এল এ ডেইস পর্ব-৪+৫

0
209

#এল_এ_ডেইস
পর্ব-৪
লেখনী – মাহীরা ফারহীন

তীক্ষ্ণ শব্দে শীশ বেজে উঠল। কোনো এক ছাত্রের এই শীশের শব্দ কক্ষ অতিক্রম করে বাইরে করিডোরেও শোনা গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিকট সবচেয়ে বিরক্তকর ক্লাসগুলোর মধ্যে একটি হলো ফিজিক্স ক্লাস। এ ক্লাসের সমাপ্তি ঘটলে প্রত্যেকে হরেক রকম ভাবে আনন্দ এবং স্বস্তি প্রকাশ করে। প্রতিটা ক্লাস শেষে অন্তত দশ মিনিট বিরতির পর অপর ক্লাস শুরু হয়। এর মাঝে শিক্ষার্থীরা লকারের সামনে থেকে এক পাক ঘুরে আসে এবং নির্দিষ্ট ক্লাসেও পৌঁছে যায়। তবে মাহীন ক্লাস থেকে বের হওয়ার পূর্বেই সেই কাউন্টারের লাল চুলো গোমড়ামুখো মহিলা ক্লাসে এসে উপস্থিত হলেন।
শীশবাদক ছেলেটা ভাবল এই বুঝি কান মলা দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের হইচইয়ের মাঝে মাহীন প্রথমে তাকে লক্ষ্য করেনি যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি চিৎকার করে বললেন,
“মিস ফারুকী!” মাহীন রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। ক্লাসে উপস্থিত সকল ছাত্র ছাত্রীই চমকে উঠেছে। সকলেরই চোখে মুখে থমথমে একটা ভাব ছেয়ে গেল। মাহীন নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করে বলল,
“আমি, আমি এখানে।” মহিলা এগিয়ে এসে একদম মাহীনের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে কঠোর গলায় বললেন,
“এই যে তোমার পার্টনার দের নাম। তাদের সাথে কথা বলে তোমাদের আর্টিকেলের বিষয়বস্তু আমাকে আগামী বিশ মিনিটের মধ্যে লিখিত ভাবে জমা দেবে।” মাহীন চিন্তিত গলায় সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যে?”
লাল চুলো মহিলা গম্ভীর মুখে বললেন,
“আগামী বিশ মিনিট কোনো ক্লাস হবে না। এবং এর মধ্যেই এইসব কাগজপত্র আমার কাছে জমা দিতে হবে।” বলেই উনি গটগট করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার রাগের তোরে অনেকেরই মনে হয় তিনি হাঁটলে বুঝি অগ্নিমূর্তির মতো তার শরীর থেকে লালচে অগ্নিশিখা ঝাঁপটা দেয়। ছাত্র ছাত্রীরা সকলে হা করে মাহীনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। একটা মেয়ে পেছন থেকে ভারি কন্ঠে বলল,
“সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি তোমার সঙ্গীদের খুঁজে বের করো।”
মাহীন অবশেষে হাঁপ ছেড়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর সোজা নিচ তলায় লকারের কাছে চলে গেল। ব্যাগটা লকারে রেখে দিল। এবার লাল চুলো মহিলার দিয়ে যাওয়া কাগজটির দিকে চোখ রাখল। দুইজন সঙ্গী। একজন সফোমোর লিম জু ফেন। আরেকজন ইলেভেন্থ গ্রেডের রায়েদ মাদিহ। মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তালিকাটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর পুনরায় দ্বিতীয় তলায় চলে গেল। প্রথমে মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে চায় ও। মনে মনে ভাবছে,
‘এখানে কারোও কোনো নির্দিষ্ট শাখা নেই দেখে কাউকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন। এবং মেয়েটার নাম দেখে মনে হচ্ছে চাইনিজ।’ ভাবতে ভাবতেই দ্বিতীয় তলায় এসে প্রতিটা কক্ষে ঢু মেরে কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করল মেয়েটার কথা। তবে কেউই তার হদিস দিতে পারল না। শেষে একজন বলল যে আজ মেয়েটা স্কুলেই আসেনি। মাহীন মাঝ করিডরে দাঁড়িয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে হাত ঘড়ির দিকে চাইল। ইতোমধ্যেই দশ মিনিট হয়ে গিয়েছে। আর দশ মিনিট বিরতি থাকবে এরপর আবার ক্লাস শুরু হবে। এরই মধ্যে এখন ওর রায়েদ মাদিহকে খুঁজে বের করতে হবে। যেহেতু সে ইলেভেন্থ গ্রেডের ছাত্র সুতরাং মাহীন সোজা চারতলায় চলে গেল। চারতলায় জুনিয়রদের ক্লাস হয় এটা জানা আছে ওর। মাহীন করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বুক ভরে শ্বাস নিল। এত ছুটাছুটি করে বেজায় ক্লান্ত হয়ে পরেছে। বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। বুক ভরে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। একটা মেয়েকে সামনের কক্ষ থেকেই বের হতে দেখে বলল,
“আচ্ছা তুমি বলতে পার রায়েদ মাদিহকে কোথায় পাব?” মেয়েটা থমকে দাঁড়ালো। অবাক দৃষ্টিতে চাইল মাহীনের দিকে। যেন এখনই মাহীন কোনো অর্থহীন কথা বললো। সে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,
‘তুমি নিশ্চিত তুমি রায়েদ মাদিহকেই খুঁজছ?

মাহীন বিভ্রান্ত হলো এহেন কথায়। তবে গাঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি নিশ্চিত না হলে পরিষ্কার ভাবে তার নামটা বলতে পারতাম না।”
“আমি জানি না ও কোথায়।’ খাপছাড়া ভাবে কথাটা বলেই মেয়েটা মাহীনকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। মাহীন ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে দেখল একটা ছেলে রেলিঙের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলের দিকে চেয়ে রয়েছে। সেদিকেই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বলতে পারো রায়েদ মাদিহ কোথায়?”

ছেলেটা মুখ তুলে চেয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং বলল,
“ওকে কেন খুঁজছ?”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমার দরকার তাই।”

ছেলেটা শ্রাগ করে বলল,
“কি জানি কোথায় আছে।

অবশেষে মাহীন জিজ্ঞেস করল,
“ও কি আদৌও স্কুলে এসেছে?”

ছেলেটা বিদ্রুপ হাসল। বলল,
“স্কুলে এসেছে মানে? স্কুল থেকে ও বের হয় কখন আমি তো এটাই বুঝি না।” ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গিমায় বেজায় বিরক্ত হলো মাহীন। আর একটাও প্রশ্ন না করেই এগিয়ে গেল। এবার আর কাউকে জিজ্ঞেস করা লাগল না কিছু। একটা লম্বা চওড়া লাল চুলো ছেলে দয়া করে এসে দাঁড়াল ওর সামনে। তারপর বলল,
“তুমি কি রায়েদ মাদিহকে খুঁজছ?”
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ে।”

ছেলেটা বলল,
“তাহলে মনিটরকে জিজ্ঞেস করলেই তো পার। এমন কেউ নেই যার খবর মনিটর রাখে না।”

মাহীন হতাশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘এবং এই মনিটর কে কোথায় পাব?’

