গোপন কথা পর্ব-০১

0
1054

#গোপন_কথা
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

বিয়ের তিন দিন পর আসল কথাটা জানতে পারলো নোরা।ওর একমাত্র ননদ তিশা তাকে ছাদে ডেকে নিলো।বললো,’ভাবী,ছাদে আমার একটা গোলাপ বাগান আছে।চলো দেখতে যাই!’
নোরা এসব পেলে বেঁচে উঠে।বাড়িতেও সে উড়নচন্ডী ছিল।আম গাছ পেয়ারা গাছ জাম গাছে উঠা ছিল তার নিত্য দিনের কাজ। বিয়ের দু’দিন আগেও পেয়ারা গাছে উঠে ঢালে হেলান দিয়ে পেয়ারা খেয়েছে। এই জন্য তার দাদুর কী বকাবকি!
‘ঘাটু মাইয়া,তরে গাছের লগেই বিয়া দেওন উচিৎ আছিলো!রাইত দিন গাছের লগেই সংসার করতি তাইলে!’
ওর মাও বকতো সব সময়।সে এসব কানেও তুলতো না কোনদিন।
সে যায় হোক, মূল কথায় থাকা ভালো। নয়তো গল্প বিরষ হবে। পাঠকের আনন্দ নষ্ট হবে ‌।
ওরা ছাদে গেলো। তারপর কথায় কথায় উঠে এলো সেই কথা।
তিশা বললো,’আজ তোমার সতীন আর সৎ পুত্র আসবে ভাবী। ওদের বোধহয় সন্ধ্যা হয়ে যাবে ফিরতে!’
নোরা আঁতকে উঠলো কথাটা শোনে।
সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,’কী বললে তিশা? একচ্যুয়েলি আমি শুনতে পাইনি!’
তিশা ঝটপট করে বললো,’ভাইয়ার প্রথম পক্ষের স্ত্রী সন্তান আসছে।’
নোরা কাঁপছে। থরথর করে।সে কাঁপা কাঁপা গলায় ফের জিজ্ঞেস করলো,’আমার সাথে
মজা করছো তাই না তিশা?
তিশা বললো,’না ভাবী।আমি তোমার সাথে মজা করবো কেন।আজ সন্ধ্যা হলেই নিজ চোখে দেখতে পারবে সত্য না মিথ্যা।’
এবার আর টিকে থাকতে পারছে না নোরা।
আর ওর মাথা কেমন ঘুরছে।লাটিমের মতো।সে চোখে ঝাপসা দেখছে সবকিছু।সাদা গোলাপ গুলোকে মনে হচ্ছে তার কালো গোলাপ।
সে বললো,’আমি পড়ে যাচ্ছি।তিশা আমায় ধরো প্লিজ!’
আরেকটুর জন্য পড়েই যেতো!তিশা ওকে জাপটে ধরলো। অবশ্য মাটিতে পড়া থেকে ওকে বাঁচাতে পারলেও ততক্ষণে সেন্সলেস হয়ে গেছে সে।
তিশা ভয় পেয়ে গেল।সে চিৎকার করে ডেকে উঠলো,’মা,মাগো,ও মা!’
ছাদ থেকে ডাকলে ঘরের ভেতর আওয়াজ পৌছুয় না।সে এবার ডাকলো ফাহাদকে,’ভাইয়া। ভাইয়া রে!ভাবী —-!’
এরপর কী বললো তিশা নিজেও জানে না।
ভাইয়া ঘরে নাই।থাকলেও শুনতো না।ওর ডাকটা শুনলো বাসার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পাশের বাসার তুষার।সে শুনে দৌড়ে এলো এবং সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠলো। এসে দেখে ভয়াবহ কান্ড!
এই তুষার হলো তিশার দু চোখের বিষ! ওকে দেখলে ওর গা জ্বলে। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব ভাবার সময় নেই। ভাবীর অবস্থা সিরিয়াস!সে কখনো তুষারকে ভাই বলে ডাকেনি। কিন্তু আজ ডাকলো।বিপদে পড়ে।সে বললো,’তুষার ভাই,আমি একা ভাবীকে নিয়ে নীচে নামতে পারবো না।আমায় হেল্প করেন।একটু ধরেন আমার সাথে। দুজন মিলে নামাই!’
তুষার ধমক দিলো ওকে।
‘ওই বেক্কল ছেরি!খালি কলা গাছের মতো লম্বাই হয়ছো। মাথায় কোন ঘিলু নাই। জলদি পানি ভর্তি বালতিটা নিয়ে আসো।মগটাও আয়নো!’
