কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-৩+৪

0
689

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

৩.

বাইরের চটচটে গরম আর ধুলো, পিচের রাস্তাটা গরমের তেজে গমগম করছে হাটলেই যেন পায়ে ফোসকা পড়ার উপক্রম। এতো সকাল সকাল যে রোদের তেজে বেড়ে যাবে তা লাবণ্য ভাবেনি। লাবণ্য ব্যাগটা গোছাতে লাগলো, অফিস টাইম তার কিন্তু সে আজ অফিস যাবে না,অন্য কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে সে। ঘড়ির কাটাতে সময় এখন সকাল নয়টা। বাড়ি থেকে দু পা হাটলেই ট্রামের রাস্তা ধরতে হবে তাকে। লাবণ্যর ব্যাতিব্যাস্ততা দেখে লাবণ্যর বাবা চটজলদি ঘরে ঢুকলেন। লাবণ্যকে দেখে অবাক হলেন বেশ।

‘কি রে কোথায় যাচ্ছিস সকাল সকাল? ‘

হাতের কাছে কোথাও ফোনটা রেখেছিল লাবণ্য কিন্তু এখন তা খুঁজে পাচ্ছে না। ওর বাবার কথার উত্তরটা এই মুহূর্তে দেওয়া হয়ে উঠলো না। ব্যাস্ত ভঙ্গিমায় বলল,

‘আমার ফোনটাতে একটু কল করোতো বাবা। খুঁজে পাচ্ছি না। ‘

মাহিম সাহেব তার পকেট থেকে ফোনটা বার করতে করতে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
‘কল তো আমি করছি কিন্তু আজ তোর জন্মদিন আর আজ এই এতো সকাল সকাল কাঠফাটা রোদের মধ্যে চললি কোথায়? ‘

লাবণ্য থমকালো। খানিকটা ইতস্তত বোধ করলো সে।
‘ দূরে কোথাও না। এই তো শৈলি বলল যে ওদের বাড়িতে আজকে যেতে, কলেজের কিছু একটা কাজ আছে সম্ভবত। ‘

মাহিম সাহেব ভ্রু জোড়া প্রসারিত করে বললেন,
‘যাচ্চিস যা কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবি।আজ সবাই দুপুরে একসাথে খাবো। শুভ আজ বাড়িতেই আছে। ‘

লাবণ্য ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে শীতল হাসলো। লাবণ্যর বাবা ইতিমধ্যে লাবণ্যর ফোনে ফোন করেছেন। পাপষ এর ওপর ফোনটা পড়ে থাকতে দেখে লাবণ্য চটজলদি ফোনটা তুললো। ফোনটা থেকে ধুলো মুছে ওর বাবার মুখের দিকে তাকালো।
‘জিনিসপত্র তো একটু ঠিকঠাক রাখবি তো নাকি। এতো অগোছালো হলে চলে? ‘

লাবণ্য অপরাধবোধের চাহনিতে তাকালো, ওর চাহনির ভাষা যেন মাহিম সাহেব খুব জলদি বুঝে ফেললেন। উনি লাবণ্যকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য বললেন,
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। আর এভাবে মাথা নীচু করে দাঁড়াতে হবে না। জলদি ফিরিস।’

লাবণ্য ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে লাবণ্য মায়ের ভালোবাসা কখনও বোঝেনি, তার বাবাই তার সব। তিনি লাবণ্যর মাথায় আলতো স্পর্শ করে বললেন,
‘একটু হাসি মুখে থাকবি সবসময়। তোকে যে এই গোমরা মুখে মানায় না। ‘

লাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওনার থেকে সরে এলো,
‘বাবা আসছি। ‘

‘সাবধানে যাস। আর তাড়াতাড়ি ফিরবি। ‘

লাবণ্য মাথা নাড়িয়ে আশ্বাস দিলো। বাড়ির মেইন গেটটা ঠেলে দিয়ে লিফটে উঠলো সে। ক্যাব বুক করেছে ও। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো আদর্শর থেকে বেশ কয়েকটা এস এম এস।

‘শুভ জন্মদিন। ‘

‘খেয়েছো? ‘

‘রিপ্লাই করছো না কেন? ‘

‘তোমার শরীর ঠিক আছে? ‘

‘তুমিও আমাকে মিস করছো তাইনা? ‘

এরকম আরও বেশ কয়েকটা এস এম এস। লাবণ্য বিরক্ত হলো। কপাল কুঁচকে নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেললো। ফোনটা ব্যাগে ভরে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো লিফটটার নীচে নামার।

.

