কখনো বৃষ্টি নামলে পর্ব-১১+১২

0
499

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে🌦
#সুরাইয়া_আয়াত

১১.

ফ্ল্যাটের সামনের বড়ো কৃষ্নচুড়া গাছটার পাতা আর ঝরে পড়া ফুলগুলোর অবশিষ্টাংশ কম বেশি সবার ব্যালকনিতে গিয়ে পড়ে, তাতে নীচের তলার মহিলাটির কতো অভিযোগ। অনেকবার কমপ্লেইন ও করেছে যাতে গাছটা কাটে। অনেকে বলে গাছটার আনুমানিক বয়স নাকি সত্তরের কাছাকাছি প্রায়। এতো বছর ধরে গাছটা তার নিজের জায়গা অধিকার করে আছে, তাকে সরাতে গেলে কি কারোর বুক কাঁপবে না? তবে লাবণ্য কখনো বিরক্ত হয়নি, বরং ওর ভালো লাগে বেশ, সারাবছর তো আর ফুল থাকে না গাছটাতে, বছরে কয়েকটা মাসের জন্য গাছটা রাঙা হয়ে যায় তাতে লাবণ্যর চোখ জুড়ে প্রশান্তি ছায়া নামে।

সন্ধ্যা নেমে অনেকখন হলো। দুই লাখ টাকা ফেরত দিতে পেরে লাবণ্য সস্তিবোধ করছে খুব তবে টাকাটা শীঘ্রই ফেরত দিয়ে সেখান থেকে দ্রুত ইস্তফা নেওয়ার তাড়া লাবণ্যকে ব্যাকুল করছে।

চরিদিকে হালকা অন্ধকার। বাড়িতেও কেও নেই। শুভ আর ওর বাবা দুজন মিলে বাজার করতে বেরিয়েছেন। লাবণ্য নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে তাতে লাবণ্যর বাবা খুশি বেশ তাই সেই আনন্দে রাতের এই ভুরিভোজ।
পায়ের কাছে গোলাপ গাছটার দিকে তাকালো লাবণ্য, গাছটাতে সারাবছর গোলাপ হয় আর লাবণ্যর এতো অযত্ন কি মানা যায়? লাবণ্য দ্রুত ওয়াশরুমে গেল আর একটা বড়ো বালতিতে করে জল টেনে টেনে এনে দম ছাড়লো সে। মগে করে এক মগ জল ঢালতেই রিঙটোনটা বেজে উঠলো গমগম করে। রিঙটোনটা অন্য, শুভ পাল্টেছে নিশ্চয়ই। লাবণ্য রিঙটোনটা শুনে বিরক্তিকর সুরে বলল,
‘ইশ কি বিশ্রি আওয়াজটা, কানে লাগছে বড্ড। ‘

ফোনের স্ক্রিনে রাকিব নামটা বড়ো বড়ো করে ভেসে উঠলো। লাবণ্যর সকালের কথা মনে পড়ে গেল। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে বেশ থমথমে আর ভীরু কন্ঠে আওয়াজ এলো,
‘লাবণ্য কেমন আছেন? ‘

লাবণ্য ফিচেল হাসলো।

‘এই তো ভলোই। আপনি? ‘

‘আমিও ভালো। আসলে একটা কথা বলার জন্যই আপনাকে কলটা করেছিলাম আমি। ‘

লাবণ্য অবাক হলো না, হয়তো এমন কিছুরই আন্দাজ করেছিল সে।

‘হ্যাঁ বলুন না।’

অপর পাশে রাকিব যে বড্ড অস্বস্তি বোধ করছে তা বুঝতে লাবণ্যর বিন্দুমাত্র বাকি নেই। রাকিব হয়তো সময় নিচ্ছে, তবে কিছু বলছে না দেখে লাবণ্য বলে উঠলো,
‘রাকিব! আপনি কি ঠিক আছেন? ‘

লাবণ্যর কথাতে যেন রাকিব সাহস পেল।

‘হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। আসলে আমি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিলাম আরকি। ‘

লাবণ্য নির্বিকার হয়ে গেল যেন।
‘ হমম বলুন। ‘

‘আসলে আমি কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে সময় লাগবে। তাই আমি চাইছি যে বিয়েটা কিছু দিন পরে করতে। আপনার কি কোন আপত্তি আছে? ‘

কথাটা শোনামাত্রই আদর্শর কথা প্রথমে মাথায় এলো লাবণ্যর। আদর্শর ভাবনা থেকে মুক্তি পাওয়ার লোভেই লাবণ্যর এই নতুন জীবনের কথা ভাবা। তবুও একটা মেয়ে হয়ে বিয়ে নিয়ে এতোটা বাড়াবাড়ি করাটা লাবণ্যর কাছে বেমানান মনে হয়। তাই আর কিছু না ভেবে বলল,
‘ না আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার দেশের বাইরে হঠাৎ কি কাজ পড়ে গেল?’

‘আসলে আমি যে কোম্পানিতে জব করি সেখান থেকে দশ জন ইন্জিনিয়ারকে দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে বিশেষ একটা প্রজেক্টে তাই আর কি। ‘

‘ওহ! ‘

এর থেকে বেশি কিছু উচ্চারণ হলো না লাবণ্যর মুখ থেকে।

লাবণ্য নরম সুরেই বলল,
‘ আপনার বাড়ির সবাই কেমন আছে? সবাইকে নিয়ে একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন। বাবা দেখা করতে চাইছে আপনাদের সবার সথে। ‘

রাকিব বেশ একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল,
‘ সে তো হবেই। আর একটা কথা বলার ছিল লাবণ্য আপনাকে। ‘

রাকিবের এই কথাটা শুনে লাবণ্যর ভ্রু কুঁচকে এলো।
‘কি কথা? ‘

‘ আঙ্কেলের থেকে শুনলাম যে তোমরা যে ফ্ল্যাট টাতে থাকছো সেখানে ভাড়া প্রচুর। তাই আমি তোমাদের জন্য একটা নতুন ফ্ল্যাট দেখেছি। সল্ট লেকের কাছে। ওখান থেকে তোমার অফিসটাও কাছে হবে। আর জায়গাটাও বেশ ভালো। ওর আশেপাশের ফ্ল্যাটেই আগে আমি থাকতাম। ‘

লাবণ্য থমকে গেল। এভাবে হুঠহাঠ করে বাড়ি চেন্জ করার কথা সে কখনোই ভবেনি আর রাকিব কথাটা কতো সহজে বলে ফেলল। লাবণ্য খানিকটা সময়ের জন্য নির্বাক হয়ে গেল। কি বলবে ভেবে হচ্ছে না সে।

লাবণ্যর গলার আওয়াজ না পেয়ে রাকিব আড়ষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ কি লো লাবণ্য কিছু বলছেন না যে? ‘

লাবণ্যর ঘোর ভাঙলো।
‘নাহ এমনিই। বাবা তো আমাকে বাড়ি চেন্জ করার কথা কিছু বলেনি তাই ভাবছি বিষয়টা নিয়ে। ‘

রাকিব একটা হাসি হেসে বলল,
‘ আচ্ছা ভাবুন। আমি এখন রাখলাম। কাজ আছে আমার। ‘

লাবণ্য কান থেকে ফোনটা নামালো। বিষয়টার ঘোর কাটছে না ওর কাছে যেন। ফোনটা রেখে আনমনা হয়ে জল দিতে লাগলো। জল টব থেকে উপচে পড়ছে তাতে ওর খেয়াল নেই। পাশের ফ্ল্যাটের মধ্য বয়সী মেয়েটা জোরে বলল,
‘লাবণ্য দিদি জল তো পড়ে গেল। ‘

লাবণ্য কেঁপে উঠলো সাথে চমকেও গেল। সত্যিই তো, অনেকটা জল পড়ে গেছে, ফ্লোরটাতে একটা ছোটখাটো বন্যা হয়ে গেছে।

…….

খাবার টেবিলের সামনে বসে আছে লাবণ্য আর শুভ, তার বাবা কিচেনে কিছু একটা করছেন। শুভ লাবণ্যর দিকে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘সি সি। ‘

লাবণ্য বিরক্ত হয়ে তাকালো।
‘কি হয়েছে? ‘

শুভ লাবণ্যকে হাত দিয়ে ইশারা করে তারদিকে সরে আসতে বলল। লাবণ্য অনিচ্ছা দেখিয়ে শুভর কাছে সরে গেল। শুভ লাবণ্যর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ দিদি তোমাকে একটা কথা বলবো তুমি রাগ করবে না তো? ‘

লাবণ্যর কপাল কুঁচকে এলো। গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল,
‘ আবার কি করেছিস তুই? ‘

শুভ কাচুমাচু মুখ করে বলল,
‘ আরে দিদি তুমি কিছু না শুনেই আগে আগে এত ধমক ঝমক করো কেন। আগে আমায় বলতে দাও। ‘

লাবণ্য বিন্দু মাত্র টু শব্দ করলো না, চোখ পাকিয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো। শুভ লাবণ্যর চাহনি দেখে বলল,
‘আরে এভাবে তাকাচ্ছো কেন, ভয় লাগে তো। ‘

লাবণ্য দৃষ্টি নরম করে বলল,
‘বল। ‘

‘বলছি বলছি। ‘

‘হম। ‘

‘কথাটা হলো, মার্কেটে আমার আদর্শ দার সাথে দেখা হয়েছিল। দাদা বলল যে তোমার তো বিয়ে, তুমি তাকে এখনো ইনভাইট করোনি কেন? এই প্রশ্নটা করলো। ‘

লাবণ্য শুভর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ বাবা। বাবা। শুভকে একটু শাষন করো। বড্ড বাড় বেড়ে গেছে ও। ‘

কথাটা বলে লাবণ্য ঘরে চলে গেল। মাহিম সাহেব কিচেন থেকে বললেন,
‘শুভ কি করেছিস তুই? লাবণ্য কি হলো রে। ‘

লাবণ্য ওর ঘরের দরজা টেনে বলল,
‘সেটা তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করো। ‘

শুভ চোখ মুখ ছোট করে ওর নিজের রুমে ঢুকে গেল। মাহিম সাহেব খাবার টেবিলে এসে দেখলেন ছেলে মেয়ে দুজনেই কেও নেই, তিনি অবাক হয়ে বললেন,
‘ এদের দুজনের যে মাঝে মাঝে কি হয় বুঝিনা। ‘

লাবণ্য রুমে ঢুকে ফোনটা চেক করলো। কি ভেবে চেক করেছে লাবণ্য জানে। হয়তো ও বিশ্বাস করতে পারছে না যে আদর্শ তার বিয়ে টাকে এতো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখছে। লাবণ্য হয়তো একটা ফোন বা এস এম এসের আশা করেছিল। কিছু আসেনি। লাবণ্য ফোনটা নিয়ে বেশ কিছুখন ঘাটাঘাটি করলো যে এই বুঝি নোটিফিকেশন বক্সে কিছু লেখা ভেসে উঠবে। কারন আদর্শ রোজ কিছু না কিছু লিখে তাকে পাঠায়। আজ তার ব্যাতিক্রম হলো। লাবণ্য ফোনটা রেখে বাইরে গেল। কিচেনে গিয়ে ওর বাবার পাশে দাঁড়াতেই উনি বলে উঠলেন,
‘ কি রে, কি হলো তখন? ‘

লাবণ্য ওনার কথাটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল,
‘বাবা তুমি রাকিবকে নতুন ফ্ল্যাটের বিষয়ে কিছু বলেছো? ‘

উনি একটু মনে করার চেষ্টা করে বললেন,
‘ সেরকম কিছু তো বলিনি। রাকিবই তো বললো যে এখান থেকে তোর অফিসটা দূরে তাই কাছে কোথাও ফ্ল্যাট নিতে। আমি বললাম যে তুই আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস, এখন অন্য কোথাও জব করছিস। ছেলেটা তো বললো তাতে সমস্যা নেই। কথায় কথায় আমিও বললাম যে এই ফ্ল্যাটের ভাড়াটা একটু বেশি। ‘

লাবণ্য মন দিয়ে ওনার কথাটা শুনতে লাগলো। রাকিবের বলা কথাটার সাথে লাবণ্যর বাবার বলা কথাগুলো মিলছে না। লাবণ্য সত্য মিথ্যা ওর বাবার সামনে যাচাই করলো না। শুধু শুনে গেল।

লাবণ্যকে চুপ থাকতে দেখে উনি বললেন,
‘ কেন কিছু হয়েছে রে? ‘

লাবণ্য ওনার কথাতে সাই দিয়ে বলল,
‘তুমি কি সত্যিই এই ফ্ল্যাটটা চেন্জ করবে? ‘

উনি হেসে বললেন,
‘দেখ তুই আর রাকিব বিয়ে করবি। আমার মনে হয় সে আমাদের খারাপ চাইবে না কখনোই। তাই যদি ওর কথাতে ভালো কিছু হয় তো ক্ষতি কি। ‘

লাবণ্য মিথ্যা একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে এল কিচেন থেকে।
মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে ও কিন্তু কাওকে কিছু জানাতে পারছে না।

…..

