কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-১+২

0
941

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

১.

‘বিয়ের আসরে আমার হবু বর কাবিননামাতে স্বাক্ষর না করেই চলে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় বলেছিলেন যে, আমি যেন তার জন্য অপেক্ষা করি কিন্তু আমরা বাড়ির লোক তা চাই না। ‘

ওপর দিকের লোকটা বললেন,
‘ আর তুমি? ‘

‘আমিও না। ‘
অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো লাবণ্য। কথাগুলো ভাবতেই চোখে নোনা জলের ভীড় জমে এলো তবুও নিজেকে সংযত করলো সে। অতীত তো অতীত ই হয়।
লাবণ্যর তুখড় নিরবতাকে ভঙ্গ করে সামনের বসে থাকা মানুষটা বলে উঠলেন,
‘তাহলে নিষ্শয়ই আপনি তাকে এখনো ভালোবাসেন। ‘

লাবণ্যর দৃষ্টি সংযত হলো, কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো, শরীরে অদ্ভুত এক জালাপোড়েন অনুভব হলো। বলতে কন্ঠ কাঁপলেও আড়ষ্ট স্বরে বলল,
‘না! ‘

তার কন্ঠস্বর শুনে সামনে বসে থাকা অপরিচিত মানুষটি বলে উঠলেন,
‘আর ইউ ওকে মিস লাবণ্য? ‘

লাবণ্য শরীরের তুমুল অস্হিরতা ভীষনভাবে অনুভব করতে লাগলো তই সেখানে চটজলদি অচেনা কেও তাকে এক দেখাতে বুঝে ফেলবে তা অস্বাভাবিক নয়।

লাবণ্য ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলে উঠল,
‘আসলে সত্যিই আজকে একটু অসুস্থ মনে হচ্ছে। আমার বোধহয় একটু রেস্ট নেওয়া উচিত। ‘

কথাটা বলে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রাক্তন কিংবা অতীত কোনটা নিয়েই কিছু বলার মতো অপ্রত্যাশিত আশা আকাঙ্ক্ষা লাবণ্যর কখনোই ছিলো না বিধায় প্রশ্ন গুলোকে এড়াতে তার এই বিরতি নেওয়া।

লাবণ্য উঠে দাঁড়ানো মাত্রই শফিক সাহেব বলে উঠলেন,
‘শেষমেশ একটা কথা জানতে পারি? ‘

লাবণ্য মূর্ছা গেল। ওনার দিকে না তাকিয়ে কন্ঠে খাদ নামিয়ে বলে উঠল,
‘জি বলুন। ‘

উনি বেশ একটা লাজুক ভঙ্গিমায় বললেন,
‘আমার কিন্তু আপনাকে বেশ পছন্দ হয়েছে লাবণ্য। আপনার ও কি আমাকে পছন্দ হয়েছে? ‘

বাকা হাসি ফুঁটলো লাবন্যর মুখে, তাচ্ছিল্যের হাসিও বলা চলে। ওনার দিকে তাকিয়ে হাসলাম আমি, ওনাকে বিভ্রান্ত করবে সেই হাসি তা নিয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
আমি বিনা বাক্য ব্যায় করে বেরিয়ে এলাম ক্যাফে থেকে। একটু দম ছেড়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম। এবার একটু শান্তি মনে হচ্ছে।
প্রতিমাসেই একটা না একটা বিয়ের সমন্ধ আনেন লাবন্যর বাবা, আর প্রত্যেকবার আমাকে এমনভাবে অপরিচিত পুরুষকে নিজের অতীতের কথা তুলে ধরতে হয় আমাকে। আমি ক্লান্ত।
ক্যাফে থেকে বড়ো রাস্তাতে নামলাম আমি। শফিক সাহেব দূর থেকে এখনো আমাকে সমানভাবে লক্ষ করে যাচ্ছেন তা তার শেষবারের চাহনি দেখেই বুঝেছিলাম আমি। আগ্ৰহ দেখাইনি আমি, কারন এটা আমার নিত্য দিনের কাজ। আদর্শ চলে যাওয়ার পর অগুনিত ছেলের সাথে তার বাবা লাবন্যর পরিচয় করিয়েছেন এই ভেবে যে এবার লাবণ্যর কাওকে পছন্দ হয়। নাহ হয়নি! কাওকেই তার মনে ধরেনি!

