এল এ ডেইস পর্ব-২+৩

0
272

#এল_এ_ডেইস
পর্ব – ২
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

যান্ত্রিক দেয়াল ঘড়িটায় সময় দেখাচ্ছে, সাতটা বেজে ছয় মিনিট। ছয়টি চেয়ার বিশিষ্ট ওক কাঠের চতুর্ভুজ আকৃতির টেবিল। মার্কিন মুল্লুকে আলাদা ডাইনিংয়ের বালাই নেই। রান্নাঘরের সঙ্গে লাগোয়া ডাইনিং। ড্রইংরুমে পাশে কাঁচের থাই গ্লাস দেওয়া স্লাইডিং ডোর। এ পথ একাধারে খিরকিজানালা এবং বাগানে যাওয়া রাস্তা। আজ তিন বছর পর একটি পরিবার পুনরায় একত্রিত হয়েছে একই ছাদের নীচে। এই পরিবারে কারোর মধ্যে দূরত্ব কোনো কালেই ছিলো না। শুধু ছিলো স্থান ও সময়ের দূরত্ব। সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল স্নিগ্ধ সকাল। তবে পৃথিবীর এক গোলার্ধের সময়, পরিবেশ, সংস্কৃতি ছেড়ে সম্পূর্ণ অন্য গোলার্ধে এসে পরায় এই তিনজন মানুষের শরীর ও মন কোনোটাই মানিয়ে নিতে পারছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যাটা সময়ই করছে। কী অদ্ভুত নিয়মে চলে এই সময়। এখানে যখন আমেরিকানরা সূর্যের আলো গায়ে মাখে তখন অন্ধকারাবৃত বাংলাদেশে মানুষ টুপ করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।নাস্তার টেবিলে বসেও ওদেরও সেই একই অবস্থা। মন মস্তিষ্ক ঘুম ঘুম করে। নাইম এবং মিসেস নাসরিনকে ঘুমের চক্করটা একটু বেশিই অসুবিধায় ফেলেছে। মাহীনের আবার এক অদ্ভুত গুন রয়েছে বা অভ্যাস রয়েছে। তা হলো ও অনায়সে যেকোনো সময় ঘুমিয়ে পরতে পারে। ঠিক তেমনিই রাতে ঘুমনোর সময় অর্থাৎ বাংলাদেশে যখন দিনের আলো ছিলো সেই সময় ও আরামসে ঘুমের পাটটা চুকিয়ে ফেলেছে। তবুও এখনো ঘুমের রেশটা হালকা টানে ধরে রেখেছে ওকে। নাস্তায় বেশি কিছু করেননি মিসেস নাসরিন। টোস্ট এবং ডিম পোঁচ ও চা। মাহীন ও নাইম ভিন্ন মিসেস নাসরিন ও মি.মোর্শেদ চা নিয়ে বসেছেন। মাহীন কখনো চা ছুঁয়েও দেখে না। ওর চাই শুধু কফি। এবং নাইমের ভাগ্যে জুটেছে এক গ্লাস সাদা দুধ। তাই তো ওর যত আপত্তি।সে হরলিকস খেতে অভ্যস্ত। কাজেই শুধু দুধেই চলবে না। মিসেস নাসরিন বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললেন,
“তুই আর কবে বড় হবি নাইম? অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছিস এবার। এই বয়সে কে হরলিকস দিয়ে দুধ খায়?”
নাইমের তীব্র কন্ঠে বলল,
‘অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছি এটা কি প্রতি কথায় মনে করিয়ে দিতে হবে? আমার তো এখনো উনিশ বছর বয়স। আর বড় হওয়ার এই এক জ্বালা। যত বড় হবা তত রুলস এন্ড রেগুলেশন মেনে চলতে হবে কেন?’ শেষের কথাটা বলার সময় ওর মুখের বিরক্তি প্রকাশ পেল। মি.মোর্শেদ মুখের সামনে পেপার মেলে ধরে আছেন। মাহীন চুপচাপ নিজের টোস্টে পিনাট বাটার লাগাতে ব্যস্ত। মিসেস নাসরিন বললেন,
“মাহীনকে দেখ। কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা করেনা। যা দেই খেয়ে নেয়। আর তুই, এখনো সবকিছু নিয়ে ঢং করিস।”
নাইম লম্বা এক শ্বাস নিল। এবার নিজেকে প্রস্তুত করল কিছু বলার জন্য। নাটকীয় ভঙ্গিতে বিজ্ঞের মতো বলতে শুরু করল,
“মা সব মানুষের পছন্দ অপছন্দ একই রকম হয়না। আর ধরো সত্যিই যদি পৃথিবীর সব মানুষের পছন্দ একই রকম হতো তাহলে কি হতো। সাপোস সব মানুষের গণহারে সাইন্স বিষয়টা পছন্দ হয়ে গেলো। এখন সবাই সাইন্স পড়তে লাগলো। আর কোনো সাবজেক্টই কারোও পছন্দ হচ্ছে না। তাহলে আর্টস, কমার্স এবং অন্যান্য বিষয় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এবং সবাই সাইন্স পড়ে ধরো বিজ্ঞানী হতে চায়। এখন পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষই যদি সাইন্স পড়ে।তাহলে অন্যান্য কাজ কে করবে? খাদ্য উৎপাদন কে করবে? অন্যান্য ব্যবসা বানিজ্য কে করবে? আর হ্যা এই সাইন্স পড়ানোর জন্য টিচারও তো প্রয়োজন।সবাই বিজ্ঞানী হলে টিচার কে হবে? আর…।”
ওর কথার মাঝখান দিয়ে মিসেস নাসরিন অতিষ্ঠ কন্ঠে বললেন,
‘থাম! এক্ষুনি থাম। আমার মনে হচ্ছে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে। তুই একদিন আমাকে মানসিক রোগী বানিয়েই ছাড়বি।’ বলে তিনি ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগলেন। কপালের কোণে জমা হওয়া সামান্য ঘামটুু হাত দিয়ে মুছে ফেললেন। বোধহয় প্রকৃতপক্ষেই তার মস্তিষ্কের কোষগুলো নাইমের অর্থহীন প্যাচালো কথার প্যাচে পরে গিয়েছে। মাহীন চাঁপা হাসছে। মি.মোর্শেদ পেপারটা ভাজ করে রাখলেন। তার ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি।তিনি আমুদে কন্ঠে বললেন,
“আচ্ছা নাইম তোর গত বছর কক্সবাজারের ঘটনাটা তো শোনা হলো না।ওটা বলতো।’ ওনার কথা শেষ হলো কি হলো না, দেখা গেলো নাইমের সম্পূর্ণ মুখ মন্ডল টমেটোর মতো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চোখে মুখে কেমন জানি এক বিব্রত ভাব। মাহীন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। দুষ্টুমির করে বলল,
” ভাইয়া তোর মুখটা তো একদম ঠিক এক ছোট পলিথিনে টমেটো সস ভরলে যেমন লাগে তেমন হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এক প্যালেট ব্লাস নিজের মুখের ওপর ঢেলে দিয়েছিস।”
নাইম ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি হানলো। মনে হলো চোখের দৃষ্টি দিয়েই ও মাহীনকে ভস্ম করে দিতে চাইছে।
মাহীন বাবার দিকে তাকাল। এবার হাসাহাসি বাদ দিয়ে কন্ঠে কিছুটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলল,
‘বাবা আমি বলছি ঘটনাটা।’
নাইম সাথে সাথে ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
“খবরদার যদি মুখ খুলেছিস তাহলে তোর একদিন কি আমার তিনশো পঁয়ষট্টি দিন।”
মাহীন ওর বড় বড় ধারালো নখ দিয়ে নাইমের হাতে আঁচড় দিতেই ও ঝট করে হাতটা সরিয়ে মাহীনকে মুক্ত করে দিলো। মাহীন এবার ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“তোর সাহস তো কম না আমার মুখ বন্ধ করতে যাস। ঘটনাই এমন ঘটেছে যে আমি আর কি বলবো।” নাইম ওর হাতের যেই জায়গাটায় আঁচড় লেগেছে সেখানে অপর হাত চেপে ধরে মুখ কুঁচকে বলল,
“ইশ আমার হাত ভয়ংকর জ্বালা করছে। জঙ্গলি মেয়ে একটা। নিজেকে মোগলি ভাবিস? কে রাখে এত বড় বড় ধারালো নখ।”
মাহীন ভেংচি কেটে বলল,
‘তোর জ্বালায়ই এত বড় বড় নখ রেখেছি। নাহলে তোকে খামচি দিতাম কি করে। আর আমি মোগলি হতে যাব কেন? আমি আরোও ভয়ংকর বেলাট্রিক্স ল্যাস্ট্রেঞ্জ।’
মি. মোর্শেদ বিস্ফারিত চোখে এতক্ষণ ওদের দুজনকে পরক্ষ করছিলেন। এবার শুধু মিসেস নাসরিনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন,
“তারমানে তুমি ফোনে যেইসব ঘটনা আমাকে বলতে সেইগুলো সত্যি ছিল?”
মিসেস নাসরিন অবাক কন্ঠে বললেন,
“এই ছিলো তোমার মনে এতদিন! আমার একটাও কথা বিশ্বাস করতে না তুমি? তুমি ভাবসো তোমার দুই ছেলে মেয়ে ধোয়া তুলসি পাতা? এবার বিশ্বাস হচ্ছে ওরা আসলে একজন রাশিয়া আরেকজন ইউএস। কখন কে কার ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।”
মি.মোর্শেদ নিঃশব্দে হেসে উঠে বললেন,
“যাক তাহলে এবার আমার বাড়িটায় ওদের দুজনের মধ্যে যুদ্ধ লাগে লাগে অবস্থার জন্য একটা টান টান উত্তেজনা ভাব থাকবে।
.
.
.
নাস্তা শেষ হওয়ার পরই মি.মোর্শেদ মাহীনকে তৈরি হওয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগলেন। মাহীন নেভি ব্লু রঙের একটা কুর্তি সঙ্গে জিনস পরল এবং গলায় একটা ওড়না পেঁচিয়ে নিল।ওর লং বব ছাটে কাটা চুলগুলো ছেড়েই রাখলো। শ্যামলা গড়ন ও ওভাল আকৃতির মুখ। হৃদয় আকৃতির ঠোঁট ও কাঠ বাদামের মতো কাজল কালো মনি বিশিষ্ট নয়ন। প্রশস্ত নাক ও চিকন থুতনি। দেখতে খুব সুন্দরও বলা যায়না আবার অসুন্দরও বলা যায়না। মোটামুটি মিষ্টি একটা মুখ। চোখে কখনো একটান কাজল দিতে ভোলে ও। মাহীন তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসতেই মি.মোর্শেদ মাহীনকে নিয়ে তাদের নীল ক্যাডিলাক রাস্তায় নামালেন। এখান থেকে স্যান্টা মনিকা হাই স্কুল এতটাই কাছে যে হেঁটেই অল্প কিছুক্ষণে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। মাথার ওপর বিস্তৃত পরিষ্কার নীল আকাশ। রাস্তায় নেই কোনো ধুলাবালি। রোদের আলোয় মেখে রুপালি রাস্তা চকচক করে। চলাচলরত গাড়িগুলোও রোদে চিকচিক করে।
গাড়িতে মন থিতু হওয়ার পূর্বেই ওরা পৌঁছে গেল গন্তব্যে। মাহীনের মনে উচ্ছাস যেন ধরে না। লস এঞ্জেলসে তো এসে পরেছে, এবার এখানকার হাই স্কুলেরও সদস্য হতে চলেছে ও। অর্থাৎ বলা যায় পাকাপোক্ত ভাবে এল এ সিটিজেন। যদিও গ্রিন কার্ড পেতে দেরি আছে। গাড়ি থেকে নেমে সামনে বড় গেট। তার ওপর ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লেখা “স্যান্টা মনিকা হাই স্কুল”। সংক্ষেপে “সামোহি (SAMOHI)”। মাহীনের শিরদাঁড়া বেয়ে আনন্দের শ্রোত বয়ে গেল। বাংলাদেশে থাকতেই গুগলে এই স্কুল সম্বন্ধে সার্চ দিয়ে দেখেছে। তখন থেকেই উদগ্রীব হয়ে আছে সচক্ষে স্কুলটা দেখার জন্য। মি.মোর্শেদ সামনে এগিয়ে যেতেই মাহীন তার পেছন পেছন এগিয়ে গেল। ভেতরে প্রবেশ করেই আরোও বিস্মিত হলো। স্কুল ক্যাম্পাসটাকে ছবিতে যত বৃহৎ দেখিয়েছিল, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি বড়। মাহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিকে পরোখ করতে করতে ধীর পদক্ষেপে হাঁটছে। স্কুল বিল্ডিং সম্পূর্ণ হালকা বাদামী রঙের। চারটি তলা রয়েছে। ডান দিকের বিশাল মাঠটা কম করে হলেও সত্তর আশি ফিট লম্বা তো হবেই। বাম দিকে গোল মতো একটা চত্ত্বর। তার এক পাশে বড় বড় অক্ষরে হলদে রঙের “সামোহি” লেখাটির স্ট্যাচু বানিয়ে রাখা। মি. মোর্শেদ গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। মূল প্রবেশ দ্বারের সামনে অন্তত তিন ফুট উঁচু লালচে ইটের সিঁড়ি দেয়া। মাহীন ও মি.মোর্শেদ ভেতরে প্রবেশ করেই একদম সোজা করিডোর ধরে হেঁটে গেলেন। ডান দিকে একটা বাক ঘুরতেই একটা কাঠের দরজার সামনে এসে থামলেন মি.মোর্শেদ। তারপর দরজায় টোকা দিলেন। ভেতর থেকে এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো,
“কাম ইন।” উনি দরজাটা এবার খুললেন। ভেতরে প্রবেশ করার পর মাহীনও ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে ওক কাঠের তৈরি ডেস্কের ওপাশে এক কৃষ্ণ কালো মধ্য বয়সি লোক বসে আছেন। তিনি হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে মি.মোর্শেদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর বললেন, “তাহলে ওই আপনার মেয়ে ম্যহিন।” কথাটা বলেই উনি মাহীনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন,
“হাউ আর ইউ মাই গার্ল?” মাহীন মি.মোর্শেদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তরে হালকা হেসে বললা,
“আই এম ভেরি ফাইন স্যার, থ্যাংক ইউ।”
মি.মোর্শেদ বললেন,
“ওহ হ্যা পরিচয়ই তো করিয়ে দেইনি। উনি এই স্কুলের প্রিন্সিপাল ডক্টর এন্টোনি সেলটন। প্রিন্সিপাল সেলটন বললেন,
“তাহলে চলেন আগে ওর ভর্তির কাজটা সেরে ফেলি। তারপর আপনার সঙ্গে অনেক কথা হবে।” তারপর মাহীনের দিকে ফিরে বললেন,
“তো মিস মাহীন ফারুকী আপনি চাইলে ততক্ষণে স্কুলটা ঘুরে ফিরে দেখতে পারেন কোনো সমস্যা নেই। আটটা থেকে ক্লাসের জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে আসা শুরু করবে। তখন ভিড় বেড়ে যাবে।”
মাহীন অবাক কন্ঠে বলল,
“আমি এখনই স্কুলটা ঘুরে দেখতে পারবো?”
প্রিন্সিপাল সেলটন হেসে বললেন,” অবশ্যই, তবে তার আগে একটি কাগজে তোমার সই লাগবে। সেটা করে যেও।”
মাহীনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। মি.মোর্শেদ মুচকি হেসে বললেন,
“আবার হারিয়ে যাইস না।”
মাহীন বলল,
“না বাবা কিছু হবে না।”
তারপর প্রিন্সিপাল সেলটন ড্রয়ার হতে একটা কাগজ বের করে সেখানে মাহীনের সাক্ষর নিলেন। তারপর মাহীন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসল। আনন্দে নেচে উঠতে ইচ্ছে করলো। ঠোঁটের কোণ থেকে হাসির রেশ মুছছেই না যেন। মাহীন হাটতে হাটতে গেটের সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। একবার ভাবলো ভেতরে যাবে। আবার ভাবলো নাহ বাইরে থেকে ঘুরে আসবে। শেষে গেটের বাইরেই বেরিয়ে গেল। এইসময় কড়া রোদ উঠেছে। স্কুল প্রাঙ্গন রোদে রৌদ্রজ্জ্বল। দেখা গেল সামনের বড় গেট হতে একে একে ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। মাহীন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। কেউ কেউ সাদা চামড়ায় মোড়া সোনালি কিংবা বাদামি কেশ ধারী। কেউ কেউ শ্যাম গড়নের আবার কেউ কেউ কৃষ্ণ বর্ণের। কারোও চোখের মণি নীল, কারোও সবুজ, কারোও আবার ধূসর কিংবা বাদামি। দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিক পরখ করতে লাগলো। কেউ কেউ একা একা আসছে আবার অন্যরা দল বেঁধে হৈচৈ করতে করতে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মাহীনের মনে এতক্ষণ যেই আনন্দ বয়ে বেড়াচ্ছিল, মুহূর্তেই যেন সেগুলো মিলিয়ে গেল। এক অজানা অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওকে। এতগুলো ছেলেমেয়ে, তাদের আলাদা আলাদা পার্সোনালিটি, চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। হ্যা এখানকার যেই উচ্ছন্নে যাওয়া সমাজরীতি তাতে বাংলাদেশের যেকোনো রক্ষণশীল পরিবাবের ছেলেমেয়েই সহজে মানিয়ে নিতে পারবে না। মনে মনে ভাবল,
আমি এখনো এই স্কুলের অতিথি মাত্র। নতুন দেশ ও নতুন সংস্কৃতি। এখানকার ছেলে মেয়েদের চাল চলন চিন্তা ভাবনা অন্য রকম। এদের সাথে তাল মিলিয়ে কিভাবে চলবো আমি? এবং আমি ভর্তি হচ্ছি দশম গ্রেডে। আগামী মাত্র দুই বছর অর্থাৎ টুয়েলভ গ্রেড পর্যন্তই এখান কার যাত্রা। তাছাড়া গত দশ বছর ধরে যারা এখানে পড়াশোনা করছে সকলেরই নিজের বন্ধু বান্ধব, অথবা বন্ধুমহল রয়েছে। আমি নতুন এসে কিভাবে মিশবো ওদের সাথে?’ এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ওর কপাল কুঁচকে গভীর চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। ধীর পদক্ষেপে গোল চত্ত্বর ধরে হাঁটছে ও। কিছুটা আনমনা। হঠাৎ সামনে দেখলো ওর থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে দুজন ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা বেশ লম্বা চওড়া এবং ফ্যাকাসে দেখতে। এবং মেয়েটার ততটাই শীর্ণকায় শরীর। মেয়েটাও যথেষ্ট ফ্যাকাসে দেখতে এবং সোনালি চুল। মেয়েটা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলো। পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে তাহলে আমি আজ আসছি। আর হ্যা ভুলেও সিগারেট ধরলে তোমার খবর আছে”। ছেলেটা মুখ টিপে হাসলো। বলল,
“আহা আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি প্রমিজ। তুমি এত চিন্তা করো না।”
মেয়েটা চিন্তিত চিত্তে বলল,
“জানি কিন্তু তবুও বলছি। এমন কিছু করলে আমিও মেনে নিবো না তোমার মাও মেনে নিবে না। মনে রেখ।” বলেই পেছন ঘুরে চলে গেল। মাহীন মুখ বাঁকা করল। ভাবল, ‘এ কোথায় এসে পরলাম আমি। এদের কালচারের উচ্ছন্নে যাওয়া দিকটার কথাও মাথায় রাখতে হবে।’ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। ছেলেটা চত্ত্বরের অপর দিকে অগ্রসর হলো। মাহীন অল্প কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পেছন ফিরলো আবার স্কুল বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। তখনই দূর থেকে দেখল সেই ছেলেটার হাতে কি থেকে যেন ধোঁয়া উঠছে। কৌতুহল বসত কয়েক পদক্ষেপ এগিয়ে যেতে বুঝল সেটা সিগারেট। মাহীন ভাবল, কি আশ্চর্য ফাজিল একটা ছেলে! এখনি গার্লফ্রেন্ড কে প্রমিজ করলো সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে বাহ! হঠাৎ কি মনে হতেই জিনসের পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করলো। এবং ক্যামেরা অন করে স্ক্রিন জুম করে ছেলেটার ভিডিও করলো। বেশ কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও করে বন্ধ করে দিলো। তারপর আনমনে বাঁকা হাসলো এবং ভাবলো,
‘কখনো না কখনো কাজে লাগবে তোমাকে শায়েস্তা করতে।’ভেবেই গেটের দিকে এগিয়ে গেল। তবে গেটের ভেতর পুনরায় প্রবেশ করার আগেই মি.মোর্শেদকে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তার হাতে কয়েকটা ভাজ করা কাগজ। তাকে দেখে মাহীন থমকে দাঁড়ালো।
মি.মোর্শেদ হাসি মুখে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোর এডমিশন হয়ে গেছে। এখন পুরো দমে ক্লাস চলছে। তুই আগামীকাল থেকেই স্কুলে আসতে পারবি।” মাহীন উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“আল্লাহ আমি কালকেই আসতে পারব?”
“হ্যা।তুই এখন সফোমোর। দশম গ্রেডের শিক্ষার্থীদের সফোমোর (Sophomore) বলে।” মাহীন ঈষৎ হাসলো। তারপর মি.মোর্শেদ বড় প্রবেশ দ্বারের দিকে অগ্রসর হলেন। মাহীন ওনার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলো। বড় গেটের দুটো পাল্লাই একদম হা করে খোলা। এইসময় শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসার ঢল নেমেছে যেন। ভীড় পার করে বাবা ও মেয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা একদম গেটের সামনেই পার্ক করার অনুমতি নেই। স্কুলের পার্কিং রয়েছে। আবার মাহীন ও মি.মোর্শেদ গাড়িতে চড়ে বসলেন। উনি গাড়ি স্টার্ট দিতেই মাহীন জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা এবার কি আমরা সোজা বাড়ি যাবো?’

‘না তোর ফোনের সিম কার্ড ও নম্বরটা পাল্টাতে হবে।’ মাহীনের এতক্ষণ মনে পরলো যে ওর বাংলাদেশী সিম কার্ড ও নম্বর এখানে কাজ করবে না। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মাহীন বলল,
‘এবং মা ও ভাইয়ার নম্বর?
মি.মোর্শেদ মুচকি হেসে বললেন,
“চিন্তা করিস না,তোর মা এবং নাইমের মোবাইল আমি সাথে এনেছি।” তারপর একটু থেমে বললেন,
“আচ্ছা তোকে সাইকেল কিনে দিলে কেমন হয় বলতো?”
মাহীন অবাক কন্ঠে বলল,
“সাইকেল! সত্যি!
মি.মোর্শেদ বললেন,
“অবশ্যই। দুইটা সাইকেল কিনবো তোর জন্য একটা, নাইমের জন্য একটা। কারণ আমি কাজে ব্যস্ত থাকবো সবসময় তোদের জন্য গাড়ি নিয়ে বের হতে পারব না। তবুও এটা ক্যালিফোর্নিয়া। এখানে সাথে কোনো ট্রান্সপোর্ট না থাকলে চলা মুশকিল।” মাহীন উপরে নিচে মাথা ঝাকিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেরাল। এখন দিনের উজ্জ্বলতার ছোঁয়ায় শহরটিকে দেখতে পাচ্ছে আরোও গভীর ভাবে। মনে মনে ভাবলো, আহা আরোও ভালো ভাবে শহরটাকে দেখতে পাবো যখন আমি রাস্তার পাশের সাইডওয়াক গুলো ধরে ভীড়ের মাঝ থেকে হাঁটব। এইসব দোকান গুলোর মাঝে যেটায় ইচ্ছা সেখানে ঢুকে মন মত কিছু কিনতে পারবো। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারবো। এই সুন্দর শহরের যত্নে থাকা এখানকার অপরুপ প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখতে পারবো। এবং সাইকেল চালিয়ে হাওয়া খেতে খেতে গোটা শহরটাকে চোষে বেড়াতে পারবো।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩
লেখিকাঃ মাহীরা ফারহীন