আগের অফিসের টাইম টেবিল অনুযায়ী লাবণ্য এগারোটা বাজার একটু আগে অফিসে ঢুকেছে। প্রথমে খানিকটা ইতস্তত বোধ করছিল কারন সব অপরিচিত মুখ। গেটটা খুলে ঢুকতেই দেখলো সবাই যে যার কাজে লেগে আছে। লাবণ্য ভাবলো যে সবাই হয়তো আগেই চলে আসে। লাবণ্য ঢুকতেই একটা মেয়ে খানিকটা ধমকের সুরে বলল,
‘ নাম কি তোমার? ‘

লাবণ্য ঘাবড়ে গেল বেশ।
‘লাবণ্য আহমেদ। ‘

মেয়েটার পোশাক আশাক দেখে লাবণ্য বুঝলো যে সে যথেষ্ট স্মার্ট আর শিক্ষিত এবং নিঃসন্দেহে সুন্দরী।

‘নেক্সট টাইম দুই মিনিট ও লেট করলে স্যালারি কেটে নেওয়া হবে। টাইম সাড়ে দশটা। এটা তোমার মামার বাড়ি নই।’

মেয়েটার নাম স্নেহা। তার গলার আওয়াজ সবার কানেই যাচ্ছে। সবাই লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণ্যর নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। অফিসে প্রথম দিন এভাবে অপমানিত হতে হবে সে ভাবেনি।

লাবণ্যর চোখে জল চলে এল। হঠাৎ পাশ থেকে স্নেহার কন্ঠস্বরের থেকে দ্বিগুন শব্দে কেও চেঁচিয়ে বলল,
‘হে ইউ, কি হচ্ছে ওখানে। ‘

লাবণ্য নিজেও কেঁপে উঠলো। আদর্শর কন্ঠস্বর তার কাছে অপরিচিত নয়। সে আদর্শর দিকে তাকালো না, মাথা নীচু করে আছে। আদর্শ কাছে আসতেই মেয়েটা বলল,
‘গুড মর্নিং স্যার। আপনি আজ হঠাৎ? ‘

আদর্শ লাবণ্যর চোখের দিকে তাকালো, ছলছল করছে। স্নেহার দিকে দাঁত কিড়কিড় করে বলল,
‘আমি এখনে কেন তার কৈফিয়ত তোমাকে দেব? ‘

স্নেহা দমে গেল।
‘সরি স্যার। ‘

‘ কি বলেছো তুমি ওনাকে? ‘

স্নেহা বলল,
‘ নেক্সট দিন তাড়াতাড়ি আসার কথা। ‘

আদর্শ লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার বাবা কয়েকদিনের জন্য বাইরে গেছেন। আমি এখন থেকে রোজ অফিসে আসবো। ‘

সবাইকে উদ্দেশ্যে করে বলল আদর্শ। সবাই একসাথে বলল,
‘ইয়েস স্যার। ‘

আদর্শ পকেটে হাত রেখে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ নাম? ‘

লাবণ্য প্রথমে চুপ থেকে বলল,
‘লাবণ্য আহমেদ। ‘

‘শিক্ষাগত যোগ্যতা? ‘

‘ কেমিস্ট্রি তে মাস্টার্স। ‘

আদর্শ যেতে যেতে বলল,
‘ফলো মি। ‘

লাবণ্য আদর্শর সাথে সাথে গেল। আদর্শ কেবিনে ঢুকলো। লাবণ্য আদর্শর কূবিনে ঢুকে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