এ শহরে রিকশার চলাচল কম, হলুদ ট্যাক্সির আনাগোনা বেশি। হিসাব মতো হলুদ ট্যাক্সিটা আমার বাড়ির সামনে এসেই থামলো। আসার পূর্বে শফিক সাহেব তার নাম্বার টা ছোট্ট একটা চিরকূটে করে লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তা এখন কলকাতা শহরের রাস্তার কোন অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠিক নেই। বাড়ির সামনে ঢুকতেই একটা বড়ো কালো রঙের গাড়ি দেখতেই শরীরটা কেঁপে উঠলো লাবণ্যর। না এমন কোন গাড়ি এর পূর্বে কখনো তার বাড়ির সামনে দাঁড়ায়নি। অতীতের কিছু কথা মাথা নাড়া দিলো, দ্রুত সে ভাবনা ত্যাগ করে বাড়িতে ঢুকলো সে। লাবণ্যরআ থাকে এ ফ্ল্যাটের বারো তলায়। লিফট থেকে নেমে দরজাটা খুলল।বাড়ির সামনে দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখল কারোর খাওয়া সিগারেটের অর্ধাংশ মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই সিগারেট খাওয়া নিয়ে আদর্শের সাথে তার ঝামেলা হয়েছে বহুবার। আদর্শের কথা পুনরায় মনে পড়তেই লাবণ্যর শরীর রি রি করে উঠলো। তীব্র ঘৃনা সহ বলল,
‘আদর্শ আদর্শ আদর্শ। মানুষটাকে এতো ঘৃনা করি তবুও মন থেকে যায় না কেন? ‘

রাগটা বেশি চড়া হলো লাবন্যর। মনে মনে ভাবলো ভালোই হলো, এর পর বাড়িতে আর বিয়ের কথা বলার সাহস করবে না কেও এমন রাগ দেখাবে সে। রাগটা কে ধরে রেখে দরজা খুলে বাড়ির ভিতর ঢুকলো সে। চিৎকার দিয়ে বলতে শুরু করলো,

‘বাবা, কতোবার না তোমাকে বলেছি এভাবে হুটহাট করে অপরিচিত কোন ছেলের কাছে আমাকে পাঠাবে না। আর কতো? আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। আমি আর পারছি না। আমাকে আমার মতো কেন থাকতে দিচ্ছ না তোমরা? ‘

কাধ থেকে ব্যাগটা সোফায় রেখে বলে উঠলো লাবন্য। ওর আওয়াজ যেন এ বাড়ির প্রতিটি দেওয়ালে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কোনরকম কোন উত্তর পেলো না। কোনরকম কোন উত্তর না আসায় লাবণ্য পিছন ফিরে তাকালো। কেও নেই। এ বাড়ির কেও কোথাও নেই? ‘

কপাল কুঁচকে এলো তার। দরজার দিকে তাকালো। বাড়িতে মানুষ নেয় অথচ দরজা খোলা যেন কেও তারই অপেক্ষায়।

লাবণ্য চেঁচালো,
‘বাবা? বাবা? এই শুভ? শুভ? ‘

কেও উত্তর দিলো না। লাবণ্য তীব্র বিরক্ত প্রকাশ করলো। রাগে সে কটমট করে উঠলো। সবকিছু কেমন কঠিন লাগছে তার কাছে।
তার রুমের পাশের বেসিনটায় চোখে মুখে জল দিতে গেলো সে। বেসিনের সামনে গিয়ে আয়নার দিকে তাকালো সে। তার বাবা বলে সে নাকি রুপবতী। সত্যিই সে রুপবতী কিন্তু এই রুপবতীকে ছেড়ে যেতে তার প্রিয় মানুষটার একটি বারের জন্যও বুকটা কাপলো না আদর্শর? মুখের ওপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলোকে সরালো লাবন্য। উগ্ৰ এক বিষাক্ত গন্ধ ভেসে আসছে তার নাকে। সিগারেটের গন্ধ! এই বাড়িতে তো কেও সিগারেট খায় না। তাহলে কে?

ভাবতে লাগলো লাবন্য। আপন মনে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘তাহলে কি শুভ সিগারেট খাওয়া ধরেছে? ‘

রাগে তিরতির করে উঠলো লাবণ্যর শরীর। চোখ মুখ শক্ত করে ভেসে আসা গন্ধের সূত্র ধরলো সে, তার রুম থেকেই গন্ধটা ভেসে আসছে। থমকে গেল লাবন্য শিউরে উঠলো শরীর। আবছা অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলো,
‘কে? ‘

এই শহরের মানুষরা কেও ম*রে গেলেও দেখতে আসে না সেখানে আপদবিপদ হলে সাহায্যের আশা রাখা বৃথা। ভয়ে লাবন্য ওর ওড়না থেকে সেফটিপিনটা খুলে নিলো, বিপদে যদি কাজে আসে। বাড়িতে ঢোকার সময় একটা কালো রঙের গাড়ি দেখেছে সে।
নিজের রুমে আজ নিজেরই শরীর কাঁপছে লাবন্যর। ভিতর থেকে গুনগুন আওয়াজ ভেসে আসছে।
‘আমার একলা আকাশ থমকে গেছে তোমার স্রোতে ভেসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে। ”

কন্ঠ শুনে থেমে গেল লাবন্যর পা। আজ প্রায় তিন বছর পর কন্ঠটা শুনছে সে। আর ভয় পেলো না ও। ধড়ফড়িয়ে মাথা ভর্তি রাগ আর ঘৃনা নিয়ে দাঁড়ালো মানুষটার সামনে,
‘আপনি এখানে কি করছেন? বেরিয়ে যান। কারোর বাড়িতে পারমিশন না নিয়ে ঢোকা আইনত অপরাধ। ‘

লাবণ্যর সব কথাকে অগ্ৰাহ্য করে আদর্শ সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে রাগে কটমট করে বলল,
‘কালকে রাতে ফোন করেছিলাম। ফোনটা ধরোনি কেন? ‘

আদর্শর কথাতে লাবন্য অবাক হলো। অন্যের বাড়িতে অযাচিত ভাবে প্রবেশ করার পরও তার মধ্যে অপরাধবোধ নেই।

কাল রাতে তার ফোনে একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছিল ঠিকই কিন্তু লাবন্য ধরেনি। লাবণ্য নির্বাক হয়ে শুনতে লাগলো, আজ কতো বছর পর মানুষটাকে দেখছে সে। আদর্শ বলল,

‘আর আপনি করে বলছো কেন? আমি তোমার আপনি ময় তুমি নয়। আমি তোমারই তুমি। আর নিজের শ্বশুর বাড়িতে ঢুকেছি। এটা অপরাধের কিছু না। ‘

আদর্শর কথাতে লাবন্যর শরীর কেঁপে উঠলো। এ তার আগের আদর্শ নয়। যে আদর্শ ওঠে কখনো ধমক দিয়েও কথা বলেনি আজ সে ওকে ধমকাচ্ছে। অধিকার দেখাচ্ছে। লাবণ্যর দু চোখ ভরে এলো।
আদর্শকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘বেরিয়ে যান আপনি। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। বেরিয়ে যান। ‘

লাবণ্যর ধাক্কাতে আদর্শ দূরে সরে গেল একটু, পরক্ষণেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আচমকাই তার হাতটা টেনে তার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি ফিরে যেতে নয়। আর আমি কোন ভুল করিনি লাবন্য। আমি তোমাকে সেদিনও যেমনটা চাইতাম আজও তেমনটা চাই। শুধু তৈরি হয়েছে দূরত্ব। তা খুব শীঘ্রই দূর করবো। ‘

