গোধূলি বিকেলে তুমি আমি পর্ব-১৫+১৬

0
273

#গোধূলি_বিকেলে_তুমি_আমি❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১৫
________________

খানিকটা বিস্মিত মাখা মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিজা অভ্রের মুখের দিকে। সে সত্যি ভাবে নি এই মুহূর্তে এই রেস্টুরেন্টে এসে অভ্রের সাথে দেখা হয়ে যাবে তাঁর। এখন অভ্রের প্রশ্নের উত্তর হিসেবে কি বলবে এটা ভেবেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আদ্রিজার। মিথ্যে বলবে নাকি সত্যি।আদ্রিজার ভাবনার মাঝেই আবারও বলে উঠল অভ্র,

‘ কি হলো তুমি কিছু বলছো না কেন এখানে কি করছো তুমি?’

হকচকিয়ে উঠল আদ্রিজা। খানিকটা আমতা আমতা করে বললো,

‘ আপনি এখানে কি করছেন?’

আদ্রিজার কথায় খানিকটা বিরক্ত প্রকাশ করে বললো অভ্র,

‘ প্রশ্ন আমি তোমায় আগে করেছি তাই উওর টাও তোমারই আগে দেওয়া উচিত তাই না।’

অভ্রের কথা শুনে হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেছে আদ্রিজার। আদ্রিজার কাঁপাকাপি দেখে কেমন যেন সন্দেহ লাগলো অভ্রের। সন্দেহ ভরা চেহারা নিয়েই বললো অভ্র,

‘ কি হলো আদ্রিজা তুমি কিছু বলছো না কেন?’ কেন এসেছো এখানে তোমার তো আমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা আরুকে তো দেখলাম তোমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করতে যাও নি বাড়ি।’

এবার আদ্রিজা তাকালো অভ্রের দিকে। এমন সময় অভ্রের পিএ ইউনুস এসে বললো অভ্রকে,

‘ স্যার গাড়ি চলে এসেছে?’

প্রতি উওরে একবার আদ্রিজা তো একবার ইউনুসের দিকে তাকায় অভ্র।’

_____

পাশাপাশি বসে গাড়ি করে যাচ্ছে আদ্রিজা আর অভ্র। সামনের সিটেই গাড়ির ড্রাইভার আর ইউনুস বসা। হঠাৎই অভ্র বলে উঠল,

‘ তাঁর মানে তুমি তোমার প্রেমিক শ্রাবণের সাথে দেখা করতে রেস্টুরেন্টে এসেছিলে ব্ল্যাকবেরি?’

অভ্রের কথা শুনে আদ্রিজা মাথা নাড়িয়ে ‘হুম’ বললো। অনেকক্ষন আগেই আদ্রিজা অভ্র বেরিয়ে আসে রেস্টুরেন্ট থেকে। আদ্রিজা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে শ্রাবণের জন্য। কিন্তু শ্রাবণ আর আসে না। এদিকে অভ্রকে যাওয়ার জন্য বললেও আদ্রিজাকে একা রেখে যাবে না বলে অভ্র, সাথে আদ্রিজা তাদের বাড়ি রেখে এখানে কেন এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত যাবে না এটাও বলে অভ্র। আর অভ্রের এমন খামখেয়ালির কথার কাছে হার মেনে অভ্রকে শ্রাবণের ব্যাপারে সব বলে আদ্রিজা। কারণ বার বার মিথ্যে বলতে মন চাইছিল না তাঁর তাই সত্যি কথাই বলে দেয় আদ্রিজা।’

‘ আর অভ্র সে শুরু থেকেই এইরকম কিছু একটার আন্দাজ করতে পারছিল। এবার সত্যি সত্যি আদ্রিজার মুখে সব শুনে পুরোপুরি অবাক না হলেও খানিকটা অবাক নিশ্চয়ই হয়েছে সে। হঠাৎই অভ্রের ভাবনাগুলোর মাঝে বলে উঠল আদ্রিজা,

‘ প্লিজ এইসব কথা আর কাউকে বলবেন না। আমি আরুদেরও শ্রাবণের কথা বলি নি। তবে কাল বলবো ভেবেছি। আপনি প্লিজ আমার আগে ওদের কিছু বলবেন না খুব কষ্ট পাবে কি না।’

আদ্রিজার কথা শুনে শুঁকনো হেঁসে বললো অভ্র,

‘ ইট’স ওকে মিস ব্ল্যাকবেরি। টেনশন নট আমি কাউকে কিছু বলবো না। কিন্তু তুমি যাকে ভালোবাসো সেও কি তোমায় ভালোবাসে এটা তুমি শিওর তো?’

অভ্রের কথা শুনে খানিকটা অবাক হয়ে বললো আদ্রিজা,

‘ মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি?’

‘ আমি তেমন কিছুই বলতে চাইছে না আদ্রিজা আসলে কি বলো আমি আজ সন্ধ্যা থেকেই ওই রেস্টুরেন্টে ছিলাম। আমার পাশাপাশি আরো একটা ছেলে ছিল ওই রেস্টুরেন্টে কারো জন্য অপেক্ষা করছিল বোধহয়। তখন ওই রেস্টুরেন্টের একজন ওয়েটটার বলছিল সেই ছেলেটা নাকি রোজ নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসে তাই বললাম তুমি আবার সেই ছেলের পাল্লায় পড়ো নি তো?’

অভ্রের কথা শুনে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো আদ্রিজার। তবে বেশি না ভেবে বিস্মিত কন্ঠ নিয়ে বললো আদ্রিজা,

‘ আমার শ্রাবণ এমন নয়, তাই বাজে কথা বলা বন্ধ করুন।

আদ্রিজার জবাব শুনে ভড়কানো গলায় বললো অভ্র

‘ আরে বাজে কথা কোথায় বললাম। আমি জাস্ট এমনি বললাম আবার এমনও হতে শ্রাবণ আজ রেস্টুরেন্টে আসে নি বা আমি যাকে নিয়ে বলছি সে শ্রাবণ নয়।’

‘ দেখুন এভাবে বলবেন না আমার শ্রাবণ যথেষ্ট ভালো।’

‘ ভালো হলেই ভালো আদ্রিজা। তারপরও সবাইকে বিশ্বাস করতে নেই। সবাই কিন্তু সঠিক হয় না।’

‘ আপনি এইভাবে বলবেন না প্লিজ, আর আপনিও তো লাবন্য আপুকে ভালোবাসেন আমি কি কখনো তাকে নিয়ে আপনার সামনে বাজে মন্তব্য করেছি তাহলে আপনি বলছেন কেন?’

বলতে বলতে কেঁদে ফেলার উপক্রম আদ্রিজার। এদিকে আদ্রিজাকে কাঁদতে দেখে ভড়কে গেল অভ্র। সে সত্যি সেই রকম কিছু ভেবে কথাগুলো নি জাস্ট এমনি বলেছিল। কিন্তু আদ্রিজা তো বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নিয়ে কেঁদে ফেলেছে। অভ্র জোরে নিশ্বাস ফেললো। তারপর আদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ তুমিও না ব্ল্যাকবেরি একটুতেই সিরিয়াস হয়ে যাও আমি তো এমনি মজার ছলে বলেছিলাম কথাটা।’

উওরে আদ্রিজা কান্না ভেজা কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ এইভাবে কেন বললেন অভ্র, আমার খুব কষ্ট হয়।’

আদ্রিজার কথায় এবার সত্যি বিপাকে পড়লো অভ্র। আদ্রিজাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর চোখ মুছে দিতে দিতে বললো,

‘ বিলিভ মি আমি তোমায় হার্ট করার জন্য বা কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলি নি। জাস্ট মনে হলো তোমায় বলা উচিত তাই বলেছি। ঠিক আছে তোমার শ্রাবণ খুব ভালো, হয়তো ও সত্যি আজ আসে নি। এবার হেপি।’

উওরে আদ্রিজা কিছু বলে না শুধু ছলছল চোখে তাকিয়ে রয় সে অভ্রের মুখের দিকে। সে সত্যি খুব কষ্ট পেয়েছে অভ্রের কথায়৷ অভ্র যাকে নিয়ে বললো সে যদি শ্রাবণ হয় কথাটা ভাবলেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে আদ্রিজার। না না অভ্র যাকে নিয়ে বলছে যে কিছুতেই শ্রাবণ হতে পারে না। শ্রাবণ তাঁকে কিছুতেই ধোঁকা দিতে পারবে না। কিন্তু শ্রাবণ তাঁকে রেস্টুরেন্টে আসতে বলে আসলো না কেন? নাকি এসে আবার চলে চলে গেছে। বেশি ভাবলো না আদ্রিজা। কেমন যেন এলেমেলো লাগলো সবকিছু।’