আদর্শ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘লুক এট মি। ‘

লাবণ্য এক কথাতে আদর্শর দিকে তাকালো।
সাদা শার্ট আর ফরমাল লুক। লাবণ্য তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে নিল।
আদর্শ লাবণ্যর দিকে একটা ওর রুমাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘চোখ মোছ। ‘

লাবণ্য তো জন্মগত ঘাড়ত্যাড়া। সে নিজের ওড়না দিয়ে মুছলো। আদর্শ কিছুটা রেগে গেল। নিজের চেয়ারে বসে বলল,
‘ আজ থেকে তোমার কাজ হলো তুমি আমার পি এ। মানে পার্সোনাল এসিসটেন্ট। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে আমার সাথে ছাতার মতো লেগে থাকবে। এটাই তোমার কাজ। স্যালারি দেব পার মান্থ ত্রিশ হাজার। ‘

লাবণ্য গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ আমাকে অন্য কাজ দিন। আমি কম্পিউটারের সমস্ত কাজ জনি। ‘

আদর্শ ফাইল হাতে নিয়ে বলল,
‘ আমার তো পি এ ই লাগবে। ‘

লাবণ্য আর কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো স্যালারির কথাটা শুনে আর না করতে পারলো না ও।

আদর্শ তার নিজের কাজে মনোযোগ দিল, লাবণ্য দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকখন ধরে, না পেরে কিছুখন পর বলল,
‘ এখন আমার কাজ কি? ‘

আদর্শ লাবণ্যর দিকে না তাকিয়ে, ফাইল চেক করতে করতে বলল,
‘ আমাকে দেখা। আমার দিকে তাকিয়ে থাকো তখন যতখন না প্রেমে পড়ে যাও। আর পা ব্যাথা হলে চেয়ারে বসতে পারো। ‘

লাবণ্য কথাটা শুনে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর সোজা অফিসের বাইরে।

আদর্শ মুচকি হাসলো।

#চলবে,,,

#কখনো_বৃষ্টি_নামলে
#সুরাইয়া_আয়াত

১২.

সারাটা রাস্তা হেটেই গেল লাবণ্য, এক নিশ্বাসে যেন সে বিশ পা হেটেছে সে। মনের ভিতর গড়ে উঠেছে রাগের এক মস্ত পাহাড়। লাবণ্য হাটতে হাটতে কখন বাড়ি পৌছে গেল তা ও নিজেও যানে না। কতখন সময় লাগলো বা কিছু কোন কিছুর হিসাব নেই। লিফটে উঠেও তরতর করে ঘামতে লাবণ্য। ওড়না দিয়ে এলোপাতাড়ি মুখ মুছতে লাগলো সে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি সম্ভবত ফ্ল্যাটে নতুন, লাবণ্য তাকে আগে দেখনি তাই হয়তো উনি আর কিছু বললেন না। লাবণ্য লিফট থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজা খুলে নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় গিয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লো। চোখটা খুলে বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছে। মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে, একটা পর্যায়ে লাবণ্যর চোখটা বন্ধ হয়ে এলো আর শরীরটাও নিস্তেজ হয়ে গেল। তার শরীরের ঘামে বিছানা ভিজে একাকার। জ্ঞান হারালো লাবণ্য।

/

চোখটা পিটপিট করে তাকালো লাবণ্য শুভর ডাকে।
‘দিদি এই দিদি। ওঠো। আর কতো ঘুমাবে?’

লাবণ্য আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় বলল,
‘ তুই যা শুভ। আমাকে আর একটু ঘুমাতে দে। ‘

শুভ কপাল চাপড়ে বলল,
‘তুমি কখন থেকে ঘুমাচ্ছো হিসেব আছে? আমি বাড়িতে এসেও দেখি ঘুমাচ্ছো, আর এখনও ঘুমাচ্ছো। দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়লো, বিকেল থেকে সন্ধ্যা। আর এখন আটটা বাজে। এখন এতো ঘুমালে রাতে কখন ঘুমাবে? ‘

শুভর কথা শুনে লাবণ্য ধড়ফড় করে বিছানা ছাড়লো, সরাসরি আয়ানার সামনে চোখাচোখি হতেই লাবণ্য থতমত খেল। বিধ্বস্ত লাগছে নিজেকে। লাবণ্য দ্রুত ওড়না গায়ে জড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। শুভ বাইরে থেকে ডাক দিল,
‘দিদি মুশুর ডালের পকোড়া খাবে? আদার চাটনিটাও দিয়েছে। তোমার তো ফেভারিট। ‘

শুভর কথার কোন প্রতিউত্তরে লাবণ্যর জবাব এলো না। শুভ ডালের পকোড়ার বাটিটা নিয়ে খাবার টেবিলে অপেক্ষা করতে লাগলো। যতখন না তার দিদি আসছে ততখন সে খাবে না।

গালে হাত দিয়ে শুভ বসে রইলো প্রায় আধা ঘন্টা। লাবণ্য আসছে না এখনো। শুভ তবুও সেখান থেকে নড়লো না। তারপর একটা পর্যায়ে লাবণ্য ওর পাশের চেয়ারে এসে বসলো। লাবণ্যর দিকে তাকাতেই শুভ মুচকি হাসলো। নির্বিকারে বলল,
‘ দিদি তোমাকে একদম মা মা লাগছে জানো তো। ‘

শুভর কথা শুনে লাবণ্য মুচকি হাসলো কিন্তু কিছু বললো না আর। শুভ লাবণ্যর হাসি দেখে বলল,
‘দিদি তোমার মন ভালো হয়েছে? ‘

লাবণ্য ডালের পকোড়া হাতে তুলে শুভর মুখের সামনে ধরে বলল,
‘কেন খারাপ ছিল বুঝি? ‘

শুভ লাবণ্যর হাত থেকে খেয়ে বলল,
‘না ঠিক তা না। মনে হলো আরকি। ‘

লাবণ্য নিজেও খেতে লাগলো।

‘আচ্ছা তোমার নতুন অফিস কেমন? সেখানের মানুষজন সবাই ভালো তো? ‘

শুভর কথা শুনে লাবণ্যর আদর্শর কথা মনে পড়ে গেল। লাবণ্য মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘হমম ভালোই। ‘

লাবণ্যর কথা শুনে শুভ মুচকি হাসলো তা লাবণ্যর নজর এড়ালো না। লাবণ্য কৌতূহল বশত জিজ্ঞাসা করলো,
‘কেন কেও কিছু জিজ্ঞাসা করেছে? ‘

শুভ হাসি চেপে বলল,
‘ কই না তো। আমাকে আবার কে কি বলবে। আমি ছোট মানুষ। ‘

কথাটা বলে শুভ পুনরায় হাসতে লাগলো। লাবণ্য চাপা রাগটা সংযত করে বলল,
‘হ্যাঁ তুমি তো এখনো শিশু। কিছু বোঝ না। ‘

শুভ এবার হেসেই ফেলল। লাবণ্য রাগ দেখিয়ে বলল,
‘তুমি না ছোট। ছোটর মতো থাকো। ‘

‘আচ্ছা। ‘

/

সকাল এগারোটা বাজে। অফিসে মানুষের কোলাহল। আদর্শ অফিসে ঢুকলো। তাকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে গুড মর্নিং জানালো। আদর্শ কখনো এমন ভাবে বাঁচতে চাইনি। শুধুমাত্র লাবণ্যর কারণে তার এতোদূর আসা।
আদর্শ অফিসে ঢুকতেই স্নেহা একপ্রকার ছুটে এসে বলল,
‘গুড মর্নিং স্যার। ‘

‘হমম মর্নিং। ‘

স্নেহাও আদর্শর সাথে যাচ্ছে দেখে আদর্শ বলল,
‘কি ব্যাপার। কিছু বলবে? ‘

আদর্শ বেশ নরম কন্ঠে কথা বলতেই স্নেহা বলে উঠলো,
‘স্যার আজ আপনার পি এ সময়ের আগেই চলে এসেছে। কালকে যেভাবে বেরিয়ে গেল আমি তো ভাবলাম সে আর আসবে না। আজকে এসেছে। আর ওনার কি একটু মেকওভার করা উচিত নয় কি? আমরা সবাই ফরম্যাল গেট আপ এ আসি আর সে! ‘