‘শুভ তোমার দিদি আমার ফোন ধরছে না, বিজি বলছে তখন থেকে। তুমি একবার তোমার দিদিকে কল করে জিজ্ঞাসা করো তো যে সে কোথায় আছে? ‘

গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে সানগ্লাসটা কপালে তুলে বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদর্শ। রাস্তার ধুলো আর গরমের ঘামে তার শরীর চ্ট চ্ট করছে। আদর্শ শার্টের ওপরের বোতামটা খুলে শুভর উত্তর এর অপেক্ষা করতে লাগলো। তার কথা মতো শুভ এখন লাবণ্য কে কল করছে।
আদর্শ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। শুভর ফোন এলো।

‘আদর্শ দা, দিদিকে কল করেছিলাম। দিদি বললো তার ফ্রেন্ডের বাড়িতে আছে। ‘

আদর্শ বিরষ কন্ঠে বলল,
‘কখন ফিরবে জানো? ‘

‘তা তো জানি না তবে লাঞ্চের আগে ফিরবে কারন বাবা রান্না বসিয়েছে। দিদির বার্থডে বলে। ‘

আদর্শর বেরঙিন মুখে রঙিন হাসি ফুটে উঠলো। শুভকে থ্যাঙ্কিউ বলে কলটা কাটলো সে।

আদর্শ গাড়ি থেকে কয়েক কদম দূরে হেটে গিয়ে গাছের ছায়ার নীচে এসে দাঁড়ালো। শনশন করে হাওয়া বইছে আর আদর্শের ঘামাক্ত শরীরে শীতলতা ছেয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলো আদর্শ। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই জায়গায় লাবণ্যর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সে, তবে সেদিন লাবণ্যর চোখে ছিল একরাশ ভালোবাসা।

তিন বছর আগে,

গরম কাল হলেও কালবৈশাখী ঝড় উঠেছিল বিকালের দিকে। আদর্শ লাবণ্যকে সারপ্রাইজ দেবে ভেবেছিল কিন্তু ঝড়ের কারনে তার অনেকটাই ভেস্তে যায়।

গাছের ছায়ার নীচে একটা চায়ের টঙ ছিল, ঝড় ওঠার কারনে দোকানের মালিক তার নিজের তল্পিতল্পা গুটিয়ে হাটা দিয়েছে। আদর্শ লাবণ্যর হাত ধরে দৌড়ে ছুটে চায়ের দোকানের আস্তানায় এলো। লাবণ্য ভিজেছে অনেকটা। আদর্শ লাবণ্যকে ডেকে বলল,
‘ লাবণ্য! ‘

লাবণ্য ওর ভিজে যাওয়া শরীর ওড়না দিয়ে যথাসম্ভব মোছার চেষ্টা করছে, আদর্শর দিক তাকালো না সে, না তাকিয়েই উত্তর দিলো
‘হমম বলো। ‘

লাবণ্যর উপেক্ষাতে আদর্শ বিরক্ত হলো। লাবণ্যর হাতটা ধরে টেনে ওর সামনে এনে দাঁড় করাতেই লাবণ্যর চাহনিতে পরিবর্তন এলো।
‘ কি হয়েছে বলো তো? ‘

আদর্শ লাবণ্যর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
‘শুভ জন্মদিন লাবণ্য। ‘

আদর্শর কথাতে লাবণ্য ফিক করে বেশ শব্দ সহকারে হেসে উঠলো।
‘হাসছো যে? ‘

লাবণ্য ফিচেল কন্ঠে বলল,
‘হাসবো না? সকাল থেকে কতোবার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জনিয়েছো হিসাব আছে? ‘

আদর্শ নাক মুখ কোচকালো।
‘ সকালের পরিস্হিতি আর এখনকার পরিস্হিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন দুজনে একটা টিনের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছি, থেমে থেমে কালবৈশাখী ঝড়, মাঝে মাঝে টিপটিপ বৃষ্টি, বাতাসের দাপটে তোমার উড়ে আসা খোলা চুল মুখের ওপর আছড়ে পড়া, কালো মেঘের আকাশে তোমাকে দেখা। এই দিন আর কখনো ফিরে পাবো কি আমি জানি না লাবণ্য তাই আবারও বলবো শুভ জন্মদিন। ‘

লাবণ্য মুখে হাত দিয়ে হেসে ফেলল। আদর্শ মুগ্ধ নয়নে তাকালো। হঠাৎ বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানি তে লাবণ্য কেঁপে উঠলো, শক্ত করে আদর্শের শরীরের সাথে মিশে এলো যেন। আদর্শও আগলে নিলো তার লাবণ্যকে। আদর্শ মৌন সুরে বলল,
‘কখনো বৃষ্টি নামলে আমি আবার তোমাকে এমনভাবে দেখতে চাই, সেদিন তোমার সাথে আমিও ভিজবো। হোক না দুটো মন মিলে মিশে একাকার। ‘

লাবণ্য মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলো আদর্শর দিকে। কিন্তু সেদিন বোধহয় লাবণ্য জানতো না যে এ বৃষ্টি হয়তো তার জীবনে অনিশ্চিত।

আদর্শর ঘোর কাটলো। চোখ মেলে সামনে তাকালো ও। চারিদিকে কড়া রোদ। আজ কি তাহলে সত্যিই বৃষ্টি নামবে না? তার কি ভেজা হবে না তার লাবণ্যর সাথে?

সিগারেট ধরালো আদর্শ। এই বদ অভ্যাসটা সে এখনো ছাড়তে পারেনি তবে হয়তো ছাড়বে কোন একদিন।

.

বাড়ির কলিংবেল বাজতেই শুভ দৌড়ে ছুটে এলো। দরজা খুলতেই লাবণ্যকে দেখে গম্ভীর মুখ করে বলল,
‘দিদি তোমার আসতে এতো সময় লাগলো কেন? খাবার গরম থেকে ঠান্ডা হওয়ার পথে। ‘

শুভর কন্ঠে তীব্র ধমকের সুর সাথে গম্ভীরতা। লাবণ্য শুভকে সাময়িকের জন্য পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো যে শুভর ক্ষিদে পেয়েছে ভীষনরকম। লাবণ্য দেরি করলো না, বাড়ির ভিতর ঢুকে দরজাটা দিতে দিতে বলল,
‘সরি আসতে দেরি হলো। রাস্তায় কোন ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না। ‘

শুভ কিছু বললো না আর, সে দ্রুত পায়ে গিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো। লাবণ্যও দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে নিলো। তারও ক্ষিদে পেয়েছে বেশ, বেসিনে হাত মুখ ধুচ্ছে সে আর টেবিল থেকে খাবারের সুগন্ধ আসছেআসছে। লাবণ্যর ক্ষিদেটা বেড়ে গেল। টেবিলে বসা মাত্রই দেখলো তার সামনে বিরাট কিছুর আয়োজন। লাবণ্য চমকে গেল, তার বাবা একা হাতে এতকিছু করেছে তা ভেবে লাবণ্যর গলা ধরে এলো। লাবণ্য কম্পিত সুরে বলল,
‘ কি দরকার ছিল বাবা এতো কিছু করার! ‘

মাহিম সাহেব লাবণ্যর মুখের দিকে পায়েশ তুলে দিয়ে বললেন,
‘ তুই আমার মেয়ে, তোর জন্য করবো না তো কার জন্য করবো বলতে পারিস? ‘

লাবণ্য আবেগি হয়ে গেল। ভাবলেই কষ্ট লাগছে যে আর কিছুদিন পর সে তার এই বাবার আদর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হবে। সে দেখা করতে গিয়েছিল তার সাথে যাকে লাবণ্যর বাবা তার জন্য পছন্দ করেছিলেন। লাবণ্য তাকে আশস্ত করেছে যে সে তাকেই বিয়ে করবে। লাবণ্যর গলা ধরে এলো। নিরবে কয়েক লোকমা খেল সে তারপর চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়াতেই ফুঁপিয়ে উঠলো সে। মাহিম সাহেব ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠলেন, শুভ ও খাওয়া ছেড়ে লাবণ্যর কাছে এলো।
‘ কি হয়েছে মা? কষ্ট হচ্ছে? ‘

লাবণ্য ওর বাবাকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো, অঝোরে কেঁদে বলল,
‘ ভালোবাসি বাবা।পারলে আমাকে ক্ষমতা করো। ‘

.