এইসব পন্ডিতি মার্কা কথার জন্যই এই ছেলেকে দেখতে পারে না তিশা। কিন্তু এবার যে কথাটা বলেছে এটা সত্য। ভাবীর মাথায় পানি ঢালতে হবে। কিন্তু সে গিয়ে পানি আনতে আনতে ভাবীর অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে!
তাই সে বললো,’তুষার ভাই, আপনি যান না নীচে। তাড়াতাড়ি হবে তাইলে!’
তুষারের রাগ উঠে গেল।সে বসা থেকে উঠে তিশার মাথায় শক্ত করে একটা চাটি মেরে বললো,’এইটা কী?বালতি না?এই বালতি ভরা পানি না?বালতির পাশে লাল এইটা কী?মগ না?’
বলে সে গোলাপ বাগানের কাছ থেকে বালতি আর মগ নিয়ে এলো। তারপর নিজেই নোরার মাথায় পানি ঢালতে শুরু করলো।
তিশা রাগে দুঃখে কেঁদে ফেললো।এক তো তার অপছন্দের লোকটা তার মাথায় রাগে ছাটি মেরেছে।দুই, খানিক আগেই ভাবীর সাথে আসার সময় সে বালতি ভরে পানি আর মগ নিয়ে এসেছিলো। নতুন যে গাছগুলো লাগিয়েছে ওগুলোর গোড়ায় পানি দিবে বলে। কিন্তু নোরা সেন্সলেস হওয়ায় সে সব ভুলে গেছে!বালতির কথা তার মনে নাই। এই জন্য লজ্জা লাগছে।
পানি ঢালতে ঢালতে তুষার দাঁত মুখ কুঁচকে বললো,’ওই ছেরি এখনও দাঁড়াইয়া আছো কেন?নিচে যাও।মারে নিয়ে আসো গিয়ে।যদি এই বেটি মরে তাইলে তো আমারে দোষবো পরে।বলবো,আমি খুন করছি।তোমারে দিয়াও বিশ্বাস নাই। তুমি নিজেও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারো!’
তিশা সাত পাঁচ না বোঝেই কাঁদতে শুরু করলো।সে ভাবলো সত্যি সত্যি তার ভাবী মরে যাবে!
তার গলাছাড়া কান্না দেখে তুষার কান ফাটানো ধমক দিয়ে বললো,’গলা ছাড়ছো কিসের জন্য?এক্ষন চুপ করো।চুপ করে নিচে যাও।মারে নিয়ে আসো গিয়ে।’
তিশা কাঁদতে কাঁদতেই নিচে গেলো। গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলো।
ওর মা ফিরোজা বেগম মেয়ের কান্না দেখে চমকে উঠলেন। এবং ভয়মাখা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,’কী হয়েছে মা?কী হলো তোর?’
তিশা বললো,’ভাবী।ভাবী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ছাদে।’
ফিরোজা বেগম আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। দৌড়ে গিয়ে উঠলেন ছাদে।তার পেছন পেছন গেল তিশাও।ফিরোজা বেগম গিয়ে দেখেন তুষার নোরার মাথায় পানি ঢালছে।
ফিরোজা বেগমকে সে দেখে বললো,’আন্টি, অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালছি। হুঁশ ফিরছে না। আমার মনে হয় ভাবীকে হসপিটালে নেয়া উচিৎ!’
ফিরোজা বেগম কিছু বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ এমন হলো কেন?
তিনি তিশাকে জিজ্ঞেস করলেন। তিশা যখন বলতে যাবে তখনই চোখ খুললো নোরা। মিটিমিটি করে তাকালো।
ফিরোজা বেগম নোরার মাথাটা নিজের কোলে টেনে নিলেন। তারপর বললেন,’কী হয়েছে মা? হঠাৎ এমন হলো কেন?’
নোরা এবার কোন কথা না বলেই কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো,’মা, আপনার ছেলের নাকি আরেকজন স্ত্রী আছে?একটা ছেলেও নাকি আছে?’
