গোপন কথা পর্ব-২+৩

0
454

#গোপন_কথা
#২য়_পর্ব_৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক


ফিরোজা বেগম নোরাকে বললেন,’যাও। দরজা খুলে গিয়ে দীপালিকে রিসিভ করো। নয়তো ও খুব রেগে যাবে ‌।ও রেগে গেলে এ বাড়িতে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে। ভূমিকম্প হবে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।ওর হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে না।’
নোরার পা চললো না।চললো তার মুখ।সে মুহূর্তে বুঝে ফেললো এই বাড়িতে সে চুপচাপ ঘরকনে হয়ে থাকতে পারবে না। তাকে অবশ্যই মুখ কাঁটা হতে হবে।কথার পিঠে কথা চালাতে হবে। তবেই শান্তি!অন্যতাই ওরা ওর সাথে যা ইচ্ছে তাই করবে। অলরেডি করতেও শুরু করেছে।কথা নাই বার্তা নাই হুট করে ফাহাদের প্রথম পক্ষের স্ত্রী বেড়িয়ে গেল। আবার তিন বছরের সন্তান একটা।কী সর্বনাশের কথা। সকাল হতে হতে দেখা যাবে আরো দু তিন বউ বেড়িয়ে যাবে!
সে তার শাশুড়িকে রাগের গলায় বললো,’মা, আপনি না সকাল বেলা বললেন এসব মিথ্যে।তিশা আমার সাথে মজা করেছে। কিন্তু এখন তো সত্যি হয়ে গেল। আপনার ছেলের প্রথম পক্ষের স্ত্রী উঠোন থেকেই গলা ছেড়ে আমায় ডাকছে। সতীন দরজা খুলে দেও।দেরি করছো কেন?
আপনি আমার সাথে মিথ্যে বললেন কেন?আর সবচেয়ে বড় কথা আপনারা বিয়ের আগে বলেননি কেন আপনাদের ছেলে মেরিড। তার এক সন্তান আছে। এখন কেন বলছেন? কেন!’
ফিরোজা বেগম বিষ্ফারিত চোখে তাকালেন। গ্রামে বড় হওয়া একটা সাধারণ পরিবারের মেয়ে তার সামনে এভাবে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারলো!দেশ কী তবে একটু হলেও বদলাতে পারলো? আগে তো বিয়ের ছ’মাস পরেও ঘরের বধূরা শশুর শাশুড়ির সামনে শব্দ করে কথা বলতেও পারতো না। ভয়ে জড়তায় বারবার ঢুক গিলতো! কিন্তু এই মেয়ে দেখি বিয়ের চতুর্থ দিনেই তুলপাড় করে নিচ্ছে বাড়ি। শাশুড়ির সাথে বাকবিতন্ডা করতেও শুরু করে দিলো!এ তো মেয়ে নয় যেন অগ্নী‌!
ফিরোজা বেগমের ইচ্ছে হলো রাগে অনেক কিছুই বলতে। কিন্তু তিনি বকাঝকা করলেন না। বকাঝকা না করার কারণ তিনি এই মুহূর্তে নোরার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলেন। এবং ভেবে দেখলেন নোরার জায়গায় তিনি হলে এরচেয়ে রুঢ় আচরণ তিনি করতেন।তাই চাপা গলায় শুধু এটুকুই বললেন,’এখন এসব বলার সময় না।আস্তে ধীরে সব জানতে পারবে। এখন তুমি দরজাটা খুলে দেও গিয়ে।আর প্রশ্ন করো না আমায়।’
নোরার কী হলো কে জানে!সে ঝট করে বসে পড়লো খাটের একপাশে। এবং সে তার শাশুড়িকে কর্কশ গলায় এটা জানিয়ে দিলো যে সে দরজা খুলতে পারবে না।আর সবচেয়ে ভালো হয় তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলে।এই সংসার সে করবে না। ফাহাদের সেকেন্ড ওয়াইফ হয়ে এখানে থাকার কোন প্রশ্নই আসে না তার। এরচেয়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অপারেটরের কাজ করে লাইফ পাড় করে দেয়া সহজ হবে তার জন্য!
ফিরোজা বেগম শেষ বারের মতো বললেন,’তবে তুমি দরজা খুলে দিবেই না?’
নোরা বললো,’নাহ।প্রশ্নই আসে না। আপনার মায়া হলে আপনি আপনার পুত্রবধূর জন্য দরজা খুলে দিন গিয়ে!’
অবশেষে ফিরোজা বেগম নিজেই দরজা খুলে দিলেন। খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলো দিপালী। নীল রঙা শাড়ি পরা বড় সড়ো ধরণের মেয়ে মানুষ।তার হাতে একটি লাগেজ।আর অন্যহাতে ধরে আছে তার ছেলে পিপলুর হাত।
দিপালী ঘরে ঢুকেই বললো,’মা, আপনার বাদাইম্যা পোলা কই আছে?ওর খবর আছে আজ!’
ফিরোজা বেগম চোখ বড় বড় করে বললেন,’কেন কী হয়েছে?’
‘কী না হয়েছে বলুন!আমি তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী। মানে বড় বউ।আর নতুন যে আসলো নোরা সে ছোট বউ। ছোট বউ হিসেবে তার দায়িত্ব কী ছিলো?আমারে বাড়ির গেট থেকে রিসিভ করে আনা। মানলাম এটা করলো না। কিন্তু ঘরের দরজাটা খুলে তো দিবে।আমায় সম্মান করে জিজ্ঞেস তো অন্তত করবে কেমন আছেন?তা না করে মুখ এমন করে বসে আছে যেন আমায় সে গিলে খাবে!ওরে বাবা!আজ ও বাসায় ফিরুক। তারপর শিক্ষাটা দেয়াবো!’
নোরা অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার আর পারছে না।সে এবার বলেই ফেললো,’আপনার সংসার আপনিই করুন। শিক্ষা দিতে হলে আপনার স্বামীকে দিন।আমায় এসব শুনাচ্ছেন কেন? আমি আগামীকাল সকাল বেলাতেই এখান থেকে গুড বাই দিচ্ছি।সতীনের সংসার করার মতো কন্ডিশন এখনও হয়নি আমার!আমি কোন এতিম অনাথ না যে এখানে না থাকলে আর কোথাও মাথা গুঁজবার ঠাঁই হবে না আমার!’
দীপালি দু হাতে তালি বাজিয়ে বললো,’বাহ্! বাহ্ বাহ্ বাহ্! গলায় দম আছে দেখছি। ঝগড়া করে মজা পাওয়া যাবে তাহলে!’
নোরার এবার সত্যি সত্যি খারাপ লাগছে।সে এবার রাগে দুঃখে কেঁদেই ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো,’আপনারা এমন খারাপ মানুষ কেন? ছিঃ!প্রতারণা করে একটা মেয়ের সুন্দর জীবনটা নষ্ট করে দিলেন!’
দীপালি ওর কাছে ঘেঁষলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো ওকে।এক পর্যায়ে দীপালি ইশারা করে তার শাশুড়ি আর ননদকে বললো পিপলুকে নিয়ে ও ঘরে চলে যেতে।ওরা ও ঘরে চলে যেতে পা বাড়াতেই ওদের পেছন পেছন নোরাও পা বাড়ালো।ভাবলো এখানে থেকে এই মহিলার সাথে ঝগড়া করার কোন মানে হয় না।সে ওদের সাথে ও ঘরে চলে যাবে।
কিন্তু পারলো না। সামনে গিয়ে দাঁড়ালো দীপালি। দাঁড়িয়ে বললো,’অত তাড়া কিসের গো তোমার? ফাহাদের সাথে সকাল সকাল ঘুমোতে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে তাই না? কিন্তু আফশোস,আজ ফাহাদ আমার সাথে থাকবে। এখন থেকে দিন রাত দু ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।দিনের বেলায় ফাহাদ তোমায় সময় দিবে।আর রাতে আমায়!’
নোরার আর সহ্য হলো না।সে মুখ ফুটে বলেই ফেললো,’শুধু রাতে কেন চব্বিশ ঘন্টাই আপনি তার সাথে থাকুন।পারলে ওকে কোমড়ের সাথে বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখুন। আমার এতে কিছু যায় আসে না।আমি কাল সকালেই বিদায় হচ্ছি এখান থেকে!’
দীপালি মুখ উজ্জ্বল করে হাসলো। হেসে বললো,’নাহ। তুমি তো এখান থেকে কোথাও যেতে পারবে না। বিয়ে কী অত সহজ বলো?সবে তো চারদিন।তোমায় বিয়ে করিয়ে আনিয়েছি কী এমনি এমনি নাকি! আমি বাবা এক বাচ্চা নিয়েই এখনও ভোগছি।আর নিতে পারবো না। বাচ্চা নেয়াবো তোমায় দিয়ে।বছর বছর একটা।জ্ঞাপ দেয়া যাবে না।হি হি হি! তুমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। কোথাও না।
কাল থেকে এ বাড়ির গেটে ভেতর থেকে একটা বড় তালা ঝুলবে সব সময়। সেই তালার চাবি থাকবে আমার কাছে। আমার অনুমতি না নিয়ে কেউ গেটের বাইরে যেতে পারবে না!’
নোরা মনে মনে ভয়ংকর অশ্লীল একটা গালি দিলো দীপালিকে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললো না।
দীপালি ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,’তুমি আমায় একটা অসভ্য গালি দিয়েছো মনে মনে।জোরে গালি দেয়ার সাহস নাই নাকি?’
নোরা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে সত্যি সত্যি হাতটা বাড়িয়ে নিলো দীপালির গালে একটা শক্ত চড় বসিয়ে দিবে বলে।
কিন্তু পারলো না।
দীপালি তখন ওর হাতটা খপ করে ধরে ফেললো। তারপর বললো,’তোমার মতো সুপুরি গাছ বটগাছের বা**টাও ছিঁড়তে পারবে না। শুধু শুধু লাগতে এসো না। এরচেয়ে সহজ যা তা করো।আমায় তোমার বড় সতীন হিসেবে মেনে নেও ।বড় সতীন মানে তো বুঝোই। শাশুড়ি মায়ের চেয়েও তারে বেশি সম্মান দিতে হবে!’
নোরা রাগে ফুঁস ফুঁস করছে আর সামনের দিকে তাকাচ্ছে। ফাহাদ আসে কি না দেখছে। সারাদিন ওই গাধাটা বাইরে ছিল। এখনও আসেনি।আজ ফিরলেই ওকে জন্মের শিক্ষাটা দিবে সে!জন্মের শিক্ষাটা দিয়েই এ বাড়ি ছাড়বে তবে!’

ফাহাদ বাসায় ফিরলো রাত বারোটার দিকে।সে ফিরতেই তার সাথে নোরা কথা বলতে চাইলো। কিন্তু কথা বলতে দিলো না দীপালি।সে ফাহাদকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল অন্য একটি ঘরে। তারপর ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

#চলবে

#গোপন_কথা
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



নোরা কী করবে না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।সে অনুভব করলো তার গায়ে যেন আগুন ধরে গেছে! সেই আগুনে সে পোড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে!
সে তিশাকে ডেকে নিলো। এবং বললো,’তিশা,এসব আমার মোটেও ভালো লাগছে না।আমি আর এখানে থাকতে চাই না বোন। এক্ষুনি চলে যেতে চাই এখান থেকে।’
তিশা মুখ কুঁচকে বললো,’কীভাবে যাবে বলো? তুমি তো ফেঁসে গেছো।এখান থেকে তুমি কিছুতেই বেরুতে পারবে না।বড় ভাবী তোমায় বেরুতে দিবে না!’
‘মানে? বেরুতে দিবে না মানে কী?সে কী ডাইনি নাকি?’
তিশা আর চেপে থাকতে পারলো না।সে শব্দ করে হেসে উঠলো।
ফিরোজা বেগমও ভেতর ঘর থেকে এবার চটজলদি এলেন। এসে ওরা যে ঘরের ভেতর ঢুকেছে সেই ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বললেন,’হয়েছে। অনেক বেশি মজা হয়ে গেছে। বেশি মজা ভালো নয় কিন্তু। এবার তোরা বেড়িয়ে আয় বলছি!’
ফিরোজা বেগম কথাটা বলতেই হাট করে ভেতর থেকে দরজাটা খুলে বেড়িয়ে এলো ওরা দুজন।ফাহাদ আর দীপা।ওরা বেড়িয়ে এসে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়লো।
নোরা এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। এবার দীপাই গিয়ে ওর হাতটা ধরলো। তারপর বললো,’বোন তোমার সাথে সবাই মিলে অনেক হাসি তামাশা করে ফেলেছি। সকাল বেলা একবার সেন্সলেসও নাকি হয়েছো তুমি তিশার কাছ থেকে ওসব শোনে! আসলে ওদের কোন দোষ নাই।সবটাই আমার প্লান ছিলো। আমার প্লান মোতাবেক সব হয়েছে।সত্যি বলতে আমি তোমাদের বিয়ের দিন এখানে থাকতে পারিনি। আমার অফিস থেকে ছুটি পাইনি আসার।কারণ সেদিন বেদেশী বাইয়ার এসেছিল অফিসে। ওদের সাথে মিটিং ছিল। এরপর যখন ছুটি পেলাম সঙ্গে সঙ্গে চলে এলাম তোমায় দেখতে।বিয়ের দিনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আজ তা সুদে আসলে পুষিয়ে নিলাম। অবশ্য তোমার শাশুড়ি মানে আমার মেজো খালা এটা কিছুতেই মানতে নারাজ ছিলেন। তিনি বারবার বলছিলেন তিনি শাশুড়ি হয়ে কীভাবে পুত্রবধূর সাথে এসব মিথ্যে নাটক খেলবেন! কিন্তু আমি তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, তুমি যদি আমার কথামতো কাজ না করো তবে কিন্তু আমি আসবো না!’
ফিরোজা বেগম এবার নিজেই নোরার কাছে এগিয়ে এলেন। এসে ওকে জাপটে ধরে বললেন,’মাগো,আমারে তুমি ভুল বুইঝো না।দীপা আমার বড় বোনের মেয়ে।ওর স্বামী থাকে ইতালিতে।আর ও ঢাকায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। বিয়েতে আসার জন্য ও প্রস্তুত ছিল।ব্যাগপত্র গুছিয়ে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট পর্যন্ত অগ্রীম কেটে রেখেছিল। কিন্তু কী দূর্ভাগ্য ওর, ওইদিনই নাকি হুট করে ওর বস ফোন দিলো।বললো জরুরি মিটিং আছে। মিটিংয়ে না গেলে চাকরি থাকবে না!তাই সে চাকরি বাঁচাতে গিয়ে বিয়েটা মিস্ করলো। বিয়ের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে সে আমার কাছে আবদার করলো এসব করতে।
আমি বারবার না করেছি। কিন্তু ও শোনে না।বলে তবে সে আসবেই না আর।
অবশেষে আমি রাজি হয়েছি।
ওদের সাথে থেকে থেকে আমিও ছেলে মানুষি করেছি।আমি যা করেছি তা একটু বাড়াবাড়িই ছিল। এর জন্য তোমার মাকে তুমি লজ্জা দিও না গো মা!’
নোরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। সকাল থেকে একটা ভয় তাকে তাড়িয়ে মারছিলো। কিন্তু এটাই শুকরিয়ার বিষয় যে ওরা মজা করেছে ‌।সত্যি সত্যি এমন কিছু হয়নি।হলে সর্বনাশ হতো!
তবুও তার মন খারাপ হলো প্রচন্ড।সে বোঝেই পেলো না এটা আবার কোন ধরনের মজা! পৃথিবীতে মজার বিষয়ের কী অভাব আছে নাকি!

