কি আশায় বাঁধি খেলাঘর পর্ব-০৭

0
276

কি আশায় বাঁধি খেলাঘর (০৭)

চন্দ্র নিজেকে সামলে নিলো খুব দ্রুত।কিন্তু সামলে নিলেও পরিবর্তন হলো কিছুটা চন্দ্রর স্বভাবে।আগের চাইতে বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে।
সব ঠিকঠাক করে নতুন বাসায় উঠলো ১ সপ্তাহ পরে।
নিষাদ প্রতি রাতে একবার করে চন্দ্রর নাম্বার বের করে। তারপর চিন্তাভাবনা করে কল না দিয়েই ফোন রেখে দেয়।

চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায়। আকাশে আজ থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে। কুয়াশা ভেজা চারদিকে চাঁদের আলো মনে হচ্ছে যেনো কুয়াশার গায়ে চাদর জড়ানো।
চারদিক ভেসে যাচ্ছে জোছনায়।

এমনই এক কুয়াশা ভেজা ভোরে সোহানের সাথে চন্দ্রর দেখা হয়েছিলো।আজ আবার তেমন কুয়াশা ভেজা সন্ধ্যায় সোহানের সাথে বিচ্ছেদ হলো।
জীবন বড় রঙ বদলায়।যাকে একদিন মনে হয়েছে অক্সিজেন সেই এখন কার্বনডাইঅক্সাইড হয়ে গেলো।
চন্দ্রর হাসি পাচ্ছে এসব ভেবে।আফসোস হচ্ছে না মোটেও।
হাসতে হাসতে চন্দ্রর মনে হলো আচ্ছা সোহানের এই রূপ বদল যদি বিয়ের পরে হতো তবে কেমন হতো?
চন্দ্র কিভাবে মেনে নিতো তখন?
আদৌ কি মানতে পারতো?

না-কি বেছে নিতো মায়ের দেখানো পথ?
খুন করতো কি সোহান কে?

চন্দ্র বুঝতে পারলো ও উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে।এলোমেলো চিন্তা করছে।
বারান্দা থেকে গিয়ে নিজের রুমে শুয়ে পড়লো।
ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আগামীকাল নিজেদের পুরনো বাসায় যাবে।যে বাসায় বাবা মায়ের সাথে ছিলো,তারপর থেকে ফ্ল্যাটটা তালা মারা।

মাঝরাতে চন্দ্রর ঘুম ভেঙে গেলো ফোনের শব্দে।কল রিসিভ করতেই শুনতে পেলো ওপাশ থেকে কেউ গিটারে গান গাইছে,

“ও কারিগর,দয়ার সাগর
ওগো দয়াময়….
চান্নি-পসর রাইতে যেনো,আমার মরন হয়
চান্নি-পসর রাইতে যেনো আমার মরন হয়….

গান শুনতে শুনতে চন্দ্র আনমনা হয়ে গেলো। চোখের কোণ ভিজে উঠলো চন্দ্রর।কি দরদী গলায় গাইছে কেউ।
চন্দ্রর মনে হলো আজ যে জোছনা রাত,আজ যদি চন্দ্রর মরন হতো,কতোই না ভালো হতো।

গান বন্ধ হতেই চন্দ্র শুয়ে পড়লো। ফোনে যে কেউ কানেক্টেড সেই কথা মনে রইলো না চন্দ্রর।
নিষাদের রাত কাটলো চন্দ্রর নিশ্বাসের শব্দ শুনে।

সকালে ৮ টায় ঘুম থেকে উঠে ফোন চেক করতেই চন্দ্র চমকে উঠলো। ৭ ঘন্টা ১২ মিনিট ধরে কল চলছে।কে কল দিয়েছে চন্দ্র তাও জানে না।কল না রেখে এভাবে আছে কেনো কিছুই বুঝতে পারছে না চন্দ্র।
চন্দ্রর মনে হলো কল দেওয়া ব্যক্তি ও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আর কল কাটে নি।
তবু শিওর হতে চন্দ্র ফোন কানে নিয়ে বললো,”হ্যালো…..”