কথাটা বলে লাবণ্যর গালে হাত রাখতে গেলেই লাবণ্য আর রাগ সংযত করতে পারলো না, সপাটে একটা থা*প্প*ড় মারলো।
চিৎকার দিয়ে বলল,
‘সমাজে আপনদের মতো মানুষের বেঁ’চে থাকার অধিকার নেই যারা কারোর জীবনটাকে পুতুলের মতো নাচাই। ঘৃনা করি আপনাকে আদর্শ। ঘৃনা করি। বেরিয়ে যান আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। ‘

চড় খেয়ে আদর্শ চোয়াল শক্ত করলো। চোখটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
‘তোমরা বাড়ি চেন্জ করেছো কেন? আর তুমি কি ভাবলে বাড়ি চেন্জ করলে আমি তোমাকে খুঁজে পাবো না? হাহ! বলেছিলাম না ফিরে আসবো।”

লাবণ্যর চোখ দিয়ে এতখন নিরবে জল গড়াচ্ছিল। চড় খাওয়ার পর ও আদর্শর এমন কথা শুনে সে অবাক হলো।
আদর্শ পুনরায় বললো,
‘শোনো তোমার বাবাকে আমি বলে রাখবো যে বিয়ের ডেট ঠিক করতে। আর কারোর সাথে দেখা করতে বললে একদম যাবে না কিন্তু গেলে তোমার খবর আছে। আমি কিন্তু ২৪ ঘন্টা তোমার ওপর নজর রাখছি। ‘

আদর্শর কথাটা শুনে লাবণ্য আর থেমে থাকলো না, পাঁচ দশ এগারো ইঞ্চি হাইটের আদর্শর শার্টের কলার ধরতে লাবন্যর বেশ বেগ পেতে হলো। আদর্শকে টেনে দরজার বাইরে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ বেরিয়ে যান। লজ্জা থাকলে আর কখনো আমার সামনে আসবেন না আপনি। ‘

আদর্শ দরজার সাথে ঘেষে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আই এম সরি। একদিন তোমাকে সবটা খুলে বলবো তখন আর তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না লাবণ্য। ‘

‘ আপনি কি যাবেন নাকি আমি সিকিউরিটি ডাকবো কোনটা? ‘

আদর্শ মুচকি হেসে বলল,
‘রাগ করলে তোমাকে বেশ মানায়। আমি আজকে আসছি কালকে আবার আসবো। সাবধানে থাকো। একা একা থাকবে না, বোর লাগলে আমাকে কল করবে আমি চলে আসবো। আর শুভ বোধহয় সিগারেট খাওয়া ধরেছে। ওর ঘর থেকেই সিগারেটটা পেলাম। ওকে সাবধান করো না হলে ওর ফুসফুসটা অকালে যাবে। ‘

লাবণ্যর খুব করে বলতে ইচ্ছা করলো,
‘ আপনি কেন এখনও সিগারেট খান আদর্শ? সেটা কি খুব ভয়ংকর একটা নেশা? ‘

ইচ্ছা থাকলেও লাবণ্য কিছু বললো না। আদর্শর সামনে সপাটে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ভিতরটা কেমন খালি খালি লাগছে লাবণ্যর, শরীর ঝিমিয়ে আসছে। কেন ফিরে আসলো মানুষটা? ও তো ফিরে যেতে চাইনি! দরজার সাথে হেলান দিয়ে হাটু ভাজ করে ফুঁপিয়ে উঠলো লাবন্য। সবকিছুর মাঝে একটাই প্রশ্ন। কেন?

#চলবে,,,,

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

২.

অশান্ত এক ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে লাবণ্যর মনের মাঝে। জ্বলছে পুরোনো ক্ষত গুলো, স্মৃতিচারণ হচ্ছে পুরোনো সব ঘটনা। গমগম দুপুরের রুমের ভিতরকার ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে শরীর চুপচুপে, তার মধ্যে মেঝেতে বসে একনাগাড়ে কাঁদছে লাবণ্য। লাবণ্যর কান্নার মাঝে কলিংবেল টা আর একবার বেজে উঠতেই কেঁপে উঠলো সে। তার ভ্রান্ত ধারণা গুলোতেও এখন আদর্শের রাজ। গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘আপনাকে আমি চলে যেতে বললাম না। আবার কেন এসেছেন এখানে? ‘

দরজার ওপারে শুভ অবাক হয়ে বলল,
‘দিদি আমি। দরজা খোল।’

শুভর কন্ঠস্বর। সবকিছুতে আদর্শকে ভাবছে সে। লাবণ্যর বিরক্তর কারন হয়ে দাঁড়ালো আদর্শ। চোখটা মুছে মেঝে থেকে ওড়নাটা কুড়িয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল লাবণ্য। দরজা খুলতেই শুভর ঘামে ভেজা মুখ দেখে লাবণ্য প্রশ্ন করে উঠলো,
‘কোথায় গিয়েছিলিস তুই? বাড়ির দরজা খুলে রেখে চলে গেছিস যে কে এলো আর গেল ইয়ত্তা নেই? ‘

শুভ পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছে বলল,
‘আমি তো একটু বাজারে গিয়েছিলাম। বাবা বলল যে পনির কিনে আনতে তাই তো। কিন্তু দিদি তোমার মুখটা এমন লাগছে কেন? তুমি কি কাঁদছো? ‘

লাবণ্য বিভ্রান্ত হলো। উত্তরে কি বলবে ভাষা নেই। পুনরায় আদর্শের কথা মনে পড়লো, সে বলেছিল যে সে নাকি শুভ র ঘর থেকে সিগারেট পেয়েছে তবে তা কতোটা সত্য তা যাচাই করা উচিত। লাবণ্য তৎক্ষণাৎ ধমকে উঠলো।
‘শুভ তুই সিগারেট খাস? ‘

গোপন সত্যটা ফাঁস হয়ে যাওয়াতে শুভ যেন বেকুব হয়ে গেল। মিথ্যার উত্তরে তৎক্ষণাৎ কোন একটা গুচ্ছিত মিথ্যা জবাব দিতে হলে তা খানিকটা হলে ভেবে চিন্তে বলতে হয় কারন মিথ্যাটা এমনভাবে উপস্হাপন করতে হবে যে অপর দিকের মানুষ টা কোনরকম কোন প্রশ্ন ছাড়াই সহজে তা বিশ্বাস করে। কিন্তু শুভ তা পারলো না, তার ব্রেনের নিউরোন গুলো তার সায় দিলো না বিধায় তার মিথ্যাটা খুব সহজেই লাবণ্যর কাছে ধরা পড়ে গেল।
‘ না তো দিদি। আমি ওসব কিছু খাইনা। বাবা জানলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না। আমি ওসব কিছু ছুঁয়ে দেখি না। ‘

লাবণ্য তার ভাইয়ের গায়ে কখনো হাত তোলেনি আজও তুলবে না। চোখের দৃষ্টি কঠিন করে কটমট করে উঠলো সে, শুভর কন্ঠস্বর কাঁপছে অর্থাৎ সে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারেনি। লাবণ্য আন্দাজে ঢিল ছুড়ে বলল,
‘ আমি তো তোর ঘরে সিগারেটের প্যাকেট পেয়েছি। তাহলে ওটা কে রাখলো? বাবা? ‘

ধরা খাওয়ার ভয়ে শুভ হড়হড়িয়ে বলল,
‘ কিন্তু আমি তো জানালা দিয়ে বাইরে প্যাকেট ফেলে দিই। ‘

লাবণ্য চোয়াল শক্ত করলো, গরমে আর রাগে লাবণ্যর মুখের রক্তিম আভা দেখে শুভ বুঝলো যে সে বেফাস কথা বলে ফেলেছে। নিজের মুখটা এক হাত দিয়ে চেপে ধরলো সে। গোঙানির সুরে বলল,
‘সরি দিদি আর কখনো হবে না। তুমি প্লিজ বাবাকে এসব কিছু বলো না। ‘

লাবণ্য থমথমে মুখে চেয়ে রইলো শুভর দিকে। আজ লাবণ্য বুঝছে মায়ের শাষন আর ভালোবাসা ঠিক কতোটা প্রয়োজন। আজ তাদের মা নেই তাই শুভ শাষন পাই না, আদরে তার মাথা বিগড়েছে। লাবণ্য কিছুটা থেমে বলল,
‘আমি যেন তোকে আর কখনো সিগারেট খেতে না দেখি। এটাই প্রথম আর এটাই শেষ ওয়ার্নিং। মনে থাকে যেন। ‘

শুভ নিষ্পাপ ভাবে মাথা নাড়ালো যেন কেও অন্যায় ভাবে তার ওপর মিথ্যার এক ভারী বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। লাবণ্য রুমে চলে গেল। শুভকে শাষন করার দায়িত্বটা লাবণ্যর অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল তা লাবণ্য উপলব্ধি করছে বেশ।

.

বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময়। কালবৈশাখী ঝড়ের কোন প্রভাব যেন এই শহরে পড়ে না। গলিতে গলিতে কালবৈশাখী যেন মিইয়ে যায় নিমেষেই। আজকে আকাশ পরিষ্কার আর বেশ গরম ভ্যাপসা পরিবেশ। বাইরে হাওয়া বাতাস খেলে বেশ। টিভিতে ঝোড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস জানিয়েছে। বিল্ডিংটা প্রায় ২০ তলা তাই কখনো আর ছাদে যাওয়া হয়ে ওঠেনি লাবণ্যর। সেখানে যাওয়ার পারমিশন আছে কি তাও তার জানা নেই। ব্যালকনিতে দাঁড়ালো সে। ছোট্ট বেলিফুলের গাছটাতে কড়ি ধরেছে, টবের মাটি শুকনো। আজকে আর লাবণ্যর শরীর বইছে না তাই আর গাছগুলোতে জল দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ব্যালকনির রেলিং এ হেলান দিয়ে বসলো লাবণ্য। ডাইনিং রুম থেকে শুভর পড়ার আওয়াজ কানে এসে পৌচ্ছাচ্ছে। সামনেই তার এইচ এস এক্সাম। রান্নাঘর থেকে সুন্দর মশলা কষানোর ঘ্রাণ ভেসে আসছে, তার বাবা পনির রান্না করছে। লাবণ্য চোখ বুঁজলো। মৃদুমন্দ হাওয়াই চুলগুলো মুখের ওপর আছড়ে পড়ছে, তার অনুভুতিটাও মন্দ না। ফোনটা হঠাৎই ভাইব্রেট হয়ে উঠলো। ফোনের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না ওর, চোখ জোড়া আজ ভীষন ক্লান্ত। চোখ বন্ধ রেখে ফোনটা সামনে ধরলো, ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আনসেভ একটা নাম্বার থেকে এস এম এস এসেছে, নাম্বারটা লাবণ্যর অচেনা নয়, সে নাম্বার টা চেনে। এটা আদর্শের নম্বর যেটা থেকে কালকে ওকে কল করেছিল।

দেখার ইচ্ছা না থাকলেও তার চোখ এস এম এসটা এড়ালো না। হোয়াটসঅ্যাপ এ টেক্সট নয়, নরমাল এস এম এস।

‘ জন্মদিনের অগ্ৰিম শুভেচ্ছা🧡। ‘

লাবণ্যর চেহারায় ভাবভঙ্গির পরিবর্তন হলো না। এড়িয়ে গেল বিষয়টা। আনন্দ বা রাগ কোনটাই যেন তার মস্তিষ্কে সাড়া পেল না। ফোনটা বন্ধ করলো। পুনরায় তা ভাইব্রেট হলো।
‘এই মেয়ে, সিন করেও উত্তর দিচ্ছ না কেন? মিস ইউ! ‘

সুন্দর একটা শুভেচ্ছার পর আচমকা এমন একটা ধমকভরা এস এম এস এর জন্য অবশ্যই লাবণ্য প্রস্তুত ছিল না। বিরক্ত হলো। উপেক্ষা করার পন্হাটা তার বাবা বোধহয় আরও সহজ করে দিল, লাবন্যর বাবা মাহিম সাহেব ওকে ডেকে উঠলো,
‘লাবণ্য, মা দেখ তো শুভ অঙ্কটা মেলাতে পারছে না। ‘

লাবন্য ফোনটা অফ করে ফিকে সুরে বলল,
‘আসছি বাবা। ‘

…..