ছেলেটা হাতের বাম দিকের প্রথম কক্ষটা দেখিয়ে বলল,
“এই রুমে জানালার পাশের একদম প্রথম টেবিলে যে বসে আছে সেই মনিটর। মাহীন ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“ধন্যবাদ।” বলেই এগিয়ে গেল দ্রুত গতিতে। সেই কক্ষে প্রবেশ করেই প্রথমে দৃষ্টি খুঁজে বেরাল জানালার পাশের প্রথম টেবিলটা। সেখানে যেই ছেলেটা বসে আছে সে যথেষ্ট ফ্যাকাসে দেখতে। এবং তার চুলগুলো বাদামি এবং চোখের মণি নীল। মাহীন সামনে এগিয়ে যেতেই পরিষ্কার ভাবে তাকে দেখতে পেল। এবং বড়ই চেনা চেনা লাগল। মনে করার চেষ্টা করতে লাগল কোথায় দেখেছে তাকে। হঠাৎ মনে পরতেই মনে মনে ভাবলো, আরেহ এটাই তো সেই ধরিবাজ ছেলে। সে আবার মনিটর।’ ভাবতে ভাবতেই ভিনজেল সামনে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ছেলেটা মুখ তুলে চাইল। মাহীন বলল,
“আমাকে একটা সাহায্য করতে হবে।”

ছেলেটা বাঁকা হাসলো এবং বলল,
“তুমি মনে হয় এখানে নতুন। আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছ জানো আমি কে?”

মাহীন ড্যাম কেয়ার ভাবে বলল,
“এসব জেনে আমার কোনো কাজ নেই। তুমি মনিটর সুতরাং নিজের দায়িত্ব পালন কর।”

“আসলে তুমি নতুন তো তাই এই স্কুল সম্বন্ধে কোনো কিছুই জানো না। এবং আমার এখন তোমার সাথে কোনো ঝামেলা করার মত ইচ্ছে নেই। আমার অনেক কাজ আছে।” মাহীন এবার নিজের সেলফোনটা হাতে নিল। মিনিটও পার না হতেই সেটা ও ছেলেটার দিকে ঘুরিয়ে ধরল। স্ক্রিনে সেই দিনের ভিডিওটা চলছে। ছেলেটার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল এবং চোয়াল ঝুলে পরল। ওর সেই ক্যাবলাকান্ত চেহারা দেখে মাহীনের হাসি পেল। তবুও হাসি চেপে গিয়ে গম্ভীর মুখভঙ্গি করে রাখল। ছেলেটা বিস্ময় মাখা কন্ঠে বলল,
“তু..তুমি এই ভিডিও কোথায় পেলে?”

মাহীন কঠোরভাবে বলল,
“সেটা বড় কথা নয়। কথা হল, এখনই আমাকে বল রায়েদ মাদিহ কোথায় নাহলে…ছেলেটা কথার মাঝেই তরিৎ গতিতে বলল,
“রায়েদ মাদিহকে কেন খুঁজছ? ”
মাহীন ভারি কন্ঠে বলল,
“আমার কাজ আছে তাই। যাকেই বলি না কেন কেউই বলতে পারে না সে কোথায়।”
ছেলেটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
‘এই স্কুলে যদি কেউ অন্তত পক্ষে এক সপ্তাহও পড়ে থাকে তাহলে সেও জানবে ক্লাসের সময় ছাড়া রায়েদ মাদিহ একমাত্র লাইব্রেরিতেই থাকে।

মাহীন তীক্ষ্ণ ভাবে বলল,
‘এতই যখন জানে তাহলে এরা আমাকে বলল না কেন শুনি?’

“খুব বেশিই দয়া দেখাতে গিয়ে।”

মাহীন ঘুরে দাঁড়াল। তবে এক কদম অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই পুনরায় পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। এবং বলে,
“এক মিনিট লাইব্রেরি আবার কোথায়?”

ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়।বলল,
“তোমাকে এখন লাইব্রেরি কোথায় বোঝাতে গেলে আমার ম্যাপ খুলে বসা লাগবে। তার চাইতে আমার সাথে চল। তারপর একটু থেমে আবার বলল,

“আর হ্যা তুমি সেই ভিডিও টা আমার মাকে দয়া করে দেখিও না।

মাহীন গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ তুমি তোমার মনিটরের দায়িত্ব সৎ ভাবে পালন করছ।” ছেলেটা আর কিছু বলল না। সোজা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মাহীনও পিছু ধরল। ছেলেটা হাঁটছে না যেন দৌড়চ্ছে। মাহীন জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তোমার নামটা কী?”

ছেলেটা বলল, “ডেক্সটার হকিংস।”
মাহীন খেয়াল করে দেখল, করিডোরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা সকলে ছানাবড়া চোখে ওদের দিকে চেয়ে আছে। ওদের মুখভঙ্গি দেখে মাহীন চাপা হাসল। মনে মনে ভাবলো,
যেই ছেলেটা আমাকে এই ধরিবাজের কাছে পাঠিয়েছে সে আমাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে এটা করেনি। সে আমাকে ঝামেলায় ফেলতে চেয়েছিল। কারণ এই ধড়িবাজের ব্যবহার দেখেই বোঝা যায়, ওর কোনো না কোনো ক্ষমতা রয়েছে যার কারণে ফাঁকিবাজি করার পরও এখনো মনিটর হিসেবে টিকে আছে। এবং যেকোনো কাউকে ঝামেলায় ফাঁসাতে পারে। হয়তোবা তাই সকলে একে এড়িয়ে চলে। কিন্তু আমার ভাবনাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। ঠিকই সেই ভিডিওটা কাজে লাগল। এবং সামনেও লাগবে। আজকেই বাড়ি গিয়ে এটা লেপটপে তুলতে হবে।” ওরা হাঁটতে হাঁটতে চত্ত্বর পেরিয়ে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের কাছে আসতে পাক্কা ছয়-সাত মিনিট লাগল। লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনে একটা বিশালাকৃতির ওক গাছ। লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের তিনতলায় খোলা করিডোরে কিছুদূর পর পর একটা করে কাঠের দরজা। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক করিডোরের শেষ প্রান্তে এসে নয় নম্বর দরজার সামনে থেমে গেল ডেক্সটার। তারপর পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। মাহীন এদিকে প্রচন্ড হাঁপিয়ে উঠেছে। ঠিকমত শ্বাসও নিতে পারছে না। এবং বাইরের রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসার কারণে ঘেমেও গিয়েছে। ডেক্সটার বলল,
“এদিক থেকে ভেতরে গিয়ে সেলফের মাঝের গলি দিয়ে সোজা যাবা। তারপর একদম কোণায় বড় জানালার পাশে একটা বড় টেবিল আছে। দেখবা চশমা পরা একটা ছেলে সেখানে পুরো টেবিলে বইখাতা ছড়িয়ে বসে আছে। সেই রায়েদ মাদিহ।” মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়লো। এবং মনিটরকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সময় থেমে গিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।” মনিটর কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। মাহীন বুক ভরে একবার লম্বা শ্বাস নিল। তারপর ভেতরে ঢুকে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে লাগল। সারি সারি সেলফ পার হয়ে কামরার কোণায় এসে থামল। মস্ত বড় দুটো জানালার সামনে বড় একটা টেবিল রাখা। সেখানে একটা ছেলে বসে আছে মাথা নিচু করে। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ায় ব্যস্ত। ছেলেটা দেখতে ফর্সা, কালো চুল, চোখে চিকন কালো ফ্রেমের চশমা। শক্ত চোয়াল। এবং ডেক্সটারের কথা মতোই সারা টেবিল জুড়ে বইখাতা বিছিয়ে রাখা। কেমন জানি রাশ ভারি এক ভাব তার মধ্যে। মাহীন এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“এক্সকিউজ মি?” ছেলেটা ভ্রূক্ষেপহীন। তাকে দেখে মনে হলো সে যেন কিছুই শোনেনি।

মাহীন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে”।
ছেলেটা এবার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” আমার সাথে কারোর কোনো জরুরী কথা থাকতে পারে না।”

মাহীন কিছুটা চমকায়িত হল ওর উত্তর শুনে। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“কিন্তু আমার আছে।”