রাতের দিকে জানালা দিতে গেলেই লাবণ্য দেখলো যে বাইরে প্রচন্ড হাওয়া হচ্ছে আর বিদ্যুৎ ও চমকাচ্ছে বেশ। লাবণ্য ভয়ে জানালা দিতে গেলেই মনে পড়ে গেল সেই পুরোনো দিনের কথা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর ঘোর ভাঙলো ঝমঝম করে বৃষ্টি নামার আওয়াজে। বৃষ্টির মাঝে মাঝে খুবই ফিকে কন্ঠে একটা কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।
‘ শুভ জন্মদিন লাবণ্য। ‘

লাবণ্য চমকালো। ভীষনরকম ভাবে শরীর শিউরে উঠলো তার। আদর্শ!

#চলবে,,

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

৪.

বারো তলার বিশাল ঘরগুলো লাবণ্যদের। আজ যে এভাবে ঝড় নামবে লাবণ্য তা আশা করেনি। লাবণ্য জানালা গুলো দিতে গেলেই ক্ষীণ একটা ভেসে আসা শব্দ শুনলো,
‘শুভ জন্মদিন লাবণ্য। ‘

লাবণ্যর বুক কেঁপে উঠলো। এ কন্ঠ তার অপরিচিত নয়। লাবণ্য থমকালো, না চাইতেও শরীরটা কম্পন সহ হেলতে দুলতে লাগলো যেন তার শরীর জুড়ে ভুমিকম্প চলছে। হঠাৎ বৃষ্টির জল তীব্র গতিতে জানালার শার্শিতে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো। লাবণ্যর শরীর আর এক দফা কেঁপে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,
‘আমি আপনার সাথে ভিজবো না আদর্শ। আপনি বড্ড খারাপ। ‘

লাবণ্য হাত পা গুটিয়ে মেঝেতে বসলো। আদর্শর কথামতো যে জন্মদিনে তাদের এভাবে পুনরায় বৃষ্টি হবে সে জন্মদিনে তাদের পুনরায় মনের মিলন ঘটবে। লাবণ্যর বুকটা ভারী হয়ে এলো। ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়তে লাগল ও। বৃষ্টির তোড়ে আদর্শর আওয়াজটা মিইয়ে গেছে। বেশ অনেকখন এভাবেই কাটলো। লাবণ্যর নিজেকে হতবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। ও কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ালো। বৃষ্টির বেগ একবার যখন বেড়েছে সহজে তা কমবার নয়, হঠাৎ যখন কখনো কখনো বৃষ্টি নামে তখন বুঝি তারা এমন ভয়ংকর হয়? লাবণ্য এর উত্তর জানে না।

ছাতাটা হাতে নিলো লাবণ্য, মস্তিষ্কের নিউরোন গুলো ওর সাথে তাল মেটাচ্ছে না বিধায় ওর মনকে আনচান করাচ্ছে। লাবণ্য ছাতা নিলো, জুতোটা পড়ে জলদি ছুটলো কিছু না ভেবে। লিফটের বাটন অন করতেই তা চললো না হয়তো ঝড় বৃষ্টির কারনে তা বন্ধ রেখেছে। লাবণ্যর সেখানেই বসে পড়তে ইচ্ছে করলো নয়তো নীচে নামতে গেলেই সিঁড়ি বেয়ে তার সারাদিনের এনার্জি নষ্ট।
কোনকিছু না ভেবে লাবণ্য সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো, সিঁড়ির রাস্তাটা বেশ অন্ধকার। সচরাচর হয়তো সেখান দিয়ে কেও যাতায়াত করে না। নীচে নামতে নামতে লাবণ্য হাঁপিয়ে উঠলো। মেইন গেটটা খোলা। লাবণ্য পড়ে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নিল। চারিদিকে নিরবতা আর শুনশান। লাবণ্য নেমে এলো ছাতা মেলে, বৃষ্টির ছাটে তার শরীরের অর্ধাংশ ভিজে গেছে ইতিমধ্যে। লাবণ্যর শরীর থমথম করতে লাগলো, রাস্তায় হাতেগোনা লোক মাত্র নেই। লাবণ্য এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। হঠাৎ কারোর উপস্থিতি অনুভব করতেই লাবণ্য শিউরে উঠলো। গলা শুকিয়ে এল ওর। পিছন থেকে আদর্শ বলে উঠলো,
‘বারোটা বাজতে কিছুটা সময় এখনো বাকি। শেষ মুহূর্তেও আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা গ্ৰহণ করার জন্য থ্যাঙ্কিউ।’