ধুপধাপ পা ফেলে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মাহীন নিচে নেমে আসলো। কাঠের সিঁড়িতে পা ফেলার ধপধপ শব্দ করে উঠলো। কাঁধে ওর বই খাতা ভরতি ব্যাগ ঝুলছে। গতকাল সন্ধ্যায় মি.মোর্শেদ ওর দশম গ্রেডের সব বইখাতা কিনে এনেছেন। রান্না ঘর থেকে মিসেস নাসরিন উচ্চস্বরে বললেন,
“একটু আস্তেধীরে নামা উঠা কর। পরে তো হাত পা ভাঙ্গবে।”
রান্নাঘরের সামনেই বসার ঘর। মি.মোর্শেদ সেখানেই সোফায় বসে সকালের খবরের কাগজ পড়ায় ব্যস্ত ছিলেন। বসার ঘরের বাম দিকে কোনো দেয়াল নেই। রয়েছে কাঁচের থাই স্লাইডিং গ্লাস। এখান থেকে সরাসরি পেছনের বাগানে বের হওয়া যায়। নাইম সোফায় বসে গেম খেলতে ব্যস্ত। মাহীন বলল, মা আমি স্কুলে যাচ্ছি। বলেই দরজার দিকে পা বাড়ালো।
তবে মাঝপথে বাঁধা দিয়ে মি.মোর্শেদ বললেন,
“দাঁড়া অপেক্ষা কর। আমি গাড়ির চাবি নিয়ে আসছি।”
মাহীন থমকে দাঁড়ালো। তারপর পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
“বাবা আমি একা স্কুলে গেলে কি খুব সমস্যা হবে?”
মি.মোর্শেদ বিভ্রান্তি ভরা নয়নে চাইলেন। তারপর বললেন,
“তুই এখন ওই পর্যন্ত হেঁটে পৌঁছতে পারবি? এখনো তো তোর সাইকেল কেনা হয়নি।”
মাহীন সোফার পাশে গিয়ে দাঁড়াল এবং অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
“বাবা প্লিজ, আমি তো গতকাল দেখেই এলাম জায়গাটা কোথায়। এবং এখন গুগলস ম্যাপ থাকতে কি আর কোনো কিছু খুঁজে পেতে চিন্তা করতে হয়?”
রান্না ঘর থেকে মিসেস নাসরিন রীতিমতো হুংকার দিয়ে বললেন,
“খবরদার তুমি যদি ওর ভণ্ডামি কথাবার্তায় সায় দিয়েছ! আজকে তোর বাবা তোকে দিয়ে আসবে আর কোনো কথা নেই। সাইকেল না কিনে দেওয়া পর্যন্ত তুই কোথাও একা যাবি না।”
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হতাশ ভঙ্গিতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। বাড়ির সামনেই স্যাকামোর গাছের ডালপালা হালকা বাতাসে দুলছে। গাছের পাতার ছাউনি ভেদ করেও ঝুড়িঝুড়ি হয়ে রোদ এসে পরছে। সামনের দিনগুলোতে এই অচেনা তল্লাটে একাই চলাফেরা করতে হবে। বাংলাদেশের মতো প্রতিমুহূর্তে সাথে সাথে কোতোয়ালগীরী করার মতো কারোও সময় নেই এখানে। সকলের সময়েরই দাম আছে। যার চলতে হবে সে নিজের ওপর নির্ভর করেই চলবে। তা জানা সত্ত্বেও নতুন এক অনুভূতি এই শহরের মাঝে। এই শহরে একা চলাফেরা করার এক অদম্য ইচ্ছা মাহীনের। যদিও তা কিছুদিন বাদেই অতি সাধারণ নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে যাবে। থাকবে না আর কোনো অদম্য উচ্ছাস। মি.মোর্শেদ নীল ক্যাডিলাক কে গ্যারাজ থেকে বের করে আনতে ছয় সাত মিনিট সময় ব্যয় করলেন। তারপর মাহীন গাড়িতে উঠে বসলো। আজ ও একটা হলুদ রঙের কুর্তি পরেছে সঙ্গে একই নীল জিনস এবং গলায় একটা ওড়না ঝুলিয়েছে। সবসময়ের মতোই চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। গাড়ি রাস্তা ধরে চলতে শুরু করেছে। বেশ কিছুক্ষণ মাহীন মুখ গোমড়া করে নিশ্চুপ বসে থাকলো। তারপর একসময় বলল,
“বাবা”। এতটুকু কন্ঠনালী হতে বের হওয়া মাত্র মি.মোর্শেদ বললেন,
” আচ্ছা মা ঠিক আছে। আমি আজকেই তোকে সাইকেলটা কিনে দেব, যেন তুই আগামীকাল থেকে একাই স্কুলে যেতে পারিস না। খুশি তো এবার? মাহীনের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠলো। সহাস্যে বলল,
“অসংখ্য ধন্যবাদ বাবা। তুমিই বেস্ট।”
মি.মোর্শেদ প্রতুত্তরে মুচকি হাসলেন। স্কুলে পৌঁছে মি.মোর্শেদ আর গাড়ি হতে নামলেন না। মাহীন বাবাকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। তারপর দেখলো গতকালের মতোই ছেলে-মেয়েরা জনে জনে ভেতরে প্রবেশ করছে। মাহীন একবার শুকনো ঢোঁক গিলল। তারপর বিসমিল্লাহ পড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আজও রোদেলা দিন। গোল চত্ত্বরের অরিগন এস গাছগুলো রোদের আলোয় ঝলমল করছে। চত্ত্বরের চারিদিকে দেয়াল ঘেঁষে বেগুনি বেগুনী ডগলাস আইরিসের সমারহ দেখা যায়। মাহীন আজ ওসব দিকে মনোনিবেশ না দিয়ে সোজা এগিয়ে গেল প্রবেশ দ্বারের দিকে। মাঝে মাঝে প্রকৃতি দেখতে দেখতেই হারিয়ে যাওয়ার একটা অভ্যাস আছে ওর। তার ফাঁদে পরল না আজ। কারণ আজ ওকে সময়মত ক্লাসে পৌঁছতে হবে। ভেতরে ঢুকে সোজা করিডোর ধরে এগিয়ে গেল। প্রিন্সিপাল সেলটনের অফিস কক্ষের পাশেই একটি কাউন্টার রয়েছে। সেখানে যাবতীয় ফর্মাল কাজ করা হয়, যেমন বেতন পরিশোধ, কোনো বিষয়ের জন্য দরখাস্ত দেওয়া ইত্যাদি। কাউন্টারের পেছনে একজন লাল চুলো মহিলা গোমড়া মুখে বসে রয়েছে। মাহীন গিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। তারপর হালকা একটু কাসতেই মহিলা মুখ তুলে চাইলেন। তারপর কাঠখোট্টা কন্ঠে বললেন, ‘কি সমস্যা!’
মাহীম ভরকাল। মনে মনে ভাবল, কি সমস্যা ওনার? এত বিরক্তি কিসের জন্য।’ মুখে বলল, “আমি দশম গ্রেডের নতুন ছাত্রী। আমার ক্লাসরুমের তালিকাটা আমাকে দেবেন?”

মহীলা একই রকম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“এক্সট্রা ল্যাঙ্গুয়েজ কি?”
“ল্যাটিন।”
“মেজোর এবং অপশনাল?”
“সাইন্স এবং হায়ার ম্যাথস।” মহিলা আর কিছু না বলেই মাথা নিচে করে কাউন্টারের ওপাশে একটা ড্রয়ার খুললেন। কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটির পর একটা প্রিন্ট করা হলদে বর্ণের কাগজ বের করলেন। তারপর সেটা সামনে কাউন্টারের ওপর রাখলেন। তারপর ড্রয়ার থেকে একটা চাবি বের করলেন।
“এটা তোমার লকারের চাবি। ভুল করেও হারাবে না।” চাবিটা কাউন্টারে রেখে কঠোর স্বরে বললেন উনি। মাহীন কাগজটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর কাগজটা এবং চাবিটা নিয়ে এখান থেকে কেটে পরতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচল। ওর কাছে মনে হলো মহীলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। তারপর চাবিটা জিনসের পকেটে রেখে হলদে বর্ণের কাগজটির দিকে দৃষ্টিপাত করলো। প্রথমে ইংলিশ ক্লাস হবে দ্বিতীয় তলায়। কাজেই সময় নষ্ট না করে সোজা সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেল। C-2 নং কক্ষটা খুঁজে বের করতে হবে ওকে। প্রথমেই খোলা বারান্দার মত করিডোর। যেদিকে খোলা সেখান থেকে রোদ এসে মেঝেতে লুটপুটি খাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা আসা যাওয়া করছে। প্রথমের লম্বা করিডোরের সম্পূর্ণ ঘুরেও মাহীন কোথাও C-2 কক্ষটা খুঁজে পেল না। কাজেই করিডোরের শেষ মাথা থেকে বামে বাক নিয়ে পাশের করিডোরে গেল। একের পর এক একটা ক্লাসের ওপর ছোট করে লেখা রয়েছে কক্ষ নং। শেষে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পরলো। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস বুক ভরে নিতে লাগলো। যেই করা রোদ উঠেছে গরম কম নয়। বাতাসের আদ্রতা কম হলে এত ছোটাছুটি করার পর রীতিমতো ঘেমে নেয় উঠেছে মাহীন। শেষে করিডোর ধরে যারা যাওয়া আসা করছে তাদের কাউকেই জিজ্ঞেস করবে বলে স্থির করল। একটা ছেলে ধীর গতিতে হেঁটে যাচ্ছিল। মাহীন বলল,
“এক্সকিউজ মি?” ছেলেটা থমকে দাঁড়ালো। তারপর ওর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বলল,
“ইয়েস, আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” মাহীন অপ্রতিভ গলায় বলল,
“C-2 নং কক্ষটি কোথায় বলতে পারবে?”
এবার ছেলেটার চোখ ধীরে ধীরে উপরের দিকে প্রসারিত হলো। এমন ভাবে ওর দিকে চাইলো, মাহীনের মনে হলো যেন,ও ওকে এই মাত্র বলেছে, আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন। এবং এই কথা বললে প্রথমে যেমন ঠিক অবাক হত তেমনি অবাক হলো তারপর হেসে ফেলতো, ঠিক তেমনি ছেলেটা হেসে উঠলো। মাহীন ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
“আমি কি কোনো হাস্যকর কথা বলেছি?”
ছেলেটা হাসি হাসি মুখেই মাহীনের কাঁধ আঁকড়ে ধরে ওকে অপর পাশে ঘুরে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর বলল, “ওপরের দিকে তাকাও।” মাহীন ওর কথা মতো ঠিক তেমনি করলো, এবং দেখতে পেল ও ঠিক যেই ক্লাস রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই কক্ষ নং C-2। মাহীনের চোয়াল ঝুলে পরল এবং চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। ছেলেটা সহাস্যে বলল,
“ক্যালিফোর্নিয়া তাল গাছের স্বর্গরাজ্য। চলা ফেরা করার সময় মাঝে মাঝে একটু মাথা উপরে তুলে দেখিও তাল গাছে তাল ধরেছে কিনা। কাজে লাগবে।” বলেই হাঁটা ধরলো।
মাহীন হতবিহ্বল হয়ে অল্প কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পুনরায় পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লাসে প্রবেশ করলো। এখানকার ক্লাসে সকলের জন্য একক চেয়ার টেবিল রয়েছে। কেউ কেউ টেবিলের ওপর উঠে বসে আছে, আবার কেউ কেউ ভদ্র ভাবে নিজ নিজ চেয়ারে বসে গল্পগুজব করতে ব্যস্ত। মাহীন সামনে এগিয়ে যাবে তখনই সামনের টেবিল থেকে একটা পেন্সিল ব্যাগ নিচে পরলো। টেবিল থেকে ব্যাগটার মালিক যেই মেয়েটা সে উঠার পূর্বেই মাহীন ঝুঁকে ব্যগটা তুলে দিল। মেয়েটা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ সো মাচ। তুমি কি ইন্ডিয়ান?”
মাহীনের অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,
“না আমি বাংলাদেশী।”
মেয়েটা বলল,
“ওহ আচ্ছা আরেকজন বাংলাদেশী।”
মাহীন জিজ্ঞেস করল,
‘কেন আরোও বাংলাদেশী আছে নাকি?’
মেয়েটা মুখ টিপে বলল,
‘দুই দিন ক্লারো। নিজেই বুঝতে পারবে।’
মাহীন মুচকি হেসে এগিয়ে গেল। গিয়ে ঠিক কোথায় বসবে বুঝতে পারছিল না।এখানে কম করে হলেও ত্রিশটা টেবিল ও চেয়ার রয়েছে। ঠিক জানালার পেছনের কিছুটা আগে জানালার পাশের একটা টেবিল মাহীনের পছন্দসই হলো। কাজেই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসলো। একদণ্ড শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার পূর্বেই পাশের টেবিল থেকে একটা মেয়ে হালকা হেসে বলল,
“হ্যালো সুইট গার্ল, আমি সাইলোহ, সাইলোহ কার্নেল।” মাহীন মেয়েটার দিকে ভালো ভাবে চাইল। ঘাড় পর্যন্ত ছোঁয় না এত ছোট ডার্ক চকলেট রঙের চুল। গাড়ো বাদামি চোখ। ছোট চিকন ঠোঁট এবং চিকন নাক। ত্রিভুজ আকৃতির মুখ। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মিষ্টি একটা হাসি। আপনাআপনিই মাহীনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো এবং মনটা নিমিষেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বলল,
“আমি মাহীন ফারুকী।”
মেয়েটা বলল,
“তুমি নতুন মনে হয়। এশিয়ান?”
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
“তুমি সিক্রেট ট্রিয়ের সাথে দেওয়া নেওয়া করেছ?” জিজ্ঞেস করল সাইলোহ। মাহীনের ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো। বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
“মানে?”
সাইলোহ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়াল এবং মাহীনের একটা হাত ধরে বলল,
“চলো দেখাচ্ছি।” হাত ধরে মাহীনকে টেনে উঠিয়ে আনলো। এবং সোজা ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে হাঁটছে সাইলোহ। ভীড় অতিক্রম করে হাঁটতে হাঁটতে ওরা ক্যাফেটেরিয়ায় এসে পৌঁছল। সেখানে ছাদটা খোলা। বলা যায় আরেকটা খোলা চত্ত্বর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোলাকৃতির টেবিল। এক পাশে বড় একটা কৃত্রিম গাছ রয়েছে। ঠিক ক্রিস্টমাস ট্রিয়ের মতো। তবে এই কৃত্রিম গাছের ডাল পালা থাকলেও কোনো পাতা নেই। তার বদলে প্রতিটা ডাল থেকে ঝুলছে ছোট ছোট রঙিন চিরকুট। সাইলোহ মাহীনকে নিয়ে ঠিক সেই গাছটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মাহীনের দিকে ঘুরে বলল,
“এটাই হচ্ছে সিক্রেট ট্রি।আমি এই স্কুলে প্রথম গ্রেড থেকে পড়ি। এবং তখন থেকেই দেখছি এটা এখানে রয়েছে।”
“এটায় ঝোলানো এসব চিরকুট কিসের?” জিজ্ঞেস করল মাহীন।
“এগুলোই সিক্রেট। একেকজন মানুষ তাদের এমন সব সিক্রেট এখানে রেখে যায় যেটা হয়তো তাড়া অন্য কাউকে বলতে পারবে না। আবার চাইলে যেকেউ যেকোনো সিক্রেট নিয়ে খুলেও দেখতে পারে।” তারপর একটু বিরতি দিয়ে বলল,
“তুমিও তোমার কোনো সিক্রেট লিখে রাখতে পারো।” মাহীন দ্বিধান্বিত হয়ে ওর দিকে চাইল তারপর বলল, “আসলে আমার তো তেমন কোনো সিক্রেটই নেই।” সাইলোহ ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
“আমার সামনে বলে লিখতে চাচ্ছো না, তাই না? মাহীন ততক্ষণাৎ বলল,
“না, সত্যি বলছি।
সাইলোহ রশিয়ে রশিয়ে বলল,
“বুঝেছি, বুঝেছি। তাহলে এক কাজ করো তুমি চাইলে এখান থেকে তোমার ইচ্ছে মতো যেকোনো চিরকুট নিয়ে পড়তে পারো। মাহীন আবার দ্বিধান্বিত হয়ে পরল। ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। বলল,
“এটা কি ঠিক হবে। মানুষ তার ব্যক্তিগত সিক্রেট লিখে রেখেছে।
সাইলোহ বলল,
” মানুষ এখানে এমন সিক্রেটের কথাই লেখে যেটা সে কাউকে বলতে পারে না। এবং এখানে লেখার অর্থ হলো কেউ না কেউ হয়তো সেটা পরেছে এবং তাদের না চিনেও না জেনেও সিক্রেটটা জানে এটাই তাদের সান্তনা। এবং কেউ নিজের সিক্রেট এইভাবে না জানিয়ে দিতে চাইলে তো এখানে এইভাবে লিখতোই না।’ অকাট্য যুক্তি, মাহীন আর কিছু বলল না। সোজা বাদামি রঙের একটা চিরকুর ডাল থেকে খুলে নিলো। সেটা সুতার সাহায্যে বাঁধা ছিলো। তারপর খুলে পরতে লাগলো। লেখা আছে,

