গোধূলীতে তুমি প্রিয় পর্ব-০১

0
1465

#গোধূলীতে_তুমি_প্রিয়
#প্রথম_পর্ব
#লেখিকা_রুবাইতা_রিয়া

বিয়ের দিন নিজের হবু বর ইথানকে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনতে দেখে গোটা পৃথিবীটা জানো থমকে গেছিলো আমার কাছে।চারটি বছর ধরে যে মানুষটাকে ভালোবাসলাম আজ সেই কিনা অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনলো।নিজের চোখকে জানো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।টুপটাপ করে নোনা পানি গড়িয়ে পরছে আমার দু চোখ বেয়ে।তবে আসল ঝটকা তো তখন খেলাম যখন ইথানের বউ বেশে আর কেউ না বরং নিজেরই বেস্ট ফ্রেন্ড ফারিহাকে দেখলাম।যেই মানুষগুলোকে আমি সবথেকে বেশি বিশ্বাস করতাম তারাই কিনা আমাকে এইভাবে ঠকালো??ফারিহা কি করে পারলো আমার থেকে আমার সবথেকে প্রিয় জিনিসটাকে কেড়ে নিতে?মন চাচ্ছে সবকিছু ভেঙে তচনচ করে দেই।

আমার সামনেই দাড়িয়ে আছে ইথান আর তার সদ্য বিয়ে করা বউ ফারিহা।বউ বেশে ফারিহাকে অপ্সরীর মতন লাগছে।হয়তো এই রূপের জন্যই আমাকে ছেড়ে সে ফারিহার কাছে গিয়েছে।আমি চুপচাপ ওদের কাজগুলো দেখতে লাগলাম।ইথানের এমন কাজে উপস্থিত সবাই অবাকের সপ্তম পর্যায়ে চলে গিয়েছে।মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে তারা এইজন্যই হয়তো এমন চুপ করে আছে।ইথানের বাবা রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।তিনি এবার রাগী গলায় বলে উঠলেন,,

ইথানের বাবা—-এইগুলো কোন ধরনের অসভ্যতামী ইথান?আজকে তোমার আর লাবিবার বিয়ে আর তুমি কিনা ফারিহাকে বিয়ে করেছো??একবারো ভাবলে পর্যন্ত না লাবিবার কথা?আমাদের মান-সম্মানের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু লাবিবার যে ক্ষতি হলো আজ তার কি হবে??সবার সামনে বউ সেজে হাসির পাত্র হলো আজকে ও।ওর মনে কি চলছে একটা বারও কি ভেবে দেখেছো তুমি??

বাবার কথা শুনে ইথান মাথা নিচু করে রইলো।মনে মনে ভাবলো আজ যদি ওর আর লাবিবার বিয়েটা হতো তাহলে হয়তো এর থেকেও বেশি ক্ষতি হতো লাবিবার।ওর জীবনটাই হয়তো নষ্ট হয়ে যেতো।ইথান এবার কিছুটা গম্ভীর ভাবেই বলে উঠলো,,

ইথান—-বাবা আমি এখন কোনোরকম সিনক্রিয়েট করতে চায় না।শুধু জেনে রাখ আমি যা করছি সবার ভালোর জন্যই করছি।আর আজকে থেকে ফারিহা এই বাড়ির বউ।এই নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চায় না আমি।অনেকে টায়ার্ড লাগছে আমি রুমে গেলাম।বলেই গটগট করে নিজের রুমে চলে গেলো।ওনি যা রাগী তাতে ওনাকে কিছু বলারও সাহস নেই এখন কারোর।

ইথান চলে যেতেই আত্মীয়রা সবাই নানারকম কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে।আমি এক দৃষ্টিতে ফারিহার দিকে চেয়ে আছি।নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও কেনো আমাকে এভাবে ঠকালো?খুব ঘৃণা লাগছে ওর প্রতি।ঠিক তখনই মামনি(ফারিহার মা)এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে উঠলো,,

মামনি—-আমাকে ক্ষমা করে দে লাবিবা।আমি যদি আগে জানতাম যে আমার এক মেয়েই আরেক মেয়ের সংসার ভাঙবে,তার প্রিয় জিনিসটাকে এভাবে কেড়ে নিবে তাহলে আগেই ওকে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।এমন মেয়ে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভালো।

মামনির এমন কথায় ফারিহা এবার বলে উঠলো,,

ফারিহা—-মা এগুলো তুমি কি বলছো??আমি তোমার মেয়ে।

মামনি—-সেটা ভাবতেই আমার ঘৃণা লাগে যে তুই আমার মেয়ে হয়েও এমন একটা জঘন্য কাজ করলি।একবার নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের কথাটাও ভাবলিনা।ছিহহ!!

মামনির এমন কথায় ফারিহা মাথা নিচু করে রইলো।মনে মনে বললো তোমাকে যদি সত্যিটা জানাতে পারতাম।কিন্তু সেই সময়টা আসতে যে অনেক দেরী।ফারিহার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি বেরিয়ে এলো।

হঠাৎ কজন আত্মীয় একে একে বলে উঠলো,,

আত্মীয় এক—-আরে আরে নতুন বউয়ের মা কাদছেন কেনো??আপনার তো খুশি হওয়ার কথা যে এতো বড়লোক পরিবারে আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে।বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে হলো ইথান সেই অনুযায়ী তো ইথানই সবকিছু পাবে।আর আমাদের ইথান দেখতে তো হিরোদের থেকে কম না।ওর বাবার যেই মেডিকেল কলেজটা আছে না সেখানে সব মেয়েদের ক্রাশ বয় ও।এতো ভালো মেয়ের জামাই পেয়ে কেউ কাঁদে নাকি?

আত্মীয় দুই—-আরে ভাবী বুজনা এইসবই হলো নাটক।এখন একটু কেদে লাবিবার কাছে ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে।মনে মনে দেখো ঠিকই খুশি হয়েছে।

আত্মীয় তিন—-মেয়েকে কেমন শিক্ষা দিয়েছে কে জানে!নিজের বান্ধবীরই কিনা বিয়ে ভাঙে।কি মেয়েরে বাবা!লাবিবা তোমার কপালটা আসলেই খারাপ!

তাদের এমন কথায় ফারিহা এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো।কিন্তু আমার মাঝে কোনোরকম প্রভাব ফেললো না।সবটা এখনো সপ্নের মতন লাগছে।ঠিক তখনই ইথান এসে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,,

ইথান—-এখানে এতো কথা হচ্ছে কেনো??ফারিহা তুমি কাঁদছো কেনো??কেউ কিছু বলেছে তোমায়?লিসেন ফারিহাকে কেউ যদি কিছু বলেছো তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না!

ইথানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে।ব্লু জিন্স সাথে অফ হোয়াইট কালারের শার্ট যার হাতা ফোল্ড করে রাখা।ভিজা চুলগুলো দিয়ে কপাল বেয়ে টুপটাপ করে পানি ঝরছে, ফর্সা গালটার মাঝখানে ছোট্ট একটা তিল যেটাতে একটু বেশিই আকর্ষণীয় লাগে ইথানকে।তার দিকে না তাকিয়ে তারাতারি নিজের চোখ সরিয়ে নিলাম।এখন যে সে অন্য কারোর।আমার ভালোবাসাটা যে ফিকে হয়ে গেছে।

ইথান এসে ফারিহার পাশে দাড়িয়ে পরলো।আমি ওদের দিকে তাকাতেই দেখি ফারিহা অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।ওর এমন ভাবে তাকানোর কারনটা ঠিক মাথায় এলো না আমার।ইথানের দিকে তাকাতেই দেখি সে আমার বিপরীত দিকে তাকিয়ে আছে।হয়তো আমাকে তার সয্যই হচ্ছে না আর।আমি ধীর পায়ে ইথান আর ফারিহার দিকে এগিয়ে গেলাম।আমাকে এভাবে আসতে দেখে দুজনেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে তা বেশ বুজতে পারছি আমি।

ইথান একবারো লাবিবার দিকে তাকাচ্ছে না।সে জানে তার লাবুপাখিকে এখন দেখলে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবেনা।আজকে যে অনেক বড় আঘাত করে ফেলছে সে লাবিবাকে।কিন্তু এখন তার কাছে আর কোনো উপায় ও নেই এটা ছাড়া নাহলে এতো প্লান সব নষ্ট হয়ে যাবে।

আমি ওদের সামনে গিয়ে দাড়াতেই বাড়ির একজন সার্ভেন্ট এসে আমাকে এক তোড়া গোলাপ ফুল দিয়ে গেলো।গোলাপের তোড়াটা হাতে নিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম,,