রায়েদ কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গে বললো, “এবং আমি সেটাকে জরুরি কথা বলে মনে করিনা। তারপর একটু থেমে আবার কঠোর গলায় বলল,

” আর দেখতে পাচ্ছ না আমি ব্যস্ত আছি “।
এখন পর্যন্ত রায়েদ একবারও মুখ তুলে চায়নি।ছেলেটার কোনো কারণ ছাড়াই এমন দাম্ভিক ভাবসাব মাহীনের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। ক্রোধ চেয়াল শক্ত হলো। মনে মনে ভাবল, কি আশ্চর্য আর অভদ্র একটা ছেলে। এটা কোন ধরনের পদ্ধতি একটা অচেনা মানুষের সাথে কথা বলার! এত অহংকার কিসের? দাম্ভিক একটা। তোমার ব্যবহারের জন্য যদি তোমাকে মজা না দেখিয়েছি আমিও এখান থেকে নড়ব না। এবং বিশ মিনিটের মধ্যে বিষয়বস্তু লিখিত ভাবে জমা না দেওয়ার কারণ হিসেবে তো তোমার কথাই বলব। আরেকজন তো আসেইনি। শাস্তি পেলে আমি একা কেন পাবো? তোমাকে সাথে নিয়ে শাস্তি পাবো। তাছাড়া এ বিষয় আমার সাথে কথা না বললে, আমি আমার ইচ্ছে মতো টপিক দিয়ে দেব, পরে সে তোমার পছন্দ হোক আর নাই হোক।” তবে মুখে তিক্ত কন্ঠে বলল,
“খুব দেখতে পাচ্ছি। তবে তোমার সাথে কথা না বলে আমিও এখান থেকে নড়ব না।” বলেই পাশের টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পরল। রায়েদ কিছুই বলল না। তারপর সেলফোনটা হাতে নিল। মোবাইল দেখার ভান করে আঁড়চোখে রায়েদের টেবিলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখল। দেখল একটা খাতায় ও কোনো কিছুর গ্রাফ অংকন করতে ব্যস্ত। বইয়ের পাশেই একটা আধা কফি ভরা কালো কাঁচের কাপ রাখা। কাপের গায়ে একটা কোট লিখা রয়েছে, “After All this time? – Always”। মাহীনের এক মুহূর্ত লাগলো না এটা বুঝতে যে রায়েদ নিশ্চিত ভাবে পটারহেড। কারণ এটা হ্যারি পটারের একটা চরিত্রের কোট। মনে মনে ভাবতে লাগল, কাপের গায়ে কি লেখা সেটা ভাবার বিষয় নয়। ভাবার বিষয় হচ্ছে ক্যাফেটেরিয়া থেকে কফি নেওয়াই যায় কিন্তু ওয়ান টাইম কাপে। তাহলে এই স্কুলে বসে ও হ্যারি পটার কাপ কোথায় পেল? নাকি সেটাও সাথে করে নিয়ে ঘোরে? তবে এটা নিশ্চিত যে এটা ওর নিজের কাপ। এতই ভাব এর যে নিজের রত্নাখচিত কাপ ব্যবহার করবে। বাহ!’
রায়েদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই মাহীনের ভাবনায় বিঘ্ন ঘটল। রায়েদ সোজা সেলফের কাছে হেঁটে গিয়ে ঝুঁকে নিচের দিকের তাকগুলো থেকে কোনো একটা বই খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরল। মাহীন একবার ওর দিকে চাইল আরেকবার কফির কাপটির দিকে চাইল। তারপর ভাবল, এই সুযোগ। তোমার এটেনশন কিভাবে আমার দিকে আনতে হয় আমি জানি।” ভাবতে ভাবতেই পকেট থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা একটা কৌটা বের করল। তারপর সেটা খুলে সেখান থেকে বেশখানিকটা লবণ হাতে নিয়ে কফির মধ্যে ঢেলে দিল। তারপর কাপটা সাবধানে তুলে হালকাভাবে দুলিয়ে নিয়ে আবার নিঃশব্দে নামিয়ে রাখল। রায়েদ তখনই একটা বই হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাহীন চমকে উঠে তাড়াতাড়ি আবার নিজের মোবাইলের দিকে চোখ ফেরাল। রায়েদ এসে আবার বসতে যাবে তখনই লাল চুলো মহিলাকে সারি সারি সেলফগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল। মাহীন সরাসরি তাকাল না সেদিকে। তবে আড় চোখে দেখে মনে মনে ভাবলো, এই মরেছি। এই মহিলা এখন আমাকে ছাড়বে না। বিশ মিনিট সেই কখন শেষ হয়ে গিয়েছে। আর এতক্ষণে নিশ্চয়ই ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছে। অবশ্য সমাজ ক্লাস, খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ তবে মহিলা রায়েদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং একটা কাগজ টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“রায়েদ তোমার সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে তোমার আর্টিকেলের বিষয়বস্তু লিখিত ভাবে আমাকে জমা দিবে।”
রায়েদ নির্বিকার চিত্তে বলল, “কিন্তু এসব করে কোনো লাভ নেই।”
মহিলা দৃঢ়ভাবে বললেন, “লাভ-ক্ষতির হিসাব আমি করব, তুমি নয়।”

“মিসেস রে, আপনি খুব ভালো করেই জানেন, আমি পার্টনার এটা শোনা মাত্র যে কেউ পারলে ইভেন্ট থেকে নিজের নাম কাটিয়ে নেবে। তাহলে আলোচনা কিসের?”

“দেখ আমি জানি এটা। তবে তাঁরা কি করবে না করবে সেটা পরের কথা। আগে তোমাকে একবার নিয়মটা পালন তো করতে হবে।”
“বলতে পারেন শেষ কবে কে আমার পার্টনার হিসেবে আমার সাথে কাজ করেছিল?”

মিসেস রে একটু ভেবে বললেন, “তুমি যখন সেভেন্থ গ্রেডে ছিলে তখন।”
রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান কন্ঠে বলল, “ঠিক আছে।”

মিসেস রে ঘুরে দাঁড়ানোর পূর্ব বললেন, “আরেকটা কথা চায়নিজ যেই মেয়েটা সে আজ স্কুলে আসেনি। সুতরাং আরেকজন যে আছে তার সাথে আলোচনা করে নিও।”
রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়লো। লাল চুলো মহিলা পেছন ঘুরে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলে গেলেন। মাহীন এতক্ষণ নিশ্চুপ বসে সব শোনার পর মনে মনে ভাবলো,
‘ঘটনা কি? গোমড়া মুখো মহিলা দেখি রায়েদের সঙ্গে খুব একটা কঠোর ভাবে কথা বললেন না। নাকি নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই কড়া আচরণ করেন?’
রায়েদ বইখাতা গুলো গুছিয়ে রাখতে শুরু করল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো গুছিয়ে ও এখান থেকে বেরিয়ে যাবে। মাহীন বলল,
“এখন চলে যাবে বুঝি?”