আদর্শর কন্ঠস্বর পেয়ে লাবণ্যর হৃদপিণ্ড থেমে আসার উপক্রম। সহ্য হলো না আদর্শর কথাগুলো। পিছন ঘুরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আদর্শকে সপাটে একটা চড় মারলো ও। লাবণ্য কাঁপছে ভীষনরকম।
আদর্শ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্য তিরস্কারের সাথে বলল,
‘ আমার জীবনটা তো শেষ করেই দিয়েছেন এখন আবার আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিতে এসেছেন? লজ্জা করে না আপনার? ‘

আদর্শ গাল থেকে হাত নামিয়ে হেসে উঠলো।
‘তাহলে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে তুমিও কেন এলে লাবণ্য? ‘

লাবণ্যর শরীর রাগে ঝলসে যেতে লাগলো যেন। মাথা থেকে ছাতাটা আদর্শর গায়ের ওপর ফেলে বলল,
‘ছাতাটা নিন আর দয়া করে বিদায় হন। আর লজ্জা থাকলে কখনো আমার সামনে আসবেন না। আর এটা একটা ভদ্র এলাকা তাই দয়া করে রাতবিরেতে নাম ধরে চেঁচিয়ে নিজেকে আরও অভদ্র প্রমান করার চেষ্টা করবেন না।’

লাবণ্য আদর্শর প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল কারন সত্যিই তার কাছে কোন উত্তর নেই। আদর্শ ছাতাটা মাটি থেকে কুড়িয়ে বলল,
‘ফেরত তো আমি আসবো, ছাতাটা দিয়ে উপকার করে আমাকে দায়বদ্ধ করলে যে।’

লাবণ্য পিছন দিকে পা বাড়ালো। সে এখানে কেন এসেছে তা ও নিজেও জানে না। বৃষ্টিতে লাবণ্য ভিজে একাকার। আদর্শ লাবণ্যর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।

‘তোমার সাথে আমি ভিজেছি লাবণ্য। ভিজেছি আমি। ”
লাবণ্য পিছু ঘুরে তাকালো না। ওর গলা ধরে এলো, বৃষ্টির জলের সাথে চোখে নোনাজলের ভিড় জমে এলো। কাঁদবে না সে, কষ্ট হলেও কাঁদবে না। আর কখনো বৃষ্টি নামলেও সে আর ভিজবে না।

বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, আদর্শকে লাবণ্য আর দেখেনি তার আশেপাশে। সে ভেবেছে আদর্শ সেদিনের পর অপমানিত বোধ করে আর তার সামনে আসবে না কখনো কিন্তু তার ধারনা ভুল। লাবণ্য রিকশায় চড়ে বসলো। আজ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্ৰি ছুই ছুই। লাবণ্যর কপাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। ওড়না দিয়ে লাবণ্য ঘামটা মুছে নিল। যেতে যেতে রিকশাটা থেমে গেল হঠাৎ। লাবণ্য কৌতূহল বশত জিজ্ঞাসা করলো,
‘সামনে কি কোন সমস্যা হয়েছে? ‘

উনি বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,
‘আমি কি করে জানবো, তুমিও যেখানে আমিও সেখানে। ‘

ওনার উত্তরে লাবণ্য দমে গেল, এতোটাও কি রুড ভাবে বলার দরকার ছিল কথাটা? লাবণ্য চোখ নামিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। ১০.৪৬ প্রায়। এগারোটার মধ্যে ওকে অফিসে ঢুকতে হয়। প্রাইভেট কম্পানি তাই চারকির ভরসা আর কে দেয়, কিছু ভুল ক্রুটি হলেই সেখান থেকে ছাটাই করতে দু মিনিট ও লাগবে না কারণ তারা জানে এ শহরের সবাই চাকরির হাহাকারে জর্জরিত।

লাবণ্যর কপালে ভাঁজ পড়ে এল। কপাল কুঁচকে রিকশা থেকে নেমে ভাবলো বাকিটা পথ হেটেই যাবে সে। রিকশার ভাড়াটা মিটিয়ে লাবণ্য পায়ে হাটা ধরলো। ভিড়ের ঘনত্ব এতোটাই বেশি যে লাবণ্য ভিড় কাটিয়ে উঠতে পারছে না, যদিও এখান থেকে তার অফিস অনেকটাই দূর। ভিড় পার করতে গিয়ে লাবণ্য এটা বেশ বুঝতে পারলো যে কারোর এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে। ভিড় কাটিয়ে লাবণ্য বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেলো সামনের অংশ দোমড়ানো মোচড়ানো একটা কালো রঙের গাড়ি। লাবণ্য থমকে দাঁড়ালো। ওর পা আর এগোলো না। গাড়ির নেমপ্লেটটা দেখলো। আদর্শর গাড়ি এটা। লাবণ্য শিউরে উঠলো। ভিড়ের মধ্যে থেকে চিৎকার আসছে বেশ। লাবণ্য ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল। লোকজনকে পাশ কাটিয়ে আদর্শর সামনে যেতেই আদর্শকে দেখতে পেলো সে। তার মাথা ফেটেছে অনেকটা, সাদা রঙের শার্টে রক্তের গাঢ় লাল লাল ছোপ ছোপ দাগ। আদর্শর মাথার চুলগুলোতে রক্ত লেপ্টে আছে। দূরে তার ফোনটা ছিটকে পড়ে আছে। অবাক হলো আদর্শকে দেখে, কারন তার শরীরের প্রতি তার কোন চিন্তা নেই, সে কিছু একটা খুঁজছে। আশেপাশের লোকজন তাকে কি বলতে চাইছে লাবণ্য তা এবার ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে।

‘আপনি কি খুঁজছেন কি? পাগল টাগল হলেন নাকি মশাই? চলেন হসপিটাল নিয়ে যায় আপনাকে। ‘

লাবণ্যর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোক বলতে লাগলো।

আদর্শ চোয়াল শক্ত করে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো, বুঝতেই পারছে যে সে কিছু একটা খুঁজছে। আদর্শর এমন হেয়ালিপনায় লাবণ্য বিরক্ত হলো। চলে যেতে নিলেই আদর্শর গলার ভয়েজ শুনতে পেলো।
‘বলছি তো আমি আমার ছাতা খুজেঁ পাচ্ছি না, ওটাই খুঁজছি। পরলে হেল্প করুন নাহলে চুপ করে থাকুন। ‘

লাবণ্য থমকে গেল। আদর্শ হঠাৎ মুখ তুলে তাকাতেই লাবণ্যকে দেখতে পেলো। লাবণ্যকে দেখে ঝটপট করে টলমল করে উঠে দাঁড়ালো সে। লাবণ্যর সামনে গিয়ে বলল,
‘ এই তো আমার লাবণ্য। দেখো না তোমার ছাতাটা হারিয়ে ফেলেছি। ‘

লাবণ্য আরও কাছ থেকে আদর্শকে দেখতে পেল। তার কপালের রক্ত গাল বেয়ে গড়াচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। আদর্শকে একটা ধমক দিয়ে শান্ত করার প্রবল ইচ্ছা জাগলো লাবণ্যর কিন্তু পারলো না। পাশ থেকে একটা লোক বললেন,
‘আপনি ওনাকে চেনেন? ‘

লাবণ ওনার দিকে তাকিয়েও কিছু বলতে পারলো না। আদর্শ কে কঠিন সুরে বলল,
‘পাগলামি বন্ধ করুন আদর্শ। ‘

‘পাগলামি কোথায় করছি, আমি তো তোমার ছাতাটা খুঁজছি। তুমি তো জানো আমি কারোর ঋণ রাখি না।’ ‘

রাগে ঘৃনায় লাবণ্যর চোখ থেকে জল গড়াতে লাগলো। আদর্শর এমন পগলামিতে আশেপাশের সবাই বিরক্ত হলো। ভিড় কমতে লাগল। লাবণ্য চোখের জলটা মুছে আদর্শর হাতটা ধরে পারে টানতে নিয়ে এলো, আদর্শ এবার ঝিমিয়ে আসতে লাগলো। একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে আদর্শকে ট্যাক্সিতে বসিয়ে ও নিজেও বসলো আদর্শ ধীরে ধীরে চোখ বুজছে। লাবণ্য হসপিটালের দিকে ট্যাক্সি যেতে বলল। আদর্শ লাবণ্যর দিকে সরে এসে লাবণ্যর কাধে মাথা রেখে গোঙানির স্বরে বলল,
‘ তোমার ছাতাটা আমি হারিয়ে ফেলেছি লাবণ্য। তোমার কাছে আমি আবার ঋণী হয়ে গেলাম। ‘

লাবণ্য ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার হলুদ রঙের ওড়নাটা আদর্শের রক্তে রাঙিয়ে গেছে। আদর্শ জ্ঞান হারালো

#চলবে,,,