল। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে হুংকার দিয়ে মিসেস নাসরিন বললেন,

“মাহীন ফারুকি! তুই এত খামখেয়ালী কেন? কোনো আক্কেল জ্ঞান আদৌ আছে তোর? সেই এক ঘন্টা আগে বলেছিলাম মধু আর দুধ আনতে। তোর স্কুল থেকে বাসায় আসতে সাত আট মিনিট লাগে। সেখানে তুই একঘন্টা ধরে কোথায় আছিস? ”

মাহীন শুকনো কন্ঠে আমতা আমতা করে বললো,
” আসলে মা আমি স্কুল থেকেই মাত্র বের হলাম। তুমি যখন কল দিয়েছিলা তখনই বের হতেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু একটা কাজে আটকে গেছিলাম।”

“ওহ তাই না? আমাকে কি ভেবেছিস তুই হ্যা? তোকে আমিই জন্ম দিয়েছি। ছোট বেলায় এসব বাহানা দেওয়ার বহুত এক্সপেরিয়েন্স আছে আমার। আর আমি তোর চালবাজি বুঝবো না।? যেখানেই আছিস দুই মিনিটের মধ্যে ঘরে আয় নাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।”

লাইন কেটে গেল। মাহীন হতবিহ্বল হয়ে রইল। ভাবল, ‘মার এগুলো বাহানা ইউজ করার অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে? তাহলে উনিও আমার মতোই ছোট বেলায় মিচকা শয়তান ছিলেন? বাহ নাহলে আমি এমন হলাম কি করে।’ ভেবেই মাহীনের ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।