আমি—-কনগ্রাচুলেশন মিস্টার ইথান এহসান আদিল এন্ড মিস জান্নাতুল ফারিহা।আমি আনন্দের সাথে আপনাদের দুজনকেই এই বাড়িতে ওয়েলকাম জানাচ্ছি।প্লিজ টেক দিজ ফ্লাওয়ার।বলেই ফুলের তোরাটা ফারিহার হাতে ধরিয়ে দিলাম।আর একমুহূর্ত সেখানে না দাড়িয়ে থেকে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

লাবিবার এমন কাজে উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ।কেউ না বুঝুক ইথান ঠিকই বুজতে পারছে লাবিবার মনে এখন কি চলছে।নিজের প্রেয়সী কে বুজতে যে একটুও কষ্ট হয়না তার।

ইথানের চিন্তার মাঝেই ওর বাবা আয়মান এহসান এসে গম্বীর কণ্ঠে বলে উঠলো,,

—-তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো ইথান।আজ তোমাকে বাবা হিসেবে একটা কথা বলতে চায়।এই কথাটা সবসময় মনে রাখবে কাঁচ নিয়ে যে খেলে হাতটা কিন্তু তারই কাটে,কাঁচের নয়।আজকে তুমি লাবিবা মায়ের ছোট্ট মনটাকে কাঁচের টুকরোর মতন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছো।ভবিষ্যতে এই কাঁচের টুকরোর মতন মনটাই না তোমার শত্রু হয়ে দারায়।কথাটা বলেই ইথানের বাবা সেখান থেকে চলে গেলেন।

তার যাওয়ার পরপরই সেখান থেকে সবাই একে একে চলে গেলো।সবার মনটাই এখন ঘৃণায় ভরে উঠেছে ইথান আর ফারিহার প্রতি।তবে সবথেকে বেশি অবাক হয়েছে তারা এটা দেখে যে ইথান ছোট থেকে লাবিবা বলতে পাগল সেই কিনা আজকে ফারিহাকে বিয়ে করলো।এর কারনটা কি??সবাই চলে যেতেই ইথানের মা এসে বলে উঠলো,,

—-চিন্তা করিস না বাবা।সব ঠিক হয়ে যাবে।তোর কিছু হবে না দেখিস।আমি তোর পাশে আছি।আমি জানি আমার ইথান বাবা লাবিবা মাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে।তোর আর ফারিহার আলাদা থাকার ব্যাবস্হা আমি করে দিচ্ছি।আপাদত রাত না হওয়া পর্যন্ত তুই ওকে নিয়ে তোর ঘরে রাখ।কথাটা বলেই কোনোভাবে চোখের পানি মুছে সেখান থেকে চলে গেলো ইথানের মা।

ইথান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফারিহাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

অন্যদিকে আমি নিজের গায়ে থাকা গহনাগুলো টেনে হিচড়ে খুলে ফেলছি।এগুলো জানো কাটার মতন লাগছে আমার কাছে।গহনাগুলো খুলে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পরলাম আর আজকের ঘটনাগুলো মনে করতে থাকলাম।

লাবিবা আফরোজ।এবার মেডিকেল সেকেন্ড ইয়ারে।খুব ছোট থাকতেই লাবিবার বাবা মারা যায় সেই থেকে লাবিবা ওর মা আর ছোট বোনকে নিয়ে আয়মান এহসান ওরফে ওর বড় কাকাইয়ের বাসায় থাকে।বাবা না থাকলেও লাবিবা কখনো বাবার অভাব বুজেনি এতোটাই ভালোবাসা দিয়ে বড় করছে লাবিবাকে ওর বড় কাকাই।ইথান হলো ওর বড় কাকুর একমাত্র ছেলে।স্টাডি কমপ্লিট করে এখন সে ডক্টর।তার বাবার নিজস্ব মেডিকেল কলেজেই সে এখন ডাক্তারি করছে।(মানে বাবার কলেজে ভাব নেই আরকি😜😜)ইথানের একটা ছোট বোন ও আছে নাম অর্থী।

আজ ইথান আর লাবিবার বিয়ের কথা ছিলো।খুব আয়োজনের সাথেই বিয়েটা হচ্ছিলো কিন্তু বিয়ের ঠিক দু ঘন্টা আগে যখন লাবিবা মনে একরাশ সপ্ন নিয়ে বউ সাজতে ব্যাস্ত তখন,,,

#চলবে??