“শোনোনি মিসেস রে কি বললো। আমার হাতে বেশি সময় নেই মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে।” ঝাঁঝ ভরা কন্ঠে বলল রায়েদ।

মাহীন বলল, ‘ওহ আচ্ছা।” এতটুকু বলে থেমে গেল। এবার আমোদ ভরা কন্ঠে বলল, “আচ্ছা মেয়েটার নাম কি?”
রায়েদ ফট করে টেবিলে রাখা কাগজটার দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল, “মিস ফারুকী।”
মাহীন সুর করে বলল, “ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আই এম মাহীন ফারুকী।”
রায়েদ এবার বিস্মিত হয়ে ওর দিকে মুখ তুলে চাইল। এতক্ষণে প্রথমবার সরাসরি মাহীনের দিকে চাইল ও। ডায়মন্ড আকৃতির উজ্জ্বল বর্ণের মুখের গঠন।
ঘন নেত্রপল্লবের পেছনে গাঢ় বাদামি চোখের মণি। ছেলেটা যে আসলেই এক সুন্দর চেহারার অধিকারী তা অন্তত মনে মনে স্বীকার করতেই হলো মাহীনকে।
তারপরও রায়েদ একবার নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই বোধহয় টেবিলে রাখা কাগজটির দিকে চাইল। বলল,
“এবং বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতেই এখানে এসেছ তুমি?”
মাহীন উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, “অবশ্যই।”

রায়েদের ভ্রু সুচালো হলো। বললো, “তুমি কি নিশ্চিত ভাবেই আমার সাথে কাজ করতে রাজি?”

বারবার একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলায় মাহীন মহা বিরক্ত। মনে মনে ভাবল, কী সমস্যা এদের? এখন পর্যন্ত এই রায়েদ তৃতীয় ব্যক্তি যে একই কথা বারবার বলছে।’ মুখে গাঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি তোমার সাথে কাজ করব বলে ইভেন্ট জয়েন করিনি। ইভেন্টে কাজ করার জন্যে ইভেন্ট জয়েন করেছি সে যার সাথেই হোক আমার কোনো সমস্যা নেই।”
তারপর এসে রায়েদের টেবিলের অপর পাশের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। রায়েদও নিজের চেয়ারে বসে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এই স্কুলে নতুন?”

মাহীন বলল, “এখন কাজের কথায় আসা যাক।”

এই স্কুলে ও নতুন, এই বিষয়টা আর কাউকে জানাতে রাজি নয় মাহীন। তাই তাড়াতাড়ি প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। রায়েদ ড্যাম কেয়ার ভাবে বলল, “ঠিক আছে। আমরা বিগ ব্যাং থিওরি নিয়ে লিখব।

মাহীন বিস্মিত হয়ে বলল,
“কি! বিগ ব্যাং থিওরি! এটা একটা বিষয় হল?”

রায়েদ তিক্ত কন্ঠে বলল, “এমন ভাবে বলছো যেন আমি পারমাণবিক বোমা তৈরির কথা বলেছি। বিগ ব্যাং থিওরি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

“মোটেও না। এমন একটা জটিল বিষয় নিয়ে ইভেন্টে আর্টিকেল লেখার কোনো মানে হয় না। পৃথিবীতে কি জিনিস এবং জায়গার অভাব পরেছে আর্টিকেল লেখার জন্য?”

রায়েদ তিক্ত কন্ঠে বলল, “সাইন্সের মাঝেও বা সমস্যা কি?”

“এটা একটা ক্রিয়েটিভ ইভেন্ট। সুতরাং কাজের মাঝে নিজের ক্রিয়েটিভি আনতে হবে। সাইন্সের তথ্যতত্র তো যে কেউ লিখে দিতে পারে।”

রায়েদ কঠোর গলায় বলল,
“তোমার সাইন্সের সঙ্গে সমস্যাটা কি বলো তো?”

মাহীন জিজ্ঞেস করল, “তুমি সাইন্সের ছাত্র তাই না?”

রায়েদ স্বগোতক্তি করল, “হ্যা, এবং তুমি নিশ্চয়ই আর্টসের ছাত্রী?”

মাহীন কাটাকাটা ভাবে বলল, “না,আমিও সাইন্সেরই ছাত্রী।”

রায়েদ কিছুটা অবাক হলো। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,
“তাই? শুনে দুঃখীত হলাম।”

মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল। বলল,
“কি বলতে চাচ্ছ তুমি?”

রায়েদ মুখে কৃত্রিম করুণা ফুটিয়ে তুলে বলল,
“সাইন্স বিষয়টাও হয়তো আফসোস এবং লজ্জিত বোধ করছে তোমার মত ছাত্রী পেয়ে।”

মাহীনের ক্রোধে মুখটা লাল হয়ে যাওয়ার কথা তবে শ্যামলা গড়ন বলে তা স্পষ্ট ফুটে উঠলো না। নিজেকে সামলে নিতে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। তারপর তিক্ত কন্ঠে বলল,

“শুধু মাত্র সাইন্সের ছাত্রী বলে নিজেকে সাইন্সের কাছে বিক্রি করে দেইনি যে সারাদিন সর্বক্ষণ সবকিছুতে সাইন্সের জয়জয়কার করব।”

রায়েদ কফির কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দিল। পরক্ষণেই মুখটা কুঁচকে ফেললো। মাহীন স্তম্ভিত হয়ে গেল। ও ভুলেই গিয়েছিল কফির কথা। রায়েদ কাপটা ততক্ষণাৎ নামিয়ে রেখেই ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,

“এত লবণ! তুমি আমার কফির সাথে কি করেছ!”

মাহীন শুকনো ঢোঁক গিলে বলল, “যে বানিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস কর। আমি কিভাবে জানব?” বলেই উঠে দাঁড়াল ও হাতঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তারপর মাথা তুলে বলল,
“ইতোমধ্যেই একটা ক্লাস মিস হয়ে গিয়েছে। এখন এত তর্কবিতর্ক করার সময় নেই।”

রায়েদ কফির কথা ভুলে বলল, “তাহলে বিগ ব্যা…” মাহীন কথার মাঝখান দিয়ে বলল, “প্রয়োজনে আগামীকাল আবার তর্ক করব তবে বিগ ব্যাং নিয়ে আমি কিছু করতে রাজি নই।”

রায়েদ বলল, “ভুলে যাচ্ছ বোধহয়, বিষয়বস্তু আমাদের আজকেই জমা দিতে হবে।”

মাহীন বলল, “মিসেস রে কে আমি সামলে নেব।”

