কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব-০২

0
897

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-২

সাইমুন যখন বান্ধবী মিশেল কে নিয়ে ফিরলো তখন সবার হাসি মজার টপিক হলো জয়ী। যে যেখানে পারছে ঠেস দিয়ে কথা বলছে। জয়ীর মামাতো ভাই আতিক একদিন ছোট ভাই বোন দের দেখিয়ে বলল, গাধা দেখবি গাধা! ওই তো জয়ীকে দেখ। জয়ী বুঝতে পারলো না যে ঠিক কী কারণে ও’কে গাধা ডাকা হচ্ছে। চৈতী আপু তো আরও এক কাঠি উপরে। একদিন সব কাজিন দের জড়ো করলো। জয়ীও সেখানে গেল। সাইমুন কে ডেকে চৈতী জিজ্ঞেস করলো,

“সাইমুন ভাই তোমার নাকি জয়ীর সঙ্গে প্রেম ছিলো? ”

সাইমুন চোখ কপালে তুলে বলল,

“মানে কী? এসব কে রটাচ্ছে?”

রিতি আপু তখন ফোড়ন কেটে বলল,

“কে আবার জয়ী!”

সাইমুন ভাই তীর্যক হেসে বলল, আরে ও তো বাচ্চা মেয়ে। একটু হেসে কথা বলছি সেটাকে প্রেম বুঝে নিচ্ছে। তোরাও না! পারিসও!

এরপর কিছুক্ষন হা হা, হি হি চলে। জয়ীর চোখে পানি চিকচিক করলেও কারও হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না। আতিক হেসে বলে, ভালোই হলো আমাদের মধ্যে সব আছে। কেউ আছে ডাক্তার, কেউ আছে ইঞ্জিনিয়ার, কেউ পিএইচডি করছে আর আমাদের জয়ী মিথ্যেয় অনার্স-মাস্টার্স করছে।

রিতি আবার বলে ফেলে, যাই বলিস জয়ী কিন্তু চাইলে স্ক্রিপ্ট রাইটার হতে পারবে। ভালো যা গল্প বানাতে পারে!

জয়ী একটাও কথা বলতে পারে না। চিৎকার করে বলতে চায়, আমি যখন এতোই মিথ্যুক তখন তোমরা আমাকে বিশ্বাস কেন করেছিলে! কিন্তু বলতে পারে না!

জয়ীর সাথে সাইমুনের আচরণ টা এমন যেন ও’কে চিনতেই পারছে না। অথচ ওদের কতো কতো কথা হয়েছে! প্রতিটি এসএমএস মোবাইলে আর্কাইভও করে রাখা। সেগুলো সহ সবার সামনে আসার সাহস ওর নেই। সত্যি বলতে মুখ খুলে নিজের পক্ষে কথা বলার মতো সাহস বা কনফিডেন্স কোনোটাই ওর ছিলো না।

জয়ীর জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা পেয়েছে দিন কয়েক পর। ছোট খালামনির ছেলে জিসান আর ও একসাথেই পড়ে। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। ছোট থেকেই রেষারেষি। সেই জিসানের থেকেই জানলো যে এটা সবার একটা প্ল্যান ছিলো। জয়ী যে সাইমুনের প্রেমে পড়েছে সেটা সাইমুন আগেই টের পেয়ে সবাইকে জানিয়েছে। এরপর থেকে প্রতিটা ঘটনা সবার সঙ্গে শেয়ার করেছে। জয়ীর প্রতিটি ম্যাসেজ, প্রতিটি কথা সবাই জানে। সবাই সব জেনেও এতোদিন চুপ করে ছিলো। একবারে মজা নিবে বলে।

এই ঘটনায় জয়ী আরও ভেঙে পড়লো। সেই ভাঙাচোরা অবস্থায় কয়েকবার সুইসাইডের কথাও ভাবলো। কিন্তু সাহসে কুলোয় নি শেষ পর্যন্ত কিছুই করে ওঠে নি। একদিন সাহস করে সাইমুন কে বলল,

“আমি আপনার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলতে চাই। ”

সাইমুন রাজিও হলো। জয়ী সাইমুন কে ভনিতা ছাড়াই প্রথম প্রশ্ন করলো,

“আপনি আমার সঙ্গে এমন টা কেন করলেন?”

সাইমুন হেসে জিজ্ঞেস করলো,

“আমি আবার কী করলাম?”

“এই যে মিথ্যে ভালোবাসার নাটক করলেন! সেটা কেন করলেন?”

