কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে পর্ব-০৩

0
828

#কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিতে
#পর্ব-৩

দিল্লি থেকে ফেরার পর জয়ীতা কেবল ঘুমিয়েই কাটাচ্ছে। সকালে ঘুম ভাঙছে বারোটার পর। খাবার টেবিলে ঠান্ডা রুটি, আলুভাজি পেয়েও সেগুলো খাচ্ছে না। সিড়ি ভেঙে গরম পরোটা বাজিয়ে এনে ঘরে ফিরে ডিম দিয়ে খেয়ে আবারও একঘন্টা ঘুমায়। এরপর উঠে চা করে খেয়ে গোসল সেড়ে খানিকক্ষন ফোন দেখতে সময় নেয়। সবমিলিয়ে শুধু খাওয়া আর ঘুমেই চলছে কয়েকটা দিন।

আজ জয়ীর ঘুম ভাঙলো আরও এক ঘন্টা পর। আজানের শব্দে ঘুম ভেঙেছে। হাত, মুখ ধুয়ে বাইরে আসতেই দেখলো ভাবী টেবিলে বসে সবজি কাটছে। জয়ী বলল,

“গুড মর্নিং ভাবী! ”

জয়ীর ভাবীর নাম লিজা। লিজা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

“এখনো মর্নিং আছে?”

“যারা আমার মতো লেট রাইজার তাদের কাছে তো মর্নিং। ”

ভাবী হাতের কাজে মন দিলো। জয়ী চেয়ার টেনে খেতে বসলো। আজ খাবারের আয়োজন আরও খারাপ। রাতের বাসী ভাত পিয়াজ, কাঁচামরিচ, ডিম দিয়ে ভাজা। জয়ী খাবার টা আবারও ঢেকে রেখে বলল,

“চা খাবে ভাবী?”

“খাওয়াও পারলে। তুমি যে কিছু করতে পারো সেটাও দেখি একটু। ”

জয়ী হাসলো। ননদ, ভাবীর সম্পর্ক যেমন হয় ওদেরও তেমন। জয়ী এই সম্পর্কের নাম দিয়েছে প্লাস্টিক সম্পর্ক। কখনো মনে হয় ভাবী ও’কে একটু হলেও পছন্দ করে। আবারও কখনো মনে হয় একদম ই পছন্দ করে না। জয়ীর ক্ষেত্রেও তাই। মাঝেমধ্যে ভাবীকে খুব ভালো লাগে; আবার মাঝেমধ্যে মনে হয় ভাইয়া এই দজ্জাল টা’কে কোথায় খুঁজে পেল!

জয়ী চা বানিয়ে নিয়ে এলো। লিজার সামনে চায়ের কাপ রেখে বলল,

“এই তোমার চা। খেয়ে নম্বর দিতে ভুলে যেও না। ”

লিজা চা’য়ে চুমুক দিলো। জয়ী চা টা খারাপ বানায় না। লিজা এবার একটু নরম গলায় বলল,

“মাঝেমধ্যে একটু কাজটাজ করলেও তো পারো জয়ী। এভাবে অলস সময় কাটাও তোমার খারাপ লাগে না?”

জয়ী চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে লাগলো। বলল,

“উঁহু। আরামটুকু উপভোগ করছি। এরপর যখন কাজে ঢুকব তখন তো আর এই আরামটুকু থাকবে না। ”

“চাকরি করার ইচ্ছে কী তোমার আছে। ”

“উঁহু সেটাও নেই। আমার লক্ষ্য অন্য। ”

লিজা আর কথা বাড়ালো না। জয়ীর লক্ষ্য সম্পর্কে এর আগেও বহুবার শুনেছে। নতুন করে তাই শোনার আর ইচ্ছে নেই। জয়ীর ইচ্ছে হলো ফিল্ম বানানো। পড়াশোনাও করেছে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশনে। কিন্তু এই ব্যাপার টা ওদের কারোর পছন্দও না। জয়ীর বাবা, মা চাইছে বিয়েটা দিয়ে দিতে। লিজারও তাই ইচ্ছে৷

“ভাবী আজ অফিস নেই নাকি?”

“না আজ এক কলিগের বিয়ে আছে। তাই যাই নি৷ বিকেলে অফিস সেড়ে যাওয়া টা চাপ হয়ে যায়। ”

“তুমি কী আমাকে কিছু বলতে চাইছো ভাবী?”

“কী করে বুঝলে?”