স্নেহার কথা শুনেও আদর্শ রেগে গেল না। বেশ স্বাভাবিক ভাবে স্নেহাকে উপেক্ষা করে সকলকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
‘সবাইকে একটা কথা আজকে বলে রাখি। ফরম্যাল গেট আপ এ আসতে হবে এমনটা বাধ্য বাধকতা নেই। আপনারা যেটাতে নিজেকে কমফোর্ট এবেল মনে করেন সেটাতেই আসবেন। আর কেও কিছু বললে আমাকে এসে বলবেন বাকিটা আমি বুঝে নেব। ‘

স্নেহাকে উদ্দেশ্যে করে আদর্শ বলে চলে গেল। আদর্শর কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো লাবণ্য। আদর্শর গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। সে নিজেও ভাবেনি যে কালকের পর সে আর কখনো এই অফিসের মুখোমুখি হবে। কিন্তু সে আজকে আদর্শর কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভাবলে নিজেরই একটু অদ্ভুত লাগছে লাবণ্যর। কি কারনে সে এলো তা ও নিজেও বুঝতে পারছে না। লাবণ্য মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আদর্শ লাবণ্যর সামনে এসে দাঁড়াতেই লাবণ্য বললো,
‘গুড মর্নিং স্যার।’

কথাগুলো বলতে খানিকটা অদ্ভুত লাগলেও লাবণ্য বললো, কারন এটা একজন স্টাফ হিসেবে ভদ্রতা।

আদর্শ মাথা নাড়িয়ে রুমে ঢুকে গেল। লাবণ্য গুটিগুটি পায়ে আদর্শর পিছন পিছন রুমে ঢুকলো। আদর্শ চেয়ারে বসে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলো, লাবণ্যর দিকে তাকালো। তারপর বলে উঠলো,
‘ ডালের পকোড়া একা একাই খেলেন মিস লাবণ্য? ‘

লাবণ্য চমকালো। তাহলে কি?

লাবণ্য উত্তর দিল না। নিরব হয়ে রইলো।
‘স্যার আমার কাজটা আমকে জানালে সুবিধা হতো। ‘

‘বসো। ‘

লাবণ্য সোফাতে গিয়ে বসলো। আদর্শ লাবণ্যর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
‘সোফাতে? আমার কোলে বসলেও কিছু মনে করতাম না যাই হোক। ‘

কথাটা বলে আদর্শ হেসে উঠলো। লাবণ্যর রাগ হলো বেশ। আদর্শ হাসি থামিয়ে বলল,
‘একটা টোস্ট আর এককাপ কফি আনো। ব্রেকফাস্ট করিনি আমি। ‘

কথাটা শোনামাত্রই লাবণ্য বেরিয়ে গেল। সে আদর্শর সামনে থেকে ওঠার জন্য হাসফাস করছিলো।

আদর্শ আড়চোখে লাবণ্যর যাওয়ার দিকে তাকালো।

লাবণ্য কিছুখন পর কেবিনে এসে দেখলো আদর্শ কোথাও নেই। কফিটা টেবিলের ওপর রেখে সোফাতে বসলো ও।
অফিস ঠান্ডা বাতাসে শরীর আর মন দুটোই ফুরফুরে লাগছে ওর কাছে। আদর্শ হঠাৎ কেবিনে ঢুকে বলল,
‘মিস লাবণ্য চলুন আমাদের এক্ষনি বেরোতে হবে। ‘

লাবণ্য অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কোথায়? ‘

আদর্শ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘মিটিং এ। ‘

কথাটা বলে আদর্শ বেরিয়ে গেল। লাবণ্য কফি আর টোস্টটার দিকে তাকিয়ে রইলো। আদর্শ না খেয়েই বেরিয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলো আদর্শ গাড়িতে বসে আছে। লাবণ্য গিয়ে পিছনের সিটে বসতেই আদর্শ বলল,
‘আমি আপনার ড্রাইভার নই। সামনে এসে বসুন।’

লাবণ্য বিনা বাক্য ব্যায় না করে পাশে এসে বসলো।

আদর্শ ড্রাইভ করতে করতে বলল,
‘কালকের ডালের পকোড়া হজম হয়েছে নাকি আ্যসিডিটি হয়েছে কোনটা? ‘

লাবণ্য নিরব। আদর্শ চুপচাপ রাস্তার একটা টার্ন নিলো। মেইন রোড থেকে রাস্তাটি বিচ্ছিন্ন। হয়তো গ্ৰামের রাস্তা।

#চলবে,,,,