“ভালোবাসা! আমি কী তোমাকে একবারও বলেছি যে তোমাকে ভালোবাসি?”

জয়ী চুপ করে থাকে। আবারও প্রশ্ন করে

“আপনি বারবার বলেছেন পরে দেখা যাবে, দেশে ফিরে বিয়ে করবেন। ”

“পরে কী দেখার কথা বলেছি? আমি কী একবারও বলেছি যে আমি তোমাকেই বিয়ে করব? আর দেশে ফিরে বিয়ে করব বলেছি ঠিকই কিন্তু তোমাকে বিয়ের কথার তো বলিনি!”

জয়ী কেঁদে ফেলে৷ সাইমুন ঠান্ডা গলায় বলে,

“লিসেন জয়ী তোমাকে একটা বলি, তুমি আমার যে জীবন দেখছ সেটা এমনি এমনি হয় নি। রাতের পর রাত জেগে কষ্ট করে প্রতিটি ক্লাসে টপ করে তারপর এই জায়গায় আসতে হয়েছে। প্রেমে পড়া অন্যায় না কিন্তু ভুল মানুষের প্রেমে পড়া অন্যায়। তুমি আর আমি কী সেইম? না! উই আর ডিফারেন্ট। দেখো, সিনেমা কিংবা বইয়ে এসব প্রেম হয়। বাস্তব সম্পূর্ণ আলাদা। সাইজ ডাজেন্ট ম্যাটার, রুপে কী আসে যায়, এসব বড় বড় কথা মুখে বলা যায়৷ বাস্তবে এসব কথার ভ্যালু নেই। তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো; তুমি কী আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো?

জয়ী হা করে তাকিয়ে আছে। চোখে বিস্ময়।

সাইমুন আবারও বলল,

“তুমি নিজেকেও দেখো আর মিশেল কেও দেখো। আমার পাশে মিশেল কেই মানায়। শুধু মানানোর ব্যাপার ছাড়া আরও কিছু ব্যাপার আছে। তোমার সঙ্গে সব টপিকে কথা বলা যায় না, কারণ তুমি কিছুই জানো না। ক্রিকেট, পলিটিক্স, সাহিত্য, সিনেমা কোনো বিষয়েই তোমার ধারণা নেই। কথা বলেও শান্তি নেই। আমরা অনেক কথা বলেছি ঠিকই কিন্তু তুমি সেগুলো শুনে শুধু হু হা করে চালিয়ে দিয়েছো। কারণ নিজেই কিছু জানো না। আমাদের মেন্টালিটি পর্যন্ত ম্যাচ করেনি।

জয়ী বলল,

“আপনি ভালো থাকুন। আমাকে গাধা মিথ্যেবাদী প্রমাণ করে আপনারা অনেক বড় সার্টিফিকেট অর্জন করে ফেলেছেন। এটা যেন ভবিষ্যতে কাজে লাগে সেই দোয়া করব।”

সাইমুন হেসে ফেলল শব্দ করে। বলল,

“আরে বোকা মেয়ে কাজিন দের প্রেমে পড়তে যাও কেন! আর হ্যাঁ সবসময় চেষ্টা করবে নিজের লেভেলের লোকের সঙ্গে মিশতে। ”

জয়ী সেদিন আর দাঁড়ায় নি। চলে এসেছে। এক অবর্ননীয় কষ্টে কাটতে লাগলো ওর দিন কাল। এই কষ্টের সঙ্গে যুক্ত হলো ঘরের লোকের দেয়া কষ্ট। জয়ীর মা, বাবা কেউ কথা শুনাতে ছাড়েন নি। জয়ীর মা তো লজ্জায় কারোর সামনে যেতে পর্যন্ত পারছে না। জিসান পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাবার পর ছোট খালাও একদিন এসে বললেন,

“আজকালকার মেয়েগুলো খারাপ। এরা প্রেম ভালোবাসা সহজেই বুঝে যায়। পড়াশোনা বুঝে না। একটা ছেলে কষ্ট করে পড়বে আর এরা সেই ছেলেটার মাথায় কাঠাল ভেঙে খাবে। এই হলো প্ল্যান। ”

এসব কথায় জয়ীর জীবন প্রায় অতিষ্ঠ। ক্লাসমেট রা এতো কিছু না জানলেও প্রেম ভাঙার কারণ হিসেবে ধরে নেয় যে এতো হ্যান্ডসাম ছেলে কী আর এভারেজ মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবে! তাই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গেছে।