“আজ আমাদের বাস্কেট বল টিম হেরে গেল। এবং সম্পূর্ণ আমার কারণে। আমার যে জরুরি ভিত্তিতে টাকার খু্ব দরকার ছিলো। তাই অপর দল যখন হেরে যাওয়ার বদলে টাকার প্রস্তাব দিলো আমি কোনো ভাবেই না করতে পারলাম না। দুঃখীত।”

মাহীনের চিরকুটটা পড়ে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেলো। সাইলোরও একই অবস্থা।
“আমার স্কুলের বাস্কেট বল টিমের কেউ ম্যাচ ফিক্সিং করেছে।” উৎকন্ঠা প্রকাশ পেল মাহীনের কন্ঠে।

সাইলোহ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কত্তবড় নিমোক হারাম। কখনো একে খুঁজে পেলে গণপিটুনি দিব”। মাহীন আরোও কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সাইলোহ দূরে করিডোরের কোণায় কাউকে ইঙ্গিত করে বলল,
“আরেহ নায়েল দেখো কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু অপেক্ষা করো আমি ওকে ডেকে আনছি।” মাহীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাইলোহ সেদিকে হাঁটা ধরলো। মাহীন আবার গাছের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরক্ষ করতে লাগলো চিরকুট গুলো। এত এত রঙিন চিরকুটের মধ্যে একটা ব্যতিক্রম ধর্মী চিরকুটের ওপর নজর পরলো। সেটা একটা কালো চিরকুট। মাহীন সেটা খুলে নিলো। তারপর ভাজ খুলে দেখা গেল ভেতরে সাদা কালিতে লেখা,

“অবিশ্বাস্য হলেও আমার মা আমার সাথে এমন আচরণ করেন যা একজন সৎ মাও তার সৎ ছেলের সাথে করবে না। এ আচরণ সহ্য করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো কারণে আমার ধৈর্য্য শক্তি বেশিই তাই আমি সহ্য করে যাচ্ছি। আমার পরিবারকে সামনে থেকে দেখে কেউ সেটা ধরতে পারবে না। বরং একটি সুখি পরিবারকেই তাঁরা দেখবে। ছোট বেলা থেকে আমিও ছিলাম আমার মায়ের চোখের মণি। তবে একটা ঘটনা সবকিছু বদলে দিল। আমি যেন তার চোখের বিষ হয়ে উঠলাম। তার হৃদয়ে যেন আমার নামের অংশে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে বিষ ঢেলে দিয়ে সবকিছু বিষাক্ত করে দিল। শুধু মাত্র মায়ের ব্যবহারের সাথে সাথে আমার জীবনটাই পাল্টে গেল। এমনকি তাকে মা বলে ডাকার সৌভাগ্যটিও এখন আমার নেই।
এর চাইতে নিকৃষ্ট ঘটনা আর কি ঘটতে পারে একটা সন্তানের সাথে । তবুও এসব সহ্য করে আমি সেই ঘরে থেকেই বেঁচে আছি। আসলে আমি বেঁচে থেকেও সেদিনই মারা গিয়েছি যেদিন আমার মা আমাকে তার ছেলে বলেই অস্বীকার করলেন। আমার বাঁচার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। জীবনের কাছে কোনো আশা নেই। তবুও বেঁচে আছি কারণ, ‘আত্মহত্যা যে মহাপাপ’।

এতটুকুই লেখা চিরকুরটায়। মাহীন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে সাদা কালিতে লেখা, শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে পানি টলমল করতে করতে হঠাৎ গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। এখানে এমন কিছু একটা পড়ে ফেলবে আশা করেনি। কোনোও মানুষ এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কেই বা সেটা ভাবতে পারে। মাহীন মনে মনে ভাবলো, কি হয়েছিল তার সাথে? কি এমন ঘটনা ঘটতে পারে একটা মানুষের সাথে যার জন্য একটা মা তার সন্তানের সঙ্গে এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করবে। এবং আমিই বা কি করতে পারি এটা নিয়ে? যখন এটাও জানি না সেই চরম দুর্ভাগা ব্যক্তিটি কে? ম্যাহীন! সাইলোর ডাকে চমকে উঠল মাহীন। নিজেকে সামলে নিয়ে গালটা একটু মুছে নিল। তারপর সাইলোর দিকে ফিরে চাইল। দেখল তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। ছেলেটির চিকন প্রসস্থ নাকের চারপাশে ও চোখের নিচ এবং সারা গালে হালকা লালচে ফ্র্যাকল রয়েছে। মনোলিড আকৃতির গাড়ো বাদামি চোখ। ওভাল আকৃতির মুখ ও ডার্ক চকলেট রঙের উসকোখুসকো চুল। সাইলোহ ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করল,
“ম্যাহীন তুমি ঠিক আছ? তোমার চোখ মুখ এমন থমথমে হয়ে আছে কেন?”
মাহীন একটু কেসে নিয়ে নাক টানলো। চোখে পানি আসলে আপনা আপনি নাকেও পানি চলে আসে। মাহীন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “না না আমি একদম ঠিক আছি। আর আমার নাম কিন্তু মা..হী..ন।” সাইলোহ বিচলিত ভাবে হেসে বলল,
“এরপর থেকে সঠিক ভাবে উচ্চারণ করার চেষ্টা করব। মাহিন।” মাহীন ফেলে মুচকি হাসল।
“ছেলেটা ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমি নায়েল কলিমোর।”
মাহীনও হাসি মুখে করমর্দন করে বলল,
“মাহীন ফারুকী।”
নায়েল বলল,
“তুমি কোনো সিক্রেট লেখনি?”

মাহীন কিছু বলার পূর্বেই সাইলোহ বলল,
“নাহ আমাদের সামনে বোধহয় লিখতে চাচ্ছে না।” মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সাইলোহ বলল,
“ও যেই চিরকুট নিয়েছে তার মধ্যে বাস্কেটবলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জবানবন্দি আছে।”
নায়েল বিস্মিত হয়ে বলল,
“বাস্কেটবলে কেউ ম্যাচ ফিস্কিং করেছে! এটা আর যেই হোক র‍্যাবিট না।

সাইলোহ মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“নাহ র‍্যাবিট এত গরিব না যে টাকার জন্য নিমক হারামি করবে।”
মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“র‍্যাবিট টা আবার কে?”
নায়েল বলল,
“আমাদের স্কুলের এক নাম্বার ফাজিল। বেশিক্ষণ লাগবে না ওকে চিনতে।”

মাহীন হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাদের ক্লাস তো শুরু হবে বলে।”

সাইলোহ বলল, “হ্যা চলো ক্লাসের দিকে যেতে যেতে কথা বলি।” ক্যাফেটেরিয়া প্রায় খালি হয়ে এসেছে। একে একে সকলে ক্লাসের দিকে রওনা দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে নায়েল বলল,
“অনেকজনের দাবি তাঁরা প্রায় প্রতি সপ্তাহে র‍্যাবিটকে সিক্রেট ট্রিতে একটা করে চিরকুট বাঁধতে দেখে।” মাহীন অবাক স্বরে বলল,
“এতো সিক্রেট ওর।”

সাইলোহ বাঁকা হেসে বলল,
“হবে না আবার সারাদিন যেসব কান্ডকারবার করে বেড়ায়। আমার ধারণা সিক্রেট ট্রিয়ের অর্ধেক চিরকুটই নিশ্চিত ভাবে র‍্যাবিটের।” নায়েল হেসে উঠলো। মাহীন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো, এখানকার মানুষের নাম যে কি হবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যার যা ইচ্ছে রেখে দেয় তাই বলে র‍্যাবিট? ক্লাসে প্রবেশ করতে করতে সাইলোহ বলল,
“আচ্ছা মাহীন আমাদের আরেকজন বান্ধবী আছে জেনেট। বেচারি দুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে বলে স্কুলে আসতে পারেনি। আমি আজ স্কুলের পর জেনেটের বাড়ি যাবো। তুমিও চলো আমার সাথে। বলে থামলো।
মাহীন এক প্রকার আঁতকে উঠল। সাইলোহ নায়েলকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,
“এবং নায়েল তুমিও।”

নায়েল ইতস্তত করে বলল, “আসলে মা আজকে স্কুলের পর আমাকে সাথে ধরে নিয়ে একটা ইয়োগা সেমিনারে যাবে।”
সাইলোহ বলল, “আহারে কি ভাগ্য তোমার।” মাহীনকে কিছুটা বিভ্রান্ত হতে দেখা গেল। মাহীন জানালার পাশে নিজের সেই টেবিলটায় বসলো। সাইলোহ পাশের টেবিলে। নায়েল বলল, “আচ্ছা তো আমি গেলাম। আমার এখন বাইওলজি ক্লাস আছে।” বলেই দরজার দিকে রওনা দিল। সাইলোহ মাহীনের দিকে ঘুরে বলল,
“তো তোমার মতামত কি?”

মাহীন জিজ্ঞেস করল,
“কি নিয়ে?”
“এই যে যাওয়া নিয়ে।”

এবার মাহীন ইতস্তত করে বলল, “আসলে আমার মনে হয় না আমার মা রাজি হবেন।উনি খুবই কড়া মানুষ”। সাইলোহ প্রথমে অবাক হলো। বলল,
‘তোমার কেন রাজি হবেন না? কোনো সমস্যা আছে?’
মাহীন অপ্রতিভ ভাবে বলল,
‘না সমস্যা তো নেই। কিন্তু হঠাৎ করে স্কুলের প্রথম দিনই কারোও বাসায় চলে যাবো,তিনি ঠিক অনুমতি দিবন না।’
রহস্যময় ভাবে হেসে বলল,
“তোমার মোবাইল টা দাও।”

মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার মোবাইল নিয়ে কি করবা?”
“আগে দাও তারপর দেখবা।” মাহীন পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সাইলোর হাতে দিল। সাইলোহ মোবাইল অন করেই বলল,
“পাসওয়ার্ড?”

মাহীন বলল,
“৯২২৯।” তারপর অস্থির ভাবে ভাবতে লাগল, ‘আল্লাহ জানে মেয়েটা আমার মোবাইল নিয়ে কি করছে। কোন ঝামেলায় ফেসে গেলাম!’ সাইলোহ এবার সেলফোন কানে ধরলো। মাহীম আরোও অবাক হয়ে চাইল। কয়েক মুহূর্ত পরে সাইলোহ বলে উঠলো, “হ্যালো, আমি সাইলোহ বলছি মাহীনের বান্ধুবী। মাহীন ততক্ষণাৎ বুঝতে পারলো ও কাকে ফোন দিয়েছে। এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শোনার পর সাইলোহ হাসি মুখে বললো,
“জ্বী আন্টি আমি অনেক ভালো আছি। আসলে আমি আজ ছুটির পর মাহীনকে নিয়ে আমার এক বান্ধুবীর বাসায় যেতে চাই যদি কোনো সমস্যা না থাকে। এবং ওর নিরাপত্তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার।” কথাগুলো কিছুটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলল। তারপর কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ফোন কেটে দিয়ে মাহীনের হাতে তুলে দিল। মাহীন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সাইলোহ বলল, এখন কোনো চিন্তা নেই। আন্টি রাজি। মাহীনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ও কাশ্মীনকালেও ভাবতে পারেনি মা ওর এককথায় এমন প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। তারপর অবাক কন্ঠে বলল,
“তুমি সত্যি অবিশ্বাস্য।” ঠিক তখনই টিচার ক্লাসে প্রবেশ করলেন। এবং সকলে নিশ্চুপ হয়ে গেল।

ছুটির ঘন্টা বাজতে বাজতে বেলা সাড়ে বারোটা বাজলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে গোটা স্কুলে হৈচৈ পরে গেল। সকলে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে লকার করিডরের দিকে ধেয়ে আসছে। পশ্চিমা দেশের এই এক ব্যাপার। স্কুলে ঢুকে এবং স্কুল থেকে বের হওয়ার পূর্বে একবার নিজেট লকারের মুখদর্শন না করলেই নয়। মাহীন ও সাইলোহ একসাথেই গেট থেকে বের হচ্ছে। ইংলিশ ক্লাসের পর জিওগ্রাফি ক্লাস ভিন্ন আর কোনো ক্লাসেই ওরা একসাথে ছিলো না। মি. মোর্শেদের এখন আর মাহীনকে নিতে আসার কথা নয়। কারণ এখান থেকে সাইলোহ ওকে নিয়ে সোজা জেনেট এর বাড়ি পৌঁছবে যা ও পূর্বেই মিসেস নাসরিন কে জানিয়ে দিয়েছে। স্কুলের বাইরে অপেক্ষামান হলুদ বাস শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দেবে নিজ নিজ বাড়িতে। তবে সকলেই বাস যাত্রা বেছে নেয় না। অনেকেই পায় হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়। সাইলোহ পার্কিং থেকে নিজের সাইকেলটা বের করল। মাহীন ওর সাইকেলের পেছনে বসল। এর পূর্বে কখনো কারোও সাইকেলের পেছনে বসেছে কিনা মনে পরে না। সাইলোর ভাষ্য, জেনেটের বাড়ি খুব একটা কাছে নয়।তবে সাইকেল চালিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না।’ মাঝে ওরা স্টারবাক্সে একবার ঢু মারলো। এই গরমে কড়া রোদের নিচে যানবাহনের তীব্র ভির এড়িয় এগিয়ে যেতে দুজনেরই কাহিল অবস্থা।তাই দুজনেই ঠান্ডা কিছু নিয়ে নিল। তারপরও বিশ মিনিট পর ওরা পৌঁছল গন্তব্যে।
জেনেট দের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাহীন এবং সাইলোহ।বড় ডুপ্লেক্স মডার্ন বাড়ি। সামনের বাগানটা ছোট তবে নানা রঙের ফুলগাছে ভরা। এর মাঝে দুধ সাদা সাদা ফ্রেসিয়া ফুলই বেশি দেখা গেল। দেখেই ধারণা করা যায় খুব ব্যয়বহুল বাড়ি।গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে এগিয়ে গিয়ে কলিং বেল বাজাল সাইলোহ।ক্ষণকাল পরেই একজন এপ্রন পড়া মহিলা দরজা খুললেন।ওরা ভেতরে ঢুকে দাঁড়াতেই তিনি বিনিত কন্ঠে বললেন,

“জেনেট ম্যাডাম তার কামরায় আছেন।আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছেন।”
সাইলোহ মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ।” তারপর দুই তলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। সাথে সাথে মাহীনও সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।একটা কামরায় সাইলোর সাথে সাথে মাহীন প্রবেশ করল।খুব ছিমছাম ভাবে সাজানো কামরাটি।দেওয়াল গুলো হালকা নীলচে রঙের। মাঝে বিছানায় একটা মেয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।ডিম্বাকৃতির মুখ।লম্বা সোনালি চুল এবং ধূসর চোখের মণি।তবে এখন মুখটা অত্যন্ত মলিন দেখাচ্ছে।ওরা দুজন বিছানার কাছে এগিয়ে যেতেই মেয়েটার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।বিনয়ী গলায় বলল,
“হ্যালো মাহীন! আমি জেনেট এলার্ড।” মাহীন বিছানার একপাশে বসতে বসতে মুচকি হেসে বলল,
“নিজের পরিচয় আর কি দেব? তুমি তো মনে হয় আগে থেকেই চিনে বসে আছ আমাকে।”
জেনেট বলল,
“সবই সাইলোর কল্যাণে।” মাহীন অবাক হয়ে হাসল।মনে মনে ভাবলো, কি অদ্ভুত তো সাইলোহ এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আসলেই আমাকে এত ভালো বন্ধু বানিয়ে নিল? তারওপর ওর আরেক বান্ধবীকেও আমার সম্পর্কে বলাও হয়ে গিয়েছে? কিন্তু বললো কখন?”
সাইলোহ জেনেটকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি কি কালকে স্কুলে আসতে পারবা?”

জেনেট মুখটা বেজার করে বলল,
“নাহ মা কাল যেতে দিবে না। তবে আমি জেদ টেদ করলে দেখা যাক কি হয়। তবে পরশু দিন থেকে নিশ্চিত ভাবে আসবো।” তারপর মাহীনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জেনেট বলল,
“আগামীকালের ক্রিয়েটিভ ইভেন্টে তুমি নাম দিবা?
মাহীন কামরা দেখতে ব্যস্ত। ওর কথায় চমকে তাকাল। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ক্রিয়েটিভ ইভেন্ট?”
সাইলোহ বলল,
“আহা আমি তো বলতেই ভুলে গিয়েছি। আগামীকাল সকাল নয়টা পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশনের শেষ সময়। এই সপ্তাহে মোট তিনটি স্কু্লে ক্রিয়েটিভ ইভেন্ট শুরু হয়েছে। শুধুমাত্র হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সেগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারবে।”
মাহীন বলল,
“কিন্তু এই ইভেন্টে কি হবেটা কি? এবং আমি কেন জয়েন করবো?”
জেনেট উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
“এখানে যত্তসব ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম হয়। আমার অনেক ভালো লাগে। কারণ গত বছরের আগের বছরের ইভেন্টটা আমার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।”
সাইলোহ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“জীবনে তো দেখলাম না কোন ক্রিয়েটিভিটর ধার দিয়ে যেতে। আর ওই বছর নামটাও আমিই জোর করে দিয়ে দিয়েছিলাম।”
জেনেট বলল,
আমি কখন বললাম আমার ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম ভালো লাগে? আমি শুধু বলেছি আমার এই ইভেন্টটা ভালো লাগে।”
মাহীন বলল,

“তো এমন কি ঘটনা ঘটেছিল যে তোমার এর আগের বছরের আগের বছরটা অতি স্মরণীয়?”
জেনেট উদ্ভাসিতমুখে বলতে লাগলো,

“সেই বছর আমার ইভেন্ট পার্টনার হিসেবে ছিল লিও আর… সাইলোহ মাঝখান দিয়ে বলল,

” আরেহ থামো তো।তোমার এই ম্যাক্সিকান প্রেম কাহিনী শুনাতে শুনাতে ক্লান্তি লাগে না হয়তো।কিন্তু শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি।মাহীনেরও মাথা খারাপ করো না।”জেনেট মুখ গোমড়া করে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই মাহীন বলে উঠলো,

“আচ্ছা হাই স্কুলের নিচের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হবে না?”
সাইলোহ বলল,
“না।আমাদের স্কুল সহ আরোও ছয়টা স্কুলে গত মাসেই প্রাইমারি স্কুলের ইভেন্ট হয়ে গিয়েছে।
“মাহীন বলল,

“আচ্ছা এখনো এটা বললে না যে এতে কি কি ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম হবে?”

সাইলোহ বলল,
“তুমি যেকোনো টপিকের ওপর প্রজেক্ট তৈরি করতে পারো। কোনো গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা বা কোনো ইনফরমেটিভ আর্টিকেল লিখতে পারো। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পারুক আর না পারুক এই লেখালেখির অংশেই নাম দেয়। কারণ এগুলোর মধ্যে স্কুলের মধ্যে সেরাগুলো বাছাই হবে তারপর সেগুলো “টিনেজ গ্লোরি”
ম্যাগাজিনে পাঠানো হবে। এবং সেখান থেকে সবচাইতে ভালো লেখাটা ওরা ম্যাগাজিনে ছাপাবে।
মাহীন দ্বিধানিত্ব হয়ে বলল,
“এটাই আমার প্রথম দিন স্কুলে। তোমাদের ছাড়া কাউকে চিনি না। কিভাবে দ্বিতীয় দিনই একটা ক্রিয়েটিভ ইভেন্টে নাম লিখিয়ে নেই?”
জেনেট বলল,
“আরেহ এত চিন্তার কিছু নেই।এটা কোনো পরীক্ষা নয়। আর তুমি একা তো কিছু করবা না, তোমার সাথে তো একজন পার্টনার থাকবে।

” কয়জন?” জিজ্ঞেস করল মাহীন।
জেনেট বলল,
“দুই জন যদি তুমি রাইটিং পার্টে নাম লেখাও তাহলে। কারণ এটা একটা গ্রুপ ওয়ার্ক ইভেন্ট।”
সাইলোহ বলল,
” আর পেইন্টিং পার্টেও তিনজন থাকে। শুধু বিভিন্ন ধরনের সাইন্টিফিক প্রোজেক্ট বা এমন ধরনের প্রোজেক্ট গুলোয় চার, পাঁচ বা ছয়জন করে সদস্য থাকে।”
মাহীন জিজ্ঞেস করল,
‘তোমরা কিসে নাম দাও?’
জেনেট গম্ভীরমুখে বলল,
“প্রথমবার সাইলোহ জোর করে আমাকে পেইন্টিং পার্টে দিয়ে দিয়েছিল যেখানে আমি আঁকিবুঁকির ধার ধরেও যাইনা।
সাইলোহ বলল,
“আমি প্রতিবছর পেইন্টিং পার্টে নাম দেই।” ওর কথা শেষ হতেই জেনেট বলল,
“ওর বাসায় গেলে তোমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে। এমন অদ্ভুত ছবি আঁকে, যে আগা গোড়া কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।”
সাইলোহ মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
“হুহ ছবির সম্বন্ধে কিছু জানলে তো বুঝবা। ছবি সম্বন্ধে না জানলে প্রকৃত ছবিকে কাকের ঠ্যাঙ্গ বকের ঠ্যাঙ্গই মনে হবে।”
মাহীন বলল,
“আমি আজ ভেবে দেখবো কোনো অংশে আমি নাম দিতে পারি কিনা। তবে কোনো প্রকার প্রজেক্টে আমি কোনো ভাবেই নাম দেবও না।”
সাইলোহ হালকা হেসে বলল,
“এইতো লাইনে এসেছ।’

চলবে ইনশাআল্লাহ।