হঠাৎই মাঝপথে একটা ব্রিজের ওপর এসে গাড়িটা থেমে হয়ে গেল অভ্রের। হুট করে এমনটা হওয়াতে অভ্র আদ্রিজা দুজনেই বেশ অবাক হলো সাথে আচমকা গাড়ি থেকে যাওয়াতে পাশাপাশি মাথায় বারিও খেল দুজন। ব্যাথাও পেয়েছে একটু অভ্র খানিকটা অবাক হয়ে বললো,

‘ হুট করে কি হলো ইউনুস?’

অভ্রের কথা শুনে ইউনুসও বলে উঠল,

‘ ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার।’

‘ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দেখো তো কি হয়েছে?’

‘ দেখছি স্যার।’

বলেই ইউনুস আর গাড়ির ড্রাইভার দুজনেই বের হলো গাড়ি থেকে। অভ্র গাড়ির দরজা খুলে বললো ইউনুসকে,

‘ কি হয়েছে ইউনুস?’

উওরে ইউনুস দৌড়ে এসে বললো,

‘ স্যার গাড়ির চাকায় পিন লেগে টায়ার পানচার হয়ে গেছে?’

ইউনুসের কথা শুনে অভ্র হতভম্ব হয়ে বললো,

‘ হোয়াট? এখন আমরা বাড়ি ফিরবো কিভাবে? এখান থেকে তো কোনো গাড়ি পাওয়াও মুশকিল। গাড়িতে কোনো এক্সট্রা টায়ার আছে ইউনুস?’

অভ্রের কথা শুনে খুব নিরাশ হয়েই বললো ইউনুস,

‘ না স্যার।’

এবার আরো হতাশ হলো অভ্র। হতাশ হয়েই বললো,

‘ তাহলে এখন কি করবো ইউনুস? মাঝরাস্তায় এইভাবে বসে থাকবো?’

উওরে ইউনুস কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,

‘ স্যার ওই সামনেই একটা মেকানিকের দোকান আছে আপনি বললে আমি আর ড্রাইভার গিয়ে মেকানিককে নিয়ে আসি? সাথে এক্সট্রা টায়ারও,,

ইউনুসের কথা শুনে অভ্র কিছু বলার আগেই খানিকটা হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো আদ্রিজা,

‘ আর আমরা?’

‘ আপনারা এখানে বসে অপেক্ষা করতেন। এছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখছি না স্যার।’

ইউনুসের কথা শুনে কিছুক্ষন ভেবে বললো অভ্র,

‘ ঠিক আছে যাও তাড়াতাড়ি আসবে ইউনুস।’

অভ্রের কথা শুনে বেশ উৎফুল্ল হয়ে বললো ইউনুস,

‘ ঠিক আছে স্যার আপনারা এখানে বসুন আমরা এক্ষুনি আসছি।’

বলেই চললো ইউনুস আর ড্রাইভার।’

আর গাড়ির ভিতর আদ্রিজা, অভ্র হতাশ হয়ে বসে রইলো দুজন।’

বেশ কিছুক্ষন কেটে গেল মাঝখানে। কিন্তু ইউনুস আর ড্রাইভারের খবর নেই তখনও এবার বেশ বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে বের হলো অভ্র। এইভাবে গাড়িতে বসে থাকা যায় নাকি। আর ইউনুসটাই বা গেল কোথায় এখনো আসছে না কেন?’ অভ্রকে বের হতে দেখে এবার আদ্রিজাও বের হলো।তাঁরও টেনশন হচ্ছে রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। এখনো বাড়ি ফিরতে পারি নি সে। কি করবে কিছুই যেন মাথাতে আসছে না তাঁর। আদ্রিজা অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো একটা ফোন করবে বাড়িতে যেই ভাবা সেই কাজ কিন্তু ফোন হাতে নিতেই আরো হতাশ হলো আদ্রিজা কারন তাঁর ফোনের চার্জ শেষ। এখন কি করবে সে।’

এদিকে ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। বিরক্তিতা কাজ করছে চরমভাবে। এইভাবে মাঝরাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে এটা ভাবতেই পারে নি সে। আর এমন একটা জায়গায় এসে গাড়িটা নষ্ট হলো সেখান থেকে কিছু করাও যাবে না।’

___

‘ আপনার ফোনটা পাওয়া যাবে একবার?’

হঠাৎই আদ্রিজার মুখে এমন কথা শুনে পাশ ফিরে তাকালো অভ্র। তারপর বিস্মিত কন্ঠ নিয়ে বললো সে,

‘ আমার ফোন দিয়ে তুমি কি করবে?’

‘ আসলে বাড়িতে একটা ফোন করতাম? মা নিশ্চয়ই খুব টেনশন করছে।’

উওরে অভ্র ভ্রু-কুচকে বললো,

‘ ফোন করে কি বলবে?’

‘ বলবো আমি এখনো আরুদের মানে আপনাদের বাড়িতে আছি যেন চিন্তা না করে।’

আদ্রিজার কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল অভ্র। বিস্মিত কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ তোমার ফোনে কি হয়েছে?’

উওরে হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো আদ্রিজা,

‘ আমার ফোনের চার্জ শেষ।’

‘ বাহ বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছো অথচ ফোনে চার্জ দিয়ে আনো নি?’

‘ আপনার বাজে বকা বন্ধ করুন তো?’

হাসলো অভ্র। অভ্রের হাসি দেখে বললো আদ্রিজা,

‘ আপনার কি এই মুহূর্তে হাসি পাচ্ছে খুব বাড়ি কিভাবে ফিরবো তাঁর কোনো চিন্তা আছে?’

‘ চিন্তা আছে দেখেই না হাসার চেষ্টা করছি।’

বলেই নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দিলো অভ্র আদ্রিজার হাতে। এমন সময় আকাশ পথে বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। আচমকা এমনটা হওয়াতে আদ্রিজ অভ্র দুজনেই খানিকটা চমকে উঠলো। সাথে দুজনেই তাকালো আকাশ পথে। কালো মেঘে ঢেকে গেছে পুরো আকাশটা, খানিকক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ তো চমকাচ্ছে। হঠাৎই চারপাশ বেয়ে আসতে লাগলো ধুলো মিশ্রিত বাতাস। ব্রিজের নিচে থাকা নদীতেও প্রবল বেগে ঢেউ হতে লাগলো। হুট করেই আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন দেখে আদ্রিজা খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বললো,

‘ ঝড় আসবে মনে হয় এখন কি হবে? আমরা বাড়ি ফিরতে পারবো তো আজ?’

উওরে অভ্র এতটুকুই বলে,

‘ ভয় পেও না ব্ল্যাকবেরি কিছু হবে না আমি তো আছি।’

প্রতিউওরে শুধু ঘাবড়ানো ফেস নিয়ে তাকালো আদ্রিজা অভ্রের দিকে। তবে কিছু বললো না। কেন যেন ভয় হচ্ছে তাঁর ভীষণ ভয়?’

#চলবে….

#গোধূলি_বিকেলে_তুমি_আমি❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১৬
________________

ভয়ে জড়সড় হয়েই তাকিয়ে আছে আদ্রিজা অভ্রের মুখের দিকে। কি হবে না হবে কিছুই বুঝচ্ছে না যেন। চারপাশের পরিবেশটা হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে ভয়ংকর। বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে, ব্রিজের নিচের নদীর ঢেউরা স্রোত দিচ্ছে ভাড়ি ভাবে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে উচ্চ স্বরে। প্রকৃতির এমন ধমকানো রূপ দেখে বললো আদ্রিজা,

‘ এখন আমরা কি করবো?’

‘ ভয় পেও না দেখবে একটা না ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।’

এরই মাঝে বিকট শব্দে ধুলো মিশ্রিত বাতাস বয়ে আসলো অভ্রদের দিকে। এতে আদ্রিজা খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে কাছাকাছি গেল অভ্রের। চোখে ধুলো ঢুকে গেছে তাঁর। অভ্র ব্রিজের দিকে মুখ করে থাকায় তাঁকে খুব একটা ছুঁতে পারলো না ধুলো। আদ্রিজা চোখ খুলতে পারছে না, চোখ খুলতে নিলেই চোখ জ্বলছে তাঁর। আদ্রিজার অবস্থা বুঝতে পেরে বললো অভ্র,

‘ কি হয়েছে?’

উওরে নিজের চোখের চশমাটা খুলে চোখ ডলতে ডলতে বললো আদ্রিজা,

‘ চোখের ভিতর কি যেন একটা ঢুকে গেছে?’

আদ্রিজার কথা শুনে খানিকটা বিস্মিত হয়ে বললো অভ্র,

‘ কই দেখি?’

বলেই আদ্রিজার আর একটু কাছাকাছি হলো অভ্র। আদ্রিজার চোখটা আস্তে করে খুলে ফুঁ দিতে লাগলো সে। কিছুক্ষন যেতেই পর পর কয়েকবার পলক ফেলে চোখ খুললো আদ্রিজা। আদ্রিজাকে চোখ খুলতে দেখে বললো অভ্র,

‘ ঠিক আছে এখন?’

উওরে মাথা নাড়িয়ে হা বললো আদ্রিজা। এরই মাঝে বলতে না বলতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টিতে ভিজে যেতে লাগলো আদ্রিজা আর অভ্র। আদ্রিজা খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বললো,

‘ এখন কি হবে বৃষ্টি পড়ছে তো গাড়িতে ঢুকে বসবেন?’

আকাশে মেঘ ডাকছে, ভয়ংকর ভাবে মেঘ ডাকছে এমন একটা অবস্থায় এইভাবে মাঝরাস্তায় গাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না। অভ্র আশেপাশে তাকিয়ে বললো,

‘ বৃষ্টির মধ্যে গাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না তাঁর চেয়ে সামনে চলো দেখি ছাউনি জাতীয় কিছু পাই কি না।’

আদ্রিজা শুনলো অভ্রের কথা। বললো,

‘ ঠিক আছে চলুন।’

অতঃপর আদ্রিজা অভ্র চললো সামনে। কতদূর এগোতেই ব্রিজের নিচে নেমে পড়লো তাঁরা। ব্রিজের নিচ থেকে নামতেই টিন বিশিষ্ট একটা ছাউনিঘর দেখতে পেল অভ্র। তক্ষৎনাত আদ্রিজার হাত ধরে এগিয়ে চললো সে সেখানে। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার অবস্থা তাদের।’

চারদিকে কাগজের বেড়া আর উপরে টিন বিশিষ্ট একটা ছাউনি ঘরের মধ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিজা আর অভ্র। আদ্রিজা শীতে থরথর করে কাঁপছে। পার্পল কালারের জামাটা বৃষ্টিতে ভিজে পুরো যাচ্ছে তাই অবস্থা তাঁর। খুব আনিজি লাগছে তাঁর অভ্রের সামনে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। আদ্রিজা তাঁর গায়ের ওড়নাটাকে মেলে নিজেকে ঢেকে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ এইরকম একটা বাজে পরিস্থিতি পড়তে হবে তাঁকে এটা ভাবতেই পারে নি আদ্রিজা।’

এদিকে অভ্র,

আদ্রিজার আনিজি ফিল হওয়াটা বেশ বুঝলো যেন। কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক কি করা যায় এটাই যেন বুঝছে না সে। হঠাৎই নিজের গায়ে থাকা কালো শার্টের ওপর কালো কোটটার কথা মনে পড়লো অভ্রের। যদিও এটাও বৃষ্টিতে ভিজে গেছে তাঁরপরও এটা আদ্রিজাকে দিলে আইথিংক একটু হলেও আদ্রিজার অসস্তিটা কমবে।’

অভ্র তক্ষৎনাত তাঁর গায়ের কোটটা খুলে আদ্রিজার দিকে এগিয়ে দিল। তবে কিছু বললো না। অভ্রের কান্ডে খুব অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলো আদ্রিজা অভ্রের হাতের দিকে। পরক্ষণেই বেশি না ভেবে কোটটা নিয়ে নিলো সে। গায়ে জড়িয়ে নিলো আনমনে।’

অতঃপর ভেজালো অবস্থায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলো আদ্রিজা আর অভ্র।’

কেটে গেল অনেকক্ষণ। কিন্তু বৃষ্টি থামলো না উল্টো বৃষ্টির বেগ যেন ধীরে ধীরে আরো বাড়তে লাগলো। ঝনঝন করে শব্দ হতে লাগলো উপর থেকে। টিনের ছাউনি হওয়ায় শব্দটা যেন আরো বেশি প্রখর। অভ্র দাঁড়িয়ে আছে একটা বাঁশের সামনে দিয়ে আর আদ্রিজা তাঁর থেকে কিছুটা দুরত্বে টেবিলের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে চুপচাপ। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ভালো কিছু পাওয়ার মধ্যে এই টেবিলটাই যেন পেলে আদ্রিজা।’

হঠাৎই কি ভেবে যেন খুব জোরে হেঁসে ফেললো আদ্রিজা। আদ্রিজাকে হুট করে হাসতে দেখে অবাক হলো অভ্র। অবাক হয়েই বললো সে,

‘ তুমি হাসছো কেন?’

উওরে আদ্রিজাও অভ্রের কোটটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

‘ হাসবো না তো কি করবো বলুন এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি যে চেয়েও কিছু করতে পারছি না।’

‘ তাই বলে হাসবে অদ্ভুত।’

‘ দেখুন মানুষ নিরূপায় হলে কি কি কাজ করতে পারে? এক হাসতে আরেক নয় কাঁদতে। এই মুহূর্তে কাঁদার মতো পরিস্থিতি হয় নি তাই হেঁসে কাম চালাচ্ছি আর কি।’

আদ্রিজার কথা শুনে অভ্র হতভাগ হয়ে বললো,

‘ বৃষ্টিতে ভিজে মাথাটা গেল নাকি কিসব ভুলভাল বকছো।’

‘ আপনি তো আসলেই অদ্ভুত মানুষ। জটিল মুহূর্তে হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করছি তাও বুঝছেন না।’

‘ হাসতে হলে মুখ বন্ধ করে উল্টোদিক ঘুরে হাসো উচ্চ স্বরে একদম হাসবে না।’

‘ হুম ঠিক আছে ঠিক আছে। বুঝতে পেরেছি আপনি রেগে গেছেন।’

বলেই হাঁচি দিলো আদ্রিজা। ঠান্ডা লেগে গেছে বোধহয়।’

চরম বিরক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। এবার সত্যি বিরক্ত লাগছে তাঁর এইভাবে মাঝপথে গাড়িটা খারাপ হওয়ার কি খুব দরকার ছিল। আর এই ইউনুসটাও বা কোথায় গেল। এখনো কোনো খবর নেই। মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই। ধুর ছাতা। সব বেডলাক আজই হওয়ার ছিল।’

অভ্র আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না এগিয়ে গেল সে আদ্রিজার দিকে। বসলো আদ্রিজার পাশ দিয়ে। বললো,

‘ আজ বোধহয় এখানেই রাত কাটাতে হবে মিস ব্ল্যাকবেরি?’

‘ আমারও তাই মনে হয়। ভাগ্যিস আপনি ছিলেন না হলে একা একা আমি কি করতাম বলুন তো।’

উওরে আদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বললো অভ্র,

‘ খুব মজা তাই না, এইভাবে বৃষ্টির মধ্যে এখানে বসে থাকতে খুব মজা।’

‘ মজা না ছাঁই, প্রচুর মশা বুঝলেন।’

‘ কি?’

‘ আপনি কানা নাকি,

‘ তুমি না বড্ড কথা বলছো আজ।’

এমন সময় আকাশে বিকটও শব্দে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। আচমকা এমনটা হওয়াতে প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়ে আদ্রিজা ধরে বসলো অভ্রের হাত। আদ্রিজার কান্ডে অভ্র শান্ত গলায় বললো,

‘ কুল ডাউন কিছু হয় নি।’

আদ্রিজা শুনলো অভ্রের কথা সাথে শীতল চাহনিতে তাকিয়ে রইলো সে অভ্রের মুখের দিকে।’

এমন সময় ছাউনির কর্নারে ঝুলে থাকা একটা বাল্ব জ্বলে উঠে ঠাস শব্দ করে নিভে গেল আবার। এতে আদ্রিজা অভ্র দুজনেই চমকে উঠলো। আদ্রিজার ঘাবড়ে গিয়ে খিঁচে বন্ধ করে আর একটু শক্ত করে চেপে ধরলো অভ্রের হাত।’

অভ্র আগের ন্যায় এখনো বসে আছে চুপচাপ। আনমনেই তাকালো সে থরথর করে কাঁপতে থাকা আদ্রিজার মুখের দিকে। ভেজালো মুখটা শুকিয়ে গেছে অনেক আগে তবে চুল শুকায় নিয়ে এখনো, চোখের চশমা থাকায় চোখের কাজল লেপ্টায় নি তেমন। ঠোঁটেও লিপস্টিক লেগে আছে বিন্দু বিন্দু। হুট করেই এক অদ্ভুত মায়া অনুভব করলো অভ্র আদ্রিজার মুখের মাঝে। তক্ষৎনাত চোখ সরিয়ে ফেললো সে আদ্রিজার উপর থেকে। মনে মনে বললো,

‘ এইভাবে কারো দিকে তাকিয়ে থাকাটা ঠিক না।’

____

সূর্যের ফুড়ফুড়ে আলো উঠছিল তখন। চারপাশ দিয়ে শিরশিরে বাতাস বইছিল খুব। বাতাসে শীত শীত ভাব। শীতের প্রলাপে গায়ের কোটটা আরেকটু শক্ত করে গায়ে জড়িয়ে নিলো আদ্রিজা। হুট করেই কাল রাতের ঝড় বৃষ্টির ঘটনা মনে পড়তেই চোখ খুলে তাকালো আদ্রিজা। আশেপাশে তাকাতেই বুঝলো সে রাতের অন্ধকার পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে, সাথে বৃষ্টিও থেমে গেছে। আদ্রিজা তক্ষৎনাত অভ্রকে ডাকার জন্য পাশ ফিরে তাকালো। সাথে সাথে অভ্রকে নিজের খুব কাছে অনুভব করলো সে। অভ্র তাঁর কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে আনমনে। আদ্রিজা তাকালো অভ্রের মুখের দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে পুরো মুখটাই শুকিয়ে গেছে, মাথায় জুড়ে থাকা সিল্কি কালো চুলগুলো পড়ে আছে কপাল জুড়ে। আদ্রিজার ইচ্ছে করলো হাত দিয়ে অভ্রের চুলগুলো সরিয়ে দিতে কিন্তু দিলো না। হঠাৎই আদ্রিজার মনে হলো, এভাবে এখানে থাকাটা আর ঠিক হবে না। আদ্রিজা তক্ষৎনাত ডাকলো অভ্রকে। বললো,

‘ শুনছেন সকাল হয়ে গেছে উঠুন তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবেন না।’

পর পর কয়েক বার ডাকতেই অভ্রের হুস আসলো। হুস আসতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো অভ্র। আশেপাশে তাকাতেই আদ্রিজার খুব কাছাকাছি চলে যাওয়াটা বুঝতে পেরে তক্ষৎনাত দূরে সরে গেল অভ্র। বললো,

‘ আই এম সরি। আমি আসলে,

অভ্র আরও কিছু বলার আগেই আদ্রিজা বলে উঠল,

‘ ইট’স ওকে। এখন চলুন তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে তো বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে চিন্তা করতে করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।’

অভ্র শুনলো আদ্রিজার কথা চটজলদি নেমে পড়লো সে নিচে। তারপর আদ্রিজার হাত ধরতেই আদ্রিজাও নেমে পড়লো উঁচু সেই টেবিলটার উপর থেকে। আশেপাশে তাকাতেই বুঝলো তাঁরা, কাল রাতে যেটাকে শুধু টিন বিশিষ্ট ছাউনি ভেবেছিল সেটা আসলে একটা দোকানঘর। আর ছাউনিটা সেই দোকানেরই সামনের অংশ।দোকানের দিকটা কাগজ দিয়ে ঢেকে থাকায় বুঝতে পারে নি অভ্র আদ্রিজা। অভ্র বললো,

‘ তাই তো বলি এই খোলামেলা ছাউনিতে বাল্ব লাগালো কে?’ হয়তো ঝড়ের কারনে কারেন্ট চলে যাওয়ায় দোকানদার লাইট বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। আর হুট করে বৃষ্টির মাঝে আচমকা জ্বলে ওঠে কেটে গেছে হয়তো।’

অতঃপর আর বেশি ভাবলো না অভ্র আদ্রিজা। তক্ষৎনাত ছাউনি থেকে বেরিয়ে এঁকে অপরের হাত ধরে এগিয়ে চললো সামনে। বৃষ্টি পড়ে বাহিরের পুরো জায়গাটা কাঁদায় পিছলে জর্জরিত হয়ে গেছে।’

অভ্র আদ্রিজা খুব সাবধানেই পার করলো কাঁদায় মিশ্রিত রাস্তাটা।’ কিন্তু ঘাপলাটা এসে বাঁধলো ব্রিজের ওপরে ওঠার রাস্তাটায়। খানিকটা উঁচু মাটির তৈরি পাহাড়ের মতো জায়গাটা। আদ্রিজা জায়গাটা দেখেই অভ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ এখান থেকে ওঠা তো খুব টাফ। বৃষ্টিতে পুরো কাঁদা কাঁদা হয়ে গেছে। উপরে উঠতে গেলেই তো পিছলে যাবো। আর পড়ে গেলে তো অবস্থা খুব খারাপ হবে। এখন,

আদ্রিজার কথা শুনে অভ্র সাহস জোগাতে বললো,

‘ কিছু হবে না যে জায়গা গুলো শুঁকনো শুঁকনো মনে হবে সেখানে সেখানে পা ফেলে উঠে পড়ো দেখবে তুমি পারবে।’

উওরে আদ্রিজা বললো,

‘ আপনি আগে যান তবে আমি আপনার পায়ের ছাপ ফলো করে আসছি।’

উওরে অভ্রও বেশি না ভেবে বললো,

‘ ঠিক আছে।’

অতঃপর এগিয়ে চলো অভ্র। ধীরে ধীরে পা ফেলেই উঠে পড়লো সে। অভ্র উপরে উঠেই বললো আদ্রিজাকে,

‘ এবার তুমি চলে এসো?’

উওরে আদ্রিজা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,

‘ হুম আসছি।’

‘ হুম তাড়াতাড়ি আসো আদ্রিজা।’

আদ্রিজা শুনলো বেশি না ভেবে আস্তে আস্তে অভ্রের পায়ের ছাপ অনুসরণ করেই উপরে উঠে লাগলো সে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো একবারে উপরে উঠে হঠাৎই পায়ে সিলিপ কেটে পড়ে যেতে নিল আদ্রিজা। অভ্র আদ্রিজার খুব কাছে থাকায় তক্ষৎনাত আদ্রিজার হাত ধরে দিলো টান। সাথে সাথে আদ্রিজা উপরে উঠেই জড়িয়ে ধরলো অভ্রকে। আসলে অভ্র এত জোরে হাত ধরে টান দিলো যে আদ্রিজা না চাইতেও জড়িয়ে ধরা লাগলো অভ্রকে।’

এদিকে অভ্র,

আদ্রিজার দিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বললো,

‘ চোখ কোথায় থাকে তোমার এক্ষুনি তো সিলিপ কেটে একদম নিচে গড়িয়ে পড়তে। মাঝা কোমড় একটাও তো আর আস্ত থাকতো না।’

উওরে স্তব্ধ হয়ে শুধু এতটুকুই বলে আদ্রিজা,

‘ আমি বুঝতে পারি নি সরি।’

_____

মাথায় নিজের কোটটা জড়িয়ে দিয়ে গাড়ির সামনের সিটে বসে আছে ইউনুস। হঠাৎই কাঁদো কাঁদো ফেস নিয়ে শোয়া থেকে বসে চেঁচিয়ে বললো সে,

‘ ওহ! বস আমনে কোমনে?’

এমন সময় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে স্ট্রেট গলায় ধমকের স্বরে বললো অভ্র,

‘ তোমার সামনে ইডিয়েট।’

#চলবে…