ফিরোজা বেগম বুঝতে পারলেন না এসব জানলো কী করে নোরা। তিনি বরং কথাটা ধামাচাপা দিতে চাইলেন।এই সময়টা ওইসব কথার জন্য মোটেও উপযুক্ত না।এসব বলার জন্য পরে অনেক সময় পাওয়া যাবে।তাই তিনি বিষয়টা ধামা চাপা দেয়ার জন্য বললেন,’কে বলছে এই কথা?’
নোরা কান্নাভেজা গলায়ই বললো,’তিশা।তিশা বলেছে।’
ফিরোজা বেগম হাসি হাসি ভাব করলেন মুখের। তারপর বললেন,’আর তুমি ওর কথা বিশ্বাস করে একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছো!বোকা মেয়ে!ননদরা এমন হাসি তামাশা করেই।তাই বলে সব বিশ্বাস করে ফেলতে হবে নাকি! তোমার ননদ যদি বলে তোমার বর আরো তিনটা বিয়ে করছে তবে তাও তুমি বিশ্বাস করবা নাকি?
এই তুষার, তোমার ফাহাদ ভাই কী আগে আরেকটা বিয়ে করছিলো নাকি?’
তুষার বললো,’তওবা তওবা।এক বিয়েই তো করতে চায় না।বয়স হয়ে গেছে চল্লিশের কাছাকাছি। আবার আরেক বিয়ে!’
ফিরোজা বেগম অতিরিক্ত কথা পছন্দ করেন না।তাই তিনি বললেন,’তুষার তুমি এখন যাও।আমরা মেয়েরা মেয়েরা একটু কথা বলবো এখন।’
তুষারের অবশ্য লজ্জা শরম কম। তবুও সে মাথা হেট করে চলে গেল এখান থেকে।যাওয়ার সময় একবার তিশার দিকে তাকালো।ভাবলো তিশা তাকে ধন্যবাদ টন্যবাদ দেয় কি না।অথবা তার দিকে তাকিয়ে যদি মিষ্টি করে হাসে।যেহুতু সে তার অতবড় সাহায্যটা করলো এর বিনিময়ে সে তো সামান্য ধন্যবাদ পাওয়ার কথায়। কিন্তু তিশা তার দিকে ফিরেও পর্যন্ত তাকালো না।তুষার মনে আঘাত পেলো। ভীষণ আঘাত। এবং ধীরে ধীরে পা ফেলে ছাদ থেকে নেমে সে চলে গেল রাস্তা ধরে।
তুষার চলে যাওয়ার পর ফিরোজা বেগম তিশাকে ডাকলেন। বললেন আমার কাছে আয়।
তিশা তার মায়ের কাছে যেতেই তিনি একটা শক্ত চড় বসিয়ে দিলেন মেয়ের গালে।চড় দিয়ে বললেন,’ওই ভন্ডটা ছাদে আসলো কেমনে?’
তিশা চড় খেয়ে রাগে দুঃখে অভিমানে কাঁদতে শুরু করলো।মার কথার সে জবাব দিলো না।

সকাল বেলা শাশুড়ির ধামাচাপা দেয়া কথায় নোরা বিশ্বাস করে বসেছিল যে ওর বর ফাহাদের আগের কোন স্ত্রী সন্তান নাই। কিন্তু সন্ধ্যা বেলায় যখন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এক মহিলা সাথে করে তিন বছরের এক ছেলে সন্তান নিয়ে এসে বাসায় উপস্থিত হলো তখনই নোরার মাথায় ধরলো। এবং অদ্ভুত ব্যাপার হলো ওই মহিলা বাড়ির উঠোনে এসেই গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করলো এই বলে যে,’আমার সতীন কোথায় গো? সে কী জানে না আজ আমি আসবো?দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে কেন এখনও!’
নোরার এই কথা শুনে মনে হলো সে ফের ঢলে পড়বে জমিনে। তবে কী তার শাশুড়িও তার সাথে প্রতারণা করেছে! ছেলের প্রথম বিয়ের কথা এভাবে গোপন রেখেছে!এখন তার কী উপায় হবে? কীভাবে সে এই বাড়িতে এই লোকের ঘর করবে সারাটা জীবন!

#চলবে।