‘ তা অফিসে কি তুমি জয়েন করবে না বলছো? এভাবে আর কতোদিন? কোন বেকার ছেলের হাতে কোন মেয়ের বাবাই তার মেয়েকে তুলে দেবে না এটা মনে রেখো আদর্শ। ‘

কোকের বোতলে চুমুক দিতে দিতে আদর্শ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার বাবার কোন কথায় যেন তার কানে যাইনি। আদর্শর এমন উদাসীন ব্যাবহারে আহানাফ সাহেব বিরক্ত হলেন। বেশ ঝাঝিয়ে বললেন,
‘আমার প্রশ্নের উত্তর কি তুমি দেবে না আদর্শ? নাকি এভাবেই চুপচাপ থাকবে? ‘

আদর্শ ফোনের দিকে তাকালো। লাবণ্যর কোন উত্তর সে পাইনি। তার বাবার কথা উপেক্ষা করে ফোনের দিক তাকিয়ে বলল,
‘আন্সার ইট লাবণ্য! ‘

আদর্শের এমন কথা শুনে উনি রেগে বললেন,
‘ আবার কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছো তুমি? একটা মেয়ের জীবন তো তুমি নষ্ট করেইছো। আর কতো? ‘

বাবার কথা শুনে আদর্শ ওনার দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
‘যে মেয়েটার জীবন নষ্ট করেছিলাম তার জীবটাই আপাতত রিপেয়ার করতে চাইছি কিন্তু মেয়েটা বড্ড ঘাড়ত্যাড়া। ‘

আদর্শের কথায় আচ পেয়ে উনি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
‘ তুমি কি কোনভাবে লাবণ্যর কথা বলতে চাইছো আদর্শ? ‘

‘হম। আমার লাবণ্যর কথায় বলছি। ‘

হঠাৎ উনি গগনবিদারী চিৎকার করে বললেন,
‘ খবরদার। তুমি মেয়েটার গোছানো জীবনকে আর নষ্ট করার চেষ্টা করবে না। অনেক কষ্ট দিয়েছো তুমি তাকে আর তার পরিবারকে, আর না। তাকে তার মতো থাকতে দাও আর তুমি যেখান থেকে তিন বছর পর ফিরে এসেছো চাইলে সেখানেও ফিরে যেতে পারো। এখানে থেকে কোন নিষ্পাপ মেয়ের জীবন আমি তোমাকে নষ্ট করতে দেবো না আদর্শ। তুমি তিন বছর আগে কারোর কথা ভাবোনি শুধু নিজের কথা ছাড়া। না বলেই কাওকে না জানিয়ে তুমি চলে গিয়েছিলে তাই তুমি না ফিরলেও তার কোন প্রভাব আমাদের জীবনে পড়তো না। আমি আর তোমার মা নিজেকে সামলে নিয়েছি। ‘

ওনার কথা শেষ হতে না হতেই আদর্শ ওনার দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে নিলজ্জের মতো বলল,
‘ একটা সিগারেট দাও তো। ‘

উনি রাগে কটমট করে উঠলেন। চোখ শক্ত করে চেয়ে রইলেন আদর্শের দিকে। কঠিন সুরে বললেন,
‘তোমার যে এতোটা অধঃপতন হয়েছে তা ভাবতেই আমার লজ্জা লাগছে। এখনো সময় আছে শুধরে যাও। ‘

কথাটা বলে উনি চলে গেলেন। উনি যেতেই আদর্শ মলীন হাসলো। ঠোঁট চেপে হাসলো সে,
‘আজ কি এই অকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামবে না? হবে না কি তুমূল বর্ষন? ভিজবে কি এই শহর? কমবে কি অভিমান? সীমাহীন হবে কি এ ভালোবাসা? ‘

…..