চলবে ইনশাআল্লাহ।

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৫
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে অনবরত ঝিঁঝি পোকাদের দল ডেকে চলেছে। দুইতলার কামরা হতে সামনের স্যকামোর গাছটাকে এক আস্ত কৃষ্ণকায় দানব লাগছে।
এর ডালপালা গুলো যেন দানবাকৃতির সাপের মতো পত্র বিশিষ্ট হাত-পা ছড়িয়ে রেখেছে জানালার সামনে। মাহীন নিজের ল্যাপটপ খুলে আরামসে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। অজস্র ভাবনায় মগ্ন মন।
জানালা দিয়ে হু হু করে আসা বাতাসে মেখে রয়েছে নিশি ফুলেদের মিষ্টি সুবাস। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর্ব ইতোমধ্যেই সমাপ্ত। প্রথন দিন সিক্রেট ট্রি থেকে নেওয়া সেই দুটো চিরকুট সামনে খুলে বিছানার ওপর ফেলে রেখেছে। ভাবছে, ‘ম্যাচ ফিক্সিং এর চিরকুট তেমন কিছু না। তবে অপর চিরকুটটা মন নাড়া দেওয়ার মত।’ যেই এটা লিখেছে তার মানসিক অবস্থা জাস্ট ভাবা যায় না। আল্লাহই জানে সে কেমন আছে। অবশ্য সে তো এখন স্কুলে নাও থাকতে পারে। সাইলোহ বলেছিল ও প্রথম গ্রেড থেকেই গাছটাকে এখানেই থাকতে দেখেছে। সুতরাং কে বলতে পারে কোন সময় কত বছর আগে এই চিরকুট কেউ এখানে লিখে রেখে গেছে। সে হয়তো এতদিনে প্রাপ্তবয়স্কও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আবার এখনো স্কুলেই থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে। তার মানসিক অবস্থা নিয়ে যদি কিছু সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার স্যাপার লেখা যেত ব্যপারটা মন্দ হত না। তবে সেই রায়েদ মাদিহ তো পরে আছে বিগ ব্যাং থিওরি নিয়ে। এমন কি মজাদার জিনিস বিগ ব্যাং? পৃথিবীর বাইরে মহাবিশ্বে কোথায় কি একটা। সেগুলো নিয়ে এত মাতামাতি করার কি আছে? আজাইরা। আর আরেক মেয়ে স্কুলেই আসেনি। সে কি চায় তাও জানি না। বড়ই ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেলাম। ওফ্ফ আজ ছুটির সময় মিসেস রেয়ের নজর এড়িয়ে বেড়িয়ে আসতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। হঠাৎ টেইল সুইফটের “রেডি ফর ইট” গানটা বেজে উঠলো কোথাও। মাহীনের ভাবনায় ছেদ পরল যখন দেখল ওর সেলফোনটা বাজছে। ফোনটা হাতে তুলে নিতেই দেখল স্ক্রিনে লেখা “ডিস্টার্বার”। মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এর আগে সকালে স্কুলে থাকা অবস্থায় ডিস্টার্বার কল দিয়েছিল তাই নম্বরটা সেভ করে রেখেছে। এবং নম্বর দেখা মাত্রই বুঝে গিয়েছিল এটা কার নম্বর। একবার বাজতে বাজতে কেটে গেল। ক্ষণকাল পরেই আবার বেজে উঠতেই মাহীন ফোনটা ধরল। সঙ্গে সঙ্গে অপর পাশ থেকে একটা কেউ বলে উঠল,
” মাহীন তুমি ফোন ধরছিলা না কেন? জানো এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমি কত চিন্তায় ছিলাম তোমাকে নিয়ে?”। মাহীন বড় দেখে একটা হাই তুললো। বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল,
“এত চিন্তা করার কি আছে? এখানে কি আমার খেয়াল রাখার কেউ নেই?”
ওপাশ থেকে বলল,
“হুহ আমি যেন জানি না তুমি কেমন। ঝামেলায় জড়ানোর বেলায় তোমার তুলনা হয় না। আর ওখানে তো একাই চলাফেরা করছ। যদি কোনো ঝামেলায় পরে যাও তখন কি হবে। আর তোমার স্কুলে নতুন কোনো বন্ধু বান্ধবী হয়নি? আর হ্যা আন্টিকে ফোন করে জানলাম তুমি নাকি একটা ক্রিয়েটিভ ইভেন্টে জয়েন করেছ?
মাহীন নির্বিকার কন্ঠে বলল,
“হ্যা করেছি। এবং আমার নতুন বন্ধুও হয়েছে। আর তোমাকে কতবার বলেছি না আমার মাকে ফোন করে বিরক্ত করবা না! ওপাশ থেকে বলল,
‘তুমি তো ফোন ধরোই না। তো তোমার খবর নেওয়ার জন্য তো আন্টিকেই ফোন দেওয়া লাগে।”
মাহীন বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমার ঘুম লাগছে। এখন রাখছি।”

ওপাশ থেকে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু এরপর থেকে ফোন করলে দয়া করে ধরো নাহলে আমি ভাববো তুমি কিডন্যাপ হয়ে গেছ।” মাহীন চোখের মণি বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে ফোনটা কেটে দিল। তারপর ফোনটা বিছানায় উল্টো করে ফেলে দিতেই আবারও “রেডি ফর ইট” গানটা বেজে উঠল। মাহীন বিরক্ত হয়ে আপন মনে বলল, আহহ,কি সমস্যা ওর! বারবার ফোন দেয় কেন?” ফোনটা বাজতেই থাকল তবে মাহীন ধরল না। থেমে গিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার বেজে উঠল। এবার মাহীন ফোনটা রিসিভ করে কিছু না দেখেই কানে দিয়েই ঝাঁঝ ভরা কন্ঠে বলল,
‘কি সমস্যা তোমার? বারবার কেন ফোন দিচ্ছ? ওপাশ থেকে এবার একজন মহিলা ইংরেজিতে শীতল কন্ঠে বলল,
“মিস ফারুকী না তুমি?” মাহীন চমকে উঠে ফোনের স্ক্রিনের দিকে চাইল। একটা আনসেভড্ নাম্বার উঠে রয়েছে। শুকনো ঢোঁক গিললো। তারপর আবার ফোনটা কানে দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“জ্বী..আমি মাহীন ফারুকী। আপনি কে?”

অপর পাশ থেকে মহিলা বলল,
“আমি মিসেস রে। সামোহির কেয়ারটেকার। আর তুমি কোন ভাষায় আমাকে গালি দিচ্ছিলা?”

মাহীন নিজের কপালে চাপর দিল। ইতস্তত করে বলল,
“আসলে আমি আপনাকে গালি দিচ্ছিলাম না। আমি আপনাকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করেছিলাম।”

মিসেস রে কঠোরভাবে বললেন,
“সেসব তো বুঝলাম। এখন তুমি আমাকে এটার কি কৈফিয়ত দিবে যে এতবার পরিষ্কার ভাবে বলে দেওয়ার পরও তুমি আমাকে আর্টিকেলের বিষয়বস্তুুর কথা জানালে না?”

মাহীন বলল, “আচ্ছা দেখুন। আরেকজন মেয়ে নাহয় আসেনি। কিন্তু রায়েদ মাদিহ তো এসেছিল স্কুলে। আপনি ওর কাছেও চাইতে পারতেন। এবং একটা কথা শুনে রাখুন রায়েদ মাদির সঙ্গে কোনো আলোচনায় যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ওর সাথে তর্ক ছাড়া আর কিছুই হয় না। ”

মিসেস রে কিছুটা বিস্ময়ান্বিত সুরে বলল,
“রায়েদ তোমার সঙ্গী? তাহলে তুমি কি ইভেন্ট ছেড়ে দিচ্ছ?”

মাহীন ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো। জিজ্ঞেস করল, “আমি কেন ইভেন্ট ছাড়ব? রায়েদের সঙ্গে কাজ করতে কিই বা এমন সমস্যা হবে? খালি একটু বেশিই অহংকারী আর খিটখিটে এই যা। এইসব আমি সামলে নিতে পারব।” বলে থেমে যাওয়ার পরও ওপাশে শুধু নিরবতা এবং নিঃশ্বাসের শব্দ। মাহীন কিছুক্ষণ কিছু শোনার অপেক্ষায় থাকল তারপর বলল,
“মিসেস রে, আপনি কি আছেন?”
এবার তিনি যেন চমকে উঠলেন। বললেন,
“ইয়ে হ্যা,হ্যা আমি আছি। যাই হোক তোমার যেভাবেই হোক এখন আমাকে বিষয়বস্তু দিতেই হবে। বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে জানাও।”

“কিন্তু আমার কাছে ওদের কারোও নম্বর নেই।”

মিসেস রে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন। তারপর বললেন,
“আচ্ছা আমি তোমাকে ওদের নম্বর ম্যাসেজ করছি।”

“কিন্তু তা করেও কোনো লাভ নেই। কারণ আমি ওদের কাউকে এখন ফোন দিচ্ছি না। একবার সময়ের দিকে তাকান। দেখেন কয়টা বাজে। আপনার ভাগ্য ভালো আমি এই সময় জেগেছিলাম।”

মিসেস রে ঝাঝের সঙ্গে বললেন,
“ওরা জেগে থাকুক আর নাই থাকুক। তোমাকে ফোন দিতে বলেছি সুতরাং তুমি ফোন দেবে।”

মাহীন আর কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দেওয়া হলো। বিরক্ত হয়ে ভাবল, ‘ধ্যৎ এই ইভেন্টে জয়েন করে কোথায় ফেসে গেলাম। আর গোমড়া মুখো মহিলা আমার পেছনেই পরে থাকে। আমার মস্তিষ্কের এতটাও খারাপ অবস্থা হয়ে যায়নি যে এই সময় ওই বদ দাম্ভিক ছেলেটাকে ফোন করব।’ তখনই সেলফোনে টিং করে একটা শব্দ হল। মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা আবার হাতে নিল। দেখল মিসেস রেয়ের নম্বর থেকে একটা মেসেজ এসেছে। তিনি দুটো নম্বর পাঠিয়েছেন। কিন্তু কোনটা কার নম্বর সেটা লিখে পাঠাননি। মাহীন মনে মনে ভাবল
‘কি আজব এখন আমি বুঝব কি করে কোনটা কার নম্বর। আর আমি এখন কি করব? সত্যিই কি ফোন দিব?’ কিছুক্ষণ নম্বর দুটোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর ঠিক করল, একবার কল দিতেই হবে। কাজেই প্রথম নম্বরটিতে সোজা কল দিল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাজতে থাকল। এক সময় কেটে গেল। কেউ ধরল না। মাহীন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কারণ কেউ ধরলেই কিভাবে কি বলতো সেটা নিয়েই চিন্তায় ছিল ও। এবার দ্বিতীয় নম্বরটায় কল দিল। অল্প কিছুক্ষণ বাজতেই সেটা রিসিভ হল। মাহীন একবার শুকনো ঢোক গিলল। ও জানে না এটা রায়েদের নম্বর নাকি চায়নিজ মেয়েটার। ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ শব্দে কাঁচের কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ ভেসে আসতেই মাহীন চমকে উঠল। এবং ফোনটা কেটে গেল। স্তব্ধ হয়ে গেছে ও। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। এবং ভাবলো, কি হলো এটা? কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ হলো কেন? এটা কার নম্বর ছিলো। এবং সে আসলে করছেটা কি? ওহ না এই নন্বরে আরেকবার ফোন দেওয়ার মতো সাহস আমার নেই।’ এবার ও মিসেস রে এর নম্বরটা ডায়েল করল। ফোনটা রিসিভ করে পরক্ষনেই ওপাশ থেকে মিসেস রেয়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। বললেন,
“হ্যা এত তাড়াতাড়ি ওদের সাথে কথা বলা হয়ে গেল?” মাহীন হতাশ কন্ঠে বলল,
“ওরা কেউই ফোন ধরেনি। তারপর ওনাকে অন্য কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলল,
” আপনি বিষয়বস্তু লিখুন সাইকোলজি, মেন্টাল হেলথ্ ডিসওর্ডার।’
মিসেস রে বললেন, “তাহলে তুমি একাই ঠিক করলে?”

মাহীন বলল,
“বাকি দুজনকে আমি সামলে নিব”।

মিসেস রে বললেন, ” আচ্ছা ঠিক আছে।’ বলেই লাইন কেটে দিলেন। মাহীন মুখে এই কথা বললেও মনে মনে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এক দিকে চায়নিজ মেয়েটা। মেয়েটা যে কীরকম সে সম্বন্ধে ওর কোনো ধারণাই নেই। তার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কেও কোনো ধারণা মেই। অপর দিকে রায়েদ মাদিহ যে কিনা অহংকারী অভদ্র এবং অতিরিক্ত গম্ভীরমুখো তাকে বোঝানো কম কথা নয়। বোধহয় সেজন্যেই কেউ এর সাথে কাজ করতে চায় না।’ ওর হ্যামস্টারটা কুই কুই করছে দেখে সেদিকে দৃষ্টি ফেরাল। বলল,
“চুনোপুঁটি তুই একমাত্র আমার দুঃখ বুঝিস।” জবাবে চুনোপুঁটি আবার কুই কুই করল। মাহীন বলল,”নারে ভাইয়া তো পুরাই বান্দর ও আর কি বুঝবে মানুষের কষ্ট।”
“কুই কুই”
“ধ্যাৎ তুই তো শুধু পারিস ভাইয়ার গুনগান করতে।
.
.
.
.
ঘড়ির কাঁটা সকাল সাড়ে সাতটা ছুঁই ছুঁই করছে। মাহীন মাত্র তৈরি হয়ে নিচে নেমে এসেছে। হালকা কমলা সোফার ওপর খোলা থাই স্লাইডিং ডোর হতে কড়া রোদ এসে পরেছে। রোদের তোরে কমলা সোফা সোনালি রঙা লাগছে। সারা ঘর উজ্জ্বলের আভায় ঝলমল করছে। সকালের পাখিরা বাগানের গাছপালা আড়ালে বসে মধুর সুরে ডাকছে। মাহীন রান্নাঘরের বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস নাসরিন কিছুক্ষণ পূর্বে উপরে গিয়েছেন কোনো কাজে। মিস্টার মোর্শেদ তৈরি হচ্ছেন নিজের অফিসে যাবেন বলে। এবং নাইমও তৈরি হচ্ছে ভার্সিটি যাবে বলে। বারের ওপর অল্প কয়েকটা স্ট্রবেরি ব্লেন্ড করে রাখা আছে। সেগুলোর সাথে আরো কিছু স্ট্রবেরি দুধ ও চিনি মিশিয়ে ব্লেন্ড করল মাহীন। তারপর একটা গ্লাসে ঢেলে নিয়ে কয়েক পিস বরফ ঢাললো। টেবিলে এসে বসল। টেবিলে আগে থেকেই টোস্ট ও ডিম পোঁচ তৈরি করে রাখা ছিল। কিছুক্ষণ পর মি.মোর্শেদ ও নাইম এসে বসলো। এরপর মিসেস নাসরিন এসে নিজের আসনে বসলেন। মাহীন মিল্কশেকটা সীপ করতেই কিছু একটা অদ্ভুত লাগল।
মুখে স্বাদের গ্রন্থিগুলো জানান দিচ্ছে এ স্বাদ মিল্কশেকের সচরাচর স্বাদ নয়। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল মিল্কশ্যাক দিকে। তারপর বলল,
“মা মিল্কশেকের স্বাদটা কেমন জানি লাগছে।”

মিসেস নাসরিন বললেন,
“কেমন লাগবে আবার। তুই বোধহয় চিনি বেশি দিয়েছিস।”

মাহীন ভারি কন্ঠে বলল,
“এটা হতে পারে না। আমার মিষ্টি বেশি পছন্দ নয় বলে মেপে মেপে চিনি দিয়েছি।”

মি.মোর্শেদ জিজ্ঞেস করলেন,
“কীরকম লাগছে খেতে?”

মাহীন বলল,
“কিছুটা টমোটোর মতো সাধ।”

নাইম হরলিকস খেতে খেতে বিষম খেল।

মিসেস নাসরিন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “আহা কতবার বলেছি আস্তে আস্তে খেতে হয়।”

মাহীন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে নাইমের দিকে। কাশি থেমে যেতেই নাইম বলল,
“কি হলো তুই আমার দিকে এমন চুন্নির মতো তাকিয়ে আছিস কেন?”
মাহীন সন্দেহ ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তুই আমার মিল্কশেকের সাথে কি করেছিস?”

নাইম শুকনো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”আচ্ছা বারের ওপর যেই বাটিটা রাখা ছিল সেটার মধ্যে কি টমেটোর সস ছিলনা?”