জয়ীর এই দুঃসময়ে কাউকে পাশে পায় নি। এমন কেউ ছিলো না যাকে মন খুলে দুঃখ, যন্ত্রনার কথা বলবে। চিৎকার করে যে কাঁদবে সেই উপায়ও নেই।

তবে এই দুঃখ, যন্ত্রণার অবসান ঘটলো ঢাকায় পড়তে আসার সুবাদে। কোথাও চান্স না পেয়ে জয়ীকে ভর্তি করা হলো ইডেন মহিলা কলেজে। জয়ীর বড় ভাই আগে থেকেই ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করতো। তাই বাবা, মা আর আপত্তি করলেন না। সবকিছু ছেড়ে ঢাকায় পড়তে আসার সময় জয়ী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো যেদিন সকলের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে সেদিনই আবার ফিরবে। তার আগে না।

****
সৌমি জয়ীকে টেনে নিয়ে এলো। চাপা গলায় বলল,

“এটা কী করলি জয়ী? সবাই তাকিয়ে ছিলো। ”

জয়ী রাগী গলায় বলল,

“ভুল কিছু করি নি। ঠিক ই করেছি। ”

“ভাগ্য ভালো যে মিডিয়ার কেউ ছিলো না।এটা যদি আমাদের দেশে হতো তাহলে বুঝতি মজা কাকে বলে। ”

“আই ডোন্ট কেয়ার। ”

“সবসময় এতো ডোন্ট কেয়ার ভাব নিলে চলে না। সবাই কিরকম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিলো! ইশ! ”

জয়ী হেসে বলল,

“তুই এদের চিনিস না। কিন্তু আমি চিনি। লোকের ভালোবাসার মূল্য এরা দিতে জানে না। যারা ছবি তুলতে গিয়েছিলো তারা তো ভালোবেসেই গিয়েছিলো নাকি! এদের প্রতি একটু ভালোবাসা দেখালে কী সম্মান চলে যাবে?”

“সেলিব্রিটিদের ব্যাপার স্যাপার আমাদের বুঝে কী কাজ?”

“আমরাই কিন্তু এদের সেলিব্রিটি বানাই। অথচ এরা মাটিতে পা রেখে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে মাটিকেই ভুলে যায়। ”

সৌমি বিরক্ত গলায় বলল, চল তো এখন। তোকে নিয়ে এখানে আসাই ভুল হয়েছে। কী ভয়ংকর কান্ড ঘটালি!

জয়ী হাসলো। ভয়ংকর কান্ড ও ঘটায় নি। কিন্তু ছেলেটা যেভাবে ভয় পেল সেটা ভেবেই ওর হাসি পাচ্ছে। মুখ টা একদম রক্তশূণ্য হয়ে গেছিল। বার বার ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো। জয়ীও বদমায়েসী করে গরম চোখে তাকিয়েছে।

***
আদনানের সঙ্গে আসা বন্ধুরা আদনান কে জিজ্ঞেস করলো,

“কী রে ভয় পেলি?”

আদনান শুকনো গলায় বলল,

“না।”

বাকীরা সবাই একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠলো। আদনান নিজেও হেসে ফেলল।

জুবায়ের নামে একজন বলল,

“তাও ভালো যে চাকু বের করে তোর গলায় ধরে নি। ”

অন্য একজন বলল,

“এসব হলো খ্যাতির বিরম্বনা। সবে তো শুরু। সামনে আরও অনেক কিছু সইতে হবে।”

আদনান হঠাৎ বলল,

“আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না যে, আমি কিভাবে ওর টাকায় এখানে ঘুরতে এলাম৷ ”

বাকীরা বলল,

“আসলেই তো! এভাবে ভেবে দেখিনি। ”

“ব্যাপার টা জানতে হবে।”

জুবায়ের বলল,

“কীভাবে জানবি?”

“বাংলাদেশে থাকে এটুকু শিওর৷ এখানকার বাঙালী হলে কথায় দেশী টান থাকতো না।”

“আচ্ছা। ”

আদনান মাথা চুলকে বলল,

“খুঁজে পাওয়া কী খুব বেশী কঠিন হবে?”

সবাই ওর দিকে অন্যরকম চোখে তাকালো। একজন বলল,

“ব্যাপার টা কী বলতো? প্রেমে পড়লি নাকি?”

আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“আমার প্রেম শুধু স্বপ্নের সঙ্গে। মেয়েদের প্রেমে আর না। ”

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা