চিরবন্ধু পর্ব-০২

0
75

#চিরবন্ধু
#পর্ব_২
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

একজন জাঁদরেল সেনা কর্মকর্তার ঘর যেমনটা হওয়া উচিত ছিল মনে করেছে তার কিছুই দেখতে পেল না তাসনিয়া। ভারী অগোছালো, অবিন্যস্ত আসবাবপত্র, কাপড়চোপড় ছড়ানো-ছিটানো,কয়েকটা চিপস আর চকলেটের প্যাকেট যততত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
যদি-ও বিয়েবাড়িতে এরকম হওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু বিয়ে বলে বাড়িতে মেহমান বেড়াতে এসেছে এই পার্থক্য ছাড়া অন্য কিছু সে দেখতে পায়নি সেহেতু তার মনে হয়েছে ঘরটা আগে থেকেই এমন ছিল। আসবাবপত্রে ঠাঁসা ঘর, অথচ সাজানো-গোছানো নেই। মিনির খেলনা, কাপড়চোপড়, জুতো, চুলের ক্লিপ, ফুল, চুড়ি সব সারা মেঝেতে, বিছানার উপর, ওয়ারড্রবের উপর। লোকটা কাজের ঝিয়ের উপর গর্জাতে গর্জাতে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। তাসনিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
– বিয়ে উপলক্ষে অনেক বাচ্চাকাচ্চা এসেছে। তাদের সাথে মিলে মিনি এসব করেছে। ঝি এসে গুছিয়ে দিচ্ছে। ওদের কখন বলেছি এই ঘরটা সাফ করে দিতে। যতক্ষণ গর্জে না বলি ততক্ষণ এরা কাজে হাত দেবেনা। ফাঁকিবাজের দল।

হ্যাংলা পাতলা একটা মেয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিল। সে মিনির ছোট ফুপু। কাজের ঝি-কে ফিসফিস করে কি যেন বলতেই ঝি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলো।
তাসনিয়া তা দেখে বলল,
– আমি গুছিয়ে নেব। সমস্যা নেই। বেশি সময় লাগবে না।
লোকটা রুক্ষ গলায় বলল,
– তার দরকার নেই। আপনার কাজ সেটা নয়।
লোকটা সবসময় মুখের উপর কথা বলে দেয় এটা অপছন্দ তাসনিয়ার। অবশ্য তার পছন্দের মানুষের আবার তার কাজগুলো পছন্দ হতো না। শুধু কাজ নয়, আর দশটা বাঙালি মুসলিম ঘরের মেয়ের মতো তার চলাফেরা, আচার-ব্যবহার ছিল। তুশিবের বাবা তা পছন্দ করতো না। ছোট থেকে যে শিক্ষায় তাসনিয়া বড় হয়েছে সেই শিক্ষা-সংস্কারের বাইরে গিয়ে সে তুশিবের বাবাকে ভালোবেসে সুখী হতে চেয়েছিলো। অথচ তার এখন মনে হয় জীবনের সবচাইতে বড় ভুলটা সে তখন করেছে। বাহ্যিক সৌন্দর্য বিমোহিত হয়ে সেই মানুষটি তার সাথে ঘর করলেও তার ভেতরটাকে চিনতে পারেনি, মনটাকে বুঝতে পারেনি, পুরোপুরি তাকে ভালোবেসে উঠতে পারেনি। অথচ সে সেই মানুষটির স্বভাব, আলস্যতা, ব্যবহার, দোষত্রুটি সব মানিয়ে নিয়ে ঘর করতে চেয়েছিলো। কিন্তু সব তো একার চাওয়ার উপর নির্ভর করে না। বেটার অপশন পেলে কেন এমন ঘরকুনো, লোকমুখ থেকে পালিয়ে বেড়ানো, তার চাহিদার সম্পূর্ণ বিপরীত মানুষটাকে নিয়ে বাকি জীবন সে পার করতে চাইবে? তাসনিয়া প্রথমেই ভেবেছিল সে আবারও মানিয়ে নেবে। নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করবে। সংসারটা তো অন্তত টিকবে। কিন্তু যখন দেখলো তার জায়গাটা ইতোমধ্যে অন্য একজনের কাছে স্থানান্তরিত তখন সে আর পিছু ফিরে তাকায়নি। কে যেন বলেছে, জীবনটাকে কাঁদিয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার চাইতে, হেসে উড়িয়ে দেয়া ভালো। সে দ্বিতীয়টাকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে অন্যজনের সাথে জড়িয়ে পড়বে তা কে জানতো?
বাচ্চাদের কথা বাদ দিয়ে দেখলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোফরান সিদ্দিকী আর সে একই পথের পথিক। ডিভোর্সি কাউকে বিশ্বাস করার মতো কাজ তাকে করতে হবে সে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি। গোফরান সিদ্দিকী হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মানুষ নন, তাহলে উনি কেন তা করতে গেলেন? উনার স্ত্রীর মতো সেও তো সংসারভাঙা একজন, তফাতটা কি বাচ্চা তার কাছে আছে বলে?

লোকটা অতিরিক্ত স্বেচ্ছাচারী, উদ্বত এবং দেমাকি সেটা অল্পতেই বুঝে গিয়েছিল সে। একজন সেনা কর্মকর্তারা এমন হয় কিনা সে জানে না তবে এতটাও জবরদস্ত মানুষ সে তা ভাবেনি। সকালে ঘুম খুব তাড়াতাড়ি ভেঙেছে তার। সবার সাথে ব্রেকফাস্ট শেষ করার পর হঠাৎই কান্নাকাটির শোরগোল শুনে সে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিতেই দেখলো অক্ষরজ্ঞানহীন বোকা কাজের লোকদুটো কান ধরে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে আরেক পা মাটির উপর তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভুল করে মাটিতে পা পড়লে তাদের উপর চটাস চটাস বেতের বাড়ি পড়ছে।
– আর করব না ছ্যার, বলে বাচ্চাদের মতো কেঁদে যাচ্ছে তারা।
তাসনিয়া অবাক হয়ে গেল। এমন করে কেউ মারতে পারে? কি আজব মানুষ?
তুশিব মিনির পাশে দাঁড়িয়ে কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে দেখছে। মিনির কাছে হয়ত তা নতুন নয় তাই সে হাসছে। তবে তুশিব ভারী ভয় পেয়েছে।
– আর কখনো যদি আমি ওসব শুনি জিভ কেটে সাম্ভাকে খেতে দেব।
তাসনিয়া প্রথমে বুঝতে পারেনি পরে মিনির পাশে কুকুরটাকে দেখে বুঝতে পারলো জিভ কেটে কুকুরকে খেতে দেবে বলেছে। কি আশ্চর্য! এমন কথাও মানুষ বলতে পারে?

আজ কড়া রোদ উঠেনি। সমীরণে বারান্দায় লাগানো ঝুলন্ত গাছের লতাগুলো দুলে দুলে উঠছে। হিমেল বাতাসে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে কেন যেন ভালো লাগছে। অনেকক্ষণ যাবত সে তুশিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তুশিব এখনো অবাক হয়ে কাজের লোক দুটোকে দেখে যাচ্ছে। তাসনিয়ার হাসি পেল তার মুখখানা দেখে। সুপারম্যানকে নিশ্চয়ই সে এমনটা ভাবেনি?
মিনির ছোট ফুপু ফিজা এসে দাঁড়ালো তখনি পাশে। তার বিয়ে হয়েছে ছ’মাস। মেডিক্যালে পড়ছে। ছোট ভাবি ডিভোর্স নিয়ে চলে যাওয়ার পরপরই ছোট ভাইয়া ভীষণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন মিনিকে নিয়ে। তাই তখন তার প্রেমের সম্পর্কটা মানাতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। তবে আরিবের চাকরি হওয়ার আগপর্যন্ত তাকে ওই বাড়িতে পাঠাবে না ভাইয়া। যদিও শ্বশুরবাড়িতে তার যাতায়াত আছে, আরিবও আসে মাঝেমধ্যে। ভাইয়াকে সে সঙ্কোচ করে বিধায় কম আসতে চায় এই বাড়িতে।
তাসনিয়ার সাথে বিয়ের আগে তার দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা কিছুই হয়নি। এমনকি বিয়ের দিনও পরিচয় হয়নি। ভাইয়া বলেছে বাড়িতে এলে তখন পরিচয় হওয়া যাবে। অত বেশি ভাবসাবের দরকার নেই। কারণ মিনির মায়ের সাথেও তার অনেক ভাবসাব ছিল। তারা পূর্ব পরিচিত আত্মীয় ছিল সেই হিসেবে অনেক মিশুক ছিল। কিন্তু এমন একটা দিন তাদের দেখতে হবে এটা তারা কেউই কল্পনা করতে পারেনি। তাসনিয়াকে প্রথম দেখায় তার মনে হয়েছিলো ভাইয়ার মতোই গম্ভীর-সম্ভীর। বোধহয় কথাটথা বলতে ভালোবাসেনা। কিন্তু পরে তার ভুল ভেঙে গেল। তাসনিয়ারও তাকে অল্পতেই ভালো লেগে গেছে। সে পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। মিনিকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মিনিকে সেও সামলাতে পারেনা যখন তার কান্নার তাল উঠে। তার মতে মিনি অনেকটা তার মায়ের মতো জেদী, একগুঁয়ে স্বভাব পেয়েছে। মা সেদিন ভুল করে বলে ফেলায় মায়ের উপর বেশ চটে গিয়েছিলো ছোট ভাইয়া। বলেছিল, তার মেয়ে তার মতো হয়েছে। কোনো মহিলার মতো নয়।

তাসনিয়াকে রতন আর বদি ভাইয়ের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাতে দেখে ফিজার মনে হলো ছোট ভাবি বোধহয় ভাবছে কেন এভাবে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তাসনিয়াকে সেটা বলতেই তাসনিয়া বললো,
– হ্যা সেটাই ভাবছি।
ফিজা বললো, ওরা সপ্তাহে দুই-তিন দিন এরকম মার খায় তারপরও শোধরায় না। মিনির সামনে একে অপরের সাথে ঝগড়া করে, মারামারি করে তারপর যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করে। মিনিও সেসব শুনে মুখে মুখে আওড়ায়। সেদিন তো বলে ফেলেছিলো বাবা বদি কাকা রতন কাকাকে বাইনচোদ বলে ডেকেছে। ভাইয়া খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে তাদের ডেকে এনে সারাবাড়ি দৌড়ে দৌড়ে পিটিয়েছিলো। কিন্তু তারা তারপরও শোধরাবে না। এই যে মার খাচ্ছে, দেখবে মার খাওয়ার পর ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবারও দুজন ঝগড়া করবে।
তাসনিয়া বলল
– সাংঘাতিক। একটু সাবধানে থাকলে তো হয়। এত মার খেতে হয় না।
ফিজা হেসে বলল,
– ওরা এমনই। জীবনেও শোধরাবে না।
– ওদের ঝগড়া কি নিয়ে।
– কাজ নিয়ে হয়। ভাইয়ার মতে ওরা দুজনেই ফাঁকিবাজ। তুমি নীচে চলো। মা ঘুম থেকে উঠে গেছে। তোমার সাথে দেখা করতে চাইলো।
তাসনিয়া বলল
– হ্যা যাচ্ছি। চলো।

তাসনিয়ার শ্বাশুড়ি বহুদিন ধরে শয্যাশায়ী। মাথার যন্ত্রণায় দিনের বেশিরভাগ সময় উনার বিছানায় কাটেন। আগে একটু কমবেশি হাঁটাচলা করতে পারলেও এ কয়েকমাসে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। মনের জোর হারিয়ে ফেললে শরীর আর কতক্ষণ? ছেলেমেয়ে শান্তিতে থাকলে মায়েরাও ভালো থাকে।
উনার কথাবার্তা অনেক মার্জিত রুচির পরিচয় বহন করে। বুঝাই যায় উনি শিক্ষিত মহিলা।
তাসনিয়াকে বললো, ও ঢাকা সেনানিবাসে কিংবা বর্ডারে গেলে মিনিকে কেউ সামলে রাখতে পারেনা। দিনের বেলা বদি আর রতনের সাথে খেলায় মেতে থাকলেও রাতের বেলা তো বাবা মাকে খুঁজে। অত ছোট বাচ্চাকে কে বুঝ দেবে? ওর কান্না শুনতে শুনতে আমি আরও অসুস্থ হয়ে গেলাম মনে হচ্ছে। এতদিন পর ও বিয়ে করতে রাজী হবে, আবার সাথে সাথে বউও নিয়ে আসবে তা আমি প্রথমে বিশ্বাসই করে উঠতে পারিনি। আমি যে কত শান্তি পেলাম বলে বুঝাতে পারব না বৌমা। ও তোমার সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেনি আমাদের। জানতে চাইলে বললো, মিনির দেখভাল করবে সেখানে তোমরা তার জীবনবৃত্তান্ত দিয়ে কি করবে? তোমাকে যেন ওইসব ব্যাপারে জিজ্ঞেসও না করি সেটাও বারণ করে দিল।
তুমি না বলতে চাইলে কিচ্ছু বলো না কিন্তু আমি কয়েকটা কথা তোমাকে বলি। ও ওর বাবার মতো হয়েছে। ওর বাবা তখনকার বাঙালি পুরুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করে কাছ থেকে মৃত্যু দেখে বেঁচেফেরা মানুষ। মেজাজি ছিলেন বটে। কথাবার্তা, ছালছলন দেখে মানুষ বিচার করতেন। খাবার-দাবারের ব্যাপারে অনেক বাছবিচার ছিল। বাড়ির মহিলারা উঁচু গলায় কথা বললে তা উনার পছন্দ ছিল না কোনোকালেই। গোফরান ওর বাবার স্বভাব পেলেও অতটা কঠিন ছিল না। নারী স্বাধীনতার ব্যাপারেও ও যথেষ্ট সচেতন। কারণ ওর অনেক সহকর্মী আছে যারা নারীও হয়ে দেশের অবদানে কাজ করে যাচ্ছে। দেখো বৌমা স্বাধীনতার সুষ্ঠু ব্যবহার আর অপব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য যারা বুঝেনা তারা সস্তা ফেমিনিস্ট। আমি স্বাধীনতা পেলাম বলে আমার স্বামী সন্তান থাকতেও আমার উচ্চশিক্ষার কোথাও শুধু স্বামীকে সন্তুষ্ট করে যেতে হবে কথাটা না থাকায় আমি চাইলেই মধুবাসে যেতে পারি, মধুসুধা পান করে কলিগদের কাঁধে ঢলে ঢলে বাড়ি ফিরতে পারি। আর ওদিকে আমার স্বামী জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে ফিরে আমার সন্তানকে দোলনায় একা একা কাঁদতে দেখবে! এটা কোন ধরণের নারী স্বাধীনতা তুমি বলতে পারো?
গোফরানকে এটাই অনেকদিন বিশ্বাস করানো গেল না যে তোর বউ এইসব এইসব করছে। যখন সে নিজেই সব প্রমাণ পেল তখন আসল ধাক্কাটা খেল। ও তো সাংসারিক কূটকচালে বিশ্বাস করতো না। তাই নিজের মাকে বিশ্বাস না করে বউয়ের কথা বিশ্বাস করতো। হয়ত ও ইচ্ছে করেই সুযোগটা দিত যাতে ও শোধরায়। তোমার শ্বশুর প্রচন্ড উদ্ধত রাজনীতিবিদ ছিলেন তারপরও উনি আমাকে ব্রাক স্কুলে পড়াতে যেতে নিষেধ করেননি কখনো। বরঞ্চ উনি আমাকে নিয়ে গর্ব করতেন এই বলে আমি সমান তালে ঘরে বাইরে সামলাচ্ছি। মেয়েরা চাইলেই সমাজটাকে সুন্দর করতে পারে, আবার একটা মেয়েই একটা সমাজের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ মিনির পাশাপাশি মিনির বাবার ভালোমন্দগুলোও বুঝে নিও মা।
তাসনিয়া মন দিয়ে কথাগুলো শুনলো তবে কিছু বললো না। তুশিবের দাদুও তাকে বুঝতো। কিন্তু তিনি তুশিবের পাঁচ বছর বয়সে মারা গেলেন। তুশিব তার দাদুকে অনেক ভালোবাসতো। এখন সে আবারও একটা দাদু পেল। মাবিয়া বেগমের সাথে তুশিবের অল্পতেই খুব ভালো জমে গিয়েছে।

———–

সন্ধ্যায় আলতাফ সাহেব এলেন তাসনিয়ার মামা খালু, ফুপু, ফুপাদের নিয়ে। ফুপু জানালো তোর বাবাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। একা একা ওই বাড়িতে কি করবে। আমার সাথে গেলে তোর ফুপার সাথে থাকবে। এখানে একা একা থাকতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুই ভালো থাক। তোর বাপকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তাসনিয়ার চিন্তা অনেকটা কমে এল। রোড এক্সিডেন্টে ভাইয়া চলে যাওয়ার পর মাও দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল আর তার বছর খানেকের মাথায় তার বিবাহবিচ্ছেদ। কত ঝড়-তুফান বয়ে গেল মানুষটার উপর দিয়ে। মানুষটার সুখের জন্য সে কিছু করতে পারেনি।

তুশিব আর মিনির খুব ভাব জমেছে। একসাথে খেলছে দুজন। মিনির কাছে তার বাবা, আর তুশিবের কাছে ওর মা-ই সেরা এই ধরণের কথাবার্তা চলছিলো দুজনের মধ্যে। ওর মাকে ও নেবে, ওর বাবাকে ও নেবে এমন ভাগাভাগিও চলছিলো। তাসনিয়া দূর থেকে দুজনকে দেখছিলো। অনেকদিন পর তুশিবের চোখেমুখে সে খুশি দেখেছে। রতন আর বদি ওদের দুজনকে পিঠের উপর তুলে হামাগুড়ি দিচ্ছিলো আর তারা দুজন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলো। ঠিক তখনি ঝি ময়না এসে বলল,
– ছোট ভাবী ছোট ভাইজান ডাকছেন। আমি বাবুদের নিয়ে আসছি। উনি বোধহয় বেরোচ্ছেন।
তাসনিয়া মাথা নেড়ে বলল,
– হ্যা যাচ্ছি।
সে ঘরে গেল রণপায়ে হেঁটে। দেখলো গোফরান সিদ্দিকী ইউনিফর্ম পড়ে ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছেন। তাসনিয়াকে দেখামাত্রই সামরিক ইউনিফর্ম টুপিটা হাতে নিয়ে বলল,
– আমি বেরোচ্ছি। আমার ফিরতে রাত হবে। মিনিকে দেখে রাখবেন। আর আপনার যা যা প্রয়োজন তা ফিজাকে বলে দেবেন। আর কিছু… আপাতত মনে পড়ছেনা। পড়লে আপনাকে ফোনে জানিয়ে দেব।
তাসনিয়া মাথা নাড়লো।
সবটা বলেই বেরোতে যাচ্ছিলো গোফরান সিদ্দিকী। মিনি ছুটে এসে উনার পা আঁকড়ে ধরলো বাবা ডেকে। তাকে কোলে তুলে গালে আদর করলেন উনি। তারপর নামিয়ে দিয়ে বললেন,
– দুষ্টুমি করবেনা। একা একা বাইরে যাবে না। রতন আর বদি গালাগালি করলে তা নোট করে রাখবে। নোট কীভাবে রাখে মনে আছে তো।
মিনি আঙুল দেখিয়ে বলল,
– এক, দুই।
– গুড। বাই।
– টা টা বাবা।
উনি দরজার বাইরে পা রাখতে যাবেন ঠিক তখনি সামনে তুশিব এসে দাঁড়ালো। মাথায় টুপিটি পড়ে তুশিবের দিকে তাকিয়ে ভুরু দুটো নাচালেন তিনি। তুশিব হা করে চেয়ে রইলো। এইতো সেই সুপারম্যান!
উত্তেজিত হয়ে পড়লো সে। শুকনো ঢোক গিললো। সুপারম্যানের কাছে বন্দুক আছে নিশ্চয়ই? দুষ্টু লোকদের খুব মারে বুঝি? বাবার মতো দুষ্টু লোকদেরও মারে?
তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে তার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে সোজা চলে গেলেন উনি। তুশিব আজও কষ্ট পেল উনি কোনো কথা না বলায়। তারপর হঠাৎ কি মনে করে দৌড় দিল পিছুপিছু। মিনিও তার পিছুপিছু দৌড়ে গেল। তাসনিয়া বলল,
– কি করছো। পড়ে যাবে তো। খোকন‌!
কেউ কারো কথা শুনলো না। তাসনিয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। গোফরান সিদ্দিকী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই তুশিব খপ করে উনার আঙুল ধরে ফেললো। চোখ নামাতেই তুশিবকে দেখে উনি কপাল ভাঁজ করলেন। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললেন,
– ফিরে এসে কথা হবে।
তুশিব কি বুঝলো কে জানে। ভীষণ চমৎকার হাসলো। তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ছোট্ট করে বলল,
– তুমি সুপারম্যান? আমার মায়ের দুঃখ কমিয়ে দেবে?
গোফরান সিদ্দিকী তার কথা শুনে কি প্রতিক্রিয়া দেবে ভুলে গেল। হাঁটুভেঙে খানিকটা নীচু হয়ে ফিসফিস করে বলল,
– যদি তুমি জুবরান হও।
তুশিব হেসে বলল,
– আমি জুবরান?
– ইয়েস।
– আমি জুবরান হলে তুমি মায়ের কষ্ট কমিয়ে দেবে?
– তোমার মা মহীয়সী নারী। তার কোনো কষ্ট নেই।
তুশিব বলল
– তোমারও কষ্ট নেই?
গোফরান সিদ্দিকী মাথা তুলে বারান্দায় পেঁয়াজি রঙের শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাসনিয়ার দিকে তাকালো। তাসনিয়া তখন আকাশ দেখছিলো। মুক্ত আকাশ!

____________

মিনিকে রাতের খাবার খাওয়াতে বেগ পেতে হয়। তখন তার কান্না শুরু হয়। প্রতিরাতে এটা নিয়ে অশান্তি লেগে থাকতো বাড়িতে। গোফরান সিদ্দিকী ছাড়া তখন কেউ তাকে শান্ত করাতে পারতো না। এমনও অনেকবার হয়েছে সে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। গোফরান সিদ্দিকীর সেনানিবাস পোস্টিং যেহেতু বেশি দূরে নয় তাই তিনি রাত করে ফিরে আসতে পারেন। আর তখন এসে তিনি মিনিকে জাগিয়ে তুলে ভাত খাওয়ান। মিনি তারপর আর ঘুমাতে চায় না। এদিকে গোফরান সিদ্দিকীর চোখে ঘুম চেপে বসে। তিনি ঘুমিয়ে গেলে মিনি আবারও কান্না্কাটি শুরু করে দেয়। এ যাবত এমন-ই হচ্ছিলো । এখন তার ব্যতিক্রম। তুশিবকে খাওয়ানোর সময় মিনিও তাসনিয়ার হাতে খেয়ে নিল। মা ডাকার অনুমতি পাওয়ায় আজ তার আনন্দ দেখে কে? সেই খুশিতে তুশিবকে বলল,
– তুমি আমার বাবাকে বাবা ডেকো। কেমন?
তুশিব বলল
– না। বাবারা খারাপ হয়। তোমার বাবা আমার সুপারম্যান। সুপারম্যানরা বাবার মতো হয় না।
মিনি কি বুঝেছিলো কে জানে। গালে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
– আমার মাও খারাপ কিন্তু তোমার মা খুব ভালো। তোমার বাবা খারাপ কিন্তু আমার বাবা খুব ভালো।
তাদের খাওয়াতে খাওয়াতে চুপচাপ তাদের কথা শুনছিলো তাসনিয়া। মিনি জানতে চাইলো,
– এই মা তুমি আমার বাবার বন্ধু হবে? আমার বাবা তোমার মতো ভালো।
তাসনিয়া বলল, – আমরা সবাই বন্ধু। এখন চুপচাপ খান।
দুজনেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

রাতে সবাইকে বেড়ে খাওয়ালো তাসনিয়া। তার ভাসুর মঈনুল সিদ্দিকী বললেন,
– বুঝলে ছোটবৌ অশান্তি আর অশান্তির চোটে পেটপুরে খাওয়াদাওয়া ভুলে গিয়েছি। আজ অনেকদিন পর মনের শান্তিতে খাচ্ছি। বাড়ির সবাই ভালো না থাকলে কি ভালো থাকা যায়? মেয়েটা সারাক্ষণ কাঁদে আর কাঁদে। কেউ থামাতে পারে না। দেখো আজ সারাদিন একটুও কাঁদেনি। কত শান্তি লাগছে। আজ পেটপুরে খেয়ে শান্তির ঘুম দেব।

তাসনিয়া মৃদু হাসার চেষ্টা করলো। বলল,
– বেশি করে খান।
– হ্যা হ্যা খাচ্ছি। একটাই তো জীবন। এই সংক্ষিপ্ত জীবনটাকে খেয়েদেয়ে নেচেকুদে উপভোগ করা উচিত। কি বলো আপা?
মিনির বড় ফুপুর বয়স হচ্ছে। তিনি বললেন,
– হ্যা । শোনো ছোটবৌ হাসিখুশি থাকবে সবসময়। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছার কথা গোফরানকে জানিয়ে দেবে। দুজনের মতের অমিল হলে ঠান্ডা মাথায় ভেবে সিদ্ধান্ত নেবে। তুমি তো নাকি চাকরি বাকরি করো। ওর রাঙামাটি সেনানিবাসে পোস্টিং হলে তখন কি করবে ভেবেছ?
– জ্বি না।
– ভাবো। ওর সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নাও।
মঈন সাহেব বললেন
– কথা বলো, বেশি বেশি করে কথা বলো। কথা বলা দরকার। একটা সম্পর্কে কথার উপর সব নির্ভর করে। ছেলেমেয়ে গুলোকে নিয়ে ভালো থাকো। খুব সুখী হও। বাকিসব ভুলে যাও। ফিজা বলল,
– সব তো সমাধান হলো। এবার আমাকে ওই বাড়ি পাঠিয়ে দাও। আরিবের ওখানে রেঁধেবেড়ে খেতে কষ্ট হয়। ওর মা বাবা সবাই ইন্ডিয়া চলে গিয়েছে।
বড় বোন তার মাথায় চাটি মেরে বলল,
– বেয়াদব। মুখে কিছু আটকায় না। গোফরান আসুক ওকে সব বলব। দাঁড়া।
ফিজা মুখ গোমড়া করে খেতে লাগলো।
বড়ভাবি হাসলো তাদের কথা শুনে। বলল,
– বরের জন্য বেচারির মন পুড়ছে বুঝায় যাচ্ছে। মাকে বলব ছোট ভাইকে যেন বুঝিয়ে বলে। বিয়ে যখন হয়ে গেছে যাদের বউ তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া ভালো। কি খাওয়াবে পড়াবে ওসব ওদের ব্যাপার।
ফিজা বলল
– একদম ঠিক। তোমাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে বড় ভাবি।
মঈন সাহেব তার মাথায় চাটি মেরে বলল,
– তুই দেখছি মহা বেয়াদব।
তাসনিয়ার খুব ভালো লাগলো পরিবারটাকে। বিশেষ করে তার ভাসুরকে। খুব অমায়িক মানুষ উনি।

গোফরানের সাথে খাবে বলে কেউ তাকে খেয়ে নিতে বলেনি। এদিকে গোফরান যখন ফিরলো তখন দেখতে পেল বই পড়তে পড়তে সোফায় হেলান দিয়ে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে তাসনিয়া। এসব তার পছন্দ নয়। টিপিক্যাল বাঙালি নারীদের অনেক স্বভাব তার পছন্দ নয়। কেন স্বামীর অপেক্ষায় তাদেরকে রাত জেগে বসে থাকতে হবে খাবার নিয়ে? আর তাসনিয়া তানজিম কেনই বা তার জন্য বসে থাকবে? এমন তো কথা ছিল না। তার শুধু মিনির প্রতি যত্নবান হওয়ার কথা। তাই সে তাসনিয়াকে না বলে বাড়ির সবাইকে একথা বলে দিল। যাতে সবাই উনাকে নিয়ে রাতের খাবারটা খায়। সেনানিবাস থেকে ফিরে সে নিজেই বেড়ে খেতে পারবে। তাছাড়া তাদের কোনো অপারেশন পড়লে দুর্গম প্রান্তে তাদের নিজেদেরকেই রেঁধে খেতে হয়।
বিষয়টা বুঝতে পেরে তাসনিয়া নিজেও খুশি হলো। একটা বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়াও তাদের মধ্যে এমন দু একটা বোঝাপড়া মাঝেমধ্যে গড়ে উঠছিলো একটু একটু করে। মিনির আকীকা করা হয়নি। সাথে জুবরানের আকীকাটাও সম্পন্ন হলো কয়েকদিনের মধ্যে। তাসনিয়ার বাবা এসেছিলো আকীকায়। জুবরান নামটা সবার অনেক পছন্দ হয়েছে। তাসনিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না কারণ সে তুশিবকে সবসময় খোকন বলে ডাকে। তুশিব নামটা দিয়েছিলো তার বাবা।

এখন সে জুবরান সিদ্দিকী। সিদ্দিক পরিবারের একটা অংশ। মিনির সাথে মায়ের একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলেও তার সাথে গোফরান সিদ্দিকীর সম্পর্কটার কোনো নাম নেই। মিনি আজকাল মাকে ছাড়া একটা মুহূর্তও চলতে পারে না। তাসনিয়া তাকে আদর করে, বকে, শাসন করে কিন্তু অপরদিকে গোফরান সিদ্দিকীর পক্ষ থেকে সেসব কিছুই নেই। তিনি গম্ভীর হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন, সামনাসামনি পড়ে গেলে চুলগুলো ঘেঁটে দেন, তার জন্য সদ্য কেনা সাইকেলটি দক্ষ হাতে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারলে দূরে দাঁড়িয়ে হাত তালি দেন, মর্নিং ওয়াকের সময় দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে আগ বাড়িয়ে তুলতে আসেন না, বরং সে নিজে নিজে উঠে দাঁড়ালে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে থামস আপ দেন। সে ব্যাথা পেলে হাঁটুভেঙে তার সামনে বসে ধূলো ঝেড়ে দিয়ে বলেন, ছেলেদের কাঁদতে নেই ম্যান।
সে তখন আর কাঁদেনা। গোফরান সিদ্দিকীর কঠিন মুখটা কাছ থেকে মনভরে দেখে নেয়।
সিদ্দিক বাড়িতে প্রথম পা দেওয়া তুশিব আর এখনকার জুবরানের এখন একটাই পার্থক্য। আগের তুশিবের কাছে গোফরান সিদ্দিকী একজন দূর হতে দেখা গম্ভীর কঠিন মানুষ হলেও এখনকার জুবরান সিদ্দিকীর কাছে গোফরান সিদ্দিকী একটা অশেষ মুগ্ধতার নাম। হয়ত এই মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে ভালোবাসায়ও রূপ নিয়েছে।
তাসনিয়াও জানে তার প্রতি মিনির ভালোবাসাটা খুবই সহজাত। বাচ্চা মেয়েরা সবসময় যত্ন চায়।
আদর ও শাসনের ফাঁকে ফাঁকে মেয়েদের চুলে বিনুনি করে দিলেও তাদের ভালোবাসা পাওয়া যায়, মুখে তুলে খাইয়ে দিলে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলে, সুন্দর করে সাজিয়ে কপালে ছোট্ট একটা টিপ পড়িয়ে দিলে, হাত ভর্তি চুড়ি আর পায়ে একজোড়া নুপুর পড়িয়ে দিলে, হাতেপায়ে আলতা মেহেন্দী পড়িয়ে দিলে মা না হয়েও ধীরেধীরে মা হয়ে উঠা যায়। কিন্তু পুরুষ মানুষের দ্বারা তা কঠিন। গোফরান সিদ্দিকীর আবেগময় ভালোবাসা পেলেও তুশিবের তাকে বাবা বলে মেনে নিতে কষ্ট হতো। বাবারা খারাপ এই ধারণা থেকে তাকে বের করতে শুধু মিনির মতো আদর ভালোবাসা যথেষ্ট নয়। তাদের বুঝার ধরণ আলাদা, অনুভব আর উপলব্ধির ধরণ ভিন্ন। এখন সে গোফরান সিদ্দিকীর সাথে অনায়াসে তার জন্মদাতা বাবার পার্থক্য করতে পারে।

আর রইলো তাসনিয়া তানজিম আর গোফরান সিদ্দিকীর মধ্যেকার সম্পর্কের কথা।
হাজারো যুদ্ধ-বিগ্রহের বেড়িবাঁধ ভেঙে বুদ্ধিদীপ্ত রণকৌশল দ্বারা যে নিত্যনতুন কাব্য রচনা করে সেই মিলিটারি কর্নেলের শক্ত হাতের মুঠোয় আগলে রাখা রাইফেল, কামানের মতো বড় বড় অস্ত্রের মধ্যে থেকে যখন আঙুলের ফাঁক দিয়ে হ্যান্ড গ্রেনেডের মতো তুচ্ছ বস্তু ছুটে গিয়ে অবলীলায় সব শেষ করে দেয়, ঠিক তেমনিভাবে বীরের যত্নে গড়ে তোলা সংসারটাও এমন একটা হ্যান্ড গ্রেনেডের মতো বস্তু আচমকা ছুটে এসে সংসার, বিশ্বাস, সব মন থেকে জ্বালিয়েপুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছিলো। সেখানে সহজাত ঔদার্যবোধ নমনীয়তা যার রক্তে মিশে ছিল, বিনয়ী বাঙালি পরিবারের সেই ঘরভাঙা মেয়েটির সাথে কিভাবে তার আবার নূতন কাব্য রচনা হতো? মানুষের জীবনে প্রথম বসন্ত যখন আসে তখন সব ভালো লাগে। যেমন হিমেল বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়তে থাকা উড়োপাতার ঢেউ। কৃষ্ণচূড়ার লাল। কোকিলের গান।
আর তারপর একসময় বসন্তের কোকিলকেও অসহ্য ঠেকে, তখন উড়োপাতার ঢেউ এসে মিশে যায় ধূলিমাখা ঝড়াপাতাদের দলে। সেই ঝড়াপাতায় আর অসহনীয় কোকিলের ডাকে ভালোবাসার রং, রূপ, গন্ধ খুঁজতে যায় কে?
দুজন মানুষকে চেনা ভারী সহজ। আর জানা? সে তো দরজা বন্ধ করে পাশাপাশি দুটো শরীরের মিলনেও সম্ভব হয় না।

সেখানে ফের বিশ্বাসে আঘাত লাগবে, যেটুকু সম্মান, শ্রদ্ধা বিদ্যমান তা নষ্ট হবে ভেবে দুজন দুজনের কাছ থেকে লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকলে, কানামাছি খেলতে গিয়ে চোখে বাঁধা পট্টির ফাঁকে তাকে দেখেও না দেখার ভান ধরে অন্ধ সেজে থাকলে ভালোবাসা ধরা দেবে কিরূপে?
মাঝেমধ্যে দু-জনেই হঠাৎ চমকে যায় নিজেদের ভেতর সেই ভালোবাসা নামক বিষবৃক্ষটিকে টের পেয়ে। এটিকে বাড়তে দেয়া চলবে না, তবু সেটি বেড়ে উঠে, তবু শিকড় বহুদূর গেঁড়ে যায়, তবুও ভালোবাসা আসে, তবুও ভালোবাসা হয়।

রাঙামাটির সেনানিবাসে আসার পর পাহাড়ি একটা বাড়ির বারান্দায় মুখোমুখি বসে গরম পানি পড়ে পুড়ে যাওয়া তাসনিয়ার হাতে দুটো পুরুষালী হাত যখন ধীরেধীরে মলম মালিশ করে সংযম আর যত্নবান মানুষের পরিচয় দিচ্ছিলো ঠিক তখন অস্তিত্বটা দুজনেই নিজেদের ভেতর টের পেয়েছিলো।
অবশ্য, লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোফরান সিদ্দিকীর মতে, ভালোবাসায় দোষ নেই। দোষ যত বাসাবাসীদের। সে আবারও দোষী হতে যাবে কোন দুঃখে?

চলমান……