নিষাদ জবাব দিলো, “জ্বি বলুন।রাত ভরে তো নিশ্চিন্তে ঘুমালেন।পাহারাদার হিসেবে জেগে জেগে ফোনের এপাশ থেকে পাহারা দিয়ে গেলাম আমি শুধু।
আমার ডিউটি শেষ,এবার আমি ঘুমাই ম্যাডাম।পরে কথা হবে।”

চন্দ্র কিছুই বুঝতে পারলো না। কল দিলো কিন্তু নিষাদ কু রিসিভ করলো না।
চন্দ্র খুব অবাক হলো এই ঘটনায়।

ধানমন্ডি থেকে তেজগাঁও যেতে যেতে চন্দ্রর বুকের ভিতর কেমন ঢিপঢিপ করতে লাগলো।
বারবার মনে হতে লাগলো বাসায় গেলেই যেনো আব্বা আম্মা দুজনেকেই দেখবে।
হয়তো দেখবে দুজনের মধ্যে ভীষণ ভাব।অথবা দেখবে আম্মা ওর জন্য নাশতা রেডি করে বসে আছে।আব্বা বসে বসে চা খাচ্ছে।
কি হতো যদি জীবনটা এরকম হতো চন্দ্রর?
বাবা মা দুজনেই বেঁচে থাকতো।সবার বাবা মায়ের মতো আদর স্নেহ দিয়ে ওকে বড় করতো।
একটা জীবন যাবে চন্দ্রর বাবা মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আক্ষেপ করে করেই।

বাস থেকে নেমে চন্দ্র কিছুটা অবাক হলো। কতো বছর পরে এলো এখানে।সব কিছুই কেমন অচেনা হয়ে গেছে। কিছুই চেনা যাচ্ছে না। চন্দ্রদের বাসা কোনটা সেটাও চন্দ্রর মনে নেই।
কোন দিকে যাবে চন্দ্র বুঝতে পারছে না।
কাউকে যে জিজ্ঞেস করবে তাও পারছে না।কি বলে জিজ্ঞেস করবে?

চন্দ্র একই জায়গায় ঘুরতে লাগলো।
বয়স্ক এক লোক চন্দ্রকে অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করলেন।তারপর চন্দ্রর কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,”কই যাইবেন আপনি?
কার কাছে আসছেন?”

ইতস্তত করে চন্দ্র বললো,”আমি একটা বাসা খুঁজছি,কিন্তু পাচ্ছি না।বাসার ঠিকানা ও জানা নেই আমার।”

লোকটা জিজ্ঞেস করলো,”কার বাসা?
বাড়িওয়ালার নাম কী?”

চন্দ্র ভাবলো একবার বাবার নাম বলবে।পরে মনে হলো,বাবা মা তো বেঁচে নেই।কে চিনবে তাদের।
একটু ভেবে চন্দ্র জবাব দিলো,”কয়েকবছর আগে এক মহিলা তার স্বামীকে খুন করেছিলেন গলা কেটে,তারপর নিজেও গলায় দড়ি দিয়ে মারা যান।ওনারা আমার বাবা মা ছিলেন।আমি আমাদের পুরনো বাসাটা খুঁজছি।”
লোকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রর দিকে। তারপর বললো,”আসেন আমার সাথে।”

চন্দ্রকে নিয়ে লোকটা হাটতে শুরু করলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে চন্দ্র লোকটার পিছু নিলো।

৫ মিনিটের মতো হাটার পর চন্দ্র নিজেই থমকে দাঁড়ালো একটা ৬ তলা বিল্ডিং এর সামনে এসে।লোকটার আর কিছু বলতে হলো না।বিল্ডিংয়ের গেইটের পাশে লিখা আছে,”চন্দ্রমহল”

চন্দ্রর কান্না পেলো ভীষণ। আহারে!
এই তো সেই বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের নীল রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
গেইট জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। বিল্ডিংয়ের সামনে একগলা সমান কচু গাছ জন্মেছে।
গেইটের পাশের বাগানবিলাস গাছটি দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।চারদিকে আগাছা জন্মেছে।কয়েকটি রুমে আলো দেখা যাচ্ছে।
চন্দ্র কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলো ভিতরের দিকে।
সিঁড়ি ভেঙে চন্দ্র ৩ তলায় উঠলো।বাসার চাবি চন্দ্রর ব্যাগের মধ্যে। চন্দ্র অভ্যস্ত হাতে তালা খুলে নিলো।যেনো বহুদিন ধরে এই বাসার তালা সে খুলছে।
ভিতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধে চন্দ্রর বমি পেয়ে গান। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে সুইচ টিপে বাতি জ্বালানো।
সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাকালো বসার ঘরের দেয়ালের দিকে।
এই ঘরে কেটেছে জীবনের ৮ টা বছর।
ধুলোমাখা ঘরের সব আসবাবপত্র। চন্দ্র সোজা বাবা মায়ের রুমে গেলো।
চন্দ্রর মনে পড়ে গেলো সেই রাতের কথা।বিছানা বালিশ সব আগের মতো আছে।শুধু মানুষ নেই।
বুকের ভিতর কেমন খাঁখাঁ মরুভূমির মতো লাগছে।তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে,অথচ এক ফোঁটা পানি দেয়ার মতো কেউ নেই এখানে।
চন্দ্র ঘুরে ফিরে সব দেখলো।