“গত দেড় বছরে তোমাকে এইটুকু চিনেছি আমি। ”

“কী চিনলে? ভালো নাকি খারাপ? ”

জয়ী হেসে বলল,

“ভালো খারাপে কী আসে যায়। আমরা আমরাই তো। ”

লিজাও হেসে ফেলল। বলল,

“আমার খালাতো ভাই অনীশ কে মনে আছে?”

“তোমার ছোট খালার ছেলে?”

“হ্যাঁ। ”

“চশমাওয়ালা?”

“হ্যাঁ। ওর নান অনীশ।”

“আচ্ছা চিনেছি। ”

“অনীশের নাকি তোমাকে খুব পছন্দ। ”

জয়ী চোখ কপালে তুলে বলল,

“তাই?”

“হ্যাঁ। ”

“ভেরি গুড। বলতে হবে লোকটার চয়েজ আছে৷ ”

লিজা তীর্যক হেসে বলল,

“আচ্ছা!”

“তারপর বলো। ”

“যাইহোক শোনো, খালামনি অনীশের বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে। তখনই অনীশ তোমার কথা বলল। ”

“কী বলল? আমাকেই বিয়ে করা লাগবে এই টাইপ কিছু? ”

“হ্যাঁ সেরকম ই। ”

“আর তোমার খালা কী বলল?”

“বলল সবার সঙ্গে কথা বলতে। ”

“ভাবী তুমি আমার কথা কিছু বলো নি?”

“কী বলব?”

“আমি যে চূড়ান্ত রকমের বে*য়াদব, অ*সভ্য এগুলো বললে না কেন! ”

লিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“এখন যুগ অনেক পাল্টেছে। বিয়ের বাজারে অ*সভ্য, বে*য়াদব রা এগিয়ে থাকে।”

জয়ী হেসে ফেলল। বলল,

“তোমার মতামত বলো?”

“আমার আবার কিসের মতামত! তোমার ভাইয়া আর মা চাচ্ছে অনীশের সঙ্গে তুমি যোগাযোগ করো। ”

“তারপর? যোগাযোগ বলতে কী মিন করছো?”

“মানে দুজনে কথাবার্তা বলবে। একে অন্যকে জানতে সময় নিবে। ”

“মানে বিয়ের আগে একটা প্রেম, প্রেম ভাব করে নিতে বলছো?”

“আমি বলছি না। এটা তোমার ভাইয়া আর মায়ের কথা। ”

“আচ্ছা। তুমি কী চাইছো?”

লিজা অধৈর্য্য গলায় বলল,

“তুমি বারবার আমার মতামত নিয়ে পড়ে আছ কেন জয়ী!”

“না মানে বুঝতে চাইছি তোমার মনে কী চলছে। তুমি তোমার খালাতো ভাইয়ের ভালো চাচ্ছো নাকি আমাকে তাড়াতে চাইছো?”

লিজা কটমট চোখে তাকালো। জয়ী হেসে বলল,

“জাস্ট কিডিং ভাবী! অনীশ বাবুর নাম্বার টা দিও। উনি কিন্তু ফেসবুকে আমার ফ্রেন্ড আছে। সেখান থেকে নাম্বার নেয়া যায়। তবুও একটা ভাব আছে না! ছেলেরা সবসময় ভাবওয়ালা মেয়েদেরই পছন্দ করে। সহজ, সরল মেয়ে মানেই তো বোকা, ক্ষ্যাত, মুরগী। ”

লিজা কথা বাড়ালো না৷ কথায় কথা বাড়ে।

****
আদনান চেয়ার টেনে বসে বলল,

“স্যরি গার্লস। আমি আজ লম্বা সময় ধরে ঘুমাচ্ছিলাম। ”

তাসিন বলল,

“ইটস ওকে। তোমাকে একটু টায়ার্ডও লাগছে। ”

নওশিন বলল, বোধহয় ঘুমাতে ঘুমাতে টায়ার্ড হয়ে গেছে।

তাসিন, নওশিন দুজনেই আদনানের বোন। দুজনেই এবার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো। একজন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। অন্যজন নর্থ সাউথে পড়ছে। আদনানের সঙ্গে ওদের দুজনের সম্পর্কই ভালো। বন্ধুর মতোই সবকিছু ওরা শেয়ার করে।

নওশিন বলল, তুমি যেন কী বলবে বলছিলে?”

“তার আগে তোদের কথা বল। কিছু কী হলো?”

দুজনেই একসঙ্গে বলল, না।

আদনানের যখনই ম্যূড ভালো থাকে তখনই এই প্রশ্নটা করে। কিছু হলো বলতে প্রেমের কথা জিজ্ঞেস করেছে। দুজনের কারো এখন পর্যন্ত প্রেম হয়েছে কী না সেটা।

তাসিন জিজ্ঞেস করলো,

“এবার তোমার কথা বলো? ইন্ডিয়ান হিরোইন মনে ধরেছে?”

“আরেহ না! কিছু জিনিস দূর থেকেই ভালো লাগে। হিরোইন দেরও দূর থেকে দেখতে ভালো লাগে। তাছাড়া হিরোইন দের পাশে দাঁড়াতে হলে আমাকেও তো হিরো হতে হবে। ”

নওশিন বলল,

“তুমি হিরোর চেয়ে কম কিসে? কতো মেয়েরা তোমার জন্য পাগল! ”

“কেউ কেউ আছে দুচোক্ষে দেখতে পারে না। ”

তাসিন বলল,

“এমন কারো সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে?”

“কে সে?”

“শোন, দিল্লিতে এক রেস্টুরেন্টে লোক জমে গিয়েছিলো সেলফি নেবার জন্য। ওদের এড়িয়ে চলে আসতে গেলে একটা মেয়ে খপ করে হাত ধরে ফেলল।”

তাসিন, নওশিন দুজনেই একে অন্যের দিকে তাকালো। নওশিন বলল,

“দেখি কোন হাত?”

আদনান হাত বাড়িয়ে দিলো। দুজনেই ভালো করে হাত দেখে বলল,

“নখের দাগ নেই তো!”

আদনান দুজনকে দুটো গাট্টা মেরে বলল,

“তোদের কী মনে হচ্ছে আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি?”

“আচ্ছা তারপর? ”

“মেয়েটা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“যারা যারা সেলফি নিতে চান সবাইকে দিবেন। আমাদের টাকায় ঘুরতে এসে এতো বাহাদুরি! ”

তাসিন জিজ্ঞেস করলো,

“ওদের টাকা মানে?”

“আরে সেটাই তো বুঝলাম না। ”

নওশিন বলল,

“তুমি জিজ্ঞেস করো নি?”

“না।”

“কেন?”

কেন’র জবাবটুকু আদনান দিলো না। জয়ীতাকে চিনতে পেরেই তো ওর মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো। কী বলবে সেটাই খুঁজে পায় নি। নওশিন জিজ্ঞেস করলো,

“কী ভাবছ?”

“কিছু না।”

তাসিন জিজ্ঞেস করলো,

“এটাই তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা?”

“হ্যাঁ। ”

দুজনে আবারও মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। আদনান বলল,

“উল্টাপাল্টা ভাবতে যাস নে যেন! এমনিই ব্যাপার টা শেয়ার করলাম। ”

“আচ্ছা।”

“দে কফি দে।”

আদনান এখনো জয়ীতার কথা ভাবছে। জীবনে কী কাকতালীয় কোনোকিছু ঘটে! আদনান জানে না। জয়ীতাকে আদনান ভুলে যায় নি। সেই দিন, সেই রাত ভুলে যাবার মতো নয়। সেই কারনেই হয়তো জয়ীতাকে মনে আছে। দেখে চিনতেও খুব একটা অসুবিধা হয় নি। সেই রাতে ভালো করে দেখে নি। তবে যতটুকু দেখে তাতে পরিবর্তন শুধু একটাই যে আগের থেকে খানিকটা রোগা হয়ে গেছে। এছাড়া তেমন পরিবর্তন হয় নি। কথা বলার ধরনও সেই একই রকম।

আদনানের ডায়েরিতে ওর জীবনের পঞ্চাশ টা উদ্দেশ্য লেখা আছে। যেগুলো পূরন করবে একে একে। ঠিক পঞ্চাশ নাম্বারে আছে জয়ীতার সঙ্গে দেখা করা। আদনান জয়ীতার নামের পাশে লিখে রেখেছে (স্থলপরী।) গরীব কাঠুরিয়াকে সোনা, রুপোর কুড়োল দিয়েছিল জলপরী, আর অসহায় ট্রেনযাত্রীকে সিএনজি ভাড়া দিয়ে উদ্ধার করেছে স্থলপরী।

আদনান শব্দ করে হেসে ফেলল। তাসিন নওশিন দুজনেই চমকে উঠলো। নওশিনের হাত থেকে খানিকটা চা’ও পড়লো। তাসিন বলল,

“মাথাটা গেছে পুরো! ”

নওশিন বলল, এটাই প্রেমের লক্ষন কিন্তু।

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা