কি আশায় বাঁধি খেলাঘর পর্ব-০৬

0
282

কি আশায় বাঁধি খেলাঘর (০৬)

চন্দ্র মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা নিউমার্কেট চলে গেলো। নতুন বাসার জন্য সবকিছুই কিনতে হবে ওর।হাড়ি পাতিল থেকে শুরু করে বিছানা বালিশ পর্যন্ত। গাড়িতে বসে চন্দ্র প্রভা কে কল দিয়ে সব জানালো।
২ দিনের মধ্যে নতুন বাসায় উঠবে তারা সেই মতো প্রভাকে বললো হোস্টেল থেকে বের হতে।

নিজ হাতে বাছাই করে করে চন্দ্র গৃহস্থালির সব জিনিস কিনলো। ভাতের পাতিল,তরকারির পাতিল,কড়াই,ফ্রাইপ্যান,রাইস কুকার,প্রেসার কুকার,ওভেন,ফ্রিজ,ফিল্টার,ময়লার ঝুঁড়ি,বালতি,
প্লেট,গ্লাস,বাটি,বটি,ছুরি,কাটিং বোর্ড।

বাদ পড়লো না কোনো কিছুই।

সবকিছু নিয়ে রেখে এলো নতুন বাসায়।বাসায় যখন ফিরলো তখন ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছিলো চন্দ্রর।
তবুও মনে শান্তি ছিলো।বিছানায় শুয়ে পড়লো না খেয়েই,রশ্মি জিজ্ঞেস করতে ও এলো না খাবে কি-না বা খেয়েছে কি-না বাহিরে।
বিছানায় শুয়ে চন্দ্র ভাবতে লাগলো ভবিষ্যতের কথা।সোহানের সাথে যখন বিয়ে হবে তখনও তো এরকম একটা সংসার হবে চন্দ্রর।
অবশ্য সেই সংসারে শশুর শাশুড়ী ননদ সবাই থাকবে।চন্দ্রর খুব ইচ্ছে সবাইকে নিয়ে থাকার।সারাজীবন যে মেয়ে কাটিয়েছে আত্মীয় স্বজন ছাড়া,তারজন্য শশুর শাশুড়ী ছাড়া জীবন মানে আল্লাহর দেওয়া সেরা নিয়ামত।
চন্দ্র খুব চায় সবাইকে নিয়ে থাকতে।বাবা মায়ের অভাব যেনো কিছুটা হলেও ঘুচে যায় ওর।

ভাবতে ভাবতে সোহান কে কল দিলো।সোহান ফোন রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করলো,”কেনো কল দিয়েছো?”

চন্দ্র হকচকিয়ে গেলো সোহানের প্রশ্ন শুনে। কি বলছে সোহান এটা?

চন্দ্র আমতাআমতা করে বললো,”তোমাকে কি আমি কল দিতে পারি না সোহান?
আমি খালামনির বাসায় আছি এখন,হোস্টেল থেকে চলে এসেছি,একটা বাসা…..”

চন্দ্রকে আর বলতে দিলো না কিছু সোহান।নিজেই বলে উঠলো,”দেখো চন্দ্র,আমার মনে হয় আমাদের আর কথা না বলাই ভালো। আমার বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।দুদিন পর আমার বিয়ে।আমি তোমার কথা জানিয়েছি বাবা মা’কে কিন্তু ওনার শুনে নি আমার কথা।বাবা মায়ের পছন্দেই আমার বিয়ে করতে হবে।আমি চাই না আর কথা বলো তুমি আমার সাথে,রাখছি আমি।”

চন্দ্র কিছু বুঝতে পারলো না সোহান কি বললো এসব।সোহানের বিয়ে মানে?
সোহান অন্য কাউকে বিয়ে করবে?
মানে কি এসবের?
কি বললো এসব সোহান?

চন্দ্র আবারও কল দিলো সোহানকে,কিন্তু ফোন অফ।
বাবা মায়ের মৃত্যুর পর চন্দ্রর মনে হলো এই প্রথম আবার ওর তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভিতর। কিছুতেই বুঝতে পারছে না চন্দ্র কি হবে।
গলাকাটা মুরগির মতো তড়পাতে লাগলো চন্দ্র একা একা।

দুদিনে চন্দ্র অনেক চেষ্টা করলো সোহানের সাথে যোগাযোগ করার।না ফোনে পাচ্ছে,না ফেসবুকে না হোয়াটসঅ্যাপে।কোথাও নেই সোহান।
চন্দ্রর মনে হলো এর চাইতে ভালো ছিলো ওকে যদি সোহান গলা টিপে মেরে ফেলতো।সোহানের বাসার ঠিকানা চন্দ্র জানে না।
কিভাবে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না চন্দ্র।

উপায় মাথায় এলো চন্দ্রর সোহানের গায়ে হলুদের দিন।সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ,বিকেলে চন্দ্রর মনে হলো সোহানের বিয়েতে নিশ্চয় সোহানের বন্ধুরা যাবে,ওর ফেসবুক আইডি থেকে ওর ফ্রেন্ডদের খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না।
সোহানের ফেসবুক আইডি থেকে সোহানের
৬ জন ফ্রেন্ড কে চন্দ্র মেসেজ দিলো।সবার কাছে একটা মেসেজই দিলো,সোহানের বাসার এড্রেসটা লাগবে ওর,সোহানের জন্য বিয়ের একটা গিফট পাঠাবে কিন্তু সঠিক ঠিকানা ভুলে গেছে চন্দ্র।

২ ঘন্টার মধ্যে ২ জন রিপ্লে দিলো,সোহানের বাসার ফুল এড্রেস জানিয়ে দিলো।
চন্দ্রর চেহারা আনন্দিত হয়ে উঠলো ঠিকানা পেয়ে।চন্দ্রর স্থির বিশ্বাস চন্দ্রকে সামনে পেলে সোহান সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে।

তড়িঘড়ি করে চন্দ্র জামা পালটে একটা সঙ্গে সবুজ সেলোয়ার-কামিজ পরে নিলো।
সাজগোজের সময় নেই এখন চন্দ্র,মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে ডাকতে চন্দ্র বাসা থেকে বের হলো।
এই দু’দিন পানি ছাড়া এক দানা খাবার চন্দ্রর গলা দিয়ে নামে নি।

সোহানদের বাসায় পৌছালো চন্দ্র সন্ধ্যা ৭ টায়।ইতোমধ্যে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। চন্দ্র দেখলো অনেক দূর থেকে মরিচ বাতি দিয়ে বাসার রাস্তা সাজানো হয়েছে।
সোহানদের পুরো বিল্ডিং মরিচ বাতি দিয়ে যেনো মুড়িয়ে রেখেছে। ছাদে দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষ। ছোট একতলা বাসাটা আজ যেনো প্রাণ ফিরর পেয়েছে,অনেক মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠলো বাসা।
চন্দ্র দৌড়ে বাসার ভিতরে ঢুকে চিৎকার করে ডাকলো সোহানকে।
বাসা ভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে। সোহান পরিবারের বড় ছেলে,তাই সব আত্মীয় কে দাওয়াত করা হয়েছে।
ছাদে বক্সে গান বাজছে।

চন্দ্রর চিৎকার শুনে কয়েকজন ছুটে এলো।
সোহান নিজের রুমে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।১৫ জন বন্ধু আজ আবার এক হয়েছে।

চন্দ্রর চিৎকার শুনে ওরাও বের হয়ে এলো।
দরজার সামনে এসে নিষাদ থমকে দাঁড়ালো। নিষাদের মনে হলো ওর পুরো শরীর যেনো জমে গেছে বরফের মতো।
এ কাকে দেখছে সে সামনে!
সেই মেয়েটা!
যাকে একবার দেখেই নিষাদ পাগল হয়েছে।

চন্দ্র সোহানকে দেখে দৌড়ে কাছে গিয়ে বললো,”এসব কী সোহান?”

চন্দ্রকে দেখে সোহান নিজেও হতভম্ব হয়ে গেলো। চন্দ্রর তো বাসার ঠিকানা জানার কথা না তবে কিভাবে এলো সোহান ভেবে পেলো না।
চন্দ্র সোহানের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,”বলো আমাকে সোহান,এসব কি হচ্ছে?
তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবে?
আমার কি হবে তাহলে সোহান?”

বিরক্তিতে সোহানের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সোহান যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার নাম রেবা।রেবার বাবা বিয়েতে রেবাকে একটা ফ্ল্যাট দিচ্ছে,সোহানকে একটা বাইক দিচ্ছে,ঘর সাজানোর সব কিছু দিচ্ছে।
অথচ চন্দ্রর কে আছে?
বাবা মা কেউ নেই।একটা সিকি পয়সা ও কেউ দিবে না চন্দ্রকে বিয়ে করলে।তার উপর চন্দ্রর মা বাবা নেই।
এরকম একটা মেয়ে প্রেমিকা হিসেবেই মানায়,বউ হিসেবে নয়।তাই সোহান চন্দ্র ছাড়া ও রেবার সাথে সম্পর্ক গড়েছে।
চন্দ্রর কথা শুনে সোহান ঠান্ডা মাথায় বললো,”দেখো চন্দ্র,সোজা কথা শুনে রাখো।আমার বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে,আমি বিয়ে করতে বাধ্য তাই।”

চন্দ্রর ভীষণ কান্না পেলো,কিন্তু কাঁদলো না।কখনো কাউকে সে চোখের পানি দেখায় নি আজও দেখাবে না।

নিজেকে সামলে চন্দ্র বললো,”তবে কেনো আমাকে ভালোবাসলে সোহান,তুমি তো জানতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার আপনজন। কেনো এরকম করে ধোঁকা দিলে আমায়?এতো বড় প্রতারক তুমি সোহান!
তোমার বাবা মা কে ডাকো সোহান,আমি তাদের পায়ে ধরবো সোহান,আমাকে ছেড়ে যেও না তুমি।আমি সারাজীবন ওনাদের সেবা করবো সোহান,আমি থাকতে পারবো না তোমাকে ছাড়া। ”

নিজেকে সামলাতে পারলো না আর সোহান,রেগে গিয়ে বললো “চন্দ্র,সোজাসাপটা বলছি এবার,তোমার বাবা মা নেই,বিয়ের পর আমি শশুর বাড়িতে যেতে পারবো না।শশুর বাড়ি মধুর হাড়ি সবাই বলে তা আমার ভাগ্যে জুটবে না।কোনো বিপদে তাদের থেকে এক পয়সা সাহায্য পাবো না।এরকম একটা মেয়েকে কেউই জেনেশুনে বউ বানিয়ে আনতে চায় না।আশা করছি আর কিছু বলতে হবে না তোমায়।”

চন্দ্র অবাক হলো সোহানের কথা শুনে।মনে মনে নিজের উপর নিজে খুব খুশি হলো এই ভেবে যে সোহান কে কখনো জানায় নি ও ওর নামে কি পরিমাণ অর্থসম্পদ রেখে গেছে ওর বাবা মা।
এসব জানালে তো সোহানের আসল রূপ দেখতে পেতো না।
মায়ের কথা মনে পড়লো ভীষণ চন্দ্রর।মা মারা যাবার আগে বলেছিলো,” কখনো পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করবি না।এরা গিরগিটি,ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়।কোনো পুরুষকে কাছে ঘেঁষতে দিবি না,কিছুতেই না,কিছুতেই না।”
আজ চন্দ্রর মনে হলো মা ঠিক কথাই বলেছে।
এই সোহান কে তো চন্দ্র চিনতো না।আজ তার অন্য রূপ দেখছে সে।

আর কথা না বাড়িয়ে চন্দ্র সবার সামনে সোহানের গালে এক চড় দিলো।তারপর থুতু ছিটিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলো সোহানদের বাসা থেকে।

সোহান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি ঘটলো কিছুই বুঝতে পারলো না।
লাভ হলো একটাই নিষাদের,মেয়েটার নাম জানতে পারলো আজ।সোহানের ফোন নিষাদের হাতেই ছিলো।ফোন থেকে চন্দ্রর নাম্বারটা নিয়ে নিলো নিজের ফোনে।

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,যেভাবেই হোক এই মেয়েকে নিষাদ বিয়ে করবেই।যে মেয়েটা জীবনে বাবা মায়ের আদর পায় নি,অসহায় হয়ে বড় হয়েছে তাকে নিষাদ বউ করে তার সব দুঃখ দূর করে দিবে নিজের ভালোবাসা দিয়ে।

গাড়িতে বসে চন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলো,বাকি জীবনে আর কাউকে ভালোবাসবে না।ভালোবাসার দাম কেউই দিতে জানে না।সবাই স্বার্থ খোঁজে,অর্থবিত্তের জন্য ভালোবাসে।

চলবে…..?

লিখা: জাহান আরা