নিজের রুমে গেলো।রুমটা আগের মতো আছে।বিছানা বালিশ সব ঠিকঠাক করে পাতা আছে।জেমেছে শুধু ধুলোর আস্তরণ।

আবারও আব্বার রুমে গেলো।এই রুমটা পুরোপুরি আব্বার দখলে থাকতো।চন্দ্র তার আম্মাকে কখনো দেখে নি এই রুমে ঢুকতে কোনো প্রয়োজনে। যেনো রুমটা অচেনা কোনো মানুষের।
এমনকি ঝাড়ুও চন্দ্রর বাবা নিজে দিতো নিজের রুমে।

চন্দ্র বাবার আলমারি খুললো।আলমারিতে দেখলো বাবার কতো জামাকাপড় রয়েছে।ইঁদুর কেটে শতচ্ছিন্ন করে রেখেছে সব।
আলমারি থেকে কেমন পঁচা একটা উৎকট গন্ধ আসছে।
চন্দ্র সব কাপড় বের করলো আলমারি থেকে।কাপড়ের ভাজ থেকে একটা নীল রঙের রুমাল পড়লো।
চন্দ্র রুমালটা তুলে নিলো।রুমালের কোণে ছোট অক্ষরে লিখা আছে “আপনার জন্য ভালোবাসা ”

চন্দ্রর বুকের ভিতর কেমন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো লিখাটা পড়ে।
তবে কি আব্বা কোনো পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন?

চন্দ্রর স্পষ্ট মনে আছে মা এসব সুই সুতো দিয়ে কিছু বানাতে বা লিখতে পারতো না।
একটা বালিশের কাভারে একবার ফুল তুলতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে রেখে দিয়েছিলো।চন্দ্র তখন হাতে নিতেই আম্মা চিৎকার করে বলেছিলো,”ছুঁবি না খবরদার। আমার জীবনের প্রথম সুই সুতোর কাজ এটা,আমি চেষ্টা করবো। হাত ও লাগাবি না এটাতে।”

চন্দ্র অবশ্য কখনো আর দেখে নি আম্মাকে এসবে হাত দিতে।
সেই কাভারটা খুঁজতে চন্দ্র দৌড়ে নিজের রুমে গেলো।ওয়ারড্রব তন্নতন্ন করে খুঁজে অবশেষে পেলো কাভারটা।
হাতের লিখা মিলিয়ে দেখলো চন্দ্র।বালিশের কাভারে চন্দ্রর আম্মা লিখার চেষ্টা করেছিলো,”রঙিলা কষ্ট”
অন্যপাশে লিখতে চেয়েছিলো,”জীবনের গল্প”
রঙিলা কষ্ট লিখা হয়েছে কিন্তু জীবনের গল্প লিখা হয় নি।তার আগেই তার জীবন থেমে গেছে।

চন্দ্রর মাথায় ঘুরতে লাগলো একটা কথা।
বাবার আলমারির এই রুমাল তবে কে দিয়েছে বাবাকে?
এরকম করে লিখা কয়েকটা ওয়ালম্যাট চন্দ্র কোথায় যেনো দেখেছে বলে মনে হলো।
কিন্তু স্পষ্ট হলো না কোথায় দেখেছে।

ধুলোবালিতে মাখা ফ্লোরে চন্দ্র বসে গেলো ধপ করে।মাথার রগ দপদপ করছে।চন্দ্র মাথা চেপে ধরে বসে রইলো।
কে লিখেছে এই রুমাল তবে?

চলবে??

লিখা: জাহান আরা