বিছানার এক পাশে ঘুরে শুয়ে আছে লাবণ্য। চোখে তার ঘুম নেই। বারোটা বেজে পনেরো মিনিট হতে যায়। নেট অন থাকলে হয়তো জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে উঠতো তার ফোন। চোখ পিটপিট করে চেয়ে আছে ও। ঘুম আসছে না। ব্যালকনির দিকে দরজা আর পর্দা উভয়ই খোলা, ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে হুড়হুড় করে, শরীরে একরাশ প্রশান্তি ছেয়ে যাচ্ছে। দরজার কড়াঘাতে প্রশ্ন করে উঠলো,
‘ কি হয়েছে? ‘

শুভ ওপার থেকে বলে উঠলো,
‘ দিদি দরজা খোলো। ‘

লাবণ্যর আর উঠতে ইচ্ছে করলো না।
‘কি হয়েছে ওখান থেকেই বল। ‘

শুভ ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
‘আরে তুমি একটু দরজাটা খোলোই না। বলছি তো দরকার আছে। ‘

শুভ নাছোড়বান্দার মতো জেদ এটে বসলো। লাবণ্যকে ব্যার্থ হতে হলো। দরজার ছিটকানিটা খুলতেই দেখলো শুভ হাত দুটো পিছনে রেখে মুচকি মুচকি হাসছে। লাবণ্য ভ্রু কুঁচকালো।
‘কি? ‘

শুভ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
‘হ্যাপি বার্থডে দিদি। ‘

লাবণ্য আর ওর গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব ধরে রাখতে পারলো না, স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘থ্যাংকিও। যা এবার গিয়ে ঘুমা।’

শুভ গেল না। লাবণ্যকে অবাক করে দরজার কাছে রাখা প্রায় তিন ফুট সাইজের একটা টেডি নিয়ে লাবন্যর সামনে ধরে বলল,
‘ এটা তোমার জন্মদিনের উপহার। ‘

লাবণ্য হতবিহ্বল হলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুখন।
‘তুই এতোটাকা কোথায় পেলি শুভ। ‘

শুভ বিরক্ত হলো।
‘তুমিও না দিদি। সবসময় এমন প্রশ্ন। কোথা থেকে কিনেছি তার জন্যও এতো প্রশ্ন? ‘

লাবণ্যর খারাপ লাগলো নিজের এমন আচরনে। বেশ নরম হয়ে বলল,
‘আচ্ছা ঠিক আছে। এটা আমি নিজের সাথে নিয়ে ঘুমাবো। আর থ্যাংকিও সো মাচ। ট্রিট হিসাবে বিরিয়ানি রেধে তোকে খাইয়ে দেব যা। ‘

শুভ মুচকি হাসলো।
‘ গুড নাইট। ‘

‘ শুভ রাত্রি। ‘

লাবণ্য দরজা বন্ধ করলো। পুতুলটা তার বিছানার ওপর রাখলো। পুতুলটাকে আলতো স্পর্শে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো।

লাবণ্যর দরজার সামনে থেকে শুভ সরে গিয়ে ওর রুমে ঢুকে গেল। ফিসফিসিয়ে ফোনের ওপাশের মানুষটাকে বলল,
‘হ্যাঁ দিদি টেডি বিয়ার টা নিয়েছে। সন্দেহ করেনি কোনরকম। ‘

ওপাশ থেকে আদর্শ মুচকি হেসে বলল,
‘থ্যাংকিও শালাবাবু। ট্রিট হিসাবে কি চাও। ‘

শুভ সন্তর্পণে বলল,
‘ আমার দিদির মুখে হাসি। কতোদিন দিদিকে হাসতে দেখি না। ‘

আর্দশ মলীন কন্ঠে বলল,
‘ কথা দিলাম তোমার দিদির মুখে হাসি ফুটিয়ে আনবো। ‘

‘থ্যাংকিও আদর্শ দা। ‘

আদর্শ কল কাটলো। আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘এই যে চাঁদ, আমার লাবণ্য কিন্তু তোমার থেকেও রুপবতী। হিংসা করোনা যেন। ‘

#চলবে,,,,,,