মিসেস নাসরিন বললেন,
“হায় কপাল তুই টমেটোর সস আর ব্লেন্ড স্ট্রবেরির মধ্যে পার্থক্যও বুঝিস না!” মি.মোর্শেদ শব্দ করে হেসে উঠলেন।

মাহীন বলল,”ভাইয়া তুই এত গাধা কেন বলতো? আর আমার ব্লেন্ড স্ট্রবেরির মধ্যে তুই টমেটোর সস কেন ঢেলেছিস?”

“আমি ইচ্ছে করে ঢেলেছি নাকি! আমি তো কালকের বেঁচে যাওয়া ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছিলাম। সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অনেকগুলে সস ছিল। তাই ওই বাটে সস আছে ভেবে ওর মধ্যে সেগুলো ঢেলে দিয়েছি।”

মাহীন মিল্কসেকের গ্লাসটা নাইমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধর তোর টমেটো সেক তুই খা।’ এমন ভাবে গ্লাসটা ওর হাতে তুলে দিল যে খানিকটা মিল্কশেক ছলকে উঠল।

তার বেশ কিছুক্ষণ পর মাহীন নিজের নতুন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরল স্কুলের উদ্দেশ্যে। গতকাল বিকেলেই মি.মোর্শেদ মাহীন ও নাইমের জন্য দুটো সাইকেল এনেছিলেন। সাইকেলে করে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছতে মোটে সাত মিনিট লাগল। রাস্তাঘাটে হালকা জাম থাকলেও সাইকেল চিকন ও হালকা পাতলা যানবাহন বলে কোনো অসুবিধা হলো না চিপাচাপা দিয়ে জায়গা করে আসতে। স্কুলের সামনে পার্কিংয়ে সাইকেলটা তালা দিয়ে রাখল। তারপর সোজা বড় গেটের দিকে এগোতেই দেখল ঠিক গেট থেকে একটু ভেতরে ঢুকতেই একটা মেয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তারপাশেই একটা সাইকেল পরে আছে। আরেকটু কাছে এগিয়ে যেতেই দেখল মেয়েটার হাঁটু খুব খারাপ ভাবে ছিলে গিয়েছে। মাহীনও মেয়েটার সামনে মাটিতেই হাঁটু গেড়ে বসে পরল। তারপর বলল,
“তোমার কি সাইকেল এক্সিডেন্ট হয়েছে?”

মেয়েটা মুখ তুলে চাইল। মেয়েটার মুখটা গোলাকৃতির, ছোট টানটান এবং ফোলা চোখ। চিকন ঠোঁট ও নাক। বব ছাটে চুল কাটা। এবং কপালের ওপর চুলগুলো ব্যাঙ্গ ছাটে কাটা।
তাকে দেখেই ধারণা করা যায় সে চাইনিজ কিংবা কোরিয়ান হতে পারে। মেয়েটা বলল,
“আসলে আমি যখন সাইকেল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিলাম তখন র‍্যবিট দ্রুত গতিতে সাইকেল নিয়ে বাইরে বের হচ্ছিল। আমি যদি সময় মত একপাশে না হেলে পরতাম তাহলে আমাদের সাইকেল একে অপরের সাথে ঢাক্কা খেত।” মাহীন এরই মধ্যে নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট ফার্স্ট এইড কিট বের করেছে। সেখান থেকে তুলো বের করে সেভলন নিয়ে মেয়েটার ছিলে যাওয়া জায়গায় লাগিয়ে দিতেই মেয়েটা চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। তারপর মাহীন সেখানে ব্যন্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। এবং বলল,
“তাহলে সম্পূর্ণ দোষ র‍্যবিটের। বুঝতেই পারছি কতটা ফাজিল ছেলে যে ওর জন্য একটা মানুষের সঙ্গে এক্সিডেন্ট হল তবুও তার কোনো হুশ নেই।”

মেয়েটা বলল,
“আচ্ছা বাদ দাও না। ও এমনি। বাই দ্যা ওয়ে আমি লিম জু ফেন। আর তুমি?”

মাহীন অবাক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে। তারপর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। বলল,
“আমি মাহীন ফারুকী। আরোও মজার ব্যাপার হলো ক্রিয়েটিভ ইভেন্টে তোমার পার্টনার কে শুনতে চাও?”

মেয়েটা আঁতকে উঠে বলল,
“দয়া করে বলো না র‍্যবিট আমার পার্টনার।”

“র‍্যবিট এর মধ্যে কোথা থেকে আসল। তোমার পার্টনার আমি।”

লিম জু ফেন নিজের সাইকেলটা তুলতে তুলতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,
“যাক শান্তি।”

“আচ্ছা আমি তোমাকে কি বলে ডাকতে পারি?”

“কি আবার লিম জু।”

“ঠিক আছে।”

“আচ্ছা প্রতিটা কাজের জন্যে তো তিনজন থেকে সাতজন বরাদ্দ থাকে। তাহলে আমাদের সাথে অবশ্যই আরেকজন আছে। সেটা কে?”

মাহীন ইতস্তত করে বললো,
“আসলে আরেকজন হচ্ছে রায়েদ ম…”

পুরো কথাটা শেষ করার পূর্বে লিম জুর চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল এবং চোয়াল ঝুলে পরল। তাই দেখে মাহীন আর পুরো নামটা বলতে পারল না। লিম জু আতঙ্কিত হয়ে তীব্র কন্ঠে বলল,
” তুমি আমাকে আগে বলবা না। আমি এইবার ইভেন্টে কাজ না করলেও তেমন বড় কিছু হয়ে যাবে না আশা করি।”

মাহীন ততক্ষণাৎ বলল,
“এই না, না একমিনিট। তুমি কেন ইভেন্ট ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছো? সমস্যাটা কোথায়?”