দীপার মিষ্টি মিষ্টি কথা আর সুন্দর আচরণে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল নোরা। কিন্তু এই মুগ্ধতা তার বেশিক্ষণ টিকলো না।দীপা আসার তিনদিন পর এক দুপুরে যখন তিশার কলেজে অভিভাবক সমাবেশে তারা মা মেয়ে চলে গেল তখন নোরা আর দীপা এক খাটে শুয়ে মজার মজার গল্প করছিলো। গল্প করতে করতে হঠাৎ নোরা ঘুমিয়ে পড়লো।আধ ঘন্টার মতো ঘুমালো সে। এবং ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় গরমে ঘামে ভিজে একসার হয়ে জেগে উঠলো নোরা। জেগে উঠে দেখে তার পাশে দীপা নেই।সে ভাবলো অন্য কোন ঘরে আছে হয়তোবা। কিন্তু সে অন্য কোন ঘরে গিয়ে যে এভাবে দীপাকে দেখতে পাবে তা কল্পনাও করেনি।সে গিয়ে দেখে ওরা হাত ধরাধরি করে খাটের উপর শুয়ে আছে।দীপা আর ফাহাদ। দীপার উড়ুর উপর একটা পা তুলে রেখেছে ফাহাদ।
দৃশ্যটা দেখে নোরার দু চোখ আঁধার হয়ে এলো।সে প্রথমে ভাবলো ভুল কিছু দেখছে। কিন্তু যখন নিজের কানেই শুনতে পেলো ফাহাদ বলছে,’দরজাটা আটকে এসো।কেউ এসে দেখে ফেলতে পারে!’
দীপা বললো,’দেখার মতো কেউ থাকলে তো দেখবে।’
ফাহাদ অবাক হয়ে বললো,’নোরা যদি চলে আসে!’
‘আরে ও ঘুমাচ্ছে। উঠবে না এখন। তাছাড়া দরজা লক করলে কেউ দেখলে সরাসরি সন্দেহ করবে। কিন্তু দরজা খোলা থাকলে কেউ কিছু ভাববে না।মিছেমিছি অনেক কিছুই বানিয়ে বলা যাবে। তাছাড়া দরজা খোলা ঘরে দুজন কাজিন থাকলে মাইন্ড করার কী আছে?কেউ তো আর সরাসরি ঘরে ঢুকে যাচ্ছে না।আর দরজা খোলা রেখে আমরা এমন কিছু করবো তা কোন বোকাও কল্পনা করতে পারবে না!’
নোরা তখন দরজা থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওখান থেকে সব শোনা যায়। সামান্য উঁকি দিলে ভেতরের সবকিছু দেখা যায়। আরেকবার সে উঁকি দিলো।ওরা আরো কাছাকাছি ঘেঁষছে। যেভাবে কামাতুর দুটি মানুষ একত্র হয়। সেভাবে।নোরা ভাবলো বিষয়টা দেখে চুপ করে থাকবে কি না। সবাই যেভাবে চুপ হয়ে থাকে।চুপ হয়ে না থেকেই বা কী করবে! মেয়েদের কী শশুর বাড়ি এসে উচ্চ বাক্য করলে চলে?তালাক ফালাকের ডর ভয় থাকে। স্বামী শাশুড়ির অত্যাচারের ভয় থাকে। তাছাড়া মান সম্মানের ব্যপার তো আছেই। কিন্তু নোরা এই মুহূর্তে অন্য কিছু ভাবছে।সে ভাবছে নিজেকে অন্য রকম কিছু।সে নিজেকে আর আটটা দশটা মেয়ের জায়গায় ভাবছে না এখন।সে জানে চুপ থেকে কাউকে অপরাধ করতে দেয়াও অপরাধ! তিনদিন আগেও যে নোরা ভেবেছিল ফাহাদকে ডিভোর্স দিবে।ওর সাথে আর সংসার করবে না। সেই নোরাই এই মুহূর্তে নিজ চোখে এসব দেখার পরেও ভাবছে ফাহাদকে সে ডিভোর্স দিবে না।ওর সাথেই সংসার করবে।কারণ আজ যদি নোরা ওকে ডিভোর্স দেয় তবে দু’দিন পর ফাহাদ অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনবে।আর সেই মেয়েও এখানে এসে স্বামীর এসব নোংরা কাজ দেখে সারা জীবন ডুকরে ডুকরে কেঁদে যাবে।এই জন্য সে ঠিক করেছে অন্য কাউকে কষ্ট পেতে সে দিবে না।সে বরং এখানে থেকে একটা রাখাল যেভাবে তার দুষ্ট গোরুকে ঠিক করে ঠিক সেভাবেই সে তার বদ স্বামীকে ঠিক করবে।প্রয়োজনে যতো কষ্ট সহ্য করতে হয় সে তা করবে। তবে কষ্ট সহ্য সে একাই করবে না। ফাহাদ কেও কষ্ট দিবে। শিক্ষা দিবে।আর সুচুতুর দীপার জীবনটাও বিষময় করে তুলবে সে। কীভাবে স্বামীর আড়ালে আবডালে পর পুরুষের সাথে উগ্র যৌনতায় মেতে উঠে তা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাইয়ে ছাড়বে।এতে তার বাঁধা আসবে।বিপত্তি আসবে।আসুক।একটা সুখের ঘর বাঁধতে আসলেই সংগ্রাম প্রয়োজন।একটা সমাজ পরিবর্তনের জন্যও প্রয়োজন কঠোর সাধনার।হতে পারে তার এই ত্যাগ তিতিক্ষা থেকে অনেকেই শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে।যে সকল নারী আজ জুলুমের শিকার হয়ে চুপ করে আছে তারা মুখ খুলবে একদিন। স্বামীকে পুজো করা ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ মেয়েগুলো স্বামীর ভুল গুলো মুখ বুজে সহ্য না করে এরপর থেকে আওয়াজ তুলবে।এ আওয়াজ একদিন পৃথিবীর প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে।সে জানে,যেদিন পৃথিবীর সকল নারী নিজেকে সম্মান দিতে জানবে, নিজেকে আর কখনো পুরুষের চেয়ে ছোট মনে করবে না ঠিক সেদিনই এ সমাজ বদলে যাবে। সেদিনই নারী তার স্বামীর অশৃঙ্খল যৌনতা মুখ বুজে আর সহ্য করবে না। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তার গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা সামান্য বকা দেয়ারও সাহস করবে না! সেদিন এ দেশের স্কুলগুলোতে ছেলে মেয়ে উভয়েই সমান সুযোগ পাবে। অংকের শিক্ষক অংক বুঝিয়ে দেয়ার নামে নারীর কাছে ঘেঁষে তার নরম পিঠে হাত রাখতে পারবে না।কলেজ ইউনিভার্সিটি গুলোতে মেয়েরা ফোঁটে থাকবে লাল টকটকে গোলাপের মতো। অটোতে,বাসে,ট্রেনে কিংবা শপিং মলের ভিড়ে কোন কামুক পুরুষ ইচ্ছে করলেই তার বুকে, পিঠে, শরীরের স্পর্শকাতর অন্য কোন জায়গায় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে পারবে না।যদি এমন কিছু করে তবে নারীও ওর গাল কষে চড় বসিয়ে দিবে।প্রয়োজনে রাস্তায় ফেলে কুকুরের মতো পেটাবে। এবং সে একা নয়, তাকে দেখে আশে পাশের সকল নারীরই এগিয়ে আসবে তাকে সাহায্য করতে।যদি এমন কিছু হয়।যদি নারীরা প্রতিবাদী হয়। তবে সব পুরুষ আপনা আপনি নারীর যথার্থ সম্মান দিবে।হোক সেটা ভয়েই।যে সমাজের মানুষ উপলব্ধি করে না। ভালোবেসে কাউকে সম্মান দেয় না।সেই সমাজ থেকে জোর করেই সম্মান আদায় করতে হবে।
নোরা তার জীবনের সংগ্রামটা এখান থেকেই শুরু করলো। অবশ্য তখন ওরা দুজন আরো কাছাকাছি। দীপার বুকের উপর গরম শ্বাস ফেলছে ফাহাদ।আর তক্ষুনি ঘরের ভেতর ঢুকে গেল নোরা। এবং গর্জন করে বলে উঠলো—–

#চলবে