মেয়েটা কেমন অপ্রতিভ ভাবে বলল,
“আমি তো এটাই ভেবে অবাক হচ্ছি যে তুমি এখনো ওর সাথে কাজ করার জন্য ইভেন্টে আছ। কিন্তু আমি থাকতে পারব না বাবা। আমার এত সাহস নেই।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“দেখ আমাকে আগে এটা বুঝিয়ে বল, রায়েদ যদি সঙ্গী হয় তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কিসের ভয় তুমি কাজ করতে চাইছ না?”
ওরা দুজন রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লিম জু এখনো ওর সাইকেল টাকে টানতে টানতে সাথে নিয়ে চলেছে। মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি এখানে নতুন? আসলেই কিছু জানো না? নাকি জেনেও না জানার ভান করছ?”
মাহীন বলল,
“আগে বলোই না কি জানা উচিৎ আমার।”
লিম জু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিরাশ কন্ঠে বলল,
“আশা করি কয়েকবার না হলেও একবার অন্তত ওর সাথে তোমার দেখা হয়েছে। এবং আমি বাজি ধরে বলতে পারি ও কতটা খারাপ ব্যবহার করে তুমি বুঝতে পেরেছ। এতটা অভদ্র ও অসভ্য আচরণ এবং চরম পর্যায়ের অপমান করে সকলকেই। সেটা কয়জন মেনে নিতে পারে? আর বেশ কয়েকমাস ধরে দেখা যায়নি ঠিকই। কিন্তু কিছুদিন পরপর দেখা যায় ও কোথাও থেকে মারামারি করে আসে। ওকে দেখলেই বোঝা যায়। তাহলে বুঝতেই পারছ এত খারাপ আচরণ কোনো ভালো মানুষ করে না। এবং এইরকম ভাবে কোনো ভালো মানুষ অন্য কোনো ভালো মানুষের সাথে মারামারিও করে আসবে না। তাহলে কাদের সাথে চলাফেরা করে ও? এতটুক স্পষ্ট যে, ও চরম পর্যায়ের ঝামেলায় জড়িয়ে যায়।”
মাহীনের ভ্রু সূঁচালো হলো।বলল, “ওকি স্কুলে মারামারি করে?”
লিম জু কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত হয়ে পরল। তারপর বলল,
“আমি কখনো দেখিনি বা শুনিনি স্কুলে কখনো ও মারামারি করেছে। তবে দুই বছর আগে ডেরেনের সঙ্গে সংঘাত লাগে লাগে অবস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আর লাগেনি। ওহ হ্যা আর গত বছর তো বিলের সঙ্গে মারামারি লেগেই গিয়েছিল। অবশ্য সকলে ওদের ততক্ষণা বাঁধা দিয়েছিল।
মাহীন ভারি কন্ঠে বলল,
“বুঝলাম। কিন্তু তাতে কি এটা প্রমাণ হয় যে ও আমাদেরও কোনো ক্ষতি করবে? অবশ্যই না। আমি গতকাল ওর সাথে কথা বলেছিলাম এবং যতটুক বুঝলাম ওর ওই বাঁকাট্যারা কথা অভদ্র অচরণ এবং ছিটিয়াল ভাবটা যা একটু সহ্য করতে হবে। আর কিছুই না।”
মেয়েটা ঠোঁট ফুলিয়ে অসহায় চাহনিতে বলল,
“কিন্তু তবুও।”
“আরেহ আমিও তো সাথে আছি। তুমি তো আর একা কাজ করতে যাচ্ছ না। আমার ওপর একটু ভরসা রাখো।” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল মাহীন।
লিম জু তখন ওর পানির বোতল বের করে পানি খেতে ব্যস্ত হয়ে পরল। এখনই ওর ড্রামের মতন বোতলের পানি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ওরা ক্লাস শুরু হতে চল্লিশ মিনিট আগে এসে পরেছে। ফলে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের এখনো আসতে দেখা যাচ্ছে না। ফকফকে সাদা ফ্রেসিয়া ফুলের সঙ্গে মিলেমিশে বেগুনি ডগলাস আইরিশ গুলো হেলান দিয়ে আছে দেয়ালে। তখনই গেট দিয়ে একটা সাইকেল দ্রুত গতিতে ভেতরে ঢুকল। এবং সাই সাই করে এগিয়ে এসে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এবং লিম জু মুখ কুঁচকে গুঙিয়ে উঠল। মাহীন ভেতরের দিকে ছিল এবং লিম জু বাইরের দিকে হাঁটছিল। মাঝে ছিল সাইকেল। মাহীন জিজ্ঞেস করল,
“আবার কি হল?”
“আমার পায়ের কানি আঙ্গুল।” মাহীন ওর পাশে সরে এসে নিচে ঝুঁকল। দেখল মেয়েটার ডান পায়ের কানি আঙ্গুল একদম টমেটোর মতো লাল হয়ে ফুলে গিয়েছে।
তারপর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওটা কি র‍্যবিট ছিল?”
লিম জু সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।
“ও কি আবার ফিরে আসবে?”

“হ্যা। ও চার-পাঁচ বার পুরো জায়গাটা প্রায় সময় চক্কর দেয়। দু মিনিটের মধ্যেই হয়তো ফিরে আসবে।”

মাহীন লিম জুর হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে নিল। তারপর এদিক ওদিক চোখ বুলাল। গোল চত্ত্বরের মাঝে থাকা পানির ফোয়ারা টা চোখে পরতেই সেদিকে এগিয়ে গেল। তারপর সম্পূর্ণ বোতল ভরে পানি তুলে আনল সেখান থেকে। লিম জু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তারপর বলল,
“ফোয়ারার পানি তো পিউরিফায়েড না।”

মাহীন গম্ভীরমুখে বলল,
“পান করার জন্য আনিনি এটা। অপেক্ষা করো দেখতে পাবা।”
তার ক্ষণকাল পরেই দেখা গেল স্কুল বিল্ডিংয়ের ডান পাশের রাস্তা দিয়ে আবারও সেই সাইকেলটা দ্রুত গতিতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। আসতে আসতে ঠিক যখন মাহীনের সামনা সামনি চলে এলো, মাহীন সোজা ড্রামের মত বড় বোতলের পানিগুলো সাইকেলের দিকে ছুঁড়ে মারল। এবং চালক হঠাৎ পানির আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে সাইকেল শুদ্ধ পরে গেল। লিম জু চোখ ছানাবড়া বানিয়ে একবার মাহীনের দিকে চাইছে তো একবার র‍্যবিটের দিকে চাইছে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দরোয়ানও বড়বড় চোখ করে এদিকেই তাকিয়ে আছে। বোধহয় সে বুঝতে চেষ্টা করছে, এখানে ঘটনা টা আসলে কি ঘটলো। র‍্যবিট ছেলেটা নিজের বাম হাতটা আঁকড়ে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“ওহ আল্লাহ মরে গেলাম রে। আমার হাত টা ভেঙ্গে গেল রে। ওফ আমি এতটাই খারাপ যে আকাশ থেকে হুটহাট আমার ওপর ফুটন্ত পানি বর্ষণ হবে।”
মাহীন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। ভাবছে, কি আজব তো ছেলেটা। এমন ন্যাকামো করছে কেন? কি ভাবলাম একে আর কি বেরোলো।” ঝাঁঝের সঙ্গে বলল,
“তোমার ওপর পানি আকাশ থেকে বর্ষণ হয়নি। আমি ফেলেছি।”

ছেলেটা থমকে গেল। পেছনে ঘুরে চাইল। ফর্সা ওভাল আকৃতির মুখ। কালো চোখ কালো চুল। হালকা পাতলা শরীর। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াতেই ঠিক তালপাতার সেপাই মনে হলো। কিছুটা অবাক হয়ে চোখ ছোট করে সে বলল,
“একমিনিট আমি তোমার কি ক্ষতি করলাম? আমার ওপর পানি ফেললে কেন?”

মাহীন বলল,”তুমি আমার ক্ষতি করোনি। তবে ওর করেছ। লিম জুর দিকে ইশারা করে বলল। তারপর আবার বলল,
” প্রথমত তোমার জন্যে ওর হাঁটু ছিলে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত তুমি ওর পায়ের ওপর দিয়ে সাইকেল উঠিয়ে দিয়েছ।”

র‍্যবিট অবাক দৃষ্টিতে লিম জুর দিকে চাইল। তারপর বলল,
“ওহ আচ্ছা। তখন যেই মেয়েটা সাইকেল নিয়ে পরে গেল সেটা তুমিই ছিলা। আসলে আমার থেমে গিয়ে তোমাকে সাহায্য করা উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তোমার তেমন কোমো ক্ষতি হয়নি।”

লিম জু নরম কন্ঠে বলল,
“না,না আমি একদম ঠিক আছি।”

র‍্যবিট এবার মাহীনের দিকে চেয়ে বলল,
“আর তাই বলে তুমি আমাকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিবা? আমার তো ক্লাস আছে।”

মাহীন ড্যামকেয়ার ভাবে বলল,
“কার কি ক্ষতি হলো তোমার জন্য সেটা যেমন, তুমি ভেবে দেখার মতো বিষয় মনে করো না। তেমনি তুমি কিভাবে এই অবস্থায় ক্লাস করবা আর কি করবা, আমি সেটা ভেবে দেখার মতন বিষয় মনে করি না। তারপর ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
” লিম জু চলো আমরা যাই।” লিম যাওয়ার আগে র‍্যবিটকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি একটা ভালো বুদ্ধি দিতে পারি। এখানে অনেক কড়া রোদ। ক্লাস শুরু না হওয়া পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। তোমার কাপড় শুঁকিয়ে যাবে।” বলেই একটা ফিচেল হাসি দিয়ে লিম জু সহ প্রায় ছুটে চলে গেল।

চলবে ইনশাআল্লাহ।